নিজ পারসেপশনের ফাঁদে নিজেই আটকে পড়া
গৌতম দাস
০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০৬ সোমবার
অবশেষে আসামের নাগরিকত্ব যাচাই প্রক্রিয়া এনআরসির নামে জেনো-ফোবিয়া [Xenophobia] বা বিদেশিবিদ্বেষ ব্যর্থ হয়ে থেমেছে। কোন যাচাই প্রমাণ ছাড়াই বিদেশিরাই আসামের দুঃখের কারণ – এই ছিল তাঁদের খুবই শক্ত এক অনুমান। সব জিনিষ নিয়ে আন্দাজি কথা বলা যায় না, খুবই বিপদজনক আত্মঘাতি হয়ে যেতে পারে তা। আসামের এনআরসি [NRC, National Register of Citizens] তাই প্রমাণ করল। আন্দাজে বলা কথা, মানে যা প্রমাণ হয় নাই অথচ দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে গেছে এবং তা পপুলার ধারণা – একেই বলে পারসেপশন [Perception]। বাস্তবে প্রমাণ করা বা প্রমাণ পাবার আগেই সারা অসমিয়দের [Assamese] এক দৃঢ় ধারণা, পারসেপশন চলে আসছে সেই 1951 সাল থেকে যে, বিদেশিরাই আসামের দুঃখের কারণ। যে বিদেশি বলতে তারা বুঝাত কথিত বাংলাদেশ থেকে আসা বাঙালি, আর যেটাকে বিজেপির কল্যাণে ২০১৬ সালের পর থেকে হয়ে গেছিল বাঙালাদেশি মুসলমান। আজ সেই মনে মনে মিঠাই খাওয়ার সুখ – সেই পারসেপশন হয়ে উঠেছে নিজেরই গলার দড়ি। আসামের এনআরসি অবশেষে প্রায় ১৯ লাখ লোকের নাগরিকত্ব নাই করে দিতে পেরেছে।
ভারতে ইংরাজিতে প্রকাশিত ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস নামে পত্রিকা আছে। ওর এক বাংলা ভার্সান আছে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা। সেখানে একটা রিপোর্টের শিরোনাম হল, –‘হিন্দু বিরোধী এনআরসি’, বিজেপি বিধায়ক-সাংসদদের পদত্যাগ দাবি বরাকের হিন্দু সংগঠনের। অর্থাৎ নাগরিকত্ব হারানো ভুক্তভোগী বা তাদের বন্ধুরা এখন তাদের প্রাণের এনআরসি কে নিজেরাই “হিন্দুবিরোধী” বলছে। শুধু তাই না, ঐ রিপোর্টের প্রথম বাক্য হল, “এনআরসি তালিকা থেকে বাদপড়া ১৯ লক্ষের মধ্যে ১১ লক্ষ হিন্দু রয়েছেন তাই এই তালিকাটি ত্রুটিপূর্ণ”। আর ভিতরে লিখেছে, “……সারা আসাম বাঙালি হিন্দু এসোসিয়েশনের সভাপতি বাসুদেব শর্মা বলেন, ১৯ লক্ষের মধ্যে মাত্র ছয় লক্ষ মুসলমান এবং এর দ্বিগুণ হিন্দু রয়েছেন”। তাই এনিয়ে এলাকার লোকেরা এখন তাদের সংসদদেরকে দায়ী অভিযুক্ত করছেন। লিখেছে, “শনিবার সকালে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পর রাজ্যের অর্থমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা, বিজেপির সভাপতি রঞ্জিত দাস, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কবীন্দ্র পুরকায়স্থ-সহ বিভিন্ন নেতারা এর বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন”। এজন্যই কী প্রবাদে বলে অন্যের জন্য গর্ত খুড়ে রাখলে তাতে ঐ গর্তে নিজের পড়ারই সম্ভাবনা তৈরি হয়! এনআরসি আজ বুমেরাং সেই প্রশ্ন উঠে গেছে!
