জাতিগিরির ‘স্বদেশী জাগরণ’ অচল ও পরাজিত
গৌতম দাস
১০ আগস্ট ২০২০, ০০:০৬ সোমবার

প্রসঙ্গটা ভারত থেকে শুরু করছি এমন হলেও ব্যাপারটা কেবল ভারতেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং এমন চিন্তার ফেনোমেনা আমাদের মত সব দেশেই কম-বেশি আছে। তাই এর প্রভাব সবখানে। কমিউনিস্ট প্রগতিবাদীরাও এনিয়ে বিভ্রান্ত থাকে, তাই প্রচ্ছন্নে সমর্থনও করে। ‘জাতি’ বা ‘স্বদেশীপনা’ ইত্যাদি ধরণের শব্দ দিয়ে এরা নিজেদের তুলে ধরে। যদিও এগুলা একেবারেই ভুল চিন্তা। কী প্রেক্ষিতে এমন চিন্তা দুনিয়ায় উদয় হয়েছিল তা ভুলে বা আমল না করেই নকল বা ‘আউট অব কনটেক্সট’ এক চিন্তাধারা এটা। বিশেষ করে যেখানে দেশ বা রাষ্ট্র বলতেই মনে খামোখা ‘জাতি’ বলে ধারণা হাজির হয়। জাতি ধারণাটাই fetish বা ভুতুড়ে অস্পষ্ট চিন্তা। কিন্তু তাসত্বেও আবার পরিস্কার থাকার দরকার আছে যে, ‘জনগোষ্ঠীগত কমন স্বার্থ’ অথবা ‘জনস্বার্থ’ বা ‘পাবলিক ইন্টারেস্ট’- এসব ধারণাগুলো সঠিক, ফলে এগুলো টিকে থাকবে। কারণ এধারণাগুলোর সাথে রাষ্ট্রে কোন ‘জাতি’ ধারণা থাকা না থাকার কোনো সম্পর্ক নেই, অনিবার্যও নয়।
আসলে কলোনি দখলবাজ ইউরোপের লুট করতে জাহাজ নিয়ে বেরিয়ে পরা ব্যবসায়ীরা এরা প্রতিদ্বন্দ্বি দেশের (যেমন ইংলিশের বিরুদ্ধে ফরাসি) দখলবাজদের বিরুদ্ধে নিজ নিজ দেশের কলোনি দখলবাজেরা এই জাতি ধারণা ছড়িয়েই দেশের সবপক্ষের পুর্ণ সমর্থন যোগাড় করেছিল। এখানে বিদেশি বিরোধিতা খুবই মুখ্য জিনিষ। যেমন ফরাসিদের বিরুদ্ধে ইংলিশ দখলবাজদের বিদেশিবিরোধিতা কথা তুলার তাগিদে যে তত্ব হাজির করেছিল এটাই জাতিবাদ বা জাতি ধারণার শুরু। এককথায়, অন্য (আমাদের মত দেশকে) কলোনিদখলকে সমর্থন আর এই অন্যায়কে দেশের ভিতর থেকে দ্বিধাহীন সমর্থন আর সাফাই পাবার তত্ব হল জাতিতত্ব বা জাতি ধারণা। তাহলে দাঁড়ালো, জাতি ধারণা আবার কার্যকর পেতে হলে পুর্বশর্ত হল কলোনি ব্যবস্থা দুনিয়াই আবার চালু থাকতে বা করতে হবে। অথচ.১৯৪৫ সালের পরের কপিবাজেরা, এই জাতিবাদীরা এটা কখনও খেয়াল করে দেখেনি।
একারণেই বিজাতীয় বা বি-জাতির বিপরীতে জাতি ধারণা – সেটা পরবর্তিতে যতই অপ্রয়োজনীয় ও নেতি হলেও তা সেকালে মিথ্যা করে “নিজেদের” বলে একটা ধারণা হাজির করে টিকানো হয়েছিল। সেই সাথে, বিদেশী মানেই খারাপ, বিদেশের বিরুদ্ধে ‘আমরা’ অথবা ‘স্বদেশী’ ধরনের এক ধারণা হলো জাতি। এখান থেকেই স্বদেশী পণ্য ভালো, তা মোটা ভাত বা মোটা কাপড় হলেও ভালো ইত্যাদি বলে ভুয়া দাবি করা হয়।
এ ছাড়াও ১৯৪৫ সালের পরের কলোনিমুক্ত বিপুলসংখ্যক মানুষের ধারণা হচ্ছে, একটা “জাতিবোধ” ছাড়া “দেশ”, “রাজনীতি” বা “রাষ্ট্রের” কল্পনা অসম্ভব। অথচ এসব ভিত্তিহীন কথা। কাজেই একটা জাতিবোধ থাকতেই হবে আর সেই সাথে কথিত “জাতীয়” বা দেশীয় পণ্যের প্রতি ভালোবাসা আর বিদেশী পণ্যের প্রতি ঘৃণা, পারলে তা বর্জন; না হলেও অন্তত কম-ভালোবাসা থাকার ‘স্বদেশীপনা’ তো থাকতেই হবে! এগুলা জাতি ধারণার পক্ষে ভুয়া বয়ান!
