মোদীকে আচ্ছা শিক্ষা দিল এক দুবাই রাজকুমারি
গৌতম দাস
১১ মে ২০২০, ০০:০৬ সোমবার
কিছুই নজর এড়াবে না, দুবাইয়ের রাজকীয় থাপ্পড় ThePRINT_
তেজস্বী সূর্য [Tejasvi Surya] – এটা ভারতের এক তরুণ বিজেপি এমপির নাম, যার বয়স এখন সবে ২৯ বছর। পুরা নাম Lakya Suryanarayana Tejasvi বা লক্ষ সুর্যনারায়ন তেজস্বী। নামগুলো এখানে বাংলা উচ্চারণ অনুসরণ করলে যেমন হয় মানে বাংলা ফোনেটিক করে লেখা হয়েছে। তিনি দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের রাজধানী বেঙ্গালুরু এর এমপি। অর্থাৎ কর্ণাটক রাজ্য মানে ভারতের ‘কন্নড়’ নামের জনগোষ্ঠী ও তাদের কানাড়া ভাষা , এই দ্রাবিড়ীয় ভাষাভাষীদের রাজ্য। গত বছর ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রের নির্বাচনে তিনি দক্ষিণ ভারতের দক্ষিণ বেঙ্গালুরু থেকে এমপি বিজয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তিতে মাত্র এক বছরের মধ্যে তিনি ভারতের বাইরে বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বড় এক ‘কুখ্যাতি’ কামিয়ে ফেলেছেন। ভারতের যারা বাইরে দুনিয়াদারির খবর রাখেন তারা বুঝে যান যে, তেজস্বীর পাশে দাঁড়ানো যাবে না বরং ওর দায় না নিয়ে তাকে নিন্দা করতে হবে। ওর থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। আর ভারতের যারা বিজেপি দলের প্রভাবে ইতোমধ্যেই মুসলমানদের প্রতি ঘৃণায় অন্ধ হয়ে গেছেন এবং হিটলারি জাতিবাদী-বর্ণবাদী উগ্র চিন্তা ধারণ করেন তারা মনে করেন তেজস্বীর বদনামের প্রতিশোধ নিতে ভারতের মুসলমানদের উপর আরো চাপ সৃষ্টি করতে হবে। যদিও ব্যাপারটা মোটেও ঢিল-পাটকেলের মত পাল্টাপাল্টি ইস্যু ছিল না বা নয়।
এমনিতেই ভারতের অর্থনীতির ঢলে পড়ার খবর গত বছরের শেষ থেকে উদাম প্রকাশিত হয়ে পড়েছিল ( গত ২০১৯ মে এর নির্বাচন পর্যন্ত ওই সব তথ্য প্রকাশ বহুকষ্টে মোদী ঠেকিয়ে রেখেছিলেন) যে, ভারতের অর্থনীতি ইতোমধ্যেই খুবই খারাপ দিকে মোড় নিয়ে ফেলেছে। এর উপর আবার নতুন বছরের শুরু থেকেই অর্থনীতির আরও ঢলে পড়া স্পষ্ট হতে থাকে, করোনার কারণে অর্থনীতি আরেক বড় ধাক্কা খেতে যাচ্ছে তাই। এই খারাপ ধাক্কায় সরকার অজনপ্রিয় হতে পড়তে যাচ্ছে, তা টের পেয়ে মোদি মুসলমানবিদ্বেষী কড়া হিন্দুত্ববাদে উসকানি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন। যেমন এখন আবার গত কয়েকদিন ধরে পাকিস্তান সীমান্তে উত্তেজনা বাড়ানোর চেষ্টা করছে। যাতে মুসলমানদের উপরে হিন্দুরা শ্রেষ্ঠ – এমন সুপ্রিমিস্ট চিন্তার উসকানি ও বর্ণবাদী নাগরিক ভেদাভেদ-চিন্তা ছড়িয়ে তাদের মধ্যে একটি জোশও এনে দেয়, আর তা দিয়ে পাবলিক লাইফে মোদীর অর্থনীতির চাপ ও কষ্ট থেকে তাদেরকে যতটা ভুলিয়ে রাখা যায় আর কী!
টার্গেট মওলানা সা’দ, মুসলমানেরা নিচা জাতঃ
ভারতে লকডাউন পালন কার্যত শুরু করা হয়েছিল গত ২৩ মার্চ বিকেল থেকে। আর এবছরে দিল্লির তাবলীগ জামাত সমাবেশ শুরু ও শেষ হয়েছিল এর অন্তত ১০ দিন আগেই; অর্থাৎ এর আয়োজনে কোনো আইনভঙ্গ করা হয়নি, বরং সরকারি অনুমতি নিয়েই ঐ সমাবেশ করা হয়েছিল। লকডাউন শুরু হওয়ার পর কারা কারা করোনা সংক্রমণে আক্রান্ত সমাজের বিভিন্ন কোণে এদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল। ফলে সমাবেশফেরত কিছু মুসল্লিদেরকেও (সমাজের আর সব কোণের মত) অনুসন্ধানে তাদের বাড়ি বাড়িতে অনেকের মধ্যে (বিবিসির ভাষায় অন্তত তিনশো জনের শরীরে করোনা সংক্রমণ পাওয়ার পরে……) করোনা পজিটিভ পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু এতে এবার বিজেপি এ ঘটনাকে তাদের মুসলমানবিদ্বেষী প্রচারণার বিষয় – এই প্রপাগান্ডা-হাতিয়ার বানিয়ে নিয়েছিল। তারা বলা শুরু করেছিল যে, মুসলমানদের জীবন আচার-অভ্যাসই নীচু ধরনের, ওরা খারাপ, তারা নিম্ন কালচারের, ধর্মীয় জাতিগতভাবে তারা নীচুসহ প্রভৃতি এমন সব বয়ান তৈরি করে জাতবিদ্বেষী, প্রবল রেসিজমের এক জোয়ার তুলেছিল সামাজিক নেটওয়ার্কজুড়ে।