শুধু তাই না আসাম বিজেপি এখন এমনই কোনঠাসা যে মানুষের এই গালমন্দ ক্ষোভ যেন পত্রিকায় রিপোর্টেড হয়ে আরও সামাজিক আলোচনা বা সোসাল মিডিয়ায় চর্চায় না বাড়তে পারে তাই “আসামকে প্রটেক্টেড এরিয়া” ঘোষণা করা হয়েছে। এর সুবিধা হল, প্রোটেক্টেড এরিয়া ক্যাটেগরির অন্তর্গত এলাকায় সংবাদমাধ্যমের বিচরণে বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়। বিদেশ থেকে আসা কোনও সাংবাদিক বিনা অনুমতিতে এই এলাকায় প্রবেশ করতে পারে না।
ওদিকে, প্রতীক হাজেলা [Prateek Hajela]। আসামের সব পক্ষ এখন দোষী করার মত এক ব্যক্তিত্ব পেয়ে বেঁচে গেছে। সবাই একমাত্র তাকেই দায়ী করে, সব দোষ তার মাথায় ঢেলে দিয়ে নিজ নিজ হাত-পা ধুয়ে নিতে চাচ্ছে। আসামের নাগরিকত্ব যাচাই প্রক্রিয়া এনআরসির বাস্তবায়নে প্রধান আমলা, এই ব্যক্তিত্বের নাম প্রতীক হাজেলা। আমাদের বিসিএসের মত প্রশাসনিক ক্যাডার অফিসার, যদিও মধ্যপ্রদেশের এক আইটি গ্র্যাজুয়েট তিনি। ২০১৩ সালে তিনি ছিলেন আসাম রাজ্য সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব। সে সময়ের আদালত নিজের তত্ত্বাবধানে হবু এনআরসি শুরু করতে চেয়ে এর জন্য প্রধান আমলা কে হতে পারেন, এমন সম্ভাব্য নামের প্রস্তাব দিতে বললে তৎকালীন কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগোই, প্রতীক হাজেলার নামই প্রস্তাব করেছিলেন।
ভারতের আসাম রাজ্য, যার আরও সারা উত্তরের বাদিকের নিরীহ ভুটানকে বাদ দিলে বাকিটা চীনা সীমান্ত আর দক্ষিণ দিকে বাংলাদেশ সীমান্ত, এভাবে পুরানা আসাম চিপায় পড়া এক ভূখণ্ড মাত্র। যার কেবল পশ্চিম দিকে এক ছোট্ট কোনা দিয়ে শিলিগুড়ি হয়ে সে পশ্চিমবঙ্গ মানে মূল ভূখণ্ড ভারতের সাথে যুক্ত হয়ে আছে। ভারতের পলিটিক্যাল এলিট এই অঞ্চলটা নর্থ-ইস্ট বলতে ভালবাসে। বাংলায় কেউ কেউ সাত ভাই বলে। আসলে ভারত স্বাধীনের পর থেকে নর্থ-ইস্ট বলতে পুরা আসাম প্রদেশ আর ততসংলগ্ন কিছু ট্রাইবাল এরিয়া আর প্রাক্তন কিছু প্রিন্সলি স্টেট এলাকাকে মিলিয়ে বুঝাত। পরে বিভিন্ন সময়ে (১৯৬৩ সালে নাগাল্যান্ড আলাদা হওয়া থেকে সর্বশেষ সম্ভবত ১৯৮৭ সালে অরুণাচলের আলাদা রাজ্য হওয়া ) সেই মূল আসামকে ভেঙে সাতটা ছোট ছোট নতুন রাজ্যের জন্ম দেয়া হয়েছে। এভাবে সব মিলিয়ে সাত ভাই হল – Arunachal Pradesh, Assam, Meghalaya, Manipur, Mizoram, Nagaland and Tripura।
