চীন-ইরান প্যাক্ট থেকে গ্লোবাল পালাবদল শুরু হবে


চীন-ইরান প্যাক্ট থেকে গ্লোবাল পালাবদল শুরু হবে

গৌতম দাস

২০ জুলাই ২০২০, ০০:০৬ সোমবার

https://wp.me/p1sCvy-36q

 

https://www.dailymail.co.uk/news/article-3413556/

চীন-ইরান এলায়েন্স থেকে গ্লোবাল পালাবদলের শুরু হবে,
আর ইউরোপের চীনের দিকে ঝুঁকবার সম্ভাবনা বেড়ে গেলঃ

বিশ্ব-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যাকে আমরা অনেকে “গ্লোবাল অর্ডার” বলে বুঝে থাকি, এর আসন্ন পালাবদলে [Global Economic Order] নির্ধারক এক ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। চীন ও ইরান এক দীর্ঘমেয়াদি এবং ইরানের অর্থনীতি ও সামরিক উন্নতিকে ফোকাস করে এক স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ চুক্তি করতে যাচ্ছে। এটা হবে দীর্ঘস্থায়ী  ও স্ট্র্যাটেজিক সাথে বাণিজ্যিকভাবেও এদুই দেশের গভীর সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়া। অবস্থা এমন হয়ে যাবে যাতে ইরানের গায়ে কেউ ফুলের টোকা দিলেও সেটা চীনের গায়ে প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে, চীনের স্বার্থের উপর এর প্রভাব থাকবে, এমন অবস্থা হয়ে যাবে। অর্থাৎ এদুই দেশ স্বার্থের প্রশ্নে তারা বহুদূর কমন স্বার্থ হয়ে হাঁটবে। তাতে এ নিয়ে তাদের মধ্যে আলাদা করে কোনো ‘প্রতিরক্ষা চুক্তি’ স্বাক্ষরিত থাকুক আর নাই থাকুক।

এনিয়ে মিডিয়ায় দুনিয়াজুড়ে  মন্তব্যের ঢল বইছে। মন্তব্যগুলো মূলত আমেরিকা ও ভারতের ব্যর্থতা বা অকর্মন্নতার  দিকে আঙুল তুলছে আর বলছে এরা দুই হল হারু পার্টি – They are the losers। যদিও লুজার শব্দটা কারোরই শুনতে ভাল লাগে না। তবু তেমনটাই কয়েকটা পত্রিকা লিখছে – ১।  ট্রাম্পের মহাকাব্যিক পরাজয় । ২। এই পার্টনারশিপ আমেরিকার জন্য ভয় পাইয়ে দিবার মত ওয়ার্নিং দিচ্ছে। ৩। এই প্যাক্ট এশিয়া্র সাথে আমেরিকার ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত করে। আবার বোকা গাড়োলের মত এক মন্তব্যও আছে আর এটা সম্ভবত এই প্যাক্ট নিয়ে আমেরিকার প্রথম সরকারি মন্তব্য। বর্তমানে ইরানের উপর অস্ত্র-ক্রয় বিষয়ে জাতিসংঘের এক নিষেধাজ্ঞা দেয়া আছে যেটা আগামি তিন মাস পরে অক্টোবরে শেষ হয়ে যাবে। সেদিকে তাকিয়ে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের (বিদেশমন্ত্রী) মাইক পম্পেও বোকার মন্তব্য করেছেন – “এই প্যাক্টই বলে দিচ্ছে আমাদেরকে আবার একটা শক্ত নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হবে“। ঘটনা হল, জাতিসংঘের কাঠামোতে ভেটো ক্ষমতাওয়ালা যেকোন একরাষ্ট্র  না-ভোট দিয়ে দিলে এরপরে ঐবিষয়ে আর কোন সিদ্ধান্ত হবার সুযোগই নাই। চীন ইতোমধ্যেই সে ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছে। এখন এখানে ভেটো ক্ষমতাধর চীন থাকার পরেও এতে পম্পেও-এর এমন আওয়াজ ছাড়ার কোন অর্থ আছে?
আচ্ছা, আপাতত আর এদিকে আগে না গিয়ে, প্যাক্ট বা চুক্তিপত্রের ভিতরে প্রেবেশ করি।

চুক্তির খসড়া দলিল তৈরির কাজ শেষ। তবে এখানে খসড়া কথার মানে হল, এর  অনুমোদনের অংশ বাকি বা প্রক্রিয়াধীন যা দুদেশের পার্লামেন্টে আলোচনা ও পাস হওয়া এরপর রাষ্ট্রপ্রধানদের  অনুমোদনের ধাপ আছে তা সমাপ্ত করার প্রক্রিয়া অচিরেই শুরু হবে বা কিছু শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু এরই ফাঁকে প্যাক্টটাকে আমেরিকার দিক থেকে দেখলে, তাদের এক সফল গোয়েন্দাগিরি সম্পন্ন হয়েছে, বলতে হয়। আর চীন-ইরানের দিক থেকে দেখলে কোনো বিশ্বাসঘাতক, হলুদ কাগজের ১৮ পৃষ্ঠার এই খসড়া দলিলটা্র কপি চুরি করেছে আর পরে নিউ ইয়র্ক টাইমস সেটা হাতে পেয়ে ছেপে দিয়েছে। পত্রিকাটার দিক থেকে দেখলে, হাতে পেলে তো তারা ছাপবেই। যদিও চুরি করে পাওয়া একটা দলিল ছাপানোতে, এতে  গোপন রহস্য ধরনের ভাব তৈরি হয়েছে যেনবা চীন-ইরান কোনো অপরাধ করছিল যা (নিউ ইয়র্ক) টাইমস প্রকাশ করে দিয়েছে, এই ভাবের। না, কোনোভাবেই এটা তেমন কিছুই নয়। কোনো ধরনের অপরাধ তো নয়ই। ট্রাম্পের আমেরিকা এপর্যন্ত  ইরানের উপর দীর্ঘদিন ধরে  যেসব সীমাহীন অবরোধ চাপিয়ে রেখেছে তাতে ইরান একেবারেই কোণঠাসা, অর্থনীতি ধুঁকছে, এই করোনাকালে ইরানিদের জীবন থমকে গেছে যেখানে। তবে ট্রাম্পের এসব অবরোধ আরোপের নেতি উদ্দেশ্য আর এতে কৃত আসল অপরাধ হল ইরানের বিরুদ্ধে ইসরাইলের হয়ে ভাড়া খাটা আর শত্রুতামূলক কাজ করা। যদিও এই অবরোধ জাতিসঙ্ঘের নয়, কেবল আমেরিকার আরোপিত বলে তা মানতে কোনো দেশের উপর কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু টেকনিক্যালি আমেরিকা আমাদেরকে বাধ্য করতে পারে এসুযোগ আমেরিকার হাতে আছে।

