প্যান্ট খুলে চেক করার নাগরিকত্ব 


ভারতে হচ্ছেটা কী?
প্যান্ট খুলে চেক করার নাগরিকত্ব!

গৌতম দাস

২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ২১:০৯ বৃহস্পতিবার

https://wp.me/p1sCvy-2Tr

 

‘Are you Hindu or Muslim?’: TOI photojournalist

সবাই জানত, অন্তত ভারতের সাংবাদিককুল! কিন্তু কেউ আমল করে নাই। সবাই ভেবেছিল আমি তো সাংবাদিক অথবা হিন্দুগোষ্ঠীর; কাজেই এটা আমার সমস্যা নয়।
ঘটনা হল, টাইমস অব ইন্ডিয়ার ডিউটিরত এক ফটোসাংবাদিক অনিন্দ্য চ্যাটার্জিকে দিল্লিতে বজরং দলের গুন্ডারা প্যান্ট খুলিয়ে তাঁর “নাগরিকত্ব  টেস্ট” করেছে। এরপর সে “মুসলমান নয়” এটা নিশ্চিত হয়ে তবেই ছেড়ে দিয়েছে।

গত সোমবার থেকে  রি রি করা ঘৃণা আর হিংসা ছড়ানোর হামলার আগুন লেগেছে  দিল্লিতে। বলা ভালো লাগানো গেছে। এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৩৫ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং ১৪৪ ধারা বা কার্ফু জারি করেও এখনো তা পুরো নিয়ন্ত্রণে আসেনি। পুলিশ আদৌ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আগ্রহী বা তাদেরকে দেয়া কাজের ব্রিফিং কী ছিল তানিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।  ভারতের মেনস্ট্রিম মিডিয়ার ভাষ্যে ইতোমধ্যে ছবি প্রমাণ ও ব্যাখ্যাসহ পুলিশের দিকে আঙুল উঠানো হয়ে গেছে।  এই নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা ও এতগুলো মৃত্যু; এর তত্ত্বাবধান ও দায় কার?

ভারতের কনস্টিটিউশন অনুসারে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থতির সুরক্ষায় দায় রাজ্য সরকারের; কেন্দ্রের নয়। তবে কেন্দ্রের কাজ রাজ্য থেকে অনুরোধ পেলে কেন্দ্রের হাতে থাকা নানান নামের ‘বাড়তি রিজার্ভ ফোর্স’ রাজ্যকে ধারে সাময়িক সরবরাহ করা; কিন্তু এদের ওপরও নির্দেশ-পরিচালনার দায় রাজ্যের হাতে। তবে কোনো কারণে যদি রাজ্য একেবারেই ফেল করে সে ক্ষেত্রে পুরো রাজ্য সরকারই ভেঙে দিয়ে প্রশাসনের কর্তৃত্ব নিজের হাতে তুলে নিতে পারে কেন্দ্র। যদি না কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্ত আবার কখনো পরে আদালতে চ্যালেঞ্জ হয়ে না যায়।

