আসামকে একটা বেছে নিতে হবে
এনআরসির নখরা করবে, না পোর্ট-করিডোর নিবে
গৌতম দাস
২৫ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০৬ সোমবার
আর না, এবার আসাম নিয়ে ভারতকে বাংলাদেশের একথা বলার সময় হয়েছে যে, বাংলাদেশকে আসাম কিভাবে দেখতে চায় তার একটা বেছে নিতে হবে – হয় আসাম এনআরসি করতে আবার মেতে উঠবে, আর না হয় বাংলাদেশের পোর্ট-করিডোর ব্যবহার করতে চায় বলে আবেদন করবে। এদুটো একসাথে ভারত বা আসাম করতে পারবে না। এদুটো এক সাথে করার জিনিষ না। আসামকে পরিস্কার করে বলতে পারতে হবে যে আসাম মুল সমস্যা কোনটা? বিদেশি অনুপ্রবেশ? যেজন্য তাকে আবার এনআরসি করার রংঢং করতে যেতে চাচ্ছে? নাকি, অনুপ্রবেশ বা মাইগ্রেশন সমস্যা নয়। আসামের মূল সমস্যা যোগাযোগহীনতা; পশ্চিমবঙ্গ বা বাকি ভারতের সাথে আসামের ভাল কোন যোগাযোগ নাই, এটাই মূল সমস্যা। যদি তাই মানে তবে কোন ফেয়ার শর্তে আসামের বাংলাদেশের উপর দিয়ে করিডোর ফেসিলিটি দরকার এটা বলতে হবে। আর সেক্ষেত্রে বলাই বাহুল্য, করিডোর পাবার পরে বিদেশি অনুপ্রবেশ বা মাইগ্রেশনকে আর কোন সমস্যা বলার কিছু থাকবে না।
আর আমাদেরকেও ভারতকে (আসাম প্রসঙ্গে) পরিস্কার করে জানিয়ে দিতে হবে। আমাদেরকেও সরাসরি রেকর্ডের উপর দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারতে হবে, আর তা টোন সটান রেখে বলতে হবে। মুসলমানবিদ্বেষ বা বাঙালি খেদানোর আড়ালে ইসলামবিদ্বেষ ও ঘৃণার চর্চা সমুলে বন্ধ করতে হবে। মোদী-অমিতের এভাবে ধর্মীয় পোলারাইজেশনের জজবা তুলে ভোটের বাক্স ভর্তি করার রাজনীতি ও কৌশল বন্ধ করতে হবে। অন্তত, বাংলাদেশের সরকারের ঘাড়ে বন্দুক রেখে এই রাজনীতি করা যাবে না। মোদী-অমিতের আরএসএস যদি মনে করে ইসলাম ঘৃণা ছড়িয়ে হিন্দুভোট বাক্সে ভরা এটা তাদের রাজনীতির কোর [Core] কৌশল তাই তারা ছাড়তে পারবে না সেক্ষেত্রে আসাম কোন ফেয়ার শর্তেও বাংলাদেশের করিডোর পেতে পারে না। আসামের কোর সমস্যা যদি বাংলাদেশের কথিত মুসলিম অনুপ্রবেশ হয় তাহলে এর অর্থ দাঁড়ায় করিডোর না পেলেও আসামের তাতে কোন সমস্যাই নাই। অতএব আসামকে বেছে নিতে হবে, সে ঠিক কী চায়।
আসলে বটম লাইনটা হল, যত কিছুই জুলুম-বেইনসাফি করেন, চাই কি অন্যের ক্ষতি করার জন্য গর্ত খুঁড়েও রাখতে পারেন; কিন্তু শেষ পর্যন্ত ন্যায়-ইনসাফের জয়ডঙ্কা বেজেই উঠে; আর আপনারই সেই গর্তে পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হবেই। সম্ভবত এ জন্যই আমরা শুনি, ধর্ম বা ন্যায়ের কল বাতাসে নড়ে বেজে ওঠে। এনআরসি ইস্যুতে আসামে বিজেপি এখন স্বীকার করছে তারাই বুমেরাংয়ের শিকার হয়ে নিজের গোল নিজেরাই খেয়েছে। কলকাতার ইংরাজি দৈনিক টেলিগ্রাফের শিরোনাম Assam final NRC boomerangs মানে এনআরসি বিজেপির জন্যই বুমেরাং হয়েছে।
তথ্য লুকিয়ে রাখাঃ
এখনকার মোদী-অমিতের জন্য সবচেয়ে বেকায়দার বিষয় হল, প্রকাশিত হয়ে পড়া একটা তথ্য। আসামের এনআরসি তৈরিতে ফাইনাল যে তালিকা, তাতে বলা হয়েছিল ১৯ লাখ মানুষ নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে নানা কারণে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে ১৪ লাখই হিন্দু জনগোষ্ঠীর – তথ্যের এই অংশটা লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। ১৯ লাখের মধ্যে কতজন হিন্দু ও মুসলমান এই ভাগ করা দেখানো ফিগার, এটা লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। কখনোই কোনো সরকারি অফিস তা প্রকাশ করেনি।
