“সারা কাশ্মিরই ভারতের” দাবির পরিণতিতে লাদাখে হাতছাড়া
গৌতম দাস
২১ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০০:০৬ সোমবার
আকসাই চিন [Aksai Chin] যেটা ভারতের ভাষায় ‘লাদাখ’ তা নিয়ে চীনের সাথে ভারতের কোন একবার সীমান্ত ভুখন্ড চুক্তি করা বা এলএসি টানতে সমঝোতা করার মানেই এরপর ‘সারা কাশ্মিরই ভারতের’ এই দাবি করার ভারতের আর সুযোগ নাই। কারণ চুক্তি করা বা এলএসি টানা মানেই আকসাই চিন চীনেরই ভুখন্ড তা মেনে নিয়েই চুক্তি করতে যাওয়া হয়েছিল। তাই চীন-ভারতের ১৯৯৬ সালের এলএসি সমঝোতা চুক্তি মানেই আকসাই চিন চীনের বলে স্বীকার করে নেওয়া। কাজেই এরপর অমিত শাহের সংসদে লোকসভায় (৫-৬ আগষ্ট ২০১৯) “সারা কাশ্মিরই ভারতের” বলে ঘোষণা করা মানে এটা আগের – ১৯৯৬ সালের এলএসি সমঝোতা চুক্তিকে একপক্ষীয়ভাবে অস্বীকার বা বাতিল করা। এভাবে মোদী-অমিত প্রমাণ করেছে ভারত এক অশিষ্ট রাষ্ট্র (rogue state)।
দুই পড়শি রাষ্ট্রের সীমান্ত [border] জিনিষটা খুবই অদ্ভুত। সীমান্ত একার হয় না। আপনার নিজ রাষ্ট্র-সীমানা কতদুর – সেটা হল আপনার পড়শির সাথে আপনি আলোচনা করে, সেখানে নানান পুরানা ম্যাপ বা যুক্তি-কারণ দেখিয়ে একটা ঐক্যমত্যে এটা যতদুর বলে আপনারা পরস্পর সাব্যস্ত করেছেন। আর সেই ঐক্যমত্যের সীমানা এরপরে একটাই ম্যাপে তা চিহ্নিত [demarcate] করেছেন। এবার সেই একই ম্যাপের দুইটা কপি দুই রাষ্ট্র নিয়ে রেখে দিয়েছেন। অর্থাৎ পুরা প্রক্রিয়াটা দুই রাষ্ট্র মিলে; যার সোজা মানে সীমান্ত একা চিহ্নিত করা যায় না।
আচ্ছা সীমান্ত একা একাই দাবি করলে মানে যেকোন কিছু একটাকে নিজের সীমানা বলে দাবি করলে কী হবে?
এর উত্তরটা খুব সহজ। সেটা ডিমার্কেটেড সীমানা হবে না। তা না হলেই বা কী অসুবিধা? সেক্ষেত্রে প্রথমত সেটাকে বলা হবে – “বিতর্কিত সীমান্ত” – মানে হল অপর পক্ষ সেটা মানে না। একমত না কারণ তার ধারণা ভিন্ন। আর সেখান থেকেই এবার লাইন অব কন্ট্রোল অথবা লাইন অব একচুয়াল কন্ট্রোল বা এলএসি ধরণের নতুন নতুন শব্দের উতপত্তি। আর বলাই বাহুল্য অনবরত সীমান্ত টেনশন। আর সেখান থেকে কখন না যুদ্ধ লেগে যায় অবস্থা, মাথার উপর টিকটিক। আর এর উলটাটা হল, একবার যদি ঐক্যমত্যে ম্যাপ এঁকে তা শেয়ার করে নেওয়া যায় তো সব ঠান্ডা। সম্ভবত সেকারণে, কলোনি শাসিত হবার একটা ইতিবাচক দিক আছে। সেটা হল সব কলোনি শাসকই সর্বপ্রথম পুরা কলোনি রাষ্ট্রের সীমানা পড়শিদের সাথে বসে ডিমার্কেটেড করে নিতেন। তাদের চোখে একাজের পিছনেই বিনিয়োগ যথার্থ কারণ এর বিকল্প হল, অযথা যেকোন সময় যুদ্ধের রিস্ক বা খরচের দায় নিতে রেডি থাকা। তাহলে মনে হচ্ছে, সব সুবিধা আর লাভালাভই ডিমার্কেটেড সীমান্ত করে নেওয়া দুই পড়শিরাষ্ট্র দুজনের পক্ষে।
তাই কী? হা মোটাদাগে তাই। কোন নেগেটিভ দিক কী এতে নাই। হা অবশ্যই আছে। এক বিরাট অসুবিধা আছে। অসুবিধাটা হল, একবার কমন ম্যাপ করে ফেলার পর আর পড়শির দখলে থেকে যাওয়া কোন ভুমি আপনার বলে আর দাবি করতে পারবেন না। করলে কী হবে? করলে এবার লিগ্যালি মানে আইনত আপনি ডিফল্টার বা অনুপ্রবেশকারী মানে অপরাধী বলে চিহ্নিত হবেন। ঠিক সে ঘটনাটাই ঘটেছে মোদী-অমিতের কপালে! কিভাবে?
