আমেরিকা ভারতকে হবু চীন-বিরোধী জোটে পাচ্ছে না


আমেরিকা ভারতকে হবু চীন-বিরোধী জোটে পাচ্ছে না

গৌতম দাস

১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০৬  সোমবার

https://wp.me/p1sCvy-3aW

 

চীন মনে করে ইন্দো-প্যাসিফিক বলে কিছু দাঁড়াবে না, কারণ এটা একটা ডেড এন্ড।Hegemonic nature of US Indo-Pacific Strategy exposed – Global Times

[সার সংক্ষেপঃ আমেরিকা চীন ঠেকানোর (Containment) লক্ষ্যে জোট গড়তে চায়, ইন্দো-প্যাসিফিক জোট। সেটাই পরিস্কার করে বলছে এখন।   কিন্তু এই জোটের বৈশিষ্ট্য কী হবে সেটাসহ এর চেহারা গত দুই দিনে অনেকটাই পরিষ্কার করে ফেলেছে। কিন্তু তাদের জন্য খারাপ খবর হল, সে জোটের ‘নৌকায়’ তারা চাইলেও ভারতকে তুলে নিতে পারছে না। ব্যাটে-বলে হচ্ছে না। তারা যেমনভাবে ভারতকে চায় আর বাস্তবের যে ভারত সেদুটোতে মিল নাই। এক নয়, তাই মিলছে না।  গত ৯-১০ সেপ্টেম্বর তাদের নিজেদের মনের কথাগুলো নিয়ে প্রকাশিত কয়েকটা আর্টিকেলে তা পরিষ্কার হয়ে গেছে। ফলে তাদের কথাগুলো  দু’টি শর্ত যুক্ত করে তারা বলছে।  আর ভারতকে সেই শর্তপূরণ সাপেক্ষে ঐ নৌকায় তুলে নেয়া যেতে পারে বলে ঐ আর্টিকেল সিদ্ধান্ত টেনেছে। শর্ত দু’টি হল – যদি ভারতের পতিত অর্থনীতি উঠে দাঁড়ানোর জন্য আবার জোয়ার আনা যায় আর দুই, বর্তমান ভারত রাষ্ট্র, রাজনীতি ও দলে ‘লিবারেল বৈশিষ্ট্য’ হাজির থাকতে হবে – যার মানে হল মুসলমানবিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়ানো মোদীকে বন্ধ করতে হবে। আর প্লুরাল বা একাধিক মুখ ও ধারার রাজনীতি যেখানে পাশাপাশি চলতে পারে এমন সমাজ গড়তে রাজি হয়ে ভারত যদি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়। তবে এটাও পরিষ্কার যে, সাধারণভাবে ভারত তো বটেই বিশেষত মোদীর সরকার এদুই শর্ত কোনো দিনই পূরণ করতে পারবে না। কাজেই সাত মণ ঘি ঢালা হচ্ছে না, রাধাও নাচবে না। কারণ এই শর্ত পূরণ করার অন্তত একটা অর্থ হল, বিজেপি-আরএসএসকে ভাল হয়ে যেতে হবে;  নাম ও রাজনীতি পরিত্যাগ করতে হবে।
সে জন্যই কি আমরা আরেকটা ডেভেলপমেন্ট দেখছি, খুব সম্ভব তাই। রাশিয়ার পুতিনের মধ্যস্থতায় সীমান্ত ইস্যুতে চীন-ভারত ‘”পাঁচ দফা ঐকমত্যের” এক যৌথ বিবৃতির ঘোষণা প্রকাশ করেছে। গত ১০ সেপ্টেম্বর রাতে মস্কোতে এমন সভা সমাপ্ত হয়েছে। রয়টার্সের নিউজ ১১ সেপ্টেম্বর সকাল ৬টায় এই খবর হোস্ট করেছে। এর ফলে পরবর্তী বিস্তারিত দিক বিশেষত ভারতে চীনা বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উপর প্রায় সবকিছুতে যে অবরোধ এবং ঘোষিত-অঘোষিত বাধা আরোপ ও প্রপাগান্ডা চালু করা হয়ে আছে এসবের এখন কী হবে, আমরা এর সম্পর্কে এখনো কিছুই জানি না। তবে বিবিসি ভারতের ব্যবসা-বাণিজ্যের এ দিকটার করুণ অবস্থা নিয়ে “উঠতি বহু ব্যবসার চোখে অন্ধকার”’ শিরোনামে এক রিপোর্ট করেছে।]

 