মানুষ ও প্রকৃতিঃ মাঝখানে চামচ কেন
প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক কী ও কেমন এটা কমবেশি সব ধর্মতত্বেরই মুখ্য বিষয়। এনিয়ে শিক্ষালাভের এক সহজ ও প্রধান উতস আমাদের ধর্মতত্বগুলো। যেসব সভ্যতা আধুনিকতার নামে এসব দিকর কিছু বুঝেই নাই বা অবজ্ঞা করেছে তারাই বিজ্ঞানবাদী হয়ে কথিত শিল্প-বিপ্লবের নামে প্রকৃতি ধবংস করে এখন হাহুতাশ করছে। যা ক্ষতি করে ফেলেছে তা এখন আরেক পরিবেশবাদ বলে কিছু একটা বুঝে ছুটা ছুটি করে বেড়াচ্ছে। কিন্তু শান্তি হচ্ছে না। তবু মানুষ-প্রকৃতির সম্পর্ক ধরতে পারার এরা ধারেকাছেও আসতে পারে নাই। প্রাণ কোথায়, কী খুজে পায় না! কারণ স্পিরিচুয়ালিটির কোন ধারণা নাই, আকাঙ্খা নাই, চাহিদাও নাই – সেটা না দার্শনিক জ্ঞান চর্চায় না ধর্মতাত্বিক চর্চা দিক থেকে। অথচ এগুলো আমাদের সমাজের স্বাভাবিক চর্চা থেকেও অন্তত কিছু জেনে নেওয়া যায়।
আমরা চামচ দিয়ে খাওয়া অভ্যাস রপ্ত করলাম না কেন? কেন সরাসরি হাত দিয়ে খাই? একেবারে হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে অনুভব করে ধরে সম্পর্ক পাতিয়ে স্পর্শ, গন্ধ স্বাদ সব ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া জানতে হবেই আমাকে তবেই তা প্রকৃতির সাথে সম্পর্কের আকাঙ্খা পূরণ হবে – এভাবে। এটাই ছোট থেকেই আমাদের শিক্ষা , ওরিয়েন্টেশন। তাতে কেন এটা করতে হবে তা বুঝি আর না বুঝি। আর সেটা বড় হয়ে নিজে চিন্তা করলেই অনেক কিছু কারণ বুঝে যাওয়া যায়, আমরা বুঝি। প্রকৃতির যা খেলাম তাই তো আমার শরীর হয়? আমি হই! তাহলে প্রকৃতি কে, কী হয় আমার? এসব নানান প্রশ্ন আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশীয়, ইসলামেরও। যার অনেক জবাব নির্দেশ রূপে আমরা পেয়েছি ইসলাম থেকেও। আঙুল দিয়ে খাব কেন, চেটে চেটে প্লেট থেকে খাব কেন? এর ভিতর সেসব ইঙ্গিত বা ম্যাসেজ আছে। এখন আপনি যদি বিজ্ঞানবাদী বা হঠাত ‘সাহেব’ বনে গিয়ে আমাকে বলেন আমি ‘নোংরা’, আমার খাওয়ার স্বভাব আচার খারাপ, আমি নিচা তাহলে আসলে অজ্ঞ কে? আপনি যে প্রকৃতি চিনেন না, সম্পর্ক বুঝেন না সে আপনি না আমি? আপনি যে বুঝের জায়গায় উঠেন নাই সেতাই আপনি বুঝেন না!
আসলে আপনি মোদী ও ভগত এখন মুসলমান ঘৃণা ছড়িয়ে মিথ্যা এবং বিপদজনক হিন্দু-জাত-শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা কায়েমের উদ্দেশ্যে এগুলো করছেন। অথচ সিভিলাইজেশন অর্থে প্রাচীন হিন্দুরীতিতে প্রকৃতির সাথে সম্পর্ক পাতানোর অনুভব আর ইসলাম থেকে পাওয়া রীতির মৌলিক অমিলটা কোথায়? এবিষয়ে আমরা কী ইসলাম থেকেও সমৃদ্ধ হই নাই! প্রাচীন হিন্দুরীতি অনুযায়ী আঙুল দিয়ে খাওয়া, চেটে খাওয়া ইত্যাদি কী নাই, প্লেট চাটাও কী নাই? অথচ এই নব্য হিন্দুত্ববাদীরা দাবি করছে তারা নাকি হিন্দুকালচারের রক্ষক! তারাই আবার প্লেট চেটে খাওয়াকে নিচা কালচার বলতে চাইছে! অদ্ভুত? তাদের মুসলমান বিদ্বেষে এতই প্রবল ঘৃণায় মারাত্মক যে তারা এখন সাহেব বা বিজ্ঞানবাদী হয়ে হলেও মুসলমান কোপাতে উঠেপড়ে লেগেছে!
