হিন্দুত্বের পরে হিন্দি জাতীয়তাবাদ
গৌতম দাস
২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০৬ সোমবার
হিন্দিতে ক খ গ লেখা, এনডিটিভি থেকে নেয়া, ১৪ সেপ্টে ২০১৯
[সার-সংক্ষেপঃ আরএসএস -বিজেপি হিন্দুত্বের জাতীয়তাবাদের পরে এবার মোদী-অমিত চেষ্টা করছেন হিন্দি জাতীয়তাবাদ মানে, সাথে ভাষার জাতীয়তাবাদও হাজির করার চেষ্টা করছেন। চলতি প্রজন্ম হয়ত জানে না। ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রথম দল কংগ্রেস ও এর নেতা জওহরলাল নেহর্ এটা আগেই চেষ্টা করে ও পরাজিত হয়ে গেছিলেন। ১৯৬৩ সালে এরই প্রচেষ্টায় তিনি The Official Languages Act, 1963 করেছিলেন। কিন্তু তা দক্ষিণের দ্রাবিড়ীয়দের আন্দোলনের মুখে ব্যর্থ হয়ে যায়। সেই থেকে হিন্দি ভারতের “জাতীয় ভাষা” আর নয়। মোদী-অমিত আবার সেই পুরানা ব্যর্থ প্রচেষ্টাটাই নতুন করে জবরদস্তিতে আনতে চাইছেন, যা ইতোমধ্যেই নেহরুর হাতে পরীক্ষিত ও পরাজিত। কংগ্রেসের এখনকার বিবৃতিই এর প্রমাণ।]
এবারের ১৪ সেপ্টেম্বর নাকি ভারতের “হিন্দি দিবস” [Hindi Divas] ছিল। মানে পালিতও হল। বুঝা গেল, ভারতের অমিত শাহ এবার হিন্দুত্বের পরে নতুন মোদী-হিটলারি লাঠি – “হিন্দি” নিয়ে হাজির হলেন। ব্রিটিশেরা চলে যাবার পরে স্বাধীন ভারতের কনস্টিটিউশন যখন লেখা হচ্ছিল সেই ১৯৪৯ সালে ১৪ সেপ্টেম্বরকে একটা হিন্দি দিবস ঘোষণা করে রাখা ছিল। রাখা ছিল বলছি এ জন্য যে এটা রেখে কোনো লাভ হয়নি, পরে হিন্দিই উধাও হয়ে গিয়েছিল। খুব একটা কিছু আগায়নি। কী আগায়নি?
ব্রিটিশ আমল থেকেই, রাজনীতি জিনিসটা কী – তা অস্পষ্ট বোল-এর উচ্চারণে আধা-বুঝাবুঝির সময় থেকেই ভারতে রাজনৈতিক দল বলতে একমাত্র একটা ‘জাতীয়তাবাদী’ দলই বুঝা হত। আবার এই জাতীয়তাবাদ বলতে একটা হিন্দু জাতীয়তাবাদ বা হিন্দুত্ব ছাড়া আর অন্য কিছু হতে পারে না- এই অনুমান নিয়েই তাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল। যদিও হিন্দুনেতাদের নিজেদের মধ্যে একটা তফাত বা বিতর্ক ছিল যে, তারা রাজনীতি ও রাষ্ট্র বলতে যে একটা হিন্দুত্ব-রাষ্ট্র বুঝছেন তা স্পষ্ট করেই বলা হবে, না তা কৌশলে আড়াল রাখা হবে, এ নিয়ে কংগ্রেস-হিন্দু মহাসভা (একালের নাম আরএসএস) গোষ্ঠির মধ্যে ভিন্নতা ছিল। কিন্তু হিন্দু রাজনীতিক মাত্রই প্রায় সবাই মানত যে, হিন্দু জাতীয়তাবাদ বা হিন্দুত্বের ভিত্তি ছাড়া ভিন্ন কোনো রাজনীতি করা এবং রাষ্ট্র গড়া ও থাকা অসম্ভব, তা হতেই পারে না। ঠিক এ কারণেই তারা অ-হিন্দু, বিশেষ করে ভোকাল মুসলমানদের সামনে নিজেদের হিন্দুত্ব চিন্তার ন্যায্যতা কী তা প্রতিষ্ঠা করতে না পারা থেকেই কংগ্রেসের জন্মের ২০ বছরের মধ্যেই ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগের জন্ম হয়েছিল।
পরিণতিতে পাকিস্তান আলাদা হয়ে যায়। কিন্তু মুসলমানেরা রাষ্ট্রে আলাদা হয়ে যাওয়া সত্বেও তাদের হিন্দু জাতীয়তাবাদ বা হিন্দুত্বের “রাষ্ট্র ধারণা” বুঝের মধ্যে এর কোন প্রভাব পড়েনি। তারা হিন্দুত্ব আঁকড়ে ধরেই থেকে গিয়েছিল। কিন্তু এভাবেই হিন্দু জাতীয়তাবাদ বা হিন্দুত্বের রাষ্ট্র ও কনস্টিটিউশন বানানোর পরবর্তিতে বাস্তবত ১৯৬৩ সালের মধ্যে, শুরু হয়ে যায় এর পতন; অর্থাৎ ডিজেনারেশন [degeneration] বা ভেঙে পড়া। মানে হিন্দু জাতীয়তাবাদ বা হিন্দুত্বের চিন্তা ও রাষ্ট্র বাস্তবায়ন শুরুর পর্যায়েই এরা টের পেতে থাকে যে সব ভেঙে পড়ছে।