এবার এই তথ্যই এখন আনন্দবাজার ও ইংরেজি টেলিগ্রাফ স্পষ্ট করে বলছে, এই সংখ্যা ১৪ লাখ। টেলিগ্রাফ লিখেছে প্রায় চৌদ্দ লাখই হল হিন্দু [ …19 lakh people excluded from the NRC in Assam, as many as 14 lakh were Hindus.]। আর আনন্দবাজার লিখেছে, “…এনআরসির-র চূড়ান্ত তালিকায় বাদ যান ১৯ লক্ষ মানুষ। যাদের মধ্যে অন্তত ১৩-১৪ লক্ষই হিন্দু”।
অর্থাৎ সর্বসাকুল্যে মুসলমান মাত্র পাঁচ লাখ। অর্থাৎ বিদেশী বলে কাউকে যদি আসাম দায়ী করতে চায় তবে সেক্ষেত্রে সিংহভাগ দায় একা হিন্দু জনগোষ্ঠীর, চার ভাগের তিন ভাগই। অথচ এত দিন তাদের প্রবল বিদেশী ঘৃণা তারা জমা করেছিল মূলত মুসলমানদের জন্য। কাজেই এখন এটা প্রমাণিত যে ১৯৫১ সাল থেকে আসামের বাসিন্দারা একটা আন্দাজ অনুমানের ধারনা নিয়ে মিথ্যা বলে আসছিল। তারা মিথ্যা নাকিকান্না গেয়ে আসছে বিদেশি মুসলমান অনুপ্রবেশের কথা তুলে।
তাই আসামের ফাইনাল এনআরসির ফলাফলে এটা এখন একেবারে হাতেনাতে ধরা পড়া নিজের পায়েই কুড়াল মারা। আসামজুড়ে এখন হতাশা আর হাহাকার; এমনকি আত্মহত্যাও। হতাশা, হাহাকার আর মন খারাপের কান্না উঠেছে মূলত হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যেই সবচেয়ে বেশি। পুষে রাখা ‘বিদেশী ঘৃণা” এখন প্রয়োগের জায়গা মিলছে না। কারণ, তারাই ওঁৎ পেতে বসেছিল যে, এবার বিদেশী বাঙালি-মুসলমানদের তারা ধরেই ছাড়বে! আর ফলাফলে বাদ পড়াদের মধ্যে হিন্দুদের বিশাল সংখ্যা দেখে বিজেপি পালিয়ে বেড়াচ্ছে, মুখ লুকিয়ে রাখছে।
পরিশেষে এখন বয়ান বদলে বলছে, এনআরসি তালিকা হয়েছে আদালতের হুকুমে, তাই এর ফল প্রকাশ হলেও আসাম সরকার নাকি তা অনুমোদন করেনি। নর্থ-ইস্টের এক ছোট অমিত শাহ আছেন, নাম হিমন্তবিশ্ব শর্মা। তিনি বিজেপির আঞ্চলিক সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা ও আসামের অথর্মন্ত্রীও। তিনি অমিত শাহের সাথে আওয়াজ তুলেছেন আসামের এনআরসি বাতিল হতে যাচ্ছে [Sarma said the Assam government had not accepted the final NRC,…]।
বাঙালিবিরোধী বিশেষত মুসলিম বাঙালিবিরোধী স্থানীয় অসমীয় সবগুলো পক্ষ কিছু আন্দাজি অনুমানে মনে ঘৃণা পুষে রাখতে রাখতে নিশ্চিত বিশ্বাস করে ফেলেছিল যে, তাদের সব দুঃখের কারণ বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দু-মুসলমান। যেটা আবার ২০১৬ সালের রাজ্য-নির্বাচনের পর বিজেপির রাজ্য সরকারের ক্ষমতায় এসে হিন্দুত্ববাদের ইসলামবিদ্বেষের কারণে তা এবার হয়ে যায় যে, আসামের সব দুঃখের কারণ নাকি বাংলাদেশের মুসলমান। এমনকি তারা এটাও বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল, কথিত এই দেশান্তরীরা নাকি স্থানীয় মোট অসমীয় জনসংখ্যাকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার জন্য ধাবমান। মনে রাখা দরকার, আসামের মোট জনসংখ্যা প্রায় তিন কোটি। আর এনআরসিতে নাগরিকত্ব প্রমাণ না করতে পারার ঝামেলায় আছে যারা, তারা মোট মাত্র ১৯ লাখ। কোনো পারসেপশনকে নিশ্চিত বিশ্বাস করে ফেললে এমনই হয়।
তাহলে আসামের প্রকৃত সমস্যা কীঃ
