এশিয়ায় আমেরিকান প্রভাব কী ফিরতে পারে


এশিয়ায় আমেরিকান প্রভাব কী ফিরতে পারে

গৌতম দাস

৩০ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০৫ সোমবার

https://wp.me/p1sCvy-2Qz

_

চারদিকে বলাবলি শুরু হয়েছে, আমেরিকা নাকি ফিরে আসছে। অন্তত চেষ্টা করছে। ফিরে আসার অর্থ হল, দুনিয়াজুড়ে পরাশক্তিগত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের প্রভাববলয় ছিল আমেরিকার। চলতি শতকের শুরু থেকে চীনের অর্থনৈতিক উত্থান চোখে পড়ার পর্যায়ে গেলে এর প্রতিক্রিয়ায় আমেরিকার প্রভাববলয় ভেঙ্গে পড়া শুরু করেছিল। সেই পুরানো প্রভাবে আবার ফিরে আসার চেষ্টার কথা বলা হচ্ছে এখানে। তাও সেটা আবার বিশেষ করে এশিয়ায়; মানে এশিয়ান প্রভাববলয় ফিরে গড়ে নিতে চায় আমেরিকা। কিন্তু সমস্যা হল, এশিয়ায় আমেরিকান প্রভাববলয়ের নিজ আয়ু শেষ হওয়ার আগেই আমেরিকা যদি নিজেই নিজের আয়ু ধরে টানাটানি করে, তাহলে সেটা ঠেকাবে কে? আসলে সেই টানাটানিতেই আমেরিকান প্রভাব বলয়ের আয়ুর অকালমৃত্যু ঘটেছিল।

বাস্তবতা হল, অন্য মহাদেশের অবস্থা যাই হোক, এশিয়ায় আমেরিকান প্রভাববলয় বজায় থাকার শর্ত এখনো আছে, নিঃশেষিত হয়নি সম্ভবত। কিন্তু বাস্তবে সেই প্রভাব নেই বা চোখে পড়ে এমন লেবেল থেকে নিচে নেমে গেছে। আর তা মূলত আমেরিকার নিজ ভুল নীতি-পলিসির কারণে। এককথায় সেই নীতিটা হল – দক্ষিণ এশিয়ায় নিজ কথিত “নিরাপত্তা স্বার্থ” ভারতের চোখ দিয়ে দেখার আমেরিকান সিদ্ধান্ত। বিশেষত এশিয়ায় তথাকথিত আমেরিকান নিরাপত্তা্র স্বার্থও নাকি আমেরিকা ভারতের চোখ দিয়ে দেখবে। চলতি শতকের প্রথম দশক থেকেই এটা শুরু হয়েছিল। ভারত নিজের সিকিউরিটি স্বার্থ দেখলে তাতে নাকি আমেরিকান সিকিউরিটি বা নিরাপত্তা স্বার্থও, মানে ওয়্যার অন টেররের জন্য প্রয়োজনীয় ‘নিরাপত্তা স্বার্থ’ দেখা হয়ে যাবে। ভারত-আমেরিকার বুঝাপড়া নাকি এত গভীর মাত্রার!

কিন্তু এটা আমেরিকার ‘নিরাপত্তা স্বার্থ’ বলে চালিয়ে দিলেও এটা কোনো “নিরাপত্তা” স্বার্থই ছিল না। তাহলে কী স্বার্থ এটা? এটা আসলে ছিল আমেরিকার ‘চীন ঠেকানোর’ [china containment] স্বার্থ। এই এসাইনমেন্ট সে ভারতকে দিয়ে করাতে গিয়ে বিনিময়ে সে ভারতকে এশিয়ায় ভারতের পড়শি কিছু রাষ্ট্রে একটা মাতবরি করতে দিয়েছিল বা প্রশ্রয় দিয়েছিল। যেটা ব্যবহার করে ভারত আজ আসামের জন্য বিনা পয়সার করিডোর ইত্যাদি লুটছে, এটা এর একটা উদাহরণ। কিন্তু আজ সেটাও কমপক্ষে ১২ বছর হয়ে গেল। এর পরিণতি ও ফলাফল কী হয়েছে? সেই স্টক টেকিং বা তাতে আমেরিকার লাভ-ক্ষতি কী হয়েছে, সেই হিসাব বুঝাবুঝি করে নেয়ার সময় হয়ে গেছে।

আমেরিকার বারাক ওবামার দুই মেয়াদ, অর্থাৎ আট বছরের (২০০৯-১৬) সময়কালে উল্লেখযোগ্য দু’টি গুরুত্বপূর্ণ নীতি-পলিসি নেয়া হয়েছিল। এর এক. আরব স্প্রিং আর দুই. চীন ঠেকানো (কন্টেইনমেন্ট)। এর মধ্যে আরব স্প্রিং যা ছিল আল কায়েদা ফেনোমেনার বিস্তার কালে মূলত মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্রগুলোতে নির্বাচিত সরকার কায়েম ও এক লিবারেল শাসন কায়েম করার প্রোগ্রাম। সাধারণভাবে এর পরিণতি কী হয়েছে তা এককথায় বললে, আমেরিকার আরব স্প্রিংয়ের প্রোগ্রাম ফেল করেছে। যেটা সামগ্রিকভাবে অন্তত মিসরে ফেল করেছে, একমাত্র তিউনিসিয়া তা এখনো টেকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। আর বাকি সব মুসলিমপ্রধান দেশেই মূলত আমেরিকার মারাত্মক কিছু “অসততা” প্রয়োগের জন্য তা ফেল করেছে।

