ভুখন্ড ফেরত ব্যাপার না, আওকাত বুঝে চল
গৌতম দাস
২৯ জুন ২০২০, ০০:০৬ সোমবার
সবার শেষে বলতে আসলেন নরেন্দ্র মোদী, তিনি বলে উঠলেন – “না, সীমান্ত পেরিয়ে কেউ ঢুকতে আসেনি। ভারতের কোনো সেনা চৌকিও অন্য কারো দখলে নেই। লাদাখের কোনো বর্ডার পোস্ট অন্যের দখলে যায়নি”। এভাবেই মার খেয়ে মার হজম অথবা কান্না হজম করতে হয়েছে মোদীকে! চীনের হাতে কমপক্ষে ২০ জন ভারতীয় সেনার মৃত্যু নিশ্চিত করার পরে ডাকা ভারতের সর্বদলীয় সভাতে তিনি এভাবেই তার কথা শুরু করেছিলেন। এ যেন দুই বারো-চৌদ্দ বছরের বাচ্চার মারামারি আর তাতে দুই বাচ্চার বাবারা যখন সালিশ মিটিংয়ে বসেছে সেখানে হঠাৎ মার খাওয়া বাচ্চার বাবা বলে বসলেন, ‘আমার ছেলেকে কেউ মারেইনি”। স্বভাবতই এরপর আর অন্য কারো কিছু বলার থাকে না, মিটিংও ডিসমিস হয়ে যায়। অর্থাৎ কঠিন মার হবে কিন্তু আওয়াজ বের হবে না সিচুয়েশন। কিন্তু মোদী এমন বললেন কেন? যেখানে ঐ মিটিংয়েরই প্রথম দিকের বক্তৃতায় এমনকি মোদীর মন্ত্রীরা বলেছেন, চীনা সৈন্যরা ভারতের ভূমি দখল করেই তাদের সেনাদের হত্যা করেছে!
রাষ্ট্র বলতে একটা নেশন-স্টেট বা জাতি-রাষ্ট্র বুঝ, এক ফান্ডামেন্টাল সমস্যা
মোদী কেন এমন বললেন, এই প্রশ্নের জবাবের আগে আমাদের অন্য কিছু সিরিয়াস আলাপ সেরে নিতে হবে। আমাদের মত দেশগুলোতে রাষ্ট্র বলতে জাতিরাষ্ট্র বুঝা হয়ে থাকে যেটা আসলে একটা ধর্মীয়-জাতি ধারণাই; যদিও এখানে সেটা ‘ধর্মীয়’ কিনা এর চেয়ে কথিত ‘জাতি” এই ভুতুড়ে ধারণাটাই মুল সমস্যা। আর এই ‘নেশন’ কথাটাকে সবাই কথার কথা হিসাবে রাষ্ট্র বলেও ডাকে। দুনিয়াতে প্রথম কলোনি দখল শুরু হয়েছিল সতেরো শতকে। এমন দখল করা প্রথম ভূমি হল ভার্জিনিয়া, আমেরিকায় এই উপনিবেশ, যা ১৬০৭ সালে ব্রিটিশদের হাতে দখল হয়েছিল। আর সেই থেকে শুরু হয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত (প্রায় টানা ৩০০ বছর) সারা দুনিয়ায়ে কলোনি দখল টিকে ও চালু ছিল। আর, এরপর থেকে কলোনিমুক্ত স্বাধীন করে দেয়া শুরু হয়েছিল। এই লম্বা কলোনি যুগের দখলদার রাষ্ট্রের কাজের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নিজদেশের রাষ্ট্র-কাঠামোই হল নেশন-স্টেট [nation-state] ও এর ধারণা। সেযুগে দখলে বের হওয়া কোম্পানির (যেমন ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি) সামরিকভাবে সজ্জিত জাহাজ নিয়ে বের হয়ে পড়া ছিল ঐ সময়ে ওসব সমাজের সবচেয়ে বড় আকর্ষণীয় ও প্রধান ব্যবসা।
জনপ্রতিনিধিত্বের রিপাবলিক রাষ্ট্র কেমন হওয়ার কথা ছিলঃ
ইংল্যান্ডের কথাই যদি ধরি, রাজতন্ত্র [monarchy] [মানে একটা রাজবংশ বা ডায়নেস্টির শাসন যে, রাজার ছেলে রাজা হবে] ভেঙে প্রথম রিপাবলিক বা জনপ্রতিনিধিত্বের রাষ্ট্র গড়ার চেষ্টা হিসাবে দেখা হয় ইংলিশ রেভোলিউশনকে (১৬৪২-৬০) [English Revolution]। যারা রেভেলিউশন বলতে চায় না এদের অনেকে এটাকে “ইংলিশ সিভিল ওয়ারও” বলে থাকে। এ্মন জনপ্রতিনিধিত্বের রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ গঠন কাঠামো হওয়ার কথা এমন যে এটা একটা রাজনৈতিকতা বা পলিটি [Polity] প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ হব্ব। যেখানে সমাজের সব অংশকে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে সমাজের সকল অংশকে জায়গা দিতে হবে, কথা বলতে দিতে হবে, সবাইকে শুনতে হবে ইত্যাদি। এভাবে সবার জন্য যা ভাল হবে এমন এক “কমন গুড” এর পক্ষে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হবে এর লক্ষ্য। এভাবে এক “পলিটিক্যাল কমিউনিটি” অর্থে রাষ্ট্রগঠন, এই ছিল এর উদ্দেশ্য।