হিন্দু-জাত-শ্রেষ্ঠত্ব কায়েমের উন্মাদনায় ঘৃণা ছড়ানোটা বিজেপি সংগঠিত ও প্রবলভাবে করেছিল তাদের আইটি সেল ও ক্যাম্পেইনের প্রধান অমিত মালব্যের নেতৃত্বে। এটা ঠিক যে ভারতে ইতোমধ্যে কবে থেকে করোনাভাইরাস সমাজে প্রান্তরে ইতোমধ্যেই প্রবেশ করে ফেলেছে তা সরকারের জানা ছিল না। এখন বুঝা যাচ্ছে ভারতে লকডাউনের সিদ্ধান্ত আরও আগেই নেয়া উচিত ছিল। সেটা সরকারেরও বুঝতে অজানা থেকে গিয়েছিল, আর এতে শুধু মুসলমান নয় হিন্দু ধর্মের নানা সমাবেশকেও তাই একইভাবে সরকার অনুমতি দিয়েছিল। সুতরাং আইনি দিক থেকে দেখলে তাবলিগ জামাত কোন আইনভঙ্গ করে নাই তাই দোষীও নয়। তাবলীগের সমাবেশ মানেই বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকে আসা মানুষের সমাবেশ। যদিও তারা দলবদ্ধভাবে নিজেরা বিভিন্ন দেশের ঘটনার প্রতি লক্ষ্য রেখে নিজেরাই স্বেচ্ছায় আগাম সতর্কতা হিসাবে সমাবেশ করা থেকে এবার বিরত বা দেরি করতে পারলে এর সুবিধা সবাই পেতে পারত। এতটুকুই। কিন্তু আবার বলছি, এটা তাবলীগের কোন ক্রাইম নয়। বিদেশ থেকে উড়ে জাহাজে কী আর লোক আসেনি? অন্য ধর্মীয় সমাবেশ কী হয় নাই। কাজেই একমাত্র উতস তাবলীগ তা তো নয়। আর অন্যদেশ থেকে বিমানবন্দরে তাবলীগের লোকদেরকে বাধা দিয়ে কোয়ারানটাইনে না রেখে বাধাহীন সমাবেশে যেতে দেওয়ার দায়ভার অবশ্যই সরকারের সংশিষ্ট অফিসের। তবে যা কেউই ইচ্ছা করে করে নাই। ভারতে তাহলে তো মোদী সরকারই সবচেয়ে বড় ক্রিমিনাল যে সে লকডাউনের সিদ্ধান্ত দিতে দেরি করেছে। তবে অনেক নামাজি মুসলমানেদের বা আল্লার পথে থাকা মুসলমানদের কোরোনা ধরে না – এই জাতীয় নামাজি আবেগ ভরা কথা আমরা শুনেছি, এগুলো তাদের কোন কাজে আসেনি। উলটা অন্যের খোঁচাখুচি বা টিটকারি করে বলা কথাবার্থা শুনার কারণ হয়েছে। আবার নিশ্চয় যারা নামাজি হয়েও আবার করোনা আক্রান্ত হয়েই গেছেন তারা এজন্য কাউকে দোষারাপ করতে আগ্রহী হবেন না। কারণ, এগুলো এড়িয়ে চলাই বুদ্ধিমানের।
আসলে ভারত জুড়ে মুসলমান ঘৃণা ও বিদ্বেষ তো কেবল আজকের ঘটনা নয়, বিশেষত গত শতকের শুরু থেকেই তা চলে আসছে। দুর্জনের ছলের অভাব হয় না। এরই প্রভাব এখনও আছে আর তাতে এখন ভাল করে হাওয়া দিচ্ছে বিজেপি-আরএসএস। দেখেন, এরই প্রভাবে এক সময়ে কলকাতার বাংলা সিনেমার (উত্তম কুমারের শেষ আমলের) নায়িকা এখন বামপন্থিদের সাথে নানান সামাজিক ইস্যুতে সচেতন হিসাবে বিবৃতিদাতা অপর্ণা সেন, তিনি এবার ধরা পড়ে গেছেন। তিনিও হিন্দু শ্রেষ্ঠত্ববাদের জোশে ভেসে গিয়ে “ভারতের তাবলীগ জামাতকে ভারতে করোনাভাইরাস বৃদ্ধির জন্য দায়ী করে শনিবার (৪ এপ্রিল) টুইট করে” বসেছেন। এটা ঠিক ইদানিং মোদীর বিপক্ষে জনস্বার্থের নানান ইস্যুতে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারের বিপুল চাপ এমনকি মামলার মুখোমুখি হতে হচ্ছিল অপর্ণা সেনদের গ্রুপটাকে। তাই হয়ত ভেবেছিলেন এ সুযোগে না জেনে বুঝে মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দু শ্রেষ্ঠত্বের গান একটু গেয়ে দিলে মোদী হয়ত তাদের প্রতি নরম হবেন। তিনি তাবলীগ জামাতের কাজকে ‘ক্রিমিন্যাল অ্যাক্ট’ বলে তাদের কঠোর শাস্তি দাবি করেন। এতে বুঝা গেল তার মেন্টর বা বুদ্ধিদাতারই আইনি জ্ঞানে বিশাল ঘাটতি আছে আর অপর্ণা সেন সেই ফাঁদে পড়ে গেছেন। এছাড়া ঐ বিবৃতির পরে, সোশাল মিডিয়ায় অপর্ণা সে্নের বিরুদ্ধেই প্রশ্ন উঠতে থাকে যে তিনি কেবল মুসলমানদের জমায়েত করার দিকে এর বিরুদ্ধে বলছেন কেন? প্রায় একই সময়ে হিন্দু ধর্মীয় জমায়েতগুলোও কী হয় নাই? পত্রিকাটা লিখেছে “অপর্ণার এমন মন্তব্য করে নেটিজেনদের তোপের মুখে পড়েন। কেউ অপর্ণাকে উদ্দেশ্য করে বলছেন, ‘শুধু জামাত নিয়ে কথা বলে কী হবে? মন্দির বা রামনবমী নিয়ে বলছেন না কেন?’ অপর্ণা সরাসরি সমস্যার গভীরে না গিয়ে শুধু মন্তব্য করে ‘মাঙ্কি ব্যালেন্সিং’ করছেন।’ বলেও মন্তব্য করেছেন কেউ কেউ”।
তবে অমিত মালব্য এন্ড গংদের মিথ্যা কিন্তু সংগঠিত প্রপাগান্ডা শক্ত ছিল। কারণ, এমনিতেই করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতিতে দুর্বিষহ কষ্টকর জীবনে ছিল, ভারতের সাধারণ মানুষ, তাদেরই মনে সেই সুযোগে এই ঘৃণা ঢুকানো হয়েছিল। এতে ভারতজুড়ে হিন্দুজাত শ্রেষ্ঠত্বের সুপ্রিমিস্ট ধারণা, এক গভীর রেসিজমে ভারতকে ঢেকে ফেলেছিল। বিজেপি-আরএসএস তাদের এমন ‘পারফরম্যান্স’ দেখে বেজায় খুশি। কিন্তু ধর্মের কল বাতাসে নড়ে! পাপ বাপকেও ছাড়ে না!