অনেকের ধারণা যে, কোনো জনগোষ্ঠীর আশি-নব্বই পার্সেন্ট ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র গড়তে কোনো সমস্যা হয় না। এ ধারণা ভুয়া, ভিত্তিহীন। এর মানে, এই অনুমান অনুসারে ভারতের মুসলমানেরা ভেঙে আলাদা নিজের রাষ্ট্র গড়ে বেরিয়ে গেলে তাতে হিন্দু জাতীয়তাবাদ বা হিন্দুত্বের রাষ্ট্র গড়তে আর অসুবিধা হবে না, পোক্ত হবে। তাই তো হওয়ার কথা, কিন্তু ভারতে তা হয়নি। মাত্র তেরো বছরের মধ্যে দক্ষিণের রাজ্যগুলো হিন্দু জাতীয়তাবাদ বা হিন্দুত্বের নামে দক্ষিণের ওপর হিন্দি-বলয়ের কর্তৃত্ব উপড়ে ফেলে দিয়েছিল। কর্নাটকের প্রধানত কন্নড় ভাষা, কেরালার মালয়ালম ভাষা, অন্ধ্রপ্রদেশের তেলেগু ভাষা, তামিলনাড়– তামিল ভাষা এদেরকে একসাথে দ্রাবিড়িয়ান ভাষা বলে। অনেকে তাই দক্ষিণের এই চার রাজ্যকে দ্রাবিড়িয় রাজ্য বলে। অনেকে আবার ভৌগলিকভাবে (এটা আসলে পুব-পশ্চিমে বিস্তৃত একটা উঁচা প্লাটো[Plateau] বা মালভুমি যার নাম ডেকান) এটা বুঝাতে দাক্ষিণাত্য বা ইংরেজিতে ডেকান [Deccan] বলে থাকে। এরাই মূল লড়াকু যারা উত্তর ভারতের (হিন্দুভাষী বা হিন্দিবলয়ের) আধিপত্যের চরম বিরোধী।
এমনকি এই বিরোধিতার বা বলা ভাল উত্তরের আর্যদের প্রতিরোধ লড়াইয়ের উৎস হিন্দু ধর্মের মতোই প্রাচীন। উত্তর ভারতে মানে মূলত এখনকার উত্তরপ্রদেশ, এখানে আর্যদের আগমনের পরে আশপাশের রাজ্য-এলাকায় বিস্তার লাভের পরে আরও দক্ষিণ দিকে অন্ধ্রপ্রদেশে প্রবেশের আগে থেকেই পরে আর আগাতে পারেনি। আরও দক্ষিণে অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে সেই এলাকাটাই দাক্ষিণার্থ বা দ্রাবিড়িয় অঞ্চল। অর্থাত ডেকান মালভুমি পেরিয়ে এরও পরে এখনকার তামিলনারু বা আরও পশ্চিম বরাবর কোস্টাল রাজ্য কেরালায় এদিকে আর আর্যরা বিস্তৃত হতে পারে নাই। একইভাবে পুবদিকে আর্যদের বিস্তার ঘটেছিল মহারাষ্ট্র পেরিয়ে বিহার পর্যন্ত। আর এর পরেই (পুব ও পশ্চিম) বাংলা অঞ্চল। এখানেও আর্যরা কত ভিতরে এসেছিল বা আসেনি সে তর্ক ছাপিয়ে বলা যায়, বাংলার প্রতিরোধ অবশ্যই ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও দূরবর্তী হলেও ভাষা বা কালচারে আর্যদের প্রভাব বাংলার উপর পরেছিল বা আছে এ নিয়ে তর্ক নেই। আর্যদের বিস্তার প্রসঙ্গে এই ফ্যাক্টসটাই একালেও সব ঘটনার ব্যাকগ্রাউন্ডে কাজ করে থাকে। সাতচল্লিশের ভারত ভাগের পরের ভারত মূলত হিন্দি-বলয়ের (যেন পুরানা দখলি নিয়ে বসা আর্যদের) ক্ষমতা হয়েই সারা ভারতকে শাসনের কেন্দ্র হয়ে উঠতে চেয়েছে। পুরা ভারতের উপর এটাই – উত্তরের শাসন, হিন্দি বলয়ের শাসন, হিন্দিভাষীদের শাসন ইত্যাদি নানান থাকে থেকে গেছে। এটাই মর্ডান ভারতে এক কাশ্মীরি ব্রাক্ষণ জওহরলাল নেহেরু ভুতুড়ে উত্তরের ক্ষমতার শাসন সর্বপ্রথম কায়েম করতে গিয়েছিলেন। যা প্রথম বড় আঘাত পেয়ে থমকে গিয়েছিল ১৯৬৩ সালে, দ্রাবিড়ীয় প্রতিরোধে। আর সেটাই আবার তবে এবার গুজরাতি মোদী-অমিত নেহেরুর ব্যার্থতার জুতা পায়ে গলিয়ে ভুতুড়ে সেই উত্তরের ক্ষমতার শাসনটাই আবার জাগানোর চেষ্টায় নেমেছেন। নেহেরুই প্রথম ১৯৬৩ সালে হিন্দুত্ব পাশে থুয়ে রেখে হিন্দি চাপানোর ভাষা-জাতীয়তা চালু করেছিলেন। বলা বাহুল্য প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়ে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছিলেন। সেই ব্যর্থতাকেই আবার কাঁধে উঠায় নিলেন মোদী-অমিত।
