কাজে লাগাতে জানলে চীন এসেট, না হলে দায়
গৌতম দাস
১৩ জুলাই ২০২০, ০০:০৬ সোমবার

কখনো কখনো এমন সময় আসে যখন বাইরে মার খেয়ে এলেও ঘরে এসে তা বলে না। এতে আরো ক্ষতি কম হবে এটাই থাকে পিছনের বুঝাবুঝি। নরেন্দ্র মোদীর অবস্থা এখন সেরকমই। তাঁর – আমাকে কেউ মারে নাই; ভূমি বা বর্ডার-পোস্ট কেউ দখল নেয় নাই ধরণের বক্তব্যটা সে রকমের। তবে ওটুকু বলাতেই ব্যাপারটা মিটে যায়নি। ইতোমধ্যে এর আরো বর্ধিত রূপও এসে গেছে। তাতে ভ্যানিটি বা অহঙ্কার আরো যা ছিল তা-ও ফুটা হয়ে, মাথা নিচু হয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। গত ৬ জুলাই সকাল থেকেই পরিষ্কার প্রকাশ হয়ে পড়ে যে, লাদাখে গালওয়ান উপত্যকা এটা পুরাই চীনের অংশ বলে মোদী মেনে নিয়েছেন। তাতে মাথা যত নিচে গিয়েই ঠেকুক, চীন তাঁর হাত-পা বেধে ফেলেছে, তাই। আর এই মেনে নেয়ার বিনিময়েই ডিসএনগেজমেন্ট বা উভয়পক্ষের সেনা প্রত্যাহারের আপসটা সম্পন্ন হতে পেয়েছে। দু’পক্ষই সেনা প্রত্যাহার করে নিতে একমত হলে এর প্রথম পর্বের বাস্তবায়নও ইতোমধ্যে সমাপ্ত হয়ে গেছে।
মোদীর ‘মন কী বাত’ মিথ্যাঃ
ভারতীয় আর্মির সাবেক এক আর্টিলারি অফিসার প্রবীন সায়নি [Pravin Sawhney], এখনকার সময়ে তিনি একজন খুবই পরিচিত প্রতিরক্ষা বিষয়ক অ্যানালিস্ট, ‘ফোর্স’ নামে এক ভারতীয় প্রতিরক্ষাবিষয়ক মাসিক ম্যাগাজিনের সম্পাদক ও কিছু বই লেখক। এছাড়া এককালের জেন্স ইন্টারন্যাশনাল সাপ্তাহিক ডিফেন্স ম্যাগাজিনের দিল্লিস্থ দক্ষিণ এশিয়া সংবাদদাতা ছিলেন। চলতি এই সময়ে তাঁর প্রতি লোকজনের আগ্রহের মূল কারণ হল, তাঁর খাড়া কথা খাড়া বলতে পারা এবং “জাতীয় স্বার্থের নামে মিথ্যা অপেশাদারিত্বের আবেগ”-এর বাইরে চীন-ভারত সামরিক উত্তেজনাকর পরিস্থিতি মূল্যায়ন এক পদ্ধতি ধরে এগিয়ে চলা। তিনি নিয়মিত ওয়েবে প্রকাশিত ‘ওয়্যার’ (WIRE) পত্রিকায় আর্টিকেল লিখছেন। সেখানে তিনি প্রশ্ন তুলে লিখেছেন, লাদাখে চীন-ভারতের এলএসি (LAC, Line of Actual Control) নামের সীমানা ঠিক কোনটা? কারণ, এর সবচেয়ে পুরনো এলএসি টা হল ১৯৫৯-৬০ সালেরটা। এছাড়া পরে ১৯৯৩, ১৯৯৬, ২০০৫, ২০১২, ২০১৫ সালের বলে ইত্যাদি আরও অনেক আছে। প্রভীন বলছেন, চীন এবার সেই ১৯৫৯-৬০ সালেরটার ভিত্তিতেই সব এলাকা মাপছে আর ওই ম্যাপ অনুসারে এলাকা নিজের দখলে নিয়েছে। তবে এটাও অস্থায়ী সীমানা। আর অস্থায়ী সীমানা মানেই এলএসি।
