বাংলাদেশের উপর ভারতের প্রভাব কিভাবে এলো
গৌতম দাস
০৭ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০৬ সোমবার
আরেক দেশের উপর যদি কোনো দেশের প্রভাব থাকে বা বাড়ে তা হলে এর ‘রুট-কজ’ হল প্রভাবশালী ঐ দেশের মূলত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিজাত সক্ষমতা। সেখানে অন্যান্য কারণও যদি কিছু থাকে সেটাও মূলত অর্থনৈতিক কারণেরই কিছু উপজাত। কিন্তু বাংলাদেশে বড় পড়শি ভারতের সাম্প্রতিক প্রভাবটা যেন গায়েবি! এটা কোথা থেকে এল কেউ জানে না। সবাই জানে এটা আছে মানে প্রদত্ত [given]; আর সবাই ভাব করে যেন এটা বাংলাদেশের জন্ম থেকে!
ভারতের এক থিংকট্যাংকের গবেষক স্মৃতি পট্টনায়ক সম্প্রতি বলছেন, তিনি বিস্মিত হন এটা ভেবে যে, “যে দেশকে ভারত সবচেয়ে বেশি সহায়তা দেয়, সেই দেশেই বিরোধিতার মাত্রা সবচেয়ে বেশি!”। তাঁর ভাষায়, “এ এক অদ্ভুত পরিহাস!”। এর মানে বাংলাদেশে দানধ্যান দেয়া বা অবকাঠামো বিনিয়োগে সবচেয়ে বেশি অর্থ ঢালে ভারত। তাই পট্টনায়ক দাবি করছেন, “ভারত সবচেয়ে বেশি সহায়তা দেয়”। এটা ত সাংঘাতিক ব্যাপার! তাহলে ভারত এখন নিজেই এক দাতা দেশ হয়ে গেছে, কী বলেন? ভারতের এত উন্নতি হয়েছে আমরা তো তা জানিই না! একেবারে পশ্চিমা দেশের মত? নাকি তাদেরকেও ছাড়িয়ে, কে জানে? যদিও আরেকটা সম্ভাবনা আছে। আসলে এই মহিলা সম্ভবত ইদানীং কোনো কারণে সংসার নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকেন। তাই ইকোনমিক ডাটা, পরিসংখ্যানের পাতা বা দুনিয়ার ভালোমত খোঁজখবর নেয়ার সময় পান না। ফলে না দেখেই মনগড়া যা মনে চায় অনেক কথা বলতে হয়। ব্যাপার হল, যে ভারত বাংলাদেশ থেকে যে করডোর সুবিধা নিতে চাইছে বিনা পয়সায় আর এর সুবিধাদি গড়তে যে অবকাঠামো বিনিয়োগ সেটাও বাংলাদেশের পাবলিকের ঘাড়ে চড়ে তাদের নামে নেয়া ঋণে – সেই ভারত বাংলাদেশকে বিনিয়োগ ফান্ড দাতা হবে কীভাবে? কোথা থেকে? এটা তো দিবাস্বপ্নেও সম্ভব নয়, ফলে সত্যি নয়। এখন এই মহিলা যিনি নাকি গবেষকও বলে জানা যাচ্ছে তাকে আমাদের উপেক্ষা করে ফেলে রাখা ছাড়া আর কী করতে পারি! প্রথম আলোর দিল্লির প্রতিনিধি সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় পট্টনায়কের এই বক্তব্য তিনদিন আগে তুলে এনেছেন।
হর্ষবর্ধন শ্রিংলার বাংলাদেশ সফরের দুই সপ্তাহ হয়ে যাওয়ার পরও এর দুঃখ আর শোক নিয়ে ভারতের হাহুতাশ যাচ্ছেই না। সম্ভবত এর মূল কারণ, এবারের এ সফরের এলোমেলো আউটকাম আর লুকানোই যাচ্ছে না। সবচেয়ে বেশি যেটা বিঁধেছে তা হল, এ সফরকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে “আনুষ্ঠানিক” বলে কোনো সিলমোহর দেয়া হয়নি। এমনকি ঐ অফিস