চীন ১৯৬২ সালের ভারত আক্রমণ করেছিল। কথিত আছে, চীনের অভিযোগ ছিল নেহরুর ভারত আমেরিকার প্ররোচনায় সীমান্তে সিআইএ তৎপরতা চালাতে দিয়েছিল, যা মূলত ছিল চীনের উপর গোয়েন্দাগিরির কাজ। এ ছাড়া ভারত-চীন সীমান্তের এ দিকটায় বহু অংশই পুরানা সেই কলোনি আমল থেকেই বিতর্কিত সীমানার, অর্থাৎ উভয় পক্ষ একমতে মেনে নেয়নি, এমন অনেক পকেট আছে। এসব মিলিয়ে কিছু উত্তেজনা, খোঁচাখুঁচি শুরু হতেই চীন ভারত আক্রমণ করে বসেছিল, “ভারতকে শিক্ষা দেয়ার” জন্য। সে সময় ভারত আসাম ভূখণ্ড রক্ষা করতে আসেনি বা পারেনি। আর বিপরীতে ক্ষমতার সক্ষমতা দেখানোর জন্য চীন আসাম দখল করে নিয়েছিল। কিন্তু পরে নিজে থেকেই নিজের সৈন্য প্রত্যাহার করে পুরানা চীন-আসাম সীমান্তে ফিরে গিয়েছিল। এখান থেকে ভারতের রাজনৈতিক নেতা ও সরকারগুলোর চোখে আসাম কী, এর একটা ঝলক দেখতে পাওয়া যায়। সেই থেকে ভারতের এক দুঃস্বপ্ন বা ট্রমার নাম হয়ে থেকে যায় আসাম।
সেকালে সেই ঘটনার বর্ণনা একালে এই গত মাসে আবার কিছুটা তুলে এনেছেন এক ভারতীয় সাংবাদিক দেবাশীষ রায় চৌধুরী [Debasish Roy Chowdhury], যিনি হংকং থেকে প্রকাশিত পত্রিকা “সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট”-এর চায়না ডেস্কের এক ডেপুটি এডিটর। আসাম এনআরসির নাগরিক তালিকা প্রসঙ্গে এর প্রকাশের চার দিন আগে ২৬ আগস্ট তিনি তার এক রিপোর্ট লেখা শুরু করেছিলেন এভাবেঃ –
“১৯৬২ সালের শীতকালে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের জনগণকে আতঙ্ক গ্রাস করেছিল। রণভঙ্গ দিয়ে পালাতে থাকা ভারতীয় বাহিনীর পিছে ধাওয়া করে চীনের সেনারা আসামে চলে আসার উপক্রম হয়। চীনারা এসে পড়ছে এই ভয়ে সরকারি অফিসাররা সব কাগজপত্র পুড়িয়ে পালিয়ে যাচ্ছে বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ায় লোকজনও পালাতে শুরু করে। আতঙ্কে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে থাকা নোট পোড়ানো শুরু হয় এবং কারাগার থেকে মানসিক সমস্যাগ্রস্ত বন্দীদের ছেড়ে দেয়া হয়। স্থানীয়রা দেখে যে কয়েদিরা চীনের পক্ষে স্লোগান দিচ্ছে। এতে তারা মনে করে চীনারা তাদের ছেড়ে দিয়েছে”।
“২০ নভেম্বর রেডিও ভাষণে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরু জাতিকে পরাজয়ের কথা জানাতে গিয়ে বলেন, তার হৃদয় আসামের জনগণের সাথে রয়েছে। নয়া দিল্লি আসামকে পরিত্যাগ করবে বলে কোনো লক্ষণ দেখা না গেলেও আসামবাসী মনে মনে সেই ধারণা করে নিয়েছিল। কিন্তু বেইজিং হঠাৎ করে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে সেনাদের ফিরিয়ে নেয়। এক মাস আগে হঠাৎ করে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, তা হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যায়। আসাম ভারতের অংশ হিসেবে থেকে যায়। কিন্তু সুরো দেবীর সংগ্রাম তখন শুরু হয়।…”।
দেবাশীষ এটা লিখছিলেন আসলে কথিত ওই সুরো দেবীর জীবনকাহিনী বলতে যেয়ে, যে তখন ওই যুদ্ধ শেষের সময় থেকে এক পরিত্যক্ত এতিম শিশু। পরবর্তীকালে পালিত হিসেবে বড় হয়ে তার বিয়েও হয়েছিল। কিন্তু কোন সন্তান জন্মানোর আগেই স্বামীর মৃত্যু হয়। এখন সুরো এক বৃদ্ধের দেখভালের কাজ করে বেঁচে আছেন। কিন্তু এনআরসি তাকে নাগরিকত্বহীনের তালিকায় ফেলেছে। দেবাশীষের এই লেখার সাথে আমাদের সম্পর্ক আপাতত এতটুকুতেই।