এলএসি [LAC] শব্দের ‘এ’ হল, এটা ‘অ্যাকচুয়াল’ শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ, যার অর্থ ‘এখন যেভাবে যার দখলে’ আছে। সবচেয়ে বড় কথা, চীন ভারতকে এবার ১৯৫৯-৬০ সালের ভিত্তিকেই সীমানা মানতে চাপ দিয়ে আসছিল। আর মোদী চীনের সেই দাবি মেনে নিয়ে এখন বলছেন, আমাদের কোনো ভূখণ্ড কেউ নেয়নি। আমাদের এলএসি আমাদের ঠিকই আছে। কিন্তু সেটি কী করে সত্যি হয়? তাই প্রভীন সোয়ানি লিখছেন, “মোদী ভারতে একটা ধারণার আবহ তৈরি করে চলতি জটিলতা পার হয়ে যেতে চান। সে প্রসঙ্গে দুটো কথা হল, “১. এলএসি অমান্য করা যায় না। আর ২. ভারতের কোনো ভূখণ্ড চীনা সেনাদের কাছে ভারত হারায়নি”। কিন্তু এই বক্তব্যের মধ্যে এবার মোদীর কথায় ফাঁকির দিকটা উন্মোচন করছেন প্রবীন। বলছেন, “তাতে সেটা অবশ্য আরেক কথা যে, কে আর এরপরে জিজ্ঞাসা করতে আসছেযে , এই “লাইন” মানে এলএসির লাইন, এটা কোন সালেরটা? ১৯৯৩ সালের এলএসি লাইন নাকি ১৯৬০ সালের দাবি করা চীনের এলএসি লাইন?” – কোনটা? [It’s another matter that no one bothered to ask which ‘line’ he was referring to — the 1993 LAC, China’s 1960 claim line or the one that is going beyond that.] এই প্রশ্নটাকে উহ্য রেখেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদী তাঁর অভ্যন্তরীণ ভোটার বা শ্রোতাদের সাথে চাতুরীটা করেছেন। কারণ, তিনি আসলে এলএসির লাইন বলতে চীনের কাছে ১৯৬০ সালের হিসাবে গলওয়ান উপত্যকা ছেড়ে দিয়ে এসেছেন। কিন্তু ভাব ধরছেন যেন এটা ১৯৯৩ সালের এলএসির লাইন বুঝাচ্ছেন! অথচ কথাটা সত্যি না।
এভাবে আপাতত নিজের মুখ রক্ষা করেছেন। তাই তিনি গালওয়ান উপত্যকা ও টহল দেয়ার ভূখণ্ডপথ ছেড়ে চলে এসেছেন। কেবল মুখরক্ষার একটা কথা বলে বেড়াচ্ছেন যে, এটা ‘সাময়িক’, অস্থায়ী। তবে প্রভীন এমনকি আরো একটা মারাত্মক তথ্যের কথা বলছেন যে, মোদীর যে নিয়মিত মাসিক রেডিও অনুষ্ঠান ‘মন কী বাত’, সেখানেও গত ২৮ জুন মোদি দাবি করেছেন- ‘গালওয়ান যুদ্ধ জয় করা গেছে’, মুখের উপর উপযুক্ত জবাব দেয়া গেছে ইত্যাদি সেই ; “A befitting reply has been given to those who cast an evil eye on Indian territory in Ladakh. Our brave soldiers have shown that they will never allow the honour of mother India to be hurt,” । আর বেশির ভাগ মিডিয়াই সরকারের ‘এই লাইন’ তোতা পাখির মতো আউড়িয়ে যাচ্ছে।
গত ৬ জুলাই বেলা ১:২০টায় প্রবীন সায়নির টুইটারে আর বিকেলে ওয়্যার ওয়েব পত্রিকায় তার লেখা আর্টিকেলে তিনি পরিষ্কার করে এসব কথা লিখেছেন। মোদীর এসব চাপাবাজি কাণ্ড ফাঁস করে দিয়েছেন।
হতাশা বাড়ছেঃ
এতে আমরা না হয় সবাই সত্যটা জানলাম। কিন্তু এরপর কী? বলাই বাহুল্য, এরপরের ঘটনা হল – নিম্নচাপ বা ডিপ্রেশন। মানে প্রবল হতাশা নেমে আসা, আর তা এসেছে। এতে ভারতীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হতাশায় প্রভাবিত অংশ হল সাংবাদিক আর পড়ালেখা জানাদের মধ্যে যারা এই খবরাখবরগুলো রাখেন তারা।