এই ঘটনা-প্রচারণার শুরু সেই ভারত স্বাধীন হওয়ার পরপরই ১৯৫১ সাল থেকে। কংগ্রেসসহ অসমীয় সব রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠন এতে শামিল ছিল। অর্থাৎ যেটাকে ইংরেজিতে বলে পারসেপশন মানে প্রমাণ ছাড়াই অনুমান, তা অসমীয় সমাজে খুবই প্রবল করে তোলা হয়েছিল। আসলে এক জেনোফোবিক [Xenophobic] বা মনের মধ্যে বিদেশী ঘৃণার চাষাবাদ করা হয়েছিল। বাংলাদেশ থেকে আসামে কখনো লোক যায়নি তা সত্য নয়। এমনকি ব্রিটিশ আমলে সরকার পরিকল্পিতভাবে জমি দেয়ার লোভ দেখিয়ে বাংলা থেকে লোক ডেকে নিয়ে ছিল। এ ছাড়া আইনত সেসময় আসাম তো তখন বিদেশও ছিল না। এরপর ১৯৭৯ সালে এসে এটাই সারা আসামের অসমীয় সব রাজনৈতিক ও সামাজিক পক্ষ সবাই এক প্রবল আন্দোলন গড়ে ফেলেছিল যে, এনআরসি National Register of Citizens (NRC) বাস্তবায়ন করতে হবে। বিদেশী বা মুসলমানদের বের করে দিতে হবে। বলা হয়ে থাকে, পরিণতিতে সে কালের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী এই দাবির সাথে আপস না করলে আসাম ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার দিকে চলে যেত; তাই তিনি ১৯৮৫ সালে “আসাম একর্ড ১৯৮৫’ (Assam accord 1985) নামে চুক্তিতে সই করে আন্দোলন থামিয়েছিলেন।
তবে আসামের প্রকৃত সঙ্কটের মূল কারণ একেবারেই অন্য খানে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান আলাদা রাষ্ট্র হয়ে ভাগ হয়ে গেলে পশ্চিমবঙ্গ আর পুরো নর্থ-ইস্ট (আসামসহ) এ দুইয়ের একেবারে মাঝখানের ভূখণ্ডটাই হয়ে যায় পূর্ব পাকিস্তান। অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের এই অবস্থান হওয়াতে ভারতের এ দুই ভূখণ্ডকে তা একেবারেই বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল। যদিও কেবল উত্তর-পশ্চিম কোণে, ২২ কিলোমিটারের এক “শিলিগুড়ি করিডোর” থেকে যায় যা এ দুই ভারত ভূখণ্ডের একমাত্র যোগাযোগ সূত্র। আর এতে মাঝের সাড়ে তিন শ’ কিলোমিটারের দূরত্ব হয়ে পড়ে সতের শ’ কিলোমিটার। আর মূল ভারতের সাথে মূলত আসামের (নর্থ-ইস্টের) এই যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি ও এর প্রভাবেই আসামের অর্থনীতি ও জীবনযাত্রা স্থবির হয়ে পড়েছিল। সেই থেকে আসামের প্রকৃত সব দুঃখের মূল কারণ হয়ে যায় এটাই।
কিন্তু অসমীয় সাধারণের চোখে এই অর্থনৈতিক নেতি প্রতিক্রিয়ার বিরাট ঘটনা তারা খালি চোখে দেখতে পাওয়ার চেয়ে সামনাসামনি বাঙালিদেরই তাদের বেশি চক্ষুশূল মনে হতে লেগেছিল। এমন হতে প্রচার-প্রপাগান্ডাও করা হয়েছিল। আসলে তারা নেতি প্রতিক্রিয়া বা ইমপ্যাক্টকে বুঝেছিল যথেষ্ট কাজ আর না পাওয়া যাওয়ার দিক বলে এই প্রপাগান্ডাই জয়লাভ করেছিল। অতএব, তাদের ব্যাখ্যা ছিল যে, বাঙালিরাই আসামে তাদের কাজ নিয়ে নিচ্ছে, ভাগ বসাচ্ছে। আর এখান থেকেই মনগড়া পারসেপশন যে বাঙালিরাই (মুসলিম) নাকি সংখ্যায় আসামে অসমীয়দের চেয়ে ছাড়িয়ে যেতে পারে। আর এখান থেকে জেনোফোবিক বা বিদেশী ঘৃণার মানসিকতা বিকশিত হয়ে পড়ার শুরু।
মজার কথা হল কেউই চোখ খুলে দেখেনি ব্যাপারটা আসলে কী, এমনকি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত অসমীয়রাও নয়। বরং তাদের মধ্যে এখান থেকেই এক অসমীয় জাতীয়তাবাদী ও দেশপ্রেমিক সাজার জোয়ার উঠেছিল। সম্ভবত চিন্তা করা ও বুঝাবুঝির কষ্ট করার চেয়ে জাতীয়তাবাদী ও দেশপ্রেমিক হয়ে যাওয়া ইতিহাসে সব সময় খুবই সহজ গণ্য হয়ে থাকে। সস্তা জাতীয়তাবাদকে এভাবে বেশি শক্তিশালী মনে হয়, এটাও তাই। তাই ১৯৭৯-৮৫ সালের ওই অন্ধ-শক্তিশালী আন্দোলন ঘটেছিল আসাম গণসংগ্রাম পরিষদ/ আসু, এই নামে সবাইকে