চীন কী মোদীর ভারতকেও নেহেরুর মতই শিক্ষা দিবে


চীন কী মোদীর ভারতকেও নেহেরুর মতই শিক্ষা দিবে

গৌতম দাস

০১ জুন ২০২০, ০০:০৬ সোমবার

https://wp.me/p1sCvy-31G

ইন্ডিয়া-চায়না বর্ডারে মুখোমুখি ২০২০_

এই মুহূর্তের দুনিয়ায় বিশেষ করে এশিয়ায় সবচেয়ে উত্তেজনাকর, যা কোনো কোনো ক্ষেত্রে করোনাভাইরাস ইস্যুকে ছাড়িয়ে উত্তেজনাকর- এমন খবর হল, লাদাখে চীন ও ভারতের মুখোমুখি সৈন্যসমাবেশ, গায়ে হাত না লাগিয়ে ধাক্কাধাক্কি ইত্যাদি। তা একটা নদীর [Galwan River valley, Pangong Lake and other areas] দু’পারে বিমানবাহিনীর সমাবেশ ঘটানো পর্যন্ত এগিয়ে গেছে। এসব ঘটনা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থার নিউজে অথবা  সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিডিও ক্লিপে ছড়িয়ে পড়েছে, আমরা দেখতে পাচ্ছি। এসব দেখার পরেও চীন-ভারত যুদ্ধ লেগে যাচ্ছে কি না, এ নিয়ে যাদের এর পরও বিশ্বাস করতে মন চায়নি; তাদেরও হিলিয়ে দেয়া ঘটনাটা হল, গত  ২৬ মে’র চীনা রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেখানো এক রিপোর্ট যা রয়টার্সের বরাতে বাইরের দুনিয়ায় আমরা জেনেছি। এটা মূলত অভ্যন্তরীণভাবে চীনা সেনাবাহিনী পিএলএ বা পিপলস লিবারেশন আর্মিকে উদ্দেশ করে দেয়া তাঁর নির্দেশ। তাদের বার্ষিক সভা চলাকালীন প্লেনারি সেশনের ফাঁকে দেয়া কমিউনিস্ট পার্টি সেক্রেটারি ও চীনা প্রেসিডেন্টের দেয়া বক্তব্য।
সেখানে তিনি বলেন- ১. ‘সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে যেতে পারো তোমরা, এটা ধরে নিয়ে প্রস্তুতি নাও। ২. যুদ্ধপ্রস্তুতির ধাপ উপরে তুলো। ৩. নির্ধারকভাবে দেশের সার্বভৌমত্ব সুরক্ষার প্রস্তুতি নাও ইত্যাদি ধরনের ‘সৈনিকদের উত্তেজিত করা’ বক্তব্য তিনি ব্যবহার করেছেন। হংকং থেকে প্রকাশিত এশিয়াটাইমস-এর ভাষায়, এটা ‘চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের প্রতিবেশী ভারতকে লক্ষ্য করে বলতে সচরাচর দেখা যায় না এমন যুদ্ধবার্তা [an unusually belligerent message directed at neighboring India.]।

[এই রচনার দৈর্ঘ অনেক বড় মনে হবে যেসব পাঠকের কাছে তারা নিচের প্যারার মত যেগুলো ডানদিকে চেপে অনেক ছোট করা আছে এমন প্যরাগুলো পুরা বাদ দিয়েই পড়তে পারেন। কম-চওড়ার এসব প্যারা মানে আসলে এই অংশ বিস্তারিত করতে লেখা হয়েছে। ফলে এই অংশগুলো বাদ দিয়েও কম দৈর্ঘে ফলে কম সময়ে লেখাটা পাঠ করে শেষ করা যেতে পারে।]

Line of Actual Control (LAC) মানে, দাগ দেয়া নাই এমন অচিহ্নিত সীমান্তঃ
আমাদের এদিকের বিশেষ করে ভারতের সকল মিডিয়া সারাদিন তার পাঠক-দর্শকদের কাছে রিপোর্ট করে যাচ্ছে যে এই চীনা হামলা শুরু হয়ে গেল কী না! এটা স্বাভাবিক কারণ ভারতের সব স্তরের মানুষের জীবন-অর্থনীতি এর সাথে জড়িত। তাদের জীবনে কী উলটপালট হতে চলেছে সেই খবর-ইঙ্গিতে জুড়ে থাকা উদ্বিগ্নতাও এটা বয়ে আনছে।  আর আমরাও তাদের উত্তেজনা ও অস্থিরতার প্রভাবে সেসব নিউজ প্রভাবের অন্তত কিছু অংশ আমরাও দেখতে পড়তে বাধ্য হচ্ছি।
কিন্তু সেখানে গিয়ে অপরিচিত কিছু টার্ম বা শব্দের ব্যবহারের কারণে আমাদের অনেকের সম্ভবত বুঝতে কিছু সমস্যা হচ্ছে। যেমন, এলএসি (LAC বা লাইন অব একশন)। এই শব্দের উতপত্তি বা অর্থ কী? তা বুঝাতে খুব সংক্ষেপে বললে – চীন-ভারতের সীমান্তবিরোধের উতপত্তি কোথা থেকে এবং কেন, এই প্রশ্ন থেকে শুরু করব। আমাদের অনেকের বড় ভুল ধারণা হল, রাষ্ট্র, সীমান্ত বা সার্বভৌমত্ব ইত্যাদি ধারণাগুলো বুঝি আজীবনই ছিল। অনেকে আবেগের ঠেলায় এটাকে দেড়-দুহাজার বছরের পুরানা আমলেও এমন ধারণা প্রচলিত ছিল বলেও মনে করে বসেন। কিন্তু ইতিহাস হল, এই তো মাত্র ১৬৪৮ সালে প্রথম রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ধারণাটা প্রচলন শুরু হয়েছিল। কিছু ছোট ছোট ঘটনা থেকেই এখনই এর প্রমাণ আমরা পেতে পারি। যেমন পুরানাকালে রাজধানীর নামই দেশ-ভুখন্ডের নাম বলে আমরা দেখে থাকি আমরা। যেমন সে আমলে ইরাক বলে কিছু নাই, কিন্তু বাগদাদে আব্বাসীয় খলিফা শাসন ছিল জানি। ইতালি নাই, কিন্তু রোম ছিল। সিরিয়া নাই কিন্তু দামাস্কাস ছিল। সারকথা, ঠিক রাষ্ট্র ধারণাটা তখন অত জরুরী না, বিকশিতও হয় নাই তেমন। মূলকারণ প্রায় সবই ছিল মুলকথায় একেকটা মনার্কি বা রাজতন্ত্র। অর্থাৎ পাবলিকের যে বলার কিছু থাকতে পারে বা ‘নাগরিক’ ধারণা আসে নাই বলে, নাগরিকই নির্ধারক এই বোধ তখনও গরহাজির, অবিকশিত।  তাই দেশ ধরণের ধারণা আছে কিন্তু তার সীমানা কতদুর সেটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না, এমন পরিস্থিতিই বজায় ছিল। তাই রাজধানী বা মূল শহরের নামই রাজার ভুখন্ডের নাম। এরপর প্রথম সীমানা ভাগ করে নেয়া বা সার্বভৌম ধারণার কথা উঠে ও প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায় সারা ইউরোপের আপোষে ভাগ বাটোয়ারায়, ১৬৪৮ সালে। হলি রোমান এম্পায়ার (পুরান রোম-কেন্দ্রিক রোম সাম্রাজ্য নয়) ভেঙ্গে সীমানা চিহ্নিত করে ইউরোপে আলাদা আলাদা সব রাষ্ট্র হয়ে যাওয়া। খ্রীষ্টিয় ৮০০ সালে এর পত্তন ঘটেছিল [Charlemagne in the year 800]। এখানে সার্বভৌম কথার অর্থ হল, যতদুর ভুখন্ডের উপর সর্বময় ক্ষমতা কর্তৃত্ব ঐ দেশ-রাষ্ট্র বা সরকারের আছে বলে স্বীকার করে নেয়া হয়। কাজেই সার্বভৌমত্বের ধারণা আর দেশ-রাষ্ট্র সীমানা নিয়ে আমাদের সচেতন হয়ে উঠা একই ধারণা, একই সময়ের ধারণা। ইউরোপের এই ধারণাই আস্তে আস্তে সারা দুনিয়ায় পরে ছড়িয়ে পড়েছিল।
তা না হয় হল, কিন্তু সেই ধানভাঙ্গার গীত এখানে কেন? আসলে এতক্ষণ হল পটভুমি গুছানো। এরপর এখন সরাসরি আমাদের  – রাষ্ট্র সীমানা বা বর্ডার  – প্রসঙ্গে ঢুকবো। দুনিয়ার বহু অসন্তোষের এক প্রধান উতস হল তিনশ বছরের কলোনি দখল ও শাসন।  তাই এই চরম অন্যায় জুলুম নির্যাতনের স্বপক্ষে আমাদের কোন সহানুভুতি থাকবার কোনই কারণ নাই, আগামিতে হবে না।  কিন্তু অনেক সময় “পড়ে পাওয়া” ঘটনা থাকে। মানে খারাপ করতে চেয়েও অজান্তে ফাঁক দিয়ে অনিচ্ছায় কিছু ভাল জিনিষ হয়ে যায়। একে “খারাপ উদ্দেশ্য অজান্তে কিছু ভাল কাজ ঘটিয়ে ফেলা” – বলতে পারি। যেমন বৃটিশ-ইন্ডিয়াতে বৃটিশ কলোনি শাসকেরাই প্রথম সে আমলের ইন্ডিয়ার “সীমানা চিহ্নিত” করিয়েছিল।  সীমানা চিহ্নিত করা কথাটায় গুরুত্ব দিতে বলব। এই কাজটা একা মানে একা কোন রাষ্ট্র করতে পারে না, তা করা ও মানাও হবে না বলে।  যেমন, নেপাল আর ভারতের সীমানা ঠিক কোথায় হবে সেটা একা নেপাল অথবা একা ভারত করলে লাভ হবে না। কারণ, সীমানা টানা মানে পড়শিরও সেই সীমানা মেনে নেয়া হতে হবে। এবং একই দলিল দুজনের কাছেই, একই কপি থাকতে হবে। যার অর্থ সব আগামি বিতর্কের মাথা মুড়ে দেওয়া হয়ে যাবে এতে। সীমানা তাই একসাথে বসে একমতে টানতে হয়। তবেই সেটা ডিমারকেশন হবে।  এভাবে পুরা বিষয়টাকে ডিমারকেশন [Demarcation] বা সীমানা চিহ্নিতকরণ প্রক্রিয়া বলে বুঝতে হবে। এই কাজটাই, বৃটিশ-ইন্ডিয়ার বেশীর ভাগ অংশই এভাবে পড়শির সাথে ডিমারকেট করে নেয়া হয়েছিল। কিন্তু এটা খারাপ লোকের বিরাট ভাল কাজ বলছি কেন?
কারণ গত তিনহাজার বছরের মানব ইতিহাসও যদি ধরি,   দেশ-রাজ্যের ভুগোল মানেই তা হল আসলে ক্রমাগত দখল আর পাল্টা-দখলে বিভিন্ন রাজ-রাজরা শাসনের ইতিহাস। এখন একালে বসে এতসবের মধ্যে কোন রাজার সময়ের সীমানাটাকে একালে সহি মানব? বিশেকরে একালের দুই দেশের বিতর্কে একেকজনে একেকটাকে সীমানার ভিত্তি বলে দাবি করতে থাকলে এনিয়ে বিতর্কের শেষ করে সমাপ্তি টানা কখনই সম্ভব হবে না।  আমরা জানি সীমান্তবিরোধ থেকেই অনেক বড় বড় যুদ্ধ লেগেছে। এইকথা মনে রেখে যুদ্ধ এড়ানোর লক্ষ্যে জাতিসংঘ ভুমি-নৌ-আকাশ সীমানা চিহ্নিত করার ভিত্তি কীহবে তা নিয়ে আন্তর্জাতিক নানান নিয়ম-কানুন কনভেনশন তৈরি করেছে। সেই ভিত্তি ঠিক করার পদ্ধতি নিয়ে সদস্য রাষ্ট্রের কনভেনশনে সাব্যস্ত করা সর্বসম্মত পথ হল কলোনি আমলের চিহ্নিত বা তৈরি ম্যাপ বা কলোনি ডিমারকেশনেই সব পক্ষের কাছেই গ্রহণযোগ্য সীমানা বলে মেনে নেয়া হবে । অর্থাৎ আগে যা হয়েছে হয়েছে যেহেতু কলোনি আমলে একবার সবপক্ষকে নিয়ে বসে সীমানা টানা হয়েছিল আর এর রেকর্ড সবপক্ষের জন্য পাওয়া সহজ ও এভেইএবল, তাই ঐ ম্যাপই সবাই গ্রহণ করে চলবে। তাহলে এখন চীন-ভারত সীমানার কলোনিয়াল ম্যাপ নিশ্চয় আছে, তাহলে আর এখন  বিরোধ আবার উঠে আসছে কোথা থেকে?

