কোল্ড ওয়ার ‘টু’ বলে কিছু ঘটবে না
গৌতম দাস
১৭ আগস্ট ২০২০, ০০:০৬
‘কোল্ড ওয়ার’ [COLD WAR]; যার সরাসরি আক্ষরিক বাংলা কেউ কেউ করেন “ঠাণ্ডা যুদ্ধ”। তবে তাতে এর অর্থ খুব একটা পরিষ্কার হয় না। এছাড়াও আরেকটা বাংলা অনেকে করেন – “স্নায়ুযুদ্ধ”। নার্ভে লাগে এমন টেনশন অর্থে নার্ভ বা স্নায়ুতে চাপ ফেলে যে যুদ্ধ। কিন্তু কোনোটাই অর্থ ঠিক পরিষ্কার করে না। তবে কেন কোল্ড ওয়ার নাম – এর ব্যাখ্যাটা একটা পাওয়া যায় যে, ‘যুদ্ধ’ বলতে আমরা যা বুঝি তাকে যদি ‘হট ওয়ার’ বলে বুঝি তবে যেটা ঠিক যুদ্ধ না হলেও যুদ্ধের মতই একটা রেষারেষি অস্থিরতা আর সব সময়ের জন্য লেগে থাকা টেনশন – এ অবস্থার নাম দেয়া যায় ‘কোল্ড ওয়ার’। এই হলো সূত্র। আর কোল্ড ওয়ারের মূল দুই বৈশিষ্ট্য হল যখন দুই দেশের মধ্যে ঠিক যুদ্ধ পরিস্থিতি বা সেনা সমাবেশ নয়, কিন্তু যুদ্ধকালীন সময়ের মত একটা বিরাট টেনশন সব সময় সক্রিয় থাকে। এছাড়া সব সময়ই একপক্ষের কোন পদক্ষেপের বিরুদ্ধে অপরপক্ষ এক পাল্টা পদক্ষেপের কথা চিন্তা করতেই আছে – এমন অবস্থা। তবে একটা কথা মনে থাকতে হবে যে, কোল্ড ওয়ার বলতে অবশ্যই আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার ব্যাপার হিসাবেই তা কেবল হাজির হয়েছিল। আর এই প্রতিযোগিতা মূলত পরাশক্তিগত লড়াই, গ্লোবাল ইকোনমিক ব্যবস্থা বা গ্লোবাল অর্ডারের নেতা হবার লডাই নয়। কারণ গ্লোবাল বাণিজ্যের কী হবে, চলবে কী করে কি ব্যবস্থায় এটা সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সারা কমিউনিস্ট জগতের কারই ভাববার এজেন্ডা নয় বা কমিউনিস্ট রাজনীতিই নয়। কাজেই সাকথায় কোল্ড ওয়ার মূলত পরাশক্তিগত – গ্লোবাল ক্ষমতা বাড়ানোও প্রভাব বাড়ানোর লড়াই যা অর্থনীতিগত কোন কিছুই নয়।
কেন এরকম?