আমরা দেবাশীষের লেখার এই অংশটুকে এনেছি এ জন্য যে, সেই যুদ্ধের পর থেকে আসামের সাথে ভারতের সম্পর্কও একধরনের এতিমের, সে সমান্তরাল টেনে ধরিয়ে দেয়ার জন্য। ভারতের এক দুঃস্বপ্ন বা ট্রমার নাম হয়ে থেকে যায় আসাম। যে তাকে যুদ্ধে হেরে যাওয়ার অনুভূতি দিয়েছে। আর সেই থেকে ভারতের ক্ষমতার জগতে এই ট্রমা আর এক মিক্সড অনুভূতি থেকেই আসামের অবকাঠামো উন্নয়ন করা, রাস্তাঘাটসহ সব কিছুতে বিনিয়োগ করা আদৌ ঠিক হবে কি না, এ নিয়ে ভারতের ক্ষমতার করিডোরে দ্বিধাদ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যায়। না, ঠিক আসামকে শাস্তি দেয়ার জন্য নয়। তবে অনেকটা নিজের প্রসব করা অবৈধ সন্তানের প্রতি যেমন মিশ্র অনুভূতি থাকে, এটা তেমনই একটা কিছু। যার সারকথাটা হল, আসামের অবকাঠামো ভাল উন্নত করে দিলে তা তো চীনেরই ভোগে লাগবে হয়ত। কারণ, যদি চীন আবার আসে?
যদি চীন আবার আসে! ওই অবকাঠামো ব্যবহার করে সহজেই আরও ভারতের ভিতরে চলে আসে? অথবা এই নেতিবাচক অনুমানের বদলে আর একটা যেটা ঠিক যুদ্ধের মতো নয়। সেটা হল, সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের উদ্দেশ্যে আসামের উন্নত অবকাঠামো ব্যবহার করে চীন যদি এরপর বাংলাদেশ হয়ে (বাংলাদেশের সাথে বরাবরই চীনের সম্পর্ক ভালো বলে) এর সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের সুযোগ পেতে আসামের উপর দিয়ে হাঁটাচলা শুরু করে যদি, তাহলে? তবে ভারত কিভাবে চীনকে না করবে অথবা না করতে কি পারবে? সব মিলিয়ে এক বিরাট সিদ্ধান্তহীনতা। যেটা ভারতের নেতাদের মনে পুরানা ট্রমার ওপর বাড়তি এক অনুষঙ্গ। এরই নীট ফলাফল হল, আসামকে সেই থেকে অনুন্নত অবকাঠামো করে ফেলে রাখা।
আসামের এই কোণায় পড়ে থাকা, বাকি ভারতের সাথে দুর্বল যোগাযোগ ব্যবস্থা, এটা শুরু হয়েছিল ১৯৪৭-এর দেশভাগ থেকে মানে বাংলাদেশ (পূর্ব পাকিস্তান)-এর জন্মের পর যখন থেকে, আসাম আর বাকি ভারতের মাঝখানে বাংলাদেশ ঢুকে থাকা থেকেই। সে কারণে প্রথম এনআরসি বা নাগরিক তালিকা করার তৎপরতা ১৯৫১ সালের। আর এরপর আবার ১৯৬২ যুদ্ধের ট্রমা। অর্থাৎ সব মিলিয়ে আসামের অনুন্নত অর্থনীতির মূল কারণ যোগাযোগ দুর্বল অবকাঠামো, যেখান থেকে কাজ চাকরি সৃষ্টিতে অভাব ও সামাজিক সুযোগ সুবিধার অভাব দেখা দেয়ার শুরু। কিন্তু সে দিকে না তাকিয়ে, কারণ হিসেবে অবকাঠামো দুর্বলতাকে চিহ্নিত না করে বরং আসামে মানুষ বেশি হয়ে গেছে, “বহিরাগত বাঙালিরাই সমস্যা মনে করা”, এই বিদেশী বিদ্বেষ [Xenophobia] জেগে উঠা বা পরিকল্পিতভাবে উঠানো, আর তা কেন্দ্র সরকারের হাতে তার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখা- এটাই আসামের অরিজিনাল বা মূল সঙ্কট।