আমেরিকা তাদের হাতের কার্ড দেখিয়ে ফেলেছে। চীন ঠেকাতে আমেরিকা কী করতে চায় বা কী আশা করে – তা আর্টিকেল লিখে প্রকাশ করে ফেলেছে। অনেকে এ পর্যন্ত এটা-সেটা বলে পেটের কথা বাইরে আনতে চেষ্টা করেছে বিভিন্ন সময়ে। ফাইনালই তারা এখন উপস্থাপনের একটাই ভাষ্য ঠিক করেছে। গুছিয়ে থিতু হয়ে বলা সেই ভাষ্যটা হল – এশিয়ার দেশগুলো কোনদিকে যাবে; চীনের বেল্ট-রোডে নাকি আমেরিকান ইন্দো-প্যাসিফিক জোটে, সেটা তাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বাংলাদেশের চ্যানেল২৪ টিভি একটা নিউজ প্রচার করছে, [এটা ছোট করে আর ওর বাংলা ভার্সানটাই লিঙ্ক দিয়েছি। আগ্রহীরা ‘মুখোমুখি | আর্ল মিলার-যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত’ এই শিরোনামের মূল পুরা ভিডিওটা ইউটিউবে দেখে নিতে পারেন।] এখানে বাংলাদেশে আমেরিকান রাষ্ট্রদূত মিলার আগেই বলে নিয়েছেন, “চীন আমেরিকার শত্রু না, প্রতিদ্বন্দ্বি”। তবে বাংলাদেশ এটা না ওটা নেবে সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে বলে এখানে ‘চোঙ্গা ফুকতে’ দেখা গেল। তবে বাংলাদেশের কোনোটাই না নেয়ার অপশন আছে কি না স্পষ্ট বোঝা যায়নি।
এছাড়া এই উপস্থাপনে সবচেয়ে বড় অসঙ্গতিটা হল, চীনা বেল্ট-বোড প্রকল্পের সাথে আমেরিকার “ইন্দো-প্যাসিফিক জোট” – এদুটার মধ্যে তুলনা টানা চলে না, এরা সমতুল্য বিষয়ই নয়।  বেল্ট-রোড মূলত একট প্রজেক্ট যাকে বড়জোড় বহুদেশকে সামিল করে নেয়া চীনের এক অর্থনৈতিক মেগাপ্রকল্প বলা যেতে পারে।  বিপরীতে প্রথমত, ইন্দো-প্যাসেফিক জিনিষটা কি তা এখনও স্পষ্ট না। যেমন রাষ্ট্রদুত মিলার চ্যানেল২৪-কে বলেছেন ইন্দো-প্যাসেফিক ‘নেশনস্‌ মানে রাষ্ট্রের জোট।  কিন্তু সেক্ষেত্রেও কথা হল এটা কী সামরিক জোট না অর্থনৈতিক জোট, তা অস্পষ্ট। অন্তত অর্থনৈতিক তো নয়ই।  আহলে বেল্ড-রোড এর সাথে এটা তুলনীয়ই নয়। তবে আমেরিকান থিঙ্কট্যাঙ্কগুলো সময়ে ইন্দো-প্যাসেফিক বলতে এক যুদ্ধজোটে সামিল করা্র কথা বুঝিয়েছে। যে জোটের ভিতরে আবার আছে কোয়াড [QUAD] জোট। কোয়াড মানে আমেরিকা জাপান, অষ্ট্রেলিয়া ও ভারত এই চার রাষ্ট্রকে নিয়ে কথিত চীনবিরোধী যুদ্ধজোট। যেটা আবার এখনও পর্যন্ত গত সর্বশেষ পাঁচবছর ধরে – এক পা আগে তো দু’পা পিছে এমন হয়ে আছে। তাহলে কথা দাড়ালো,  ইন্দো-প্যাসেফিক এই শব্দগুলো মিলারের ভাষার ‘নেশনস’ হোক কিংবা অন্যদের ভাষ্যে সেটা ‘যুদ্ধজোট’  যাই হোক তা অন্তত বেল্ট-রোড – এই অর্থনৈতিক প্রকল্পের সাথে তুলনা করা যায় এমন সমতুল্য কোন বিষয় বা ফেনোমেনা হতেই পারে না।
আবার চ্যানেল২৪ নিজে এটাকে ইন্দো-প্যাসেফিক “করিডোর” বছে।  কেন বলছে এর কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। ফলে সবমিলিয়ে  যারা ভেবেছিলেন বাংলাদেশে ‘চীনা প্রভাব’ ছুটানোর জন্য ভারতের সর্বাত্মক তৎপরতা চীন-ভারতের লাদাখ সীমান্ত সংঘর্ষের কারণে হাজির হয়েছে, তাদের অনুমান ‘ভুল’। বিষয়টা আসলে হল – এশিয়ার চীনের বিরুদ্ধে একটা শেষ লড়াই লড়ার খায়েশ এখন আমেরিকান নির্বাচনের আগে আমেরিকার দুই দলেরই (বাই-পার্টিজান) খায়েশ হয়ে দাড়িয়েছে, এই হল বাস্তবতা। খালি তফাত এটুকুই যে, ট্রাম্প জিতলে একটু কৌশলে ভিন্নতা থাকবে যেটা বাইডেন জিতলে তুলনামূলকভাবে সফট কৌশল হবে। অর্থাৎ এশিয়ার চীনের বিরুদ্ধে আমেরিকান লড়াইয়ের চেষ্টা শুরু  হবে আসন্ন আমেরিকান নির্বাচনের পরের বিজয়ী প্রশাসনের হাত দিয়ে। কিন্তু লড়াই একটা কমবেশি হবে সেটা নিশ্চিত।
সেটা হলেও এটাকে শেষ লড়াই বলছি এ জন্য যে, ঠিক এটাই ওবামার প্রথম টার্মে ২০১১ সালে চেষ্টা করা হয়েছিল , ‘এশিয়া পিভোট’ নাম দিয়ে যা ওবামার সেকেন্ড টার্মেও বিস্তৃত থাকলেও বোঝা গিয়েছিল যে, এটা অকেজো, কাজ করছে না; মানে ভুয়া চেষ্টা। ব্যাপারটা সার কথায় বললে, ‘পিভোটে’ অনুমানে ধরে নিয়েছিল এশিয়ার রাষ্ট্রগুলো মনে করে, চীন এক আগ্রাসী শক্তি। আর তাই এই শক্তির বিরুদ্ধে এশিয়ার দেশগুলোকে একটা চীনবিরোধী সামরিক জোটে আমেরিকা শামিল করতে পারবে বলে ধরে নিয়েছিল। কিন্তু এই অনুমান সঠিক ছিল না। তাই এটা ফেল করে যায়, কারণ এশিয়ার দেশগুলো বলতে চায় – চীনের অনেক কিছুতেই তাদের বিরোধিতা বা অপছন্দ থাকলেও সে জন্য আমেরিকান নেতৃত্বে কোনো চীনবিরোধী জোটে বা যুদ্ধজোটে তাদের ঢুকতেই হবে, এটা হবে আত্মঘাতী। এতে ‘ওভার অ্যাক্ট’ করা হয়ে যাবে। এর চেয়ে চীনের সাথে যদি কোনো দেশের সীমান্তবিরোধ থাকে তা নিয়ে আপত্তির কথা নিয়মিত বলে যাওয়া ও ডায়ালগের চেষ্টা (এব্যাপারে আদর্শ উদাহরণ সম্ভবত প্রেসিডেন্ট দুতের্তো-র ফিলিপাইন) করে যেতে হবে।
আর একই সাথে, উঠতি অর্থনীতির চীনের সাথেই অর্থনৈতিক (পুঁজি-পণ্য বিনিময়ের গভীর ) সম্পর্ক জোরদার করা হবে নিজ দেশ পরিচালনার সঠিক কৌশল। এর বিপরীতে কোনো যুদ্ধের সম্ভাবনার মধ্যে নিজ দেশকে ফেলে দেয়ার মানে হবে অর্থনৈতিকভাবে নিজ দেশকে শেষ করে দেয়া। কাজেই ঐ আমেরিকান কৌশলের পক্ষে প্রায় কেউই নামেনি। তাই ওবামার শেষ বছর, পুরো ২০১৬ সালটাই ছিল আসলে তার ‘পিভোট’ গুটানোর বছর। কিন্তু পরে ট্রাম্প আমলে নিজের টার্মে চীনবিরোধিতাও তিনি অবশ্যই করেছেন, কিন্তু নিজে জাতিবাদী আমেরিকান হিসেবে আর অবশ্যই তা চীনবিরোধী কোনো জোট গড়তে অনাগ্রহী থেকে। এর ফলে আগে ‘চীন ঠেকানোর’ রাজনৈতিক তৎপরতার ধারা জারি রাখা বা আমেরিকান থিঙ্কট্যাংকগুলোর জন্য গাইড হিসেবে যে ভূমিকা রাখছিল ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে এসে পেন্টাগন বা স্টেট ডিপার্টমেন্ট সে কাজ থেকে নিজেদেরকে  প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। এ কারণে গত দুই বছর ধরে কিছু আমেরিকান থিঙ্কট্যাঙ্ক আবার নিজেরাই ‘চীন ঠেকানোর’ লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছিল। এবারের এই মিশনের মুখ্য ভূমিকায় ছিল ও আছে থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘আটল্যান্টিক কাউন্সিল’ [www.atlanticcouncil.org]। এর মূল ভূমিকাটা হল যেন, মোদীর ভারতকে আমেরিকান নৌকায় তোলা, এটাকে সর্বক্ষণের ধ্যানজ্ঞান করা। একাজে তাদের জন্য  মূল গুরুত্বপুর্ণ প্রিয় ব্যক্তিত্ব এস জয়শঙ্কর, তিনি মোদীর এখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী। যার সাথে  প্রায় সর্বক্ষণ যোগাযোগের মাধ্যমে মোদী সরকারের সাথে সম্পর্ক রাখছে। কারণ আবার উল্টাদিকে মোদীর এক ট্রমার নাম হল চীন। চীন আবার কোন সামরিক পদক্ষেপ নিয়ে ১৯৬২ সালের মত ভারতকে মার দিয়ে যায় কি না!  এরই কাউন্টার হিসাবে নিজের নিরাপত্তাবোধ, সেফবোধ করার জন্য বিশেষত মোদীকে আমেরিকা যতই তুচ্ছতাচ্ছিল্য অথবা কেবল নতুন নতুন আমেরিকান অস্ত্র কিনবার জন্য চাপ সব সহ্য করে হলেও আমেরিকা পাশে আছে এই বোধটা মোদী পেতে চেয়ে এসছেন। আর মোদীর ধারণ তার মনোবাসনা সবচেয়ে ভালভাবে আমেরিকায় ঠিক ঠিক জায়গায় কানে তুলতে পারেন একমাত্র জয়শঙ্কর। তাই ‘আটল্যান্টিক কাউন্সিল’  আর মোদী এই দুজনের মাঝে জয়শঙ্কর, দুদিকেই দুজনে দুজনার। যদিও  ‘আটল্যান্টিক কাউন্সিল’ ছাড়াও অন্য আরোদিকে ভূমিকা রাখছিল আরেক থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘কার্নেগি এন্ডোমেন্ট’  [Carnegie Endowment[ আর কার্ণেগি ইন্ডিয়ার ওয়েবপেজ এখানে