তবে অবশ্যই, আমেরিকার অবরোধ আরোপ মানে আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে ডলারের অপব্যবহার করা হচ্ছে এখানে। মূলত “আমেরিকান অবরোধ আরোপ” কথার প্রাকটিক্যাল মানে হল, আমেরিকার ইরানকে নিষেধ করে দেয়া যে তুমি আমেরিকান ডলারে কোন আন্তর্জাতিক কেনাবেচা করতে পারবে না। কারণ দুই দেশ ডলারে কোন বেচাকেনা করলে “আমেরিকান কোন ব্যাংকের” কাছে যাওয়া ছাড়া এই লেনদেনের একাউন্ট ট্রান্সফার সম্পন্ন হবে না।   অতএব এর প্রতিকারের ব্যাপারটা এখন গায়ের জোর। এই অবস্থায় গায়ের জোরের মুরোদে কুলালে সবার আগে ঐ আমেরিকান অবরোধ উপড়ে ফেলে দেয়াটাই হবে খুবই জায়েজ কাজ।  সেটা কেমন, সেদিকে যাব।

চুক্তিটা ঠিক কী নিয়েঃ
সামগ্রিকভাবে উপর থেকে দেখলে, ইরানের এটা চীন থেকে পুঁজি আর টেকনোলজি ধার নিয়ে নিজের অবকাঠামো, শিল্প আর সাথে সামরিক ব্যবস্থাদিতেও সহযোগিতা নিয়ে সেসব গড়ে নেয়া। (নিউইয়র্ক)  টাইমসের ভাষায়, ইরান ব্যাংকিং, টেলিকম, বন্দর, রেলওয়েসহ আরো ডজনখানেক প্রকল্প হাতে নিবে; এছাড়া সামরিক সহযোগিতা, গবেষণা, ট্রেনিংসহ এসব বিষয় দেয়ানেয়া করবে। এভাবে ইরান নিজেকে সবল বাণিজ্যিক পার্টনার হিসাবে গড়ে তুলবে। আর নেয়া ঐ ঋণ শোধ দিতে চীনকে ইরানের তেল-গ্যাস সরবরাহ করবে। ফলে মোট ২৫ বছর এনার্জি দিয়ে বিনিময়ে ৪০০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ ও টেক পাওয়ার চুক্তি এটা।  টাইমসের ভাষায়, এজন্য এটা এক ‘বিনিয়োগ ও নিরাপত্তার’ প্যাক্ট [Economic and Security Partnership]। একটা তুলনা দিয়ে বলা যাক এটা কত বড় অঙ্কের অর্থ। বিশ্বব্যাংক  সবখাতক রাষ্ট্রের জন্য অবকাঠামো খাতে স্বল্প সুদে ঋণ দেয়ার মোট বাজেট হল বছরে ৫০-৬০ বিলিয়ন। আর তুলনায় ইরানের এই ঋণ হল গড়ে একাই কেবল নিজ-রাষ্ট্রের জন্য প্রতি বছরে ১৬ বিলিয়ন ডলার করে, এবং তা ধারাবাহিক ২৫ বছর।

ইরানের কাছে এই ঋণের গুরুত্ব কীঃ
কম করে বললে সেই ১৯৫৩ সাল থেকে ইরান ধুঁকে মরছে, লড়ছেও। আমেরিকা যখন ফিজিক্যালি সিআইএ এজেন্ট পাঠিয়ে (যেটা একালে (2013) আমেরিকান সরকারের স্বীকার করার কারণে প্রতিষ্ঠিত সত্য) ইরানের নির্বাচিত মোসাদ্দেক সরকারকে ফেলে দিয়ে শাহকে ক্ষমতায় বসিয়ে চার দেশ মিলে ইরানের তেল লুট করে নেয়ার চুক্তিটা করে নিয়েছিল, সেই থেকে। এর চেয়ে প্রকাশ্যে সম্পদ লুণ্ঠনের ঘটনা আর কী হতে পারে! এর প্রতিক্রিয়ায় ১৯৭৯ সালের খোমেনির বিপ্লব সফল হয়েছিল। এক সবল পালটা থাপ্পর।  আর তাতে লুটেরাদের হাত থেকে ইরান নিজের সার্বভৌমত্ব সামলে ছিল কিন্তু সেটাকে সংহত সুরক্ষিত করতে গিয়ে ইরানিদের অর্থনৈতিক জীবনটা আর কখনো স্থায়িত্ব দেয়া, একটু থিতু হওয়া আর কখনই সম্ভব করতে পারে নাই। প্রধান সঙ্কট থেকে গেছে, প্রয়োজনীয় পুঁজি-বিনিয়োগে ঘাটতি ও টেকনোলজি পাওয়া আর ওদিকে নিজের এনার্জি পণ্য, অবরোধের কারণে বিক্রি করতে না-পারা, সবসময় এগুলোই তাদের বেঁধে রেখেছে। এই যে চার দিকে নেই নেই অথচ দেশের প্রয়োজনীয় সম্পদ আছে গরিব দেশ নয় – এঅবস্থা থেকে ইরান সম্ভবত এবার মুক্তি পেতে যাচ্ছে। এই প্রথম ইরানের বিনিয়োগে খরা কাটতে যাচ্ছে। ইরানের শিক্ষিত বা সক্ষম মানুষেরা কাজ পায় না বেকার, সে দুঃখ সম্ভবত  ঘুচবে এবার।