সোভিয়েত ইউনিয়নে লেনিনের রুশ কমিউনিস্ট বিপ্লব হয়েছিল ১৯১৭ সালে। এ সময়টা ছিল এমনই যখন সে দেশে কী হচ্ছে সে দিকে মনোযোগ দেয়ার অবস্থায় ছিল না ইউরোপের কেউ; মানে ইউরোপের কলোনি দখলদার মালিকদের কারো। কারণ এর চেয়েও বড় স্বার্থ নিয়ে তারা সবাই ডুবে ছিলেন। সেটা হল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। মাতব্বরেরা সবাই যুদ্ধে যার যার স্বার্থ নিয়ে একেবারেই ডুবে ছিল, যে যুদ্ধ চলেছিল ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ সময়কালজুড়ে। এই যুদ্ধে জার্মানিকে সামলাতেই ইউরোপের বাকিরা কঠিন হিমশিম অবস্থায় পড়েছিল। আর এ সুযোগ নিয়ে সবাব অলক্ষ্যে লেনিনের বিপ্লব বা ক্ষমতা দখল সম্পন্ন হয়ে যায়। সেই থেকে আলাদা রাজনৈতিক ব্যবস্থার দেশ বলে সোভিয়েত ইউনিয়ন ইউরোপের ঘটনাবলি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েই কাটিয়ে দিয়েছিল। এরপর ১৯৩২ সাল থেকে জার্মানিতে হিটলারের উত্থান আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-১৯৪৫) শুরু, এ দুই ঘটনার উদয় হওয়া পর্যন্ত ইউরোপের কেউ তাকিয়ে দেখার ফুরসত পাননি যে, সোভিয়েত ইউনিয়নে ঠিক কী ঘটেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে সোভিয়েত আর (হিটলারের) জার্মানির মধ্যে অনাক্রমণ চুক্তি থাকলেও হিটলার সোভিয়েত আক্রমণ করেছিলেন। তখনো আমেরিকা যুদ্ধে কোনো পক্ষেই অংশ নেয়নি। ফলে হিটলারবিরোধী অ্যালায়েন্স বা মিত্রবাহিনী যুদ্ধজোট জন্মের তখনো কোনো খবর ছিল না। যুদ্ধ শুরুর প্রায় তিন বছর পরে ১৯৪২ সালের জানুয়ারি থেকে সোভিয়েতরা আমেরিকার সাথে একই জোট পক্ষ হয়ে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু ততদিনে হিটলারের হাতে সোভিয়েতের ক্ষয়ক্ষতি হয়ে গিয়েছিল অনেক। তবু ১৯৪২ সালের ১ জানুয়ারি মিত্রবাহিনী গঠনের শর্তাবলিতে স্বাক্ষর দিতে সোভিয়েত রাশিয়া ব্যাপারটাকে বিরাট সুযোগ হিসাবে নিয়েছিল। পরের চার বছরে ১৯৪৫ সালের মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে এলে এবার সারা পশ্চিমের এই প্রথম নজরে আসে সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি। সব কিছু সরকারি মালিকানায় আনতে হবে – আমেরিকা ও ইউরোপের সব রাষ্ট্রের কাছে এটাই মূলত ভীতি আর এটা একটা বিশৃঙ্খলা তৈরি করবে বলে এটাকে তারা হুমকিরূপে দেখতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু পশ্চিমের এসব আপত্তি প্রকাশ্য না এনে বরং তারা বাইরে বলার সময় বলত, কমিউনিস্ট দেশে নাগরিক অধিকার না দেয়া, মানুষকে কথা বলতে না দেয়া, দমিয়ে রাখা, ন্যূনতম স্বাধীনতা হরণ ইত্যাদি চাপের অভিযোগ তুলত।