কিন্তু সেসময়ের বৃটিশ সমাজের সবচেয়ে বড় প্রভাবশালী ব্যবসা ছিল কলোনি দখল কোম্পানির মালিক হওয়া। তাই ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির মত ব্যবসায়ী কোম্পানিগুলোর স্বার্থে “পলিটিক্যাল কমিউনিটি” গঠনের সব চিন্তা সবকিছু উলটে দিয়ে বাস্তবে যে প্রথম রিপাবলিক গড়েছিল তাই ছিল নেশন-স্টেট।
অর্থাৎ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ গঠন কাঠামোটাই পলিটিক্যাল কমিউনিটি হিসেবে গঠিত আর হলো না। এর বদলে রাষ্ট্রের বাইরের দিকে তাকিয়ে এক রাষ্ট্র গড়া হল। যেমন ঐ কলোনি দখল ব্যবসা কোম্পানিগুলোর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল ইউরোপের পড়শি রাষ্ট্রের (যেমন ফরাসি বা ডাচ রাষ্ট্রের) সমতুল্য কোম্পানি – যেমন ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিদ্বন্দ্বী হল ডাচ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি, এরকম। তাই ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো নিজের স্বার্থে চাইল এই নেশন-স্টেট। যাতে সকল ব্রিটিশ মানুষ কথিত ‘এক জাতির’ আওয়াজ তুলে অপরাপর ডাচ বা ফরাসি প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানির বিরুদ্ধে নিজ দেশের ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষে বিনা-বিভক্তিতে সকলে খাড়া হয়ে যায়। এতে কলোনি দখলের কোম্পানিগুলোর স্বার্থই যেন সব ব্রিটিশ নাগরিক-মানুষের স্বার্থ বলে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। এতে সকল বৃটিশ নাগরিক বিশেষত যারা প্রান্তজন, গরীব বা কম আয়ের মানুষ – তারা কী চায়, তাদের সমস্যা কী সেটা আর তাদেরকে বলতে সুযোগ দেয়া হল না, শুনাও হল না। এককথায় “কমন গুড” আর হল না। কলোনি দখল আর দাস ব্যবসায়ীদের স্বার্থটাই কথিত “নেশনের স্বার্থ” বলে চালিয়ে দিতে তা সবার উপরে চেপে বসল, চাপিয়ে দেওয়া হল। নেশন স্টেটের কাজই হল এই চাপিয়ে দেয়াটা নিশ্চিত করা।
রেনেসাঁর ধারণার মূলকথা হয়ে যায় জাতিরাষ্ট্রঃ
রিপাবলিক বলতে নেশন-স্টেট ধারণা প্রতিষ্ঠা পেয়ে যাওয়ায় মূলত যে দুই নিট ক্ষতি হয়ে যায় তা হল – এক. রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ গঠন কাঠামোটা পলিটিক্যাল কমিউনিটি হলে সব পক্ষকেই শুনার যে বাধ্যবাধকতা থাকার কথা তা হারিয়ে যায়। দুই. অন্যের দেশ কলোনি-দখল করা ও সম্পদ লুট করে আনা বৈধ হয়ে যায়। রাষ্ট্র সব জায়েজ করে দেয়। আর সবচেয়ে ভয়াবহ তৃতীয় ক্ষতিটা হল, রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিকল্প হিসাবে রিপাবলিক বা গণপ্রতিনিধিত্বের রাষ্ট্র বলতে আসলে নষ্টা নেশন-স্টেট রূপটাই রেনেসাঁ চিন্তার সর্বোত্তম উপহার দাবিতে হাজির হয়ে যায়।
রেনেসাঁর আদিগুরু রামমোহন রায়ের হাতে ব্রাহ্মধর্মীয়-জাতিরাষ্ট্রের মশালঃ
কমিউনিস্টদের দাবি রামমোহন রায় ভারতে রেনেসাঁ এনেছেন মানে, প্রগতিশীলতা এনেছেন। বাস্তবত কথা মিছা নয়। কিন্তু প্রগতির ঐ রেনেসাঁতে রিপাবলিক রাষ্ট্র বলতে ‘নেশন-স্টেট’ (জাতি-রাষ্ট্র) ধারণাই। অর্থাত জাতি-রাষ্ট্র ধারণা রেনেসাঁর ভিতর দিয়ে রামমোহন রায় ভারতে এনেছেন। কিন্তু এর উপর আবার তাঁর দেখা ও বুঝের ব্রিটিশ জাতি-রাষ্ট্র বলতে একে তিনি বুঝেছিলেন, ধর্মভিত্তিক একটা জাতি-রাষ্ট্র হিসাবে। মানে তাঁর বুঝাবুঝিতে কথিত বৃটিশ জাতিরাষ্ট্রকে তিনি এভাবেই বুঝেছিলেন; এক “এংলো ক্যাথলিক ক্রিশ্চান