আর সাধারণ মানুষের মধ্যে যে হতাশা তা কাটাতে অন্তত কিছু ক্ষোভ প্রকাশের একটা ব্যবস্থা করা হয়েছে। তা হল চীনের তৈরি প্রায় ৫৯টা মোবাইল ‘অ্যাপ’ বা অ্যাপ্লিকেশন ভারতের সরকার ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। আর এই নিষেধাজ্ঞা নিয়ে প্রপাগান্ডা হয়েছে এমন যেন, এই নিষেধাজ্ঞা দিয়েই চীনের ওপর কিছু ‘গোলাবর্ষণ করা গেছে’। যদিও এতে সবচেয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া এসেছে টিকটক অ্যাপ বন্ধ হওয়াতে। কারণ, এটা ব্যবহার করে ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপ বাসায় বসে তৈরি করা যেত, যা ফেসবুকে প্রকাশ করলে ওর বিজ্ঞাপনের আয় থেকে তরুণেরা হাতখরচের পয়সা জোগাড় করতে পারত। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় তারা বলতে চেয়েছে, দেশের যুদ্ধ বা স্বার্থ নিয়ে সরকারের যা মন চায় করুক তাদের কোনো আপত্তি নেই; কিন্তু তারা যা থেকে কিছু অর্থ আয় করত তার ওপর হাত দেয়া কেন? সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় তাদের স্বার্থের কথা কেউ আমলে নেয়নি কেন? এছাড়া মোদী নিজেই চীনা সোশাল মিডিয়া এপ উইবো ব্যবহার করতেন আর তা নিষেধাজ্ঞা জারির পরে ছেড়েছেন বলে এটা নিয়ে রিপোর্ট মানুষের ক্ষোভ প্রকাশের একটা উপায় হয়ে হাজির হয়েছিল। ওদিকে প্রাচীন দক্ষিণী ইংরাজি দৈনিক ‘দ্যা হিন্দু’ ” নিষিদ্ধ (ডিলিট) করেন না, নিয়ন্ত্রণ করেন” শিরোনামে সম্পাদকীয় লিখে মন্তব্য করেছে। সারকথায় বললে, মোদীর পারফরমেন্স প্রশংসিত হয় নাই বা আপ-টু-দা-মার্ক নয়।
কেন মোদী আজকের অবস্থায় পৌছালোঃ
এক কথায় বললে মোদীর এমন অবস্থায় পৌঁছানোর পেছনের মূল কারণ, এক ‘নেশন’ ধারণ। কিছু বাতিওল হয়ে পড়া ধারণা। যেমন, হিন্দু জাতিরাষ্ট্রের ধারণা, যা হিন্দুত্ববাদ বা উগ্র জাতিবাদ এর উতস। এছাড়া এর অনুরূপ কিছু অর্থনীতিগত ধারণা যেমন কথিত ‘স্বদেশি’ বা একালের শব্দ “আত্মনির্ভর” এসব ধারণাগুলো অবসলিট বা অচল ধারণা। উলটা ফল দিবে এমন ধারণা।
কিন্তু কেন মোদীর কাছে এগুলো জরুরি? তাঁর কাছে এটা শুধু জরুরিই নয়, এর ওপরই মোদীর রাজনীতি ও ক্ষমতা নির্ভরশীল করে সাজানো এবং সামগ্রিকভাবে নির্বাচনে ভোট জোগাড়, পোলারাইজেশন সব কিছু এমন জাতিবাদনির্ভর। এটাই তো হিন্দুত্ব। যেমন, কাশ্মিরের ৩৭০ ধারা বাতিল করে দিয়ে জবরদস্তি একে ‘ভারতের অংশ’ বলে দখল করে নেয়া – এর একদম রুট কারণ হল হিন্দুর নামে একজোটে ভোট নেয়া, হিন্দু পোলারাইজেশন, হিন্দুত্বের মহিমা বিক্রি করে ক্ষমতায় যাওয়া ইত্যাদি এগুলো সব করা যায় এতে আর তাতে সত্যমিথ্যা সবকিছুই বলা যায়। সে কারণে সংসদে অমিত শাহ দাবি করে বলে দিলেন যে, পাকিস্তান ও চীনের অংশের কাশ্মিরও ভারত দখল করবে। মোদী-অমিত তা করতে যান আর নাই যান বেপরোয়াভাবে তারা এটা বলে ফেলতে পারলেন।