সারকথায়, উত্তরের শাসন, যেটা নেহেরুর হাতে নিজেকে হিন্দু জাতীয়তাবাদ বা হিন্দুত্বের পরিচয়ের আড়ালে কার্যকর থাকতে চেয়েছিল। ঐতিহাসিক রেওয়াজ রিনিউ করে এরই প্রবল বিরোধী হল দ্রাবিড়ীয় ও বাংলা অঞ্চল। একালে গত কয়েক বছর ধরে মুখ্যমন্ত্রী মমতার যে মোদী বা হিন্দির বিরোধিতা সেটা পুরানা ঐতিহাসিক বিরোধিতারই এক নব অধ্যায়।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, দ্রাবিড়ীয় ও বাংলা – এই দুই অঞ্চল থেকেই ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরোধিতা উঠে এসেছিল। হিন্দুধর্মের পক্ষে থেকে নিজের ন্যায্যতা দিতে গিয়ে এর সবচেয়ে দুর্বল দিক হল, এর ব্রাহ্মণ-শ্রেষ্ঠত্ববাদ বা ব্রাহ্মণ্যবাদের বয়ান – এটা উদাম হয়ে যায়। এই ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে দ্রাবিড়ীয় ও বাংলা অঞ্চলের মিল পাওয়া যায়। বাংলায় সুলতান শাসন আমলের (১২০৫-১৫৭৬) শেষের দিকে নদীয়াকেন্দ্রিক চৈতন্যের ও পরবর্তীতে লালনের জাতপাতবিরোধী সামাজিক আন্দোলনের কথা অনেকেই জানি।
আর ওদিকে ব্রিটিশ আমল থেকেই সামাজিক সুযোগ সুবিধায় সরাসরি ব্রাহ্মণবিরোধিতার আন্দোলনের সূচনা করেছিল তামিল সমাজ। আজকের তামিলনাড়ুতে যে দুই স্থানীয় দলের হাতে এই রাজ্য পালটাপালটি শাসিত হয়ে আসছে সে মূল দলের নাম ডিএমকে [DMK]। ইংরেজি আদ্যক্ষরে বলা এই দলের নাম দ্রাবিড়া মুনেত্রা কাজাঘাম (দ্রাবিড় প্রগেসিভ ফেডারেশন) [Dravida Munnetra Kazhagam ( transl. Dravidian Progress Federation] থেকেই ডিএমকে। আর সেটা থেকে ভেঙে পরে (১৯৭২) অন্য আরেক অংশের দলের নাম এআইএডিএমকে [AIA-DMK]। ততকালীন মাদ্রাজে (তামিলনাড়ু) ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণের ঝগড়া তীব্র উঠেছিল বৃটিশ আমলেই সামাজিক সুযোগ সুবিধায় চরম বৈষম্য থেকে। সেখান থেকেই ব্রাহ্মণবিরোধিতার আন্দোলনের সূচনা করেছিল জাস্টিস পার্টি, ১৯২০ সালেরও আগে থেকে। এই দলেরই কয়েকজন পরে ১৯৪৪ সালে নিজেরা পুনর্গঠিত হয়ে জন্ম দেন দ্রাবিড়া কাজাঘাম [Dravidar Kazhagam, DK] দল। ব্রাহ্মণের সামাজিক আধিপত্যের বিরোধীতা এই ছিল তাদের মূল ইস্যু; তাই তারা সাম্যের সমাজ ছিল তাদের মূল শ্লোগান। কিন্তু প্রধান দুই নেতার বিরোধ থেকে ১৯৪৯ সালে এক অংশ দ্রাবিড়া মুনেত্রা কাজাঘাম [Dravida Munnetra Kazhagam] ডিএমকে খুলে বসেন। নেতা আনাদুরাই -এর নেতৃত্বের এই দল, এদের ব্রাহ্মণ বিরোধিতা এতই তুঙ্গে ছিল যে এরাই প্রথম কোন ব্রাক্ষণ ছাড়াই সামাজিক-ধর্মীয় বিয়ের নতুন প্রথা চালু করেছিল। এটাকেই আইনি কাঠামো দিয়ে তারা এর নাম দিয়েছিল আত্মসম্মানের আইনে বিয়ে [Self-respect marriages Act]।
কিন্তু সবাইকে ছাড়িয়ে ডিএমকে দল বিখ্যাত হয়েছিল নেহেরুর হিন্দি-জাতিবাদের বিরোধীতার আন্দোলনে সফল হয়ে। নেহরুর যুগে.১৯৬৩ সালে ভারতকে হিন্দু জাতীয়তাবাদ বা হিন্দুত্বের পরিচয়ের ভারত বানানোর প্রচেষ্টা প্রথম ধাক্কা খেয়েছিল দ্রাবিড়িয়দের বিশেষ করে ডিএমকে দলের হাতেই। দেশ ভাগের পরে পাকিস্তান পাবার পরে, মূল নেতা মুসলিম লীগের জিন্নাহর পূর্ব পাকিস্তানে ভিলেন হয়ে যান উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাবের প্রশ্নে। কিন্তু মজার কথা হল, ঠিক একই ধরণের ভাষা-জাতিবাদী চিন্তায় জিন্নাহর মতই একই কাজ করেছিলেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেহরু। তাঁর আমলেই হিন্দিকে সরকারি ভাষা করা হয়েছিল। আর সেখান থেকেই হিন্দি দিবস বলে একটা দিন চালু ও পালন করা হয়েছিল ১৯৪৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর।