নিয়ে। বাংলায় লেখা আসু এর মানে হল AASU (All Assam Students’ Union)। আর আসাম গণসংগ্রাম পরিষদ বা Assam Gana Sangram Parishad (AAGSP) এই সংগঠনটিই ছিল মূলত শিক্ষিত অসমীয় জাতীয়তাবাদী ও দেশপ্রেমিকদের সমর্থনের ওপর দাঁড়ানো সব অসমীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন। রাজীব গান্ধী চুক্তিও করেছিলেন এ’দুই সংগঠনের সাথেই। এই চুক্তি করতে রাজীব গান্ধীকে বাধ্য করার পিছনে অসমীয় উগ্র অহমিয়া জাতীয়তাবাদ গোষ্ঠির মুসলমান ও বাঙালি বলে এক {নেলি ম্যাসাকার বা, Nellie massacre and Khoirabari massacre} জবাই ম্যাসাকার করার ঘটনা ঘটিয়েছিল। কিন্তু আসাম একর্ড চুক্তি হয়ে যাওয়ার পরের আসামের কোনো রাজ্য সরকার চুক্তির বাস্তবায়ন মানে এনআরসি নিয়ে কোন কাজ শুরু করতে পারেনি বা করতে আগ্রহী হয়নি। শেষে ব্যাপারটা আদালতে নিয়ে গিয়েছিল আরেক অসমীয় জাতীয়তাবাদী ও দেশপ্রেমী এনজিও; নাম [Assam Public Works, an NGO]। আর যার তত্বাবধানে এর বাস্তবায়ন তিনি এক অসমীয় জাতীয়তাবাদী ও দেশপ্রেমিক একজন বিচারপতি রঞ্জন গোগোই। তিনিই আবার ভারতের প্রধান বিচারপতি হয়ে গেলে তাঁর আমলেই এটা শেষ হয়। সমস্যা হল এখন এনআরসির ফাইনাল তালিকা প্রকাশ হয়ে পড়ার পরে তাদের এই বিশেষ অর্জনের ভাগ নেয়া বা উতযাপন করার জন্য সেই অসমীয় জাতীয়তাবাদী ও দেশপ্রেমিকদের এখন দেখা যাচ্ছে না। কারণ তাদের অর্জনের চেয়েও অনেক বেশি হল এনআরসিতে ফেল করা ১৪ লাখ হিন্দুর কান্না ও হাহাকারের আওয়াজ, যার নিচে এরা সবাই নিজেরা লুকিয়ে যাবার সুযোগ নিয়েছে।
রঞ্জন গোগোই সদ্য অবসরে যাওয়া তিনি প্রধান বিচারপতি। কিন্তু তামসাটা হল, লম্বা ছয় বছরের কাজটি করেছেন একটা নির্বাহী বিভাগের কাজ হিসেবে ও নিজ তত্ত্বাবধানে। ইতিহাসের এ এক বিরল দৃষ্টান্ত এবং প্রবল ব্যতিক্রম যে, বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগের ভূমিকায় কাজে নেমে গিয়েছিল। কারণ এটাকে আসামীয়দের স্বার্থরক্ষার এক বিরাট বিপ্লবী কাজ মনে করত আসামীয়রা। যা এক বিরাট পবিত্র কাজই বটে। আর গোগোই এটাকে নিজের অসমীয় জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেম দেখানোর বিরাট সুযোগ মনে করেছিল। যদিও এখন আসামে তিনি উলটা পরিণত হয়েছেন কলঙ্কিতদের আরেকজন। অন্তত বিজেপির চোখে তো বটেই, আর আসামের পুরানা অসমীয় বিপ্লবীর চোখেও। অথচ পুরো প্রক্রিয়ায় বিজেপি সরকারের সাথে গোগোই-এর আঁতাত তিনি আড়াল করতে পারেননি। মধ্যপ্রদেশ ক্যাডার সার্ভিস থেকে প্রতীক হাজেরা – একে কে রঞ্জন গোগোই-এর জন্য বেছে এনে দিয়েছিল? আর গোগোই একে নিয়েই এনআরসি বাস্তবায়নের প্রধান আমলা কর্মকর্তা বানিয়েছিলেন কেন? এছাড়া আবার এনআরসি ফাইনাল তালিকা ঘোষণার কাজ শেষে, বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত কোনো কারণ না দেখিয়ে এই প্রধান বিচারপতি গোগোই-ই তাকে মধ্যপ্রদেশে ফেরত পাঠিয়েছিলেন। অর্থাৎ অসমীয় জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের সাথে হিন্দুত্ববাদের প্রবল হাত ধরাধরি আমরা দেখেছিলাম, যদিও তাতে কারও শেষ রক্ষা হয়নি।
আঁতাত শেষ পর্যন্ত টেকেনি। এনআরসির তালিকা এখন সব পক্ষের কাছে পরিত্যাজ্য, অপ্রয়োজনীয় অনাদরের এক দলিল। তাহলে এখন সেই ১৯৭৯ সাল থেকে যারা এনআরসি ঘোষণার জন্য আন্দোলন করেছেন; আজ এর পরিণতি দেখে তাদের মূল্যায়ন কী?