এই ‘কার্নেগি এন্ডোমেন্ট’ (সংক্ষেপে এন্ডোমেন্ট বলব)  সেই বুশের আমলে ২০০৬ সাল থেকে এই কাজে ভারতে ভূমিকা রেখে চলেছে। তবে রেজিস্ট্রার্ড ইন্ডিয়ান শাখা হয়েছে অনেক পরে আর, তবে সেটা সম্ভবত এনজিও হিসাবে। ভারতের চীনবিরোধী বয়ান ভাষ্য যাই আমরা ভারতে চালু থাকতে দেখি বিশেষত, সকল ভারতীয় থিঙ্কট্যাংকের ফান্ড পাওয়া এবং তাদের যে কমন এক বয়ানে অবস্থান, এটাকে সাজিয়ে দিয়েছে  মূলত এই কার্নোগি এন্ডোমেন্ট। যেমন, “চীন ভারতকে মুক্তমালার মতো ঘিরে ফেলছে” অথবা চীন “ঋণের ফাঁদে” সবাইকে ফেলছে ইত্যাদি।  এন্ডোমেন্টের আরেক বড় ফান্ড দিবার খাত হল তরুণ গ্রাজুয়েটদেরকে  মাস্টার্স পড়তে বা পিএইচডি করতে পশ্চিমে যেতে স্কলারশীপ দেওয়া। আসলে এর বিনিময়েই তাদেরকে আমেরিকান বয়ানে দীক্ষা নিতেই হয়।  তাই কার্নোগি এন্ডোমেন্ট এর প্রধান কাজ আমেরিকান বয়ান ছেয়ে ফেলা, খাড়া করা ও নিয়ন্ত্রণ করা। ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর নিজের জাতিবাদী রাজনীতিতে নিজেকে হাজির করার আগে পর্যন্ত এন্ডোমেন্ট প্রবলভাবে ভারতে নিজের ফান্ড ঢেলে তৎপর ছিল। নিয়মিত তরুণদের মাস্টার্স বা পিএইচডির জন্য স্কলারশিপ বরাদ্দ করেছে আর ওসব বয়ান মুখে তুলে দিয়েছে। কিন্তু ট্রাম্পের অবস্থান তাদেরকে এরপর থেকে তৎপরতা ছোট করে আনতে বাধ্য করেছিল। আগে এর বড় কর্মকর্তা  ছিলেন সি রাজামোহন। তিনি সম্ভবত এখন এটা ছেড়ে সিঙ্গাপুরের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু একটা মজার তামাশা ঘটেছে। রাজামোহন অনেক আগে থেকে নিয়মিত ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় সাপ্তাহিক কলাম লিখে থাকেন। লাদাখে চীনা হামলায় অন্তত ২০ জন ভারতীয় সেনা মারা যাবার পরে তাঁর লেখা একটা কলামের শিরোনাম মোদীর উচিত চীনকে এক পরাশক্তি বলে মেনে নেওয়া। মানে মোদীকে এককালে আমেরিকান বয়ানে সাজিয়ে এখন মোদীকে উলটা পরামর্শ দিচ্ছেন চীনকে মেনে নিতে।

