বিদেশিবিরোধিতা সস্তা মিথ, ‘গ্লোবাল অর্ডার’ বুঝেন


বিদেশিবিরোধিতা সস্তা মিথ, ‘গ্লোবাল অর্ডার’ বুঝেন

গৌতম দাস

২৭ জুলাই ২০২০, ০০:০৬ সোমবার

https://wp.me/p1sCvy-37d

Sharad Pawar: The God of Broken Mandates, YOUTUBE Rare Interviews, Crux Files

আপনি যে ভুখন্ডে দাঁড়িয়ে আছেন চাইলে কেবল তার কথা মনে রেখে নিজের সম্পর্কে কথা বলতে পারেন। নিজের অস্তিত্ব অনুভব করতে পারেন এভাবে। অথবা অন্যটা হল,  এই গ্লোব বা বিশ্বের যে অংশ আপনার ঐ ভুখন্ড, গ্লোবাল পটভুমির কথা খেয়ালে রেখে এবার আপনি আপনার ভুখন্ড সম্পর্কে অনুভবের কথা বলতে পারেন। এখানে খেয়াল করেন, দ্বিতীয়টাও কিন্তু আপনার সম্পর্কেই অনুভব। কিন্তু ফারাক হল, এখানে এক গ্লোবাল পটভুমিতে আপনি, এভাবে।  তাতে এই দুই ভাষ্য হবে দুরকম।  সেক্ষেত্রে প্রথমটাকে বলা হবে এক লোকাল ভাষ্য আর দ্বিতীয়টাকে গ্লোবাল ভাষ্য।  অর্থাৎ আপনারই  সম্পর্কে প্রথমটা হল এক সংকীর্ণ ভাষ্য আর পরেরটা পুর্ণ ভাষ্য। এই হল লোকাল বনাম গ্লোবাল ভাষ্যের ফারাক।
[লেখাটা অনেক বড় হয়ে গেছে, এড়াতে পারিনি। তবে একটা উপায় আছে, যারা ছোট ভার্সানে পড়তে চান তারা কিছু প্যারা বাদ দিয়ে পড়তে পারেন। যে সব প্যারা এক ইঞ্চি জায়গা ছেড়ে শুরু এগুলোই সেই প্যারা। বাদ দিয়ে পড়া যায় এখানে এমন দুটা প্যারা আছে। এতে লেখাটা অনেক ছোট হবে। চেষ্টা করে দেখতে পারেন। ]

গ্লোবাল প্রেক্ষিত বা দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়াই ভারতের প্রবীন রাজনীতিক শারদ পাওয়ার [Sharad Power] কথা বলেন। তবে তিনি একা নন বরং ভারতের প্রায় সব রাজনীতিকই এমন, তাই তাঁকে সব রাজনীতিকেরই প্রতীকী প্রতিনিধি হিসাবে ধরে নিয়ে কথা হবে। এঁদের দেশ বলতে একটা ‘লোকাল’ বুঝের ধারণায়,  আর এক কল্পনার জগতে বাস করা রাজনীতিবিদ। মানে গ্লোবাল প্রেক্ষিতে থেকে এবার লোকাল অনুভবটা করতে পারেন না এরা, মিসিং। এঁরা মনে করেন তারা ‘স্বনির্ভর’, ‘আত্মনির্ভরশীল’, ‘স্বদেশ’ ইত্যাদি শব্দের লোক। কিন্তু আসলে তাঁরা এসব শব্দের মিথ্যা ফুলজুড়ি বিলানো ধরনের রাজনৈতিক জগতের জন্য লড়ছেন। যদিও  এঁদের অনেকেই জানেন এটা বাস্তব নয়, বাস্তবে এসব নেই, পরাবাস্তবতা অস্তিত্বহীন। তবু এটা কেবল তাদের কল্পনায় আছে। রেখে দিয়েছেন। কারণ তারা মনে করেন হোক অবাস্তব তবু এর একটা ‘উপযোগিতা’ আছে।  বাস্তবায়ন অযোগ্য হলেও এটা তাদের লাগে পাবলিকের কাছে কিছু স্বপ্ন বিলিয়ে কল্পনায় জগতে পাবলিককে প্রবেশ করিয়ে যাতে আবেগী কিছু মিথ্যা কথা বলে তাদের সংযত রাখতে পারেন। আবার সময়ে উস্কে তুলতে পারেন – এমন কিছু শব্দ দিয়ে যেমন দেশপ্রেম, দেশভক্তি, হিন্দু জাতি মহান অথবা ভারতীয় জাতি মহান ধরনের অলীক এবং অর্থহীন। একদিকে এরা গ্লোবাল প্রেক্ষিত বা গ্লোবাল অর্ডার বলে দুনিয়াতে কিছু আছে কি না তারা খোঁজ করে দেখেননি। আবার অন্যদিকে তবু কেবল ভুয়া স্বদেশিপনায় অলীক স্বপ্নগুলোই তারা বিক্রি করেন, এটাই তাদের রাজনীতি। অন্তত ভোট যোগাড়ের কৌশল। এটাই ভারতের নেশন-স্টেট বা জাতিরাষ্ট্র বাদীদের অনড় রাজনীতি। তাতে এরা হিন্দুত্বের জাতিবাদী বিজেপিই হোক কীংবা  সফট হিন্দুত্বের জাতিবাদী কংগ্রেস যেই হোক। জাতিবাদী সকল রাজনীতির বৈশিষ্ট এটা।