উপচে ওঠা প্রভাবঃ
হবু এই চুক্তি নিঃসন্দেহে ইরানের নিজস্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নতি আনবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবু সাধারণভাবে দেখলে মনে হবে এটা আর পাঁচটা দেশের বড় অবকাঠামো বিনিয়োগের মতই কিছু ঘটনা হয়ত। কিন্ত তাই কী? আর এতটুকুতেই কি সীমাবদ্ধ থাকবে? অবশ্যই না। কারণ, এতে বেশ কিছু প্রভাব তৈরি হবে তা অন্যান্য প্রভাবের উপর পড়বে আর তাতে প্রভাবগুলোর মোট যোগফল বা কিউমিউলেটিভ ফলাফল পরিণতি হবে গভীর। আর এটাই “গ্লোবাল অর্ডারে” বড় ধরনের পালাবদল ঘটিয়ে ফেলবে। সব গ্লোবাল উত্তেজনা তাই এখানেই। খুব সম্ভবত আগামী ইতিহাসে, কোন কোন ঘটনা থেকে পালাবদলে গ্লোবাল অর্ডারের নেতৃত্ব পুরানা স্থিতি ছেড়ে চীনের হাতে চলে এসেছিল – এর অন্যতম হিসেবে চীন-ইরানের এই হবু চুক্তির কথা লেখা হবে। এই চুক্তি এমনই বড় প্রভাবশালী হয়ে উঠতে যাচ্ছে এবং হওয়ার মতই প্রবল পটেনশিয়াল।

যেমন একটা পটেনশিয়ালিটি বা সম্ভাব্য আড়ালে থাকা ক্ষমতার কথা বলি। এক কথায় বললে, আমেরিকার ইচ্ছামতো যাকে খুশি যেকোনো দেশের উপর “অবরোধ আরোপ করে” তাকে ডলারে কেনাবেচার সুবিধা থেকে বঞ্চিত করতে পারে। এর টেকনিক্যাল সুযোগ সে পড়ে পাওয়া চার আনার মত পেয়েছে ও নিয়েছে। ১৯৪৪ সালে আইএমএফের জন্মের সময় এর সদস্যরা একমত হওয়াতে একমাত্র আমেরিকান ডলারকেই (এবং এটাই তখন সব শর্তপুরণ করতে পারে এমন একমাত্র যোগ্য মুদ্রা ছিল) আন্তর্জাতিক বিনিময় মুদ্রা হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। কারণ মুদ্রার বাস্তব অসুবিধা হল, কোন না কো রাষ্ট্রীয় মুদ্রাকেই একই সাথে তাকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা বলেও গ্রহণ করতেই হয়। কোন রাষ্ট্রীয় মুদ্রার বড় ইতিগুণ হল, এটাই একমাত্র বাস্তব কার্যকর ও ব্যবহারিক মুদ্রা। ফলে যা লোকাল একটা দেশের মুদ্রা যে মুদ্রার নিয়ন্ত্রণ ওই দেশের হাতে তাকেই উপায়হীন হয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা বলেও গ্রহণ করতেই হয়েছিল। এটাই মুদ্রার গুণ-বৈশিষ্ট্যের ব্যবহারিক সীমাবদ্ধতা। মুদ্রার এই সীমাবদ্ধতা কাটানোর কোনো সমাধান এখনো দুনিয়াতে নাই।
তাই  আইএমএফ-স্বীকৃত আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে যদিও ডলারে কেনাবেচা করতে ইরানকে কেউ বাধা দিতে পারে না। কারণ ইরানও আইএমএফের সক্রিয় সদস্য। কিন্তু আমেরিকা এর বিপরীতে বলবে সে নিজের রাষ্ট্রীয় মুদ্রা হিসেবে যে ডলার সেই ডলারে বেচাকেনা করতে ইরানকে বাধা দিতেই পারে। এই এক্তিয়ার তার আছে। সোজা কথা, মুদ্রার গুণগত সীমাবদ্ধতাকে কাজে লাগিয়ে আমেরিকা বাড়তি এই ক্ষমতাটা অপব্যবহার করে থাকে। আমেরিকার এই অপব্যবহার এতই মারাত্মক যে গত ২০০৮ সাল থেকে বারো বছর ধরে রাশিয়াকে সে আজও ডলার-অবরোধ দিয়ে রেখেছে। পরিণতিতে রাশিয়ান মুদ্রা রুবলের মূল্য অর্ধেক হয়ে আছে।
শেষে প্রায় ইরানের মতনই রাশিয়াও সেকালে চীনের সাথে এক এনার্জি চুক্তি করে এর বিনিময়ে নিজ অর্থনীতি সামলিয়েছে। অবশ্য এছাড়াও ওদিকে ব্রিটেন রাশিয়ান গ্যাস ব্যবহার করে আর সেই গ্যাসের মূল্য থেকে পাওয়া আয় রাশিয়া আবার ব্রিটিশ বাজারে বিনিয়োগ করে রেখেছে বলে ব্রিটেনের বিশেষ অনুরোধে আমেরিকা কেবল এই অর্থটা অবরোধ আরোপের বাইরে ছাড় দিয়ে রেখেছে। তবে মূলত চীনের সাথে লেনদেনের ভরসায় রাশিয়া বাজারে টিকে আছে। মনে রাখতে হবে, অবরোধের আরেক ব্যবহারিক মানে হল গ্রামে কাউকে যদি একঘরে করে রাখা হয় – এর প্রভাব একটা রাষ্ট্রের উপর তেমনই। সেটা যাই হোক, এটাই আবার চীন-রাশিয়ার বর্তমান বিশেষ সম্পর্ক ও  এলায়েন্সের আসল ভিত্তি। তাদের আমেরিকাবিরোধী অবস্থানের গোড়ার কথা এটা। যদিও কেউ কেউ এখনো ভুল করে ‘কমিউনিস্ট ইডিওলজি’ এদের সম্পর্কের ভিত্তি মনে করে; যা একেবারেই ভিত্তিহীন। আর ইডিওলজির সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে আজকে নয় সেই ১৯৫৮ সাল থেকেই তা ভেঙে চুকেবুকে গেছে। বরং আমেরিকার ডলার-অবরোধের ক্ষমতা ভাঙতে চীনের মিত্র হিসাবে সবচেয়ে আগ্রহী শক্তি রাশিয়ার পুতিন। অতিরিক্ত ছটফটে পুতিন পারলে এখনই কিছু করে এমন যেকোনো কিছু করতে রাজি। তবে এ নিয়ে চীনের সাথে রাশিয়ার লম্বা যৌথ পরিকল্পনা আছে।