ব্রিটিশ” জাতি, এভাবে। এখানে ‘এংলো ক্যাথলিক’ বলতে সেটা ক্যাথলিক ক্রিশ্চান ধর্মটাই কিন্তু ইংলিশ রাজপরিবার এর যে ভাষ্যটা মানে কেবল সেই রূপ ও ভাষ্যটা। কিন্তু এদিকে রামমোহনের নিজ ভারতের বেলায় এখানে দুটা বড় ধর্ম হিন্দু-মুসলমান ছাড়াও ছোট সংখ্যায় পালিত আরও অনেক ধর্ম আছে, টের পেলেন। তাই তিনি স্বাধীন ভারত একটা “জাতি-রাষ্ট্র” গড়ার প্রধান সমস্যা সমাধানের জন্য সবার আগে সবাইকে একই একেশ্বরবাদী ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত করতে মনস্থ করলেন। তাই তিনি ১৮১৫ সালে ব্রাহ্ম ধর্ম চালু করেন। কিন্তু এরপর তিনি মাত্র আর ১৮ বছর বেঁচে ছিলেন। তিনি বেঁচে থাকতেই যেসব বাধা ও সমস্যার তিনি মুখোমুখি হচ্ছিলেন তা তিনি মারা যাবার পরে আরও বিরাট আকার ধারণ করে। শেষে তাঁর ব্রাহ্মসমাজ দুটো ধারাতে ভাগ হয়ে যাবার পর ক্রমশ তারা সকলেই অকেজো, স্থবির হয়ে যায়। এই প্রকল্প ব্যর্থ হলে আর তিনি মারাও গেছেন বলে এরপরে বঙ্কিমচন্দ্র, বিবেকানন্দ, অরবিন্দ ঘোষ প্রমুখের হাত ঘুরে এই প্রকল্প যেন “ব্রাহ্ম জাতি-রাষ্ট্র” হতে পারল না বলে নেহায়তই ‘না-পারতে’, এটা এক ‘হিন্দু জাতি-রাষ্ট্র’ প্রকল্প হিসাবে মানিয়ে নেয়ানোর চেষ্টা হিসেবে হাজির করেন, এরা সকলে। ততদিনে কংগ্রেস দলের জন্মানোর সময় হয়ে গেছিল। তাই ১৮৮৫ সালের কংগ্রেস দলের জন্মের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হিসাবে ‘হিন্দু জাতি-রাষ্ট্র ধারণাই হাজির হয়েছিল। বলাই বাহুল্য এটা মুসলমানদের জন্য অস্বস্তিকর। কংগ্রেসের মুসলিম সদস্যরা তো বটেই সমাজেও মুসলিমদের থেকে আপত্তি প্রবল হয়ে থাকে। এটা না হবার কোন কারণ ছিল না। কারণ, একটা রাষ্ট্র গড়তে চায় বলে জনগণকে একটা ধর্মে আসতে হবে – এটা কী কোন পুর্বশর্ত হতে পারে? কাউকে আরেক ধর্মে যেতে ফোর্স করা যায়? না সম্ভব? এটাই তো বড় জুলুম, চরম অন্যায্য!
মুসলমানদেরকে হিন্দু-জাতি-রাষ্ট্র মেনে নিতে বলা হচ্ছিল – কেন? গান্ধী ১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে মরবার আগে পর্যন্ত এমন আবেদন একাজ করতে গিয়ে “হিন্দু-মুসলমান এক” হতে বলে চলেছেন, অসহায় পাগলের মতন। কারণ ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হতেই ব্যাপক দাঙ্গা ছড়িয়ে পরেছিল। কিন্তু তাতে কী? বাস্তবে গান্ধী টের পেয়েছেন তার এই আবেদন কতটা অবসার্ড, উদ্ভট। কোন মানুষের কাছেই স্ব স্ব ধর্মত্যাগের আহবান খুবই অস্বস্তিকর। মানুষ একটা রাষ্ট্র গড়তে চায় বলে তাদের সবাইকে এক ধর্মে যেতে হবে, এক হতে হবে – এর কী সম্পর্ক? অথচ সব জটিলতার, সব এবসার্ডিটির উতস হল একই ধর্মের এক জাতিরাষ্ট্র গড়ার কল্পনা – রাষ্ট্র সম্পর্কে এমন উদ্ভট ইমাজিনেশন থেকে। অথচ সহজ সমাধানটা হল, কে কোন ধর্মের তাতে কিছু এসে যায় না, সবাই নাগরিক। কিন্তু সমান নাগরিক। সমান অধিকার-সম্পন্ন নাগরিক। অধিকারের বৈষম্যহীন নাগরিক। কাজেই এরপর কে কোন এক না ভিন্ন ধর্মের নাগরিক তাতে কিছু এসে যায় না। কাউকে ধর্ম বদলাবার আহবান অথবা তথাকথিত হিন্দু-মুসলমান’ “এক হবার আবেদন” করতে মারা যাবারও কোন দরকারই পরে না। কারণ সেক্ষেত্রে সবাই সমান অধিকারের নাগরিক। কিন্তু গান্ধী-নেহেরুর কংগ্রেস নিজেদের এই উদ্ভট চিন্তার পরাজয় ঢাকতে হিন্দু শব্দটা লুকিয়ে ফেললেন কিন্তু সেই হিন্দু-জাতি-রাষ্ট্র – এটাকেই কায়েম করতে সচেষ্ট থেকে গেলেন।
কংগ্রেসের জন্মের পর মুসলমানেরা দীর্ঘ ২০ বছর অপেক্ষার দেন-দরবার চালিয়েছিলেন। এরপর ১৯০৬ সালে বাধ্য হয়ে মুসলমান জাতি-রাষ্ট্র প্রকল্প হিসাবে মুসলিম লীগের জন্ম হয়ে যায়।