তাদের পারসেপশন এখন পুরোটাই মিথ্যা প্রমাণিত। আর খোদ আসামের হিন্দু বাসিন্দারাই সবচেয়ে অখুশি! আপসোস আর হায় হায় চলছে চার দিকে। আগেও প্রমাণিত ছিল, এখনো প্রমাণিত যে আসামের মূল সমস্যা বিদেশী বা মুসলমানেরা নয়; আসামের সমস্যা যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা ও এর দুর্বলতা। কিন্তু এত দিন তাহলে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার নর্থ-ইস্টের যোগাযোগ সমস্যার সমাধান বা বিকল্প খুজতে নিয়ে কিছু করেনি কেন? কারণ, এ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারগুলোর কিছু সুনির্দিষ্ট মনোবাঞ্ছা আছে। প্রথমত, তাদের ভয় হলো, নর্থ-ইস্টের রাজ্যগুলো ভারত ছেড়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে চলে যেতে পারে, চাই কি পড়শি চীনের সাথে যুক্ত হওয়া অথবা স্বাধীন হয়ে যেতে পারে। ভারত সরকার সব সময় এসবকেই প্রবল ভয় করে এসেছে।
দ্বিতীয়ত, ভারত আবার আসামের জন্য বাংলাদেশের ওপর দিয়ে কোনো করিডোর জোগাড় করে আনতে পারলেও তা এত দিন আসামকে দিলে ভারত নিজেই স্বস্তি অনুভব করবে না বলে মনে করে, এ জন্য মূলত এত দিন জোগাড় করেনি। ভারতের ভয় হয়, বাংলাদেশ থেকে নিয়ে এমন করিডোর দেয়া যাবে না, যা আসামের সীমান্তের অপর পারের চীনা ভুখন্ড এই অঞ্চলও ঐ প্রাপ্ত ব্যবহার করতে চেয়ে বসতে পারে। অর্থাৎ বাংলাদেশ করিডোর কেবল ভারতের ব্যবহারের জন্য এক্সক্লুসিভ নয়, একই সাথে তা চীনকেও ব্যবহার করার অফার ও সুযোগ দিতে চাইতে পারে। সম্ভাব্য সে ক্ষেত্রে চীনের ভারত-সীমান্তের লাগোয়া ঐ চীনা অঞ্চলের জন্য চীনও ভারতের কাছেও করিডোর চেয়ে বসতে পারে। আর তাতে চীন ভারতের নর্থ-ইস্টের ওপর দিয়ে পাওয়া হবু করিডোর পার হয়ে, এরপর একইভাবে বাংলাদেশের করিডোর (যা ভারতেরও পাওয়া একই করিডোর ফ্যাসিলিটি হবে) পার হয়ে বঙ্গোপসাগরে যেতে চাইবে বা বন্দর ব্যবহার করতে চাইবে। এটাই ভারত একেবারেই চায় না। এটা ভারত অনেকবার প্রকাশ করে জানিয়েছে। কারণ ভারতের ভয় হল এতে আসাম আগামিতে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। এ জন্য ভারতের চাওয়া বাংলাদেশ ভারতকে একা করিডোর দেবে, এক্সক্লুসিভ।
তবে ইতোমধ্যে গত ১০ বছরে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে আসাম থেকে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অংশ পর্যন্ত কোন এক্সক্লুসিভ করিডোর দিতে এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নাই – সেটি বিদ্যুৎ এর খুঁটি, মাটির নিচের জ্বালানি তেলের পাইপলাইন, রেল ও সড়ক অবকাঠামো যোগাযোগ, নাব্য নদীপথ ও বন্দর, সরাসরি দু-দু’টি সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া, সরাসরি কলকাতা পর্যন্ত বাস যোগাযোগ ইত্যাদি প্রায় সব ক্ষেত্রে। আর সবই এক্সক্লুসিভ, কেবল ভারত ব্যবহার করবে। এক কথায় এটা কোনো আঞ্চলিক করিডোর নয়, যা অঞ্চলের সবাই বাণিজ্যিক ব্যবহার করবে এমন নয়। এমনকি ভাইসভারসাও নয়। যে বিনিময়ে আমরা ভারত পেরিয়ে আমরা নেপাল বা ভুটানে যেতে পারব বা নেপাল-ভুটান বাংলাদেশে আসতে পারবে। আবার অবকাঠামো করিডোর সুবিধাগুলো- বিনিয়োগ ও পরিচালনার খরচের কী হবে তা অনিশ্চিত। আর নয়তো খুবই নামকাওয়াস্তে অর্থের বিনিময়ে। এই প্রসঙ্গে আনন্দবাজারে ছাপা হওয়া আজকের আহ্লাদিত রিপোর্টের দুটা লাইন এরকম – “সম্প্রতি ভারতের অনুরোধে ঢাকা তাদের দেশের ভিতর দিয়ে অসম-ত্রিপুরায় পণ্য পরিবহণের জন্য ‘ফি’ এক ধাক্কায় টন প্রতি ১০৫৪ টাকা থেকে কমিয়ে করেছে ১৯২ টাকায়“। এই ভাষ্যগুলো আমার লেখা একেবারেই না। খোদ আনন্দবাজারেরই খুশি আর আহ্লাদে লেখা ভাষ্য।
স্পষ্ট কথা স্পষ্ট বলা ও বুঝাবার সময় এটাঃ
এক কথায় বললে তাই, আর নয়; আমাদের এখন স্পষ্ট কথা স্পষ্ট বলা ও বুঝাবার সময় এসেছে। করিডোর বাণিজ্যিক জিনিষ তাই এখানে প্রেমের একান্ত উপহার দেয়ানেয়া ভাবা বা চালানো চলতে পারে না। এটা কাজ করবে না, বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থ আছে – এটা আমরা উপেক্ষা করতে পারবই না। আমরা সাধু-সন্ন্যাসি হয়ে গেলেও পারবে না। কারণ সন্ন্যাসিদেরও খেতে হয়, খাবার যোগাড় করতে হয়। করিডোরের অবকাঠামো বিনিয়োগ পরিচালনার খরচ তাহলে কে বইবে, বাংলাদেশের অর্থনীতি? কেন? কার কোন আবদারে?