এখানে স্বদেশীপনা শব্দটা ব্যবহার করেছি নেতি ও ঠাট্টা অর্থে। অনেকটা ছেলেমিপনা, আদেখলাপনা বা পোলাপান শব্দের মত নেতিবাচক অর্থে। অর্থাৎ যাকে ‘স্বদেশী’ বলছি তা আসলে স্বদেশী বা দেশের জন্য ইতিবাচক নয়; সেটা বুঝাতে; আর আসলে তা নয় সেই হুঁশ আনার জন্যই এমন ব্যবহার।
আলোচনার সমস্যাঃ
এদিকে এ ধরনের আলোচনার সমস্যা হয় যেটা তা হল, ব্যাপারটা কী তা বুঝিয়ে বললেও এবং তা ভালই বুঝা গেলেও সেটা তত্ত্বগত ধারণার মত একটা দূরত্বেই থেকে যায়। তাই অবস্থা হয় – কথা সত্য কিন্তু মানতে পারব না- ধরনের। সেকারণে, আজ এখানে কোন তত্ব নয়, একেবারে বাস্তবে ঘটেছে, বাস্তব সমস্যা হিসেবে হাজির হয়েছে সেটা দেখিয়ে এখানে কথা বলে দেখাব যে, কথিত জাতিবোধের স্বদেশীপনা একটা ভুল ও অকার্যকর ধারণা। আর সেটা এখানে দেখাব ভারতের এখনকার বাস্তব সমস্যা বা উদাহরণের পরিপ্রেক্ষিতে।
আরো আছে। যেমন সমস্যা হচ্ছে প্রায় সবাই স্বদেশীপনা শব্দের সাথে পরিচিত। ফলে ধারণাটা জানা আছে কিন্তু কেউ বাস্তবে একালের নিজ নিজ দেশে ধারণাটা পরখ করে দেখেনি। তবে একালে ধারণাটার সত্যতা না থাকলেও এর একটা প্রবল আবেগী দিক আছে; ভুয়া হলেও তা একটা আবেগী জোশ তুলতে পারে – যেমন ‘দেশের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়া’ বা ‘কল্পিত বিদেশী বা শত্রুর বিরুদ্ধে এক হওয়া’ ধরনের; আর এটাই আমাদের মত দেশের রাজনীতিবিদেরা সবাই ব্যবহার করে গেছে এ পর্যন্ত করে চলেছে, আর সমানে ফায়দা তুলে গেছে। তাতে ধারণাটা সত্য না হলেও কোনো অসুবিধা হয়নি। যেমন ভারতে এমন আরেক চরম মিথ্যা আড়ালের শব্দ হল, “ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট”। আপনি সাংবাদিক আপনি জানেন কোন একটা কথা মিথ্যা। কিন্তু তবুও “ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট” এর নামে আপনি সেকথা সত্য বলে চালাচ্ছেন। এটা মূলত মিথ্যা বলে তা কোনভাবেই সাংবাদিকতাই নয় আপনি জানেন তবু আপনি তা সত্য বলে গ্রহণ করতে বলছেন!
তাহলে মিথ্যা হলেও তা ব্যবহারের সুযোগ কেন পাওয়া যায়ঃ
কেন এমন সুযোগ পাওয়া যায়? কারণ দুনিয়ার শুরুর দিকে পণ্য বিনিময়-বাণিজ্য-লেনদেন অবিকশিত অবস্থায় ছিল এবং স্বাভাবিক। তাই ব্যাপারটা মনে রাখার জন্য একটা সহজ সুত্র হল – কমুনিকেশন বা যোগাযোগ শব্দটা। যত ভাল বা বিকশিত কমিউনিকেশন ততই ভাল পণ্য বিনিময়-বাণিজ্য-লেনদেন।
কমিউনিকেশনঃ
ছোট একটা শব্দ কমিউনিকেশন, কিন্তু এর অর্থ অ-নে-ক গুলো। কমিউনিকেশনের অনেকগুলো রূপ। এখানে কমুনিকেশন শব্দের সঠিক মানে কোনটা? না সবগুলো, কোনটাই বাদ নয়। যেমন রাস্তাঘাট বুঝাতেও আমরা কমিউনিকেশন বলি। বলি কমিউনিকেশন ভাল না বা কমিউনিকেশন মিনিষ্ট্রি। কিন্তু তাও আবার সড়ক নাকি রেল নাকি এয়ার বা এরোপ্লেনের কমিউনিকেশন, এমন অনেকগুলো ভাগ আছে। আবার কমিউনিকেশন মানে তো ভাষাও, ল্যাঙ্গুয়েজ। আরো আছে। কমিউনিকেশন মানে টেলিফোন, টরেটক্কা করে পাঠানো পুরানাদিনের টেলিগ্রাফ। এমনকি তা বেতার, এফএম রেডিও অথবা পুলিশ-আর্মির ওয়ারলেস – রজারস। আবার কমিউনিকেশন মানে আইটি – এর নেটওয়ার্ক, ইমেল, ফেসবুক বা স্যাটেলাইট ইত্যাদি সব। অর্থাৎ এক কমিউনিকেশন শব্দ দিয়ে অনেক কিছুই বুঝায়। তা বুঝাক কোনই অসুবিধা নাই।