আসলে কাশ্মির সমস্যার রূট বা সার কথা হল, এতে কাশ্মির কার অথবা এর সীমানা কার অংশ বা এটা স্বাধীন রাষ্ট্র কি না এসব অমীমাংসিত থেকে যাওয়া। কাশ্মির পুরা ব্রিটিশ আমলজুড়ে করদরাজ্য ছিল বলে কখনোই পড়শির সাথে এর কোনো সীমানাই চিহ্নিত করা হয়নি, পরস্পর বুঝে নেয়া, কমন ম্যাপ আঁকা হয় নাই। আর এ থেকে কাশ্মিরের ভারত-চীন-পাকিস্তান অংশ কখনোই এদের মধ্যেও পারস্পরিক স্বীকৃত সীমানা নয়। তাই এখন বলা হচ্ছে, এর বাউন্ডারি নেই। যার যা “দখলে” (অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোলে) আছে, এই হল সীমানার ভিত্তি। সেখান থেকেই তো LAC, Line of Actual Control ধরণের ধারণার উতপত্তি।
কিন্তু তবু আরেকটা ইতিবাচক বিরাট অর্জনও ছিল। ১৯৬০ সালের পর থেকে কাশ্মিরের সীমানা নিয়ে আর বড় বদবদল হয়নি। বিশেষ করে ২০১৯ সালের আগস্টে ভারতের সংসদে বসে ৩৭০ ধারা উঠিয়ে কাশ্মিরকে ভারতের অংশ বলে দাবি করার আগে পর্যন্ত।ীকারণে ৩৭০ ধারা উঠানো – এই পদক্ষেপ এটাই তাই বাকি দুই রাষ্ট্রের কাছে ছিল ভারতের সবচেয়ে আস্থাভঙ্গের মেসেজ; যে গত ৬০ বছরের যার যার দখলে থাকা সীমানায় বড় কোনো ভাঙচুর হয়নি, এটাই ৬০ বছরের এক ধরনের আস্থাটা ছিল যে তিন টুকরা হওয়ার পরেও কাশ্মির আর যেন ভাঙবে না। কিন্তু মোদী-অমিত যেমন হিন্দুর নামে ভোট পাওয়ার জন্য যা ইচ্ছা তাই বলা কোনো ব্যাপার নয়, ঠিক তেমনি পাকিস্তান ও চীনের থেকেও তাদের কাশ্মির অংশ ছিনিয়ে নিব অথবা একক-ইচ্ছায় যেকোন পদক্ষেপ নিতে পারে ভারত – এক কথাটাই অবলীলায় এটা বলে বসেন। চীন এ থেকে কী মেসেজ নেবে সেদিক সম্পর্কে তারা বেপরোয়া, এটাই মোদি-অমিত জানিয়ে দিয়েছিলেন। তাই ১৯৬০ সালের এলএসি ভুমি আবার ফিরে দাবি করে চীন যেন বুঝিয়ে দিল চীনও তাহলে ফিরে আবার যা খুশি অংশ দাবি করতেই পারে।
আমরা লক্ষ করলে দেখব, কোথাও কোন দেশে সরকার বদল হলে বিশেষত সামরিক আইনের সরকার বা বিপ্লবীদের ক্ষমতা দখলের ক্ষেত্রে দখলকারীরা ক্ষমতায় এসে প্রথমে যে ঘোষণাটা দেন তা হল, তার ক্ষমতাকে দেশের কোন আদালতে চ্যালেঞ্জ করা নিষিদ্ধ (এটা আগে করতেই হয়)। আর দ্বিতীয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা হল, তার রাষ্ট্র এর আগে অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে বিভিন্ন সময়ে যেসব চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল তার নতুন সরকার সেসব চুক্তি মেনে চলতে অঙ্গীকার করছে। এমন ঘোষণার মূল কারণ অন্য রাষ্ট্রের আস্থা অর্জন যে নতুন সরকার আইন-নিয়ম মানে। তাই আগে যা কিছু কৃত চুক্তি ও আস্থা স্থাপন হয়ে আছে সে সেটার ধারাবাহিকতা মেনে চলতে চায়।, তা মেনে চলার অঙ্গীকার করার মানে এ থেকে ইচ্ছা মত এবং একতরফা সরে আসা যায় না – এই আন্তর্জাতিক নীতির সাথে নতুন সরকার একমত। তাই কেউ যেন সন্দেহবশত বিরূপ আচরণ না করে। নতুন সরকার কোনো ঝামেলা চাচ্ছে না। কিন্তু এর মানে কী সে কিছুই বদলাতে পারবে না?