এমনিতেই আমেরিকান পলিসি মাত্রই যেন সেটা ঘোষিত পলিসির সাথে সাথে আড়ালে দুই-একটা লুকানো এজেন্ডাও থাকবেই, এটাই হয়ে গেছে আমেরিকান প্রাকটিস। এই লুকানো এজেন্ডা মাত্রই এগুলো মূলত আমেরিকা ন্যূনতম স্বচ্ছতা ও সততা বজায় রাখে না বা পারে না এমন কিছু বাড়তি তৎপরতা। যেমন- লিবিয়ায়, আরব স্প্রিংয়ের নামে গাদ্দাফিকে প্রত্যক্ষভাবে খুন করাই ছিল এর লুকানো লক্ষ্য। অথচ বাইরে বলেছে, আরব স্প্রিংয়ের সংস্কার এর লক্ষ্য। ফলাফল কী হয়েছে? গাদ্দাফিকে নৃশংসভাবে পাবলিকলি খুন করা হয়েছে। কিন্তু তাতে আমেরিকার তেমন কিছুই সফলতা কি এসেছে, তা কেউ বলতে পারবে না।

বরং লিবিয়া এখন হয়েছে রাষ্ট্রহীন এক ভুখন্ড। কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা বিভক্ত হয়ে গেছে আর ওয়ার লর্ডদের শহর হয়ে আছে লিবিয়া এখন। আর শুধু তাই না, সেকালের ওবামা-হিলারি ভেবেছিলেন তারাই একমাত্র ও খুবই বুদ্ধিমান আর দক্ষ। কিন্তু না, তা একেবারেই নয়। গাদ্দাফি লিবিয়া থেকে ক্ষমতাচ্যুত ও খুন হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু ওবামা-হিলারির কাফফারা দেয়া শুরু হয়েছিল সেই থেকে। পাল্টা চার আমেরিকান – রাষ্ট্রদূত ও তাঁর সহকারী আর সাথে দুই সিআইএ অপারেটর সবাই বেনগাজি এম্বাসির ভিতরেই খুন হয়ে গেছিলেন। আর তা হয়েছিল যারা ওই খুনের পরে আইএস নামে আত্মপ্রকাশ করছিল সেই হবু আইএস, তাদেরই হাতে। ওদিকে প্রায় একইভাবে সিরিয়াও ছারখার হয়ে গেছে। যদিও পুতিনের কারণে প্রেসিডেন্ট আসাদ টিকে গেছে, কিন্তু তার দেশ-রাষ্ট্র সব শেষ, নরক হয়ে গেছে।

এরপরেও এখন কী সব থিতু হওয়া আর পুনর্গঠন কী শুরু হয়েছে? না, তা আসার কোনো আশু সম্ভাবনা নেই। কিন্তু এমন সিরিয়া থেকেও কোনো লাভালাভ কিছুই আমেরিকা নিজের ভোগে লাগাতে পারেনি। তাহলে এই আরব স্প্রিংয়ের আমেরিকার লাভ হল কী? এদিকে শেষবেলায় এসে ন্যাটো সদস্য তুরস্ক এখন খোদ আমেরিকার বিরুদ্ধেই সদর্পে দাঁড়িয়ে গেছে। তাহলে স্টক টেকিং এর ফলাফল হল এই যে, আমেরিকান এই প্রকল্পের সবটাই পানিতে গেছে। আর তা গেছে মূলত লুকানো এজেন্ডার কারণে।
তবে অন্য কথা হল, আরব স্প্রিংয়ের তৎপরতার সব বলতে এতটুকুই নয়। আরো যেসব স্টান্ডিং প্রোগ্রাম ছিল ও আছে, সেগুলো রুটিনমাফিক এখনো চলছে বিশেষত, যেসব এম্বাসি-ভিত্তিক প্রোগ্রাম আছে যেগুলো ‘লিডারশিপ’ বা ‘ইয়ুথ’ [Leadership, Youth]- এই শব্দ দুটো সেখানে আছে বা থাকবেই এমন ইউএসএইড ফাইন্যান্সড, এনজিও প্রোগ্রাম সেগুলো।  এগুলো আসলে আরব স্প্রিং প্রোগ্রামের আরও কিছু দিক।  তবে মোটা দাগে বলা যায়, আমেরিকান কোনো পলিসি লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে না, মূলত তার ভেতরে প্রায়ই কিছু লুকানো এজেন্ডাও সাথে বাস্তবায়নের চেষ্টা করতে যাওয়া হয়, মূলত এর দায় নিতে যায় বলে।