কেন শারদ পাওয়ার প্রসঙ্গঃ
শারদ পাওয়ার, ৮০ বছর বয়সী ভারতের প্রবীণ রাজনীতিবিদদের একজন, যিনি এখনো রাজনীতিতে সক্রিয়। মূলত মারাঠা জনবসতির রাজ্য মহারাষ্ট্র, যার রাজধানী মুম্বাই; আর এর এখনকার ক্ষমতাসীন রাজ্য-সরকার এক কোয়ালিশন সরকার। এতে শারদ পাওয়ার কেবল এক অংশীদার শুধু নন, অ্যাংকর বলা যায়, যিনি জোট ধরে রাখার ক্ষেত্রে এক বড় মুরব্বির ভূমিকা পালন করে থাকেন। এই রাজনীতিবিদ ১৯৬০ সালের দিকে ২০ বছর বয়সে প্রথম কংগ্রেস দলে নাম লিখিয়েছিলেন।  আর অনেক পরে, তিনি আসলে ভারতের এক সাবেক প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাওয়ের সমসাময়িক; এই অর্থে যে, ১৯৯১ সালে রাজীব গান্ধী মারা যাওয়ার পর তাঁরা একসাথে দলের প্রধান পদের দাবিদার দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের শিকা শেষে নরসীমার পক্ষে যায়। নরসীমা প্রধানমন্ত্রীও হন, আর শারদ পাওয়ার পান পরের ভারী পদ প্রতিরক্ষা মন্ত্রিত্ব। অবশ্য তিনি একবার কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রীও ছিলেন। এ ছাড়া রাজনৈতিক জীবনে তিনি অন্তত পাঁচবার মুখ্যমন্ত্রী আর অনেকবার অনেক মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হয়েছেন।
কিন্তু ১৯৯৯ সালে এসে পুরনো প্রতিযোগিতার লেজ ধরে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীরা তাঁকে আরো চাপের মুখে ফেলে হারাতে চেয়ে পাল্টা গান্ধী পরিবারের হাতে দলের সবক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার কৌশল নিয়েছিল। পরিণতিতে একপর্যায়ে তিনি কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে নিজেই নিজ আঞ্চলিক মারাঠাকেন্দ্রিক এক দল খুলে বসেন যার নাম- ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টি বা এনসিপি। কিন্তু কংগ্রেসের প্রতি নিজের জন্ম-মোহটা থেকেই গিয়েছিল বলা যায়। তাই আমরা পরবর্তিতে দেখি প্রায় সব সময়ই তিনি কংগ্রেস দলের সাথে ঐক্যে নানান কোয়ালিশন করে ক্ষমতায় অথবা কখনো বিরোধী দলে থেকেছেন।

শারদ পাওয়ার ভারতের রাজনীতিবিদদের এক সিম্বল বা প্রতীক ধরে নিয়েই আজকের কথা আগাবো আমরা। আমাদের আজকের লেখায় তাকে বেছে আনার গুরুত্ব হল – তার সমবয়সী ভারতীয় কোন রাজনীতিবিদ আর রাজনীতিতে প্রায় নেই বললেই চলে। তাঁরা অবসরে নয়ত মৃত। গান্ধী পরিবারে ক্ষমতা এক বংশ পরম্পরার মধ্যে কুক্ষিগত হওয়ায় একদিকে কংগ্রেসে আর অন্যদিকে মোদীর উত্থানের পর মোদীর দলেরও সিনিয়র প্রায় সব নেতাকে (ঘোষণা দিয়ে ৭০ বছর বয়স যাদের হয়ে গিয়েছে তারা সবাইকে) অবসরে পাঠিয়ে দেয়াতে, বলতে গেলে ভারতের সিনিয়র রাজনীতিকদের এক আকাল শুরু হয়েছে যার মধ্যে শারদ পাওয়ার সম্ভবত একমাত্র ব্যতিক্রম যিনি ৬০ বছর একটানা রাজনীতি করেও এখনো সক্রিয় রাজনীতিক। আমাদের দরকার ছিল একজন ভারতীয় রাজনীতিকের যিনি অন্তত টানা ৬০ বছর সক্রিয় রাজনীতি করেছেন এবং এখনো ভারতের রাজনৈতিক ঘটনাবলি বিশেষ করে বর্তমান চীন সম্পর্কে কী ভাবেন তা সেই নিজ বুঝটাই সরাসরি অবলীলায় তুলে ধরেন বা ধরতে রাজি আছেন। কারণ ভারতের রাজনীতিকদের চিন্তার ঝোঁক বা ট্রেন্ডের একটা উদাহরণ হিসেবে কাউকে পাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছিল যাতে তাকে দেখিয়ে প্রতীক হিসেবে বাকিদেরই এক নমুনা হিসাবে তাঁকে তুলে ধরে কথা বলা যায়। আমাদের মনে হয়েছে শারদ পাওয়ার তেমনই একজন, ভারতীয় রাজনীতিকদের কমন ট্রেন্ডের প্রতীক।

এক মুখপাত্র ‘সামনা’ ম্যাগাজিনঃ
মুম্বাইয়ে এখন মূলত শিবসেনা দল ক্ষমতায়। কিন্তু তারা তাদের সাবেক জোটসঙ্গী বিজেপিকে বাদ দিয়ে এবার সাথে কংগ্রেস আর এনসিপিকে নিয়ে মিলে রাজ্যক্ষমতায় সরকার গঠন করে আছে। আর মুরব্বি হিসেবে পরামর্শ দিয়ে শারদ পাওয়ার এই জোটকে  ইতোমধ্যেই কয়েকবার সরকার-পড়ে-যাওয়া  সামলিয়েছেন। অনুমান করা হয়, শারদ পাওয়ারের এসব দিক ও গুরুত্ব বিবেচনা করে – শিবসেনা দলের মারাঠি ভাষায় প্রকাশিত এক দলীয় মুখপত্র পত্রিকা আছে নাম ‘সামনা’- (এর একটা ভাল বাংলায় অর্থ হবে সম্ভবত মুখোমুখি বা ফেস করা) এই পত্রিকায় শারদ পাওয়ারের এক লম্বা সাক্ষাৎকার নিয়ে ছাপা হয়েছিল। মারাঠি ভাষার সেই সাক্ষাৎকার পরে গত ১২ জুলাই আরেক (মূলত টিভি) মিডিয়া ‘নিউজ ১৮’ [NEWS18.COM]-এর ওয়েবে ইংরাজিতে অনুবাদ করে ছাপা হয়েছিল। যা আমাদের হাতে মানে নজরে আসে।
সময়কাল হিসেবে এই সাক্ষাৎকার হল চীন-ভারত সীমান্তে সংঘর্ষ, উত্তেজনা ও অন্তত ২০ ভারতীয় সেনা মারা যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে। ফলে সেসব ঘটনাকে পটভূমিতে রেখে পাওয়ার কথা বলে গেছেন।
ভারতে কী রাজনীতি চলে আসছে? তা অন্তত গত ৬০ বছর ধরে যে চিন্তায় যে রাজনীতি তারা সব দলের সবাই যা করে এসেছেন এমন কোনো রাজনীতিকের নিজের মুখে এর স্বীকার করেছেন – এমনটা সহজে পাওয়া যায় না। আমরা এই সাক্ষাৎকারটাকেই নিব ভারতের দল নির্বিশেষে বিভিন্ন রাজনীতিবিদদের চিন্তার সাধারণ বৈশিষ্ট্য ও ঝোঁক বা ট্রেন্ড কেমন, কী – সেটা বুঝতে ও রেফার করতে একটা উদাহরণ হিসেবে।