থেকে কোনো বিবৃতি বা ব্রিফিং ধরনের কোন কিছু প্রেসকেও পাঠানো হয়নি। অর্থাৎ এই সফরে প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাত যাকিছু তা “অফিসিয়ালি” কোনো কিছুই ঘটেনি। সবটাই ব্যক্তিগত পর্যায়ের ঘটনা, সরকারি আনুষ্ঠানিক কোনো কিছু নয়। গত ২১ আগস্ট বিবিসি লিখেছে, “কিন্তু সেই রাতে প্রধানমন্ত্রীর মুখপাত্র জানিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর সাথে ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের কোনো বৈঠক বা সাক্ষাৎ হয়নি। ফলে সাক্ষাৎ হয়েছে কি না- এ নিয়েই বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছিল”।
বিবিসির এই শেষের বাক্যটাই বরং অযথা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে লেখা হয়েছে। তামাসাটা হল বিবিসি নিজেই আগের বাক্যে লিখেছে, মুখপাত্র জানিয়েছিল, “ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের কোনো বৈঠক বা সাক্ষাৎ হয়নি”। তাহলে বিবিসির বিভ্রান্তির উতস আর কোথা থেকে? কূটনীতিতে কোনো সরকারি অফিস যখন বলে ‘প্রধানমন্ত্রীর সাথে ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের কোনো বৈঠক বা সাক্ষাৎ সেদিন হয়নি’ – এর মানে তো সোজা। তা হল, প্রধানমন্ত্রীর সাথে ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের কোনো “আনুষ্ঠানিক” বৈঠক বা সাক্ষাৎ সেদিন হয়নি। এটি যারা বুঝতে পারেনি বলে ‘বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছিল’ লেখে, এরা কার স্বার্থ রক্ষা করছেন? এরা ভারত বা শ্রিংলার হয়ে তাদের মুখরক্ষার দায়িত্ব নিজেরাই নিয়ে ফেলেছে; তাই ওমন ভান করছে! এগুলো ভাল সাংবাদিকতার উদাহরণ অবশ্যই নয়।
এটা তো পরিষ্কার যে, এ’অবস্থায় ভারতীয় সরকারি পক্ষও যেখানে কোথাও দাবি করছে না বা করতে পারছে না যে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাথে শ্রিংলার “আনুষ্ঠানিক” সাক্ষাৎ হয়েছে বা কোনো কর্মসূচি ছিল। অর্থাৎ বাংলাদেশে রওনা হওয়ার আগে কর্মসূচিটা “আনুষ্ঠানিক” কিনা তা নিশ্চিত না করে নিতে পারার দুর্বলতা রেখেই শ্রিংলা বাংলাদেশে এসেছিলেন। সম্ভবত নিজেকে ওভার এস্টিমেট করেছিলেন এই বলে যে, নিজের ব্যক্তিগত ক্যারিশমা দিয়ে তিনি সব ঠিক করে ফেলবেন। কারণ তিনি এই সে দিন বাংলাদেশে তিন বছর কাটিয়ে গেছেন – কত কিছু ঠিক করে গেছেন, লোক সেট করে গেছেন ইত্যাদি। অর্থাৎ নিজের উপর এই খামোখা কিন্তু অগাধ অতি-ভরসা করেই তিনি এসেছিলেন। কাজেই এর একটা মাশুল তো তাকে এখন দিতেই হবে! তবে ভারতের বিদেশ মন্ত্রনালয় এখানে গত বছরের ডিসেম্বরের হাসিনা সফরের এই রিপোর্টটা একটু চোখ বুলিয়ে নিতে পারে, তাতে তাদের সব বহু কিছু মনে পড়ে যাবে।