সেই কার্নেগি এন্ডোমেন্টে এখন আরো অনেক ততপর।  এন্ডোমেন্টের পক্ষ থেকে এশলে জে তাল্লিস [Ashley J. Tellis,, Tata Chair for Strategic Affairs; মানে হল তাল্লিসের কাজের চেয়ারের জন্য ফান্ড দেয় ভারতের টাটা কোম্পানি]। তিনি আমেরিকান আগামী সম্ভাব্য অবস্থানের ডকুমেন্টটা তৈরি করেছেন। লেখাটা এখানে পাবেন।  এই লেখাকে কার্নেগি এন্ডোমেন্টের পক্ষ থেকে সাম্প্রতিক পলিসি ব্রিফিং হিসেবে দেখতে বলে – উল্লেখ করে হিন্দুস্তান টাইমসে একটি আর্টিকেল ছাপানো হয়েছে। সেটা আবার লিখেছেন মঞ্জরি চ্যাটার্জি মিলার, যিনি বোস্টন ইউনিভার্সিটির পারদি স্কুলের [Frederick S Pardee School of Global  Studies] অধ্যাপক। তিনি নিজের লেখাটা আনাদেরকে  পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন এভাবে – “আমেরিকার দীর্ঘ দিনের এক খায়েশ, ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে এশিয়ায় কাউন্টার-ওয়েট হিসেবে কাজে লাগায়। ভারত কী তা করবে?’ [The United States has long wanted it to act as a counterweight to China. Will Delhi do so?]
ঐ পুরো লেখাতেই গুরুত্বপূর্ণ শব্দ হল এই ‘কাউন্টার-ওয়েট’ [Counterweight to China], বাংলায়, চীনের পাল্টা ওজন বা বাটখারা।  এশলের এই লেখাটা ছাড়াও অধ্যাপক মঞ্জরি আরেকটা লেখার কথা তুলেছেন। তা হল- ড্যানিয়েল টেনরিরো [DANIEL TENREIRO] এর লেখা; যার শিরোনাম ‘এশিয়ায় চীনের পাল্টা বাটখারা হিসেবে ইন্ডিয়া’ [India as Counterweight to China in Asia]