কারণ কলোনি শাসকেরা সকল সীমান্তের ম্যাপ টানেন নাই। তবে ঠিক ঢালাওভাবে নয়। কিছু কিছু পকেটে সীমানা-বিরোধ সেকালেও বিতর্কিত থাকাতে মিটানো যায় নাই বা হয় নাই। এছাড়া  কলীনি মালিকদের আগ্রহ বা দরকারের তীব্রতা না থাকায় বহু এলাকাতেই (পকেটে) কখনও সীমানা চিহ্নিত করার আসর বসেই নাই। এছাড়া এমন আরেক বড় সমস্যা ছিল কিছু এলাকায়। এমন ফাঁকা সীমান্ত হল কলোনি আমলের “প্রিন্সলি স্টেট” বা করদ রাজার রাজ্যগুলো। কারণ ইন্ডিয়া বলে একটা অখন্ড একটা দেশ বা রাষ্ট্র এমন ভারতবর্ষ বলে কোনদিনই কিছু ছিল না, বৃটিশ আমলেও না। লিগাল স্টাটাস বা মর্যাদা হিসাবে প্রিন্সলি স্টেট বৃটিশ-ইন্ডিয়ান ভুমি নয়। তবে কিছু বিশেষ শর্ত চুক্তিতে আবদ্ধ আগের মতই অনুগত রাজার রাজ্য ভুমি। তাই প্রিন্সলি স্টেট হিসাবে কাশ্মীর – এর কোন সীমানাই (যা এখন ভারত, পাকিস্তান বা চীন নিয়ন্ত্রিত তিন অংশ) তা কখনই ভারতের সাথে চিহ্নিত সীমানা নয়, হয়নি কখনও। এককথায় আন-ডিমারকেটেড সীমানা। তাহলে?

কথা এরপরেও থাকে, অবশ্যই। যা আছে সেটা হল,  যার যেটা দাবি করা এলাকা অথবা দখলে থাকা এলাকা সেটা ত অন্যপক্ষ হানে, তা মানে আর নাই মানে। তাই এখন সীমানা নির্ধারণের কাজ নতুন করে শুরু করতে হবে, এটা একমত হয়ে কাজ শুরু করার আগে একটা স্থিতিবস্থা বজায় রাখা জরুরি। এটা যদি পক্ষগুলো মেনে নিতে পারে তাহলে সেখানে আর সেখানে একটা শব্দ উভয়ে একমত হতে হয় যে “যার যেটা দাবি করা এলাকা অথবা দখলে থাকা এলাকা বা ব্যবহার করছে এমন এলাকা” – এটাকেই অস্থায়ী সীমানা বলে ধরে নিয়ে থাকে তারা সাধারণত। আর এরপরেই স্থায়ী চিহ্নিত সীমানা টানার কাজে তারা সাধারণত বসে থাকে।  আর এই অস্থায়ী সীমানা টাকে তারা লাইন অন একচুয়াল কন্ট্রোল (Line of Actual Control) বা সংক্ষেপে এলএসি বলে ডাকে। কথাটার অর্থ হল স্থায়ী দুপক্ষের গ্রহণ করে নেয়া সীমানা নয়, বাস্তবের কাজ চালানো সীমানা।