পাঁচদফার যৌথ ঘোষণা আবার পেন্ডুলামওঃ
সীমান্ত বিরোধ সংঘাত নিয়ে চীন-ভারতের পাঁচ দফা ঐকমত্যের যৌথ ঘোষণা রাশিয়ার মধ্যস্থতায় গত ১০ সেপ্টেম্বর মস্কোতে স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কিন্তু খবর কী শুধু এতটুকুই? না, এর মধ্যেই সব আছে মনে করলে ভুল হবে, আর সেটা দুই কারণে। প্রথমত, পরের দিনই ১১ সেপ্টেম্বর বা সময় হিসাবে কয়েক ঘণ্টা পরই ছিল আমেরিকার সাথে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করের (সাথে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংকে নিয়েও) গুরুত্বপূর্ণ অনলাইন বা ভার্চুয়াল মিটিং। এটাকে দেখে এক পলিটিক্যাল কমেন্টেটর মন্তব্য করেছেন, ভারত পেন্ডুলামের মতো আমেরিকা না চীন এই করে দোল খাচ্ছে, এর প্রতীকী চিহ্ন এটা [India swings like a pendulum between China and US]। কথা হয়ত মিছা নয়। আমরাও গত সপ্তাহের লেখায় বলেছিলাম “তামাশা হল আমেরিকার সাথে এক মিটিংয়ে খাওয়া ডিনারের ঢেঁকুর জয়শঙ্কর চীনের সাথে মিটিংয়ে গিয়ে তোলেন”। কাজেই মোদীর ভারতের কঠিন ডিলেমা মানে ‘এধার না উধারের দু নৌকায়’ পা দেয়ার সঙ্কটটা এখানেই।
তবুও দ্বিতীয়ত, সার কথায় বললে আমেরিকার সাথে ১১ তারিখের মিটিংটা বড়ই আজিব, এমনকি নামের দিক থেকেও। এ নিয়ে একটা বড় রিপোর্ট করেছে ভারতের দ্যাপ্রিন্টের নয়নিমা বসু। আর তিনি তা করেছেন এই বিশ্বাস করে যে, কোনো যুদ্ধে ভারতের পক্ষে আমেরিকার দাঁড়িয়ে যাওয়ার দলিলটাই যেন লেখা হচ্ছে বা হবে এখানে। কাজেই ভারতের আর যেন চীনভীতির কিছু নেই! থাকবে না! কিন্তু নয়নিমার রিপোর্টিংয়ে সাজানো এই মেজাজ ও অনুমানগুলোর আলোকে তাঁর লেখা পড়া ভুল হবে।
১১ সেপ্টেম্বর ভারত-আমেরিকার মিটিংটা ছিল মূলত আমেরিকার অস্ত্র বিক্রির; আর তা এই বিক্রির পদ্ধতিগত বিস্তারিত দিক নিয়ে মিটিং। ঐ মিটিংয়ের নাম – ‘ভারত-আমেরিকার ২+২ মিনিস্টরিয়াল ডায়লগের ইন্টারসেশনাল মিটিং” বা ইংরাজিতে [“Intersessional Meeting of the U.S.-India 2+2 Ministerial Dialogue”]। বেকায়দার নাম শুনেই ঘাবড়ানোর কিছু নেই। অস্ত্র বিক্রি করতে বিস্তারিত আলাপের জন্য এটা দু’পক্ষেরই দু’টা করে মন্ত্রী মিলে বৈঠক, আর দু’পক্ষের পররাষ্ট্র আর প্রতিরক্ষা মন্ত্রীরা এখানে উপস্থিত থাকবেন – তাই ‘২+২’ বলা। আর এখানে অস্ত্র বিক্রি বলতে, একে৪৭ বা মেশিনগানের মতো সিম্পল অস্ত্র নয়; বড়, জটিল ও হাইটেক বায়ুযানবিষয়ক ব্যাপার। তাই এমন ক্ষেত্রে আমেরিকার কমন প্র্যাকটিস হল, ওসব অস্ত্র বা যন্ত্র প্রভৃতি বিক্রির আগে সব ক্রেতাকে অবশ্যই অনেকরকম চুক্তি করিয়ে নেয়া যে, কী কী শর্তে এগুলো ভারত ব্যবহার করতে পারবে, ট্রেনিং কী হবে, যন্ত্রাংশ সরবরাহ কেমনে কী হবে, স্টক কী করে রাখতে হবে, দক্ষভাবে এর ব্যবহার কী করে করতে হবে, সাথে ইনটেলিজেন্স কী লাগবে, তার ট্রেনিং কে দেবে প্রভৃতি খুঁটিনাটি বিস্তারিত দিক থাকে এর মধ্যে। এ ছাড়া অস্ত্র