বিজেপির তরুণ এমপি তেজস্বী সুর্য-এর বেয়াদবিঃ
বিজেপির তরুণ এমপি তেজস্বী সূর্য, তার এমন এক ‘পুরনো পাপের ঘটনা ছিল গত ২০১৫ সালে মার্চের। তিনি আরব নারীদের সম্পর্কে খুবই আপত্তিকর ও অসম্মানজনক মন্তব্য টুইট করেছিলেন তখন। লিখেছিলেন, “৯৫ শতাংশ আরব নারী যৌন-সন্তুষ্টি জিনিসটাই জীবনে বুঝেন নাই। তাদের প্রতিটি মা ভালোবাসায় যৌন-সন্তুষ্টির দিকটা কী তা না বুঝেই খালি বাচ্চা পয়দা করে যাচ্ছে”। বলাবাহুল্য, আরব নারীদের সম্পর্কে ইতরচিতজ্ঞানে এর চেয়ে অপমানজনক মন্তব্য সম্ভবত আর হয় না। এর মানে, যার মনে যেই-ই তার মত নয় – এক অপর – এমন তাদের প্রতি দগদগে ঘৃণা চুড়ে দেয়া ছাড়া তার আর কাজ নাই। নিজেদের জাতশ্রেষ্ঠত্বের অসুখে ভোগা এক গভীর বর্ণবাদ বা রেসিজম এটা।
মানব জনগোষ্ঠী দুনিয়ার বসতি স্থাপন করে যাত্রা শুরু করেছিল দুনিয়াটার নানা কোণে ছড়িয়ে ছিটিয়েই, আর শুরুতে তা ছিল পরস্পর একেবারেই যোগাযোগবিহীন। এ ছাড়া সবাই দুনিয়াতে একসাথেই বসতি স্থাপন শুরু করেনি, আগে-পিছেও আছে। আবার ভুমিগঠন, মাটি প্রকৃতি আর আরহাওয়া মানুষের প্রতি ফেবার সবার বেলায় একই রকম ছিল না। ফলে প্রত্যেকেরই জীবন অভিজ্ঞতা বৈচিত্রে ভরা। তবু নৃতত্ত্ববিদদের কড়া মন্তব্য হল, দুনিয়ার ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রতিটি মানবসভ্যতা তার নিজের বিকাশে সবাই শ্রেষ্ঠত্বের গুণসম্পন্ন হওয়ার সক্ষমতা নিয়েই বেড়ে উঠে। প্রকৃতির সাথে নানানভাবে সম্পর্ক পাতে, অদ্ভুত বৈচিত্রের ভিন্নতায় জীবনের নানান রূপ হাজির করে থাকে। কিন্তু পরে নানা দখলদার সভ্যতার চাপে নিজেদের আর আলাদা বৈশিষ্ট্যে ও অভুতপুর্ব সম্ভাবনাগুলোকে টিকিয়ে রাখতে পারে না, অবিকশিত থেকে যায় বা চাপা পড়ে থাকে। আর এই দখলদার সভ্যতাগুলোই নিজেদের বেইনসাফি জুলুমের কাজগুলোকে সাফাই দিতেই জাতশ্রেষ্ঠত্বের ধারণার মিথ্যা সাফাই নিয়ে আসে।
মানে সারকথায় তাঁরা বলতে চেয়েছেন; কাজেই সভ্যতার বিকাশে বড় ছোট বলে কিছু নেই, সবাই নানান দিকে শ্রেষ্ঠ হওয়ার সম্ভাবনাময় হয়েই জন্মায়। বরং পরে এমন জাতশ্রেষ্ঠত্বের দাবি করে যারা মানে, আসলে এবাই অন্যায় কলোনি দখলের পক্ষেই মিথ্যা সাফাই দেয়া। অথবা ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে নিজেদের জুলুমকেই বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করে থাকে। তবে খুশির কথা, দুই বিশ্বযুদ্ধ মানুষকে কঠিন শিক্ষা দিয়ে গেছে, অনেক কিছু শিখিয়েছে। বিশেষ করে হিটলারের চরম বর্ণবাদ দেখার পর থেকে বর্ণবাদবিস্তারে এসবের বিরুদ্ধে গ্লোবাল মানুষ নানা আন্তর্জাতিক আইন ও কনভেনশন তৈরি করে ফেলেছে। চলতি শতক থেকে একে জাতশ্রেষ্ঠত্বের বর্ণবাদ বা রেসিজম বলে চিহ্নিত করে একে বড় শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক আইন আদালত- সবই এখন অনেক শক্ত বুঝাবুঝির ভিতের উপরও প্রতিষ্ঠিত এবং জনমতও প্রবল সোচ্চার।