তাই, শ্রিংলাসহ ভারতীয় স্টাবলিশমেন্টের বোঝা উচিত হাসিনার এই মনোভাব তো আকস্মিকও নয়। ২০১৮ নির্বাচনের সময় থেকেই তিনি পরিষ্কার করে বলছিলেন, তিনি ভারতের জন্য কি না করেছেন, কত কী দিয়েছেন তা ভারতকে স্মরণে রাখতে হবে। এ ছাড়া গত মার্চে বাংলাদেশে লকডাউন শুরুর আগে থেকেই বাংলাদেশের মন্ত্রী-স্পিকারদের ভারত-সফর বাতিল করা নিয়মিত ঘটনা হয়ে গিয়েছিল। শেখ হাসিনা পরিষ্কার করেই বলছিলেন, নরেন্দ্র মোদীর মুসলমানবিদ্বেষী কর্মকাণ্ড ও ঘৃণা ছড়ানো তিনি পছন্দ করছেন না। তবে তিনি বরং বুঝানোর স্বরে বলেছিলেন – তাঁকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান বাংলাদেশের মানুষ নিয়েই চলতে হয়, তাদের সেন্টিমেন্টের দিকটা মোদী সরকার যদি আমলে না নেয় তবে আর কিছু করার থাকবে না। কিন্তু তবু ভারত নিজের ওপর অতি আস্থা রেখে বেপরোয়াই থেকে গিয়েছিল। শ্রিংলাও যেটা সবচেয়ে বেশি খাটো করে দেখেছেন তা হল, ২০১৮ সালের ‘নির্বাচনের হাসিনা’ আর ২০২০ সালে হাসিনা আর একই রকম নাই। বিশেষ করে ২০১৯ সালে নতুন সরকার গঠনের সময় যেভাবে কথিত কিছু অতি প্রো-ইন্ডিয়ান ও ‘প্রগতিবাদী’ মন্ত্রীদের তিনি দূরে রেখে দেন, সেই ইঙ্গিত তারা আমলে না নিলে কে আর তাদের বুঝিয়ে বলতে পারবে! তবু ভারতীয় পক্ষের মধ্যে এনিয়ে কোনো বিকার হতে দেখা যায়নি বললেই চলে। এর কারণ কী?
ছোট্ট কিছু শব্দে এর এক কারণ ব্যাখ্যা দিয়েছেন এক প্রাক্তন কূটনীতিক সেরাজুল ইসলাম [M Serajul Islam]। সেটা হল – no alternative। মানে, “ভারত ছাড়া হাসিনা সরকারের গতি নাই” – ভারতের এই মনোভাব। তিনি বলছেন, [New Delhi made no effort to bring Dhaka back confident as Dhaka would come back on its own because it had no alternative to India. That did not happen.] ভারতীয় রিডিং ছিল, তারা ২০১৮ নির্বাচনে ভারত প্রকাশ্যে সমর্থন না দিলেও বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের ভারতকে ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা নাই। কাজেই তাদের ভারত তুচ্ছ বা অবজ্ঞা করে বা-হাতে ফুল দিলেও যাই করুক তা হাসিনাকে মেনে নিতেই হবে – এটাই ছিল ভারতের অনুমান আর সেই অনুমানের ওপর ভর করেই ভারত তখন থেকে হেঁটে এসেছে। আর ২০১৯ সালের শুরু থেকে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান হল যে, তারা এতটা ঠেকে নাই, কারণ বাংলাদেশেরও বিকল্প আছে। ভারতের সমর্থন পেলে ভালো কিন্তু তা এত জরুরি নয়। আর সব টানা-হেঁচড়া লড়াই এর শুরু এখান থেকেই। অথচ শ্রিংলা এই পরিবর্তনটাকে আমলে না নিয়ে অতি-আস্থা দেখাতে গিয়েই নিজের জন্য বিপদ ডেকে এনেছেন।