ড্যানিয়েলের লেখাতে পরিষ্কার যে, ভারতকে চীনের কাউন্টার-ওয়েট হিসেবে এশিয়ায় পাওয়া- এর প্রয়োজনটা ভারতের নয়। বরং, খোদ আমেরিকার ও ড্যানিয়েলের মতো স্ট্র্যাটেজিস্টদের। তাই ড্যানিয়েল বা মঞ্জরি আশা রাখছেন, ভারত কি আমেরিকার হয়ে কাউন্টার-ওয়েট বা চীন ঠেকানোর  ভূমিকায় নামবে? কিন্তু কেন?

কারণ স্ট্র্যাটেজিস্টদের মনের খায়েশ হল – চীনের পাল্টা ওজনদার রাষ্ট্রটাকে (ভারতকে) হতে হবে আমেরিকার হাতের পুতুল। চীনের মত না হলেও অর্থনৈতিক সম্ভাবনাময় হতে হবে। আর মি. এশলে কোনো লাজলজ্জার বালাই না রেখে বলেছেন, ভারত বা সেই পাল্টা ওজনদার রাষ্ট্রটাকে দু’টি শর্ত মানতে হবে- ‘ইকোনমিক অগ্রগতি’ [‘economic momentum’ ] ফেরত আনতে হবে আর ‘লিবারেল বৈশিষ্ট্যের’ [‘liberal credentials’] হতে হবে।

কথাটাকে বাংলাদেশিদের বুঝার মত করে বলতে গেলে এভাবে বলা যায়, বাংলাদেশকে যেমন ২০০৯ সাল থেকে ভারতের জন্য “ওপেন মার্কেট” আর ভারতের চোখে যথেষ্ট  “লিবারেল” বৈশিষ্টের মনে হয় এমন করে সাজিয়ে দেয়া হয়েছিল বা বাংলাদেশ ভারতের জন্য এমন দুটা শর্ত পূরণ করা হয়েছিল। ঠিক সেই রকমই এবার আমেরিকারও খায়েস হল, ভারতেকে আমেরিকার জন্য “ওপেন মার্কেট” আর আমেরিকার চোখে ভারতকে  যথেষ্ট  “লিবারেল” বৈশিষ্টের মনে হয় এমন করে সাজানোর শর্ত পূরণ করা হোক – এই হল এশলে, মঞ্জরি বা ড্যানিয়েলের মত স্ট্রাট্রজিষ্টদের আমেরিকার জন্য খায়েস ও প্রেসক্রিপশন। তবে বাংলাদশের বেলায় যেমন একজন প্রণব মুখার্জি ছিল আমেরিকার বেলায় নিশ্চয় একটা সাদা চামড়ার প্রণব মুখার্জি থাকবে, সেটা কে তা এখনও জানা যায় নাই।

কিন্তু কেন এশলে কে ভারতের নাম এমন শর্ত আকারে বলতে হল? এশলে লেখাটার শিরোনামের দিকে তাকালে দেখি তা হল,  ‘বড় লীগে যোগ দিতে হলে ভারতের রাস্তা’ [Indias Path to the Big Leagues]। এর মানে আসলে এশলে তার লেখাটা শুরুর আগেই বুঝে গেছেন, ভারত চীনের পাল্টা তাদের পেয়ারের কাম্য  হবু ওজনদার দেশটা হচ্ছে না। হতে পারছে না। পারবে না। তাই তিনি তখন সরাসরি লিখতে বসেছেন- ‘কেন ভারতকে দিয়ে হবে না’। সে কারণে উল্টা করে লিখতে বসেছেন কোন শর্ত পূরণ করলে হবে। যেখানে এশলে জানেন, এই শর্ত ভারত পূরণ করতে পারবে না। তাই তিনি শর্ত লাগিয়ে বলছেন।

আবার সমালোচকের চোখ দিয়ে দেখে বললে, এশলে অ্যান্ড গং-এরা চীনের কাউন্টার-ওয়েট বলে কাউকে খুঁজেই পাবে না। যদিও ভারতের প্রবল আর বিশেষ ‘খামতি’ আছে। কিন্তু ভারতের খামতি না থাকলেও এশলেরা ভারতকে বেছে নিতে পারতেন না। কেন?