অবশ্যই পারবে। কিন্তু ধাপগুলো হল, প্রথমত পুরনো সব চুক্তি মানতেই হয়। আর এরপর উপযুক্ত আইন ও সম্পর্করক্ষার পদ্ধতি মেনে (খামখেয়ালি নয়, একপক্ষীয় নয়) নোটিশ দিয়ে উভয়পক্ষের আলোচনাকারীকে ডেকে বসার পর সেখানে প্রস্তাব করে অবশ্যই পুরনো যেকোনো চুক্তি রদ করা যাবে, ইচ্ছা করা যাবে। আন্তর্জাতিক আইনকানুন মেনেই তা করতে হবে। সোজা কথা ক্ষমতায় থাকাকালে খামখেয়ালি নয়, একপক্ষীয় নয় এমন কাজ করা নিষিদ্ধ যা থেকে প্রতিপক্ষ ভুল মেসেজ পাবে। কিন্তু ঠিক এই নাদানিটাই করেছিলেন মোদি-অমিত।
অথচ তাঁরা আচরণ করেছে ঠিক যেমন মোদী-অমিতের ইচ্ছা হল তো তাদের জন্য কোন মুসলমান নাগরিককে ‘জয়শ্রীরাম বলতে বাধ্য করানো’ এটা কোন ব্যাপারই নয়। ্স্বভাবতই, ঐ নাগরিক তা করতে কথা শুনতে রাজি হবে না। এরপর তখন তাকে মাটিতে শুইয়ে ফেলে সেই শরীরের ওপর লাফ দিয়ে ওর বুকের ওপর চড়ে বসা, বুকের হাড়গোড় ভেঙে দেয়া – এগুলো কোনো ব্যাপারই নয় যেন। কোন আদালত, কোন পুলিশ কোথাও এর কোন রেকর্ড হবে না। তারা যা ইচ্ছা তাই করতে পারবেন। কোথাও কিচ্ছু হবে না। ক্ষমতাকে তারা এতই সহজ হাতের মোয়া মনে করেন। তাই মোদী-অমিত বলে দিয়েছিলেন, তেমনি সহজ করেই অবলীলায় বলে দিয়েছিলেন যে চীন ও পাকিস্তানের কাশ্মির অংশও তারা দখল করবেনই। তাতে এটা যে তাদের কথার কথা; আর পাঁচটা কথার মতোই চাপাবাজি তা তো চীন মানেনি, এ দিকটাও তারা আমল করেননি। রাষ্ট্র বা ক্ষমতা খুবই হালকা জিনিস, তাদের কাছে মুসলমানকে জবরদস্তিতে “জয়শ্রীরাম বলানোর” মতই সহজ!
কিন্তু মোদী কী এখন বুঝেছেন কেন চীন আজ হঠাৎ বা কোন ইচ্ছায় ১৯৬০ সালের এলএসি, সেটাই মানতে বাধ্য করাচ্ছে আর কোন খেয়ালে? তার চেয়েও বড় কথা, মোদি এখন কাকে জিজ্ঞাসা করবেন চীন কেন খামখেয়ালি আচরণ করছে? আসলে মানতেই হচ্ছে এটাই মোদীর প্রাপ্য ছিল। কারণ, মোদি কি নিজ দেশের কনস্টিটিউশন অথবা আন্তর্জাতিক আইন বা রীতি রেওয়াজ মেনে চলতে অভ্যস্ত রাজনৈতিক নেতা? মোদি বা তার দল কি এটা দাবি করতে পারবেন? দুনিয়াটা ‘হিন্দুত্ব’ দিয়ে, কিংবা খামখেয়ালি দিয়ে চলে; এটাই ভেবেছিলেন মোদী!
তবু সেই হিন্দুত্ব এখনো বর্তমান এবং মোদী-অমিতের একমাত্র আশ্রয়। তাই হতাশ ভারত, হতাশ রাজনৈতিক নেতারা এখন আরো ভয়ঙ্কর হতে চাইবে। নিজের হতাশায় তারা আরও ডুবে যাবার মত পদক্ষেপ নিয়ে বসতে পারে। তবু আগামী বছরের এপ্রিলের আগে সম্ভবত ভারতের কোনো রাজ্য নির্বাচন হচ্ছে না, কোভিড পরিস্থিতিও এর আরেক কারণ। এটাই হয়ত সাময়িক একটু স্বস্তি। না হলে জনগোষ্ঠীগত হতাশা আরো বাড়িয়ে মোদির তাণ্ডব ভোটের বাজার কাঁপাত।
না, তবু এত ভরসা করার কিছু নেই। কেন?