লোকাল বনাম গ্লোবালঃ
আমরা প্রায়ই বলতে শুনি, ভারতীয় রাজনীতিকদের গ্লোবাল প্রেক্ষিত বোধ একদমই নেই। এই কথাটা বলতে ঠিক কী বুঝব? শুরুতে যেটা বলছিলাম, তারা যে রাজনীতির বোধে অভ্যস্ত ও যাকে আদর্শ মনে করে বড় হয়েছে, সারা দেশে যেটা ব্যাপকভাবে আচ্ছন্ন প্রধান ধারার চিন্তা সেটা হল – এক পবিত্র দেশপ্রেম আর নেশন বোধ। মানে প্রবল জাতিরাষ্ট্র-বাদী বা সংক্ষেপে প্রবল জাতিবাদী এবং মূলত এক কাল্পনিক স্বদেশিপনা। আর সর্বোপরি এপ্রসঙ্গে উপরে যেভাবে বলছি, তাতে এ’এক “লোকাল” চিন্তা।  সম্ভবত এত প্রবল এর স্বদেশিপনা বলেই এরা এর মধ্যে আর গ্লোবাল প্রেক্ষিত বোধকে জন্ম নিতে দেয় নাই। বিজেপির মোদী অথবা শাওরদ পাওয়ার ইত্যাদি সবাই এই জায়গায় এক – কম অথবা বেশি স্বদেশিপনা আর আর লোকাল চিন্তাতেই সব সীমিত। আর এক কমন দিক এরা সকলে জাতি-রাষ্ট্র বাদী।
সব রাষ্ট্র ব্যবস্থাই মূলত এক লোকাল ফেনোমেনা – এক স্থানীয় সিস্টেম। অর্থাৎ রাষ্ট্র একটা সিস্টেম – এক বিধিবদ্ধ ব্যবস্থা, কিন্তু তা স্থানীয়। আর একে লোকাল বা স্থানীয় বলছি বলে এর সাপেক্ষে একটা গ্লোবাল বা বাইরের বলতে কিছু আছে। হা আছে। ঠিক যে অর্থে রাষ্ট্র মূলত আভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা। তাহলে ওর বাইরের দিকের কী হবে? কোন বাইরের? কেবল নিজেরই বাইরের? না। সব রাষ্ট্রেরই কমন বাইরের দিক যেটা তা নিয়ে কথা বলছি। মানে কেবল একটা রাষ্ট্রের কথা আর বলছি না। একটা রাষ্টের মধ্যে প্রসঙ্গ আর নাই, বের হয়ে গেছি। রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অন্তঃসম্পর্ক এখন প্রসঙ্গ। এই আন্তঃসম্পর্কঅকে একটা ব্যবস্থাধীন করার জন্য একটা সিস্টেম লাগবে মানে আরেক বিধিবদ্ধ ব্যবস্থা লাগবে, এটার কী হবে? আসলে এটাকেই বলছি গ্লোবাল – এক গ্লোবাল সিস্টেম দরকার। গ্লোবাল অর্ডার, গ্লোবালি ছেয়ে থাকা এক বিধিবদ্ধ ব্যবস্থার কথা বলছি।
তাহলে এখন সার করে বললে, রাষ্ট্র বলতে যদি স্থানীয় বা লোকাল পর্যায়ের এক আভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা বুঝি তবে রাষ্ট্রগুলোর বাইরের দিকের জন্য আরেকটা ব্যবস্থা, এক গ্লোবাল সিস্টেম বা গ্লোবাল অর্ডার লাগবে। এটাই গ্লোবাল অর্ডার, এর কথা বলছি।
দুনিয়ায় প্রথম এক গ্লোবাল অর্ডার স্থাপিত হয়েছিল আমেরিকার হাতে বা নেতৃত্বে। অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে, এতে বিজয়ীদের হাতে ও নেতার নেতৃত্বে। এই প্রথম অর্ডার চালু করতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তা করা হয়েছিল। এমন সব গ্লোবাল প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকর হয়েছিল ১৯৪৫ সালে। যদিও প্রস্তুতির কাজ ১৯৪২ সাল থেকে শুরু বলা চলে।
তার মানে কী এর আগে কোন গ্লোবাল ব্যবস্থা বলতে দুনিয়াতে কিছু ছিল না?  হ্যাঁ ঠিক তাই। আসলে এর আগের দুনিয়া বলতে ১৬০৭-১৯৪৫ এই সময়কালটা কলোনি যুগ। মানে তা দখল শাসন ও লূটের যুগ। তখন কলোনি মালিকদের মধ্যে শত্রুতাই ছিল মুখ্য, তেমন কোন আন্তঃবাণিজ্য বা সম্পর্ক বলতে খুব তেমন কিছু ছিল না।
আসলে গ্লোবাল অর্ডার বলতে এ্কটা একই সাথে এটা মূলত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক ব্যবস্থা বা অর্ডার বুঝায়।  আর এই তিনটাই প্রথম চালু হয়েছিল আমেরিকার নেতৃত্বে ১৯৪৫ সালের ঐ সময়ে। তাহলে এর আগের কালটাকে কি বলতে পারি? বলতে পারি সেটা ছিল একটা কলোনি যুগ যার মাধ্যমে একধরণের “কলোনি ক্যাপিটালিজম” বলতে পারি একে কিন্তু সাথে খুবই সীমিত বা তেমন কোন বাণিজ্যিক ব্যবস্থা ছিল না বলা যায়। এখন ৭৫ বছর পরে আমেরিকার নেতৃত্বের ঐ গ্লোবাল ব্যবস্থার যুগ ধীরে ধীরে শেষ হচ্ছে। আর সে জায়গা নিতে উঠে আসতে চাইছে চীনের নেতৃত্বের এক ভিন্ন গ্লোবাল ব্যবস্থা বা অর্ডার।