কিন্তু ২০১৫ সালে করা তেজস্বী সূর্যের ঘৃণামূলক মন্তব্য নিয়ে সে সময়ে ততটা প্রতিবাদ না হলেও এবার ২০২০ সালে তা ফিরে প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছে। এর মূল কারণ ইতোমধ্যে “তাবলিগের কারণেই ভারতে করোনা ছড়িয়েছে” অথবা “মুসলমানরা নীচু ধর্মীয় ও সভ্যতার আচার ও কালচারের মানুষ” এসব প্রপাগান্ডা করে ঘৃণা ছড়ানোর কাজ এবার ভারতে মোদীরা প্রবল করাতে এতে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে না চাইতেই এক বিরাট রেজিষ্ঠান্স বা প্রতিরোধ সংগঠিত হয়ে গেছে।
মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন শহরে কাজ করে মোটাদাগে এমন নিম্ন আয়ের শ্রমদাতা অথবা হোয়াইট কলার ম্যানেজার, সেমি ম্যানেজার ধরনের সব পদই ভরিয়ে রেখেছে ভারতীয়রা। যেমন কোন রেসিডেন্সিয়াল হোটেলে কেবল মালিক বা মালিকেরাই হয়ত আরব। কিন্তু এছাড়া এর নিচের সমস্ত নির্বাহী থেকে মিডলসহ তারও নিচের সব লেভেলের ম্যানেজার পর্যন্ত এরা সবাই প্রধাস্নত একচেটিয়া দক্ষিণ ভারতের। আর এরও নিচের স্টাফ বাকি সবাই – নিচের দারোয়ান পর্যন্ত সকলেই এশিয়ান আর সব দেশের। তাই এবার করোনাকালে মধ্যপ্রাচ্যের ঐসব ভারতীয়দের সবার মন-মানসিকতাতে ভারত থেকে আমদানি করা চিন্তার প্রভাবে যে মুসলমানদের ওপরে হিন্দুজাত শ্রেষ্ঠত্বের মিথ্যা বয়ান তা সহজেই স্থান পেয়েছিল। আর সেখান থেকে মধ্যপ্রাচ্যের সোশ্যাল মিডিয়ার হিন্দু ভারতীয়রা তাদের বিভিন্ন স্ট্যাটাসে যেহেতু আরবরাও মুসলমান, ফলে তাদের সম্পর্কেও অবাধে হিন্দুশ্রেষ্ঠত্বের বোধে বিভিন্ন বর্ণবাদী মন্তব্য লেখা শুরু হয়ে যায়। তারা ভুলে গেছিল তাদের ভাত-কাপড় যোগান দিচ্ছে কে? আর এ সময়েই একপর্যায়ে একজন ২০১৫ সালে তেজস্বী সূর্যের ঐ পুরানা আবার মন্তব্যও সামনে নিয়ে আসে একজন। আর এভাবে পুরো ব্যাপারটাতে শুরু হয় আরব সমাজ ও সরকারগুলোর কড়া প্রতিরোধ ও অ্যাকশন। তারা মন্তব্য নিয়ে ঐ মন্তব্যকারীদের অফিসকে নোটিফাই করাতে এবার ঐ অফিস থেকে তাদের চাকরিচ্যুতির এবং দেশ থেকে বের করে দেয়ার নোটিশ হাতে ধরিয়ে দেয়া শুরু করেছিল।
কারণটা হল, কোন বনেদি ব্যবসায়ী কখনই চাইতে পারে না যে তার ক্রেতা কেবল একটা ধর্মের লোকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকুক। এটা বাণিজ্য বিকাশের পরিপন্থি। কারণ ক্রেতা কম হবে, সীমিত হয়ে যাবে। তাই ধর্ম নির্বিশেষে সকল ক্রেতাই তার কাছে কাম্য ও আদরণীয় হয়। এমনকি তিনি ব্যক্তিগতভাবে কোন্ ধর্ম বা ভুগোলের মানুষকে তেমন পছন্দ না করলেও সেকথা চেহারায় কোনভাবেই ফুটে উঠতে দেন না, একান্ত ব্যক্তিগত করে রেখে দেন বরং কার্যকর চেহারাটা হল তিনি সবার সহবস্থানই পছন্দ করেন। তাই তিনি মুসলমানদেরকে গালি দিচ্ছে, নিচা দেখাচ্ছে এমন ভারতীয় কর্মচারিকে সবার আগে চাকরিচ্যুত করবেন, এরপর ঐ কর্মচারির জন্য দেশত্যাগ করানোর একশন নিয়েছেন সেটাই দেখাতে চাইবেন যাতে সকল ক্রেতাদের আস্থা বাড়ে ও অটুট থাকে। তাই এককথায় দুরতক চিন্তা করা বুদ্ধিমান ব্যবসায়ী মাত্রই তিনি সহবস্থান-বাদী। মোদী ও তার দলের চরম বেকুবি আত্মঘাতি অবস্থানটা এখানেই। এটাই এখনকার স্টান্ডার্ড গ্লোবাল বিজনেস কালচার। মোদী ও তার দল যেখানে তুলনায় ঘোরতর মফস্বলি সংকীর্ণ এক নাদান বালক! কুয়ার ব্যাঙ মাত্র!