তবে আসল কথাটা হল, দুনিয়াতে এই কমিউনিকেশন যত বিকশিত ততই, পণ্য বিনিময়-বাণিজ্য-লেনদেনও সে মাত্রায় ব্যাপক। আর যতদিন দুনিয়ায় কমিউনিকেশন দুর্বল বা অবিকশিত বলে দুনিয়ায় কোণায় কোণায় থাকা মানুষকে চেনাজানাও দুর্বল থাকে; মানে মানুষে মানুষে পণ্য বিনিময়-বাণিজ্য-লেনদেন বিকশিত নয় বা নাই । অথবা এক জনগোষ্ঠীর সাথে অন্য জনগোষ্ঠী এবং অন্য সব জনগোষ্ঠীর সাথে পণ্য বিনিময়-বাণিজ্য-লেনদেন নাই অথবা তেমন নাই অর্থাৎ ব্যাপক হয়ে না উঠেছে, তত দিন স্বদেশীপনা ধারণাটা যে মিথ্যা বা ধারণাটার যে সমস্যা তা টের পাওয়া যায় না।
গত ১৬০৭ সাল থেকে ধরা হলে পরের প্রায় ৩০০ বছর ধরে দুনিয়ায় চালু ব্যবস্থাটা বলি কলোনি যুগ; যখন দখলবাজ ছোটবড় পাঁচ-ছয় রাষ্ট্র বাকি প্রায় সব দেশকে দখল করে কলোনি বা উপনিবেশ যুগ কায়েম করেছিল। সে সময় কোনো দেশের বাইরে পণ্য বিনিময় লেনদেন বলতে ছিল মুলত দখল-মালিক দেশ আর প্রজা দেশের মধ্যে; তাও আবার ছিল একপক্ষীয়- মূলত প্রজা বা দখলি-হওয়া দেশ থেকে লুটেরা সম্পদ দখল-মালিক দেশে নেয়া (যেমন ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া থেকে ব্রিটেনে) – এই রকম। এ ছাড়া ওদিকে পাঁচ-ছয়টা কলোনি দখলদার মালিকের নিজেদের মধ্যে লেনদেন – সেটাও ছিল প্রায় নাই না খুবই সীমিত পর্যায়ে। তাই জাতি ধারণা আর স্বদেশীপনা যে ভুয়া অচল ধারণা তা ইউরোপ কলোনিযুগে টের পায়নি। আবার কলোনি যুগের প্রায় ৩০০ বছর ইউরোপ ‘বিদেশী মাত্রই শত্রু’ গণ্য করা জাতি ধারণার জাতিরাষ্ট্র, নেশন-স্টেট ছিল। এটাই কলোনি-মালিক জাতি-রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে লেনদেন ও বিনিময় বাণিজ্য প্রায় ‘নাই’ ধরনের সীমিত হয়ে থাকার আরেক কারণ। সুতরাং, এক কথায় ‘জাতি’ ধারণাটা বা দেশকে জাতি বলে বুঝা – এটা মূলত কলোনি দখল করা যেসব দেশের মূল ব্যবসা তাদেরই অনুসৃত ও প্রচলিত ধারণা। এদের চিনবার মূল বৈশিষ্ট্য হল এরা জাত বা জাতির বাইরে কারো সাথে লেনদেন-বাণিজ্য-বিনিময় পছন্দ করে না, খারাপ মনে করে। তাই এখান থেকেই বিদেশির বিরুদ্ধে স্বদেশী বলে ধারণা জন্মানো সহজ ও সম্ভব।
এজন্যই, স্বদেশী-জাতি-কলোনি যুগ এগুলো সম্পর্কযুক্ত শব্দ। কলোনি যুগেই জন্ম বলে জাতি বা স্বদেশী ধারণা সেখানে প্রথম পাওয়া যায়। দুনিয়াতে প্রথমত জাতি বা জাতিরাষ্ট্র ধারণাটার জন্ম বা পাওয়া যায় কলোনি যুগে; মানে ১৬০৭-১৯৪৫ অর্থাৎ প্রায় ৩০০ বছরের সময়কালের এবং মূলত ইউরোপে।
কিন্তু পরবর্তিতে মানে কলোনি যুগ-পরবর্তী সময়কাল আগের কলোনি সময়ের তুলনায় অনেক ছোট, ৩০০ এর বিপরীতে মাত্র প্রায় ৭৫ বছর। এই পঁচাত্তর বছর, ১৯৪৫ থেকে একাল পর্যন্ত সময়টা কলোনিমুক্ত স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়ার কাল। মোটা দাগে বললে সবার আগে কলোনি মুক্তি ঘটেছিল এশিয়ায়; পরে ল্যাটিন আমেরিকা আর শেষে ১৯৮০ সালের মধ্যে আফ্রিকা (সাউথ আফ্রিকা বাদে) সবাই প্রায় স্বাধীন হয়ে যায়। ফলে এবার সব রাষ্ট্রের সাথে সব রাষ্ট্রের লেনদেন-বাণিজ্য-বিনিময় ব্যাপক রূপ নেয়া শুরু হয়। তবে কমিউনিস্টরা লেনদেন-বাণিজ্য-বিনিময় ব্যাপারটা নিয়ে শুরু থেকেই অস্পষ্ট ও দ্বিধায় ছিল বলে তারা বাণিজ্যে রাজি হয়নি মূলত সোভিয়েত ইউনিয়নের কারণে। এছাড়া আর ১৯৫৩ থেকে ১৯৯১ সাল- এই কোল্ডওয়্যারের যুগের কারণে। ফলে সোভিয়েতকে অনুসরণ করে পুরা কমিউনিস্ট ব্লক লেনদেন-বাণিজ্য-বিনিময় করতে আসেনি, যোগ দেয় নাই। পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে গেলে ১৯৯২ সাল থেকে সকলেইও অবশ্য বাণিজ্যে যোগ দেয়।