গ্লোবাল অর্ডার বলতে মুখ্য ফোকাস আন্তর্জাতিক বাণিজ্যঃ
গ্লোবাল ব্যবস্থার মুখ্য বা কেন্দ্রীয় ফোকাস বলতে সবসময়ই সেটা হল বাণিজ্য – আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। এই বাণিজ্যের এক সিস্টেম গড়ে তোলা ও নিয়ন্ত্রিত হয় মূল দুই নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে, আর সাথে বাণিজ্যিক বিষয়ে রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থের পারস্পরিক বুঝাবুঝির প্রতিষ্ঠান হল ডাবলুটিও। আগেই বলেছি গ্লোবাল অর্ডার বলে যাই বুঝি না কেন এর মুখ্য জিনিষ হল এক আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্থা। গ্লোবাল পণ্য ও পুঁজির লেনদেন বিনিময় বাণিজ্য। যা আবার আসলে একটা মুদ্রা ব্যবস্থা – আন্তর্জাতিক  বেচাকেনা বিনিময়ের মুদ্রা ব্যবস্থা। কারণ প্রত্যেক রাষ্ট্রের সীমানা যেখানে শেষ সেই রাষ্ট্রের স্থানীয় মুদ্রা দিয়ে কেনাবেচা সেখানেই শেষ। তাই যেকোন দুই রাষ্ট্রের মধ্যে পণ্য-বিনিময় বাণিজ্য হতে পারে যেকোন দু রাষ্ট্রের মানে সব রাষ্ট্রের কাছেই গ্রহণযোগ্য এক মুদ্রা ব্যবস্থা চালু করতে পারা দিয়ে; মানেই এক আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থা চালু করতে হবে আগে। নইলে পণ্য বিনিময় অচল। এই কাজটারই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আইএমএফ। আমরা বলি দুনিয়াটা বড়লোক দেশের দিকে ফেবার করে সাজানো। কথা সত্য। এরই আরেক অর্থ হল, আইএমএফ বড়লোক রাষ্ট্রগুলোর দিকে কান্নি মেরে কাজ করে ও সাজানো। কিন্তু সাবধান। এর মানে আইএমএফ “নিপাত গেলে” এটা কোন সমাধান নয়, হবে না। আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য সম্ভব করতে চাইলে আইএমএফ ধরণের কোঅর্ডিনেশন ও নিয়ন্ত্রণে প্রতিষ্ঠান আমাদের লাগবেই। তবে যাতে সে কান্নি না মারে – তা বন্ধ করার ব্যবস্থা অবশ্যই নিতে হবে। যদিও কান্নি মারা বন্ধ করতে সক্ষম হওয়া সেটা কিন্তু এক ক্ষতিগ্রস্থ-পক্ষদের গ্লোবাল ক্ষমতার অর্জন ও নিয়ন্ত্রণ পাওয়ার প্রশ্ন। মানে এটা আইএমএফ “নিপাত” যাওয়ার প্রশ্ন নয়। আমরা যাই নতুন কিছু করি না কেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থা চালু রাখা ও নিয়ন্ত্রণ – দুনিয়াকে চালু রাখার জন্য অনিবার্য প্রয়োজনীয়।
অনেকে শ্লোগান দেন, বিদেশি পুঁজি, বিদেশি পণ্য ইত্যাদি সব হারাম – দেশি – স্বদেশিপনাই একমাত্র পথ। এরাই অবশ্য জাতি-রাষ্ট্র বাদী। আর এটাই কলোনি যুগের ধারণা। যখন আন্তর্জাতিক পণ্য বিনিময় বাণিজ্য ধারণাটাও ছিল না। ফলে স্বদেশি বা আত্নম্বভরিতা ধরণের ধারণা জন্মানোর জন্য উর্বর মাটি-পরিস্থিতি। আর রাজনীতি বা রাজনৈতিক ক্ষমতা মানেই অন্যদেশ ভুমি কলোনি-দখলের ক্ষমতা। এরচেয়েও বড় কথা “স্বাধীন রাষ্ট্র” বলে কিছু নাই। আছে কলোনি হয়ে থাকা রাষ্ট্রের ধারণা – মাই লর্ড বলে হাত জোর করে দাঁড়িয়ে থাকা। ফলে এই দশা-পরিস্থিতি জন্ম নেয়া রাষ্ট্র ধারণাটাই জাতি-রাষ্ট্র ধারণা। আর এদেরই অলীক কল্পনাটা হল অর্থনৈতিক স্বদেশিপনা, বিদেশি মানে হারাম ধারণা। পণ্য বিনিময় বানিজ্য ধারণাকে নিচে চাপা দিয়ে ফেলে রাখা। বলাই বাহুল্য এটাই এবসার্ড, অবাস্তব কথা বলা। বাস্তবে তাদের কথা মিলিয়ে দেখে এরপর তারা বলে না। আপনি নিজেই একটা কারখানা দিলেন কিন্তু সেটা চালাতে যদি অন্য দেশের একটা টেকনোলজি, একটা ধাতব অংশ যা খুবকম দেশে পাওয়া যায় ইত্যাদি এমন হয় (আর সব কিছুই – সেটা ধাতু বা কাঁচামাল সব দেশে পাওয়া যায় না, যাবে না বলে) সেক্ষেত্রে ঐ কারখানা চলবে না। কারণ,ধাতু বা কাঁচামাল বা টেক (বাজার না হয় না বললাম) ইত্যাদি পেতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিনিময়ই ওর একমাত্র সমাধান। কিন্তু স্বদেশিপনা জাতিবাদী আপনি তো কিছুই বিদেশের কিনতেও চান না, বেচতেও চান না। অথচ এটাই আইএমএফ “নিপাত যাক” কথার ব্যবহারিক সত্যিকারের মানে।
সারকথায়, এই জাতিবাদীদের জন্ম কলোনি যুগে যখন দুনিয়ায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিনিময় ব্যবস্থা বলতে কিছুই ছিল না। কিন্তু সেখান থেকে আজকের দুনিয়ায় একটা গ্লোবাল বাণিজ্যিক ব্যবস্থার দুনিয়ায় রূপান্তরিত হয়ে গেল কেমন করে? কে করল তা এরা ‘কেউ’ জানে না।  এই কেউ বলতে জাতি-রাষ্ট্র বাদী আর কমিউনিস্ট দুই পক্ষকেই বুঝতে হবে। এই রূপান্তরটা সম্পর্কে এদুই পক্ষই অন্ধকারে। গ্লোবাল বাণিজ্যিক ব্যবস্থা, খারাপ-ভাল ত্রুটিপুর্ণ যাহোক একটা গ্লোবাল অর্ডার কার্যকর হয়ে আছে এটা তারা জানে না। যদিও এটা থাকার সুবিধা গ্রহণ করতে তারা দ্বিধা করে না। ডলার কামানোকে কাঙ্খিত ভগবান পাওয়ার মতনই মনে করে। যদিও আবার যারা একটু সিনিয়র মোটামুটি বুঝতে পারে গ্লোবাল ব্যবস্থা একটা কিছু আছে তারা আবার সে ধারণায় পানি ঢেলে একে নেতি চোখে দেখে আর বলে ওটা “সাম্রাজ্যবাদী”। একারণে তারাও অন্ধকারে।
কেউ বুঝুক অথবা সারাজীবন অন্ধকারেই থেকে যাক গ্লোবাল বাণিজ্যিক ব্যবস্থাকে কেন্দ্রে রেখে একটা গ্লোবাল অর্ডার দুনিয়ার কার্যকর আছে। আমেরিকার নিয়ন্ত্রণে গড়ে উঠা যে ব্যবস্থাটা বয়স এখন প্রায় ৭৫ বছর। এদিকে আবার এই গ্লোবাল ব্যবস্থার নেতা আমেরিকাকে অন্তত অর্থনৈতিক দিক থেকে চ্যালেঞ্জ করে নেতৃত্ব নিতে চীনের উত্থান এখন আসন্ন। ধীরে ধিরে তা কার্যকর হওয়া শুরু করেছে। এটা যে আসন্ন তা চীন নিজে বলেছে বলে জেনেছি তা নয়। এটা আমেরিকান সার্ভে-স্টাডিতে পাওয়া রিপোর্টর ফাইন্ডিংস বলেছে।
এখন সমস্যা কত গভীর হয়েছে দেখেন! যে জাতিবাদীরা আমেরিকার নেতৃত্বে গ্লোবাল সিস্টেম বা অর্ডার সম্পর্কে পুরাই অন্ধকারে থেকে গেছিল গত ৭৫ বছর ধরে তারা এখন কিভাবে বুঝবে যে এখন যে আমেরিকান গ্লোবাল নেতৃত্বটাই বদল হয়ে চীনের উত্থানের সময় হয়েছে?