পুরাতন বিরোধ কিন্তু এখন তা কেন বাইরে এলোঃ
কলোনি শাসনের সমাপ্তিতে এরপর গত সত্তর বছরের ইতিহাসে চীন-ভারত বিরোধ প্রকাশ্যে ছড়িয়ে পড়া প্রথম শুরু হয়েছিল ১৯৫৯ সালের মার্চে। মূল ঘটনাটা ছিল যদিও চীনের একেবারেই অভ্যন্তরীণ ঘটনা। মাও সে তুংয়ের চীনা বিপ্লব ও ক্ষমতা দখল সম্পন্ন হয়েছিল ১৯৪৯ সালের অক্টোবরে। আর তা থেকে শুরু অভ্যন্তরীণ ঘটনাটা হল, দক্ষিণ-পুর্ব চীনে তিব্বত স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল, এই তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের ‘গেলুগ’ নামের যে শাখাটি সেখানে অনুসরণ ও প্রচলিত আছে, তারই প্রধান ধর্মগুরুকে দালাইলামা নামে অভিহিত করা হয়। এর  নেতারা ধর্মীয়ভাবেই স্থানীয় কমিউনিটি প্রশাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করত। এদের নেতা  দালাই লামা চীনা কমিউনিস্ট নেতাদের সাথে বিরোধে জড়িয়ে সবশেষে চীনা কমিউনিস্ট সরকারের হামলার মুখে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল, ঐ ১৯৫৯ সালে।
আসলে দশ বছরে আগে ১৯৪৯ সালে চীনা বিপ্লবের সময়ে এই ঝগড়াটা এরানো গেছিল। পুরানা স্থানীয় ক্ষমতা ব্যবস্থাটা কমিউনিস্ট পার্টির সাথে কোন  প্রত্যক্ষ বিরোধ এড়িয়ে চলে, কোনমতে টিকে গেছিল ঠিকই। কিন্তু ১৯৫৮ সালে ক্ষমতার কেন্দ্রে  কমিউনিস্ট পার্টি  তারা এক সংস্কারি ক্ষমতাচর্চার নতুন পর্যায় শুরু করেছিল। কথাটাকে সম্ভবত এভাবে বলা যায়, মাও নিজেই পুরান মাও আর নতুন মাও বলে নিজেরই পুরান আর নতুন রাজনৈতিক অবস্থানে বিভক্ত হওয়াতে দল দুই তত্বীয় অবস্থানে ভাগ হয়ে গেছিলেন। বিরোধ শুরু হয়েছিল মাওয়ের পুরান অবস্থানের সমর্থকের বিরুদ্ধে মাওয়েরই নতুন অবস্থানের সমর্থকদের। পুরান অবস্থানের লোকেরা ‘বুর্জোয়া হয়ে গেছে’ বলে চিনিয়ে তাদের বিরুদ্ধেই এক “সাংস্কৃতিক বিপ্লব” করতে আহবান রেখেছিলেন মাও। এটাই মাওয়ের পার্টির ভিতরে ১৯৫৮ সালের মাওয়ের ভাষায় চীনা “সাংস্কৃতিক বিপ্লব”। সেসময়ের নতুন মাও-অবস্থান যাদের এরাই শেষে জিতেছিল, আজকের যে চীন আমরা দেখছি এরাই তারা।  আজকের যে চীন আমরা দেখছি, এরাই সে সময়ের নতুন মাওয়ের অবস্থান। যদিও আমাদের এদিকের চীনপন্থি কমিউনিস্টদের ধারণা ও ব্যাখ্যা উলটা।  আসলে বিপ্লবের দশবছর পরেও সমবায় ব্যবস্থায় কৃষিতে কাঙ্খিত উতপাদন না আনতে পারায় কেবল মালিকানা উচ্ছেদ দিয়ে কিছু আগানো যাবে না এই সিদ্ধান্তে আসেন মাও। ফলে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বেই ও নিয়ন্ত্রণে কৃষিতে একটা কাপিটালিজমের বিকাশ ঘটানো তিনি অনিবার্য ভেবেছিলেন। সেকাজে দলে নতুন সমর্থকদের উপরে নেতৃত্বে  আনা, নতুন ধারার রাজনীতিকে হাজির এবং প্রধান ধারা করতে দল ঢেলে সাজানোর কাজটা তিনি “সাংস্কৃতিক বিপ্লব” নামের আড়ালে শুরু ও সম্পন্ন করে নিয়েছিলেন। তবে এতে সোভিয়েত ইউনিয়নের থেকে কোনো বাগড়া বা হামলা হতে পারে, এই ভয়ে তিনি আগাম রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক আগেই ছিন্ন করে দিয়েছিলেন। তার এমন ভয়ের পিছনের বড় কারণ হল ইতোমধ্যেই সোভিয়েত ইউনিয়নের কথা না শুনে নিজের মত চলতে চাওয়ায় ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন সেনা পাঠিয়ে তা্দের পছন্দের সরকার বসানো ঘটিয়ে নিয়েছিল। এছাড়া চীনে ১৯৫৮ সালে মাওয়ের নতুন তত্ব বা চলার পথ পরিবর্তনের পর  আরও পরবর্তিকালে ১৯৬৬ সালে চেকোশ্লোভিয়ায় একই সোভিয়েত হামলার ঘটনা আর এভাবে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তান স্থানীয় কমিউনিস্ট পার্টির উছিলায় ক্ষমতা দখল –  একই ধারাবাহিকতার এসব ঘটনা সোভিয়েত শাসনকালের মারাত্মক “ব্ল্যাক স্পট” হিসাবে থেকে গেছিল, তা আমরা দেখেছি। অর্থাৎ সোভিয়েত হস্তক্ষেপ সম্পর্কে  মাওয়ের অনুমান ভুল ছিল না আমরা বলতে পারি। সে যাই হোক, মাও ১৯৫৮ সালেই  ফতোয়া দিয়েছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নও এক “সাম্রাজ্যবাদী” রাষ্ট্র। তবে ওরা কমিউনিস্ট বলে সাথে আরো একটা নতুন বিশেষণ যোগ করে বলেছিলেন, তারা “সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী”। তবে সোজা কথার প্রশ্নটা হল, একদেশের কোন কমিউনিস্ট পার্টি আরেক দেশের কমিউনিষ্ট পার্টি বা সরকারের উপর (অথবা স্থানীয় পার্টির নামে) হস্তক্ষেপ করতে পারে কিনা? এই প্রশ্নে সোভিয়েত ইউনিয়নের রেকর্ড খুবই খারাপ – ডেসপটিক, কালোদাগ লাগানো। হয়ত চীনের বেলাতেও তা কম সত্য নয়। কিন্তু আপাতত সেদিকে্র তর্কে এখন আর যাব না।
চীনের ঐ সাংস্কৃতিক বিপ্লবের আমলে পরের বছর ১৯৫৯ সালে এসে তিব্বত আর দালাই লামাদের হাতে আগের মত থাকতে পারে নাই। এবার মাওয়ের নতুন লাইনের পার্টি-নেতৃত্ব আর তিব্বতের স্থানীয় লামাদের ধর্মীয়-ক্ষমতা-প্রশাসন সহ্য করতে চায় নাই বা পারে নাই বলতে পারি। এতেই ধর্মীয় নেতা বলে এখন আমরা যাকে ‘দালাই লামা’ বলে জানি, তিনি ১৪তম দালাই লামা – তার নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে লামাদের প্রতিবাদ আন্দোলন পার্টি গুঁড়িয়ে এসেছিল। আর দালাইলামা ঐ চীনা হামলা থেকে রক্ষা পেতে ভারতে পালিয়ে আশ্রয় নেন ৩০ মার্চ ১৯৫৯ সালে। তিনি আসামের দিশপুর সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছিলেন। ঘটনা শুধু এতটাতে সীমাবদ্ধ থাকলে আজ বহু কিছুই হয়তো অন্য রকম থাকত। কিন্তু বাস্তবের ঘটনাতে আরও অনেক বড় বড় “মোচড়” ছিল।

এশিয়াকে অ্যামেরিকান পরিকল্পনায় সাজানোটা মাও উলটে দিয়েছিলেনঃ
তা কিভাবে ঘটেছিল সেদিকে যাব। কিন্তু তার আগে কিছু কথা। দালাইলামার ভারতে হিজরতের ঘটনায় প্রথম ‘মোচড়’ হলেন জেনারেল আইসেনহাওয়ারের হস্তক্ষেপ। এই জেনারেল যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের বিরুদ্ধে আমেরিকা-রাশিয়া-ইংল্যান্ড ইত্যাদির ‘মিত্রশক্তির’ যে সামরিক জোট গড়া হয়েছিল এর প্রধান কমান্ডার ছিলেন। তিনিই বিশ্বযুদ্ধ জয়লাভের শেষের দিক থেকে – পরের দুই টার্ম ১৯৪৪ আর ১৯৪৮ সালের আমেরিকান নির্বাচনেরও পরেরবার, ১৯৫২ সালের নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হন আর শেষে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে যান। শপথ নেন ২০ জানুয়ারি ১৯৫৩ সালে। আর এতে তিনিই হলেন ১৯৩২ সালের পর থেকে আমেরিকায় একনাগাড়ে পাঁচবার ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্টের পরে ষষ্ঠবারে এসে প্রথম রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট। এছাড়া  তিনি আবার পরপর দুবারের (১৯৫৩-৬১ পর্যন্ত) নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ছিলেন।