ডলারের অবরোধ আরোপের ক্ষমতা ভেঙে দেয়া মানে কীঃ
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যাপারটা কী তা কমিউনিস্টদের আজো ঠিকমতো বোঝা হয়নি। কারণ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্থাটা ১৯৪৪ সালে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণের চালু ও দাঁড়িয়ে আছে এটাই তারা রিয়েলাইজ করে না। এই ব্যবস্থাটা চালু হয়ে গেলেও কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলো তখন এতে অংশ নেয় নাই (আবার আমেরিকাও নেতিবাচক মনোভাব রাখাতে যেমন, সুনির্দিষ্ট করে পোল্যান্ডের সদস্য-পদলাভের আবেদন না করে দিয়েছিল আমেরিকা)।  কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলো সেই থেকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পর্ক ছাড়াই বিকশিত হয়েছিল। তবে কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সীমিতভাবে বার্টারে কিছু পণ্য বিনিময় হত। কিন্তু এভাবে কতদিন?  এভাবে ১৯৯২ সালে সোভিয়েত রাষ্ট্র ভেঙে যাওয়ার আগে পর্যন্ত। এরপরে এরা সবাই আইএমএফের সদস্যপদ পায় ও নেয়। তত দিনে দুনিয়ার বাণিজ্যে কেনাবেচা প্রধানত ডলারেই সম্পন্ন হওয়া প্রবলে  শুরু হয়ে গেছে। প্রধানত মানে? মানে হল, অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে  আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের  সত্তর ভাগের বেশি লেনদেন যদি কোন একক মুদ্রায় সম্পন্ন হয় তাহলে সেটাই প্রধান আন্তর্জাতিক মুদ্রা বলে ধরতে পারি। এটা অনেকটা খুব চালু দোকানের খাবারের মত। খুব চালু বলেই ওর খাবার সবসময় টাটকা ও ভেরাইটি থাকে। ফলে ওর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অন্য দোকান কেউ দাড়াতেই পারে না। কিন্তু একবার যদি তার বিক্রি পড়ে যায় তবে ঐ দোকান শেষ। একইভাবে, ডলারের ক্ষেত্রে, ওর প্রতিদ্বন্দ্বী মুদ্রা গ্লোবাল লেনদেনের মুদ্রা হিসাবে একবার সত্তর ভাগের কাছাকাছি চলে গেলে ডলারের দফারফা হয়ে যাবে। এটাই ডলারের অবরোধ আরোপের ক্ষমতা ভেঙে দেয়া। এদিকে ইতোমধ্যে  চীনা ইউয়ান শর্ত পূরণ করাতে পারায় গত ২০১৫ সাল থেকে ইউয়ানকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে আইএমএফের স্বীকৃতি পায়। আর সেই থেকে রাশিয়ার সাথে চীন পরিকল্পনা করে করে আগাচ্ছে।

চীনের জ্বালানি কেনাকেন্দ্রিক পরিকল্পনা নিয়ে আগানোঃ

China's annual average crude oil imports

Source: China General Administration of Customs, based on Bloomberg, L.P.

এখনকার মুল পরিকল্পনাটা হল, চীনের জ্বালানি কেনাকেন্দ্রিক। বড় অর্থনীতি বলে চীনকে প্রচুর জ্বালানি কিনতে হয় [World’s largest Importer]  …..more than 10 million barrels a day last year। মানেই তার পরিশোধ করা এক বড় পেমেন্ট হল জ্বালানির মূল্য শোধ করা। অতএব হিসাবটা হল, এই পেমেন্ট যদি সে ডলারে না করে নিজ মুদ্রা ইউয়ানে করে তাহলে ঐ ৭০% গ্লোবাল লেনদেন থেকে ডলারকে হটানোর পথে অনেক দূর আগিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু এত দিন এই পরিকল্পনা ছিল মধ্যপ্রাচ্যের বাদশা বা গালফকেন্দ্রিক, বাদশাহরা যদি আমেরিকার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে একবার রাজি হয় ভরসা করে – এভাবে। কিন্তু এর ভিতরে  ইরানকে নিয়ে গোনায় ভাবা হয়নি। কারণ ইরান আজকের হবু সম্পর্কের মধ্যে আসতে চায় এমন আগ্রহ আগে কখনও  দেখায়নি। আর ইরানের কাছে চীনের দেয়া প্রস্তাব ছিল সামগ্রিক ও দীর্ঘস্থায়ী, এখনকার হবু চুক্তির মত হতে হবে এই শর্তের।  ইরানের আগে অনাগ্রহটা কেন ছিল তা বুঝতে ইরানের বিরোধী নেতা আহমদিনেজাদের প্রতিক্রিয়া অনুসরণ করা যেতে পারে। তিনি বলছেন, এই চুক্তি হলে আমরা অনেক বেশি চীনা নির্ভরশীল হয়ে যাব। বাইরে থেকে দেখলে তিনি সম্ভবত আগামী নির্বাচনে লড়ার কথা ভাবছেন। তবে প্রশ্নাতীতভাবেই ইরান চীনা নির্ভরশীল তো হবেই, কথা সত্য। কিন্তু প্রশ্ন সেখানে নয়। প্রশ্ন হল ইরানের হাতে এর বিকল্প আর কী আছে? ব্যাপারটা হল, পোলাও পাতে আসার অপশন যদি নাই থাকে তবে পোলাও খাবো কি না সেই বাছাবাছির অর্থ কী! এই হল ইরানের বাস্তবতা। যদিও ইলেকশনি ইস্যু হিসেবে দেখলে আহমদিনেজাদের বক্তব্যের গুরুত্ব বুঝা যেতে পারে।