কিন্তু এখানে মজার ব্যাপার হল, মুসলিম লীগ “মুসলমান” জাতি-রাষ্ট্র কথাটা প্রকাশ্যে উচ্চারণ করেই বলতে হয়েছিল যাতে সে মুসলমানদের এতে, এদলে ডেকে আনতে পারে। কারণ, তাদেরকে “মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ট অঞ্চলগুলোকে নিয়েই” আলাদা রাষ্ট্র চাই একথা বলা ছাড়া উপায় ছিল না। আর এই সুযোগে কংগ্রেসিরা নিজেদের হিন্দু-জাতি-রাষ্ট্রের লোক – তাদের এই পরিচয় লুকিয়ে ফেলে দাবি করতে থাকে তারা কেবল জাতি-রাষ্ট্রের লোক এবং তারা প্রগতিশীল। কারণ তারা রেনেসাঁ মানা-বুঝা লোক। আর এখান থেকেই এক পর্যায়ে আর জাতি-রাষ্ট্র কথাটাও না বলে তারা বলতে থাকে তারা জাতীয়তাবাদী। যেন নেশন-স্টেট ধারণা থেকে জাতীয়তাবাদী ধারণাটা আলাদা। তাই এই “জাতীয়তাবাদ” এক প্রগতিশীল ধারণা হয়ে যায়।
আর এর বিপরীতে মুসলমানেরা ধর্মের রাষ্ট্র চায়, রেনেসাঁ মানে না- তাই তারা হয়ে যায় পশ্চাৎপদ – এই হয়ে যায় তাদের যুক্তি। বিশেষ করে পাকিস্তান রাষ্ট্র আলাদা হয়ে যাওয়ার পর জমিদার-হিন্দুরা কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়ে নিজেদের ক্ষমতা জমিদারি হারানোর বদলা নিতে গিয়ে এই “পশ্চাৎপদ-প্রগতিশীলতার” ভুয়া তর্ক ও যুক্তিটা তুলে ধরেছিল। আর সেই সাথে জাতি-রাষ্ট্র কথাতে যে তার হিন্দুজাতি্রাষ্ট্র আকাঙ্খা পরিচয় যাতে ধরা না পড়ে যায় তাই “জাতি” শব্দটা ভেঙে এবার ‘জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র’ বলা শুরু করল; যেন এটা জাতি-রাষ্ট্র থেকে এটা ভিন্ন কোন ধারণা। এই রেনেসাঁ আর প্রগতিশীলতা এটাই ড; সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বুঝের ‘রেনেসাঁ’ আর ‘প্রগতিশীলতা’ ধারণার উতস। জিন্নাহ’র উপরে কুপিয়ে গেছেন অথচ নেহেরু-গান্ধীর হিন্দু-জাতি-রাষ্ট্রের কংগ্রেস এটা চোখে দেখেন নাই। ভাবেন – এটা ভারতীয় রেনেসাঁ ফলে প্রগতিশীলতা , এই বলে কাভার দেন – এসব হল “জাতীয়তাবাদ”।
ইউরোপের জাতিরাষ্ট্র চিন্তার পরিণতিঃ
ভারত-পাকিস্তানের পরিণতি জানলাম এখন ইউরোপের পরিণতি দেখা যাক। মূলত দু’কারণে সারা ইউরোপ. (৪৭ টা রাষ্ট্রের এক জোট হয়ে) ১৯৫৩ সালে জাতি-রাষ্ট্র ধারণাটা ত্যাগ করেছিল। তারা ঐ ৪৭ রাষ্ট্র একটা সম্মেলন ডেকে “পুর্ণ-স্নান সেরে” নিয়ে নিজেদের শুদ্ধ করে নিয়েছিলেন। স্ব স্ব রাষ্ট্র পুণর্গঠন করে নিয়েছিলেন যে জাতি-রাষ্ট্র আর না, সবারই এটা এখন নাগরিক অধিকার ভিত্তিক রাষ্ট্র। কারণ এক. দ্বিতীয় বিশযুদ্ধে ইউরোপে জাতি-রাষ্ট্র চিন্তার সবচেয়ে খারাপ পরিণতি ও প্রোডাক্ট হল জার্মানির হিটলার ও তাঁর শাসন। হিটলারের উত্থান ও তাঁর নীলচোখের শ্রেষ্ঠ “জার্মান নেশন” – এই জাতগর্বের চরম বর্ণবাদী ভয়াবহতা দেখতে হয়েছিল সারা দুনিয়াকে। এটা ছিল নিজেদের জাতি-রাষ্ট্র ধারণার সবচেয়ে কদর্য ও চরম রূপ। সারা ইউরোপ কোনমতে এটা থামাতে পেরেছিল তবে নিজের মুরোদে না। মূলত আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের দেয়া অর্থ ও সামরিক সহায়তায় তাঁরা সক্ষমতা দেখিয়ে জিতেছিল । অতএব এরপর জাতি-রাষ্ট্র ধারণাটা ফেলে দেয়া এটা ফরজ হয়ে যায়। আর দ্বিতীয় কারণ, ঐ মার্কিন সহায়তা যেটা না পেলে সারা ইউরোপই হিটলারের পদানত হয়ে যেত, ঐ সহায়তাটা পেতে শর্ত হিসাবে সারা ইউরোপকে দাসখত দিতে হয়েছিল যে, তারা দুনিয়া থেকে কলোনি দখল ব্যবসা বন্ধ করে দেবে এবং কলোনিকৃত রাষ্ট্রগুলোকে মুক্ত স্বাধীন করে দেবে। আর মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট দ্বিতীয় বিশযুদ্ধ বিজয় পরবর্তী দুনিয়ায় রাষ্ট্রের যে ধারণা আঁকছেন, তবে তা তিনি করছেন মূলত একটা জাতিসঙ্ঘের রূপ কাঠামো বর্ণনা করে। সে কাঠামোটা হল অধিকারভিত্তিক রাষ্ট্রের এসোসিয়েশন হিসেবে জাতিসঙ্ঘ। অতএব রাষ্ট্র হতে হবে অধিকারভিত্তিক রাষ্ট্র এই বাধ্যবাধকতাও ছিল।