কারণ, ইতোমধ্যে আরেক ভীষণ আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত- এই নেশন স্টেট বা জাতিবাদীরা নিয়ে বসে আছেন। উপরে টিকটক এপ বন্ধ করে দেয়াতে তাদের কথিত গর্বের কথা বলছি। মোদির আরেক হামবড়া ভুয়া গর্বের সিদ্ধান্তের কথা জানা যাচ্ছে। তা হল, নানা দেশের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আঞ্চলিক বা বাণিজ্যিক জোট হতে দেখা যায়।
কিন্তু মোদী সম্প্রতি তাঁর নেয়া এমনই এক সিদ্ধান্তের কথা জানাচ্ছেন যে, কোনো বাণিজ্যিক জোট যেখানে চীন সদস্যরাষ্ট্র হয়ে আছে এমন হলে ভারত ওই জোটে আর সদস্য হবে না। অথচ এই সিদ্ধান্তটাই প্রমাণ করে, এটা আগা-পাশতলা না ভেবে নেয়া জিদের সিদ্ধান্ত। যেমন কেউ কম্বলের লোম বাছবার আর তা বেছে তুলে ফেলে দিয়ে এরপর তা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিতে যায় না, এটা তেমনি অবিবেচক সিদ্ধান্ত। মোদীর এই সিদ্ধান্তের অর্থ কি তাহলে – ব্রিকস [BRICS] ব্যাংক উদ্যোগ, এআইআইবি [AIIB] ব্যাংক অথবা সাংহাই করপোরেশন অর্গানাইজেশন [SCO] ইত্যাদি সব সাংগঠনিক উদ্যোগ থেকে ভারত এখন বের হয়ে আসবে? যদিও ভারত এখনো কোথাও তা পরিষ্কার করে বলেনি। এ ছাড়া ভারতের অবকাঠামো খাতে যত বিদেশী ঋণ নেয়া আছে, এর বেশির ভাগ হল চীনা ঋণ। এগুলোর কী হবে? নিশ্চয় ভারত কোনো অর্থপূর্ণ সিদ্ধান্তই নিতে চাচ্ছে আমরা ধরে নিতে পারি। মানে বলতে চাচ্ছি – ঝোল খাবো, কিন্তু গোশত খাবো না – ধরনের হাস্যকর বা নামকাওয়াস্তে কোনো সিদ্ধান্ত নিশ্চয় হবে না! এছাড়া আরও আছে। চীনা পণ্য ভারতে আমদানি বছরে প্রায় পঞ্চাশ বিলিয়ন, আর চীনে রফতানি প্রায় ১৫ বিলিয়ন। এগুলোতেও যদি মোদীর কথা মেনে চলা হয় তবে দু’পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা বলাই বাহুল্য।
কিন্তু চীনা সস্তা পণ্যের উপর, গড়ে প্রায় ৪০ ভাগের মতো কাঁচামাল বা তৈরি পণ্যে ভারতের নির্ভরশীলতা তাতে খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভারত। ব্যাপারটা মেনে চলা একেবারেই সহজ হবে না। মূলত এ ব্যাপারে ‘নেশন’ বা জাতিরাষ্ট্রবাদীদের ধারণাটাই গড়বড়ে; তা একেবারেই প্র্যাকটিক্যাল নয়, বরং ফ্যান্টাসিতে ভরা। এর বিকল্প মোদীর হিন্দুত্ববাদী আরেক অচল স্লোগান হলো ‘আত্মনির্ভরশীলতা’। এটাও একটা ফ্যান্টাসি, অবিবেচক ও হুদাই গা-গরম করা ধারণা। কারণ, আপনি সারা দিন যা ভোগ করেন তার সবই নিজেই উৎপাদন করে নেয়া হতে হবে এমন জিদ ধরতে পারেন না। কারণ এই স্লোগান খুবই অ্যাবসার্ড, বাস্তবায়ন অযোগ্য আর ফ্যান্টাসিতে ভরপুর, অবিবেচক ধারণা। এর চেয়ে বরং আরো বেশি করে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও পণ্য বিনিময়ের সম্পর্ক- এমন পারস্পরিক নির্ভরশীলতাই উত্তম সমাধান, যাতে কেউ খেয়ালে যা ইচ্ছা করে তাই সিদ্ধান্ত না নিতে পারে। “স্বদেশী পণ্যের” ধারণা আজীবনই অকার্যকর ও অপরীক্ষিত ধারণা ছিল।