ভারতের দ্যা প্রিন্ট পত্রিকা বলছে, অ্যাকশন শুরু হয়েছিল দুবাইয়ের এক আরব নারী ব্যবসায়ীর উদ্যোগ থেকে [Among the first to call out Surya was Dubai-based businesswoman Noora AlGhurair,…]। তিনি প্রথম এক টুইটে লিখেছেন, ‘করুণা হয় সেই শিক্ষাকে যা তোমাকে নারীদের অসম্মান করতে শিক্ষা দিয়েছে” [“pitied his upbringing that has taught him to disrespect women”.।’ এ ছাড়া তিনি “আরব দেশের ভিসা নিয়ে ঘুরে বেরিয়ে আবার আরব নারীদের অপমান করার ব্যাপারে” সতর্ক করে, এমপি সূর্যের পুরনো টুইটটাকে সাথে গেঁথে দিয়ে নতুন করে টুইট করে দিলেন। স্বভাবতই এবার এটা ভাইরাল হয়ে যায়। তিনি আসলে একই সাথে ভারতে মুসলমানদের সাথে অসাম্য ও অধস্তন আচরণের ব্যাপারে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেন।
“করুণা হয় সেই শিক্ষাকে যা তোমাকে নারীদের অসম্মান করতে শিক্ষা দিয়েছে” – Noora AlGhurair
দ্বিতীয় উদ্যোগ বা সতর্কবাণী আসে আরেক আরব নারীর কাছ থেকেও। তিনি দুবাই রাজপরিবারের রাজকুমারী এক বিদুষী, হেন্দ আল কাসেমি [Princess Hend Al Qassimi]। তিনি সতর্ক করে বলেন, “যারা এই খোলাখুলি রেসিজম এবং মানুষে মানুষে বৈষম্য সৃষ্টির চোখে দেখে মন্তব্য করছেন যা দুবাইয়ের আইন অনুসারে জরিমানাযোগ্য অপরাধ এবং এ কারণে দেশ থেকে বের করে দেয়া হতেও পারে”। Anyone that is openly racist and discriminatory in the UAE will be fined and made to leave. তিনি আরও হুমকি দিয়ে বলেন “এসব ইসলামফোবিক কাজের প্রত নজর রাখা হবে”। এর পর থেকে এক চেইন রিঅ্যাকশনে মধ্যপ্রাচ্যের শহরগুলো থেকে প্রতিক্রিয়া ও অ্যাকশনের ঝড় বইতে শুরু করে। অনেকেই চাকরি হারায় এবং অনেককে দেশ থেকে বের করে দেয়া হয়। অনেকেই সরাসরি মোদীকে “একশন দেখতে চাই বলে” টুইট করেন। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মোদি এর প্রতিক্রিয়ায় মুখরক্ষার দায় ঠেলা এম মন্তব্য করেন টুইটে বলেন, করোনা কোনো ধর্ম মানে না। তাই সংক্রমণে আক্রান্তের জাত ধর্ম বিচার ঠিক নয়।’অথচ বাস্তবে মোদীর দলের নেতাকর্মীরা মুসলমানদের নীচু দেখানো আর করোনা সংক্রমণ ছড়ানোর জন্য দায়ী করে আগের প্রপাগান্ডা চালাতেই থাকেন।
এদিকে ভারতের এক নারী তেজস্বী সূর্যকে উদ্দেশ করে আর্টিকেল লিখে তাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। তিনি বলেন, নারী-পুরুষের সম্পর্কের সমস্যাটা কোন আরব-অনারবের সমস্যাই নয়। তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, ভারতীয় নারীদের অবস্থা কী, সেটা খুঁজে না দেখে সে সমস্যা কেবল আরব নারীদের বলে দাবি করতে গেছেন কেন? এটাই তো বর্ণবাদ।
কিন্তু প্রশ্ন জাগে এই তরুণ সূর্য আরব নারীদের অপমান করে নীচু করছেন কেন? বিশেষত পাঁচ বছর আগে তিনি যখন মাত্র ২৪ বছরের তরুণ?
এর সম্ভাব্য কারণ হল, প্রথমত এই তরুণ কেবল বিজেপির নয়, একেবারে আরএসএসের “স্বয়ংসেবক” সদস্য। মানে এর কোর মেম্বার ও প্রশিক্ষিত ভলিন্টিয়ার। কোন প্রশিক্ষণ? গত ১৯২৫ সালে আরএসএসের প্রতিষ্ঠাতা মাধব সদাশিব গোলওয়ালকার যিনি হেডগেওয়ারের পরে আরএসএসের পরবর্তী সর্বোচ্চ প্রধান নেতা হয়েছিলেন, তিনি হিটলারের বর্ণ-বিশুদ্ধতার মতবাদে অনুপ্রাণিত ছিলেন। তাদের হাতে এই প্রশিক্ষণের মূল নীতি নির্ধারিত হয়েছিল। হিটলার বেঁচে থাকা অবস্থায় এরা হিটলারের এসব তত্ব শুনে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তাই হিটলারের জাতের ‘খাঁটিত্ব’ তারাও মানতেন। আর সেখান থেকে এটা তাদের প্রশিক্ষণের ম্যানুয়াল ও গাইডলাইনে উঠে বসে। এদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের জাতবর্ণবাদী বক্তব্যের উত্থান এবং পতন এবং ফিজিক্যালি তার মৃত্যু ও বিনাশ এসব মিলিয়ে সারা ইউরোপ এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে তাদের রাষ্ট্রের গঠনভিত্তিটাই বদলে নিয়েছিল। সারা ইউরোপের গঠন ভিত্তি বলতে মোটামুটি (১৬৫০-১৯৫০) তিনশ বছর ধরে একই গড়ন। সেটা হল এরা সব রাষ্ট্র গুলোই ছিল আসলে জাতি-রাষ্ট্র বা নেশন স্টেট। অর্থাত সেগুলো আধুনিক রিপাবলিক বলে নিজেদের দাবি করলেও আদতে সেগুলোর মূল বৈশিষ্ঠ ছিল নেশন স্টেট। সারকথায় ‘জাতের ধারণা’ ফলে জাতিঘৃণাও প্রবল এমন এক ‘জাত-রাষ্ট্র (nation state) সেগুলা। আর এখান থেকেই এর সবচেইয়ে চরম রূপটাই হল হিটলারি জাতশ্রেষ্ঠত্ব, এক রেসিজম। তাই এই ভিত্তিটাকেই বদলে নিতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল ইউরোপ। ১৯৫৩ সাল ইউরোপের ৪৭ টা রাষ্ট্র তাদের গঠনভিত্তি বদলাতে এক কনভেনশনে মিলিত হয়েছিল। যেখান থেকে নেশনস্টেটের বদলে তাদের প্রত্যেক রাষ্ট্রের গঠনভিত্তি হয় নাগরিক অধিকারভিত্তিক রাষ্ট্র। আর এর গৃহিত কনভেনশনটা সদস্য সকলে মানছে কিনা তা তদারকের জন্য, এবং তা সকলের জন্য মানা বাধ্যতামূলক এমন একটা সুপ্রীম কোর্ট গঠন করে নেয়া হয়েছিল।