তবে পুরো ভারতীয় স্টাবলিশমেন্ট বুঝে যায় ও আভ্যন্তরীণভাবে স্বীকার করে যে, তারা বড় একটা হোঁচট খেয়েছেন। তবু তারা সিদ্ধান্ত নেয়, উঠে ধুলা ঝেড়ে যেন ‘কিছু হয়নি’ ভাব দেখিয়ে সব নরমাল আছে এটা দেখানোই তাদের উচিত হবে। আর এখান থেকেই গত প্রতি সপ্তাহে তারা দু-তিনটি করে প্রোগ্রাম করেছে, আর নিজেকেই সান্ত্বনা দিয়েছে যে, বাংলাদেশ তাদের ছেচা দেয়নি, ভারতের কিছু হয়নি, সব ঠিক আছে আগের মতই।
বিবিসি ছাড়াও আরও কিছু অতি-সার্ভিস দাতাঃ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এক অধ্যাপক বলেছেন, “প্রধানমন্ত্রীর সাথে ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের সাক্ষাৎ বা বৈঠক নিয়ে স্পষ্ট বক্তব্য না দেয়ায় বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে”। এটা আরেক মামাবাড়ির আবদার! এটাকে বলা যায়, ভারতকে এক অতি উৎসাহীর দেয়া ‘সার্ভিস’। এমনকি একথা বলে তিনি নিজের একাডেমিক ইজ্জত-সম্মান কিছু থাকলে সেটাও লুটিয়েছেন, সেই খবর নাই। আচ্ছা, প্রধানমন্ত্রীকে কেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের সাক্ষাৎ বা বৈঠক নিয়ে স্পষ্ট বক্তব্য দিতে হবে? তা ছাড়া বৈঠকটা যদি হয়ে থাকে গায়েপড়ে ইনফরমালি নেয়া? অর্থাৎ সারকথায় অনানুষ্ঠানিক? শ্রিংলা যদি নিজের গণ্ডিতে থাকতে না চান, ওভার-ইনফ্লুয়েন্সি দেখাতে চান তবে তার “পদের” অপমান তো তাকে সহ্য করতেই হবে! অধ্যাপক বলছেন, “ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের যথেষ্ট তথ্য বা ইনফরমেশন নেই, এটি পরিষ্কার। তার ফলে বিভিন্ন ধরনের স্পেকুলেশনের আশ্রয় নিতে হচ্ছে। নানা কথাবার্তা ডালপালা মেলছে। এটি তো খুব একটা হেল্পফুল না”।
সরকারপ্রধানের অফিস থেকে যদি দেখাতে চাওয়া হয় যে শ্রিংলার সাথে এই সাক্ষাৎ ব্যক্তিগত, আনুষ্ঠানিক সফর নয়, সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার তারা তো যেচে এটাই দেখাবেন যে, এই পদ্ধতিতে সফর জোগাড় করা “খুব একটা হেল্পফুল নয়”। অধ্যাপককে একটা প্রধানমন্ত্রীর অফিসের কূটনৈতিক ইঙ্গিত ও পরিভাষা কে শিখাবে? অধ্যাপক আরো বলেছেন, “সেখানে তো আলোচনার একটা এজেন্ডা থাকবে। কিন্তু সে এজেন্ডা আমরা দেখিনি। প্রধানমন্ত্রীর সাথে যে দেখা হয়েছে, সেটা সম্পর্কে আমাদের পরিষ্কারভাবে কিছু বলা হয়নি”। পরিষ্কারভাবে যখন কিছু বলা হয়নি তার মানে এর অনানুষ্ঠানিক – এটা বুঝতে অধ্যাপকের অসুবিধা হচ্ছে কেন?
একটা আনুষ্ঠানিক আলোচনা হবে বলে যখন কিছুই সাব্যস্তই হয়নি, তখন সেখানে এজেন্ডা থাকতেই হবে কেন? কিভাবে থাকবে? এতো দেখি মহা আবদার! বরং অধাপকসহ যেন সকলেই বুঝেন এটা অনানুষ্ঠানিক; এর জন্য প্রধানমন্ত্রীর কী ঠেকা লাগছে?