কিন্তু এর আগেই সব অর্গল খুলে যায়। কারণ, আশির দশকের শুরু থেকেই গ্লোবালাইজেশন শুরু হয়ে গিয়েছিল। মানে যেকোনো দেশের সাথে যেকোনো দেশের লেনদেন-বাণিজ্য-বিনিময় ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হতে শুরু করেছিল। বাংলাদেশে আমাদের জন্য তা সহজে বোঝার চিহ্ন হল, যখন থেকে আমরা গার্মেন্ট এক্সপোর্ট শুরু করি এবং ক্রমে তা বাড়াতে থাকি।
একটা পর্যবেক্ষণ হিসাবে বলা যায়, গত ৪০০ বছরের দুনিয়ায় দেশ (রাষ্ট্র)গুলোর মধ্যে লেনদেন-বাণিজ্য-বিনিময় উন্মুক্ত ও পরিপাটি ব্যবস্তা ছিল মাত্র প্রায় পচাত্তর বছর। যার আবার সক্রিয় বাণিজ্য চালু ছিল কেবল মাত্র শেষের চল্লিশ বছর। আর এর ইমিডিয়েট আগের ১৯৪৫ সালথেকে চালু হওয়া ব্যবস্থায় রাষ্ট্রগুলো পরস্পরের কাছে বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত থাকলে ব্যাপক লেনদেন-বাণিজ্য-বিনিময় চালুর প্রস্তুতি নিতেই প্রথম ত্রিশ-পয়ত্রিশ বছর চলে যায়। এখন একটা সাধারণ সূত্র হলো, লেনদেন-বাণিজ্য-বিনিময় না থাকা মানেই সেটা হবে জাতি বা জাতি-রাষ্ট্র বা স্বদেশী চিন্তার কাল। আর যতই গ্লোবালাইজেশন, ততই লেনদেন-বাণিজ্য-বিনিময় ব্যাপকতর; ততই বাস্তবে জাতি বা জাতিরাষ্ট্র বা স্বদেশী চিন্তার অকার্যকারিতা বা বিলুপ্তির দিকে চলে যাবে।
আবার মজার ফ্যাক্টস হলো, ইউরোপ ১৯৪৫ সালের পরে জাতি বা জাতিরাষ্ট্র বা স্বদেশী চিন্তা ত্যাগ করে সরে যায় অধিকারভিত্তিক রাষ্ট্রে নিজেদের রূপান্তরিত করে নিয়ে।
কিন্তু ট্রাজেডিটা হলো ইউরোপ রূপান্তরিত হয়ে গেলেও আমরা জানি না আর তাল বুঝি না বলে অবুঝ-নাবুঝ হয়ে আমাদের মত দেশের বেলায় রাষ্ট্রের মডেল হয়ে যায় ইউরোপের ফেলে দেওয়া ঐ ‘জাতি’ ধারণা। মানে, জাতিরাষ্ট্র বা স্বদেশী চিন্তা। এমন চিন্তার সপক্ষে কমিউনিস্টদের সাপোর্টও ছিল। কারণ তারাও বিভ্রান্ত। এখনো বেশির ভাগই জেনে না জেনে জাতি-রাষ্ট্র করে থাকে। অথচ এটা স্ববিরোধী। কারণ জাতিরাষ্ট্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ অর্থনীতি হল, কলোনি দখল যুগে থাকা এবং দখলবাজ হয়ে থাকা। আর অপর বৈশিষ্ট্য হল প্রায় নাই অথবা খুবই সীমিত বৈদেশিক লেনদেন-বাণিজ্য-বিনিময়ে থাকা। যার সোজা মানে কলোনিমুক্ত স্বাধীন দেশগুলো জাতি বা স্বদেশিপনা ধারণাগুলো আকড়ে আপন করে নিয়ে থাকা এতা এক চরম স্ববিরোধিতা। এজন্য এরা মুখে বলবে স্বদেশিপনা আত্মনির্ভরতা ইতাদি ছেদো কথা। কিন্তু ডলার দেখলে ডলার পেতে এক্সপোর্ট করতে লালা পড়বে। আপনি যদি স্বদেশি অর্থনীতির লোক তবে ঐ প্রাপ্ত ডলার দিয়ে কী করবেন? বলাই বাহুল্য ঊনি আমদানিওও করবেন আর ঐ আমদানির মুল্য শোধ করতে ঐ ডলার ব্যভার করবেন। তাহলে কী দারালো আপনি আসলে সবটাতে সবখানেই আছেন। অথচ হুদাই স্বদেশিপনা বিদেশিবিরোধিতার ভাব ধরেন।