কিন্তু দিল্লি এসব কিছুর ব্যতিক্রম। সেক্ষেত্রে এর সাফাইটা হল, দিল্লি একটা রাজ্য; কিন্তু একই সাথে এটা ‘ন্যাশনাল ক্যাপিটাল অঞ্চল’ [NCT] মানে, কেন্দ্রের সরকার যেখানে বসে বা অবস্থিত।  এই বিশেষ আইনের কারণে দিল্লি পুলিশের কর্তৃত্ব দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর (বিজেপিবিরোধী কেজরিওয়ালের) হাতে নয়, খোদ কেন্দ্রের হাতে। যদিও এ নিয়ে পুলিশের ক্ষমতাহীন ঠুঁটো দিল্লি-মুখ্যমন্ত্রীর একটা মামলার ফয়সালা অপেক্ষায় আদালতে মুলতবি আছে।
বিজেপি চলতি মাসেই শোচনীয়ভাবে দিল্লিতে হেরেছে । দিল্লি এই রাজ্য নির্বাচন শেষে গত ১১ ফেব্রুয়ারি ফল প্রকাশিত হয়েছিল। শোচনীয় বলছি  এজন্য যে, ২০০২ সালে গুজরাটে প্রায় হাজার দুই মুসলমান মেরে ফেলা কৃতিত্বের(!) রাজ্যসরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন এই অমিত শাহ। সেই ‘পারফরম্যান্স’ থেকে এ পর্যন্ত তবু তিনিই ক্ষমতার শিখরে চড়েই গেছেন। থামেননি। কিন্তু এই প্রথমবার দিল্লির নির্বাচনে তিনি মুসলমানবিদ্বেষী স্লে­াগান তোলা ভুল হয়েছে বলে স্বীকার করেন এবং টানা দুই দিন জনসমক্ষে আসেননি। কাজেই গত দু’দিনে দিল্লির জাফরাবাদের মুসলমান-টার্গেট করে করা হামলা ঘটানো এটা দিল্লি নির্বাচনে হারের প্রতিক্রিয়া। এক জিঘাংসা। এই বিশ্বাসে কঠিন অকল্পনীয় নির্যাতন আর চাপের মধ্যে ফেলতে পারলে বিজেপি-বিরোধিতা বন্ধ করার একটা উপায় হতে পারে।  মুসলমানবিদ্বেষী উত্তেজনা তুলে হিন্দু ভোট জড়ো করার মেরুকরণ, এটা বাদ রাখতে বা ভুল মনে করতেই পারে না। এটাই তো বিজেপি!
গত তিনদিনের ঘটনার মূল কেন্দ্র বলা হচ্ছে উত্তরপূর্ব দিল্লি জেলার জাফরাবাদ ও মৌজপুর মেট্রোস্টেশনের আশপাশ। আর গত রাত থেকে ভাইরাল হয়ে গেছে টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক রিপোর্ট, যা বাংলাদেশের অনেক মিডিয়া রাতেই অনুবাদ করে ছেপেছে। ঐ রিপোর্টের লেখক এক ফটো জার্নালিস্ট। মিডিয়ায় তার কাজ রিপোর্ট লেখার নয় যদিও, তবুও কারণ, এই রিপোর্টটা খোদ ওই ফটো জার্নালিস্টকে নিয়েই।
ইতোমধ্যে অবশ্য লক্ষণীয় ভাবে ভারতের মিডিয়ায় ‘ভাষা’ বদলানো শুরু হয়েছে। [যা আজ ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে আবার সরকারবিরোধী হইয়ে দিল্লি পুলিশের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। ] দিল্লির এই ঘটনাকে সবাই রিপোর্ট করছে নাগরিকত্ব আইনের ‘বিরোধী’ আর ‘পক্ষের গ্রুপের’ লড়াই বলে। কেউ কেউ বুদ্ধিমানের মতো কোনো পক্ষ থেকে ‘মোদি মোদি’ বলে স্লে­াগান ওঠার কথা লিখেছে। মানে সরাসরি বিজেপির নাম নেয়া বন্ধ হয়েছে।
ফটো জার্নালিস্ট হলেন কলকাতার বাঙালি অনিন্দ্য চ্যাটার্জি। সোমবার দুপুর সাড়ে বারোটা থেকে প্রতি পদে নিজে হিন্দু কি না সেই পরিচয় দিতে দিতে তার কেটেছিল। বা বলা যায় বিজেপির ‘মেরুকরণের’ শিকার হতে বাধ্য হয়েছিলেন। মৌজপুর স্টেশনে এক ‘হিন্দুসেনা’ তাকে তাঁর কপালে তিলক লাগিয়ে দিতে চেয়েছিল। নাছোড়বান্দা হয়ে বলা সেই হিন্দুসেনার ডায়লগ ছিল, “তিলক লাগিয়ে নিলে আপনার কাজ করা সহজ হবে… আপনিও তো হিন্দু; কাজেই এতে ক্ষতি কী?”।
সেই বিড়ম্বনা কাটিয়ে কিছু দূর এগিয়ে একটা আগুন লাগা বাসার দিকে যেতেই আবার বাধা। তিনি ছবি তুলতে যেতেই ওদের একজন বলে ওঠে, “আপনিও তো হিন্দু, কেন তবে ও-দিকে যাচ্ছেন? আজ হিন্দুরা জেগে উঠেছে’। এভাবে বাধা পেয়ে ঘুরে অন্য দিক দিয়ে স্পটে পৌঁছতে চেষ্টা করলে এবার আরেক দল লাঠি হাতে যারা তাকে ফলো করেছিল তাদের একজন বলে ওঠে “তুই তো দেখি খুবই চালাক! তুই কি হিন্দু, না মুসলমান?” এরপরই তাঁরা সাংবাদিক অনিন্দ্যর প্যান্ট খুলে ধর্মীয় চিহ্ন খোঁজার চেষ্টা করে। কোনোমতে বিনয় দেখিয়ে মাফ চেয়ে তিনি পালিয়ে আসেন।
এর পরের বর্ণনা আরো চরমের। তিনি এবার ঐ এলাকা ছেড়ে পালানোর কথা ভাবছেন। একটা সিএনজি (অটো) পেয়ে তাতে চড়ে রওনা দেন। রাস্তায় চার তরুণ তাদের আটকে সিনজি থেকে জামার কলার ধরে টেনে-হিঁচড়ে বের করে তারা হিন্দু না মুসলমান জানতে চায়। তিনি নিজে নিরীহ সাংবাদিক বলে পার পেলেও ঘটনাচক্রে ড্রাইভার ছিল মুসলমান। বহু অনুনয় করে ড্রাইভার এক গরীব ছাপোষা বলে মন গলিয়ে তবেই সে যাত্রায় তারা পার পায়।
উপরের চারটা বর্ণনায়, আপনি হিন্দু হলে মাফ, না হলে টর্চার, তাতে মৃত্যু হলেও এরা বেপরোয়া – এটাই বিজেপির মেরুকরণের রাজনীতি। শুরুতেই কপালে তিলক এঁকে দেয়ার অফার, এর মানে হলো সেই বুশের নীতি, হয় আপনি আমার পক্ষে না হয় আমার এনিমি’। আপনি হিন্দু হলে বিজেপির তিলক আপনাকে পরতেই হবে আর মুসলমান হলে নির্যাতিত বা মরণ সইতে হবে।