বিক্রি কোনো সাধারণ পণ্য নয়। তাই দুদিকের দুজন মন্ত্রী লাগে। আর সাথে এত পদ্ধতিগত বাধা পার হতে হয়। এমনিতে আমেরিকার দিক থেকে নিজেদের অস্ত্র বিক্রির দায় ও ক্রেডিট পেন্টাগনের। কিন্তু স্ট্র্যাটেজিক ও পলিটিক্যাল দিক এর সাথে জড়িয়ে থাকে বলে তাদের ফরেন অফিসকেও সাথে নিয়ে নামতে হয়। এরপর সেসব ‘পদ্ধতিগত দিক’ ফাইনাল করে চুক্তিতে পৌঁছানোই ছিল ঐ সভার উদ্দেশ্য। এমন পদ্ধতি মানতে হয় আরেক কারণে। যেমন, ভারতের সাথে রাশিয়ার খাতির খুব কম নয়। তাই ভারত যদি আমেরিকার কোনো অস্ত্র বা সামরিক যন্ত্র কিনে আর তা রাশিয়াকে দেখতে দেয় যাতে সে ভেঙেচুরে তার সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে শিখে ফেলতে পারে! তাই এটা ঠেকানোই এসব চুক্তির আসল উদ্দেশ্য যাতে অস্ত্র বা সামরিক যন্ত্র তৃতীয় দেশের হাতে না যায়।
তবে বলাই বাহুল্য, কোনো অস্ত্র বিক্রেতা দেশ আপনার দেশকে অস্ত্র বিক্রি করেছে – এখন এর মানেই আপনার কোন শত্রুর সাথে আপনার যুদ্ধ লাগলে তখন আপনার পাশে মাঠে এসে অস্ত্র বিক্রেতাও দাঁড়িয়ে লড়বে – এমন গ্যারান্টিও সে ক্রেতা দেশ দিয়েছে – যারা এটা মনে করে তাদের অবশ্যই তা বিরাট আহাম্মকি কান্ড বুঝতে হবে। এদের থেকে দূরে থাকতে হবে। যদিও কোনো অস্ত্র বিক্রি মানে, সেটা দু’দেশের মধ্যে এক ধরনের ছোটখাট ‘সামরিক চুক্তি’ মনে করা দোষের হবে না। আবার আমেরিকার সাথে সামরিক চুক্তি হচ্ছে বলে এটুকু পড়ার পরই গা-গরম করে ফেলা যাবে না, কারণ এর মানে হয় না। তবে একবার (১৯৬২) চীনের হাতে মার খাওয়াতে ভারতের নেতাদের যে মানসিক ট্রমা হয়েছে তা থেকে উদ্ধার পেতে অজান্তে বা জেনেই যাতে কিছু সান্ত্বনা পাওয়া যায় এমন ইঙ্গিত রিপোর্টে থেকে যেতেই পারে। তবু আমাদের বুঝাবুঝিতে পরিষ্কার ফারাক রাখতে হবে – অস্ত্র বিক্রির চুক্তির সাথে সামরিক-স্ট্র্যাটেজিক জোটে ঢুকে পড়ার চুক্তির কোনো সম্পর্ক নেই; দুটো আলাদা।
তবু নয়নিমা এমন বিভ্রান্তি তৈরির পক্ষে অজ্ঞাত ও ‘নাম বলতে না চাওয়া’ সরকারি কর্তার কথা বলে আড়ালে দাবি করেছেন, মোদী সরকার নাকি সামরিক-স্ট্র্যাটেজিক জোটে ঢুকে পড়তে গভীর আগ্রহে আছে তাই দুটাকে এক করে দেখছেন নয়নিমা।
কিন্তু কথিত অজ্ঞাত বলে যাই দাবি করুন, বেজ ফ্যাক্টস হল, মোদির নীতি-নির্ধারকেরা পরিষ্কার যে, তারা আমেরিকার সাথে ইন্দো-প্যাসিফিক জোটে উঠতে পারছেন না। ট্রাম্পের আমেরিকা অবশ্য আরো সরেস হয়ে দাবি করছেন এই জোট হবেই আর যেন এর নাম হয়ে যাবে ‘এশিয়ান ন্যাটো’। যদিও এমন দাবির বিরুদ্ধে জয়শঙ্কর আগেই দায় ঝেড়ে ফেলতে বলছেন, “ভারত জোটনিরপেক্ষ অবস্থানেই” থাকবে। কিন্তু আবার পরিষ্কারও করেন না যে, তাহলে মোদীসহ অমিত-মাধব [রাম মাধব বিজেপির কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল ও আরএসএস এর খাস নেতা ] সবারই মনে যুদ্ধের মাঠে আমেরিকা ভারতের পাশে খাড়া হবে এমন আশার বাতি কেন জ্বালিয়ে রাখেন তারা, নিভান না কেন?