এই স্ববিরোধিতা কী ধরনের সঙ্কট নিয়ে হাজির হয় তা এখন আমরা দেখব ভারতের ক্ষেত্রে। সেখানে ১৯৪৭ সালে জন্ম থেকেই এখানে জাতিরাষ্ট্র ধারণাকে খুবই শক্ত করে (অন্তত আমাদের চেয়ে অনেক বেশি) আঁকড়ে ধরা এক রাষ্ট্র গড়েছিল। এর উপর আবার ‘জাতি’ বলতে এটা হিন্দু-জাতির এক জাতিরাষ্ট্র বুঝে তারা। গত ২০১৪ সাল থেকে বিজেপি ক্ষমতায় আসাতে এই হিন্দু জাতিরাষ্ট্র বোধ সবার উপরে তাদের চাপানোর ঝোঁক আরো প্রবল। এখন চীনের সাথে সীমান্ত সঙ্ঘাতে ২০ সেনাকে হারিয়ে যতই স্বদেশীপনাকে নরেন্দ্র মোদী আঁকড়ে ধরতে চাইছেন ততই জাতিরাষ্ট্র, হিন্দুত্ব বা স্বদেশীপনা ধারণার অকার্যকারিতা আর ভুয়া আবেগসর্বস্বতা প্রকট হয়ে হাজির হচ্ছে।
বাস্তব উদাহরণ হিন্দু জাতিরাষ্ট্র ও এর স্বদেশীপনাঃ
ভারতের একটা মিডিয়া রিপোর্ট পড়ে শুরু করা যাক। দ্য হিন্দু পত্রিকার ঘরেরই আরেকটা পত্রিকা আছে যেটা ব্যবসা-বাণিজ্যকে প্রাধান্য দিয়ে প্রকাশিত হয়, এর নাম ‘হিন্দু বিজনেস লাইন’ [Hindu Business Line]। সে পত্রিকার ২৭ জুলাইয়ের এক লিডিং রিপোর্ট বলছে, জাপান ভারতের কাছে এক আজব অনুরোধ রেখেছে। ঐ খবরের শিরোনাম দেখেন,
Japan to India: Don’t increase tariff on Chinese inputs used by Japanese firms
যার বাংলা করলে মোটের উপর কথাটা হল, ‘ভারত যেন চীন থেকে আসা পণ্যের ওপর বাড়তি ট্যাক্স এবং কোনো কোনো চীনা পণ্যের আমদানির উপরেই যে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে তা যেন আরোপ না করা হয়।’ জাপানের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ ট্রেড প্রমোশন ডিপার্টমেন্ট এই অনুরোধ নিয়ে মোদী মন্ত্রিসভার দরবারে এসেছে তদবির করতে।
এখানে পিছনের কথা আগে একটু বলে নেই। চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষ, অন্তত ২০ জন ভারতীয় সেনা নিহত হওয়ার পর পালটা প্রশাসনিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে মোদি ভারতে সাথে চীনের বাণিজ্য সম্পর্ককে বিরূপ করে তুলতে সব মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই সাথে চীনা পণ্য বর্জনের রাজনৈতিক কর্মসূচিও নিয়েছিলেন। এই প্রপাগান্ডা কাজের জন্য আগে থেকেই বিজেপি-আরএসএস এর দলীয় এক অঙ্গ-সংগঠন তৈরি করাই ছিল, যার নাম ‘স্বদেশী জাগরণ মঞ্চ’ [Swadeshi Jagran Manch ]। নাম শুনে নিশ্চয় বুঝা যাচ্ছে এর কাজ হল স্বদেশিপনা দেখানো। এখন দেশে-বিদেশে এই সংগঠনের তৎপরতাই জোরদার করা হয়েছে- চীনা পণ্য বর্জনের স্লোগান এদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে। যেমন ইন্ডিয়ান ক্রিকেটে এবারের কোন এক টুর্ণামেন্টে স্পন্সর হয়েছিল চীনা মোবাইল কোম্পানি ‘ভিভো’ [VIVO]।
তবে বলাই বাহুল্য, এটা স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সাথে মিলে চীনা ভিভোর সাবসিডিয়ারি কোম্পানি। এখন মোদী চীনা কোম্পানির উপর বৈষম্য বা বিরূপতা আরোপের নির্দেশ জারি করাতে ওই জাগরণ মঞ্চ ক্রিকেট বোর্ডের কাছে ভিভোকে বাতিল করার আবেদন নিয়ে যায় এই যুক্তিতে যে, এটা চীনা কোম্পানি বলে এদেরকে স্পন্সর দেয়া হয়েছে ‘জাতির বর্তমান মুডের বিরুদ্ধে’ বোর্ডের করা কাজ [because Vivo is a Chinese company and BCCI’s move goes against the “current mood of the nation”.]।