দ্বিতীয় আমেরিকান পলিসির নাম বলেছিলাম-  চীন ঠেকানো বা কন্টেনমেন্ট। বুশের হাতে শুরু হয়ে দুই বছর চলার পর এটা ওবামার আট বছর ধরে চলে শেষে এই পলিসিও পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে যায়। কিসের ভিত্তিতে এই পলিসিকে ব্যর্থ বলছি? প্রথমত, ‘চীন ঠেকানোর’ পলিসি মানে অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রভাবশালী হয়ে ওঠা চীনের উত্থান ঠেকানো। বুশ-ওবামা এমন উত্থিত চীনের গায়ে ফুলের টোকাও লাগাতে পারেননি। ঠিক যেমন আমেরিকা উত্থিত হয়েছিল উনিশ শতকের শেষ ভাগে (১৮৮৩ সালের দিকে) এবং তা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৮) আগেই;  আজকের চীনের মতই ছিল সেই আমেরিকার উত্থান  – সেকালের কলোনি মালিক ব্রিটেন বা ফরাসিরা এদেরকে ছাড়িয়ে আমেরিকান উত্থান ঘটে গিয়েছিল। অর্থাৎ তারাও আমেরিকার উত্থান কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। সেকালের বুদ্ধিমান আমেরিকানরা বলত এটা এক আমেরিকান সেঞ্চুরির দিন আসতেছে! তাসত্বেও এথেকে কোন শিক্ষা না নিয়ে একালে চলতি শতকে বুশের আমলে আমেরিকার কিছু ‘আবেগি ইমোশনাল ফুল” – নীতিনির্ধারক ভেবেছিলেন তাদের প্রাণপ্রিয় আমেরিকা বুঝি চীনের উত্থান ঠেকিয়ে রাখতে পারবে; অন্তত বেশ কিছুদিন, তাতেই অনেক ফায়দা হবে, আমেরিকার। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় গাধা বা বোকাটা ছিল বারাক ওবামা। আয়ারল্যান্ড সফরে (মে ২০১১) গিয়ে এক পাবলিক বক্তৃতায় তিনি দাবি করেছিলেন “দুনিয়াকে আমরাই এখনও শাসন করে যাব”।  সে যাই হোক, এশিয়ার দুটা রাইজিং ইকোনমি চীন ও ভারত, এদের একটাকে দিয়ে অন্যটাকে ঠেকিয়ে দিতে হবে – আমেরিকা এই কুটনীতির কথা তখনকার তাদের প্রধান শান্ত্বনা ছিল।  মনে করা হয়েছিল, এতে চীনের বদলে এশিয়ায় সবখানে না হোক, অন্তত ভারতের পড়শি রাষ্ট্রগুলোতে  চীনের বদলে ও তুলনায় ভারতের প্রভাব বাড়বে, প্রভাব বেশি করা সম্ভব হবে। এতেই চীন ঠেকবে, দমে যাবে ইত্যাদি।

না, বাস্তবে সেসব কিছুই করা সম্ভব হয়নি তা আমরা এখন দেখতেই পাচ্ছি। না আমেরিকা, না ভারত এনিয়ে কিছু করতে পেরেছিল। এর কিছুই হয়নি। ফলে চীনা উত্থান ঠেকানোর দিক থেকেও এই পলিসিও ব্যর্থ অবশ্যই। আবার আমেরিকান পলিসির দিক থেকে এটা শুধু ব্যর্থ হয়ে শেষ হলেও তাও হত। না তা নয়। ভারতের পড়শি রাষ্ট্রগুলোতে এখন বাংলাদেশ সহ অন্য যেকোন পড়শি দেশে ভারতের প্রভাব যেমনই থাক এসব রাষ্ট্রের উপর অন্তত আগে আমেরিকার যে ট্র্যাডিশনাল প্রভাব ছিল, সেসবেরও কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। কারণ আমেরিকা তার যাঁতা-কাঠি (আমাদেরকে চাপ দিয়ে করিয়ে নিবার জন্য আমেরিকার যা সক্ষমতা ছিল এরই হাতিয়ার) নিজের কথা ভুলে ভারতকে দিয়ে দিয়েছিল। আর ভারত সেই আমেরিকান ক্ষমতা পেয়েও তা নিজের প্রভাব তৈরিতে কাজে লাগাতে বা নিজের বলয় তৈরিতে তা কাজে লাগানো বা ধরে রাখতে পারেনি। মূলত প্রভাব ফেলতেই পারেনি। চীনের কাছে বারবার প্রায় সবক্ষেত্রেই ভারত হেরে গেছে মূলত দু’টি কারণে। এক বিনিয়োগ সক্ষমতার দিক থেকে চীনের মত ভারত চীনের ক্ষমতার সমান কেউ নয়, এর ধারেকাছের কেউ নয়। আর দ্বিতীয়ত, ভারতের জন্ম থেকেই নেহরু অনুসৃত ‘কলোনিয়াল চিন্তার’ অনুসৃত নীতি ও ব্যুরোক্রাটদের নেহেরু-মানসিকতা। এর সবচেয়ে পারফেক্ট উদাহরণ হল নেপাল।