কিন্তু বিজেপি ইউরোপের এসব সংশোধণ আর এসব শিক্ষানেয়ার তাতপর্য কখনও বুঝেও নাই, গ্রহণও করে নাই। তবে এই সমস্যাটা একা বিজেপি-আরএসএস নয় সারা ভারতের নেহেরু-গান্ধী বা কোন কমিউনিস্টসহ সব রাজনৈতিক দলের ভিতরই রাষ্ট্রধারণা বলতে nation state ধারণাটাই শুরু প্রবল নয় বরং একমাত্র অর্থ হয়ে গৃহিত থেকে আছে। ততফাত সম্ভবত এতটুকুই যে বিজেপি-আরএসএস সবসময়ই তাদের উগ্র জাতিবাদ প্রকাশ্যে বলে চর্চা করে। আর কমিউনিস্টসহ অন্যেরা সকলেই কঠিন জাতিবাদী। কিন্তু মুলকথাটা হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের চরম উত্থান-পতন থেকে জাতি রাষ্ট্র ধারণা একেবারেই পরিত্যাগ করার যে শিক্ষা দিয়ে গেল, ইউরোপ অন্তত তাদের রাষ্ট্রের গঠন ভিত্তি বদলে যেটার স্বীকৃতি দিয়ে গেল – এই শিক্ষার কোন প্রভাব – কোন জানাশুনা, কোন আলোচনা কোথাও নাই। এমনকি কোন একাদেমিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব ধারণা এসেছে আমাদের জানা নাই। এছাড়া সুনির্দিষ্ট করে কমিউনিস্টদের দায় হল, তারা আধুনিক রিপাবলিক রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে নয়, এর ব্যাপারেই সিরিয়াস নয় শুধু তাই নয়। কখনও এটা স্টাডির বিষয়ও করে নাই। বরং এমনকি অধিকার বা রাষ্ট্র ধারণা এগুলো তার রাজনীতিও নয় কোন এজেন্ডাও নয় মনে করে থাকে এখনও। একমাত্র ব্যতিক্রম সম্ভবত নতুন নেপাল। অথচ ্মনের ভিতরে সকলেই কোর ধারণায় একেকজন nation state বা জাত-রাষ্ট্রবাদী। মজার কথা আমাদের বাঙালি জাতিবাদও একই nation state বা জাত-রাষ্ট্রবাদী। এমনকি পাহাড়িভায়েরাও এর বাইরে নয়। জুম্মু জাতিবাদও একই nation state বা জাত-রাষ্ট্রবাদী। আসলে কেউই চোখ খুলে তাকায় দেখে নাই, দুনিয়া যুদ্ধের পর কোনদিকে গিয়েছে, আবার কেমন করে দেখতে হবে তাও কখনও জানা হয় নাই। বরং সারা ইউরোপের যে তিনশ বছরের জাতিরাষ্ট্র ধারণা চ্চালু ছিল, চোখ বন্ধ করে সেটাই কপি করে চলেছে এরা।
তাহলে দাড়ালো চিন্তা ও চর্চার সমস্যার সংকীর্ণতা এটা একা বিজেপি-আরএসেওএসের না। যদিও বিজেপিত-আরএসএসের বেলায় তা সবচেয়ে উগ্রভাবে প্রকাশিত। তাদের ট্রেনিং সিলেবাস এমন চিন্তা এক খোলাখুলি বিষয়। যার পরিণতি এখন হাতেনাতে মোদী পাচ্ছেন। যদি মোদী এখন থেকে কোন শিক্ষা পাবেন সে সম্ভাবনা দেখা যায় না।
যদিও উগ্র জাতি রাষ্ট্র মানা না মানার ব্যাপারে আরএসএসের চেয়ে বিজেপিতে শিথিলতা কিছুটা রাখা হয়েছে। এ কারণে যারা সরাসরি আরএসএসের সদস্য তারা এত কট্টর বেশি। তেজস্বী সূর্য আরএসএসের সদস্য হিসেবেই সবিশেষ প্রশিক্ষিত। এ ছাড়া তেজস্বী সূর্য বেঙ্গালুরু বিজেপির আইটি সেলের প্রধান। যে আইটি সেল মানে হল অমিত মালব্যের অধীনে মূলত মুসলমানবিদ্বেষী প্রপাগান্ডা সেল। গত বছর ইউরোপীয় ইউনিয়ন এক তদন্ত করেছিল ইউরোপের ভিতরে বসে ভারতের কারা মুসলমান নাম নিয়ে ফেক ওয়েবসাইট চালায়। তাতে যাদের নাম প্রকাশিত হয়েছিল তাদেরই একজন হল তারেক ফাতাহ। এখানে একটা রিপোর্টে তার নাম ও ছবি আছে। তিনি মূলত পাকিস্তানি-কানাডিয়ান। তিনি বিজেপিকে ভুয়া ওয়েবসাইট আয়োজন করে দিয়ে অর্থ কামিয়ে নিয়ে থাকেন। এতাই তার পেশা।
এখানে এক মজার দিক হল তেজস্বী সূর্য যে টুইট করে কুখ্যাতি পেয়েছেন, সেটা এবার ভাইরাল হয়ে গেলে পর তিনি দাবি করেছেন- এই ভাষ্য তার নয়। এটা নাকি ওই (ভাড়াটে) তারেক ফাতাহ মন্তব্য। যা হোক এই মন্তব্য অন্যের নামে চালিয়ে এমপি সুর্যের কোন অসতকাজের দায়ে পড়েনি বলে মনে করছেন। কারণ তিনি মূলত যেন নাম ভাড়া দেয়া অথবা ফেক ওয়েব সাইট ভাড়া দেয়া ভাড়াটঙ্কে কিনেছেন। অমিত মালব্যের সাথে তারেক ফাতাহ এর সম্পর্ক এই সুত্রে, অমিত হল ক্রেতা এবং ফেক মুসলমানবিদ্বেষী খবরের অর্ডারদাতা। আর সেখান থেকেই তারেক ফাতাহ আর তেজস্বী সূর্য-এরা হয়ে যান নানান ছোটবড় ছিচকে কিন্তু ঘৃণিত অপধাধের সাগরেদ। তেজস্বী সূর্য তারেক ফাতাহ এর নামে নিজের অপরাধ চালিয়ে দিলেও কেন তিনি ভাড়াটের মন্তব্য ব্যবহার করলেন , সে জবাব দেননি।
এখন এ দিকে সর্বশেষ হল, দুবাইয়ে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত পবন কাপুর ঐ ২১ এপ্রিলই বুঝেছিলেন মোদী ও তার দল যাই করুক অফিসিয়ালি তাকে ভারত রাষ্ট্রের হয়ে কিছু একশনে যেতে হবে। তাই তিনি ঐদিনই ভারতীয়দের সতর্ক করতে টুইট করে বলেছেন, ‘ভারত ও আরব আমিরাত (দুবাই) একই নাগরিক বৈষম্যহীনতার নীতিতে বিশ্বাসী [India and UAE share value of non-discrimination, says ambassador] ফলে সবাই যেন সতর্ক থাকেন”। এই শুকনা কথায়ই কি মধ্যপ্রাচ্য রাজি হবে, বিশ্বাস করবে, অপমান ভুলতে পারবে? স্বভাবতই তা হবার কথা না। তাহলে?