ভারতের স্বার্থ যাই থাক, বাংলাদেশের জেনুইন স্বার্থের দিক থেকে বিচারে সে একমাত্র ভায়াবলভাবে করিডোর খুলতে পারে প্রথমত ও একমাত্র কেবল রিজিওনাল বা আঞ্চলিক করিডোর হিসাবে। এক্সক্লুসিভ করিডোর এই আত্মঘাতি চিন্তার প্রশ্নই আসে না। ব্যাপারটা রাষ্ট্রস্বার্থ তাই এটা আমাদের কারও ব্যক্তিগত মামা-খালা বা স্বামীস্ত্রীর ব্যাপার কখনই নয়, হতেই পারে না। এছাড়া মৌলিক ও সম্ভাব্য কিছু শর্তের দিকে যেখানে খেয়াল রাখতেই হবেঃ;
যেমন করিডোরে দেয়ার চিন্তাটা করতে হবেঃ ১. কাউকেই আগাম কেউ দেশপ্রেমিক নয় বলে প্রচারে যাওয়া এই ঝগড়াটা কাউন্টার প্রডাকটিভ হবে। এরচেয়ে বরং পজিটিভ এপ্রোচে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে ও দেশের স্বার্থগুলো নিয়ে কথাবলা ও চর্চা করতে হবে। এতে জনস্বার্থ ও দেশের স্বার্থবিরোধী চিন্তাগুলোকে সহজেই বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারব। ২. করিডোর দেয়া হবে একমাত্র আঞ্চলিকভাবে তবে সেই সাথে (নিরাপত্তার বিষয়টাসহ) তা বাংলাদেশের নিজ রাষ্ট্র-ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত। ৩. অবশ্যই কেবল বাণিজ্যিকভাবে অর্থাৎ কোন রাষ্ট্রের (স্পষ্ট করেই বলা দেয়া ভাল, চীন অথবা ভারতের তো নয়ই এমনকি আমেরিকারও নয়) কৌশলগত বা অন্য কোন স্বার্থ বিবেচনার দায় আমরা না নিয়ে। গত বিশবছরে শ্রীলঙ্কাকে আমরা দেখছি যেমন প্রায়ই সে ‘ভাগের বউ’ হয়ে যাচ্ছে, কখনও এর কখনও ওর। এমন বাংলাদেশ যদি আমরা এমন দুরবস্থায় না দেখতে চাই তাহলে এটাই আমাদের জন্য একমাত্র পথ, আগাম সাবধান হবার সম্ভবত শেষ সুযোগ। ৪. করিডোর অবকাঠামোতে বিনিয়োগ ও পরিচালনা আমাদের কর্তৃত্বে হতে হবে অবশ্যই, তবে পারস্পরিক স্বার্থ বুঝে পেলে পোষালে যে কেউ থেকে সহযোগিতা নেয়া যাবে। ৫. আঞ্চলিক করিডোর ব্যবহারকারী রাষ্ট্র সবাইকেই পরস্পরকে নিজ ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে অন্যকে বাণিজ্যিক করিডোর দিতে নীতিগতভাবে রাজি থাকতে হবে। ৬. বাংলাদেশের আঞ্চলিক করিডোরে আরও অবকাঠামো সুবিধা বাড়ানোর চেষ্টা বাংলাদেশই নিবে। ব্যবহারকারিরা তাদের ব্যবহারের স্বার্থের দিক থেকে পরামর্শ অবশ্যই রাখবে। টেকনিক্যাল ও রাজনৈতিক কনসালটেটিভ কমিটিতে ব্যবহারকারিরা তাদের স্বার্থ ও পরামর্শের কথা যেন জানাতে পারে সেব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু সব সিদ্ধান্ত বাংলাদেশই একা চুড়ান্ত করবে। আর তা দিবার নীতিগত দিক হবে – তা দেবে শতভাগ বাণিজ্যিকভাবে এবং কেবল বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য এবং এক্সক্লুসিভ বাংলাদেশের নিজস্ব বাহিনী দিয়ে সাজানো নিরাপত্তা- নিশ্চয়তাসহ সব সার্ভিস দেয়া হবে। আর অবশ্যই কোন অবকাঠামো ফেসিলিটি এই সার্ভিস কোন সামরিক স্বার্থে ও উদ্দেশ্যে কোনো রাষ্ট্রকে দেয়াই হবে না, ব্যবহারকারি সকলকেই এর আগাম নিশ্চয়তা ও প্রতিশ্রুতি দেয়া থাকবে আর তা কঠোরভাবে মেনটেন করতে হবে। ইত্যাদি।
ভারতের প্রণব মুখার্জি তিনি রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে অনেক বছর ভারতের অর্থ বা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিল। তিনি ২০০৯ সালের দিকে বলতেন, “ভারতকে বাংলাদেশের বাণিজ্যিকভাবে করিডোর দেয়ার কথা ভাবতে হবে”। বলাই বাহুল্য, ভারত নিজেই এখন সে জায়গায় নেই।