সেকালের বৃটিশ আমলে খুবই অবিকশিত বিনিময় লেনদেন ব্যবস্থা থাকায় ছিল বলে সাময়িক কিছু ফল দেখা দিয়েছিল। কিন্তু একালে এটা একেবারেই অসম্ভব, অচল। ‘কোল্ড ওয়ার’ আমলে আমেরিকা-সোভিয়েত এভাবে দুই ব্লক রাজনীতি চলতে পেরেছিল। এর মূল কারণ এ দুই ব্লকের দেশের মধ্যে কোন কমন লেনদেন-বিনিময় বাণিজ্য শুরু থেকেই চালু ছিল না। অর্থাৎ শুরুরও আগে থেকেই কোনো নির্ভরশীলতাই ছিল না বলেই এটা ৪০ বছর চলতে পেরেছিল। যেমন খুব কম লোকই খেয়াল করেছেন যে, একালে পুতিনের রাশিয়া আর সোভিয়েত ইউনিয়নের মতন একেবারেই নয়। সেটা এ জন্য নয় যে, রাশিয়া ‘পুঁজিবাদী কী পুঁজিবাদী নয়’। বরং এই পুজিবাদী কিনা এগুলো নিজেই খুবই অবুঝের প্রশ্ন। বিষয়টা হলো রাশিয়া কী গ্লোবাল লেনদেন-বিনিময় বাণিজ্য ব্যবস্থা (যেটা সোভিয়েত ব্লকের দেসাহগুলোকে বাইরে রেখেই দাঁড়িয়ে গেছিল এখনকার রাশিয়া এখন এর কোন সদস্যরাষ্ট্র হয়ে যেতে পেরেছে না বাইরেই আছে – এই হলো মুখ্য প্রশ্ন। রাশিয়া, সোভিয়েত ভেঙ্গে যাবার পরের রাশিয়া এখন গ্লোবাল বিনিময় লেনদেন চলে এমন ব্যবস্থার ভেতরের রাষ্ট্র। যদিও তা হওয়া সত্ত্বেও অনেক পরে আবার আমেরিকা রাশিয়ার ওপর অবরোধ আরোপ করে রেখেছে, ফলে রাশিয়া ডলারে কেনাবেচা করতে পারে না। এটুকুই বাধা আছে।
কিন্তু তবুও ওদিকে সারা ইউরোপে রাশিয়ার গ্যাস বেচে চলেছে। এতে ব্রিটিশ সম্পদ, শেয়ার বা নানান তৈরি পণ্য কিনে মালিক হচ্ছে পুতিনের রাশিয়া। এতে রাশিয়া যতটুকু অন্য রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল হতে পেরেছে, বিকশিত করতে পেরেছে ততই রাশিয়ানদের জীবনযাপন সহজ হয়েছে, হওয়ারই কথা। কারণ, সোজা ফর্মুলাটা হলো যত “পারস্পরিক নির্ভরশীলতা” [inter-dependent] ততই জীবন সহজ। ততই আপনার শ্রম দক্ষ, ততই বেশি উতপাদন, বেশি ভোগ। যদিও আবার এটাও ভোলা যাবে না যে, ইউরোপে বেচতে পারে, বাজার চাহিদা আছে বলেই সাইবেরিয়ার গ্যাসের মূল্য আছে। চাহিদা ইউরোপে আছে বলেই গ্যাস বেচা যায় বা বেচে অর্থ পাওয়া যায়। এছাড়া আবার আপনাকে গ্লোবাল বাজার-বিনিময় ব্যবস্থার বাইরে বের করে দেয়নি বলেই এখনো গ্যাস বেচতে পারেন।
নইলে একেবারেই একঘরে হয়ে কোনায় পড়ে থাকতেন। স্বদেশিয়ানা বা ‘আত্মম্ভরিতার’ নামে নিজে নিজেই একঘরে হয়ে থাকা খুবই আদর্শ বলে মনে হলেও পুতিনের রাশিয়া বা একালের ইরান নিশ্চয় খুশিও হত! তা তো নয়। বাণিজ্যবিনিময় ব্যবস্থার এই গ্লোবাল দিকটা ব্যবহারিক কমিউনিস্টরা কখনো বুঝতে পারেনি। বরং এদের না বোঝাটাই গান্ধীর স্বদেশিয়ানা বা বিজেপি-আরএসএসের স্বয়ংসম্পূর্ণতার মিথ্যা ধারণাটাকে অপরীক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও টিকে থাকতে সাহায্য করে চলেছে। হিন্দু হলেই কেউ হিন্দুত্ব কিংবা ‘আত্মম্ভরিতা’ বা আত্মনির্ভরশীলতা বুঝি বলে দাবি করতে পারে সহজেই। কিন্তু তাতে গ্লোবাল বিনিময়ব্যবস্থা বোঝা আর হয় না! ভারতের অন্তত দুটা প্রফেশনাল ব্যক্তিত্ব মোদীকে চীনের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক ত্যাগ আর আত্মনির্ভরতার নামে গ্লোবাল বাণিজ্যবিনিময় ব্যবস্থা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে মোদীকে সাবধান করেছেন। এদের একজন ভারতের পরিকল্পনা কমিশনের প্রাক্তন ভাইসচেয়ারম্যান অরবিন্দ পানাগোরিয়া। তিনি সুনির্দিষ্ট করে