এছাড়া ওদিকে সিনিয়র মন্ত্রী নীতিন গড়করি যিনি বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প দেখাশুনা করেন, তিনি গত ১ জুলাই ঘোষণাই করে দিয়েছেন কোনো চীনা কোম্পানি ভারতে টেন্ডারে অংশ নিতেই পারবে না [India to ban Chinese companies from highway projects, says Nitin Gadkari]। অর্থাৎ চীনা কোম্পানির সাথে segregation বা বিচ্ছেদ ইতোমধ্যেই মাঠে কার্যকর। একই হিসাব মতে, ম্যানুফাকচারিং খাতেও চীনা পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়েছে, না হয় শুল্ক এমন বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে যেন কেউ আমদানি না করে।
অনেকেরই ধারণা, ভারতে চীনের প্রতিদ্বন্দ্বী জাপান। এছাড়া চীনবিরোধী চার দেশ জাপান, ভারত, অস্ট্রেলিয়া আর আমেরিকা- এদের জোট ‘কোয়াড’ যার মধ্যে জাপানও আছে [কোয়াড নিয়ে জানত আমার এক গতবারের লেখার কোয়াড আসছে এই শিরোনামের প্যারাটা দেখে নেয়া যেতে পারে। ] । এবং আমেরিকা আশা করছে তারা সামরিক জোট হিসেবে কাজ করার কথাও চিন্তা করবে; এদের তো এতে পোয়া বারো। তাহলে তো জাপানের এখন চার দিকে লাভ আর লাভ হওয়ার কথা।
কিন্তু হতাশ করা কথা হল তা ঘটছে না! আমরা বরং দেখছি উলটা এই জাপানই তার ট্রেড প্রমোশন বিভাগ দিয়ে মোদীর কাছে দেনদরবার করছে যেন, চীনা পণ্য আমদানি অটুট থাকে, কোন বাড়তি ট্যাক্স আরোপ না করা হয়; চীনকে ভারতে নিজ পণ্য রপ্তানীতে কোনো ধরণের বাধা না দেয়া হয়। কেন?
এর সোজা মানে তাহলে ভারতের চীনা পণ্য বর্জনের দেশপ্রেম, স্বদেশীপনা বা জাতিগিরি ফলানো এগুলো অচল হয়ে যাচ্ছে।
জাপানের চীনা পণ্যের প্রতিইবা এমন দরদি মায়া কেন?
ভারতে গাড়ির কোম্পানির বেশির ভাগই জাপানি ব্র্যান্ডের সাথে জয়েন্ট ভেঞ্চার। অন্তত প্রাইভেট কার – এই গাড়ির মার্কেটে। কিন্তু তা হলে হবে কী, এর ম্যানুফেকচারিং ও অ্যাসেম্বলিতে যন্ত্রাংশ-স্পেয়ার – ভারত বা জাপান কেউই নিজেরা বানায় না। চীন থেকে কিনে আনে। আর অ্যাসেম্বল বা জোড়া লাগিয়ে জাপানি গাড়ি তৈরি করা হয়। কেন? কারণ ওসব পার্টস জাপানে তৈরি করলে গাড়ির দাম বেড়ে যাবে। কারণ লিভিং কষ্ট বা লেবার কষ্ট বা ন্যূনতম মজুরি জাপানে অনেক বেশি। আবার ভারতেও তা তৈরি করতে গেলে সে ক্ষেত্রেও চীনের তুলনায় অদক্ষতার কারণে দাম বেশি পড়বে, কোয়ালিটিও খারাপ হবে সামগ্রিকভাবে মোট কথা জাপানি গাড়ি বিক্রির প্রফিটে টান পড়বে। অতএব চীনা পার্টস হলে কী হবে ওটাতেই মোক্ষ। এতে অবশ্য পিছনের একেবারে মুখ্য কারণ, চীনা যেকোনো ম্যানুফ্যাকচারিং কারখানায় প্রোডাকশন লাইন সাজানোর নতুন কৌশল। এটা অ্যাডভান্সড ম্যানেজমেন্ট বুদ্ধিতে সাজানো। ফলে তা দক্ষ এবং কম উৎপাদন খরচ বলে সবার চেয়ে কমপিটিটিভ। আর সেটার লোভেই জাপানিরা কোয়াড জোটের কথিত সামরিকতার লোভ ভুলে উলটা মোদীর কাছে চীনকে ভারতে পণ্য রপ্তানিতে রেখে দেয়ার সুপারিশে লেগে পড়েছেন।
ওদিকে অবশেষে ক্রিকেট বোর্ড ভিভো মোবাইলের কী অবস্থা বা পরিণতি?