এই রিপোর্টের শুরুতে, লেখক ওসব বিজেপি-সেনা কর্মীকে বর্ণনা করতে কিছু শব্দ ব্যবহার করেছেন তিনি। যেমন, এদের কারণেই দিল্লি “নিয়ন্ত্রণহীন” হয়ে গেছে। এরা “মিসগাইডেড ইয়ুথ”। “আইন হাতে তুলে” নিয়ে “ভায়োলেন্স” ছড়াচ্ছে। এরা “ধর্মীয় আইডেনটিটি” ভিত্তিক ভায়োলেন্স করছে। ইত্যাদি।

কিন্তু প্রশ্ন হল, গত ছয় বছর ধরে এগুলোই কী মোদীর ভারতে চালু ছিল না? কেউ মুসলমান হলে নিপীড়ন করে “জয় শ্রীরাম” বলানোতে বাধ্য করা,  গরু ব্যবসায়ী হলে তাকে পিটিয়ে হত্যা করা, এমন যে কাউকে মাটিতে শুইয়ে বুকের উপর লাফ দিয়ে উঠে জোড়া পায়ের লাথি মারার অজস্র ক্লিপ কী আমরা সোশাল মিডিয়ায় দেখিনাই?  অথচ সামাজিক প্রতিবাদ দূরে থাকে ঐ ঘটনাস্থলের চার দিকে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে নির্বিকার মজা দেখা এই কমন চিত্র কি অনিন্দ্যরা দেখেনি? এমনকি মোদীর সরকারের পক্ষ থেকে “এধরণের ঘটনাগুলো সব গুজব বলে” – এগুলোর কোন অস্তিত্ব নাই বলে মোদীর সংখ্যালঘু মন্ত্রীর বয়ান কী ভারতের মিডিয়া ছাপেনি? কোন মিডিয়াই কী মন্ত্রীর বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করতে একটা ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম করেছিল? নাকি তখন কি কেবল মনে হয়েছিল “আমি তো সাংবাদিক অথবা হিন্দুগোষ্ঠীর!  কাজেই সমস্যাটা আমার না” – এমন মনে হয়েছিল তাই নয় কি? তাহলে আজ অনিন্দ্যদের দুঃখের কথা জানাতে চাচ্ছে কেন?  কে শুনবে? মোদী না অমিত শাহ? কী আশা করেছিলেন আপনি?

বরং নিজেকে জিজ্ঞাসা করেন? কেন এতদিন চুপ ছিলেন? মুসলমানদের উপর হচ্ছিল বলে? তুচ্ছ করে? তাহলে আপনি কী?

সারা ভারত আর সাথে এমনকি সুপ্রিম কোর্ট বা নির্বাচন কমিশন পর্যন্ত এই মুসলমান মারা বা নির্যাতন করার নষ্ট “মেরুকরণের” বিজেপিকেই রুখবার চেষ্টার দায়িত্ব পালন করেনি?  এটা ভারতের কনষ্টিটিউশন-বিরোধী ততপরতা – এই দায়ে বিজেপির উপর কোন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে নাই। বরং নির্বাচন করতে, ক্ষমতায় যেতে জায়গা করে দিয়ে গেছে? তাই, আজ আঁতকে উঠে লাভ কী, অনিন্দ্য?  সবই তো শেষ!

বলা হয়, বিজ্ঞানের আবিষ্কারগুলো বেশির ভাগই নির্দিষ্ট করে খুঁজতে গিয়ে তা আবিস্কার হয়েছিল এমন নয়। বরং অন্য কিছু খুঁজতে গিয়ে পথে পড়ে পাওয়া ধরণের আবিস্কার সেগুলো।। দেখা যাচ্ছে মোদি-অমিতও নাগরিকত্ব প্রমাণের যে পথ খুঁজছিলেন এই ঘটনাতে এর এক সহজ সমাধান পাওয়া গেছে। এখন দেখা যাচ্ছে, প্যান্ট খুলে দেখা, চেক করাই “নাগরিকত্বের বেস্ট প্রমাণ”। কারণ কে মুসলমান কেবল এটা জানতেই তো বিজেপির এত আয়োজন। তাই নয় কী? তাহলে এত কাগজ এনআরসি, সিএএ বা এনপিআর ইত্যাদি এসবের আর প্রয়োজন কী!

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

 

এই লেখাটা গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০ দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ওয়েবেপ্রিন্টে ‘নাগরিকত্ব প্রমাণের নতুন মডেল!”এই শিরোনামে প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছিল।  পরবর্তিতে সে লেখাটাই এখানে আরও নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে এখানে আজ ছাপা হল। ]

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s