এর চেয়ে বরং আসেন যিনি ভারত বা শ্রীংলাকে তাঁর কোন অতি সার্ভিস দেয়ার দায় নাই তাই তিনি কোন কোনো জিদ নিয়ে আসেননি – এমন এক ব্যক্তিত্বের বক্তব্য শুনি। সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেছেন, “সফরটাও তো ভারতের উদ্যোগ থেকে, সেটা বোঝা যাচ্ছে। ভারতের দিক থেকে উদ্যোগেই হয়েছে। ভারতের দিক থেকে কিছু একটা বক্তব্য আছে বা বার্তা আছে, সেই বার্তাটা পৌঁছে দেয়ার জন্য তার আসা এবং সেই সুবাদে [আমাদের] পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে বৈঠক হয়েছে”।
‘এখন যদি তাদের বার্তা থাকে, তারা হয়তো বার্তা দিয়েছেন। আমরা বার্তাটা শুনেছি। আমাদের দিক থেকে হয়তো সেটার ব্যাপারে এখনো কোনো বক্তব্য নেই। সে জন্য আমরা জানাচ্ছি না। এটাও হতে পারে”। এই হলো অন্তত নিউট্রাল বা অবজেকটিভ একটা মূল্যায়ন। এটাই প্রফেশনাল কূটনীতিকের মত কাজ ও ব্যাখ্যা।
সরকার চীনের দিকে অনেক ঝুঁকবার সক্ষমতা দেখাচ্ছেঃ
অবশ্য এটাও ঠিক ভারতের ইচ্ছা বা মত শুনে পরিচালিত হয়ে বাংলাদেশ এর আগে চীনের অনেক প্রস্তাব অবজ্ঞা করা হয়েছে, যেমন সোনাদিয়ার বন্দর প্রস্তাব ফেলে রাখা হয়েছে [এখন তো পুরাই বাতিল]। আর পায়রা যেটা আসলে কোনো বন্দরই নয়; না বড় জাহাজ ভেড়ানোর জন্য, না অন্য কিছু। সব চেয়েও বড় কথা, জন্ম থেকেই সারা বছর এই বন্দরকে নাব্য রাখতে হলে নিয়মিত ড্রেজিং করেই যেতে হবে। ন্যায্য প্রমাণ করা কঠিন, অপ্রয়োজনীয় এই অপচয় করে যেতে হবে। অথচ ভারতের ইচ্ছায় আমরা এতে বিনিয়োগ করছি আর এটা প্রকল্প ফেল করবে জেনেও এমন একটা প্রকল্পের দায়ভার নিচ্ছি।
তবে এখন অবশ্যই দিন আর আগের মতো নেই; বদলেছে, অন্তত কিছুটা। সেটা উপরে বর্ণিত কারণে অবশ্যই। তবে এর বাইরেও আরো নতুন কারণ আছে। সেটা হল সরকারের ‘উন্নয়নের’ অর্থ পাওয়ার সঙ্কট। বিশেষ করে এবারের বাজেটের অর্থ সংগ্রহকাল থেকেই সঙ্কটটা আনেক মারাত্মক। খুবই কষ্ট হয়েছে, এখনও কষ্ট করে মিলানোর চেষ্টা চলছে। সব মিলিয়ে তাই সরকারের আরো বেশি চীন ঘনিষ্ঠ হওয়াটাই স্বাভাবিক। আগে চীনের দেয়া অনেক প্রজেক্ট ভারতের কারণে সরকার না করে দিয়ে এসেছে, এখন সে অবস্থায় সরকার নাই। কিন্তু আগে প্রায়োরিটি দিয়ে ভারতের স্বার্থের কথা শোনাতে ভারতের একটা ধারণা হয়েছে, শ্রিংলা এসে কথা বললেই কোনো চীনা প্রকল্প নেয়া থেকে তিনি হাসিনা সরকারকে বিরত রাখতে পারবেন।
দুই সপ্তাহ ধরে শ্রিংলা সফরের দুঃখে মলম লাগানো হচ্ছে অথচ প্রথমতঃ কাউকেই দেখা যাচ্ছে না এটি ব্যাখ্যা করতে যে ভারতের বাংলাদেশের উপরে এত প্রভাব এলো কোথা থেকে এবং কবে থেকে কিংবা কেন? সবাই এটা ধরে নিয়ে আলাপ শুরু করতে চান যে, বাংলাদেশে ভারতের প্রভাব একটা আছেই। কিন্তু কেন, কিসের প্রভাব এটা? এরই মধ্যে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি মারা গেছেন। তাকে বাংলাদেশের উপর প্রধান প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তিনিও ২০১২ সালের লেখা বইয়ে নিজেকে বিরাট প্রভাবশালী এবং সব কিছু তিনি ঠিক করেন এমন ভাব দেখিয়ে নানান কথা লিখেছেন। কোন রাষ্ট্রের আরেক রাষ্ট্রের উপরে প্রভাব বাড়ে মূলত নিজের অর্থনৈতিক বিরাট উচ্চ অবস্থার কারণে। কিন্তু ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা কী উল্লেখযোগ্য কোন উচ্চতার শিখরে? না এমনটা আমাদের জানা নাই। ভারতও তা দাবি করে নাই কোথাও। আর আমরা প্রতিনিয়ত নিউজ শুনি যে ভারত, চীন বা জাপান; বিশেষত চীনের মত দেশ থেকে বিপুল অবকাঠামো ঋণ নিয়ে চলেছে। আবার ভারত দান বা বিনিয়োগের অর্থ বলে কী কিছু বাংলাদেশের কাছে তেমন গোনায় ধরা? না তাও না। সেটা এমনকি ভারতের প্রণব মুখার্জিসহ কেউ কোনো দিন দাবি করেননি। তা হলে?