কেউ মনে আশার আলো জ্বালিয়ে রাখলে আর কী করা, মনের উপর হাত চলে না। তবে মোদির নীতিনির্ধারকরা পরিষ্কার যে, তারা ইন্দো-প্যাসিফিক জোটে উঠতে পারছেন না। এর অন্তত একটা প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। সেটা হলো চীনের সাথে পাঁচ দফা ঐকমত্য করতে মোদীর রাজি হওয়া। এর অন্তত প্রথম দুটো দফা এর প্রমাণ। পুরা পাঁচ দফা এখানে। ওর প্রথম দফা লিখেছে (এখানে বাংলাটা ভারতের সরকারি ওয়েবসাইটের করা, ওর পিডিএফ সেখান থেকে নেয়া) – …… “‘ভারত-চীন সম্পর্কের বিকাশে নেতাদের ঐকমত্যের শৃঙ্খলা থেকে উভয় পক্ষের পথনির্দেশিকা গ্রহণ করা উচিত”।
এর মানে ভারত-চীন সম্পর্কের ভিত্তি হল, দু’দেশের যেগুলো এখন ঐকমত্য হয়েছে এমন পয়েন্ট; তাই দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু তাহলে এর এখন মানে হয়ে গেছে যে, ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট লোকসভায় কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসন সংক্রান্ত ৩৭০ ধারা জবরদস্তি বাতিল করে দেয়া ভুল হয়েছে। কারণ অমিত শাহের এই বাতিল করে দেয়ার ভিত্তিতেই পরের দিন তিনি আলাদা ও পরিষ্কার করে ঘোষণা করে দেন, সারা কাশ্মিরই এখন একমাত্র ভারতের অংশ। অর্থাৎ পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মিরের অংশ ও চীনের অধিকৃত কাশ্মিরের অংশ (আকসাই চীন) ইত্যাদি সবই ঐদিন থেকে ভারতের বলে অমিত শাহ ঘোষণা করে দিয়েছিলেন [PoK, Aksai Chin integral part of J&K, can die for it: Amit Shah in Lok Sabha]।
“Kashmir is an integral part of India, there is no doubt over it. When I talk about Jammu and Kashmir, Pakistan occupied Kashmir and Aksai Chin are included in it and can die for it,” -Amit Shah, 06 August 2019 in the parliament
আসলে ঐদিনের ঘটনায় মোদী-অমিত যে রাষ্ট্র-রাজনীতি বিষয়ে কত নাদান, তাই স্পষ্ট হয়েছিল। কারণ এই ঘোষণার সোজা মানে, ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ থেকে ওই ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত ৭২ বছরে যা কিছু সীমান্ত-ভূমি বিষয়ে ভারত-চীন সমঝোতা ও চুক্তি আছে বা হয়েছিল – এর সবকিছু ভারত সেদিন সংসদে একাই একপক্ষীয়ভাবে বাতিল বলে ঘোষণা করে দিয়েছিল। কারণ অমিত শাহ বলছেন কাশ্মীরের চীনের অংশ (আকসাই চিন) আর পাকিস্তানের অংশ সহ পুরা কাশ্মীরই ভারতের ইন্টিগ্রাল বা অবিচ্ছেদ্দ অংশ। কারণ অমিত শাহ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে ভারতীয় কনষ্টিটিউশনের ৩৭০ ধারা বাতিলের বিল পাশ করাতে পুরা কাশ্মীর এরপর থেকে সরাসরি ভারতের অবিচ্ছেদ্দ অংশ হয়ে গেছে। এতে আরো মানে হল লাদাখে ভারত চীনের সাথে সীমান্ত আলোচনায় (১৯৯৩-৬) কাশ্মীরের যেসব ভুখন্ড চীনের কাছ থেকে ছাড় পেয়ে নিজের এলএসি বলে ১৯৯৬ সাল থেকে যা নিজের ভুখন্ড বলে দাবি করছিল সেসব চুক্তির আর কোন মূল্য নাই। তা অকেজো ও বাতিল। কারণ ৫-৬ আগষ্ট ২০১৯ থেকে সারা কাশ্মীরই ভারতের কারণ অমিত শাহ সেটা সংসদে ঘোষণা দিয়েছে – এটাই এর একমাত্র ভিত্তি। পুরা আকসাই চিন যদি অমিত শাহের ভারতের হয়ে যায় তাহলে আবার মাত্র ১৯৯৬ সালের একমতের এলএসি পর্যন্ত ভারতের সীমানা – এই দাবির মানে কী? এই দাবি স্ববিরোধী।
কোনো দু’দেশীয় চুক্তি হওয়ার পর এবার কোনো একটা পক্ষ একাই তা বাতিল বলে ঘোষণা করে দিলে জেনেভা কনভেনশন চালু হওয়ার পর থেকে এমন বাতিলকারী রাষ্ট্রকে অশিষ্ট রাষ্ট্র [ROGUE State] মনে করা হয়। ইংরেজি এই শব্দের মানে হল, যে নিয়ম বা আইন মানে না, শয়তান বা চিট করে চলা লোক বা রাষ্ট্র। অর্থাৎ অমিত শাহের ঐ ঘোষণা ভারতকে অশিষ্ট রাষ্ট্রে পরিণত করেছে।
কেন এমন খারাপ কথা? তাহলে কী দুদেশের কোন ‘হওয়া’ চুক্তি আর কখনো বাতিল করা যাবে না? তা নয়; অবশ্যই যাবে। কিন্তু পদ্ধতি মেনে তা করতে হবে। “অশিষ্ট” হয়ে নয়, একপক্ষীয় খেয়াল খুশিতে নয়। বাতিলের ইচ্ছা প্রকাশ করে অপরপক্ষকে নোটিশ দিয়ে আলোচনার তারিখ নিয়ে এবার আলোচনায় বসতে হবে। সাধারণত সব চুক্তিতেই কিভাবে ঐ চুক্তি বাতিল করা যাবে তাও লেখা থাকে। কাজেই সে মোতাবেক ঐ মিটিংয়ের সিদ্ধান্ত হিসাবে চুক্তি বাতিল করা যাবে। কিন্তু মোদীর ভারত একেবারে গায়ের জোরে তাই করেছে।
মোদী-অমিতের চোখ নিবদ্ধ ছিল ৩৭০ ধারা বাতিল আর পুরা কাশ্মীর এরপর থেকে সরাসরি ভারতের অবিচ্ছেদ্দ অংশ – এই ঘোষণার লাভালাভের দিকে। তারা উগ্র জাতিবাদী ধারণায় এই ঘোষণার ফলাফল পরিণতি হিসাবে এরপর থেকে সমস্ত হিন্দু ভোট জাতগর্বে উঠে দাঁড়াবে আর বিজেপির পক্ষে ভোটের বাক্সে চলে আসবে – এই অনুমানের দিকে ছিল তাদের মূল দৃষ্টি। কিন্তু তাদের ঘোষণা যে এতদিন চীন-ভারতের সব সীমান্ত ভূমিবিষয়ক চুক্তি ও এলএসিগুলোকেও বাতিল করে দিচ্ছে সেদিকটা একেবারেই আমল করেন নাই।
তাই অমিত শাহের ঐ ঘোষণার পর চীনা প্রতিক্রিয়া কী ছিল তাও মোদী সরকার আমলে নেয়নি। কিন্তু ২০১৯ সালে ৩১ অক্টোবর বেইজিংয়ে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রেগুলার প্রেস ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে সে কড়া প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছিল। বলেছিল, “ভারত একপক্ষীয়ভাবে খেয়াল খুশিতে নতুন করে জম্মু-কাশ্মির ও লাদাখ বলে তাদের দুটা ইউনিয়ন টেরিটরি ঘোষণা করেছে যার মাধ্যমে আসলে চীনা টেরিটরিকে ভারতীয় প্রশাসনের অন্তর্গত বলে দাবি করা হয়েছে। এতে চীনা সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে”।
কেন এত কড়া চীনা প্রতিক্রিয়া?