এই বাধ্যবাধকতায় জাতিসঙ্ঘের রূপ কাঠামোটা কী ছিলঃ
রূপ্টা কী ছিল তা বুঝার সবচেয়ে সহজ প্রমাণ হল আমাদের সবার পরিচিত কাশ্মির। কাশ্মিরের রাজা হরি সিং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নেহরুর সাথে অন্তর্ভুক্তি চুক্তিতে [Accession Treaty বা ইন্সট্রুমেন্ট অব একসেশন] (যদিও অস্থায়ী) স্বাক্ষর করেছেন তাই কাশ্মির ভারতের অংশ হয়ে গেছে – এই দাবি নিয়ে নেহরু ব্যাপারটায় ভারতের পক্ষে রায় আনতে জাতিসঙ্ঘে দরবার করতে যান। খুশি তিনি, কারণ তার চোখে এত সহজ এই মামলা, অতএব রায় তার পক্ষে আসবেই। এই যে আস্থা আর নেহরুর রাষ্ট্র বোঝাবুঝি এটাই প্রমাণ করে যে, তিনি প্রবল জাতিরাষ্ট্র-বাদী। আর সেই সাথে জাতিসঙ্ঘের গঠনভিত্তি কী তিনি এর কিছুই জানেন না, অজ্ঞ। কখনো খেয়াল করেন নাই, বুঝতেও যান নাই। তাই তিনি বোকা হয়ে দেখলেন, জাতিসঙ্ঘ কাশ্মিরে গণভোটে আয়োজন করতে বললেন। আর সে ভোটের রায় নিয়ে সে ভিত্তিতে কাশ্মির কার থাকবে – ভারত বা পাকিস্তানের না স্বাধীন কাশ্মির হবে, কোনটা – তা ফয়সালা করতে সিদ্ধান্ত দিয়েছিল। ভুখন্ডের বাসিন্দাদের সিদ্ধান্ত যে শাসক কে হবে তা বেছে নিবার নাগরিক অধিকার, পাবলিক ভোট – এই হল ভিত্তি।
কেন জাতিসঙ্গ এমন রায় দিয়েছিলঃ
কেন এমন রায়? কারণ সেকথাটাই জাতিসঙ্ঘেরও জন্মভিত্তি। এর মানে হল নেহরু জাতিসঙ্ঘের জন্মভিত্তি জানতেন না। নেহেরু তো রাজা নিয়ে এসেছিলেন, ভেবেছিলেন রাজার সইয়ের হুকুমে কাশ্মির ভারতের। কাশ্মির ভুখন্ডের বাসিন্দাদের সিদ্ধান্ত – এরাই যে ক্ষমতার উতস তা নেহেরু জানতেন না। জানলে তো রাজার কাছে ছুটতেন না। জাতিসঙ্ঘের জন্মভিত্তি কলোনি দখল ‘হারাম’। তাই যেকোন ভুখন্ডের বাসিন্দারাই সিদ্ধান্ত নিবার হক রাখেন যে তারা কার দ্বারা শাসিত হবেন – এটাই, জাতিসংঘেরও জন্মভিত্তি। কোন ভূখণ্ড কোথায় কার সাথে যুক্ত হবে, কাদের দ্বারা শাসিত হবে, এর সিদ্ধান্ত নেবার একমাত্র এখতিয়ার কোনো রাজা নয়, কোনো সম্রাট বা সুলতানও নয়। সেই সিদ্ধান্ত নেবে ওই ভূখণ্ডের বাসিন্দা জনগণ। এটা তাদের নাগরিক অধিকার।
খেয়াল করুন কোনো, “জাতি”গোষ্ঠী নয়, কোনো ধর্মীয় পরিচয়ের গোষ্ঠীও নয়। কোনো ‘নেশন’ নয়। আর এই যুক্তির ভিত্তিতেই জাতিসঙ্ঘ কলোনি দখল করা অবৈধ জ্ঞান করে। কাজেই রাজা-সম্রাটেরা কেউ কিছুই নয়। বাসিন্দা নাগরিকেরাই সব, তারাই ক্ষমতার উৎস। এ কারণে রাজা হরি সিংয়ের চুক্তিতে স্বাক্ষরের কোনো মূল্য নেই। তাই কাশ্মির সেকালের নেহরুর ভারতের নয়, একালে ৩৭০ ধারা বাতিল করে দিলেও তা মোদীর ভারতের নয়। মোদীর কাশ্মিরকে ভারতে অন্তর্ভুক্তি করে নেওয়াও একই কারণে জাতিসঙ্ঘের চোখে অবৈধ। অর্থাৎ কাশ্মির ভূখণ্ডের বাসিন্দাদের ‘নাগরিক অধিকারই’ মূল কথা; যেটা জাতিরাষ্ট্র বুঝের নেহরু বুঝেন নাই বলেই ধরা খাইছিলেন। তিনি অধিকারভিত্তিক রাষ্ট্র সম্পর্কে নির্বোধ ও উদাসীন। তাই এর বাস্তবায়কও নন। তিনি আসলে এক জাতি-রাষ্ট্রের শাসক ও তেমনই রাজনীতিক। তিনি জাতিসঙ্ঘের জন্মভিত্তি জানতেন না বলেই কাশ্মির ইস্যুতে ‘বোকার সাহস” করে জাতিসঙ্ঘের রায় আনতে গেছিলেন। ধরাও খেয়েছিলেন।
তাহলে এখন চীন-ভারত বিবাদের মধ্যে এসব কথার গুরুত্ব কী?