অতএব চীন বা আমেরিকেকেও ভারত বিবেচনা করছে গ্লোবাল অর্ডারের হবু অথবা পুরান নেতা হিসাবে নয়। বড় জোর আর পাঁচটা পড়শি রাষ্ট্রের মতই যেখানে এরা দুজন হয়ত কিছু বাড়তি ক্ষমতাধর রাষ্ট্র, এরকম। গ্লোবাল সিস্টেম বলতে মূলত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আর তাকে কেন্দ্র করে পলিটিক্যাল ও ইকোনমিক সিস্টেম এক গ্লোবাল ব্যবস্থা বলে যে কিছু আছে এসব তাদের নলেজ-অনুমানের বাইরে মনে হচ্ছে। একটা জাতিসংঘ বলে কিছু আছে তা জানে। কিন্তু কে বানালো এটা, কেন বানাতে পারল, সেসব জানা এসব গ্লোবাল প্রেক্ষিতের ভিতর দিয়ে ভারতের দুনিয়াকে জানা – না, জাতি-রাষ্ট্রের রাজনীতির জন্য এসব জানা জরুরি নয়। এসব বিষয় সবচেয়ে ভাল্ভাবে ধরা পড়ে জাতিসংঘের ভেটো-মেম্বার হওয়ার জন্য তাদের বোকার আকুতি দেখলে। বুশ আমলের শেষে ওবামার শুরুতে ওবামা ভারতকে চীন ঠেকানো বা চায়না কনটেইমেন্ট কাজের ঠিকা দেওয়ার কথা পাকা করেছিল। আর তখন টোপ দিয়েছিল যে বিনিময়ে আরেকটা মুলা দিবে। সেটা হল ভেটো-মেম্বার পদ। আর প্রণব মুখার্জি তা বিশ্বাস করেছিল এতই দৃঢ়ভাবে যে ২০১০ সালে হাসিনার ভারত সফরে হাসিনাকে দিয়ে দাবি তুলিয়েছিল যে ভারতকে ভেটোক্ষমতা দিতে হবে! জাতিসংঘের জন্ম কেন হয়েছিল কী করতে হয়েছিল আর কেনই বা এই ভেটোক্ষমতার ব্যবস্থা্র জন্ম তা প্রণব বুঝেন এরপর আর তা মনে হয় না। যদি হত তাহলে ওবামা আশ্বাস যে ফাঁকা ধুর্তমি তা ধরতে পারতেন। ভেটো কথাটার ব্যবহারিক মানে কী তাই তো তিনি বুঝেন নাই, দেখা যাচ্ছে। কথা হল পাঁচ ভেটো মেম্বারের কেবল একজন যদি ভেটো দেন মানে না করে দেন তবে সেই সিদ্ধান্ত হবে না। কাজেই ওবামা চাইলেই ভারতকে নতুন সদস্যপদ দিতেই পারবেন না। অন্তত চীনকেও পক্ষে নিতে হবে। তা যদি বুঝতেন তাহলে তো চীনকেই আগে সন্তুষ্ট করতে যেতেন। আসলে সেটাও কম বোকামি হত না। কারণ, আমেরিকা নেতা ছিল বলেই ডিকটেট করে ঐ পাঁচজনকে ভেটো ক্ষমতা দিয়ে হলেও একটা জাতিসংঘ গড়তে সক্ষম হয়েছিলেন। দুনিয়ার নেতা বদলালে পরে তার ডিকটেটের ক্ষমতা কী মাত্রায় হবে সেটার উপর নির্ভর করে তিনি জাতিসংঘ-২ বলে কিছু শুরু করতে পারবেন কিনা! এতা গ্লোবাল সিস্টেম সম্পর্কে বুঝাবুঝির মামলা। তবে সাবধান তা আবার ইউরোপের কোন দেশের বই-পুস্তক পড়ে জানা যাবে না। অর্থাৎ সারা ভারত এই অতি জাতি-রাষ্ট্রবাদ এটাই তাদের গ্লোবাল প্রেক্ষিত থেকে ভারতকে অস্তিত্বের তাতপর্য ও সম্ভাবনা কখনও বুঝতে পারেন নাই। গ্লোবাল প্রেক্ষিত সম্পর্কে দুর্বল বুঝাবুঝির উতস এখানেই। মজার কথা কলোনি আমলের ও ঐ আমলের সাথে সামঞ্জস্যপুর্ণ ধারণা বলে কলোনি শাসনের সমাপ্তিতে সারা ইউরোপের সকল রাষ্ট্র এটা ১৯৫৩ সালের মধ্যে ত্যাগ করে, বাতিল করে দেয়। সেটা রাজনীতিকরা তো নয়ই, ভারতের একাদেমিকরাও টেরও পেয়েছে জানা যায় না।
সাধারণভাবে ভারতের রাজনীতিক্বেওর পর্ব এখানেই শেষ করে এবার শারদ পাওয়ারের পর্ব।