এর পেছনের লম্বা ইতিহাসের সংক্ষেপটা হল, কাশ্মিরের এই চীন-ভারত সীমান্তটাই পূর্ব লাদাখ যা ব্রিটিশ আমল থেকেই কখনোই উভয়পক্ষের সম্মতিতে সীমান্ত চিহ্নিত করে নেয়া হয়নি এমন সীমান্ত। ব্রিটিশেরা তার কলোনি পড়শিদের সাথে ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ার ডিমার্কেটেড ম্যাপ তৈরি করত। কিন্তু করদ রাজ্যগুলো মানে ওর সীমানাগুলোকে বাদ দিয়ে। কারণ আইনত প্রিন্সলি বা করদ স্টেটগুলো বৃটিশদের ঠিক কলোনিভুমি নয়। আর কাশ্মির ছিল করদরাজ্য। সেজন্য কখনোই লাদাখ সীমান্ত চীন-ভারতের বসে একমত হয়ে চিহ্নিত করে নেয়া কোন সীমান্ত নয়। তাই সর্বপ্রথম চীন ওই এলাকায় কতদূর নিজের এলাকা বলে দাবি করে বা এলএসি দাবি করে তা ঘটেছিল ১৯৫৯ সালে। এটাই ১৯৫৯ সালের এলএসি [LAC]। পরবর্তিতে ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের পরে চীন তা আরো পোক্ত করে নেয়। কিন্তু পরবর্তীতে একালে চীন-ভারত সম্পর্কের উত্থান-পতনে যখন তা ভালো হয়েছে তখন সীমান্ত আলোচনায় বসার মত অবস্থায় ১৯৯৩-৯৬ সালের এই চার বছরে বিস্তীর্ণ এলাকা চীন ভারতের পক্ষে ছেড়ে দেওয়ার চুক্তি করেছে। কারণ, চীনের সেসময় নীতি ছিল – কোনো এলাকা স্ট্র্যাটেজিক্যালি গুরুত্বপূর্ণ মনে না হলে আর সে এলাকা নিয়ে ভারতের দাবি থাকলে তা ভারতের কাছে ছেড়ে দেয়া। কারণ ভারতের সাথে অন্যসব সম্পর্কের লম্বা এনগেজমেন্টে চীনের অনেক গভীর স্বার্থ আছে। তাই আস্থা সম্প্রসারণ চীনের জন্য জরুরি মনে হয়েছিল। এ কারণে ১৯৯৩ সালের এলএসিতে ভারত প্রথম বিস্তীর্ণ ভূমি ছাড় পায় যা ১৯৯৬ সালে ভারত পায় চীনের আরো চরম ছাড়ে। সেজন্য চীন-ভারত লাদাখ সীমান্ত বলতে ভারত সর্বশেষ ১৯৯৬ সালের এলএসিকে মূল ভিত্তি মনে করে এসেছে। কিন্তু অমিত শাহের ৫-৬ আগস্টের ঐ ঘোষণা যে এসব (১৯৯৩-৬ সালের) চুক্তি আর বুঝাবুঝিকে নাকচ করে দিচ্ছে – এটা তারা টেরও পয় নাই। এমন মেসেজ যে মোদী সরকার চীনকে দিয়ে ফেলছে সেটাও তারা বুঝেছেন বলে মনে হয় না। আবার অমিত যে সারা কাশ্মিরকেই ভারতের একক অংশ বলে দাবি করছেন সেটা সচেতনভাবেই করছেন। কিন্তু আইনিচুক্তি ও কূটনৈতিক কনসিকোয়েন্স-পরিণতি না বুঝে। তাই চীনের বক্তব্য, তাহলে অমিতের ঐ (৫-৬ আগষ্ট ২০১৯) ভাষ্য বলছে – আমাদের দু’দেশের আলোচনা, চুক্তি ও এলএসি আর সব বুঝাবুঝি বাতিল ও ভুয়া। কারণ অমিত শাহ একপক্ষীয়ভাবে দাবি করেছেন “পুরা কাশ্মিরই ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ”।
কাজেই এখনকার সীমান্ত সংঘাতে চীনা ভাষ্য ও চীনের পালটা সামরিক ততপরতার ব্যাখ্যাটা হলঃ চীন বলতে চাইছে, অমিত শাহ যদি একপক্ষীয়ভাবে সব ভুখন্ড দাবি করেন, এর মানে তিনি নিজেই ১৯৯৩-৯৬ সালের সব চুক্তি ও এলএসি বাতিল বলে দাবি করছেন। তাই ভারতের সাথে এবারের সীমান্ত সংঘাতে “আমরাও ঐ পালটা গায়ের জোরে ১৯৫৯ সালের এলএসিকে ভিত্তি মেনে সব ভূমি নিজেদের দখলে নিয়ে নিয়েছি”। কোন ভারতীয় এলএসি কে মান্য করি নাই। কারণ যে এলএসি অমিত শাহই বাতিল করে দিয়েছেন তা মানবার কোন দায় আমাদেরও নাই। এমনকি এক সামরিক চাপ ফেলে এরপর মোদী সরকারকে দিয়ে ‘চীন ভারতীয় কোনো ভূমি দখল করেনি বলিয়ে নিয়েছি”। অর্থাৎ মোদিকে দিয়ে মানিয়েছি, ১৯৯৬ সালের এলএসিকে ভিত্তি ধরে নয়, ১৯৫৯ সালের এলএসিকে ভিত্তি ধরলে চীন ভারতের কোনো ভূমি দখল করেনি। আর মোদী তাই মেনে নিয়েছেন।