আমরা আসলে এতক্ষণ ছিলাম রাষ্ট্রের ‘লোকাল’ দিকের আলোচনায় যে রাষ্ট্র জাতিভিত্তিক না নাগরিক ও নাগরিক অধিকারভিত্তিক হতে হবে এই প্রসঙ্গে। এখন আমরা যাব এর ‘গ্লোবাল’ দিকে।
রুজভেল্ট শুধু রাষ্ট্রের ভিত্তি কী হবে সেকথাই সবাইকে নিয়ে সে সময় ঠিক করে দিয়েছিলেন তাই নয়। তিনি রাষ্ট্রের গ্লোবাল দিক কী হবে সেটাও ঠিক করেছিলেন।
গ্লোবাল দিক মানে হল মূলত “আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের” দিক – যেটা মূলত গ্লোবাল রাজনৈতিক অর্ডার এবং গ্লোবাল অর্থনৈতিক অর্ডার এসব দিক। আমরা এখন ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলতে আরেকটা শব্দ ব্যবহার করব। ইংরাজি ‘অর্ডার’ শব্দটা নিয়ম শৃঙ্খলা রক্ষা বা চালু করা অর্থে ব্যবহৃত হয়। সময়ে এটা আইন প্রণয়ন অর্থেও। মানে রাষ্ট্রের গ্লোবাল দিক বলতে আমরা বুঝাতে ও বুঝতে বলছি গ্লোবাল অর্ডার এর দিক। অর্থাত এবার আর রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ নয় মূলত বাইরের এই অর্থে যে এতক্ষণ যদি রাষ্ট্রের ভেতরের অর্ডার নিয়ে কথা বলে থাকি তবে এখন রাষ্ট্রগুলোর মধ্যকার, বাইরের বা পারস্পরিক সম্পর্কের নিয়মশৃঙ্খলা ও আইন অর্থে এক অর্ডার নিয়ে কথা বলব। তাই কথাটা এখানে গ্লোবাল অর্ডার বা আন্তঃরাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকের মত বিষয়গুলোতে পারস্পরিক সম্পর্কের নিয়ম-শৃঙ্খলার বা সুশৃঙ্খলা বিন্যাস ঘটাতে একটা অর্ডার।।
আগেই বলে নিয়া যাক েই গ্লোবাল অর্ডার স্থাপন আপনাতেই বা কর্তা ছাড়া হয় নাই। এই কর্তা হলেন চারবারের (১৯৩২-৪৫) লাগাতর আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডেলোনো রুজভেল্ট [Franklin Delano Roosevelt বা FDR]। দুনিয়াকে একটা গ্লোবাল অর্ডারে সাজানোটা আমেরিকান প্রেসিডেন্টের হাতে হওয়াটা জায়েজ হয়েছে কী না – তা নিয়ে কথা বলা এখানকার প্রসঙ্গ নয়। সেটা খোলা রেখেই আমরা ইতিহাসে যা ঘটেছিল তা নিয়েই আগাচ্ছি। তবে কোন সাবজেকটিভ কর্তা ছাড়া একাজ সম্ভবত হতই না। রুজভেল্টের আমেরিকা বিশ্বযুদ্ধ শেষে গ্লোবাল অর্ডার কী হবে এর এক নির্ধারক হয়ে উঠেছিলেন। গ্লোবাল অর্ডার বলতে যেমন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কী হবে, কিভাবে হবে এর নির্ধারক হয়ে উঠেছিল আমেরিকা। অথবা আরো সরাসরি বললে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নীতি নিয়ম, মুদ্রা কী হবে তা প্রথম প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ঠিক হয়েছিল আমেরিকার নেতৃত্বের গ্লোবাল অর্ডারে। এই গ্লোবাল অর্ডারটা খাড়া হয়ে ছিল বা আছে মূলত তিনটা প্রতিষ্ঠান জাতিসঙ্ঘ, আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকে। অবশ্য সাথে আরো কিছু অনুষঙ্গ প্রতিষ্ঠান থাকলেও এরাই মুখ্য। গত সত্তর বছর ধরে এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই আমেরিকার নেতৃত্বে গ্লোবাল অর্ডারটা চালু থেকেছে। আর তা ভালো ও খারাপ দু অর্থেই। কিন্তু এখন এই প্রথম ক্রমশ অন্তত অর্থনৈতিকভাবে চীন আরো প্রভাবশালী রাষ্ট্র হিসেবে উঠে আসছে। ফলে এবার চীনের নেতৃত্বের নতুন এক গ্লোবাল অর্ডার একে বদলে ফেলতে উঠে আসছে।
তৈরি হন, গ্লোবাল অর্ডারে পরিবর্তন আসছেঃ
কিন্তু এর প্রমাণ কী? এই বক্তব্যের ভিত্তিই বা কী? কারো খেয়ালে বা নেহায়তই অনুমানে এমন কথা নিশ্চয় লেখা যায় না। আসলে প্রথমে কথাটা কিছু লক্ষণ দেখে বলাবলি শুরু হয়েছিল ২০০২ সালের দিকে, কিছু পশ্চিমা মিডিয়ায়। পরে আমেরিকা নিজেই সরকারি প্রতিষ্ঠান দিয়ে স্টাডি করে গ্লোবাল অর্ডারে পরিবর্তন আসছে তা নিশ্চিত হয় ও আমাদেরকেও নিশ্চিত করে। এর রিপোর্ট ওয়েবে পাবলিক করে দেয়া ডকুমেন্ট আর যা প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৮ সালে। শিরোনাম ছিল “২০২৫ সালের দুনিয়া দেখতে কেমন হবে” [“NIC Global Trends 2025 | (Published in- 2008)| ]। শুধু তাই নয়, পরেও এই স্টাডি চালিয়ে যাওয়া হয়। আরো দুটা রিপোর্টে – ২০৩০ সালে কেমন “NIC Global Trends 2030″| (Published in- 2012)| আর শেষেরটা ২০৩৫ সালে কেমন হবে [“NIC Global Trends 2035″| (Published in- 2017) ] এভাবে। সবগুলোরই একই রেজাল্ট আসে, আমেরিকা ডুবে যাচ্ছে চীন ভেসে উঠছে – নতুন নেতা চীন। বাস্তবে চীনের নেতৃত্বের এই স্পষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে লিড নেয়া শুরু হয়েছে ২০০৯ সাল থেকে।