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, বাণিজ্যিক করিডোর সুবিধাকে অর্থনৈতিক দিক থেকে ভায়াবল করতে গেলে এর সর্বোচ্চ ব্যবহার, মানে এর আঞ্চলিক ব্যবহারও নিশ্চিত করতে হবে। এ দিকটি গুরুত্বপূর্ণ, না হলে কোনো করিডোর ব্যবস্থাপনা কার্যকরভাবে টিকতে পারবে না। ফি’ এক ধাক্কায় টন প্রতি ১০৫৪ টাকা থেকে কমিয়ে করেছে ১৯২ টাকায় – এটা কোন বুদ্ধিমান গ্রহিতা বা দাতার ব্যবস্থা হতেই পারে না। কোন বাণিজ্যিক ব্যবস্থা কী একপক্ষীয় লাগাতর লোকসানে চলতে পারে? এই ব্যবস্থা ডুবতে আর অকার্যকর হয়ে ভেঙ্গে পড়তে বাধ্য। একথাটাই প্রমাণ যে দাতা ও গ্রহিতা এখানে কোন লেবেলের নাদান। কোন বাণিজ্যিক স্বার্থের বিষয় এভাবে চলতে ও টিকতেই পারে না। বাংলাদেশের সরকার চাইলেও এর খরচ একা ভার বয়ে বা ভর্তুকি দিয়ে এটা চালাতেই পারব না। আর একাজ করতে গিয়ে বাংলাদেশ যদি দেউলিয়া হয়ে যায়, স্বভাবতই তাতে করিডোর সুবিধা যদি মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায় এতে ভারতেরও ক্ষতি কোন অংশে কম হবে না। আর তাতে আসাম আবার ১৯৫১ সালের সময়ের অবস্থায়, প্যাভেলিয়নে ফিরে যাবে। রাষ্ট্র চালানো যা আসলে এখানে আঞ্চলিক রাষ্ট্রস্বার্থ পরিচালনা – এগুলো নিম্ন মধ্যবিত্ত এর সংসার চালানো নয়। কাজেই ১০৫৪ টাকা থেকে কমিয়ে করেছে ১৯২ টাকায় – এটাতে ভারতের মেলা লাভ হয়েছে এভাবে ব্যপারটাকে দেখা এটা মারাত্মক পেটি-মধ্যবিত্তের চিন্তা। ফি দেয়াকে কম বা না দেয়ার অবস্থায় নিলে এই করিডোর সার্ভিসটাই বন্ধ হয়ে যেতে বাধ্য। কারণ বাংলাদেশে একবার করিডোর চালু হয়ে গেলে আসামে বিপুল বিনিয়োগ (রাষ্ট্রীয় ও প্রাইভেট ) আসা ও ঢেলে দেয়া শুরু হয়ে যাবে। এখন বাংলাদেশকে ফি না দেওয়াতে যদি করিডোর সার্ভিস হঠাত বন্ধ হয়ে যায় তাতে ভারতের এই বিনিয়োগগুলো অবশ্যই পথে বসবে – সে ক্ষতি বাংলাদেশের নিজস্ব যা হবে তা তো হবেই; কিন্তু ক্ষতি ভারতের যা হবে সেটাও কী বাংলাদেশের হবে? ভারতে বুদ্ধিমান ব্যবসায়ী থাকলে তারা এটা আগেই ধরতে পারবে। এতে ভারতের কোন লাভটা হাসিল হবে – এদিকটা চিন্তা করার ক্ষমতা মারাত্মক ক্ষতিকর আত্মধবংসী পেটি-মধ্যবিত্তের থাকে না। আনন্দবাজার সেই মারাত্মক পেটি-মধ্যবিত্ত লেবেলর চিন্তাকারিদের পত্রিকা।
যে রাষ্ট্র কোন প্রকল্পে কোনটা নিজের আসল অর্থনৈতিক স্বার্থ বা এমন বিবেচনাগুলো আমল করতেই অক্ষম সে নিজে ডুবে যাবেই, পড়শি রাষ্ট্রকেও ডুবাবে।
কিছু উপসংহারঃ
আসামসহ পুরো নর্থ-ইস্টকেই বাংলাদেশের করিডোর সুবিধার অনেক কিছুই দেয়া শুরু হয়ে গেছে। এতে বাংলাদেশের স্বার্থ কতটুকু কী দেখা হয়েছে, কিংবা হয়নি এ নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা-সমালোচনা তোলার বিরাট দিক আছে। সেটি যাই হোক, কিন্তু বাস্তবতা হল – করিডোর সুবিধা দেয়া হয়ে গেছে। এর সরল অর্থ আসামের মূল সমস্যার সমাধানকেই আমলে নিয়ে তা সরাসরি সমাধান করা শুরু হয়েছে বলা যায়। আর সেখানেই বাংলাদেশ এক বিরাট সহযোগিতা দাতা এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায়। অথচ এদিকটা এই গুরুত্বপুর্ণ দাতা তাকে এখনও বিপ্লবী অসমীয় জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমীরা সহ সারা নর্থ-ইস্ট এখনও চিনতেই পারে নাই। গুরুত্বটাই বুঝতে পারে নাই। তাই দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কী দিয়ে তা বুঝা গেল?