নেপালে মাওবাদী সশস্ত্র আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৯৯৫ সাল থেকে, যা ২০০৭ সালে নেপালি রাজতন্ত্র উৎখাত করে শেষে নতুন নেপাল রিপাবলিকের কনস্টিটিউশন রচনার সমাপ্তির ঘোষণা দিতে  পেরেছিল ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে। [আমার লেখা “নতুন নেপাল” বইয়ের প্রসঙ্গ এটাই ]। এই পুরো সময়ের মধ্যে চীন নেপালের কোন কিছুতেই কেউ ছিল না; রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কোনভাবেই সম্পর্কিত কেউ ছিল না। অথচ হঠাত করে ২০১৬ সালের শুরু থেকে চীন নেপালের এক বিরাট ত্রাতা হিসেবে হাজির হয়ে যায়। কারণ, ভারত নেপাল অবরোধ করে বসেছিল। মানে ল্যান্ডলক নেপালকে এতদিন ভারতের উপর দিয়ে সমস্ত আমদানি করা অনুমতি ছিল তা ভারত নিষিদ্ধ করে দেয় এক সীমান্ত অবরোধ আরোপ করে।  মূলত এটাই ভারতের চরমতম ভুল নাড়াচাড়া আর তা থেকে নেপালি প্রতিটা সাধারণ মানুষ পর্যন্ত ভারতকে প্রচণ্ডভাবে সবচেয়ে ক্ষিপ্ত ও ঘৃণা  অপছন্দ করতে শুরু করেছিল। কারণ নেপাল জ্বালানিতে বিশেষ করে রান্নার গ্যাসে শতভাগ ভারতের উপর নির্ভরশীল। তাই পণ্য অবরোধে জ্বালানির অভাবে গরীব মানুষ ও নারীদের জীবন সবচেয়ে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। অথচ মাওবাদীদের কাজ ও রাজনীতি – “নতুন নেপাল” গড়া  – এই কাজটা সহজ করে দিয়েছিল কিন্তু আমেরিকান সরকারই।

নেপালের শেষ রাজা ও তাঁর অকেজো প্রশাসনের সাথে  পুরনো সব রাজনৈতিক দলের সবার সাথেই রাজার ওয়ার্কিং রিলেশন ভেঙে পড়ায় ত্যক্ত-বিরক্ত অবস্থায় আমেরিকান উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিশ্চান রাকা নেপাল সফরে এসেছিলেন। আর সেখানেই তিনি পাল্টা মাওবাদীদেরকেই পছন্দ করে বসেন। কেন? কারণ এরা বাস্তববাদী ও কাজবুঝা লোক, বোকা কমিউনিস্ট নয়। এমনকি সেখান থেকেই, আমেরিকানদের কারণে ও তাদের মধ্যস্থতায়  ভারতকে দিয়েও মাওবাদীদের  গ্রহণ করানো কাজটা সহজ করে দিয়েছিল। আমেরিকান সেই উদ্যোগের কারণের ২০০৬ সালে মাওবাদীরা সশস্ত্রতা থেকে গণ-আন্দোলনের ধারায় শিফট করে ফিরে এসেছিল এবং নেপালের সব দল মিলে গণ-আন্দোলনে রাজাকে পরাস্ত করে ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল। তবে আমেরিকা মাওবাদীদের সাথে কাজ করা সম্ভব মনে করেছিল মূলত যে কারণে তা হল, এরাও মাওবাদী বটে কিন্তু অন্তত কম্বোডিয়ার খেমাররুজ নয়। কেউ কিছুর মালিক মাত্রই তাঁর গলা কাটতে হবে এটা তাদের নীতি ছিল না। এছাড়া কথিত “সমাজতন্ত্র” ধারণার কোন ফ্যান্টাসিও এদের নেই। বাস্তবে এরা  রাজতন্ত্র উতখাত করে নাগরিক অধিকারভিত্তিক রিপাবলিক রাষ্ট্র কায়েম করতে চায়। এই শেষের লক্ষ্যটাই আমেরিকানদের আকৃষ্ট করে ধারণা বদলে যায়। আর সম্ভবত তা কিছুটা ভারতকেও। যদিও এখনও ভারতের মাওবাদীরা নেপালি মাওবাদীদের থেকে এলাবারেই আলাদা থেকে যায়।