আর ১৯৪৯ সালে এর আইনটা লেখা হয়েছিল এভাবে, ভারতের “জাতীয় ভাষা (National language) হিসাবে হিন্দি’, ‘প্রথম সরকারি দফতরের ভাষা (Official language), আর ইংরেজি দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে চালু থাকবে”। তবে এখানে দুইটা “কিন্তুও” ছিল। প্রথমত, ভাষার নাম ‘হিন্দি’ হবে, ঠিক তা বলা হয়নি। বলা ছিল “হিন্দুস্থানী ভাষা”। তা আরও ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছিল, তা দেবনাগরি অক্ষরে (এখন ভারতে যে অক্ষরে হিন্দি লেখা হয়) বা ফার্সি অক্ষরে হতে পারবে। আর দ্বিতীয় শর্ত ছিল, এই নিয়ম বা আইনটা , পরবর্তি ১৫ বছর পর্যন্ত চালু থাকবে। এরপর পার্লামেন্ট নিজে বসে ভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, এরপরে কী হবে।
এই হিসাবে ১৯৬৩ সালে “হিন্দি ভাষা-জাতীয়তাবাদ” কায়েমের জোশে, মহান সুযোগ কাজে লাগাতে চেয়ে জিন্নাহর মতনই নেহরুও হিন্দিকে জাতীয় ভাষা ও একমাত্র অফিসিয়াল ভাষা ঘোষণা করে সংসদে পাস করা এক আইন জারি করেন। এছাড়া এর আগেই অ-হিন্দিভাষী রাজ্যগুলোতে শিক্ষা কারিকুলামে হিন্দি ভাষা শেখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। এটাই সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ বিক্ষোভ সংগঠিত হতে থাকে অহিন্দি রাজ্যগুলোতে, বিশেষ করে দ্রাবিড়িয় অঞ্চলে। সেখানে ক্ষোভ প্রতিবাদ এতই তীব্র ছিল যে পাঁচজন মানুষ নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহুতি দিয়েছিল। সাথে ঐ আন্দোলনে দুজন পুলিশেরও মৃত্যু হয়েছিল। কেরালায় বহু কেন্দ্রীয় সরকারি অফিসে আগুন দেয়া হয়েছিল। অবশেষে বাধ্য হয়ে কংগ্রেস সরকার আইনটা প্রত্যাহার করে নিয়ে আন্দোলন থামিয়েছিল। পরের বছর ১৯৬৪ [২৭ মে ১৯৬৪] সালে নেহরুর মৃত্যু হয়। আর ১৯৬৪ সালে [০৯ জুন ১৯৬৪] নতুন প্রধানমন্ত্রী হন লাল বাহাদুর শাস্ত্রী। আর স্বভাবতই তাঁর প্রথম কাজ ছিল একটা ভাষা প্রশ্নে একটা আপোষ ফর্মুলা বের করা। তাঁর আমলেই নতুন করে আগের official language act 1963 এর মধ্যে সংশোধন এনে জানুয়ারি ১৯৬৫ সালে এটাকে আগের মতই হিন্দির পাশাপাশি ইংরেজি সরকারি দাপ্তরিক ভাষা ফিরে করা হয়। তবে জাতীয় ভাষা কী হবে তা উহ্য রাখা হয়। আসলে এটাই ছিল দ্রাবিড়িয় রাজ্যগুলোর সাথে আপসনামা রফায় সংশোধিত অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাক্ট ১৯৬৩। এইবিষয়টা পড়ে গুজরাত হাইকোর্টের ২০১০ সালের এক রায়েও স্বীকৃত হয়। সেকালে মামলাটা ছিল্ভিন্ন প্রসঙ্গে যে, এক ব্যক্তি আদালতের নির্দেশনা চেয়ে মামলা করেছিল যেসব্ব পণ্যের গায়ে হিন্দিতে বর্ণনা লেখা বাধ্যতামূলক করা হোক। কিন্তু আদালত অপারগতা জানিয়ে বলে, ২০১০ সালের জানুয়ারিতে গুজরাট হাইকোর্টের এক রায়ে এটাই স্বীকার করা হয়েছে যে, ভারতে ‘জাতীয় ভাষা’ বলে কোনো কিছুই নেই।
সারকথাটা হল, হিন্দু জাতীয়তাবাদ বা হিন্দুত্বের ভারত রাষ্ট্র গড়ার দাবিদারেরা বিশেষত নেহরুর কংগ্রেস ১৯৬৩ সালেই এই প্রথম সবচেয়ে বড় ধাক্কা খায়। যেটা আসলে হিন্দি ভাষা-জাতীয়তাবাদ করার উদ্যোগকে কেন্দ্র করে সংঘটিত ও উন্মোচিত হয়ে মার খেয়ে যায়। সেই থেকে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান এসবের জাতীয়তাবাদ আসলে হতভম্ব হয়ে বিভ্রান্ত ও ফিকে হয়ে যেতে থাকে।
বহুবার বলেছি, হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান অথবা হিন্দু জাতীয়তাবাদ বা হিন্দুত্বের ভারত রাষ্ট্রের কামনা কেবল কংগ্রেসের নয়, এটা হিন্দু মহাসভা বা পরে এদেরই নতুন নাম আরএসএস-জনসংঘ বা একালের বিজেপির কামনা ছিল সবসময়। তফাত শুধু এই যে, হিন্দুত্বকে কংগ্রেস সেকুলার জামার আড়ালে রেখে ফেরি করতে চায়। আর বিজেপি হিন্দুত্বকে গর্ব করে প্রকাশ্যে বলতে চায়। তবে ১৯৬৫ সালের মধ্যেই কংগ্রেসের নেতৃত্বে যে হিন্দি ও হিন্দুত্বের মার খেয়ে যাওয়া- এ প্রসঙ্গটা কংগ্রেসের কাছে প্রচন্ড হতাশার অবশ্যই কিন্তু কোনো বিকল্প করণীয় ছাড়াই।