সেটা যাই হোক, এবারের সর্বশেষ ২০১৯ সালের মে মাসের শুরু থেকেই ট্রাম্প আরো  কড়া অবরোধ আরোপ করেছিলেন। এতে এক চীন আর ভেনিজুয়েলা (একে তেল পাঠানো রি-সেল করার জন্য) ছাড়া কোথাও ইরানি তেল বেচা যায়নি। ভারত এই প্রথম কোন তেল কিনে নাই। তাও সেটা আবার সকলকেই  কনসেশন রেটে আর ইরানি নৌবাহিনীর পাহারায় নিজ ট্যাংকার-ক্যারিয়ারে করে তা পাঠাতে এবার ইরানি-অফার ছিল তা সত্ত্বেও। ফলে ইরানের পাবলিক তাদের জীবনযাত্রায় আর কত গভীর চাপ, আর কত দিন সহ্য করতে পারা সম্ভব- এটাও মুখ্য বিবেচনার দিক হয়ে উঠেছিল এখানে। সম্ভবত সে কারণে এর আগে সহসা ইরান রাজি হতে পারেনি এমন হলেও এবার বাধ্যবাধকতা বেশি অনুভব করায় রাজি হয়েছে। এতে গালফ বাদশাহদের ইউয়ানের চীনা তেলের পেমেন্ট নেয়াতে রাজি করানো যতটা কঠিন ছিল এখানে সে কাজ অনেক সহজেই সম্পন্ন হয়েছে, দেখা যাচ্ছে। কারণ খসড়া চুক্তিতে দেখা যাচ্ছে সব লেনদেন হবে চীনা ইউয়ানে, একথা ইতোমধ্যেই লেখা আছে। সুতরাং এটা একটা বিরাট অগ্রগতি। অর্থাৎ পালাবদলের ধাক্কা দেয়ার ক্ষেত্রে এক বিরাট পদক্ষেপ হয়েছে এটা। অর্থাৎ এই চুক্তির ইমপ্যাক্ট কেবল ইরানের কী লাভ-সুবিধা হল ততটুকুতেই নয় বরং নতুন এক চীনা গ্লোবাল ক্ষমতায় প্রভাব প্রতিপত্তিতে হাজির হতেও বড় ভূমিকা রাখবে। যেখানে ইরান সেই নতুন ক্ষমতার পাশে বুক ফুলিয়ে হাটবে তা বলাই বাহুল্য!  এজন্যই বলা হচ্ছে এই চুক্তি পালাবদলের শুরুর ঘটনা হয়ে দাঁড়াবে।

সবচেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্তদের অন্যতম হবে ভারতঃ
ভারতে চিন্তাবিদরা এখন বিরাট প্রশ্নের সম্মুখীন ও প্রকাশিত যে, তাদের চিন্তার ক্ষমতা-সামর্থ্য কত সীমিত! এই চিন্তাবিদ বলতে নানান রঙের কথিত থিংকট্যাংক বা একাডেমিক বা কনসাল্টিং ফার্মের কথা বলছি। এক কথায় বললে, এই চুক্তি ভারতকে ভারতের স্বার্থ একেবারে ধসিয়ে দিবে, দিশেহারা করে দিবে। অথচ, এর আগাম কোনো হদিস এই কথিত চিন্তাবিদরা ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদদের দিয়েছে প্রমাণ জানা যায় না।  বরং আমরা বিস্মিত হই দেখে যে, হবু-চুক্তি প্রকাশ হবার পরে সবচেয়ে বেশি অহেতুক বাজে কথা বলা হামবড়া লোকটাই এখন সবার আগে মাথা নিচা করেছে। বিসিসিকে এরা যা বলেছে এর সারকথাটা হল, তারা হেরে সব মেনে নিয়েছে। বিবিসি লিখছেঃ

 “ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ক সাবেক সচিব পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীও কার্যত মেনে নিচ্ছেন, চাবাহারে ভারত বিপুল পরিমাণ লগ্নি করার পরও এই বন্দরের নিয়ন্ত্রণ হয়তো শেষ পর্যন্ত চীনের কাছেই হাতছাড়া হয়ে যাবে। মি. চক্রবর্তীর কথায়,”ইরান বলছে ওই রেল প্রকল্পে ভারত ঠিক সময়ে টাকাপয়সা দেয়নি। আমরা যেটা দেখছি,চাবাহার নিয়ে ভারতের মধ্যেও এখন একটা দ্বিধা কাজ করছে – কারণ ওই প্রকল্পে চীনের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।” “আমার ধারণা চাবাহার বন্দর প্রকল্পে শেষ পর্যন্ত ভারতেরও শেয়ার থাকবে – কিন্তু চীনই শেষ পর্যন্ত ওখানে সবচেয়ে বড় প্লেয়ার হিসেবে উঠে আসবে।”
—এরপর আর আমাদের কিছুই কী বলার আছে!