এমনিতেই অবশ্য ১৯৪৫ সালে বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকে আমেরিকার সাথে সোভিয়েতের যুদ্ধজোটের সময়ের সম্পর্ক ঢিলা হতে শুরু করেছিল। এ ছাড়া প্রথম মনোমালিন্য দেখা দেয় জার্মানি ভাগ করা নিয়ে। এ ছাড়া যুদ্ধ শেষ হলে ইউরোপজুড়ে যুদ্ধে ভেঙে পড়া অর্থনীতি – অবকাঠামো আর শিল্প-প্রতিষ্ঠানের ক্ষয়ক্ষতি পুনর্বাসনের জন্য আমেরিকা এক বিশাল, খুবই কম সুদের অবকাঠামো ঋণ প্রকল্প নিয়েছিল, যা ‘মার্শাল প্ল্যান’ নামে পরিচিত ছিল। আমরা বলতে পারি, বিশ্বব্যাংক জন্মের পরে কাজ শুরু করে প্রথম হাত পাকিয়েছিল এই মার্শাল প্ল্যান বাস্তবায়ন করেই। এরপর ষাটের দশকের শুরুর দিকে ইউরোপে অবকাঠামো বিনিয়োগের প্রয়োজন পূরণ হয়ে গেলে তখন ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এশিয়ার দিকে মনোযোগ দিয়েছিল। কিন্তু মূল কথা হল, মার্শাল প্ল্যানের ব্যাপারে স্টালিনের আপত্তি ও অস্বস্তি ছিল। স্বভাবতই অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগে যাওয়া মানেই ঐ সব ইউরোপীয় দেশে আমেরিকান প্রভাব বাড়বে, এটাই ছিল তার অস্বস্তির কারণ। কিন্তু এতে স্টালিনের বাস্তবে কিছুই করার ছিল না। কারণ যুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট, রেল বা কলকারখানা ইত্যাদি নিয়ে ইউরোপের বসে থাকা বা ধুঁকে মরা তো চলতে পারে না। আবার কমরেড স্টালিনের মুরোদও ছিল না যে নামেমাত্র সার্ভিস চার্জের বিনিময়ে কোনো অবকাঠামো ঋণ দেয়। আবার ঋণ দেয়া তাদের চোখে ‘পুঁজিবাদী কারবার।’ ফলে তা কমিউনিস্টদের দৃষ্টিতে, পাপকাজ। এ অবস্থাটা ছিল ‘মিয়াবিবি রাজি’র মত। ঋণদাতা আমেরিকা আর গ্রহীতা ইউরোপ রাজি। কাজেই তা ঠেকাবে কে?
ওদিকে ইরানের তেল তোলার কন্ট্রাক্ট পাওয়ার জন্য সোভিয়েতের সাথে আমেরিকার নেতৃত্বে ইউরোপের জোটের প্রতিযোগিতা নিয়ে টেনশনও শুরু হয়ে গিয়েছিল।
কাজেই আমেরিকার সাথে স্টালিনের টেনশন বেড়েই চলছিল। এর মধ্যেই ১২ মার্চ ১৯৪৭ আমেরিকান প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান তার ‘ট্রুম্যান ডকট্রিন’ আমেরিকার কংগ্রেসে ঘোষণা করেছিলেন। এর সার কথা হল, ‘কমিউনিজম ঠেকানো [containment] – কমিউনিজম’ ঠেকাতে হবে। ট্রুম্যান বললেন, কোনো রাষ্ট্র কমিউনিজমের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে চাইলে তিনি তাদের সাহায্য করবেন। এ কাজই তিনি ১৯৫২ সাল পর্যন্ত চালিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৫৩ সালের জানুয়ারিতে এই প্রথম টানা ২০ বছর পরে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট আইসেনহাওয়ার ক্ষমতায় আসেন। তারা আরো সবলভাবে ‘কমিউনিজম ঠেকানো’ নীতি কার্যকর করে গেছেন। আর তখন থেকেই সোভিয়েত-আমেরিকান ঠাণ্ডা যুদ্ধ আরো প্রবলভাবে জেগে উঠেছিল। ১৯৯১-তে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তা বজায় ছিল। তার মূল কারণ হল, অস্ত্র প্রতিযোগিতা, বিশেষ করে পারমাণবিক অস্ত্রের। আর সেখান থেকেই ঘটনা এবার তৃতীয় মাত্রায় উন্নীত হয়।