কংগ্রেসের এই ঢিলেঢালা অবস্থাতেই চলতে চলতে ১৯৮৫ সালের পর থেকে কংগ্রেস ভারতের কেন্দ্রীয় ক্ষমতা থেকেই হারিয়ে যাওয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল। মনে রাখতে হবে ওই ১৯৬৩ সালে কংগ্রেসের প্রথম পরাজয়ের পর থেকে ডিএমকেই কংগ্রেসের পরে প্রথম (আঞ্চলিক) রাজনৈতিক দল, যারা ১৯৬৭ সালের নির্বাচন থেকে এককভাবে রাজ্যে ক্ষমতা দখল করেছিল। আর সেই থেকে দ্রাবিড় অঞ্চল থেকে হিন্দিভাষী দলের হারিয়ে যাওয়া শুরু। তবে ১৯৭২ সালে ডিএমকে তে একদভা ভাঙনে তৈরি হয়েছিল এআইএডিএমকে [AIA-DMK] বা আন্না ডিএমকে। তাই ঐ ১৯৬৭ সাল থেকেই তামিলনাড়ূতে ডিএমকে অথবা আন্নাডিএমকে পাল্টাপাল্টি করে রাজ্য সরকারের ক্ষমতায় এসেছে।
কিন্তু এই পরাজয় সম্পর্কে বা সাধারণভাবে হিন্দু জাতীয়তাবাদ বা হিন্দুত্বের ভারত রাষ্ট্র কামনা সম্পর্কে আরএসএস-বিজেপির ভাষ্য ও মূল্যায়নটা হলো, কংগ্রেস লিবারেল বা দুর্বল ঈমানের হিন্দুত্ব করে বলেই হেরে গেছে। আগ্রাসী-হিন্দুত্ব নিয়ে আগালে হিন্দুত্ব কখনো হারত না।
অনুমান করা যায় এসব ব্যাকগ্রাউন্ড মনে রাখার কারণেই, মোদীর দ্বিতীয়বার নির্বাচনে জয়ী হওয়াতে বিজেপি এবার আস্তে ধীরে নিজেদের মূল্যায়নের ঝাঁপি খুলে ধরতে শুরু করেছে। কাজেই মোদি সরকার-টু, এটা আসলে (১৯৪৭-৬৩) সময়কালের কংগ্রেসের হিন্দু জাতীয়তাবাদ বা হিন্দুত্বের ভারত রাষ্ট্রের স্বপ্ন ও দর্শন যে মিথ্যা, অকেজো ও অকার্যকর প্রমাণ হয়েছিল সেই হিন্দুত্বকেই এবার আবার ধুয়ে মুছে কিন্তু প্রচন্ড আগ্রাসী-হিন্দুত্ব হিসেবে হাজির করতে সিদ্ধান্ত নিয়ে এগিয়ে আসছেন মোদি-অমিত গোষ্ঠী। বলাই বাহুল্য, হাস্যকর জিনিস করার উদ্যোগে প্রথমবারের ব্যর্থতার পরও দ্বিতীয়বার তা নিলে সেটা এবার তামাসার পরিণতি নিয়েই ফেরে। এই হাস্যকর জিনিসটা হলো হিন্দুত্বের জাতীয়তবাদ- যা এখন জয় শ্রীরাম বলে পরিচিত!
হিন্দি দিবস এতদিন ধুলা ময়লায় পড়ে কোথাও কোণে অবহেলায় গড়াগড়ি যাচ্ছিল। ওদিকে এতদিনে সরকারি দপ্তরের ভাষা, হিউম্যান রিসোর্স বা বিজনেস ম্যানেজমেন্টের ডিফল্ট ভাষা হয়ে উঠেছে ইংরাজি। কংগ্রেস হাত-পা ছেড়ে এটাই একবাক্যে মেনে নিয়েছিল। কিন্তু অমিত শাহ এবার সেই ধুলা ময়লা পড়া “হিন্দি দিবস” তা ঝেড়ে পুছে নিয়ে এবার আবার পালন করে বসলেন। যদিও সেটা বড় তেমন কোন কিছু নয়। কেবল এক টুইটার স্টেটমেন্ট তাও আবার তা হিন্দিতেই হতে হয়েছে। তবে সেই স্টেটমেন্টটাই গুরুত্বপুর্ণ অবশ্যই। সেটার আনন্দবাজারের করা বাংলা অনুবাদটা হল এরকম – ‘‘ভারতে বহু ভাষা রয়েছে। প্রত্যেকটির গুরুত্ব রয়েছে। কিন্তু দেশের একটি ভাষা থাকা প্রয়োজন,যাকে বিশ্ব স্বীকৃতি দেবে ভারতীয় ভাষা হিসেবে। যদি কোনও ভাষা দেশকে বাঁধতে পারে,তা হিন্দি”।
প্রথমত লক্ষণীয় হল, অমিত শাহ কোন প্রধানমন্ত্রী নন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, কাজেই ভাষা নিয়ে বিবৃতি এটা তাঁর মন্ত্রণালয়ের কাজই নয়। ভারতে হিউম্যান রিসোর্স বলে মন্ত্রণালয় আছে, সেই মন্ত্রী যদি এই হিন্দি দিবস পালনের বিবৃতি দিতেন তাও একটা কথা ছিল! তাহলে অমিত শাহ কেন? একটা টেনেটুনে সাফাই অনেকেই করতে চাইবে হয়ত যে অমিত শাহ দলের সভাপতি, তাই। কিন্তু না। কাজটা রাষ্ট্রের তরফের, দল না। খুব সম্ভবত এর আসল অর্থ হল, হিন্দি জাতীয়তাবাদ করতে গিয়ে ১৯৬৩ সালের কংগ্রেসের মত এবার আগ্রাসী-হিন্দুত্বতে তা করতে গিয়ে যদি এবারও তা মার খেয়ে যায় তবে প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে যেন পশ্চাদ-অপসারণটা ঘোষণা দেওয়ার সুযোগ নেয়া যায়।