এর মানে, এই চুক্তির কারণে ভারত মূলত ইরান, আফগান বা সেন্ট্রাল এশিয়া জোনে ব্যবসা বাণিজ্য সহায় সমর্থনহীন অবস্থায় পড়ে সব গুটিয়ে নিয়ে বাসায় ফিরতে মানসিকভাবে তৈরি। কিন্তু ভারতের দুর্দশা তো এতেও শেষ হবে না। এই হবু চুক্তির আয়োজনের ফলে ভারতকে চীন এমন কঠিন এক  দুর্দশা পরিস্থিতিতে ফেলে দেবার মুখে নিয়ে যাবে যেখানে – ভারতকে এখন খোলাখুলি চীন অথবা আমেরিকা কোনো একটা পক্ষকে বেছে নিতে হবে। অর্থাৎ সেই সময় এসে গেছে যখন ‘এ-ও হয় ও-ও হয়’ বলে দু’দিকেই নৌকায় পা দিয়ে থাকার সুবিধা এনজয় করার দিন শেষ। এতে ভারত যদি আমেরিকা ক্যাম্পে যায় তা গেলে হয়ত সামরিক দিকে কিছু সুবিধা হতে পারে। কিন্তু সাথে খামোখা অনেক দায় আসবে যেগুলো  আসলে হুদাই পশ্চিমের ব্যাগেজ টানা হবে। কিন্তু সেক্ষেত্রে  সবচেয়ে বড় ক্ষতি যেটা হবে বাইরে থেকে সব অর্থনৈতিক সাহায্য সমর্থন পাওয়ার দিন শেষ হবে। আর যদি চীনের ক্যাম্পে মাথা নিচু করে ফিরে তবে চীনের টার্মেই ফিরতে হবে। কম দরে বিক্রি হতে হবে।

আবার উপরে এই যে অবলীলায় বলছেন,  “ভারতেরও শেয়ার থাকবে” – এই কথা কয়টা তো মারাত্মক ভীতিকর। মানে ব্রিকস ব্যাংক বা এআইআইবি ব্যাংক ইত্যাদি এমন সবখান থেকে ভারত গুটিয়ে যাবে কেবল নিস্ক্রিয় পার্টনারের মত  শেয়ার মালিকানা নিয়ে থাকবে – তাই কী? তার মানে গত এক সপ্তাহের মধ্যে কথার চাপা আর তুবরি ছুটানো লোকগুলো সব হার মেনে নিয়ে গুটিয়ে যাচ্ছে  -সেলফ, নিজ উদ্যোগে??

আবার যে কথাটা বলছিলাম ভারতীয় চিন্তার সামর্থ্য – এখন এটা ভারতের রাজনীতিক ও চিন্তাবিদদের জন্য প্রমাণ করা খুবই কঠিন যে, চীন-ইরান যে এমন একটা দীর্ঘস্থায়ী এলায়েন্স করে বসতে পারে তা তারা বিন্দুমাত্র আগে জানত। অর্থাৎ ইরানি তেল না কিনলে মুখ ঘুরিয়ে নিলে যে ভারতেরই বহুমুখী স্বার্থ  যে মারাত্মকভাবে ক্ষুন্ন হবে সেটা তারা আগে দেখতেই পায়নি, টেরই পায় নাই! তাদের চোখে “মেরা ভারত মহান” হয়েই ছিল বা “অনেক ক্ষমতাবান” হয়েই ছিল! তার মানে দাঁড়াল ভারতে শুধু উদ্বৃত্ত বা বিনিয়োগের বিপুল ঘাটতি আছে তাই নয়, চিন্তার সামর্থের দিক থেকেও  বহু পিছনে আছে। আমেরিকান থিংকট্যাংকের পাল্লায় পড়ে তাদের স্ব-ক্ষমতাটাও শেষ।