সুনির্দিষ্ট শারদ পাওয়ারের লেখা থেকেঃ
বয়ান একঃ ঐ সাক্ষাৎকারে শারদ পাওয়ারের বক্তব্য, ‘চীন সামরিক সক্ষমতা ভারতের চেয়ে দশ গুণ বড়। কাজেই পাকিস্তানের চেয়ে চীন আমাদের বড় শত্রু ও হুমকি”। কিন্তু এর মানে কী যারাই ভারতের চেয়ে সামরিক দিক দিয়ে বড় তারা সবাই ভারতের শত্রু? তাই নয় কী?
অর্থাৎ তাহলে তো আমেরিকা ভারতের জন্য চীনের চেয়েও আরো বড় শত্রু; মানতে হবে। কারণ আমেরিকা সামরিক দিক দিয়ে এখনো চীনের চেয়ে বড়। কিন্তু পাওয়ার-সহ ভারতীয় নেতা ও পাবলিক কি তাই মনে করবে? ট্রাম্প পুজা করা বিজেপি তো অবশ্যই না। তার মানে ভারতের চেয়ে সামরিক সক্ষমতায় বড় হওয়াটাই ভারতের কেউ শত্রু হবেই। এটা ভিত্তিহীন তাই কারো মানার কোন কারণ নাই!
আবার তিনি বলছেন, ‘শত্রুর কথা উঠলেই আমাদের পাকিস্তানের কথা মনে আসে। কিন্তু না, পাকিস্তান নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। বরং সামনে চীন আমাদের প্রধান শত্রু, কারণ ভারতের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করার চীনের ক্ষমতা আছে, আর আছে দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মসূচি”।

পাওয়ারের এই বোঝাবুঝিও ভুল। কারণ একই যুক্তিতে তো তাহলে আমেরিকাও ভারতের শত্রু হয়ে উঠতে পারে। মানে উঠবেই। এই যে ‘ভারতের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ’ কথাটা- এখানে কে শত্রু হবে আর কে মিত্র হবে এটা বুঝবার ভিত্তি কী?
আসলে শারদ পাওয়ার বা তার মত করে ভাবা (জাতি ভাবনার) মোদীর মধ্যে কোনো ফারাক নেই। তারা সবাই একই চিন্তা ফ্রেমের লোক যেটা পুরনো ফ্রেমের কলোনি আমলের ফ্রেম ও সে আমলে সারা ইউরোপ এভাবেই চিন্তা করত। যার সার কথাটা হল – বিদেশী মাত্রই আমার শত্রু। আমার দেশে আমরা এক জাতি আর এর বাইরে সবাই ‘বিদেশী’ যার মানেই ওরা সবাই আমার শত্রু। এটাই জাতি-রাষ্ট্রের ধারণার চিন্তা ফ্রেম। য়াগে বলেছি এটা অবশ্য সারা ইউরোপ ১৯৫৩ সাল থেকে বাদ দিয়েছে। কিন্তু এর চেয়েও বড় কথা, বিদেশী মাত্রই শত্রু এ কথা সবসময় ঠিক নয়। বরং বিদেশীর সাথে ‘বাণিজ্যও’ করা সম্ভব আর তা দুদেশের জন্য বিরাট লাভজনক হতে পারে। বাণিজ্য মানে পণ্য বিনিময়, লেনদেন- এক পণ্যের বিনিময়ে অন্য পণ্য দেয়া। যেটা নিজ নিজ দেশের হাটবাজার-গঞ্জে করে থাকি, সেটাই তবে কিছু ভিন্ন রূপে বা ভিন্ন শর্ত-পরিস্থিতিতে।