দ্বিতীয়ত, অমিতের বিবৃতিতে প্রথম দুই বাক্যে বলা হয়েছে, “ভারতে বহু ভাষা রয়েছে। প্রত্যেকটির গুরুত্ব রয়েছে”। এর মানে হল তারা ১৯৬৩ সালের পরাজয়টা আমল করেছেন। তাই আগাম প্রলেপ দিয়ে নিলেন। কিন্তু আরএসএস-বিজেপির মূল যুক্তিটা জানা গেল পরের বাক্য – “দেশের একটি ভাষা থাকা প্রয়োজন”। এছাড়া ইতোমধ্যেই মোদীর খসড়া শিক্ষানীতি ২০১৯-এ দেখা গেছে, হিন্দি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার কথা আছে সেখানে – যেখানে স্বয়ং নেহেরু পরাজিত হয়ে পিছু হটে গিয়েছিলেন।
অমিত আসলে বলতে চাইছেন “ভারতের একটা হিন্দি-হিন্দুত্বের জাতীয়তাবাদ প্রয়োজন”। কেন? সেই পুরানা বেকুবি যুক্তি। আর সেটাকেই আনন্দবাজারের তার শিরোনাম করে লিখেছে – [“ভারতকে বাঁধতে পারে হিন্দিই”,এক রাষ্ট্র, এক ভাষা চান অমিত শাহ]।
এই যুক্তিটা আসলে রাষ্ট্র না-বুঝ যারা এদের। এরা একই সঙ্গে যারা হিন্দু-শ্রেষ্ঠত্বের হিটলার একেকজন – “জয় শ্রীরাম” – এদের যুক্তি।
অমিতের কথা অনুযায়ী ভারতকে বাঁধতে পারে এমন “রশি” বা ভাল “আঠা” দরকার অমিতের। আচ্ছা নাগরিক কী বেধে রাখার জিনিষ? অমিত মনে করেন হাঁ; এজন্য দরকার একটা হিন্দুত্ব মানে, হিন্দুত্বের জাতীয়তাবাদ। না হলেও একটা হিন্দি ভাষার জাতীয়তাবাদ।
মোদী-অমিত শাহরা আসলে অসুস্থ চিন্তার লোক। কোন রাষ্ট্র গড়বার জন্য না হিন্দুত্বের মত কোন আদর্শ, না কোন ধরণের জাতীয়তাবাদ – কোনটার কোনই দরকার নাই। কোন দিন ছিলও না। কিন্তু ভুল বুঝা হয়েছে – জাতিরাষ্ট্র বা নেশন –স্টেট বলে এক সোনার পাথর বাটি ধারণা এসেছে। আর নাগরিককে রাষ্ট্রে ধরে রাখার জন্য কোন ভাষাগত ঐক্য বা ধর্মীয় ঐক্য অপ্রয়োজনীয়। যদি তাই হত তবে দ্রাবিড়ীয়রা কী হিন্দু ধর্মের বাইরের? পাঞ্জাব কী বৃহত্তর হিন্দি ধর্ম বা কালচারের বাইরের? এই ডিএমকে ১৯৬২ সালের আগে পর্যন্ত স্বায়ত্বশাসন বা বিচ্ছিন্ন হতে চাওয়ার দল ছিল। পাঞ্জাবের বিচ্ছিন্নতার সমস্যা এখনও একেবারে মিটে গেছে তা নয়। পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে আমাদের ধর্মীয় ঐক্য থাকা সত্বেও কী আমরা বিচ্ছিন্ন হই নাই! কেন এমন হয়েছিল?
রাষ্ট্রে ঐক্যবদ্ধ থাকতে মূল প্রয়োজন, অনিবার্য দরকার আসলে – বৈষম্যহীন নাগরিক অধিকার, নাগরিক নির্বিশেষে সবার সমান অধিকার, সমান সুযোগ – এমন এক “রাজনৈতিক নীতির ঐক্য”। এক পলিটিক্যাল কমিউনিটি কায়েম। এমন নাগরিক অধিকার ও মানুষের মর্যাদা রক্ষার প্রতিশ্রুতি এবং এর বাস্তবায়ন। রাষ্ট্রে জুলুম বন্ধ করুন, নাগরিক নির্বিশেষে কোন জুলুমে ভুক্তভোগী সবাইকে একটা ইনসাফ দেন। এমন ব্যবস্থা কায়েম করেন। মানুষকে বেধে রাখতে হবে না, কোনো বাড়তি রশি, আঠা কিছুই লাগবে না।
রাষ্ট্রগড়া প্রসঙ্গে, সবচেয়ে অপ্রয়োজনীয় টেনে আনা শব্দ বা নামটা আসলে নেশন, জাতি বা জাতীয়তাবাদ।
আমেরিকা রাষ্ট্রটা আদর্শ নয়। অনেক খুঁত ও ব্যর্থতাও এর আছে অবশ্যই। তবু খুঁটিয়ে দেখেন তো- আমেরিকান রাষ্ট্র গড়তে কোনও ধরনের জাতীয়তাবাদের ব্যবহার আছে কিনা? আমেরিকানেরা কারা ও কোন ‘জাতি’? পঞ্চাশ রাজ্যের সমাহার আমেরিকা। ভারতের চেয়েও বড়। তবু কোনও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন নাই কেন? নাগরিক বা খোদ কোন রাজ্যের পালিয়ে যাওয়া ঠেকাতে ওখানে রশি বা আঠা বলে কিছু, কোনো জাতীয়তাবাদ কী আছে? খুজে দেখেন!