এটাকে বলে, “পুণঃ মুসিক ভব!”। মানে আবার ইদুঁর হয়ে যা। দয়াপরবশ হয়ে এক সাধু এক ইঁদুরকে বিরাট ক্ষমতাবান বানিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু মানুষ এত অত্যাচারিত হোয়ার অভিযোগ উঠতে থাকে যে বিরক্ত হয়ে সাধুকে বলতেই হয়, “পুণঃ মুসিক ভব!”। মানে আবার ইদুঁর হয়ে যা। ভিভোকে কিভাবে রেখে দেওয়া যায় এর তদবীর শুরু হয়েছে। কারণ এক. প্রতিবছর প্রায় ৪৪০ কোটি রুপী করে পাঁচ বছর ধরে টাকা দিয়ে আসছে। লোভ লাগার মত ভাল পরিমাণের টাকা, কারোণ এই চীনা মোবাইল ওয়ান অব দা টপ পছন্দের তাই বোর্ডকে অফার করার ক্ষমতাও প্রতিদ্বন্দ্বিদের চেয়ে বেশি। এছাড়া এখন ভিভোকে বাদ দিবার কথা তুললে উলটা ক্ষতিপুরণ দিতে হতে পারে। আর দুই. বোর্ড এখন অমিত শাহের ছেলের কর্তৃত্বে ফলে তিনি ভিভোকে নিয়েই এগিয়ে যাবার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। ফলে এখন ঘটনা মোদীর হাতে তিনি নিশ্চয় শেষ মীমাংসাটা দিবেন। ভিভো-কে স্পন্সরশিপ থেকে বাদ দিতে গিয়ে দেখে তাদের প্রফিট মার্জিনে টান পড়ছে। কাজেই মোদীকে বলে, ভিভোকে রেখেই চলা যায় কিনা!
অর্থাৎ সার কথা চীনাপণ্য ভারতের বাজারে ঢুকেছে নিজ যোগ্যতা ও পণ্য ক্রেতা মনোরঞ্জনের ক্ষমতার জোরে। এটাই হলো সরাসরি কথিত স্বদেশীপনা বনাম গ্লোবালাইজেশন। যে পণ্যে যে সবচেয়ে নিচের কম খরচে মানে কম শ্রমে ও দক্ষতায় বানাতে পারে, সবাই ওই পণ্য তার কাছেই কিনবে- এটাই হলো গ্লোবালাইজেশনের ভিত্তি। তাতে সে দেশী-বিদেশী না কোন দেশী সেটা কোনো বিবেচ্য নয়। ফাঁপা আবেগের দেশীবোধ বলে কিছু নেই। দেখাই যাচ্ছে এটা কাজ করছে না। অর্থাৎ গ্লোবালাইজেশনের এত ভিত্তি ও খেলার নিয়মে প্রত্যেক রাষ্ট্রকেই কোনো না কোনো পণ্যে বা ওর কোনো পার্টস উৎপাদনে সবচেয়ে কম শ্রমে ও বেশি দক্ষতায় বানাতে পারতেই হবে। তা হলেই ভ্যালু অ্যাডেড প্রোগ্রামে তাকেও অন্য সব রাষ্ট্র গোনায় ধরতেই হবে। চাইলেও বাদ দেয়া যাবে না। এভাবেই যা কিছু দেশটা ভোগ করে তার সব কিছুই আর স্বনির্ভরতা বা আত্মনির্ভরতার ভুয়া স্লোগান দিয়ে নিজের অদক্ষ হাতে বানাতে হবে না। বরং এর বিপরীত ‘গিভ অ্যান্ড টেক’। আরো বেশি করে পরস্পর পরস্পরের ওপর নির্ভরশীলতায় জড়িয়ে পড়তে হবে যাতে কেউ আলগা ‘ফুটানি’, বেশি দাম, বেশি গরজ তৈরি করতে না পারে। বরং সবাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
তবে এখানে একটা মধ্যবিত্তের পেটিমনকে সামলাতে হবে যেন ছিঁচকে সমালোচনার চোখে না দেখা হয়। যেমন কেউয়ু বলল চীন ছাড়া ভারতের চলেই না। না এমন খোটা দেয়া পেটি সংকীর্ণ চিন্তা। যদিও তা টংয়ের চা দোকানে চলবেই বন্ধ করা যাবে না।
ব্যাপারটা হল গ্লোবালাইজেশন অন্যকে নিচা দেখানোর জন্য নয়। বরং সবাই যেন কোন না কোন একটা পণ্য সবার চেয়ে বেশি দক্ষতায় উতপাদন করতে পারে – পারুক এই উদ্যোগ সফল হোক সেই কামনা। কারণ সে সফল হলে আমরা সবাই ঐ সফলতার ভাগ নিব। ব্যাপকভাবে পারস্পরিক পণ্যবিনিময়ে মেতে উঠব। একা একা কথিত স্বনির্ভরতা অর্জনের নামে আসলে অদক্ষতায় কোয়ালিটি খারাপ দাম বেশি এমন পণ্য গলাধকরণ করার বিপরীতে ব্যাপকভাবে নির্ভরশীলতা কিন্তু এটা একা না সবাই সবার উপর নির্ভরশীল এমন ইন্টার ডিপেন্ডেন্সি – তৈরি করার সম্পর্ক। যাতে কেউ একজন ডাট দেখানো, বেশি অন্যায় সুবিধা না নিতে পারে তা কমে আসে – এটাই গ্লোবালাইজেশন । যাতে চাইলেই কেউ যুদ্ধ লাগিয়ে না দিতে পারে। কারণ যেখানে বোমা ফেলার কথা ভাবছে সেখানে ঐ শহরে নিজের স্বার্থও আছে। আর কেউ নিজের মাথায় বোমা মারে না। কাজেই ডায়লগ আর বুঝমান হওটাটাই উভয়পক্ষের লাভ, সহজ রাস্তা।