শুধু তাই নয়, আরো বড় ঘটনা আছে। কমিউনিস্টরা তো আমেরিকাকে “সাম্রাজ্যবাদ” বলে তা এখন আমরা সকলেই জানি। আবার তা দেখে একালে ইসলামিস্ট ভাবাপন্ন কেউ কেউও রাগে ক্ষোভে সেও আমেরিকাকে “সাম্রাজ্যবাদ” বলে। কিন্তু আমরা কি জানি, কমিউনিস্টরা কবে থেকে আমেরিকাকে ‘সাম্রাজ্যবাদ’ বলা শুরু করেছিল? এর জবাব হল,  খুব কম কমিউনিস্টই জানে অথবা বলা যায় জানে কি না বলে বাজি রাখা যায়! নিশ্চয়ই বিশ্বযুদ্ধে স্টালিন যখন আমেরিকার কাঁধে কাঁধ মিলানো মিত্রশক্তি, তখন তিনি অবশ্যই আমেরিকাকে সাম্রাজ্যবাদ বলতেন না, ধরে নিতে পারি। ঘটনাটা ঘটেছিল আসলে এই আইসেনহাওয়ারের [Dwight D. Eisenhower] আমল থেকেই, রাশিয়া “আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ” কথাটা বলা শুরু করেছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট, তিনিই জাতিসঙ্ঘ’ ধরণের প্রতিষ্ঠান গড়ার আইডিয়ার জনক।  আর নিজ আইডিয়ার নৌকায় তুলতে তিনি “ভেটোক্ষমতার জাতিসংঘ” এর কথা বলে নিজ প্রস্তাবে  স্তালিনকে রাজি করিয়েছিলেন। কিন্তু শুরু থেকেই পাঁচ ভেটোক্ষমতাওয়ালার মধ্যে চীন কী করে জায়গা পেয়েছিল? গোনায় ধরার মত কোন সামরিক শক্তিও তো সেকালের চীন ছিল না। আসলে রুজভেল্ট তার শত্রু হিসাবে সাজিয়েছিলেন জর্মানির হিটলার, ইতালির মুসোলীনি আর? এই তৃতীয়টাই গুরুত্বপুর্ণ। এথেকে তাঁর পুরা মনোভাব ধরা পড়বে। তৃতীয়টা হল এশিয়ার একমাত্র মার্শাল তেজোর জাপান।  এই তিনদেশ বা শক্তিকে গুড়িয়ে দিয়েই রুজভেল্ট ১৯৪৫ সালের পরের দুনিয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। কারণ ঐ জাপান ছিল তখন এশিয়ার কলোনি দখলদার শক্তি আর, চীন ও (একই) কোরিয়া ছিল জাপানের কলোনি। কাজেই চীনকে হবু এবং কাম্য (পরাশক্তি না হলেও) সামরিক শক্তি গণ্য করেছিল রুজভেল্টের ইমাজিনেশন। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার (যদিও তিনি মারা যান ঐ ১৯৪৫ সালেই), কেউ বুঝতেও পারে নাই যে চার বছরের মধ্যে ১৯৪৯ সালে  কমিউনিস্ট মাও এর এক চীন – ক্ষমতা দখল করতে আসতেছে।  তাই এককথায় মাওয়ের চীনের উত্থান অ্যামেরিকান স্বপ্নে ঠান্ডা পানি ঢেলে দেওয়া হয়েছিল। বলা বাহুল্য আমেরিকান হতাশা ছিল তাতে।
তাই পরবর্তিতে ১৯৫৩ সালে ডেমোক্রাট প্রেসিডেন্ট থেকে এক রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টের বদলটা সাধারণ বদল ছিল না। প্রথমত, এই প্রথম আইসেনহাওয়ারের হাতে এসে আগের চারবারের প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের আমেরিকার নীতিতেই বড় রকমের নির্ধারক বদল তিনি ঘটিয়ে দিয়েছিলেন। যদিও আইসেনহাওয়ারের আগের প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান তিনি রুজভেল্টের একই নীতির অনুসরণকারী ও তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান বলে (১৯৪৫-১৯৫২ মোট সাড়ে সাতবছরের প্রেসিডেন্ট) তিনি জাতিসংঘকে দেখেছিলেন সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে স্বার্থবিরোধ যেন যুদ্ধ এড়াতে পারে এর নিগোশিয়েশন ও মধ্যাস্থতা করাই প্রতিষ্ঠান হিসাবে। তাই তেলের খনির মালিকানা প্রশ্নে বৃটিশ-ইরান বিরোধে তিনি ১৯৫২ সাল পর্যন্ত নানানভাবে মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করে গেছিলেন।  ইরানের তেল উত্তেলনের চুক্তি আমেরিকার নিজে পাওয়া বা দখলের চেষ্টা তার ছিল না। কিন্তু আইসেনহাওয়ার ১৯৫৩ সালে শপথ নেয়ার কয়েক মাসের মধ্যে প্রথম একদল সিআইএ অপারেটিভ এজেন্ট পাঠিয়ে ইরানে প্রধানমন্ত্রী ডা: মোসাদ্দেককে ক্ষতাচ্যুত করেন, সরকার ফেলে দিয়ে শাহের হাতে রাজতন্ত্রের ক্ষমতা আবার চালু করেন। এভাবে ইরানি তেলের খনি ব্রিটিশ, ফরাসি, ডাচ আর আমেরিকান কোম্পানির মধ্যে ভাগ করে নিতে তিনি এ কাজ করেছিলেন।

তাহলে আইসেনহাওয়ারের সিআইএ দল পাঠিয়ে ক্ষমতা দখলের ও ব্যবসা দখলের যে স্টাইলের চর্চা তিনি শুরু করেছিল এটা আমেরিকার বিশ্বযুদ্ধের নীতির মারাত্মক বরখেলাপ ও পুরাপুরি উলটা। যেমন  রুজভেল্ট বলেছিলেন ও কল্পনা করতেন যুদ্ধপরবর্তীকালে কলোনিমুক্ত স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের এক দুনিয়া গড়তে হবে, যেখানে ওই স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর সাথে আমেরিকার বিনিয়োগকারীদের সম্পর্ক হবে ঋণদাতা-খাতকের, পণ্য বিনিময় সম্পর্কের। ওপেন ও স্বাধীন ব্যবসায়িক সম্পর্ক।  সেখানে এর ১২ বছরের মধ্যে আইসেনহাওয়ার বলতে চাইলেন, তিনি ইরানের সাথে সিআইএ অপারেটিভ পাঠানোর “সম্পর্ক” করবেন। জবরদস্তিতে ক্ষমতা দখল করে কাজ-ব্যবসা বাগাবেন। এমন দুনিয়াই গড়বেন।’ এবং  চাইলেই যেন তিনি সিআইএ দল পাঠাইতেই পারেন, গুম-হত্যা করতেই পারেন।

কিন্তু ঘটনা এখানেই শেষ নয়, শুরু। আর পাঠক সাবধান হন, এতদূর পড়েই কমিউনিস্টদের সাধুবাদ জানাতে যাইয়েন না। কারণ, কেউ কম যায়নি। এ দিকে সোভিয়েতরা ইরানের তেলের কিছুই না পেয়ে (তারা চেয়েছিল ব্রিটিশের বদলে তাদের দিয়ে জ্বালানি তেল তোলা হোক) এই ঘটনায় প্রতিপক্ষ আমেরিকাকে ‘সাম্রাজ্যবাদ’ বলে গালি দেয়ার শুরু তখন থেকে, এতে মনের দুঃখ মিটিয়েছিল অবশ্যই। কিন্তু ইরানে কোনো কমিউনিস্ট বিপ্লব চিরদিন রহিত হয়ে গেছিল সেই থেকেই। খোমেনির বিপ্লব বিনা কারণে হয়নি। ইরানি বিপ্লব আমাদের দুনিয়ায় এক গ্লোবাল-ঐতিহাসিক ঘটনা। এটা অবশ্যই একটা লোকাল বিপ্লব, খোমেনির ক্যাসেট বিপ্লব অথচ এর তাৎপর্য গ্লোবাল। আর সেই থেকে অ্যামেরিকা দুনিয়াকে এমনি এমনি ‘ওয়ার অন টেররের’ নোংরামি পর্যন্ত আনেনি। তাই ধীরেসুস্থে বুঝেশুনে পরে যাকে খুশি সাধুবাদ দিয়েন। আগে বুঝাবুঝি শেষ করে নেন। যদিও আপাতত আমরা সেদিকে যাচ্ছি না। কিন্তু দালাই লামার গল্পে কেন এত দূর এলাম?