যদিও আন্তঃরাষ্ট্র বা আন্তর্জাতিক পরিস্তিতিতে সেখানে আরেক বাস্তব টেকনিক্যাল সমস্যা আছে। সেটা হলো মুদ্রা। একটা দেশের সীমানার মধ্যে ওই দেশের মুদ্রা- এটাই পণ্য বিনিময় বাণিজ্যে বিরাট ও মূল ভূমিকা রাখে। কিন্তু সমস্যা অন্যখানে, আপনি পকেটে টাকা নিয়ে সারা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত চষে বেড়াতে পারবেন, যা মনে চান আর যা সেখানে পাওয়া যায় সব কিনতে পারবেন। কিন্তু দেশের সীমান্ত পার হলেই বাংলাদেশী মুদ্রা আর কাজ করবে না। আপনি বাধা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বেন। অর্থাৎ সীমান্ত ছেড়ে যাওয়া মানে তখন পড়শি দেশের মধ্যে একটা বিনিময় বাণিজ্যের অবস্থা। সেক্ষেত্রে অন্য কোনো দেশে বেচাকেনা মানে কেবল সে দেশের মুদ্রাই চলবে। তাই আপনার সে ক্ষেত্রে বাড়তি দরকার পড়বে একে তো মুদ্রার বিনিময় হার জানা আর মুদ্রা বিনিময় করে দিতে রাজি থাকা একটা দোকান বা ব্যাংক। আরো কথা আছে- আলোচ্য দুই দেশকে আইএমএফের সদস্য হতে হবে। নইলে বিনিময় হার জানাসহ আরো বহুবিধ জটিলতার মুখে পড়বেন। কেনাবেচা লাটে উঠবে। কিন্তু একটা বিশাল ঘটনা এখানে ঘটে গেছে। তা হল, এই দুই দেশের বাণিজ্য মানে জাতিরাষ্ট্রবাদী রাজনীতিবিদরা জন্মের পর থেকে দেখে আসছেন একটা গ্লোবাল বাণিজ্যের ব্যবস্থা চালু হয়েই আছে। তাই তারা ধরে নেন, এই ব্যবস্থাটা দুনিয়ার জন্ম থেকে নিশ্চয়ই ছিল।
এটাই শতভাগ মিথ্যে অনুমান। আইএমএফেরই জন্ম এইমাত্র ১৯৪৪ সালে। এর মানে এর আগে বিনিময় বাণিজ্য খুবই কঠিন না প্রায় ছিলই না, দরকারও কম ছিল, সে অন্য কারণে। এক কথায় আজ আইএমএফ যা করে এই পুরোটাই সেকালে করত মাত্র এক ব্যক্তির মালিকানার এক ব্যাংক আর ইউরোপের আর তিন-চার শহরে বসে থাকা তার তিন-চার ছেলে মিলে। সেদিকে এখন আর যাবো না। আরো যাবো না কমিউনিস্ট রহস্য-গল্প দূরে রাখার জন্য।
যে কথা বলছিলাম, তার মানে যেকোনো দুই দেশের মধ্যে পণ্য-বিনিময় বাণিজ্য মানে হল – আইএমএফের জন্ম এর আগেই হয়ে গিয়েছে আর এই বাণিজ্য আর কেবল দুই দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বা ‘লোকাল’ ঘটনা একেবারেই নয়। একটা গ্লোবাল বাণিজ্য ব্যবস্থা দুনিয়ায় চালু থাকা। তাতে জাতিবাদী মন যতই মনে করুক পড়শি দেশের সাথে বাণিজ্য একটা লোকাল ঘটনা, এটা কিন্তু একেবারেই সত্য নয়।
গত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই গ্লোবাল রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থাবলির পুরো কাঠামোই যে তৈরি হয়েছিল আমেরিকার নেতৃত্বে সেটা আমরা টের না পেয়ে বিদেশী পুঁজি, বিদেশী ঋণ ঘৃণাকারী যেই হই না কেন। একটা গ্লোবাল সিস্টেম আছে বা ১৯৪৫ সালে চালু হয়েছিল বলেই মোদী বা শারদ পাওয়ারের ‘দেশী অর্থনীতি’ নামক কল্পনা চালু আছে। নইলে তো বাণিজ্যের অভাবে না খেয়ে রাজনীতিবিদিদের মুখ দিয়ে কথাই বের হত না!

কাজেই আমাদের একটা বড় অবজারভেশন ও দাবি যে, ভারতের রাজনীতির সাধারণ ধারা হল তাদের এক প্রবল মিথ্যা অনুমান যে সব কিছুই ‘লোকাল’। তারা ‘বিদেশী’ বিরোধী। বিদেশী মাত্রই ভারতের স্বার্থবিরোধী ইত্যাদি যত সব মনগড়া কল্পনা আছে। মানে ভারতের অভ্যন্তরীণ চোখে দুনিয়াটাকে দেখা। কিন্তু এর বিপরীতে আমাদের মত রাষ্ট্রগুলোর উপরে একটা প্রবল প্রভাবশালী গ্লোবাল ব্যবস্থা বা গ্লোবাল অর্ডার কার্যকর থাকে ও সক্রিয় কাজ করে থাকে। সেই গ্লোবাল অর্ডারের অধীনে আমাদের অভ্যন্তরীণ বা লোকাল ঘটনাবলিগুলো তৈরি ও কার্যকর হয় ও ক্রিয়াশীল থাকে। কিন্তু আমরা তা টের পাওয়ার যোগ্য না হলে মনে হবে গ্লোবাল সিস্টেম বলে কিছু নেই। ভার্তে যা ঘটে তার সবই যেন তার অভ্যন্তরীণ স্বার্থ বা ইচ্ছা দিয়েই ঘটায়। সার কথায়- গ্লোবাল প্রেক্ষিতই বড় প্রভাব বিছিয়ে ঠিক করে দেয় লোকাল ঘটনাবলি কেমন ঘটবে। কাজেই স্থানীয় স্বাধীন কোন প্রেক্ষিতে লোকাল ঘটনাবলি ঘটে না, ঘটবে না। চীন পালটা আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক গড়ার উদ্যোগ ও এক নয়া গ্লোবাল ব্যবস্থা খাড়া করতে চায় বলে, চাইতে পারে বলেই ভারতের কাছে অফার আসতে পারে আসবে। আবার ভারত যদি ঠিক করতে বসে আমেরিকার চীন ঠেকানোর ঠিকা নিয়ে আমেরিকার সাথে ভাগ্যকে বেধে ডুবতে বসা সিস্টেমের নায়কের সঙ্গি হবে নাকি নতুন গ্লোবাল অর্ডার যে ঠিক করবে যে দুনিয়ার ভবিষ্যত ঠিক করবে তার সাথে যাবে – এটা কে বেশি সুবিধা দিবে সেই মামলা একেবারেই নয়। ভারতের ভবিষ্যত নতুন গ্লোবাল অর্ডারের ভিতরে – যদি গ্লোবাল অর্ডার জিনিষটা বুঝতে সক্ষম হন।
বয়ান দুইঃ শারদ পাওয়ার বলছেন, “ভারতের জন্য সত্যিকারের হুমকি হলো চীন, যে চীন ভারতের চেয়ে শক্তিশালী হয়ে গেছে। অতএব, ঐ চীনের সাথে, কমরেডদের সাথে আমাদের খুব গলাগলি আছে, (যেমন একই দোলনায় বসে মোদি-শিং দোল খাচ্ছে আর কথা বলছে) এমনটা এই ছবি দেখিয়ে য়ামাদের মাঝে যে শত্রুতা এর মোকাবিলা হবে না। মোদি হাত মিলাচ্ছে বা কুলাকুলিতে জড়িয়ে ধরছে প্রেসিডেন্টকে শি কে এটা হতে পারে না”।
এর চেয়ে জাতিবাদী বক্তব্য আর কী হতে পারে?
শারদ পাওয়ারের এসব কথা তাকে আরো নাদান কম চিন্তা ও সঙ্কীর্ণ বুঝের লোক বলে পরিচিত করবে। তার প্রথম সমস্যা শত্রু আর প্রতিদ্বন্দ্বী শব্দ দুটোকে মাখিয়ে ফেলা। যেমন ক্লাসের দুই ফার্স্ট-সেকেন্ড স্টুডেন্টের মধ্যে যেটা হয় সেটাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বলে, শত্রুতা নয়। স্পোর্টসে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় কিন্তু কেউ কারো শত্রু নয়।
সোভিয়েত ইউনিয়ন-আমেরিকার মধ্যে শত্রুতা ছিল তা সত্ত্বেও কোনো কোনো ফোরামে একসাথে বসে কথা বলা ও কাজ করার মতো বন্ধুত্ব থাকতেই হত। কিন্তু কোন বাণিজ্য সম্পর্ক, পণ্য লেনদেন ছিল না, গ্লোবাল বাণিজ্য সিস্টেমের সুবিধাও কার্যকর ছিল না। কিন্তু এটা ১৯৪৫-৯২ সাল পর্যন্ত। আর এর পর থেকে রাশিয়ার পুতিনসহ নিজেকে কমিউনিস্ট মনে করা (আজ অথবা আগের) সব রাষ্ট্রই আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের সদস্য হয়ে গেছে। মানে দুনিয়াটা এখন একই গ্লোবাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে এসে গেছে। যেটা এখনো আমেরিকার একার পকেটে সবচেয়ে বেশি নিয়ন্ত্রণে। আর এটাই ভেঙে পড়ছে ধীরে ধীরে আর চীনের নেতৃত্ব নতুন একটা ব্যবস্থা গড়তে, বদল ঘটাতে এগিয়ে আসছে। মোদী বা শারদের মত কথিত দেশী জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকরা আগেই আমেরিকার নেতৃত্বে গ্লোবাল অর্ডারের মধ্য থেকেও এর সম্পর্কে বেখবর থেকেছে। নিজের স্বনির্ভর-অর্থনীতি নামে সোনার-পাথর বাটি ধরণের কাল্পনিক ধারণার মধ্যে বসবাস করে গেছে বলে গ্লোবাল অর্ডারের পালাবদল ব্যাপারটা কখনও বোধগম্য হয় নাই। বাস্তবতা হল – ভারত চাইলেও পুরনো আমেরিকার নেতৃত্বের পুরনো অর্ডারের মধ্যে বসবাস করতে পারবে না। খোদ আমেরিকাকেও চীনের নেতৃত্বের গ্লোবাল অর্ডারের মধ্যে ঢুকতে হবে। কারণ একসাথে দুনিয়াতে দু’টি অর্ডার চালু থাকতে পারবে না। দুইটা আইএমএফ চালু থাকতে পারবে না।