তাহলে এখন পাঁচ দফা ঐকমত্যের যৌথ ঘোষণার মানে কীঃ
অতএব এখন পাঁচ দফা ঐকমত্যের যৌথ ঘোষণার মানে হল উপরের পুরা চীনা ভাষ্যটাই মোদীর মেনে নেওয়া। কারণ অপশনগুলোর মধ্যে এটাই মোদীর জন্য সবচেয়ে কম ক্ষতির ও বহনযোগ্য। যেমন পাঁচ দফা ঐকমত্যের প্রথম দফার অর্থ হল – আবার আমরা স্বীকার করছি, চীন-ভারতের আলোচনায় যেকোনো ঐকমত্যই আমাদের সম্পর্কের সবকিছুর ভিত্তি হবে। অমিত শাহ বা কোনো মন্ত্রী কোথায় কী বলেছেন, সেটা নয়।
পাঁচদফার প্রথম দফাঃ
- The two Ministers agreed that both sides should take guidance from the series of consensus of the leaders on developing India-China relations, including not allowing differences to become disputes.
এমনকি এ কারণে দ্বিতীয় দফা খেয়াল করা যাক। ওখানে বলা হয়েছে, ‘দুই বিদেশমন্ত্রী সহমত হয়েছেন যে, সীমান্তের বর্তমান পরিস্থিতি কোনো পক্ষের জন্যই ভালো নয়। তার জন্য তারা সহমত হয়েছেন যে, উভয়পক্ষের সীমান্ত বাহিনীর উচিত তাদের আলাপ আলোচনা চালিয়ে যাওয়া, দ্রুত সৈন্য সরিয়ে নেয়া, সঠিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং উত্তেজনা প্রশমিত করা।’ অর্থাৎ প্রথম দফা মেনে নেয়া সাপেক্ষে দ্বিতীয় দফায় উভয়পক্ষ সৈন্য ফিরিয়ে নিতেও একমত। এতেই তাদের স্বার্থ!
2. The two Foreign Ministers agreed that the current situation in the border areas is not in the interest of either side. They agreed therefore that the border troops of both sides should continue their dialogue, quickly disengage, maintain proper distance and ease tensions.
অতএব ভারত-চীন সম্পর্কের নতুন ভিত্তি এখন থেকে পারস্পরিক আলোচনায় ঐকমত্য। আর এটাই মোদী মেনে নিয়েছেন বলেই পাঁচ দফার ঐকমত্য টানা সম্ভব হয়েছে আর এটাই এখন সবকিছুর ভিত্তি। তাই পুরা পাঁচ দফায় ‘এলএসি’ বলে কোনো শব্দই রাখা হয়নি। মানে সীমান্ত আলোচনা বলতে কিছু থাকতে গেলে তা নতুন করে ‘ফির সে শুরু’ করতে হবে। আর ফের আলোচনায় ঐকমত্য হলে সবই ভারতের, আবার তা হতেও পারে। কিন্তু এর আগে পর্যন্ত সব ভূমি চীনের দখলে থাকবে। তাই যেন ‘এলএসি’ শব্দের আর দরকার কী? ভারত ভালো মানুষ ও রাষ্ট্র, চীনের মনে এমন আস্থা জমলে আবার সবকিছু সে ফেরত দিতে পারে। এমন কী, আরো বেশি ভুমি চীন ফেরত দিয়ে দেবে – পাঁচ দফায় যা লেখা নেই এমনও হতে পারে; কিন্তু ইঙ্গিত আছে এই হলো তার মূল কথা।
মোদি এটা মেনে নিলেন কেন?
