দশক আগেরটা নয়, সংশোধিত আমেরিকায় কিছু সম্ভাবনা


দশক আগেরটা নয়, সংশোধিত আমেরিকায় কিছু সম্ভাবনা

গৌতম দাস

  ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:৩৮

https://wp.me/p1sCvy-3ce

Bangladesh-US political relationship

গ্লোবাল নেতৃত্ব বিশেষত গ্লোবাল অর্থনৈতিক অর্ডারের নেতা হওয়ার লড়াই এবার সম্ভবত তুঙ্গে উঠতে যাচ্ছে। এটা ফাইনাল লড়াইও হয়ে উঠার লক্ষণ সম্পন্ন। আমেরিকার আসন্ন নভেম্বর নির্বাচনের জন্যই যেন সবাই অপেক্ষা করছে; রাষ্ট্র হিসেবে আমেরিকাও মরণপণ লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। মোটাদাগে আমেরিকার দিক থেকে এই লড়াই হবে বাই-পার্টিজান। মানে ডেমোক্র্যাট-রিপাবলিকান দু’দলই এমন লড়াইয়ের পক্ষে। যদিও ফারাক শুধু এখানেই যে নির্বাচনে যে জিতবে সে নিজের কায়দায় ও কৌশলে এ লড়াইয়ে নামবে, নেতৃত্ব দেবে। কিন্তু তবু দু’দলে অনেকগুলো মিলও আছে। এর একটা হল যেমন,  এ’দুই দল যেন চাইলেই খোদ আমেরিকাকে গ্লোবাল নেতৃত্বের আসনে ধরে রাখতে পারবে, এই মিথ্যা কথাটা দুদলই সত্যি ধরে নিয়েছে। “আমি সরব না” বললেই যেন গ্লোবাল এম্পায়ারের নেতার আসন ধরে রাখা যায়। যেমন অনেককে আবার দেখছি সামরিক শক্তির বিচারে চীন আমেরিকার কত পেছনে সেটা মেপে দেখিয়ে আর্টিকেল লিখে দাবি করছে, আমেরিকাকে কেউ নেতাচ্যুত করতে পারবে না। তাহলে সোজা আরেক কমন দিক হল, এ দু’দলই মনে করে  – গ্লোবাল এম্পেরা’র (সাম্রাজ্যশাসক) নেতা থাকার ব্যাপারটা আমেরিকার ইচ্ছাধীন।