কিন্তু এসবের চেয়েও এসব থেকেই আর এক বড় সঙ্কট এখন ‘পারসেপশন’ [Perception]। কিসের পারসেপশন? পারসেপশন মানে যাচাইয়ে প্রমাণ হওয়া ছাড়াই আন্দাজে একটা অনুমান দাঁড় করানো, এবং দৃঢ়ভাবে তা বিশ্বাস করা। এমনভাবে বিশ্বাস করা যা থেকে মানুষ এরপর থেকে ভুলে যায় যে সেটা একটা অপ্রমাণিত অনুমান মাত্র ছিল। যেমন, আসামে বহিরাগত বাঙালিরাই আসল সমস্যা কি না তা কি বাস্তবে মাঠে যাচাই করা হয়েছে? জবাব হল, না, কখনোই হয়নি। এ ছাড়া আগে এতক্ষণ এটাই বলেছি, আসামের মূল সমস্যা সব ধরনের যোগাযোগ অবকাঠামো দীর্ঘ দিন বিনিয়োগহীন পড়ে থাকা বা কেন্দ্রের ফেলে রাখা। কিন্তু বহিরাগত বাঙালিরাই সমস্যা- এই পারসেপশন শুধু জেঁকে বসে গেছে শুধু তাই নয়, এর ওপর দাঁড়িয়ে পুরো আসাম সমাজ সে সময় (১৯৭৯-৮৫) এতই উন্মত্ত হয়ে গেছিল যে তারা ভারত থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হতে নিচ্ছিল। আর তা ঠেকাতে সেকালের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী “১৯৮৫ সালের ‘আসাম একর্ড” চুক্তি করেছিলেন, যার মূল পয়েন্ট ছিল “বহিরাগত খেদাও”।
কোন পারসেপশন আর বিচার-আদালত একসাথে চলতে পারে না। চালাতে চাইলে ওর নাম হয় শাহবাগ। বিচার-আদালত মানেই তাতে কোন একটা জিনিষ সত্য প্রমাণিত হতেও পারে, আবার না-ও পারে। বিচার শেষের আগে এর কোনোটাই সঠিক বলা যাবে না। এই দু’টি অপশনই ঘটতে পারার সুযোগ খুলে রাখতে হবে। কোন বিচারে বসার আগেই যদি আগাম তা না খুলে রাখা হয়, তবে ঐ বিচার শুরু করার মানেই হয় না। ওটা বিচার বলাই যাবে না। কারণ, যদি ধরেই নেই পারসেপশনই সত্য তাহলে আর যাচাই-বিচারে বসার দরকার কী?
আসামের তাই বহিরাগত বাঙালিরাই সমস্যা – এই পারসেপশন, এটা আর সত্য কি না তা আর যাচাইয়ের কোনো সুযোগই নেই। অন্তত যতক্ষণ এটা ‘পারসেপশন’ জারি থাকবে। হয় চোখ বন্ধ করে একে মেনে নিতে হবে আর নাহলে পারসেপশন ফেলে দিয়ে সত্যতা যাচাইয়ে নামতে হবে। একসাথে বিচার আর পারসেপশন চলতে পারবে না।
কিন্তু আসামে তা হচ্ছে না। হয়নি; অথচ তারা এনআরসি করতে নেমে গিয়েছিল। মানে যাচাই করতে নেমেছিল। কারা নাগরিক তা যাচাইয়ে নেমেছিল। কিন্তু এর ফলাফলে তাদের পারসেপশন ভুল প্রমাণ হলে, আসামের বাসিন্দারা কি তা মেনে নেবে? জবাব হল যে কখনোই না।
সে সুযোগ রাখা হয়নি। না রেখেই এনআরসি বা নাগরিকত্বের বাছবিচারে নামা হয়েছে। এমনকি আদালতের বিচারকেরাও ছিল বিরাট বেকুব। একটা বিদেশী বা বহিরাগত খেদাওয়ের আন্দোলন সফল হয়ে গেছে, একটা চুক্তি হয়েছে তাদেরই পক্ষে। এটা তো আদালতের জানাই ছিল। তাহলে তা আবার আদালতের মাধ্যমে “নাগরিকত্ব যাচাইয়ে নামার” মানে কী? কারণ, “বহিরাগত খেদাওয়ের” আন্দোলন করা ভুল ছিল তা প্রমাণও হতে পারে, সেই অপশন ত খুলে রাখা হয়নি।