বহু পুরানা দিন থেকে – মুসলমান অনুপ্রবেশকারী, উইপোকা, তেলাপোকা এসব বলা অমিত শাহ এন্ড গং এরা করে চলে আসছে। আমরা বুঝি ও জানি মুসলমান অনুপ্রবেশকারী, উইপোকা, তেলাপোকা এসব বলে ধর্মীয় পোলারাইজেশন করা বিজেপির নির্বাচনী রাজনীতি। যার সোজা মানে হল সারা অসমীয় জনগোষ্ঠি অমিত শাহের এই ঘিনঘিনে ঘৃণার বক্তব্য খুবই স্বাদ করেছে খেয়েছে। মজা পেয়েছে। খুব ভাল লেগেছে তাদের – কেমন ভাল লেগেছে এর প্রমাণ হল গত ২০১৬ সালে তারা বিজেপিকে প্রথম আসামে ক্ষমতায় এনেছে, সে সরকার গেড়ে বসেছে।
অর্থাৎ প্রতিটা অসমীয় মানুষের কোর-স্বার্থের সমাধান-দাতা হল বাংলাদেশ। কিন্তু সারা আসামসহ ভারতে বাংলাদেশের মুসলমানেরা হল উল্টা আসামি। কারণ তাদের অপরাধ তারা মুসলমানপ্রধান। নৃশংস অমিত শাহ এই তেলাপোকা পিষে মারার প্রচার করে চলেছে। আবারও করবে সেই হুমকিও দেয়া শুরু করেছে। কারণ ২০২১ সালে আবার আসাম নির্বাচন। এর সোজা অর্থ ভারত বাংলাদেশ থেকে করিডোর নেওয়ার ও পাবার জন্য যোগ্য পার্টনারই নয়।
কাজেই আমাদের দিক থেকে কথাটা হল, আসামের মৌলিক সমস্যার দিকটি স্বীকার না করে এত দিন বিদেশী, মুসলমান, তেলাপোকা, উইপোকা ইত্যাদি বলে যে কৃত্রিম কারণ দেখিয়ে চলেছিল তা একেবারেও অগ্রহণযোগ্যই শুধু নয়, বরং প্রমাণই হয়েছে যে
মুসলমান অনুপ্রবেশকারী, উইপোকা, তেলাপোকা ইত্যাদি বলে যারা ঘৃণা ছড়িয়ে চলছে দমকে দমকে তারাই সব সমস্যার মূল। তাহলে এখন এটা স্পষ্ট ভারতকে যদি আসামের জন্য বাংলাদেশ থেকে যে শর্তেই করিডোর নিতে চাইতে হয় তবে মুসলমানবিদ্বেষ সমুলে ছাড়তে হবে, বার বার এনআরসির নামে নখরা তাকে সবার আগে বন্ধ করতে হবে।
অথচ বিজেপির ক্রমাগত সারা ভারত জুড়ে মুসলমানবিদ্বেষের দামামা বাজিয়েই চলেছে। ভারত কী নিজের স্বার্থেই এমন কিছুই করতে বা বলতে পারে না, যার ঢেউ বা আঁচ বাংলাদেশে এসে পড়ে বা আমরা শঙ্কিত হই অথবা সীমান্তে মানুষের ঢল নামে অথবা ঢল নামে কি না সে শঙ্কা তৈরি হয়। আল্লাহ ভারতকে অন্তত কিছু জ্ঞানবুদ্ধি ওয়ালা মানুষ দেক এমন সকল নাগরিককে বিশেষত আসামের কে নিজ স্বার্থের কথা ভাবতে যোগ্যতা দেক, দোয়া করি।
ভারত ও আসামকে তাই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা বাংলাদেশ থেকে ঠিক কী চায়? করিডোর পাওয়ার আগ্রহ থাকলে এনআরসির অছিলায় কোনো নির্বাচনী নুইসেন্স, মুসলমানবিদ্বেষ বিজেপির বন্ধ করতেই হবে। করিডোর পেতে চাইলে উপযুক্ত যোগ্য ও দায়ীত্ববান পার্টনার হতে হবে।
আসাম ঠিক কী চায় সে এনআরসির নামে মুসলমান খেদানোর চেষ্টার মত্ত উন্মাদ হবে নাকি দায়ীত্ববান হিসাবে বাংলাদেশ থেক পোর্ট-করিডোর নিতে চায় – কোনটা সে চায় এটা স্পষ্ট করে বলতেই হবে। ঘটনা কিন্তু ইতোমধ্যেই করিডোর বাস্তবায়ন করতে অক্ষম হয়ে পড়বে, এই সুবিধা ব্লক হয়ে যাবে এঅবস্থার সেদিক মোড় নেয়া শুরু করেছে, যেটা বাংলাদেশের সরকার চাইলেও ঠেকাতে পারবে না।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
[এই লেখাটা গত ২৩ নভেম্বর ২০১৯ দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ওয়েবে ও পরদিন প্রিন্টে “আসাম এনআরসি করবে না পোর্ট-করিডোর নেবে?“ – এই শিরোনামে ছাপা হয়েছিল। পরবর্তিতে সে লেখাটাই এখানে আরও নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে এখানে আজ ছাপা হল। ]