এসব কারণেই  আমেরিকান মধ্যস্থতা মেনে এমনকি ভারতও পুরানো রাজার হাত ছেড়ে মাওবাদীসহ নেপালি অন্যান্য দলের পক্ষে বিরাট ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছিল। যেমন মাওবাদীরাসহ রাজাবিরোধী সব দলের নিজেদের মধ্যে রাজা উতখাতের কর্মসুচী ফাইনালের রফা-চুক্তির গোপন বৈঠকগুলো সব ভারতের আয়োজনে ও নিরাপত্তায় এবং ভারতে সম্পন্ন হয়েছিল। সেটা ছিল ভারতের দিক থেকে দেওয়া এক ব্যাপক ও খুবই ক্রুশিয়াল সহযোগিতা। কিন্তু রাজা উৎখাতের পরে নেপালে রাষ্ট্রগঠনের কালে ভারত কাকে নিজের প্রভাবাধীন করে নেয়া যায়, এমন দল বা গোষ্ঠী খুঁজতে লেগে গিয়েছিল। এ ছাড়া রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক লাভালাভের উইন-উইন সিচুয়েশনের পথে না গিয়ে ভারত কলোনিয়াল মাস্টারের ভূমিকা ও সম্পর্ক চেয়ে বসেছিল। অথচ ভারতের জন্য এগুলোর কোন প্রয়োজনই ছিল না। কিন্তু তাতে কী? ভারতের মাথায় মডেল হিসেবে ঘুরছিল ১৯৫০ সালের ভারত-নেপাল চুক্তিটা।

কারণ, সেটা ছিল আসলে এক কলোনি-চুক্তি। সেভাবেই এটা লেখা হয়ে আছে। ভারত বুঝতেই পারল না ১৯৫০ সাল আর ২০১৫ সাল এক নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে দুনিয়া থেকে কলোনি উঠে গিয়েছিল কেন? অথবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আমেরিকা কেন ব্রিটিশদের কলোনি মাস্টারের ভূমিকাতেই নিয়ে মাঠে নেমে যায় নাই কেন? আমেরিকা কী বোকা ছিল? আর নেহেরু খুব চালাক! আসলে জাতিসঙ্ঘ কেন ও কিসের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল, এটাও নেহরুর কখনোই বোঝা হলো না, বুঝতেই পারেননি তিনি। ফলে পরবর্তীকালের সারা ইন্ডিয়ারও পলিটিক্যাল জগৎটাও নেহেরু-বুঝের দুনিয়া হয়ে থেকে গেছে। আর এখন তো সবকিছুই বুঝাবুঝির বাইরে চলে গেছে। বরং উল্টো ভারতের নেহরু ডিপ্লোমেসির চোখে  – তারা নেপাল বা ভুটানের সাথে ব্রিটিশ কলোনিয়াল শক্তিদের মতোই ভারত চুক্তি করতে সফল হয়েছিল – এটাকেই সাকসেস মনে করা হয় এখনও।

নেপাল ২০১৫ সালে নতুন কনস্টিটিউশন চালু ঘোষণা করলে কলোনি-মডেল মনের ভারত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। তারা ভারতের উপর দিয়ে নেপালের পণ্য আমদানি বন্ধ করে দিয়েছিল। আর সেকালে ভারতের ওপর দিয়ে যাওয়া ছাড়া নেপালের মানুষের বাইরে বের হওয়ার আর কোন বিকল্প পথ ছিল না। আর সেই থেকে প্রথম দৃশ্যপটে চীনের আগমন। ভারতের উলটা দিকে নেপালের অপর সারা উত্তর সীমান্তে চীন ছিল-আছে বটে, কিন্তু সেদিকে রাস্তাঘাট বলতে তেমন কিছু ছিল না। যেটুকু টিমটিমা ছিল তাও ঐ জমানায় ঘটা ভুমিকম্পের পরে পাথর চাপায় বন্ধ হয়ে গেছিল। বরং সেকালে চীনের অভ্যন্তরে যেসব নতুন হাইওয়ে রেল নেটওয়ার্ক সুবিধা তৈরি হচ্ছিল, তাতে যুক্ত হতে গেলে রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে প্রায় শত কিলোমিটার নতুন কানেকটিং রেল বা সড়ক যোগাযোগ তৈরি করে নিতে হবে – এই ছিল অবস্থা । ২০১৫ সালের পরে ভারতের বেকুবিতে সেসব কানেকটিং রেল বা সড়ক যোগাযোগ একালে এখন তৈরি করে নেয়া হয়েছে। ভারত থেকে একটা দিয়াশলাইও আমদানি না করে নেপাল এখন সহজেই চীনের বন্দর ও চীনের ভেতর দিয়ে বা চীন থেকে জ্বালানিসহ সব পণ্য আনতে পারে। আবার নেপালের নিজেদের উৎপাদিত বিদ্যুৎ বিক্রি করতে পারে ভারত ছাড়া অন্য কাউকে।