কারণ ১৯৫৯ সালের ৩০ মার্চ, দালাই লামাকে আসামের দিশপুর দিয়ে ‘হিজরত’ করিয়ে ভারতে এনে পৌছে দিয়েছিল সিআইএ’র কিছু অপারেটিভ এজেন্ট। অর্থাৎ কথায় কথায় সিআইএ পাঠানো  তখন আইসেনহাওয়ারের কাছে ডাল-ভাত হয়ে গেছিল। তিনি তাই ইরানে হাত পাকিয়ে এরপর আমারিকার পুরানা হাতছুট চীনের উপর প্রভাব-দখল বাড়াতে বা ফেরত পেতে দালাইলামাকে সহায়তা করার উছিলায় চীনের ঘটনায় বা’ হাত ঢুকাতে,  প্রবেশ করেছিলেন। বলাই বাহুল্য এতে মাও কেমন ক্ষুব্ধ হবেন!  এদিকে অতএব দেখা যাচ্ছে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নেহরু শুধু দালাই লামার আশ্রয়দাতাই ছিলেন না, এশিয়ায় এই অঞ্চলে আইসেনহাওয়ারের সহযোগী হতে লোভী হয়ে উঠেছিলেন।  সিআইএ অপারেটিভ এজেন্টের আনাগোনা আর আশ্রয়-প্রশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিতে সক্রিয় হতে গেছিলেন।  পারলে তেলের খনির মত এখানেও যা যা লাভ আসে এর বখরা পেতেও নেহরু মহা আগ্রহী ছিলেন বলে দেখা যাচ্ছে। তবে সিআইএ’র কিছু অপারেটিভের সহায়তায় যে দালাই লামা এসেছিলেন, এ তথ্য পাওয়া খুব সহজ নয়। অথচ ভারতের কূটনীতিকপাড়ার আলোচনায় মুখে মুখে এটা খুবই চালু। ভারতীয় চীনপন্থী কমিউনিস্টদের মহলেও খুবই চালু তথ্য এটা। তবু ভারতে একাডেমিক সার্কেলেও এর তথ্য পাওয়া মুশকিল, দেশদ্রোহিতার মামলা খাবার ভয়ে। তবু একটা সহজ রেফারেন্স দিয়ে রাখি। ‘উইকি’কে বিশ্বাস করতে বলছি না। কিন্তু উইকিপিডিয়াতে 14th Dalai Lama – বলে সার্চ দিলেই পাওয়া যাবে। ওর ভিতরে ৭৯ নম্বর রেফারেন্স। সেটা একটা বইয়ের নাম- যেটা হল, “সিআইএ-জ সিক্রেট ওয়ার ইন টিবেট’” কানসাস ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০২। সেখানে লেখা আছে, [At the outset of the 1959 Tibetan uprising, fearing for his life, the Dalai Lama and his retinue fled Tibet with the help of the CIA’s Special Activities Division,[79] crossing into India on 30 March 1959, reaching Tezpur in Assam on 18 April.[80] ]।

কিন্তু দুর্ভাগ্য নেহরুর। মাওয়ের চীন সেকালের নিরীহ ইরানিদের মতো নয় যে, মোসাদ্দেকের ক্ষমতাচ্যুতিতে তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে। তাই, এর প্রতিশোধ নিতে আর শিক্ষা দিতে, ১৯৬২ সালে মাওয়ের চীন ভারত আক্রমণ করেছিল। একটা শিক্ষা দেয়ার জন্য এ হামলা। পুরো আসাম দখল করে নিয়ে কয়েক দিন-ঘণ্টা রেখে দিয়ে এরপর চীনা সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছিল। সামরিক ভাষায়, প্রতিপক্ষের এ রকম একটা পুরো শহর কিংবা খোদ রাজধানী অথবা একটা রাজ্য বা এলাকা দু-একদিন দখল করে রেখে দিয়ে বুঝিয়ে দেয়া যে কার মুরোদ কতখানি – এটাকে বলে ‘শিক্ষা দেয়ার’ হামলা। আমেরিকাকেসহ সব পক্ষকে শিক্ষা দিতে মাও এটা যেভাবে ভেবেছিলেন, আজ দেখা যাচ্ছে এটা সত্যিই কাজ করেছিল। আজও এটা ভারতের জন্য একটা ‘ট্রমা’ হয়ে আছে।

নেহরুর প্রধানমন্ত্রিত্বের জীবনে পড়ালেখা না করা সংশ্লিষ্ট ঘটনা ফলে ঠিকঠাক বুঝতে বা ধারণা করতে না পারা দুটো মারাত্মক ভুল ঘটেছে।  যার ফলে তার চিন্তা করার অযোগ্যতাকে আঙুল তুলে প্রশ্ন করা যায়, এমন একটি হল – জাতিসঙ্ঘ কী, এর জন্মভিত্তিমূক ধারণা কী তা না বুঝেই কাশ্মির দখল ক্রতে যাওয়া। তাই তিনি কাশ্মিরের জনগণকে ফেলে রাজার ওপর ভরসা করতে গিয়ে সারা জীবন “ফাউলে খেলে” গোল দিয়ে গিয়েছেন। বিজেপি যেটাকে আরও চুড়ান্ত করছে।  আর দ্বিতীয়টা হল, আমেরিকান সিআইএকে ভারতের হোস্ট করতে যাওয়ার কুবুদ্ধি; এমন এম্পায়ারগিরিতে সামিল হয়ে উচ্ছিষ্ট খাওয়ার সীমাহীন লোভ করতে গিয়েছিলেন। – কিন্তু এতে কাকে লাড়তে গিয়ে কাকে লেড়ে দিয়েছেন খবর নেই। অথচ তিনি তো “শরণার্থীকে” কেবল আশ্রয়দাতার ভূমিকাতেই সীমাবদ্ধ থাকতে পারতেন। এতে উল্টো তিনি ‘হিরো’ হতে পারতেন। কিন্তু আজীবন নেহরু এমন উলটা কাজ, ভুল ব্যাট হাঁকিয়ে গেছেন!

মোদি কী দ্বিতীয় নেহরু হতে যাচ্ছেন?
বাষট্টি সালের পর থেকে বলাই বাহুল্য, সারা ভারত জানত নেহরু পরাজিত হয়েছেন, কিন্তু কেউ এতে নিমক ছিটায়নি। তবে অনেকে মনে করেন এই ব্যর্থতার যে লজ্জা যে নিজস্ব একান্ত ‘শক’, তা খুবই মারাত্মক হয়েছিল বলেই তিনি দুই বছর পরই ১৯৬৪ সালে (হার্টফেল করে) মারা যান। আবার ভারতের চীনা কমিউনিস্টরা দেশদ্রোহিতার মামলা ভয়ে ইস্যুটা নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো মূল্যায়ন তোলে না। এমনকি এ নিয়ে ভারতে কেউ একাডেমিক আলাপ বা স্টাডি করেছেন বলেও জানা যায় না। তবে সব কিছুই সামলানো হয়ে আসছে উগ্র (প্রকাশ্য বা ‘ছুপা’) হিন্দুজাতিবাদ দিয়ে। যেমন, সেই থেকে এখনো সব দল-পক্ষের মিডিয়াই সাধারণভাবে প্রবল অ্যান্টি-চায়না টোন বজায় রেখে চলছে।

কিন্তু না, সরি ইন্ডিয়া! এটা আপনাদের জাতীয় চেতনায় এক হওয়া, ন্যশনাল ইন্টারেস্ট হতেই পারে না। এটা জাতিস্বার্থ নয়। আপনি আরেক দেশে সিআইএ অপেরেটিভ পাঠিয়ে সরকার ফেলায় দিবেন – এটা সমর্থন করবেন, সামিল হবেন – আর এটাই কী ভারতের ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট হতে পারে?  দুনিয়ার সমস্ত চোরামি শয়তানি অন্যায় কাজ সবকিছুকে কী জাতীয় স্বার্থ বলে শব্দের আড়ালে চালিয়ে দেয়া যায়? না যাবে? ভারতের মিডিয়ার এই ” জাতীয় স্বার্থ বলে শব্দের আড়ালে” সবকিছু চালিয়ে দেয়া আচরণ – এটাই তাদের আজীবনের কালো দাগ। আপনারা কোন পাপের দায় কাঁধে নিয়ে ঘুরছেন কোনদিন কী তা বুঝবেন মনে হয় না, রাষ্টটা ভেঙ্গে পড়ার আগে তা বুঝবেন বলে মনে হয় না। দুনিয়ার সবকিছুই রাষ্ট্রস্বার্থ নয়, হতে পারে না।