সর্বশেষটা দেখতে পাচ্ছি আজকে। মোদী আপোষ প্রস্তাব দিচ্ছেন। এতদিন দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাজ মসজিদে তাবলিগ জামাতের প্রধান মওলানা সা্দকে হয়রানি আর হেস্তনেস্তের চরমে নেয়া হচ্ছিল। মুসলমানেরা নিচাজাতের বলে সারা ভারতজুড়ে জাতঘৃণাটা এই মওলানা সাদের কান্ধে বন্ধুক রেখে ঐ মামলার ভয় দেখিয়ে চাপে ফেলে করা হচ্ছিল। দিল্লি পুলিশের প্রচার তুঙ্গে উঠেছিল মওলানা সা’দ নাকি পরিকল্পিতভাবে ভাইরাস ছড়িয়েছেন আর এর ভিডিও ফুটেজ আছে পুলিশের কাছে। অথচ আজকের রিপোর্ট হল সেই দিল্লি পুলিশই বলছে, মাওলানা সা’দের নামে প্রচারিত সেই অডিও ক্লিপ ভুয়া, এডিট করা, ফেক ভিডিও। এর মানে হল, মোদী-অমিত এখন সা’দের বিরুদ্ধের মামলাকে ফেক বলে স্বীকার করে তা উঠিয়ে নেওয়ার বিনিময়ে সওদা করতে চাইছেন, এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আর এখন তিনি চাইবেন বিনিময়ে মওলানা সা’দ ও তার বন্ধুরা যেন এখন মধ্যপ্রাচ্যের সমাজ ও শাসকদের কাছে মোদী সরকারের পক্ষে সুপারিশ করেন। যাতে ইতোমধ্যে ভারতীয়দের যা ক্ষতি হয়ে গেছে গেছে তবে তা আবার স্বাভাবিক পুরানা সুবিধাদির জায়গায় যেন ফিরে আসে। ইতোমধ্যে গত পরশুদিন টুইটারকে মোদী সরকার সরকারি তরফ থেকে এক চিঠি দেয়া হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে ইতোমধ্যে যে ১২১ টা টুইট করা হয়েছে মোদীর দলের নেতা এমপি বা মন্ত্রীর তরফ থেকে, মওলানা সা’দকে টেররিস্ট বলে অথবা ইসলামের বিরুদ্ধে নন্দা বা আপত্তিকর শব্দে – যেন এসব টুইট মুছে সরায়ে বা মুছে ফেলা হয়। কিন্তু এতে কার ভাগ্য খুলল টুইটারের বা মোদীর? আসলে মোদী এখানে নিজের ইজ্জত রক্ষার্থে এই পদক্ষেপ নিল। তাহলে এতদিন সা’দের বিরুদ্ধে এগুলো চলতে দিয়েছিলেন কেন? এটা কী সরকার চালানোর কোন নীতি হতে পারে? এত নিলজ্জ ও ইতরচিত! তাহলে শিক্ষাটা কী এখানে? শিক্ষাটা হল দুবাইয়ের একজন রাজকুমারিও জানেন কোনটা রেসিজম-জাতবর্ণবাদ এবং কেন এটা পরিত্যাজ্য ও অপরাধ। অথচ একজন প্রধানমন্ত্রী মোদী ও তার দলবল আরএসএস পর্যন্ত এর সাগরেদেরা – এদের কেউই তা জানে না, শিখতে পারলও না! হায়্ হিন্দুত্ব!
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
[এই লেখাটা গত ০৯ মে ২০২০ দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ওয়েবে ও পরেরদিন প্রিন্টে আর “বিজেপির শ্রেষ্ঠত্ববোধ বিপদে” – এই শিরোনামে উপ-সম্পাদকীয়তে ছাপা হয়েছিল। পরবর্তিতে সে লেখাটাই এখানে আরও নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে এখানে আজ ছাপা হল। ]
The most dangerous things are that these peoples are educated, established who traveled to many countries, and still believe in RSS terrorisms.
LikeLike
আপনার লেখা ও বিশ্লেষণ ভাল লাগল। আশা করি ভারত বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মুসলিমদের হিন্দুফোবিয়া, হিন্দুবিদ্বেষ, গজওয়ায়ে হিন্দ, জিহাদ ইত্যাদির চর্চা ও প্রসার ও হিন্দুসমাজে তার প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি নিয়েও এরকম মনোজ্ঞ ভাষায় তথ্যমূলক বিশ্লেষণ লিখবেন। অপেক্ষায় থাকলাম।
LikeLike
যেকোন ধর্মবিদ্বেষই নিন্দনীয়।
তবুও ধর্মীয় রাজনীতিও থেকে যাবেই। আর সব ধর্মীয় রাজনীতির মধ্যেই জেনে না না জেনে অন্যের প্রতি ধর্মবিদ্বেষ থেকেই যায়, সাধারণত।
আপনার কথা খেয়াল রাখব।
থ্যাঙ্কস
LikeLike