ব্যাপারটা হলো চীনা অর্থনৈতিক উত্থান ঠেকানোর লক্ষ্যে, তার প্রভাবশালী হয়ে উঠা যদি কিছুটা ঠেকিয়ে দেয়া যায় এশিয়ায় আমেরিকার এই স্বার্থপূরণ করে দেওয়ার বিনিময়ে বাংলাদেশকে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছিল আমেরিকা। এটাই ছিল ওয়ান-ইলেভেন ক্ষমতা দখলের মূল উদ্দেশ্য। তামাশার দিকটা হলো, যারা ২০০৭ সাল থেকে আমেরিকার এই কাজের সহযোগী ও সমর্থক তারা এই আত্মবিক্রির কাজের কোনো দায়ই টের পান না। তারা তখন মনে করতেন, বাংলাদেশকে দুর্নীতিমুক্ত আর জঙ্গিমুক্ত করতে তারা দেশপ্রেমিকের কাজ করছেন, তাই ‘১/১১’ সরকার তারা এনেছেন। অথচ এরা সবাই মিলে যে কাজটা করেছেন তা হল বাংলাদেশকে ভারতের হাতে তুলে দেয়া। যাথেকে ভারতের প্রথম নগদ প্রাপ্তি হল বিনা পয়সায় করিডোর আর পোর্ট দখল নেয়া। আবার দেখেন, তাদের কথিত সেকালের শতকোটির দুর্নীতি নির্মূল করতে নাকি টিআইবিসহ তারা এ কাজ করেছিলেন। আর তাতে দুর্নীতি এখন কমা দূরে থাক, একালে দুর্নীতি মাপা হয় এখন শ’কোটির বদলে হাজার কোটি দিয়ে। অথচ আমেরিকার ফান্ড বা ইউএসএইডে চলা এনজিওসহ নানান মিডিয়া – এসব প্রতিষ্ঠানের কারো এখনও এনিয়ে বিকার নেই। তারা সেদিন ঠিক কী করেছিলেন যে আজ বাংলাদেশ ভারতের কবলে পড়েছে? আর আজ একেকটা দুর্নীতি মানেই হাজার কোটি টাকায় তা মাপতে হবে- এ বিরাট অগ্রগতিগুলো কেন হলো, কেমন করে? তারা কি এটাই করতে চেয়েছিলেন? তাদের আমেরিকান মুনিব যে বাংলাদেশকে ভারতের হাতে তুলে দিতে যাচ্ছে সেটা তারা জানতে পারেননি কেন? কোনো বাধা দেননি কেন? আজ তারা যখন জানছেন তখন নিজেকে কি জবাব দেবেন?