কিন্তু বাস্তবের ভারতের ঘটনা হল, একালে চীনা পণ্য মানে চীন থেকে অনেক আমদানি পণ্য যা তুলনায় শস্তা, তাই মনে যতই এন্টিচায়না জাতিচেতনা থাকুক, তবু চীন থেকে ভারতের আমদানির পরিমাণ অনেক চড়া। দুই দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্য চলছে সমানে – বছরে ৭০ বিলিয়ন ডলারের। যার মধ্যে চীন থেকে আমদানিই প্রায় ৫৩ বিলিয়ন ডলারের।  এর বাইরে ভারতে বিপুল চীনা বিনিয়োগ, সেসব তো আছেই।

আবার চীন-ভারত সীমান্ত নিয়ে টেনশনের প্রসঙ্গে আসি। তাদের সীমান্তবিরোধের  বড় কারণ তাদের সীমান্ন্তের অনেক অংশই চিহ্নিত বা ডিমারকেটেড নয়। অর্থাৎ  চীন-ভারত সীমান্তের বহু অংশই  পরস্পরের বসে উভয়ের কাছে গ্রহণযোগ্য করে আঁকা হয় নাই।  নয়, অর্থাৎ দু’পক্ষই মানে এমন অনেকাংশই ডিমার্কেটেড সীমান্ত নেই। আর তা কেবল কাশ্মীরের অতীত প্রিন্সলি স্টেট ছিল বলে কাশ্মীর-সংশ্লিষ্ট চীন নিয়ন্ত্রিত এলাকা – আকসাই চীন, লাদাখ শুধু এদিকটাই নয়। বরং সাথে নেপাল, সিকিম বা ভুটান সংশ্লিষ্ট সীমান্তের বহু পকেট আছে যা বৃটিশ আমল থেকেই বিতর্কিত হয়ে পড়ে আছে।  এই আন-ডিমার্কেটেড অবস্থা নিয়ে সর্ব প্রথম বিরাট  ইতিবাচক  পদক্ষেপ,  গত ২০১৩ সালের অক্টোবরে এক বিরাট অগ্রগতি হয়েছিল।

চীন-ভারত গত ২০১৩ সালের অক্টোবরে এক দ্বিপক্ষীয় সীমান্ত চুক্তি করেছিল। তার মুখ্য বিষয় ছিল, পরস্পর কথা বলে আপসে এই নীতিতে ডায়ালগ নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে কার কোনটা সীমান্ত তা চিহ্নিত করে ফেলবে। এর জন্য অনেক বিষয়েই মোড ও প্রটোকল ঠিক করা হয়েছিল, ঐ সীমান্ত আলোচনায় দু’পক্ষেরই স্থায়ী প্রধান ব্যক্তি কে হবেন তাও ঠিক করে তা পরস্পরের কাছে জমা দেওয়ার নিয়ম করা হয়েছিল, যা এখন বাস্তবে করা আছে। এছাড়া মাঠপর্যায়ে সীমান্ত পোস্টের কমান্ডার পর্যায়ে টেলিফোন হটলাইন থেকে শুরু করে সার্বক্ষণিক ডায়ালগের সুযোগে থাকার সব বন্দোবস্ত ও মোড ঠিক করা আছে। যাতে ভুলেও কোনো পক্ষ গুলি তো দূরে থাক একটা হাতাহাতিও যেন হয়ে না যায়, এরই সব মোড আর প্রটোকল ঠিক করা আছে সেখানে। যেমন গত কয়েক দিন ধরে বিশেষ করে গত শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে বিপুল পরিমাণ ভিডিও ফুটেজ সোশ্যাল মিডিয়ায় খেয়াল করে দেখেছেন অনেকে – অনুমান করছি। সেখানে দেখে থাকবেন, চীনা আর ভারতীয় সৈন্য ঝগড়া করছে, কথা বলছে কিন্তু কেউ কারো গায়ে হাত লাগাচ্ছে না, ওই প্রটোকলের কারণে যেখানে সেটা বারণ করা আছে। তাই বুকে বুক দিয়ে ঠেলাঠেলি আর ক্যামেরায় ছবি তুলে এ মর্মে প্রমাণ সংগ্রহ করে রেখে দেয়া যে, ‘আমি দোষী নই।’ কারণ ওই ঠেলাঠেলিই শেষ নয়, বরং পরস্পরের ক্যামেরায় তোলা ওইসব ছবি হয়ত, আগের কোনো ঐকমত্য হওয়া থাকায় তার প্রটোকল মেনে চলার প্রমাণ দেখাতে হতে পারে পরের কোনো যৌথ মিটিংয়ে।
কিন্তু এত কিছুর পরও সীমানা চিহ্নিত করার মিটিংয়ে বসার অগ্রগতি খুবই কম। এর একটা কারণ অবজেকটিভ  ভাবে আমরা ধরতে পারি যে, দু’পক্ষই অগ্রগতি না হওয়ার মধ্যে এখানে দুপক্ষই কোনো-না-কোনো স্বার্থ দেখতে পাচ্ছে। তাই অগ্রগতি নাই। যেমন খুব সম্ভবত এটা হতে পারে যে, ‘ভারতের আশা- ভবিষ্যতে কখনও আমেরিকাকে যদি সে নিজের পক্ষে পাশে পেয়েই যায়, তবে নেগোসিয়েশনে সেটা তার জন্য ওজনদার শক্তি হিসেবে হাজির হতেও পারে। কাজেই অপেক্ষায় থাকি”।  আর এর বিপক্ষে চীনের অনুমান হয়ত ভারতের এমন আশা যতদিন সক্রিয় থাকবে ততদিন ভারতকে বলে বা চাপ দিয়েও কিছু করানো যাবে না। যখন এমন আশা শুকিয়ে মরবে কেবল তখনও ভারত সক্রিয় হতে পারে। সেপর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হবে।