ভারতের হাতে সব দিয়ে দিয়ে, সব প্রভাব হারানো আমেরিকা গত মাস থেকে এখন নতুন করে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও নেপালের সাথে অর্থনৈতিক ও সামরিক তৈরি করার চেষ্টা শুরু করেছে। যদিও সম্প্রতি নেপাল আমেরিকার ৫০০ মিলিয়ন ডলারের অনুদান প্রস্তাব অনুমোদন করে নাই। অর্থাৎ সেই আমেরিকা এখন সব হারিয়ে আবার নেপালে প্রবেশ করতে স্ট্রাগাল করছে। যেটা মূলত চীনের প্রভাব টপকাবার জন্য আমেরিকার এক স্ট্রাগল। তবে অবশ্যই এবার আর ভারতের হাত দিয়ে খাওয়া নয় অথবা ভারতের চোখ দিয়ে দেখা নয়- সবই আমেরিকার নিজের ও সরাসরি উদ্যোগ। বরং চীনের সাথে একটা প্রতিযোগী মুডে আমেরিকা লড়তে চাইছে। এই ঘটনার প্রমাণ থেকে মনে হচ্ছে, আমেরিকা ফেরত আসার চেষ্টা করছে অবশ্যই। আর ভারতের হাত দিয়ে খেতে চাওয়া পুরনো আমেরিকার একটা ভাল শিক্ষা হয়েছে এতে, তা দেখাই যাচ্ছে। একই রকম আবার ওদিকে শ্রীলঙ্কা?

শ্রীলঙ্কায় নির্বাচনে সরকার বদলের সাথে সাথে সেখানে খুবই নোংরাভাবে ওদেশের দলগুলো চীন অথবা ভারতমুখী হয়ে যাচ্ছিল। যেটা স্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলোর মেরুদণ্ডহীন দুর্দশাকেই প্রকাশ করে আসলে। এরপর গত সরকারের শেষ দিকে তারা সেবার ভারত-চীন ছেড়ে আবার আমেরিকামুখী হয়ে যায়, মানে আমেরিকাকেও উন্নয়ন প্রজেক্ট দিয়েছিল। আগের চীনা-পছন্দ রাজা পাকসে – তাঁর ভাই এবারের নির্বাচনে জয়ী হন ও সরকার গড়েন। কিন্তু এবারের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আসার পর, এখন আমরা রিপোর্ট দেখছি নতুন সরকার আমেরিকান প্রজেক্ট স্থগিত করে দিয়েছে [চীনমুখি শ্রীলঙ্কা এখন, আমেরিকার মিলিয়ন ডলারের প্রকল্প স্থগিত] করেছে। প্রায় একই দশা দেখা গেছে মালদ্বীপেও। আসলে এগুলো মূলত দুর্বল সরকার ও সরকার ব্যবস্থাপনায় ত্রুটির লক্ষণ।

মূল কথাটা হল – রাষ্ট্রস্বার্থকে দল বা ব্যক্তিস্বার্থের অধীন করে ফেলা অথবা সেকেন্ডারি করে ফেলা থেকে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়। কোনো বিদেশী সরকারকেই নিজের সরকার ও ক্ষমতার অভ্যন্তরীণ এই স্তরে ঢুকে পড়তে এলাও করা একেবারেই অনুচিত। নিজের ক্ষমতায় থাকা বা ফিরে আসার সুবিধার কথা ভেবে কোন সরকার একবার এ কাজ করে বসলে- চীন, ভারত বা আমেরিকা এ তিন রাষ্ট্রকে দূরে রাখা ঐ রাষ্ট্রের জন্য খুবই কঠিন হয়ে যায়। তবে আমাদের জন্য এখন প্রাসঙ্গিক বিষয় হল, আমেরিকা নিজের কর্তৃত্ব-আধিপত্যের দণ্ড একবার ভারতের কাছে দিয়ে দেয়া অথবা খোয়ানোর পর এখন এসব দেশেই নতুন করে নিজের ক্ষমতার বলয় বানাতে চেষ্টা করতে নেমেছে আমেরিকা। এগুলোও আমেরিকার ফিরে উঠে দাঁড়ানোর মরিয়া চেষ্টার নমুনা বলা যায়।

তবে ২০১৬ সালে ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর আগের ওবামা সরকারের আমেরিকার ভারতকে দেয়া বিশেষ সুবিধা (যেমন চীন ঠেকানোর জন্য খোদ বাংলাদেশকেই ভারতের হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল)। এছাড়া যেমন- আমেরিকায় শুল্কমুক্ত রফতানির সুযোগ পেত ভারত। সেগুলো সুবিধা সব সমূলে প্রত্যাহার করে নেন ট্রাম্প। উল্টা শাস্তিমূলকভাবে ভারতের রপ্তানির উপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ ট্যারিফ আরোপ করেন যা কার্যত আমেরিকায় ভারতের রফতানির সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল ট্রাম্প।

আমেরিকার বাংলাদেশকে ভারতের হাতে তুলে দেয়ার পর থেকে বাংলাদেশের সবকিছুই এখন ভারতের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু কোন কর্তৃত্বই আর আমেরিকার হাতে বা ভাগে নেই বললেই চলে। তবে গত অক্টোবরে বাংলাদেশের সমুদ্র সীমান্ত বরাবর ভারতকে রাডার বসানোর চুক্তি করার পর থেকে আমেরিকা কিছুটা তোলপাড় দেখানো শুরু করেছিল। কিন্তু সেটাও হঠাৎ করে এ বিষয়ে আবার সবকিছু নিশ্চুপ দেখা যাচ্ছে। তবে সারকথায় – নিজের ক্ষমতা ও প্রভাব ফিরে পেতে আমেরিকা আবার সব দেশেই তৎপর হতে চেষ্টা করছে, তা আমরা দেখতে পাচ্ছি।