তাহলে আমেরিকা-রাষ্ট্রটা টিকে আছে কী করে? অনেক দুর্বলতা আছে এর, কিন্তু ভাঙার, ভেঙ্গে পড়ার, এক না থাকার কোন কথা নেই।
আর ভারতের বেলায় দেখেন, কংগ্রেসের নিজের পরাজয় ঘটে গেছে বহু আগেই। আর দলটা এখন শুকিয়ে যাওয়াতে কংগ্রেসের আর ভারত ভাঙার কারণ হওয়ার সুযোগ বা উসিলা নেই। বিপরীতে এ থেকে শিক্ষা না নিয়ে একই ভুল করতে হিটলারি আগ্রাসী হয়ে হিন্দুত্ব, এক “জয় শ্রীরাম” হাতে এগিয়ে আসছে মোদি-অমিতেরা।
এরা আসলে হিন্দুত্বে ডুবে অসুস্থ হয়ে গেছে, আর ততটাই এরা রাষ্ট্র ধারণা ও চিন্তায় অবুঝ। এদের ধারণা হিন্দুর সবকিছুতে শত্রু হল মুসলমান। আচ্ছা তাহলে দ্রাবিড়ীয় যত নেতা আছেন, ডিএমকে এর নেতা স্টালিনসহ এরা কী মূসলমান? কলকাতার সিপিএম বা মমতা এরা? তা হলে? কথা হল, দ্রাবিড়িয়রা বা বাঙালিরা হিন্দু হলেও তারা অমিত-মোদীদের বিরোধী হবেই। কারণ তারা হিন্দি বলয়ের ক্ষমতার নামে ভুতুড়ে কেন্দ্রীয় ক্ষমতাটার বিরোধী। অমিত-মোদীরা এই চোরা আর ভুতুড়ে ক্ষমতায় বিশ্বাসী, এটাই তো আসল সমস্যা।
যেমন দেখেন, কেন্দ্রের হাতে জমা হওয়া রাজস্ব তা বিলি বন্টনে কোন রাজ্য কত পাবে কিসের ভিত্তিতে? – এটা রেখে দেয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর খেয়ালের হাতে, ব্যক্তি-ইচ্ছার বাইরে নিরপেক্ষতা ও অবজেকটিভ নিয়ম বা সুত্র রাখা হয়নি। যেমন মমতা মোদীর দলের না হওয়াতে তিনি মমতাকে চাপ সৃষ্টি করতে পারেন? মমতাকে যেকোন বিরোধিতার শাস্তি দিতে পারেন। এটা কি ইনসাফ? এর সোজা মানে এক রাজ্যের কাঁধে চড়ে আরেক রাজ্য খাচ্ছে। আর প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মোদী নিজে অথবা যাকে ইচ্ছা তাকে এটা খাইতে দিবেন। এটারই একমাত্র প্রতিকার ছিল ফেডারেলিজম [Federalism]। আমেরিকার মত ভারতেরও এক ফেডারল রাষ্ট্র হওয়া। এটা তো প্রমাণিত এখন যে “মহান” নেহেরু সাহেবের ভারত রাষ্ট্রের জন্মের শুরু থেকেই এনিয়ে কোন বুঝাবুঝি ছিল না। আস্থা ও সাহসের ঘাটতিও ছিল। কোন প্রমাণ রাখেন নাই যে তিনি ফেডারেলিজম বুঝতেন।
আবার মোদীকে দেখেন। ভারতের সিবিআই, ইডি বা গোয়েন্দা র – এসব প্রতিষ্ঠান তো আগে থেকেই ছিল। তাতেও মোদি সন্তুষ্ট নন, সম্ভবত পুরানগুলাকে ততখানি নিজদলীয় মনে হয় নাই। অথবা দলীয় করতে সময় লাগবে, যে সময় তার নাই। এখন বিজেপির প্রভাবে এন্টি টেররিজমের নামে গড়ে নেয়া হয়েছে অল্প বয়সী (২০০৯) নতুন আরেকটা এনআইএ (NIA)। আর এরপর এধরণের সব প্রতিষ্ঠানকে মোদী ব্যবহার করছেন (আগে কংগ্রেসও কমবেশি করেছে) বিরোধীদের দুর্নীতি ও অনিয়মের নামে তাদের শায়েস্তা করতে, এদের বিরুদ্ধে মামলা হয়রানি করতে পারেন এমন হাতিয়ার হিসেবে। অথচ এসব প্রতিষ্ঠানকে ক্ষমতাসীন সরকারের অপব্যবহার থেকে স্বাধীনভাবে কাজের আইন, নিয়ম ও নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করে দেয়ার বদলে উলটা তা ব্যাহত করে নিজদলীয় স্বার্থে এদের ব্যবহার করছেন মোদী। যেমন দেখেন, মোদীর প্রথম গত পাঁচ বছরে বিরোধীদের সমর্থন ছাড়া রাজ্যসভায় তাঁর সরকার কোন বিল পাস করতে পারেননি। এবার সিবিআই, ইডি, র ইত্যাদির ভয় দেখিয়ে বিরোধীদের বাগে এনেছেন। আর তা দিয়ে এবার মোদী-টু সরকারের প্রথম তিন মাসের আগেই “কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা বাতিল” – পাস করে নিয়েছেন। বিরোধীরা যে বাগে এসেছে এটা টেস্ট করার জন্য এর আগে মোদী-টু এর নতুন সরকার, তিনি “তিন তালাক বিল পাস” করে নিয়েছেন। অর্থাৎ ভারত রাষ্ট্র একটা অন্ধকারের ক্ষমতা একটা দাগী ক্ষমতার রাষ্ট্র হিসেবে রেখে দিতে চান মোদী-অমিতেরা। আর মুখে বুলি জয় শ্রীরাম আর হিন্দুত্ব। হিন্দি বা হিন্দুত্বের জাতীয়তাবাদ খুঁজে বেড়াচ্ছেন, এটা দিয়ে নাকি রাষ্ট্র এক রাখবেন!