কাজেই এই অপশন খুলে না রাখার কারণে ২০১৩ সালে আদালত তো মূলত নাগরিকত্ব যাচাই বিচারের প্রক্রিয়া শুরুর আদেশ দিতেই পারে না। তবু হয়ত হতে পারত এক শর্তে যে, আদালতকে পরিষ্কার ঘোষণা দিতে হত, নাগরিকেরা যেন তাদের মনে গেড়ে বসা অনুমান বা পারসেপশন ভুল প্রমাণ হয়ে যেতে পারে, সে জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে থাকে। অথচ আদালত এমন কোনো ঘোষণা দিয়ে রাখেননি। মানুষকে সাবধান করেনি। দেখা যাচ্ছে, আসলে আদালতও ছিলেন অহমীয়দের মত একই পারসেপশনের শিকার।
এসবেরই ফলাফল হল, এখন এনআরসির পরিণতি দেখে আসামের সব পক্ষই অখুশি। যদিও বিজেপি জানত যে এটাই হতে যাচ্ছে। তাই তা আগে টের পেয়ে দুই মাস আগে আদালতের কাছে আবার বাংলাদেশ-আসাম সীমান্তের ২০ শতাংশ ডাটা রি-ভেরিফিকেশন বা পুনঃ যাচাই এর দাবি তুলেছিল। তাদের পরিকল্পনা ছিল আবার যাচাইয়ের নামে এবার তারা ডাটায় হাত ঢুকাবে আর ‘পারসেপশন’ মোতাবেক ফল বের করে আনবে।
কিন্তু আদালত এমন পুনঃ যাচাইয়ের আবেদন নাকচ করে দেয় এই অজুহাতে যে, প্রতীক হাজেলা নিয়মিত যে অগ্রগতি রিপোর্ট দিত, এর শেষ রিপোর্টে বলা ছিল, ইতোমধ্যে ২৭ শতাংশ ডাটা পুনঃযাচাই করা হয়ে গেছে। আর এতেই বিজেপির কূটকৌশল মারা পড়ায় সবার আগে তারাই এনআরসির সব ব্যর্থতার জন্য প্রতীক হাজেলাকেই দায়ী করে মিটিং করেছিল। এরপর আসামের বহিরাগত খেদাও – এই পারসেপশনের সব পক্ষই বিজেপিকে অনুসরণ করে প্রতীক হাজেলার মাথায় সব ব্যর্থতার ভার চাপিয়ে দিয়েছে।
আবার এখনো যা করা হচ্ছে যে সব ব্যর্থতার ভার চাপানো – সেটাও তো ঠিক হাজেলার অপরাধ নয়। কারণ ব্যাপারটা হল, নিজের অজান্তে তিনি একটা সত্যি কথা বলে রাখার জন্য বিজেপির এতে পরবর্তিতে হাত ঢুকানোর সুযোগ নষ্ট হয়ে যাওয়া- এটা তো হাজেলার কোন অপরাধ নয়। এখন যদি কোনো টেকনিক্যাল কারণে প্রতীক হাজেলাকে দায়ী করার সুযোগ না থাকত তাহলে কী হতো? সোজা হিসাব, ‘পারসেপশনে’ মজে থাকা আসামের সব পক্ষই আদালতকে দায়ী করত, এর একটা বিরাট সম্ভাবনা ছিল।
এদিকে আদালতের নির্দেশে প্রতীক হাজেলা এখন সব ধরনের পাবলিক উপস্থিতি থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছেন। এর লাভালাভ আদালতের পক্ষেও কম যাচ্ছে না।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
_
এই লেখাটা এর আগে গত ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার প্রিন্টে ও ওয়েবে “নিজের পারসেপশনে আটকে পড়া“ – এই শিরোনামে ছাপা হয়েছিল। পরবর্তিতে সে লেখাটাই এখানে আরও নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে এখানে ছাপা হল। ]