ভারতে চীনের রাষ্ট্রদুত সান ওয়েদং এক ওয়েবনিয়ার অন লাইন আলোচনায় এটাই মন্তব্য বা হেদায়েত করে ছেন। বলেছেন ভারত-চীনের অর্থনীতিতে বিচ্ছেদ আনা বা দুরত্ব তৈরি করা হবে একালের স্বাভাবিক স্রোতের উলটা হাটার চেষ্টা। এটা সফল হবে না। তিনি ঐ আলোচলায় ডাটা দিয়ে দেখিয়েছেন, স্পেয়ার পার্টস বা যন্ত্রাংশ কম্পিউটারে ৯২%, টিভিতে ৮২%, নেটওয়ার্কের অপটিক্যাল ফাইবারে ৮০%, মটরসাইকেলে ৮৫% ইত্যাদি এভাবে চীনাপণ্য ভারতে আপদানি করা হয়ে থাকে।
কিন্তু সাবধান এটা ভারতকে ছোট দেখানোর জায়গা থেকে পড়বেন না। ভারতকে তার ভোগ্য সব পণ্য বানাতে হবে, আর সবখাতেই দক্ষ হতে হবে ইত্যাদি না একেবারেই না। এটাই জাতিচিন্তার লাইন। স্বদেশিপনার লাইন। বরং এসব উপেক্ষা করে এর বিপরীতে বরং ভারত কোন কোন পণ্য বানাতে পেরেছে আর এতে (হোক তা খুবই ছোট পণ্য) সর্বোচ্চ দক্ষতা অর্জন করাতে সেই পণ্যের উপর চীনের নির্ভরশীলতা তৈরি হচ্ছে, আর ঐ পণ্য চীনে আমদানি আস্তে আস্তে বাড়ছে – এসব নির্মাণ হল আসল পথ। ৈ যে বললাম হোক তা খুবই ছোট পণ্য এনিয়ে এই তাইওয়ানি উতপাদকের এক প্রবাদমূলক ব্রিলিয়ান্ট বয়ান হল, মাথা হতে হবে, হাতির মত বড় কিছুর মাথা না হতে পারলেও অসুবিধা নাই। কিন্তু মাথা হতে হবে। কিছু না পারলে মুরগীর মাথা হয়ে দেখান।
এই হল কথিত জাতি বা মিথ্যা স্বদেশিপনা ধারণার বিপরীতে পারস্পরিক গভীর নির্ভরশীলতার সঠিক লাইন।
কিন্তু গত লেখার শিরোনামেই বলেছিলাম ভারত এই বুঝ ধারণ করতে বা সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। কেন?
কারণ, সারা ভারতকে জন্ম থেকেই এই মিথ্যা অচল – ‘জাতি’ বা স্বদেশি ধারণায় বুঁদ করে রাখা হয়েছে। ডুবে আছে। একালে মোদী জমানায় একথাগুলোকেই মিথ্যা হলেও আরও শানিয়ে তোলা হয়েছে। আর এর সাথেই তাদের হিন্দুত্বের ধারণা জুড়ে রাখা হয়েছে, হিন্দুত্ব কেন শ্রেষ্ঠ এর সাফাই টানা হয়েছে। আর এই হিন্দুত্ব বিক্রি করেই, হিন্দুত্বের গর্ব উস্কানি দিয়েই এবার হিন্দুভোট তার ভোট সংগ্রহের বা ভোট টানার মূল মেকানিজম। এজন্য বলেছি মোদী পারবেন না। কিন্তু সেটা তত্বকথা ঠিক আছে থাক। বাস্তবে মোদী কী করে তকার গভীর উভয় সঙ্কট সামলান, কী পরিণতি হয় সেটা দেকার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে, তবে তা প্রত্যক্ষে দেখতে পাওয়া হবে আমাদের জন্য এক অর্জন।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
[এই লেখাটা গত ০৮ আগষ্ট ২০২০, দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ওয়েবে ও পরদিনই প্রিন্টেও “জাতিগিরির ‘স্বদেশী জাগরণ’ অচল” – এই শিরোনামে উপ-সম্পাদকীয়তে ছাপা হয়েছিল। পরবর্তিতে সে লেখাটাই এখানে আরও নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে এখানে আজ ছাপা হল। ]