একাধিক বিশ্বব্যাংক  যদিও থাকতে পারবে। তাহলে কেন চীন ভারতের শত্রু? আবার খেয়াল করতে হবে যে, চীন শত্রু না হলেও খুবই খারাপ প্রতিদ্বন্দ্বী সেই চীনই আবার বাণিজ্যের পার্টনার হতে পারে, পুঁজি বিনিয়োগদাতা ইত্যাদি এসবই একালে সম্ভব। কারণ কোল্ড-ওয়্যারের আমলে সোভিয়েত-আমেরিকা কোন একই বাণিজ্য ব্যবস্থার সদস্য ছিল না। সোভিয়েতরা বৈদেশিক বাণিজ্যে বিশ্বাস করত মনে হয় না। অন্তত এনিয়ে তাদের তাত্বিক অবস্থানও নাই। এটাই সেকালে শত্রুতা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হওয়া সম্ভব ছিল। সেটা একালে আর সম্ভব নয়। কারণ এখন চাল-ডাল মিলে গেছে, এখন আলাদা করা তত্বে সম্ভব বলে যদিও দেখাতেও পারে বাস্তবে এটা প্রায় অসম্ভব।
আবার ঘটনা হল, চীনের সাথে ভারতের নতুন ও পাল্টা আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক নির্মাণ প্রকল্প ব্রিকস, সেটা এতদিন ঠিকই চলছিল। এর মানে কী তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা শত্রুতা মিলিয়ে গেছিল, তা ছিল না? বিস্মিত হতে হয় শারদ পাওয়ারের চিন্তা না করে কথা বলে বসা দেখে। অথচ প্রতিদ্বন্দ্বিতা শত্রুতা যাই বলেন তা অবশ্যই ছিল। কিন্তু সবাই নখ লুকিয়ে ফেলা শত্রুতা সামনে না নিয়ে আসা অর্থে একটা কার্যকর লেনদেনের সম্পর্কের মধ্যে ছিল। এটা সম্ভব। আর এটাই একালের গ্লোবাল সিস্টেমের বৈশিষ্ট। যেটা জাতি ধারণা নিয়ে ধরাছোয়া যাবে না। সবই উলটাপালটা মনে হবে। কাজেই ভারতের সব দুর্দশার রুট কারণ এসব জাতিবাদী, বিদেশবিরোধী আজিব চিন্তা যা এদেরকে গ্লোবাল সিস্টেম বুঝতে সবসময় বিরাট বাধা হয়ে থেকেছে!

মোদী বা শারদের বিদেশ-নির্ভরতা বিরুদ্ধে কথা বলাটা ভুল। বিদেশের সাথে পণ্য-বিনিময় বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়া মানেই তা  বিদেশনির্ভরতা নাও হতে পারে। যদি ব্যাপারটাকে ইন্টারডিপেন্ডেন্সি –পরস্পরের উপর পরস্পর নির্ভরশীল হওয়া, একপক্ষীয় না এভাবে সাজানো যায়। আর ব্যাপক বৈদেশিক বাণিজ্যে জড়িয়ে যাওয়া মানে কিছু কিছু রপ্তানি পণ্যে মাস্টার উতপাদক হয়ে যাওয়া। মানে সবচেয়ে দক্ষ উতপাদক মানে সবচেয়ে কম শ্রমে তা উতপাদন করতে পারা নায়ক হওয়া। এসব নয়া ধারণা, বিদেশ-নির্ভরতা বিরুদ্ধবাদীদের মাথায় ঢুকবে না!

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

[এই লেখাটা  গত ২৫ জুলাই ২০২০, দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ওয়েবে ও  পরদিনই প্রিন্টেও  শারদ পাওয়ার সবার প্রতিনিধি– এই শিরোনামে উপ-সম্পাদকীয়তে ছাপা হয়েছিল।  পরবর্তিতে সে লেখাটাই এখানে আরও নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে এখানে আজ ছাপা হল। ]

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s