মোদী-অমিত হিন্দি-হিন্দুত্বের আড়ালে এসব যা করছেন মূলত এজন্যই ভারত ভেঙে যাবে। ভারত ভাংবার কারণ হবেই মোদী-অমিত। আর তাদের ‘অন্ধকারের ক্ষমতার’ প্রতি আগ্রহ।
ভারতে কেন আঞ্চলিক দলের এত ছড়াছড়ি? মানে, রাজ্যভিত্তিক রাজনৈতিক দল যেমন ডিএমকে বা মমতার তৃণমূল – বিভিন্ন রাজ্যে এমন দলের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে কেন? এর সোজা জবাব, মূলত দায়ী নেহেরু ও তার কংগ্রেস। মানে তাদের রাষ্ট্র-চিন্তায় কিছু মারাত্মক ত্রুটি বা ঘাটতি। তাদের সর্বভারতীয় দলের নামে (১৯৪৭-৮৫) উত্তর ভারতের কোটারি ক্ষমতা দিয়ে সারা ভারতের সব রাজ্যকে দাবড়িয়ে চলেছিলেন। এক ভুতুড়ে ক্ষমতা, অন্ধকারের একটা দাগী রাষ্ট্রক্ষমতার প্রথম জনক এরা। আর এখন একেই একেবারে হুবহু কিন্তু আরও আগ্রাসী-হিন্দুত্ব দিয়ে ঢেলে সাজিয়ে, এবার কংগ্রেসকেই অনুসরণ করছে বিজেপি। আর প্রথম জমানায় কংগ্রেসের কালো ভুতুড়ে ক্ষমতার অত্যাচারেই আঞ্চলিক দল খুলার হিড়িক লেগেছিল। এরই ফলশ্রুতিতে বিগত (১৯৮৫- ২০১৮) এই সময় কালে লাগাতরভাবে কেন্দ্রে কোয়ালিশন সরকারই একমাত্র বাস্তবতা ছিল। মানে কংগ্রেস অথবা বিজেপি একা নিজ দলের সংখ্যাগরিষ্ঠাতার মুরোদে নয়, আঞ্চলিক দলের সাথে একমাত্র কোয়ালিশন করেই এরা ক্ষমতাসীন হয়েছিল। এই সময়কালে রেকর্ড বলছে, কংগ্রেস বা বিজেপি এইদুইয়ের যে দল কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টের মোট ৫৪২ আসনের মধ্যে নিজ দলের মুরোদে তা প্রাপ্ত মোট আসন তা ১১৫ ছাড়িয়েছিল তারাই গোটা দশেক আঞ্চলিক দলের সহায়তায় কেন্দ্রে সরকার করেছিল; যেখানে হাফ মার্ক বা সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল ২৭২ আসন। এটাই ছিল (১৯৮৫- ২০১৮) এই সময়কালের ফ্যাক্টস ও রেকর্ড। এর মানে এই সময় কালে কংগ্রেস বা বিজেপির চেয়ে সরকার গঠনে সবসময় আঞ্চলিক দলগুলো মোট সংখ্যা মানে ভুমিকাটা ছিল মুখ্য ও বেশি।
অথচ অমিত এখন “বাণীদাতা” হয়েছেন। উলটা বলতেছেন “আঞ্চলিক দলগুলোই নাকি ভারতের “অনৈক্যের” কারণ“। এটা হল রোগের লক্ষণকেই রোগ বলে চালানো চেষ্টা। ভারত-রাষ্ট্রগঠন কাঠামোর মধ্যে মূল সমস্যা হল, এখানে এক রাজ্যের অন্য রাজ্যের ঘাড়ে চড়ে খাওয়ার সুযোগ আছে। এই সুযোগ রেখে দেয়া হয়েছে। কারণ উত্তরপ্রদেশের কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ নেহেরু ঠিক এটাই চেয়েছিলেন। কারণ তার ধারণা ও বুঝ ছিল যে ভারতকে জবরদস্তিতে এক রাখতে চাইলে এমন ক্ষমতা কাঠামোই তাকে মাইলেজ বা বিশেষ সুবিধার ক্ষমতা দিবে। ভারতকে তথাকথিত এক রাখার ভুয়া ডরে নেহেরু এমন কাঠামোতেই ভারত গড়েছেন। এতে কেন্দ্র যার হাতে থাকে সে এই নির্ধারণ ক্ষমতাটা পায় যে কে কার ঘারে চড়বে ও খাবে। অর্থাৎ ভারত রাষ্ট্র ও এর ক্ষমতা ব্যবস্থা গড়ার সময়ের মৌলিক কাঠামোগত ত্রুটির জন্য এটা সম্ভব হয়ে আসছে। আর এর লক্ষণ হিসাবে মাত্র প্রায় ৩৮ বছরের মধ্যে কংগ্রেসের একক ক্ষমতার দল হিসাবে বিদায়, পরাজয় ও রাজ্যে রাজ্যে আঞ্চলিক দল জন্মানোর হিড়িক দেখা দিয়েছিল। কংগ্রেসের বদলে ঠিক সে জায়গাটাই নিতে আজ নতুন কুতুব হতে চেষ্টা করছে মোদীর -অমিতের বিজেপি। তাই এখন লক্ষণকেই রোগ বলে চালানোর চেষ্টা করছে। অমিত শাহ রাষ্ট্র-ক্ষমতা “জ্ঞানের” বিরাট তাত্বিক হয়ে উঠেছেন।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর আনন্দবাজার লিখেছে,
আজ দিল্লির ‘অল ইন্ডিয়া ম্যানেজমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন’–এর অনুষ্ঠানের মঞ্চে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘‘স্বাধীনতার ৭০ বছর পরে মানুষের মনে প্রশ্ন জেগেছে, বহুদলীয় সংসদীয় ব্যবস্থা আসলে ব্যর্থ কি না? ওই ব্যবস্থা কি দেশবাসীর লক্ষ্য পূরণ করতে পেরেছে?’’ তার পরে নিজেই জবাব দিয়েছেন,‘‘মানুষ আশাহত”। তাঁর দাবি,আঞ্চলিক দলগুলি আঞ্চলিক আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারেনি।
এই ইস্যুটাকে ভারতের বেশির ভাগ মিডিয়া দেশে এক দলীয় শাসনের ইঙ্গিত হিসাবে রিপোর্ট করেছে,। কলকাতার টেলিগ্রাফ একদলীয় পার্টির শাসনের ইঙ্গিত বলেছে। এভাবে ডিএনএ, লাইভমিন্ট, এশিয়ান-এজ অনেকেই।
কংগ্রেস বিবৃতি দিয়ে বিজেপির জোট এনডিএ-এর কোয়ালিশন দলগুলোকে জবাব দিবার দাবি জানিয়েছে। সারকথায় অমিতের যুক্তি হল, কংগ্রেস শক্তহাতে “হিন্দুত্ব” কায়েম এর এক কর্তৃত্ববাজ শাসন জারি করতে পারে নাই দেখেই এসব ঘটেছিল। কাজেই এখন শক্ত হাতে সেটা পূরণ করতে আগ্রাসী হয়ে বিজেপি শাসন করবে। কী তামসা!
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
এই লেখাটা এর আগে গত ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ওয়েবে ও পরদিন প্রিন্টে “অমিতের হিন্দি ভাষা-জাতীয়তাবাদ“ – এই শিরোনামে ছাপা হয়েছিল। পরবর্তিতে সে লেখাটাই এখানে আরও নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে এখানে ছাপা হল। ]
One thought on “হিন্দুত্বের পরে হিন্দি জাতীয়তাবাদ”