আসলে, ততদিনে এ দুই রাষ্ট্রের হাতে দুনিয়াকে কয়েকবার নির্মূল করে দিতে সক্ষম, এমন পারমাণবিক অস্ত্র মজুদ হয়ে গেছিল।
কিন্তু তাতে আগে যেমন মনে হত নানান কিসিমের অস্ত্রের মজুদ হাতে আসা মানেই নিরাপত্তা বোধ জগত। কিন্তু তখন এই প্রথম মনে হতে লাগলে যে না অস্ত্রই নিরাপত্তাহীনতার কারণ। কারণ দুপক্ষই এই ভেবে প্রচণ্ড মাত্রায় ভীত হয়ে পড়েছিল যে, কোনো ভুলচুক হয়ে গেলে বা ছোট ঘটনায় যথেষ্ট গুরুত্ব না দেয়ার কারণে একপক্ষ যদি অপরের ওপর বোমা ফেলে, তা হলে কী পরিণত হবে? এতে এবার কোল্ড ওয়ার শব্দটার উপর তৃতীয় আরেক বৈশিষ্ট্য আরোপ করেছিল। যুদ্ধ লেগে যায় কি না এ নিয়ে সর্বক্ষণ টেনশন ছিল আগের এই বৈশিষ্ট্ তো ছিলই। আর এখন কে কার মাথায় পারমাণবিক বোমা ফেলে দেয়; এমনকি ভুলেও যদি হয়ে যায়? সেই দুশ্চিন্তাই সেই তৃতীয় বৈশিষ্ট্য।
একটা কথা বলে রাখি। স্টালিন বা পরবর্তীকালের সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধানরা যে নীতি অনুসরণ করে গেছেন তা হলো, মূলত আমেরিকা থেকে কোন অবকাঠামো বিনিয়োগ এবং কোন ব্যবসায়িক পুঁজি (এফডিআই) নেয়া যাবে না এবং কেউ নিলে এর বিরোধিতা করতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো কলোনি লুটেরাদের হাতে সব ফোকলা হয়ে যাওয়া আমাদের মত দেশের সম্পদ হারিয়ে যাওয়ার ফলে অবকাঠামোতে বিনিয়োগ পুঁজি পাওয়া এসব দেশের জন্য মৌলিক প্রয়োজন। অথচ এটাই সোভিয়েত বা কমিউনিষ্টরা মেনে নিতে চায়নি। তাদের পয়েন্ট হল, এতে আমাদের মতো দেশে আমেরিকান প্রভাব বেড়ে যাবে, তাই তারা এতে একমত নন। কিন্তু তাহলে আমাদের পুঁজি পাওয়ার বিকল্প উপায় কী? না, এ নিয়ে সোভিয়েত নায়কদের কোনো মাথাব্যথা ছিল না।
কিন্তু এর একটা মজার পরিণতি ঘটে গিয়েছিল সত্তরের দশকে। আমাদের সবার লিডার হয়ে এখন সামনে হাজির হতে চাইছে চীন। এর আনুষ্ঠানিক শুরু হয়েছিল ১৯৭৮ সাল থেকে। যখন চীন আমেরিকান পুঁজি গ্রহণের দুয়ার খুলে দিয়েছিল। তবে এর অনেক আগে চীনকে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে হয়েছিল, ১৯৫৮ সালেই। সোভিয়েত ইউনিয়নও ‘আরেক কিসিমের সাম্রাজ্যবাদী’ দেশ বলে চীন অভিযোগ তুলেছিল; যার নাম দিয়েছিল ‘সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ’।
আমরা আমাদের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। এরপর পুরো আশির দশকটাতেই সোভিয়েত ইউনিয়নের সরকারের আয়-ইনকাম রাজস্ব কমতে শুরু করেছিল, বিশেষ করে কারখানা উৎপাদন যেখানে মালিকানা মাত্রই সরকারি ছিল। মূলত উৎপাদনে অদক্ষতার দরুন এটা ভেঙে পড়া শুরু করেছিল। আর এই ধাক্কা সামলাতে না পেরে অন্য সব কিছু মিলিয়ে ফেল করাতে ১৯৯১ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায়। রাশিয়া বাদে আরো ১৫টি আলাদা রাষ্ট্রে সোভিয়েত মহারাষ্ট্র টুকরো টুকরো হয়ে যায়।