প্রধান কারণ নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকেই সব ভারতীয় সেনাদের লাদাখ থেকে মোদীকে ফেরত আনতেই হবে। শীতকাল শুরু হয়ে যাবে, ঠান্ডা ছেয়ে যাবে। কারণ ভারতের অর্থনীতি এমন যে, ঐ বরফজমা ঠাণ্ডার মধ্যে তাদের সেখানে গরম ঘরে রাখার মত খরচ জোগানোর সামর্থ্য ভারতের নাই। একথা কয়েক সপ্তাহ আগে সাবেক এক পররাষ্ট্র সচিব ও উপদেষ্টা শ্যাম সরন বলেছিলেন। যা মোদী তাকে দিতে বলিয়েছে বলে অনুমান করা হয়। ফলে এমনিতেই তাকে সেনা প্রত্যাহার করতেই হতো।
Shyam Saran also said, “My sense is, if this, for example, continues during the winter — which would be very difficult because this area is very inhospitable during winter – it would require a considerable investment in setting up heated dwelling units, making certain you have enough equipment for use during very very severe winters.” – ইকোনমিক টাইমস, টাইমস অব ইন্ডিয়া
এ ছাড়া আরো অন্য কারণ হল, মোদী আমেরিকার ওপর আস্থা রাখেন না যদিও মনের কোণে একটা স্বপ্নদেখার মত খায়েসের বাতি তিনি জ্বালিয়ে রেখেছেন। যদিও বাস্তবত হুঁশের-মোদী বুঝেন, সেটা সত্যি নয়। মোদি আসলে অসহায়। চীনের কাছে ভালো মানুষের পরীক্ষা দেয়া ছাড়া তার হাতে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। কাশ্মীর পুরাটাই সরাসরি ভারত অংশ এই উগ্র হিন্দু জাতিবাদের জোশ তুলতে পারলে পরের সব নির্বাচনে ভোটের বাক্সে ভারতের সব হিন্দু ভোট ঢেলে বিজেপির ভাগে আসতেই থাকবে – এই অনুমান ও প্রচন্ড লোভে পড়ে গত ৫ আগষ্ট ২০১৯ থেকে তিনি যাই করতেছেন তাই এখন বুমেরাং হয়ে তার গলায় আটকেছে। তবে এদিকে আবার খুব সম্ভবত তিনি অনুভব করেন যে, এমন দশায় আমেরিকার ওপর আস্থা রাখা মানে নিজের পছন্দের হিন্দুত্বের রাজনীতি কখনো ভারতীয় জনগণের হাতেই প্রত্যাখ্যাত হওয়ার আগেই আমেরিকারই হুকুমে ত্যাগ করতে হবে। এ ছাড়া ভারতের ব্যবসা-বাণিজ্য আমেরিকান ব্যবসায়ীদের আধিপত্যে খুলে দিতে হবে তাকে- এভাবেই তথাকথিত ‘ওপেন মার্কেট’ করে সংস্কার করতে হবে ভারতের অর্থনীতি ও বাজার। এগুলো মোদীর জন্য ‘আরো বড় আত্মহত্যা’। মোদির ব্যাকগ্রাউন্ড ব্যবসায়ী। মানে গুজরাটি বেনিয়া। মোদি শব্দের অর্থও তাই। কাজেই আমেরিকার এসব আবদারের অর্থ তার না বুঝার কিছু নেই। সম্ভবত সে জন্য তিনি আমেরিকার কাছে যেতে পারছেন না।
পাঁচ দফা ঐকমত্য বিষয়টা ভারতের পাবলিককে কীভাবে বলবেনঃ
বলাই বাহুল্য এটা এক পাহাড় ডিঙ্গানো, মোদীর নিজের ফাদে আটকানো। যে মোদী-অমিত ‘সারা কাশ্মিরই ভারতের’ একথা বলে হিন্দুত্বের বুকের ছাতি ফুলাতে গেছিলেন তারা এখন কীভাবে বলবেন চীনের কাছে উলটা লাদাখের ভূমি খুইয়ে এখন নতুন করে সমঝোতার মাধ্যমে সেই ভুমি ফেরত আনতে যাচ্ছেন তিনি?
তাই এনিয়ে আরো দুটা কথা আছে। যার মূল বিষয় চীনের সাথে করা পাঁচ দফা ঐকমত্য কেন করছেন এনিয়ে তিনি পাবলিকের সামনে কী বলবেন? এসব ব্যাপারে মোদীর কিছু ধুর্ত বুদ্ধি আছে। সেজন্যই তিনি জয়শঙ্করকে দিয়ে করা আরেকটা ভাষ্য প্রকাশ করিয়েছেন। যেমন লক্ষ্য করেন, আনন্দবাজারের ১১ সেপ্টেম্বরের শিরোনাম : ‘মস্কোয় দ্বিপাক্ষিক বৈঠক। আগে সেনা সরাক চিন : জয়শঙ্কর’। অর্থাৎ এখানে ভারত কী সাংঘাতিক বিপ্লবী! এখানে ভারত বিরাট শক্তি, এমন দাবি করা হচ্ছে উগ্র জাতিবাদী ঢংয়ে। এছাড়া, আগে চীন কী করে দেখি, এরপর ইচ্ছা হলে ভারত করবে – এমন ডাটদেখানোর এক ভাব তৈরি করা হয়েছে। মোদির ভারত এমনই শক্তিশালী! এটা কেমন কী হল?
না, খুব সহজ। যৌথ ঘোষণাটাকে অগুরুত্বপূর্ণ করে পেছনে ফেলে রাখতে জয়শঙ্কর তাই এর পরেও আরেকটা ভাষ্য তৈরি করে সে ভিত্তিতে বিদেশ মন্ত্রণালয় থেকে আরেকটা আভ্যন্তরীণ মিডিয়া ব্রিফিং সহ বিবৃতি দিয়েছেন; ঠিক যেমনটা মিডিয়া শুনতে চায়, পাবলিককেও শুনাতে চায়, সেভাবে। এখানে সবচেয়ে বড় কথা ভারতের হিন্দুজাতিবাদী মিডিয়াও এমন ভাষ্যই চায়। এরা ‘ন্যশনাল ইন্টারেস্ট বা কথিত হিন্দুজাতির স্বার্থের নামে গু-গোবর সব হালাল করে তারা চালিয়ে দিবে।
কেউ কেউ ‘বিশেষ’। কারা এরা?
কিন্তু এর পরেও কথা আছে। সবাই তো আবার আম-পাবলিক নয়। কেউ কেউ ‘বিশেষ’। কারা এরা? যেমন সাবেক সামরিক জেনারেল অশোক মেহতা। তিনি নিজের লেখার শিরোনাম দিয়েছেন, “যৌথ-বিবৃতিতে কী মিসিং আমাদের সেদিকে তাকানো উচিত” [We Need to Look at What Was Missing in the India-China Joint Statement]।
তিনি বলতে চাইছেন যেমন, ‘এলএসি’ শব্দটা যৌথবিবৃতিতে নাই। এ ছাড়া আরো বড় জায়গার গ্যাপ তিনি ধরেছেন। যেমন সীমান্তে “আগে যে যেখানে ছিল সেখানে ফেরত যাবে” এমন শব্দগুলো সব সময় থাকত কিন্তু এবার তা কোথাও নেই। এছাড়া এখন ‘এলএসি’ শব্দটার বদলে লেখা হয়েছে ‘বর্ডার এরিয়া’। এছাড়া তিনি বেইজিংয়ের গ্লোবাল টাইমসের একটা টুইটের ছবি তুলে এনে দেখাচ্ছেন। যেখানে লেখা আছে, “ভারত শান্তি চাইলে ভারতকে ১৯৫৯ সালের ৭ নভেম্বরের এলএসি মেনে নিতে হবে। আর যুদ্ধ চাইলে চীন যুদ্ধ করবে। দেখা যাক কোন দেশ শেষে টিকে”। বলাই বাহুল্য এসব কথা জেনারেলেদের আত্মসম্মানে লাগে তাই ভাল কথা না। বলাই বাহুল্য, জেনারেলদের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে এসব লেখায় বাধা দিলে বাহিনীতে প্রভাব পড়বে। এর চেয়ে উপেক্ষাই মোদির জন্য একমাত্র কৌশল। একই রকম প্রশ্ন তোলা আরো লেখকের লেখা আছে। যেমন আরেক প্রাক্তন সামরিক কর্তা ও বর্তমান সামরিক সাপ্তাহিকের [editor of FORCE magazine] সম্পাদক প্রবীণ সোয়েনি শিরোনাম দিয়ে লিখছেন, ‘যৌথ বিবৃতি থেকেই বুঝা যাচ্ছে ভারত কী হারিয়েছে”।
কিন্তু এসব সামরিক লোকেদের ভুলটা কোথায়?
তারা বলতে চাইছেন, ভারতের আগে ১৯৯৬ সালে এলএসি অনুযায়ী সীমান্ত ছিল এখন মোদী সেটা চীনের কাছে খুইয়ে এসেছেন কেন? এটাই তাদের সবার সার বক্তব্য। অথচ তারা একটু কষ্ট করে আরো বিস্তারে আরো বিশাল ভুখন্ড পাওয়াটা দেখতে চাইছেন না। সেটা হল ৫-৬ আগষ্ট ২০১৯ ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে তো তাদেরকে “‘সারা কাশ্মিরই ভারতের’ বলে আরো বড় ভুখন্ড এনে দিয়েছেন – সেদিকে দেখেন না কেন? এতে এটা বুঝতে তাদের অসুবিধা কোথায় অমিত শাহই তো সেদিন -১৯৯৬ সালে এলএসি- মানেন নাই। বাতিল বলেছেন বলা যায়। কারণ আকসাই চিনসহ সারা সারা কাশ্মিরই যদি ভারতের’ হয় তবে ওর ভিতরের কোন ভুখন্ড -১৯৯৬ সালে এলএসি – নিয়ে চীন-ভারতের সমঝোতা তো অমিত শাহকে সবার আগে অস্বীকার বা বাতিল মনে করতেই হবে।
অতএব সবার আগে এসব জেনারেলদেরকে বুঝতে হবে অমিত শাহের দাবির অর্থ কী। ফলে চীন না, সবার আগে “১৯৯৬ সালে এলএসি” অমান্য বা বাতিল করছে খোদ ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ আর তা করেছেন সংসদে মানে লোকসভাতে। কাজেই চীনের আর সেটা মান্য-অমান্যের দায় কী? তাই জেনারেলদের অভিযোগ যাওয়া বা জবাবদীহিতা চাওয়া উচিত মোদী-অমিতের কাছে। মোদী সেকারণের সংসদের এনিয়ে কোন আলোচনা হতে দেন নাই।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
[এই লেখাটা গত ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০, দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ওয়েবে ও পরদিনই প্রিন্টেও “‘সারা কাশ্মিরই ভারতের’ দাবির পরিণতি ” – এই শিরোনামে উপ-সম্পাদকীয়তে ছাপা হয়েছিল। এছাড়া আমার আরেকটা লেখা যেটা ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ সাপ্তাহিক দেশকাল পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, প্রায় একই কাছাকাছি শিরোনামে, “চীন-ভারতের সীমান্ত বিরোধ” নামে। পরবর্তিতে ঐ দুই লেখাটাকে একত্র করে এখানে আরও নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে এখানে আজ ছাপা হল। ]