ভারত ইরানের জাভেদ জারিফকে প্রবল হতাশায় ফে্লে এর পরিণতি খাটো করে দেখেছিলঃ  
আবার ঘটনা দেখেন সেদিন কীভাবে ঘটেছিল। তেলকেনা বিষয়ে ভারতের পিছলানির আলাপ সেই ২০১৮ জুনে নিকি হেলির ভারত সফরের সময় থেকে শুরু আর মোচরানি দিতে শুরু করেছিল। ভেবেছিল কী জানি বিরাট ক্ষমতাবান এক ভারতীয় পাঞ্জাব অরিজিনের মানুষ হাতে লেগে গেছে, ভারতকে আর পায় কে!  তাই সেসব মোচরানি! এছাড়া  সর্বশেষ যেদিন ১৩ মে ২০১৯ ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ [Mohammad Javad Zarif] এক দিনের ঝড়ো সফরে ভারত এসেছিলেন এবং খুবই মনোক্ষুন্ন হয়ে ফিরে গিয়েছিলেন। কারণ এর আগেই ২ মে ২০১৯ থেকে ইরানের অনুরোধ ফেলে মাড়িয়ে ভারত ইরানি তেল কেনা বন্ধ করে দিয়েছিল; আমেরিকান অবরোধের অজুহাত দেখিয়ে। অথচ  চীন তখনও তেল কিনা জারি রেখেছিল। বিশেষত সেবার যেখানে তেল ইরানি পাহারায় ইরানি ট্যাঙ্কারে ভারতের তীরে পৌছে দেওয়ার সস্তা অফার ছিল। তবু ভারত এই প্রথম মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল। তাই অন্তত শেষবারের মত “ফাইনাল ওয়ার্ডস” শুনতে এসেছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ। এমনকি পরিষ্কার করে বলেছিলেন, ঐ আমেরিকান থিংকট্যাংক- সিএসআইএস [CSIS] -তোমাদের ডুবিয়ে ছাড়বে, এদের পাল্লায় পড়ো না। কিন্তু কেউ তার কথা শোনেনি। এমনকি পরের ২ অক্টোবর ২০১৯ এ আমেরিকায় মিডিয়াকে জয়শঙ্কর দাবি করে বুঝাচ্ছিলেন [Iran not disappointed with India for not buying oil from Tehran: Jaishankar] তেল কেনা বন্ধ করে দেয়ায় ইরান ভারতের ব্যাপারে হতাশ হয়নি। আরো ভয়ঙ্কর সাফাই দিয়ে বলেছিলেন, [we frankly understand each other’s compulsions and possibilities,] – “যার যার দেশের বাধ্যবাধকতা আছে আর (আরেক দিকের) সুবিধাও আছে”। এর মানে তাহলে এখন চীন-ইরান নতুন চুক্তির পথে চলে যাওয়ায় নিশ্চয় ভারতের কোনো ক্ষতি বা অসুবিধা হয়নি, তাই নয় কি? বুঝে শুনেই তো যার যার লাভালাভের সন্ধানে ভারত ইরানকে ছেড়ে আমেরিকাকে বেছে নিয়েছিল! তাহলে চার দিকে আজ চীন-ইরান চুক্তির খবরে মিডিয়ায় ভারতের নাকিকান্না কেন? জয়শঙ্করের সম্ভবত অনুমান এই যে আমেরিকার CSIS থিঙ্কট্যাঙ্কে দাওয়াত পেলে জাতে উঠা যাবে।  কিন্তু গ্লোবাল সিস্টেমটাকে বুঝবার  যে দুনিয়াদারি সেখানে আমেরিকার নেতৃত্বের পুরানা গ্লোবাল অর্ডার যে ভেঙ্গে পড়েছে  এটা তো নিজের যোগ্যতায় জেনে নিতে হয়, আর ঠিক করতে হয় কী কী করব না!
যদিও বেশির ভাগ মিডিয়া ভারতের ক্ষতিটা ঠিক কী হয়েছে সেটাও বুঝেনি মনে করার কারণ আছে। যেমন দ্য হিন্দু। এটাকে অনেক বুদ্ধিমান অগ্রসর মিডিয়া বলে মানুষ মানে। কিন্তু ওর শিরোনাম দেখুন, “ইরানে চাবাহার রেল প্রজেক্ট থেকে ভারতকে বের করে দিয়েছে ফান্ড দিতে ভারতের দেরি দেখে”। এর মানে ঘটনাকে কত ক্ষুদ্র সংকীর্ণ জায়গা থেকে দেখছে। ভাবছে ব্যাপারটা হল ভারতকে কেবল একটা রেল প্রজেক্ট থেকে বের করে দেওয়া।  ঠিক একই নাদান বুঝ  বিবিসিকে দিয়েছে ভারতের এক সাবেক ভাইস অ্যাডমিরাল শেখর সিনহা। বলেছেন তাদের ঠিকাদার কোম্পানিটা আসলে নাকি ঢিলা!  কিন্তু ঘটনাটা কী এতই সহজ আর এতটুকুই! অথচ হিন্দুর ঐ রিপোর্টেই ভেতরে ঐ চীন-ইরান চুক্তির সবকিছুর উল্লেখ আছে। ভারতকে যে  মূলত ইরান, আফগান বা সেন্ট্রাল এশিয়া জোনে ব্যবসা-বাণিজ্যে সহায়শুণ্য বের করে দিবে সেদিকটা দেখতেই পায় নাই। এছাড়া নিজে  অন্তত অবকাঠামো বিনিয়োগে ঘাটতি  সমস্যায় পড়তে যাচ্ছে সেসব তো আছেই।
এর সোজা মানে হল, পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদকে হতাশায় ফিরিয়ে দেয়াকে তারা দেখেছিল – আমেরিকার সাথে ভারতের সম্পর্ক এত বিশাল কিছু আর এতে ভারতের জন্য অর্জন এতই বড় যে, ভারতের এর বিপরীতে ক্ষুদ্র ইরানের কথাগুলো নিয়ে ভাবা অপ্রয়োজনীয়, খুবই স্মল। কাজেই তখনকার এসব অনুমানের উপর খুশিতে ডগমগ আত্মতুষ্টিতে থাকা ভারত এখন কিভাবে অনুসিদ্ধান্ত টানে যে এখন ভারতের যা ক্ষতি তাতে সব দোষ চীনে্র? বড়ই বিচিত্র ভারতের ভিকটিমহুড মন!
যেমন দেখেন এনিয়ে আরো কিছু মিডিয়ায় শিরোনামঃ ‘”চাবাহার প্রকল্পে ধাক্কা ভারতের, নেপথ্যে চিন”, “ইরানের একটি বড় প্রকল্প থেকে ভারতকে বাদ” – এটা নাকি আবার আমাদের প্রথম আলোর সারা দুনিয়ার মিডিয়া ঘেটে করা এক ডেস্ক রিপোর্ট।  বুঝেন অবস্থা তাদের চোখ কত সংকীর্ণ। আবার “চীন-ইরান দোস্তি, যুক্তরাষ্ট্রে অস্বস্তি”। কিন্তু ট্রাম্প বাবাজি অস্বস্তিতে পড়বে কেন? তিনি কী ইরানের সাথে পারমানবিক চুক্তি কেন ভেঙ্গে দিয়েছিলেন?  অর্থাৎ এর মানে হল,  এই চুক্তির বড় পিকচার বা গ্লোবাল প্রভাবের দিকটা তিনি আমল করতে পারেনি।  আসলে এখনও অনেকেই ব্যাপারটাকে নেহাতই একটা ইরানি প্রকল্প থেকে ‘চীনের প্রভাবে’ ভারতকে বের করে দেয়া হিসেবেই বুঝেছে। এভাবে চীনকে দোষারোপ করে নিজেদের চিন্তা করারও অযোগ্যতা তারা ঢাকতে চাচ্ছে। আবার ভারত আমেরিকান সখ্যকে অতিগুরুত্ব দিয়ে তারা বলতে চাচ্ছে  – ভারত চাইলে  ইরানি তেল কেনা বন্ধ করতে পারবে কিন্তু ইরান ভারতকে কোন প্রজেক্ট থেকেই বাদ দিতে পারে না! আহা কী সুবিধা!