সবচেয়ে বড় কথা, কোল্ড ওয়ার জিনিসটারও পরিসমাপ্তি ঘটেছিল এতে।
কোল্ড ওয়ার ২.০
সেকালে কোল্ড ওয়ারের ভাগ্যে কী ঘটেছিল তা একালে এখানে আবার বয়ান করতে নিশ্চয় বসিনি। তাহলে? অন্তত গত ছয় মাস ধরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প উঠতে বসতে চীন-ব্যাশিং বা চীনকে গুঁতা দেয়া একবারে চরমে নিয়ে গেছেন। এ ছাড়া ট্রাম্পের পুরো চার বছর (২০১৭-২০) চীন বিরোধিতার বাণিজ্যযুদ্ধ সারা সময়ই কমবেশি ছিল। এমনকি এ বছরের শুধু চীন-আমেরিকার আপসী বাণিজ্যচুক্তির প্রথম ভাগও দু’পক্ষ স্বাক্ষর করে রেখেছে। কিন্তু আর কিছুই ডোনাল্ড ট্রাম্প করবেন না নির্বাচন পর্যন্ত। কারণ তার বিশ্বাস একমাত্র চরম ও কড়া চীনা ব্যাশিং করলেই তিনি ভোটে হেরে যাওয়ার অবস্থার মুখে, একমাত্র সম্ভাবনা হিসেবে পরিস্থিতি নিজের দিকে ঘোরাতে পারেন।
সে যাই হোক, নির্বাচনে জয়-পরাজয় তো একটা হবেই। কিন্তু এর আগের যে ভাষ্যটা ক্রমেই প্রবল হচ্ছে সেটা হল, কোল্ড ওয়ার আবার নাকি ফিরে আসছে। দেশের-বিদেশের মিডিয়াতেও প্রায়ই এমন লেখা দেখা যায়। অনেক সিরিয়াস লেখক বা মিডিয়া এমন ভুল করতেছেন। ইতোমধ্যে ২০১৬ সালে কোল্ড ওয়ার টু – এই নামে একটা প্রপাগান্ডা সিনেমাও হয়ে গেছে। তাই বুঝুক না বুঝুক পেটি মধ্যবিত্ত জোশও একটা তৈরি হয়েছে। ্বসবের মুল বক্তব্যটা হল, যেহেতু চীন-আমেরিকার মধ্যকার এবারের হবু টেনশন-সঙ্ঘাত ভালই চড়ছে দেখা যাচ্ছে তাই এর কোন বৈশিষ্ট লক্ষ্মণ বিবেচনা ছাড়াই নিজের আতলামি প্রকাশের জন্য এটা বলা শুরু করে দিয়েছে যে কোল্ড ওয়ার ২.০ আসতেছে।
এনিয়ে আমার প্রথম মন্তব্য হল, আমাদের পরিচিত একমাত্র দুনিয়াটাতে আবার নতুন করে কখনো কোথাও কারো সাথে কারো আর কোল্ড ওয়ার সম্পর্ক তৈরি হবে না, তা দেখা যাবে না।
কাজেই যারাই কোল্ড ওয়ারের কথা আবার তুলছেন, তারা সময় ও পরিবেশ মিলিয়ে যাচাই করে না দেখেই মুখস্থের মতো এসব কথা বলছেন। তাদের উচিত হবে, কেন সোভিয়েত-আমেরিকা একটা কোল্ড ওয়ার সম্পর্কে জড়াতে পেরেছিল, তার পেছনের অবজেকটিভ বা বাস্তব শর্ত কী ছিল আগে তা খুঁজে দেখা।
কথাটা সরাসরি বললে, সেকালের সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার মধ্যে কোনো লেনদেন-বাণিজ্য বিনিময় ছিল না। এটাই হল সবচেয়ে নির্ধারক বাস্তবতা। এ কারণে কোল্ড ওয়ারের মতো চরম বিরোধাত্মক সম্পর্কে যাওয়ার বাস্তব শর্ত সেকালে তৈরী ছিল, যা এখন আর নেই। আর কখনো ফিরেও আসবে না। এর বিপরীতে আজকের পুতিনের রাশিয়া আর ভেঙে তৈরি হওয়া ১৫টি রাষ্ট্রসহ সব রাষ্ট্রই এখন একই গ্লোবাল বাণিজ্য ব্যবস্থার সদস্য। মানে একই আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকের সদস্য। যখন লেনদেন-বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল না বলেই এক রাষ্ট্র অপরের রাজধানীতে বোমা ফেলে আসার কথা অবলীলায় ভাবা তখন সম্ভব ছিল। কারণ পরস্পরের অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিল না বলেই অপরের মাথায় বোমা নিজের ক্ষতিগ্রস্থ হবার সম্ভাবনা ছিল না। কিন্তু আজ আমেরিকার ওয়াল স্ট্রিট চীনের বাজারে বিনিয়োগ করে ছেয়ে আছে। তাই চীনের মাথায় বোমা মারতে হলে এর আগে য়ামেরিকাকেই অনেক কিছু ভাবতে হবে। নিজের স্বার্থের মাথায় কে বোমা ফেলে?কারণ আজ সেটা নিজ দেশের বা স্বার্থের প্রতিষ্ঠানের ওপরই বোমা মারা হয়ে যেতে পারে। কাজেই আজকের সম্পর্ক নতুন করে অন্য কিছু একটা হলেও হতে পারে; কিন্তু পুরনো কোল্ড ওয়ার আর হবে না।
এছাড়াও ফারাক আরও অনেক আছে। সোভিয়েত বনাম আমেরিকার বিরোধ ছিল পরাশক্তিগত ক্ষমতা ও প্রভাবের প্রতিযোগিতা। কিন্তু আজ চীন-আমেইরিকার বিরোধ গ্লোবাল অর্ডারের নেতৃত্বের যেখানে আমেরিকা নিজের গবেষণা থেকে জানে সে হারু পার্টি। কাজেই দুই রাষ্ট্রের মধ্যে টেনশন দেখলেই সেটাকে কোল্ড ওয়ার বলে দিজ্ঞজি বুঝ তুলে কথা বলতে হবে, এটা কোন ভাল কথা না।
দুনিয়াতে কোল্ড ওয়ার আর ফিরবে না। এখন চাল-ডাল মিশে যাওয়ার মত অবস্থায় আমরা যখন একবার তা মিশিয়ে দিলে যেমন তা আবার চাল-ডাল আলাদা করা কঠিন, সেরকম আমরা সবাই গ্লোবাল বাণিজ্যিক ব্যবস্থার অধীনে চলে গেছি বলে চাইলেই অনেক কিছু করা যাবে না। আবার পুজিঁ-পণ্য শ সবকিছু ভাষা পর্যন্ত লেনদেন বানিজ্য বিনিময়ে বন্ধের জায়গায় ফিরে যেতে পারব না। এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ট্রাম্প বলছেন, তিনি সম্পর্ক ভালো করতে চীনের দিকে আগাবেন না। কিন্তু নির্বাচনের পরে ট্রাম্পই জিতে গেলে অথবা যেই জিতুক, আবার চীনের সাথে আমেরিকার সম্পর্ক হওয়া খুবই সম্ভব। এই যে আগে-পিছে করার সুযোগ নিতে পারি এখন, এটা পুরনো কোল্ড ওয়ারের আমলে সম্ভবই ছিল না। কাজেই না-বুঝ অবুঝ কোল্ড ওয়ার নিয়ে কথা বলতে সাবধানতা নিতেই হবে। যা মনে চায় বলা যাবে না, ভেবেচিন্তে বলতে হবে। কাজেই আমরা আশা করব সকলে এবিষয়ে দায়ীত্ব নিয়ে কথা বলবে।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
[এই লেখাটা গত ১৫ আগষ্ট ২০২০, দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ওয়েবে ও পরদিনই প্রিন্টেও “কোল্ড ওয়ার ‘টু’ হবে কি?” – এই শিরোনামে উপ-সম্পাদকীয়তে ছাপা হয়েছিল। পরবর্তিতে সে লেখাটাই এখানে আরও নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে এখানে আজ ছাপা হল। ]
ভাল লাগলো
LikeLike