কারণ আমেরিকার দরকার এমন এক ভারত যাকে সে চীনবিরোধী তাদের মডেল দেশ হিসেবে তারা তুলে ধরতে পারে। চীন খারাপ, চীন আদর্শ না, চীন কথিত লিবারেল দেশ নয়, ইত্যাদির বিপরীতে যেন তারা এমন ভারতকে তুলে ধরতে পারে – যে ভারত আমেরিকার চোখে আদর্শ ও কাম্য দেশ, এভাবে। কিন্তু তাহলে আবার ভারতকে এমন আদর্শ দেশ বলে ফুলানোরই বা আমেরিকার কেন বা কী দরকার? দরকার এ জন্য যে, ভারত লিবারেল- এই প্রশংসা করে এর বিনিময়ে ভারতের ওপর মাতব্বরিটা  আমেরিকা নিজের হাতে তুলে নিতে চায়, ভারত না আমেরিকার জন্য বিপুল বিনিয়োগ আর লাভালাভের কেন্দ্র বানাতে চায় ভারতকে। সে জন্য ভারতে তাদের “ইচ্ছামতো একটা সংস্কার” করে সাজিয়ে নিতে চায়। কিন্তু এখানে সাবধান। এখানে কথাটা এভাবে বলাতে ভারতের অর্থনীতিকে ভারতের নিজেরই জন্য কোন সংস্কার দরকার নাই, এটা বুঝে বা ধরে নেওয়া চভুল হবে। ভারতের অর্থনীতির সংস্কার দরকার অবশ্যই আছে। কিন্তু এর মানে “আমেরিকার স্বার্থে ভারতের অর্থনীতির সংস্কার” – এমন বুঝা বিরাট ভুল ও ভিন্ন অর্থ হবে।

যেমন- এশলের লেখায় আরো দু’টি বিশেষ শব্দ আছে- ‘ফাস্ট-গ্রোয়িং ‘ফ্রি মার্কেট ডেমোক্র্যাসি’[fastest-growing free market democracy]। এর মধ্যে সোনার পাথরের বাটি ধরণের অর্থহীন শব্দটা হল – “ফ্রি মার্কেট ডেমোক্র্যাসি”। এখানে ‘ফ্রি মার্কেট’ শব্দের সাথে ‘ডেমোক্র্যাসি’ শব্দের কী সম্পর্ক? এসবের অর্থহীন কথা ও শব্দের ভজকট মিশাল দিয়ে তারা খাড়া করেছে যাতে তাদের স্বার্থটা সহজে বুঝা বা ধরা না যায়। অথচ এর ভেতর দিয়ে তারা বুঝাতে চায়- ভারতকে আমেরিকার ডমিনেটেড বাজার ব্যবস্থা করে গড়ে পেতে চায় তারা। কিন্তু জবাব দিতে চায় না ভারত কেন এটা আমেরিকাকে দেবে? ইন্ডিয়ান পুঁজি আর ব্যাবস্থাপনা দক্ষতা কী নাই? পুঁজি ঘাটতি থাকতে পারে কিন্তু তা বলে ভারত সব আমেরিকার হাতে ছেড়ে দিয়ে অধস্থন নিতে হবে কেন?  এসব বিদ্যানেরা সংস্কার আর লিবারেল – এসব শব্দের আড়ালে আমেরিকান স্বার্থটা হাসিল করতে চায়।
যে কথা বলছিলাম, ভারতের নিজস্ব অন্য খামতি যে নাই তা নয়। যেমন ভারতের রুট সমস্যা তথাকথিত স্বদেশিয়ানা বা অর্থহীন ‘আত্মনির্ভর অর্থনীতি’ ধরণের কথাবার্তা। মোদীও বলতে ভালোবাসেন, তিনি “আত্মনির্ভর অর্থনীতির” লোক। ভালো কথা। তার যা ইচ্ছা হতে চান, হবেন। কিন্তু মোদী তাহলে আবার রফতানি করতে ডলার গুনতে ভালোবাসেন কেন? ওসব ডলার পেয়ে জমিয়ে তিনি কী করবেন? ডলার জমানো মানেই তো তিনি আমদানিও করবেন! তাহলে উনার ‘আত্মনির্ভর অর্থনীতি’ কোথায় রইল? আবার মোদীর খুব খায়েশ দুনিয়াটা এমন হয়ে যাক যেন তিনি কেবলই রফতানি করতে পারেন। যেন সবাই তাকে রফতানি করতেই দিক! অথচ এটা তো অসম্ভব কল্পনা। তবু ভারতের খায়েশ, দরকার হলে সুযোগ পেলে অন্যকে পুরনো কায়দায় কলোনি করে শাসন করা। তবে ‘আত্মনির্ভর অর্থনীতি’ তার বাস্তবে যতটা না দরকার এর চেয়ে বেশি শব্দটা প্রপাগান্ডা হিসেবে দরকার। কারণ উগ্র হিন্দু জাতিবাদের জোশ তুলতে তথাকথিত স্বদেশিয়ানা বা অর্থহীন ‘আত্মনির্ভর অর্থনীতি’ শব্দগুলোর প্রপাগান্ডা-মূল্য অনেক। তবে আবার সাবধান এই কথিত জাতিবাদী স্বদেশিয়ানার উদ্ভট ধারণা – এসব  বিজেপির একার নয়, নেহরু আমল থেকেই ভারতের সব রাজনৈতিক দলের কমবেশি অবস্থানই এটা;  এটা একই সমস্যা ভারতজুড়ে।