অথচ তারা এখন গা বাঁচাতে সব দোষ হাসিনার ওপর চাপাতে চান। অথচ সত্যি কথাটা হল তাদের আমেরিকান মুনিব, তাদেরকে ব্যবহার করে বাংলাদেশকে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে। বাংলাদেশে ভারতের প্রভাবের শুরু এখান থেকেই।
প্রথম আলোর দিল্লি প্রতিনিধি সৌম্য “দিল্লির দৃষ্টিতে বাংলাদেশ- সোনালি অধ্যায়ে...’” নামে একটা আর্টিকেল লিখে শ্রিংলা-বেইজ্জতি বিষয়টা ডাকা দিয়ে রাখতে প্রচেষ্টা নিয়েছেন, আলোচনা শুরু করেছেন – তার আলাপটা যেন এমন- শ্রিংলাকে কী কেবল মেরে তক্তা বানানো হয়েছে, নাকি কাপড়ও খুলে নিয়ে গেছে! এ বিষয়ে সেখানে আলোচকদের সিদ্ধান্ত যে, না, জুতার দাম নেয়নি। বাংলাদেশে এখনো প্রণবের অনেক নাকি প্রভাব! আর ঐ লেখাটা ছাপবার পরে কিছুটা দায় মিটাতে প্রথম আলো নিজেও পাল্টা আরেক “ঢাকার দৃষ্টিতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক” লিখতে গেছে। কিন্তু এদুই লেখাতেও সকলেই যার যার কথা বলে গেলেও কেউ বলছেন না যে, বাংলাদেশকে ভারতের হাতে তুলে দিলো কে? তারা বুঝতেও পারেননি প্রণব মুখার্জি এত বড় প্রভাবশালী হয়ে উঠলেন কার ক্ষমতায়? কোন সূত্রে? কে তাকে ক্ষমতাবান বানাল? – না, কারো মুখে এ নিয়ে রা নেই। যেন বাংলাদেশের ওপর ভারতের কর্তৃত্ব বাংলাদেশের জন্মের পর থেকেই? নাকি বাংলাদেশের জন্মেরও আগে থেকে এসব বুজরুকি চলছে।
আমেরিকান অর্থ বা প্রভাবে চলে এমন এনজিওসহ সব প্রতিষ্ঠান নিজেই নিজের অযোগ্যতায় নিজের বিরুদ্ধে কাজ করেছে- বাংলাদেশকে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে অথচ ভাবটা হলো তারা এটা জানে না, নয়ত নির্বিকার। বাংলাদেশকে ভারতের হাতে তারাও তুলে দিল কিভাবে? তাদের কোন আত্মজিজ্ঞাসাও আমরা দেখিনি। এটা নিয়ে কোনো আত্মবিশ্লেষণেও তারা যেতে চান না। বরং সব দোষ শেখ হাসিনাকে দিয়ে নিজেরা হাত ধুয়ে ফেলতে চান। আর তারা অভিযোগ করেন, হাসিনা তাদের ফান্ড এনজিও ব্যুরো পার হতে দেয়া হয় না। কিন্তু আসলে কেন দেয়া হবে?
আমেরিকার যদি সক্ষমতা থাকে ‘১/১১’ সরকার কায়েম করার তা হলে যেকোন সরকারকে সরানোর ক্ষমতাও তার থাকবে, এটি তো সাদা কথা। কাজেই আমেরিকার এই ক্ষমতাকে ঠেকাতে বাধা দিতে হাসিনা ঐসব এনজিও সৈন্য সামন্তদের ব্যুরোসহ যেখানেই পাবেন আটকে রাখবেন – ঠিক কী না? এটাই তো স্বাভাবিক। এটাই তো সেলফ-ইন্টারেস্ট বুঝা লোকের কাজ! তবে এখানে হাসিনা তো অন্তত নিজের ক্ষমতা বা স্বার্থের চিন্তা করেছেন। কিন্তু এই সৈন্য-সামন্তরা? আমেরিকা ভারতের হাতে বাংলাদেশকে তুলে দিলে তাদের কী লাভ – এটা কি তারা চিন্তা করেছিল, না এই যোগ্যতা তাদের ছিল? উত্তর হল, না, কারণ তারা ছিল অনুভূতিহীন মাংসপিন্ড। তাই টেরও পায়নি। ‘ওস্তাদের খেপ মেরে দেয়া’ ছাড়া যারা আর কোন কর্ম করতে কিছু বুঝতে পারে না। যারা সেলফ-ইন্টারেস্টেও বুঝে না। তাই এখন আমরা শুনি টিআইবির সুলতালা কামাল নয়া শোষণ তত্ব দিয়েছেন। সারা জীবন ভারতের স্বার্থে খেদমত আর রাজনীতি করে এরা এখন বলে ‘ভারত বাংলাদেশকে নাকি পাকিস্তানের চেয়ে বেশি শোষণ করছে।’ এই নয়া তত্ত্ব¡ খুব একটা কার্যকারিতা দেখা যায়নি, সম্ভবত সমাজে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা কমে গেছে বলে। এছাড়া কারণ অনেক দেরি হয়ে গেছে। ভারতের হাতে বাংলাদেশকে কে তুলে দিল – এনিয়ে কথা তোলার সাহস ও যোগ্যতা যাদের নেই, তারা এখন নয়া শোষণ তত্ত্ব দিলে লাভ কী? মানুষ তাই বলবে কারা এরা? তবে মুরোদ থাকলে এখন আত্মসমালোচনা করে অন্তত পুরো ঘটনাকে এরা মূল্যায়নেও সক্ষম কি না সেটি করে দেখাক। এরা তো নিজের কৃতকর্মের ভয়াবহতার দিকটাও বুঝতে পারে না!
যা হোক আবার মূল প্রশ্ন- বাংলাদেশকে ভারতের হাতে তুলে দিলো কে- প্রথম আলোতে ঐদুই লেখায় যাদের বক্তব্য নেয়া হয়েছে যেসব ব্যক্তিত্বরা এরাও কেউই এই প্রশ্ন নিয়ে নাড়াচাড়া করতে সাহস করেননি। সবাই ধরে নিয়েছেন বাংলাদেশকে ভারতের হাতে তুলে দেয়ার ব্যাপারটা যেন আকাশ থেকে পড়েছে। বাংলাদেশের ওপর ভারতের প্রভাব যেন জন্ম থেকেই এবং গিভেন!
তবে এখন আর সম্ভবত এসব সত্যি থাকছেনা। যেকোনো কারণেই হোক বাংলাদেশের ওপর ভারতের প্রভাব আদৌ থাকবে কি না, চীনা প্রভাবইবা কতটা থাকবে এর আপাত নির্ধারক সরকারপ্রধান নিজেই। আর রুট ফ্যাক্টস হল, বাংলাদেশে চীনের প্রভাব আগামী দিনেও বাস্তবতার কারণে গভীরই থাকবে। না আমেরিকা না ভারত, এটা আর তারা নির্ধারণ করতে পারবে; সে বাস্তবতাই শুকিয়ে আসছে। আমরা তাদের সব মুরোদ দেখে ফেলেছি। সব বন্ধন ছিন্ন হয়ে বাস্তব এলোমেলো হয়ে গেছে, যেকারণে আর কোনো পুরান বাধনে আবার আটকানো যাবে না।
এ ছাড়া বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা নয় যে এর একেকটা দল চীন, ভারত বা আমেরিকা এভাবে সবাই কারো না কারো লেজ ধরে চলে। যেকোনো কারণেই হোক, আজকের বাংলাদেশটা এমন নয়। এর অন্য অনেক খামতি থাকা সত্বেও। তাই বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা নয়। এছাড়া এখন অন্তত বাংলাদেশের মানুষ নিজে ক্রমেই আরেকটা ফ্যাক্টর হয়ে উঠছে। যেটা শ্রীলংকায় নাই। এই প্রশ্নে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকবে। বাংলাদেশের মানুষের নিজেদের পজিশন আছে, জনমতে তা ক্রমশ শক্ত হচ্ছে যেটা আমল করা ছাড়া সামনে কিছুই হবে না।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
[এই লেখাটা গত ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ওয়েবে ও পরদিনই প্রিন্টেও “বাংলাদেশের ওপর ভারতের প্রভাব” – এই শিরোনামে উপ-সম্পাদকীয়তে ছাপা হয়েছিল। পরবর্তিতে সে লেখাটাই এখানে আরও নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে এখানে আজ ছাপা হল। ]