মোদী-ট্রাম্পের আরেক শস্তা সমীকরণঃ
তবে এসবের বাইরে মোদি-ট্রাম্পের আরেক শস্তা সমীকরণ আছে। যা মূলত পারসোনাল স্বার্থে সরকার প্রধানের পদকে ব্যবহার ধরণের। এই বিশেষ ধরণের কারণে, খুব সম্ভবত আগামী নভেম্বর পর্যন্ত চীনবিরোধী এই টেনশন টেনে নিতে চাইবেন তারা দু’জন। ব্যাপারটা হল, ব্যক্তিগত লাভের নির্বাচনী স্বার্থ, মানে ভোটারদের বিভ্রান্ত করার স্বার্থই এখানে প্রধান ভুমিকায়। এর আগে মোদী-ট্রাম্প দু’বার দুই দেশে আমেরিকার হিউস্টনে (সেপ্টেম্বর ২০১৯) আর ভারতের গুজরাতে (ফেব্রু ২০২০) পাবলিক সমাবেশে দুই নেতা পরস্পরকে ব্যক্তিগত নির্বাচনী সুবিধা করে দিতে হাজির হয়েছিলেন। আমাদের নিশ্চয়ই তা মনে আছে। এবার আগামি নভেম্বরের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ট্রাম্প তার সম্ভাব্য ভোটারদের দেখাতে চান যে তিনি চীনের বিরুদ্ধে আমেরিকার সব ধরনের স্বার্থ নিয়ে লড়াকু – এক বেস্ট ক্যান্ডিডেট। যেহেতু চীনের উত্থানেই আমেরিকার গৌরব সব ধূসর হয়ে গেছে। কাজেই সেই চীন-ধোলাই করতে সক্ষম, ডোনাল্ড ট্রাম্পই আমেরিকার জন্য বেস্ট ক্যান্ডিডেট। এই হল এর ম্যাসেজ।  এজন্য তিনি ম্যালেরিয়া ওষুধকে করোনার ওষুধ বলে খাওয়ানো থেকে শুরু করে, নিজে এই ভুয়া ওষুধ খাচ্ছেন বলে প্রচারণা, আর মূলত নিজের করোনা মোকাবিলার প্রস্তুতির ঘাটতি লুকানোর জন্য – চীন-ব্যাসিং;  চীন করোনা ভাইরাস এনেছে,  তথ্য লুকিয়েছে দাবি করা, হু [WHO]  এর বিরুদ্ধে কামান দাগানো, এই প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করা ইত্যাদি সবকিছু করে চলেছে।
আর এই ইমেজ তৈরি করার ক্ষেত্রে মোদী হচ্ছে ট্রাম্পের প্রধান সহযোগী সাগরেদ। তিনি এই ইমেজ গড়তে বাতাস দিতে এগিয়ে এসেছেন। কারণ এতে বিনিময়ে তারও লাভ-স্বার্থ আছে। কারণ, অর্থনৈতিক অবস্থার দিক থেকে ভারতের মোদি সরকার খুবই খারাপ অবস্থায়। এর উপর এখন করোনায় কারণে অবস্থা আরো খারাপ। কাজেই তাঁর সরকারের অর্থনৈতিক  পারফরম্যান্স এখন পাবলিকের কাছে বিরাট প্রশ্নবোধক।  সরকারি সক্ষমতা আর ফান্ড বরাদ্দ নিয়ে প্রতিদিন কেন্দ্র আর রাজ্য সরকারের টানাটানি চলছে।  এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া মাইগ্রেন্ট শ্রমিক ফেরত আনার খরচ ও ব্যবস্থাপনার পরাজয় ব্যর্থতা চরমে উঠেছে। এ-ওর গায়ে দায় চাপাচ্ছে, এখানে এক চরম  মানবিক বিপর্যয়ে দেখা দিয়েছে। অতএব সরকারের পারফরম্যান্স ও যোগ্যতা থেকে পাবলিকের অভিযোগে অসন্তোষের মন ও চোখ সরাতে, হয় পাকিস্তান অথবা চীনের সাথে কোনো সীমান্ত টেনশন তৈরি করা আর সেখান থেকে, অবাস্তব হলেও, মোদি নিজেকে অন্তত একবার বিজয় অর্জনকারী বীরের ভূমিকায় হাজির করতে পারলে তিনি মনে করেন সেটা এক ‘বিরাট অর্জন’ ও সব অর্থনৈতিক ব্যর্থতা ঢেকে ফেলার চাদর-কাভার হতে পারে সেটা। মোদির লক্ষ্য হচ্ছে, ট্রাম্পের ‘খেপ মেরে’ দেয়া’র বিনিময়ে নিজের জন্য এটা তিনি অর্জন করতে চান। তাই তিনি চীন-ভারত সীমান্ত টেনশনে ইতোমধ্যে “ট্রাম্প মধ্যস্থতা করতে চান”- এই প্রস্তাব বাজারে ট্রাম্পকে দিয়েই হাজির করাচ্ছেন। যদিও তিনি এটা আরো করাচ্ছেন নিজেরই উপর নিজ দেশের এলিট-মাতবর লোকদেরও অনাস্থা-ভয় কাটাতে। যেমন ভারতের কূটনীতিক মহলেই এখন খোলাখুলি টুইটের মাধ্যমে প্রস্তাব দেয়াদেয়ি চলছে যে, রাশিয়ার পুতিনকে দিয়ে এখন মোদী যেন চীনকে থামানোর চেষ্টা করেন, এতেই  চীনের সম্ভাব্য হামলা ঠেকানো যেতে পারে। অর্থাৎ সমাজের এই সেকশন ভয় পেয়েছে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের এক রিপোর্টে এই ভয়ের ছাপ প্রকাশ পেয়েছে […detailed analysis of satellite images has shown extensive deployment of towed artillery and mechanised elements on the Chinese side, ……]। অভ্যন্তরীণভাবে ভারতীয়দের মনে ভয় ও হেরে যাবার ইঙ্গিত ফুটে উঠেছে। ইংরাজি ওয়েব পত্রিকা WIRE এর এই আর্টিকেলে সেসবই ফুটে উঠেছে যে ইতোমধ্যেই ভারতীয় সেনারা কী কী ভুখন্ড হারিয়েছে, চারটা পয়েন্টে তাই প্রকাশ করা হয়েছে।

কথা সত্য! আর বলাই বাহুল্য এটা খুবই ‘রিস্কি গেম’! কেন? কারণ খুবই সম্ভাবনা হল, চীন ১৯৬২ সালের মতো এবার লাদাখে আবার একটা “শিক্ষার আয়োজন” করে ফেলতে পারে। আসলে মোদী ব্যাপারটাকে নিয়েছেন নির্বাচনী ভোটার নাচানোর বিষয় মনে করে নিজের পক্ষে মিথ্যা হলেও একটা বিজয়ের গল্প পেতে। কিন্তু এটাতেই চীনারা সবচেয়ে অসন্তুষ্ট। তারা  সিরিয়াস বিষয় নিয়ে মস্করা খেলাপাতি খেলা কেন মনে করবে?  তারা বরং খেলার উপকরণ হিসেবেই যেন এটাকে দেখা বা দেখানোর সুযোগ না থাকে, চীন তাই চেয়ে বসতে পারে এবার।

আর ঠিক এই মেসেজই পেয়ে গেছে ভারতের এলিট, বিরোধী দল, মিডিয়া- সবাই। তারা একেবারে অস্থির।  যদিও সবার আগে তাদের সকলের ভয় পাওয়াটা প্রকাশ করেছিল চীনে ভারতের সাবেক ও অবসরপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদুত গৌতম বাম্বালা। তিনি পরামর্শের ঢঙে বলে বসেন,  চীন-ভারতের ডায়লগে বসে যাওয়া উচিত। আসলে মোদীর আকাঙ্খার কথাটা তিনি নিজের ব্যক্তিগত মতামত হিসাবে তুলে ধরেন।  আর এদিকে বিরক্ত ভারতীয়দের মনের কথাটা – আনন্দবাজার পত্রিকা এই সঠিক জায়গাটা ধরে প্রকাশ্যে অন্তত দুটা আর্টিকেল লিখে বলতে চেয়েছে যে চীনের দখলে থাকা কাশ্মীরের অংশ নিয়ে দাবি জানানো এই উস্কানি তৈরির জন্য অমিত শাহ দায়ী। কাশ্মীর নিয়ে ভারতের সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করার পর থেকেই ভারতের ওপর সব বিপদ-আপদ এসে হাজির হয়েছে। তিনি কেন লাদাখ কোনো রাজ্যের অংশ নাকি কেমন প্রদেশ, সেসব স্ট্যাটাস নিয়ে নাড়াচাড়া করতে গেলেন? আনন্দবাজার লিখেছে,

“গত বছর অগস্টে কাশ্মীর নিয়ে সিদ্ধান্তের পরেই সংসদে অমিত শাহ পাকিস্তান ও চিনের সঙ্গে সীমান্ত সমস্যার ব্যাপারে চড়া সুরে বলেন,‘‘পাক অধিকৃত কাশ্মীর ও আকসাই চিনও ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ।’’

আনন্দবাজারের অভিযোগ আরও গভীরে – তাই লিখেছে,
“গত কয়েক মাসে একাধিক বার বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল চিনা নেতৃত্বকে বুঝিয়ে এসেছেন যে জম্মু-কাশ্মীর নিয়ে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তা একান্তই ভারতের অভ্যন্তরীণ। কিন্তু পরিস্থিতি যে দিকে এগোচ্ছে তাতে স্পষ্ট, কূটনৈতিক দৌত্যে চিঁড়ে ভেজেনি”।

সার অভিযোগ বিশেষ করে চীনের দখলে থাকা ‘কাশ্মিরের অংশও’ ভারতের বলে পার্লামেন্টে বিবৃতি দিতে গেলেন? আনন্দবাজার যেন বলতে চাচ্ছে, – “আসলে এ থেকেই তো সব কিছু অস্থিতিশীল হয়ে গেছে। আগে বহুকিছুই অমীমাংসেয় ছিল সত্য কিন্তু একটা স্থিতাবস্থা বজায় ছিল। সেটা উগ্র জাতিবাদ দেখাতে গিয়ে অমিত শাহ-ই নাড়িয়ে নষ্ট করে দিয়েছেন। তাই এই লাইনে ভারতের ভেতর থেকেই অমিত শাহের বিরুদ্ধে যুক্তিতর্ক প্রকাশ্যেই শানিয়ে উঠছে সবার আগে”। বুঝাই যাচ্ছে, এরা শক্তের ভক্ত হয়ে অমিত শাহের হাত আগেভাগে ছেড়ে নিজেরা নতুন অবস্থান নিয়ে বাঁচতে চাইছেন। অর্থাৎ মোদির নির্বাচন বা ভোটার নিয়ে খেলা চালানোতে ভারতের এলিট, বিরোধী রাজনীতিক, মিডিয়া ইত্যাদি সবাই মোদির দায় ত্যাগ করে ফেলতে চাইছেন। এতে পুরাপুরি একটা মেরুকরণ ইতোমধ্যে দাঁড়িয়ে গেছে। এই পরিস্থিতি ভারতের জন্য খুবই বিপজ্জনক।