মজার ব্যাপারটা হল, একমাত্র চীন-ভারতের অর্থনৈতিক সম্পর্কের বেলায় এই সমস্যাটা তুলনায় কম। কারণ চীন ব্যাপারটা দেখে এ জায়গা থেকে যে, তার পার্টনার দুনিয়ার সব সমস্যারই ডিপো হতে পারে। হলে তা হোক। তাই এটা ধরে নিয়েই চীন পার্টনারের সমস্যা কী সেদিক থেকে না গুনে বরং প্রাকটিক্যালি মাঠে ঠিক কী হলে চীন কাজ করতে পারে সেটা পূরণ আছে কি না সেদিক থেকে মাপা শুরু করে। নইলে বলে দেয়, সে পারবে না। এ জন্য চীনের সাথে ভারতের কাজের সম্পর্ক তুলনায় ভালো। আর চীনের অ্যাপ্রোচ ব্যবহারিক দিক থেকে বলে ভারতীয়রাই বদলে যায়; মেনেও নেয়। কারণ তারা দেখে তারা এই ব্যবহারিক বদলটা না করলে চীনের সাথে সম্পর্ক বা ডিলটাই হবে না। চীনাদের এই অ্যাপ্রোচে সুবিধার দিক হলো –  পার্টনারের নিজস্ব  প্রবলেমটা কী এটা নিয়ে আগেই তারা ঝগড়া শুরু করে না। যাই হোক, সার কথাটা হল – আমেরিকানদের সাথে কোনো ভারতীয় জাতিবাদীর কিল হওয়া একেবারেই অসামঞ্জস্যপূর্ণ। তাতে দোষ কার অথবা কে কতটা ভালো-মন্দ সে আলাপ উঠায় রাখি।

তাহলে এখন কী হবে?
বাস্তবতা হচ্ছে, আমেরিকার ‘চীন ঠেকানো’ কাজে কাউন্টার ওয়েট হিসেবে ভারতকে ব্যবহারের পক্ষে ভারতের সাথে কোনো সম্পর্কই কার্যকর হচ্ছে না; যদিও এমন ভাব নেয়ার অঙ্গভঙ্গি সম্ভবত জীবিত ও জারি থাকবে। অনেক সময় মানুষ তা চায় না বলে কোন প্রমাণিত সত্য জিনিস মেনে নিতেও তার কষ্ট হয়। তেমন অবস্থার উদ্ভব হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আর মোদীর কাছে  এখন সম্ভবত এটা প্রমাণিত যে, চীন তার হিন্দুত্বের রাজনীতির জন্য তুলনামূলক ভালো বিকল্প। তবু চীনের বেলায় যেটুকু সঙ্ঘাত বারবার সামনে এসে পড়বেই সেটা বারবার এড়িয়ে হলেও মোদী চলতে পারবেন। কিন্তু যেটা সহসা চীন-ভারত সম্পর্ককে আগের জায়গায় ফিরতে দেবে না তা হলো- সারা ভারতে ‘চীন আমাদের শত্রু’ বলে যে ক্যাম্পেইন মোদী চালিয়েছেন তা সহসাই লোপ পাবে বা উধাও হবে না।