এর চেয়ে বরং কংগ্রেসে আমরা কিছুটা বুদ্ধিমান লোকজন আছে মনে হচ্ছে। তারা বলেছে,‘চীন বেটার ডিল দিয়ে ইরানকে ভাগিয়ে নিয়ে গেছে অথচ মোদী সরকার সেটা আগে বুঝতেই পারেনি।’ অর্থাৎ  কংগ্রেস অন্তত বিনা প্রসঙ্গে চীনকে দোষী করার দিকে যেতে চায়নি; বরং প্রতিদ্বন্দ্বিতা হিসেবে দেখেছে।

মাথা নিচা ভারতের বুদ্ধিমানেরাঃ
তবে এই প্রথম আমরা এক নতুন ধরণের ভারতকে দেখতে পাচ্ছি যারা চীন-ইরান হবু চুক্তির কথা প্রকাশিত হবার পর একেবারেই চুপসে গেছে, যেন তাদের দম্ভ কমেছে অন্তত কিছুটা। বিশেষ করে থিঙ্কট্যাকের সাথে সংশ্লিষ্ট আছেন যারা এমন ব্যক্তিত্বদের ক্ষেত্রে। বিশেষত বাংলাদেশের ১/১১ এর সময়ের ভারতীয় রাষ্ট্রদুত  পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীর পরিবর্তন অবাক করার মত। ওআরএফ – এই থিঙ্কট্যাঙ্কের সাথে  সর্বশেষ জড়িত এই সাবেক কূটনীতিক, যেখানে সেখানে কটু কথা বলার ক্ষেত্রে খুবই খ্যাত, তিনি বিবিসির সাথে যেভাবে কথা বলেছেন তার ইঙ্গিতটা হল যেন বলা যে, আমরা চীন-ইরান চুক্তির কাছে হেরে গিয়েছি আর তা মেনে নিচ্ছি বলেই আমাদের স্বর এমন নরম হয়ে বদলে গেছে। তবে  স্বর বদলে  নরম করে নেয়া প্রসঙ্গে পিনাক রঞ্জনকেও ছাড়িয়ে গেছেন আরেক নারী ব্যক্তিত্ব, তিনি  দিল্লিতে ইনস্টিটিউট অব চায়না স্টাডিজ নামে আরেক থিঙ্কট্যাঙ্কের ফেলো অধ্যাপক শ্রীমতি চক্রবর্তী। বিবিসির কাছে তিনি প্রায় সব প্রশ্নেই ভারতের দোষ দেখেছেন বা হার স্বীকার করে নিয়েছেন। যেমন তিনি  “ভারতকে সরানোয় চীনের ভূমিকা আছে কি না তা বলা মুশকিল”  বলেছেন। এছাড়া বলেছেন, “ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞা জারির পর তেহরান দিল্লির কাছ থেকে যে ধরনের সমর্থন আশা করেছিল, সেটা তারা পায়নি তাতেও কোনও ভুল নেই!”।  মানে একদম গুলে গিয়ে সবাই যেন মোম হবার দশায়।  যদিও তিনি বলছেন, “ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষমতায় আসার পর আমেরিকার সঙ্গে ইরানের যে সংঘাত চরমে উঠেছে, চীন খুব ভালভাবেই তার অ্যাডভান্টেজ নিচ্ছে”। মনে হতে পারে তিনি এখানে পরোক্ষে হলেও চীনকে দায়ী করছেন সুবিধা তুলে নেওয়ার জন্য। যেখানে ব্যাপারটা হল আপনি আপনার প্রতিদ্বন্দ্বিকে যদি বোকা হয়ে সুবিধা করে দেন সেক্ষেত্রে সে সুবিধা তো নিবেই। গ্লোবাল নেতৃত্ব দখলের দিনগুলোতে সামলে না চললে প্রতিদ্বন্দ্বি সুবিধা ত নিবেই। সেখানে প্রেসিডেন্টের নানান ক্ষমতার মর্ম ও ওজন বুঝে না এমন কোন দেউলিয়া ব্যবসায়ী যদি হঠাত করে আমেরিকান প্রেসিডেন্টের আসনে বসে পড়ে তবে তার ‘কেলাসনেস’ বা অযোগ্যতা আমেরিকার ক্ষতি তো করবেই। গ্লোবাল ক্ষমতার পালাবদলের সময়ে আমেরিকার প্রতিদ্বন্দ্বি এভাবেই সুযোগ নিয়ে নিয়ে সামনে ধেয়ে আসছে এবং আসবেই – এটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক। আর এদিকে ভারতের ক্ষেত্রে তার চিন্তা করার প্রকৃত সামর্থ ও যোগ্যতা তার যে লেবেল বা মানের তাতে শেষে আজ সে ঠিক সেই মাপের বামন হয়ে গেছে।  ইরানকে গুরুত্ব দিয়ে না দেখা খাটো করে দেখা বা ইরানের তেল না কিনলে ভারতের কিছুই হবে না এই হামবড়া ভাব – এভাবে ট্রাম্প আর মোদী মিলে ধারাবাহিক ভাবে ইরানের উপর চাপ সৃষ্টি করে যেন ইরানকে ঠেলতে ঠেলতে চীনের কোলে ফেলে দিয়েছে। এখন এর কাফফারা দিতে দিতে এরা কোথায় গিয়ে ঠেকে তাই দেখার বিষয়!

চিন্তায় অযোগ্য আর বেপরোয়া মানুষেরা এমন কাফফারা দিতে দিতেই শেষ হয়ে যায়! দিন সবারই একদিন আসে, আগে আর পরে!

 

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

 

 

[এই লেখাটা  গত ১৯ জুলাই ২০২০, দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ওয়েবে ও  ঐদিনই প্রিন্টেও  চীন-ইরান এলায়েন্স,পালাবদলের শুরু” – এই শিরোনামে উপ-সম্পাদকীয়তে ছাপা হয়েছিল।  পরবর্তিতে সে লেখাটাই এখানে আরও নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে এখানে আজ ছাপা হল। ]

5 thoughts on “চীন-ইরান প্যাক্ট থেকে গ্লোবাল পালাবদল শুরু হবে

  1. বরাবরের মতোই ধারালো বিশ্লেষণ, দাদা!

    শুভেচ্ছা

    Like

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s