চীনের সাথে কোন বাণিজ্যযুদ্ধের শুরু করার বিপদ থেকে সাবধান করে দিয়েছেন। এনিয়ে তাঁর সাক্ষাতকার এখানে পড়া যেতে পারে। আর দ্বিতীয়জন অর্থনীতিবিদ স্বামীনাথন আয়ার। তিনি ভারতের ইকনমিক টাইমসেরও পরামর্শদাতা সম্পাদক। তিনি অনেক আগে থেকেই বলছেন নেহেরুর ভুল দ্বিতীয়বার যেন মোদী আবার না করে বসেন। তিনিই পরিস্কার করে বলছেন, অথাকথিত আত্মনির্ভরতা ভুল, এর বদলে পরস্পরের উপর পরস্পরের নির্ভরশীলতা এটা সঠিক পথ [This means no self-sufficiency, it means interdependence]। তাঁর বক্তব্য পাওয়া যাবে এখানে।
জয়শঙ্কর নয়, দোভাল – এর তাতপর্য কীঃ
গত ১৫ জুন অন্তত ২০ ভারতীয় সেনা চীনের হাতে মারা যাবার পর থেকে চীন-ভারত পরস্পর ভাল-মন্দ বা কূট কথা চালাচালি করে আসছিল দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে। ভারতের জয়শঙ্করকে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ঈ-এর সাথে তিতা বড়ির শর্ত মেনেই কথা চালিয়ে যেতে হচ্ছিল। কিন্তু ৬ জুলাইয়ের ডিসএনগেজমেন্টের আপোষ রফায় দেখা গেল এবার এই রফা করা হয়েছে ভারতের নতুন মুখ অজিত দোভালের মাধ্যমে, জয়শঙ্কর নাই। আগের লেখায় বলেছিলাম জয়শঙ্কর হল মোদীর আমেরিকার পকেটে পৌছানোর হাতিয়ার। তাই অনেকের মতে, জয়শঙ্কর আমেরিকান লো্ক, তারা এভাবে বলেন। এর মানে দাঁড়ালো মোদী গলওয়ান উপত্যকা চীনকে ছেড়ে দেওয়ার রফা টা করলেন অজিত দোভালের মাধ্যমে। অর্থাৎ মোদী এই জায়গায় এসে আমেরিকাকেই এড়ালেন! এন্টি-আমেরিকান প্রাক্তন কূটনীতিক ভদ্রকুমারের মতে, দোভালই এখানে সঠিক লোক। ভদ্রকুমারও আস্থা রাখেন দোভালের উপর, কারণ তাঁর যুক্তি, দোভাল জাতিবাদি আবেগী নন, দেশের প্রাকটিক্যাল স্বার্থ ব্যাপারটা মাঠের চোখে বুঝেন। কিন্তু ভদ্রকুমার একটা কড়া কথা লিখেছেন, এই আপোষনামার ব্যাখ্যা কী হবে তা ঠিক করে দিবার চেষ্টা করছে আমেরিকান লবিস্টরা [ US lobbyists set the Indian narrative on China border]।
যা হোক, চীনের সাথে ভারতের বাণিজ্য-সম্পর্কহীনতাবিষয়ক চিন্তা, এককথায় অবিবেচক ও অভিমানঘটিত চিন্তার অধিক কিছু নয়। ফলে এটা অবাস্তব, আর ভারতীয়দের জীবনযাপনকে আরো কষ্ট করে তোলার এক চিন্তার নামান্তর। তবে এটা এড়ানোর একটা সহজ পথ আছে। যেমন, মোদী বলেছেন বলেই তিনি তা আসলে বাস্তবায়ন করবেনই তা তো বলেননি, এমন মানে করে বসতে পারে্ন তিনি। ব্যাপারটা কেবল প্রপাগান্ডা বা ক্যাম্পেইন হিসেবে থেকে গেলেই, মোদী এভাবেই তাঁর সব দিক সামলানো সহজ করে ফেলতে পারেন! কে বলতে পারে যে, এটা এমনই হবে না?
তাই সারকথা, কাজে লাগাতে জানলে ভারতের কাছে চীন অ্যাসেট হবে, না হলে দায়; কিন্তু কী হবে মোদীই জানে!
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
[এই লেখাটা গত ১১ জুলাই ২০২০, দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ওয়েবে ও পরদিনই প্রিন্টেও “কাজে লাগাতে জানলে সম্পর্ক অ্যাসেট, না হলে দায়“– এই শিরোনামে উপ-সম্পাদকীয়তে ছাপা হয়েছিল। পরবর্তিতে সে লেখাটাই এখানে আরও নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে এখানে আজ ছাপা হল। ]