ঐ স্টাডিতে চীনের পিছনে পিছনে আর কার অর্থনীতি উঠে আসার সম্ভাবনা আছে, এরও স্টাডি-ডাটা সেখানে ছিল। এ থেকেই বুশের আমল থেকে আমেরিকা নিজের করণীয় ঠিক করে যে, ভারতের পিঠে হাত রেখে কাছে টেনে একে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা – এটা তার কৌশল হবে। আর তা থেকেই বাজারে ভারতের গুরুত্ব বাড়ে। এমনিতে ভারতের অর্থনীতি খুব গরিবই; বিশেষ করে অবকাঠামোগত সক্ষমতার দিক থেকে। তবুও চীনের কাছাকাছি জনসংখ্যার বলে এর পটেনশিয়াল বা সম্ভাবনা আছে এমন “রাইজিং অর্থনীতি” মনে করা হয়। ইতোমধ্যে ২০০৯ সাল থেকে চীনের নেতৃত্বে পালটা আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংক ধরনের কিন্তু নতুন প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্রিকস [BRICS] ব্যাংক জন্ম নেয়। ভারত সেখানে যুক্ত হতে অফার পেলে যোগ দেয়। চীনও তার বিনিয়োগ সক্ষমতা থেকে ভারতের চাহিদামত ঋণ বিশেষত অবকাঠামোগত ঋণ প্রদান করতে থাকে। কিন্তু ততই আমেরিকার কাছে ফিরে ফিরে যাওয়ার ঝোঁক ও আমেরিকার অফার করা সুবিধা নেওয়ার ঝোঁক তার বাড়তেই থাকে। যদিও ট্রাম্প আমলে এসে আমেরিকা মনে করে, ভারতকে চীনের পেছনে লাগানো বৃথা। কারণ এটা তেমন কোনো ফলদায়ক নয়, তেমন রেজাল্ট নাই।
কিন্তু ভারতের আচরণ এমন হয়ে যায় যে, সে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে থাকে যে, সে যেন চীন ও আমেরিকার মাঝে দুটার সাথেই স্মার্ট প্লে করে দু’জনের থেকেই নিজের সুবিধা আদায় করে ফুলে উঠতে পারবে। বর্তমান ভারত-চীন দ্বন্দ্ব-সংঘাত হল, সেই অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী মোদীর ভারতকে নিজ প্রকৃত সক্ষমতার দিকে হুঁশ-নজর করিয়ে দেয়ারই চীনা-উদ্যোগ, বলা যায়।
ব্যাপারটা অনেকটা কাউকে মারধর দেয়ার পরে আবার যেমন বুঝিয়ে দেয়া যে কাঁদলে আবার আরো মার খাবি। কথিত বিশ ভারতীয় সেনা মারা যাওয়ার পর চীন সাবধান করে দেয় যেন ভারত নতুন টেনশন আবার সৃষ্টির চেষ্টা না করে। তাই অবশেষে মোদীর সবল অবস্থান ঘোষণা যে “কেউ ভারতের মাটিতে আসেনি”। খুব সম্ভবত ভারতকে সামরিকভাবে আরো হেস্তনেস্ত করবে আর বুঝিয়ে দিবে যে চীন-ভারত বাণিজ্যিক সম্পর্ক ত্যাগ করলে ভারতেরই বেশি ক্ষতি শুধু নয়, তার অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকা মুশকিল হয়ে যাবে, সে কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া থেকেই মোদির এমন হঠাত বক্তব্য – ‘কেউ ভারতের মাটিতে আসে নাই।’
কিন্তু ভারতের কেন এমন হল কেনঃ
ভারতের কোনো রাজনীতিক বা একাডেমিক বা নীতিনির্ধারক চলতি পুরা ইস্যুটাকে “গ্লোবাল অর্ডারের” দিক থেকে দেখেছেন এমন কোন মিডিয়া রিপোর্ট নজরে আসেনি। এর ওপর আছে ভারত মানেই আসলে এক নেশন-স্টেট ভাবনায় ডুবে থাকা ভারত। এর প্রধান স্বাক্ষ্য হল হিন্দুত্বভিত্তিক রাজনীতি একমাত্র নেশন-স্টেট ভাবনার উপরেই নিজে দাড়াতে পারে। মোদীর তথাকথিত বয়কট বা স্বদেশি অর্থনীতির ধারণাও বোকা বোকা কথার নেশন-স্টেট ভাবনার উপরেই জন্মাতে পারে।
তাই এবার আরো সরাসরি বলে, যদি প্রশ্ন করা যায়, গ্লোবাল অর্ডার নিয়ন্ত্রণের লিডার প্রশ্নে ভারত কার সাথে থাকতে চায় নিজের ভবিষ্যত ভাল হবে বলে মনে করে – আমেরিকা না চীনের সাথে? এখন পর্যন্ত ভারতের আচরণ থেকে এর জবাব হল ভারত জানে না। এবং না জেনেই এমন ফেলে রেখে থেকে যেতে চায়।
অথচ এর সহজ জবাব হবে আমেরিকার বিরুদ্ধে এবং সেটা এজন্য যে, যে নেতার যুগ শেষ হয়ে যাচ্ছে সে আমেরিকা, সে ক্ষয়িষ্ণু শেষ হয়ে যাচ্ছে – তাই সে দুনিয়ার অতীত নেতা; বিপরীতে ভারত নিঃসন্দেহে নিজেই প্রধান নেতা হতে চায় অথবা অন্ততপক্ষে আগামী নেতা চীনের প্রধান সহযোগীর ভূমিকায় দেখতে চায়। তাই এটাই হতে হবে। এসবের বাইরে অন্য কিছু তো হতে পারে না। তাহলে সে বারবার অতীতের মধ্যে মানে আমেরিকার ভেতর আশ্রয় খুঁজছে কেন, তাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইছে কেন?