আবার অন্য দিকে, আমেরিকা ও তার বন্ধুরা যেটাকে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক জোট’ বলে ড্রাম পিটাচ্ছে এই প্রপাগান্ডাও সহসাই থেমে যাবে না; তাতে ভারতের সাথে আমেরিকার কোন সম্পর্ক হোক আর নাই হোক তা জারি থাকবে। দ্বিতীয়ত, এি জোটের আরেকটা নাম আছে, এশিয়ান-ন্যাটো। মানে ইউরোপে যেমন ১৯৪৫ সালের পরে সোভিয়েতবিরোধী সবাইকে ন্যাটো সামরিক জোটে জড়ো করা হয়েছিল, সেই ন্যাটোই যেন এবার এশিয়ায় জাগতে যাচ্ছে, এমন ভাব শুরু করা হয়েছে। মোদীর প্রো-আমেরিকান মন্ত্রী জয়শঙ্কর তাই একবার বলেন, ভারত জোটনিরপেক্ষ দেশ; আরেকবার বলেন, জয়শঙ্করদের এশিয়ান ন্যাটোর স্বপ্নের কথা। ব্যাপারটা নিয়ে জয়শঙ্করের সবচেয়ে বড় সমালোচক হলেন প্রচণ্ড ক্ষেপা এমকে ভদ্রকুমার, তিনি এক সিনিয়র সাবেক ভারতীয় কূটনীতিক রাষ্ট্রদূত ও বর্তমানে দুহাতে লেখা এক কলাম লেখক।https://www.reuters.com/article/us-india-china-idUSKBN262039তামাশার দিকটি হল – এই জয়শঙ্করই আবার মস্কোতে সাংহাই করপোরেশনের মিটিংয়ে হাজির হওয়ার উছিলায়  মস্কোর মধ্যস্থতায় চীন-ভারত যে পাঁচ দফা আপস সমঝোতা করল সেখানে ভারতের প্রতিনিধি। জয়শঙ্করের গা থেকে তখনো আমেরিকান কোনো ডিনারের ঢেঁকুর উঠছিল হয়ত। তবে রয়টার্সই একমাত্র এর ব্যাপক রিপোর্টিং করেছে। তাতে তারা দু’টি ছবি ছেপেছে যেখানে রাশিয়া, চীন ও ভারতের তিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফানি পোজ দিয়ে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু তিনজনই ‘ফানি’ভাবে নানা অঙ্গভঙ্গি করে ছবি তুলেছেন, যেটা অবশ্যই কূটনৈতিক আচরণ না হলেও; একটু ইনফরমাল মুড প্রকাশ করেছে যেন, আমেরিকাকে তিনজনে ঠাট্টা করতে এসব করেছেন। এর বটম লাইনটা হল, চীন-ভারতের সম্পর্ক  আবার আগের বন্ধুর মুড়ে ফিরে যাওয়া শুরু করবে হয়ত। কিন্তু তা কতটা? মনে হয় না খুব সহসাই সেটা আগের লেভেলে ফিরে যাচ্ছে। আর দ্বিতীয়ত, চীন ঠেকানোর কাজে ভাটা পড়লে আমেরিকা তো কাজের অভাবেই মারা যাবে! একমাত্র একটু ভরসা, নির্বাচনে বাইডেন যদি জিতেন। সে ক্ষেত্রে চীনের থেকে বাণিজ্যে আমেরিকার জন্য অনেক বড় ছাড় আনতে পারবেন তিনি। ফলে ট্রাম্প আমলের বাণিজ্যযুদ্ধের অনেকটাই স্মৃতিতে পেছনে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। কিন্তু হিউম্যান রাইট ইস্যুতে বাইডেন অনেক বেশি চীনকে ঘায়েল করবেন। কমবেশি আমরা নিশ্চিত। এ ব্যাপারে ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার সেক্রেটারি অব ডিফেন্স মার্ক এস্পারের আমাদের প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোনকল করেছেন যেটা অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। ঢাকার অভ্যন্তরীণ মিডিয়া ‘রোহিঙ্গা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে সহায়তার’ ওপর জোর দিলেও ঢাকার দূতাবাসের বিবৃতিতে “একটি অবাধ ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিকের প্রতি তাদের যৌথ প্রতিশ্রুতির” কথা বলে সেখানে জোর দেয়া হয়েছে। রাষ্টড়দুত মিলারের “বাংলাদেশের জন্য ইচ্ছা কোনদিকে যাবে – এই ভাষ্যের তুলনায় এসপারের ভাষ্য অনেক এগ্রেসিভই বলতে হয়।  এর অভ্যন্তরীণ আমেরিকান মেসেজটা হল – যেন বলতে চাচ্ছে, আমরা চীন ও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে হিউম্যান রাইট ইস্যুতে শক্তভাবে চেপে ধরতে আসছি। ফলে আমরাও আপনার কাছে গুরুত্ব চাই। ইন্দো-প্যাসিফিক ইস্যুতে তাই আমাদের ক্যাম্পে আসুন। অর্থাৎ ভারতকে আমেরিকা পাচ্ছে না, আপাতত এটাই সারকথা মনে হলেও মিয়ানমার বা ইন্দো-প্যাসিফিক ইস্যুতে বাংলাদেশের জন্য এগুলো ডমিনেটিং বিষয় হতে যাবার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে গেল। তবে বাংলাদেশের সাথে আমেরিকান প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা অথবা ইন্দো-প্যাসিফিক জোট কোথায় সম্পর্কিত তা এই ফোনকল স্পষ্ট করতে পারেনি।  হাসিনা চাইবে আমেরিকা, চীন ও ভারত স্কলকেই পাশাপাশি রেখে দিয়ে একটা নিউট্রাল অবস্থান নিয়ে দাঁড়িয়ে যেতে। বাংলাদেশের জন্য সেটাই সঠিক ও আদর্শ অবস্থানই হত, অবশ্যই। কিন্তু তা হাসিনার জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জিং, কারণ তার মূল জিনিষটাই নাই। পাবলিক সাপোর্ট বা রেটিং।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

 

[এই লেখাটা  গত  ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০, দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ওয়েবে ও  পরদিনই প্রিন্টেও  “আমেরিকা ভারতকে হবু জোটে পাচ্ছে না” – এই শিরোনামে উপ-সম্পাদকীয়তে ছাপা হয়েছিল।  পরবর্তিতে সে লেখাটাই এখানে আরও নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে এখানে আজ ছাপা হল। ]

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s