ওদিকে আমেরিকাকে পালটা শিক্ষা দেয়ার ব্যাপারে সবচেয়ে এগিয়ে ছিল সম্ভবত পাকিস্তান। আর মূলত সেই পাকিস্তানেই এখন আমেরিকা আবার ফিরে যাচ্ছে। আগের মতই সামরিক সহযোগিতা ও ট্রেনিং দেয়ার এক লম্বা কর্মসূচি নেয়া হয়েছে।

গত ২০১৬ জানুয়ারিতে ট্রাম্পের শপথ নেয়ার পর থেকে পাকিস্তানের ব্যাপারে কঠোর ভূমিকা নিয়ে প্রায় তেড়ে এসেছিলেন ট্রাম্প। অবস্থা এমন যেন আমেরিকা নিজেই না বরং পাকিস্তানই আমেরিকাকে আফগানিস্তানে হামলা করতে ডেকে নিয়েছিল। তাই পাকিস্তান আমেরিকার সব দুঃখের জন্য দায়ী এমন ভাব ধরেছিল ট্রাম্প। অর্থাৎ আমেরিকা না, পাকিস্তানই সব কথিত “টেররিজমের” জন্য দায়ী। যেন আফগান তালেবানের তৎপরতা বহাল আছে; পাকিস্তানের কারণেই। এমনই ছদ্ম অভিযোগে আমেরিকান প্রতিশ্রুতির ৬০০ মিলিয়ন ডলার হঠাৎ বন্ধ করে দিয়েছিল ট্রাম্প। আমেরিকা-পাকিস্তান সম্পর্ক সবচেয়ে নেতি ও প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমেছিল। এসব ঘটনা সবই পাকিস্তানের গত নির্বাচনের (জুলাই ২০১৮) আগের ঘটনা। কিন্তু পাকিস্তানও শক্ত অবস্থান নিয়ে আমেরিকা থেকে দূরে সরেছিল আর তা পাকিস্তানের সেনা-সিভিল ক্ষমতা্র এক সাথে নেয়া সিদ্ধান্তে। আর ততই আমেরিকা পাকিস্তানকে দোষারোপ করে চলেছিল চীনের সাথে ঘনিষ্ঠতার জন্য, গোয়াদর বন্দর প্রকল্পের জন্য।

আসলে গত সরকারের (২০১৮ সালের আগের) আমল থেকে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক দুর্দশা খুবই খারাপ জায়গায় ঠেকেছিল। তাই নতুন নির্বাচিত ইমরান খানের  উপর আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রধান মাইক পম্পেও যেন গোলা ছুড়ছিলেন, যখন তিনি বললেন, আইএমএফ বিশ্বব্যাংকের থেকে লোন নিয়ে ইমরান খান চীনের লোন পরিশোধ করতে পারবে না। ক্যাম্পেইন তখন এমনই চরমে উঠেছিল। অথচ চীনা লোনের কিস্তি পরিশোধের সময়কাল শুরুই হয়নি এখনো, হবে ২০২৩ সাল থেকে। যা হোক, শেষে সবই থিতু হয়েছে এখন। পাকিস্তানের প্রয়োজনীয় সব ঋণ সে একাই চীনের থেকে পেতে পারত, কিন্তু ইমরান খান এর পুরাটা নিতে চাননি। কারণ, পশ্চিমা বাজার এই খবরটা ভালোভাবে নিবে না। বাজারকে আস্থায় আনা সমস্যা হবে, এছাড়া আমেরিকান প্রপাগান্ডার ত উপস্থিত থাকবেই। তাই বাজারের আস্থা পেতে লোনের একটা অংশ প্রায় ছয় বিলিয়ন ডলার  পাকিস্তান সেটা আইএমএফের থেকেই সংগ্রহ করেছিল। কারণ আইএমএফ জড়িত ও তার রেকমেন্ডেশন হলে বাজার আস্থা পাবে। হয়ে ছিলও তাই। তাই আজ? গত পরশুর রিপোর্ট – আইএমএফ, পাকিস্তানি সরকারের উদ্যোগের উচ্ছসিত প্রশংসা করে বলছে অর্থনৈতিক অগ্রগতি সঠিক রাস্তায় উঠে পড়েছে [Pakistan’s economic reform program is on track. ]। কিন্তু মনে রাখতে হবে  ইমরান খান এসব সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আমেরিকার চোখ রাঙানি উপেক্ষা করেই।