এর জবাব ভারতের কাছে নেই। কেন নেই?
মূল কারণ, গ্লোবাল দিকটা সে বুঝতেই পারে না। মূল কারণ, হিন্দুত্ববাদী জাতি-রাষ্ট্র বুঝের লোক। এর বাইরে তার দৃষ্টি যায় না, প্রয়োজনও দেখে না। গ্লোবাল বলে কিছু দেখতেই পায় না। তাদের দুনিয়া স্বদেশিপনাতেই!
যেমন আমাকে একজন বলছিল, পাকিস্তান যদি চীন ও আমেরিকার সাথে একই সাথে সম্পর্ক রাখতে পারে তাহলে ভারতও চীন ও আমেরিকার সাথে একই সাথে সম্পর্ক রাখলে সেটা দোষের হবে কেন? বা পারবে না কেন?
প্রথম কথা, আমরা গ্লোবাল অর্ডার নিয়ন্ত্রণকদের সহযোগী (মূল নেতার সাথে প্রভাবশালী ভূমিকায়) কেউ একজন হওয়ার প্রসঙ্গে কথা বলছি। স্রেফ দুটা রাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক রাখা না রাখার বিষয় নয় এটা। পাকিস্তান গ্লোবাল অর্ডার নিয়ন্ত্রণকারীদের কেউ নয়, সহযোগী হয়ে ওঠার তালিকাতেও কেউ নয়। পাকিস্তান অর্থনীতিগতভাবেও তেমন কোনো শক্তিশালী দেশ নয়। তাই বলছি গ্লোবাল অর্ডার বা এর নিয়ন্ত্রক বলতে কী বুঝিয়েছি সেটা আমল করাই হয় নাই, এই প্রশ্নের মধ্যে। অর্থাৎ এই প্রশ্নকর্তা যেন ভারত নিজেই!
হিন্দি বা উর্দুতে একটা কমন ফিল্মি ডায়লগ আছে- “আওকাত দেখা দিয়া” না! মানে কারও বাস্তব মুরোদ বা স্টাটাস কি ও কেমন সেটা কোনো হামবড়া লোককে মনে করিয়ে বা দেখিয়ে দেয়া। চীন ভারতকে তার আওকাত মনে করিয়ে দিয়েছে; যদিও তার মিডিয়া ও বিরোধী দল, এমনকি তার নিজ দল পুরানা স্টাইলে এখনো ভাব দেখিয়ে যাচ্ছে! অর্থাৎ তারা ধারণাও করতে পারছে না চীন মোদীকে ঠিক কী দেখিয়ে দিয়েছে!
কারো কোনো সামরিক বা অর্থনৈতিক সক্ষমতা না থাকা নিশ্চয় দোষের নয়। তবে না থাকলে কেমন আচরণ করতে হয় সেটাই আলোচ্য। যতদিন সেটা অর্জিত না হয় ততদিন ভারত চীনের সাথে সংঘাতবিহীন সম্পর্ক রেখে বা সংঘাত এড়ানোর বুদ্ধিতে চলাই তার জন্য “সোজা রাস্তা” । আসলে চীন বুঝিয়ে দিচ্ছে মোদী তোমার হিন্দুত্ব, তোমার জাতি-রাষ্ট্র ধারণার বাইরের সবকিছুতে অবুঝ থাকা আর তোমার হামবড়া ভাব- এগুলো অচল! এভাবে চললে তুমি মরে যাবা – তাই এসব ছাড়তে হবে।
চীন কী আগ্রাসনবাদী হয়ে উঠছেঃ
নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে, “চীন যা করছে তা পড়শিকে দেয়া উস্কানি মনে হলেও এতে ম্যাসেজ দিয়েছে আমেরিকাকেই”। আমেরিকান ডিপ্লোম্যাটরা গালওয়ানের হত্যার ঘটনাকে “চীনের আগ্রাসন” বলছে। কিন্তু ভারতের এক রিটায়ার্ড লে জেনারেল বলছে, “কে ক্ষমতায় বস – এটা ভারতকে চীনের দেখানো শেষ হয়েছে মনে হয়ে গেলে সে সব ভুমি ফেরত দিয়ে চলে যাবে”।
একথার সাথে সম্ভবত আরেকটা কথা যোগ দিতে হবে – ততদিনে সম্ভবত চীন সাথে – এক ডিসিপ্লিন্ড অনুশাসন মেনে চলা – সুবোধ বালক, এমন ভারতকেও দেখব আমরা!
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
[এই লেখাটা গত ২৭ জুন ২০২০, দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ওয়েবে ও পরদিনই প্রিন্টেও “ভূখণ্ড ফেরত আনা ব্যাপার নয়”– এই শিরোনামে উপ-সম্পাদকীয়তে ছাপা হয়েছিল। পরবর্তিতে সে লেখাটাই এখানে আরও নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে এখানে আজ ছাপা হল। ]
হামবড়া, ঝগড়াটে, খারাপ প্রতিবেশী ভারতের উচিত শিক্ষা হওয়া দরকার।
LikeLike
দাদা, তথ্যবহুল লেখার জন্য ধন্যবাদ। চীন-ভারত দ্বন্দ্ব-সংঘাত লেগেই আছে। এর সাথে জড়িয়ে আছে ভুটান ও নেপালের কিছু ইস্যু। এ ব্যাপারে আরও লেখা দেওয়ার জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ করছি।
LikeLike