এখন যদি চীন মিথ্যা করেও একটা হামলার অবস্থায় যাচ্ছে দেখায় বসে তাতেও ভারতের সব ভেঙে পড়ে যেতে পারে। হয়তো দেখা যাবে, মোদীর বিরুদ্ধেই ‘দেশকে বিপদের মুখে ফেলার অভিযোগে’ মিছিল শুরু হয়ে গেছে। এ দিকে ভারতীয় সেনাবাহিনী এই প্রথম সম্ভবত একটি দলের মান বাঁচানোর প্রোগ্রামে শামিল হয়ে গেছে। সেনাবাহিনীর ওপর দিকের নেতৃত্ব যেন বিজেপির কর্মী। এতে সেনা সদস্যরা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের দায়দায়িত্বের মধ্যে জড়িয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে অবসরে যাওয়ার আগে-পরে নানান সুবিধার লোভে জেনারেলদের পা পিছলিয়ে যাচ্ছে। আর তাতে পুরো সেনা প্রতিষ্ঠানের পেশাদারিত্ব ধুলায় লুটাচ্ছে। মোদি-ট্রাম্পের দলীয় বা ব্যক্তিগত বা দলীয় স্বার্থে বাহিনীর কোনো সংশ্লিষ্টতা- এগুলো খুবই বিপজ্জনক।

এদিকটাই ফোকাসে এনেছে সর্বশেষ চীনা ‘গ্লোবাল টাইমস’ ম্যাগাজিন।  পরামর্শ দিয়েছে ভারত-চীনের ইস্যু থেকে আমেরিকাকে দূরে রাখতে। আর সেই সাথে ভারতীয়দেরকে মনে করিয়ে দিয়েছে যে ট্রাম্পের মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব এটাও এমনকি হোয়াইট হাউসের বক্তব্যও নয়, ট্রাম্পের ব্যক্তিগত বক্তব্য।

লিখেছে,  To what extent Trump’s personal Twitter account reflects the will of the White House remains to be seen…।

অর্থাৎ যেন ট্রাম্পের “মধ্যস্থতার কথায়” ভারতীয়রা কোন আস্থা না রাখে, আস্থায় না নেয়। কথা সত্য এর আগে ডোকলামে চীন-ভারত মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যাওয়ার সময়ও আমেরিকান প্রশাসন বরং নিজেদের নিরপেক্ষতা দেখাতেই ব্যস্থ হয়ে গেছিল।  এদিকে আজ ৩১ মে গ্লোবাল টাইমস আর একটা আর্টিকেল ছাপিয়েছে। যার বিষয়বস্তু হল উচু পাহাড়ি এলাকায় ব্যবহারের জন্য (advantage in high altitude arsenal possession ) বাড়তি সুবিধা পাওয়ার মত চীনা সেনাবাহিনী দখলে কী কী বিশেষ অস্ত্রশস্ত্র আছে এর তালিকা নিয়ে। এর একটা মানে হতে পারে হাল্কা করে দেখলে এটা শক্তি দেখানো। আর ভারি দিকটা দেখলে এর মানে এটা আক্রমণের ইঙ্গিত। তাহলে গ্লোবাল টাইমসের কথার মানে কী চীনরা এবারও আবার ‘শিক্ষা দেয়ার’ অ্যাকশনে যেতেও পারে? এটা কি সেই ইঙ্গিত?

সবশেষে  এক ফাকে নেপালঃ
ওদিকে নেপাল ইস্যু; বলাই বাহুল্য, এটা ‘মাছের তেলে মাছ ভাজার’ জন্য মোদীর কৌশল ও  চেষ্টা ছিল। কিন্তু সবার আগে সম্ভবত এখান থেকেই মোদী পিছটান দিতে যাচ্ছেন।  মোদি ও ট্রাম্পের নির্বাচনী ব্যক্তগত লাভালাভের খেলার বিষয়টাকে দেখিয়ে নেপালকে ভয় পাইয়ে দিতে চেয়েছিলেন মোদী। আর এই ফাকে মোদীর প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং  কোনো কথাবার্তা ছাড়াই লিপুলেখের ভূমি দখলটা সেরে ফেলতে পারবে অনুমান করে ভারত এগিয়েছিল। একাজে ভারত নিজেই উসকানি দিয়ে ভারতের সেনাপ্রধান বলেছেন, “নেপাল নাকি চীনা উসকানিতেই প্রতিবাদ” করছে। কথাবার্তা ছাড়াই নেপালের ভূমি দখল বিতর্ক শুরু করল ভারত, সেটা উসকানি নয়; বরং নেপালের প্রতিবাদ, সেটার উসকানিদাতা হলো নাকি চীন? এখন এই ইঙ্গিত বাড়ছে যে মোদীকে অপমানজনকভাবে  নেপালের ভুখন্ড ছেড়ে আসতে হবে। আগেই জানা যাচ্ছিল যে চীন-ভারত ইস্যু একটু হালকা হলেই নেপাল ইস্যুতেও ভারত হারবে এবং সবার আগে কূটনৈতিক পশ্চাৎ অপসারণ শুরু হবে সম্ভবত এখান থেকেই। আজ নেপালের পার্লামেন্ট আরও একধাপ এগেসিভ হয়ে তাদের প্রকাশিত ম্যাপ আজ পার্লামেন্টেও পেশ করেছে, যা সহজেই পাশ হয়ে যাবে বলে ভারতের মিডিয়ার ধারণা।  এর মানে এখন নেপালে মোদীর পিছুহটা আরও অপমানজনক হয়ে হাজির হবে।

যেটা সিরিয়াস বিষয় তা নিয়ে নির্বাচনী খেলা খেলতে গিয়ে মোদী সম্ভবত  নিজের ‘পেটব্যথা’ ডেকে আনতে যাচ্ছেন। কারণ চীনারা সিরিয়াস বিষয় নিয়ে খেলা-মসকরা পছন্দ করে না। মোদীর পরামর্শকেরাও সম্ভবত অযোগ্য বা মোদীরই মতন। তারা কী আগে যাচাই করছেন তারা চীনের কী নিয়ে খেলতে গেছেন। এটা শুরু লাদাখের কিছু পাহাড়ি হিমশীতল এলাকার ভুমি দখলে থাকার প্রেস্টিজ নয়। চীনা প্রেসিডেন্ট-সহ চীনের অর্থনীতির ভবিষ্যত ও সেই সাথে ভ্যানিটির প্রজেক্ট হল চীনা বেল্ট-রোড প্রকল্প। প্রায় ৭০ টা দেশের অর্থনীতি এর সাথে ইতোমধ্যেই জুড়ে গিয়েছি এই গ্লোবাল মহা-অবকাঠামো প্রকল্প।  আর এই প্রকল্পকে চীনের ভুখন্ডের সাথে জুড়তে পাকিস্তান তার অধিকৃত কাশ্মীরের অংশের উপর দিয়ে অতিক্রম করতে দিয়েছে। চীনা জিনজিয়াং (বহুল প্রচলিত উইঘুর প্রদেশ) প্রদেশে প্রবেশের জন্য এটা সহজ রাস্তা হয়, রাস্তা ঘুরে আসতে হয় না তাই। কাজেই এটা নিয়ে কোন মসকরা বা কোন মসকারার ইঙ্গিতের মুল্য মোদীকে চুকাতে হতে পারে তা বলাই বাহুল্য। এখন মোদীর ছেলেখেলার জবাব ও শিক্ষা কী তিনি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নেহরুর চেয়েও খারাপভাবে নেবেন? সব কিছুই গভীরভাবে অস্থির ও অনিশ্চিত হয়ে উঠছে!

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

 

[এই লেখাটা  গত ৩০ মে ২০২০ দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ওয়েবে ও  পরদিনই প্রিন্টেও  মোদি কি নেহরুর মতো শিক্ষা পেতে যাচ্ছেন? – এই শিরোনামে উপ-সম্পাদকীয়তে ছাপা হয়েছিল।  পরবর্তিতে সে লেখাটাই এখানে আরও নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে এখানে আজ ছাপা হল। ]

One thought on “চীন কী মোদীর ভারতকেও নেহেরুর মতই শিক্ষা দিবে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s