তবে আমেরিকার সাথে পাকিস্তানের সব উত্তেজনা ঠাণ্ডা হয়ে যায় মূলত আমেরিকার আফগানিস্তান থেকে শেষ সৈন্যকে নিয়ে বের হয়ে যাওয়ার ইচ্ছা থেকে। ওবামা ২০১৪ সালে মূল অংশটা নিয়ে গেলেও দশ হাজারেরও বেশি একটা সামরিক ব্যাচকে রেখে গেছিল ট্রেনিং এর নামে। এবার ট্রাম্প এদেরকেও আরামে দেশে ফিরিয়ে নিতে  আমেরিকার তালেবানদের সাথে চুক্তি করতে গিয়ে দেখেছিল যে পাকিস্তানের সহযোগিতা ছাড়া এটা অসম্ভব। আর এই চুক্তি আমেরিকার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করাতে তাদের আমেরিকা-পাকিস্তান দ্বিপাক্ষিক সমপর্ক আবার উষ্ণ করে নিতে চায় ট্রাম্প। পাকিস্তানের উপর আস্থা রাখা যায় ও তা খুব গুরুত্বপুর্ণ, এই হুঁশ থেকে আমেরিকা পাকিস্তান সম্পর্ক নরমাল হতে শুরু করেছে। আর সেখান থেকে সম্পর্ক এখন আগের চেয়ে গভীর হতে চলেছে। এটাকেই ‘দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন নীতিতে দৃশ্যমান পরিবর্তন’ বলছেন অনেকে। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টও তা সরাসরি নিজেও বলছে [U.S. to resume military training program for Pakistan: State Department]।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার জড়ানো, আবার পুরো কর্তৃত্ব নেয়া, সবাইকে সাহায্য করা ছাড়াও আর যেসব নীতিগত ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে আমেরিকা যুদ্ধের নেতৃত্ব নিতে রাজি হয়েছিল সেটা হল – নাগরিক অধিকারভিত্তিক স্বাধীন রিপাবলিক রাষ্ট্র ও ভুখন্ড শাসক কে হবে এর নির্ধারণের হকদার একমাত্র ঐ ভুখন্ডের বাসিন্দা কোন রাজা বা কলোনি দখলদার নয় – এই নীতির ভিত্তিতে জাতিসঙ্ঘ ধরনের প্রতিষ্ঠানের জন্ম দেয়া। পাঁচ ভেটো সদস্যের জাতিসঙ্ঘের সবাই (ফ্রান্স বাদে সে তখন হিটলারের দখলে ছিল তাই, পরে স্বাক্ষর দিয়েছিল) এসব কথা লেখা এক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে সম্মতি দিয়েছিল ১৯৪২ সালে্র ১ জানুয়ারি। এটাকেই পরবর্তিকালে “জাতিসংঘের জন্ম ঘোষণা” বা Declaration বলে মানা হয়। কিন্তু নাগরিক অধিকারভিত্তিক রাষ্ট্র বা মানবাধিকার মেনে চলার বাধ্যবাধকতা কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মাওয়ের চীন (যারা ঐ পাঁচের মধ্যে দুই ভেটো ক্ষমতাসম্পন্ন সদস্য) পরবর্তীকালে মানেনি বা নিজ রাষ্ট্রে কখনো চর্চা  করেনি।  একালে এখন চীনা অর্থনৈতিক উত্থান একটা বাস্তবতা, দুনিয়ার অর্থনৈতিক নেতা সে। কিন্তু চীনের রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রসঙ্গ? এর ভবিষ্যত অন্ধকার!

স্পষ্ট করেই বলা যায়, নাগরিক অধিকারভিত্তিক রাষ্ট্র বা মানবাধিকারের বাইরে থাকা বা থেকে চীনের পক্ষে দুনিয়াকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেয়া অসম্ভব। বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে শুরু হওয়া আমেরিকার নেতৃত্ব  – এর সেই ভূমিকা ঠিক একারণেই সহসা দুনিয়া থেকে চলে যেতে গিয়েও যাবে না, যাচ্ছে না। এটাই বারবার আমেরিকার নেতৃত্বে ফিরে আসার শর্ত জাগিয়ে রাখছে, রাখবে।

তাহলে আমেরিকা কি আগের মতোই বাংলাদেশেও কোন প্রভাব কর্তৃত্ব নেবে, এমন ভূমিকায় ফিরে আসবে? অন্তত নিজেও চীনের পাশে একটা শেয়ার নিবে?  আর বলাই বাহুল্য- জুতা খুলে ঘরে ঢোকার মত এবার ভারতকে বাইরে রেখে আসবে; এবার আর ভারতকে ভুলেও সাথে আনবে না? বিষয়গুলো এখনো আনসেটেল্ড, অবশ্যই! তবে বড় অক্ষরে এর একটা শর্ত লিখে দেওয়া যেতে পারে – এশিয়ায় আমেরিকা ফিরতে চাইলে ভারতের হাত ছেড়ে দিয়ে আসতে হবে। যাতে সবাই বুঝে যে আমেরিকা আগের সিদ্ধান্তের ভুল কারেক্ট করছে।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

 

[এই লেখাটা গত ২৮ ডিসেম্বর ২০১৯ দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ওয়েবে ও পরদিন প্রিন্টে এশিয়ায় আমেরিকার ফিরে আসা এই শিরোনামে ছাপা হয়েছিল।  পরবর্তিতে সে লেখাটাই এখানে আরও নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে এখানে আজ ছাপা হল। ]

Leave a comment