অথচ কেউ আর চাইলেও গ্লোবাল লিডার বা এম্পেরা’র ভূমিকায় আমেরিকাকে রাখতে পারছে না বা পারবে না, এটাই বাস্তবতা।  আবার সেই আমেরিকা আজ কোথায় – যে আমেরিকা আগে গত সত্তর বছর ধরে নিজেই ছিল গ্লোবাল নেতা, অর্থনৈতিক গ্লোবালাইজেশনের লিডার, পণ্য বিনিময় ব্যাপকভাবে দুনিয়ার কোণে কোণে ছড়িয়ে এক গ্লোবাল বিনিময় লেনদেনের ব্যবস্থা বা অর্ডার গড়ে তোলার কাজে ছিল যার লক্ষ্য ও যে ছিল নেতা? সেই আমেরিকা তো এখন এখন ফিরে গ্লোবালাইজেশনের লিডার হওয়া ছেড়ে বুড়ো বয়সে এসে কেবল ‘আমেরিকান জাতির’ নেতা হওয়ার চেষ্টা শুরু করেছে! তা সত্বেও আবার এটা অবশ্যই ব্যর্থ হবে। কারণ যে দুনিয়া একবার কথিত ‘জাতি’ থেকে গ্লোবালাইজড বিনিময়ের এক ব্যবস্থা বা অর্ডারে ঢুকে গেছে সে আর ফিরে ঘরোয়া একা একা নিজ সীমানার ‘জাতি ব্যবস্থায়’ ফিরে যাবে না, চাইলেও পারবে না। গত ২০১৪ থেকে অনেককে বলার চেষ্টা করেছিলাম দুনিয়াতে আবার ভুয়া “জাতি” হবার একটা জোয়ার উঠানো আনার চেষ্টা হচ্ছে ও উঠবে। এরা বাস্তবতা না বুঝে মনে করেন জোর করে বা জোয়ার তুলে হলেও আমেরিকাকে গ্লোবাল নেতার ভুমিকায় রাখা যাবে এবং এটা সম্ভব। এটা অনেকটা যেন সেই স্বপ্ন যে দুনিয়াটাকে আবার যদি কলোনিদখল ব্যবসা ও ব্যবস্থার যুগে ফেরত নেয়া সম্ভব হত! সেই আলোকে এবার তাই আমরা দেখছি ট্রাম্পের এডভাইজার স্টিভ ব্যাননদের [Steve Bannon] আবির্ভাব কিংবা হোয়াইট সুপ্রিমিস্টদের উত্থান; এসবই কিছু সেই নমুনা। তবু বলাই বাহুল্য এরা সমূলে ব্যর্থ ও নির্মুল বা উন্মুল হয়ে যাবেই।  তবে এর আগে আরো বহুবিধ ধ্বংস ঘটিয়ে এরপরে তা বিলীন হবে হয়ত। নরওয়ে বা নিউজিল্যান্ডের মুসলমান বা ‘বিদেশি’ হত্যার ঘটনাগুলো আমরা এখানে মনে করতে পারি। গত সপ্তাহে আমেরিকান হোমল্যান্ড সিকিউরিটির প্রধান – মানে যে প্রতিষ্ঠান মুসলমানেরাই আমেরিকান প্রধান শত্রুজ্ঞান করে জন্ম দেয়া হয়েছিল – তিনি  আমেরিকান কংগ্রেসের (বা সংসদীয় কমিটির) এক শুনানিতে সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেন  আমেরিকা রাষ্ট্রের জন্য এখনকার সবচেয়ে বড় হুমকি হোয়াইট সুপ্রিমিস্টদের নিয়মিত চরমপন্থা বা এক্সিমিজম। এসব ততপরতা এখন বাড়ার আরেক বড় কারণ অবশ্য খোদ ট্রাম্পেরই পেটি-ক্ষুদ্র স্বার্থ বা লাভালাভে এসব গোষ্ঠিকে পরোক্ষে বা কখনও প্রকাশ্যে সমর্থন দেয়া বা নেয়া।

তবু ‘জাতি ব্যবস্থায়’ ফিরে যাওয়ার চেষ্টা ট্রাম্পের গত চার বছরের ধরে তৎপরতা হয়েই ছিল। আজকের আমেরিকান প্রশাসন সেই আকার পেয়েছে বা দেয়া হয়ে গেছে যা ট্রাম্পের ততপরতার কিছু প্রত্যক্ষ ফসল। শুধু তাই নয়, এতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবস্থা এমন জায়গায় চলে গেছে যে, বাইডেন জিতলেও ট্রাম্পের এক্সিকিউটিভ অর্ডার বা পলিসিগুলো আর বদলাতে বা পুরনো ট্রাম্প-পুর্ব জায়গায়  নিতে পারবেন না। বাইডেনকে ট্রাম্পের কাম-আকাম বহুকিছুই অনুসরণ করে যেতে হবে। আর এভাবেই যেন আমেরিকা ক্রমশ শেষ হয়ে যেতে চাওয়ার রাস্তায় উঠে গেছে; শেষ দিনগুলোতে যতদিন না গ্লোবাল নেতা আমেরিকা এভাবে ক্ষয়ে ক্ষয়ে নিজেকে বিলীন হওয়ার দিকে নিয়ে চলে যায়। চলতি সপ্তাহের (১৯ সেপ্টেম্বর) ‘ইকোনমিস্ট’ ট্রাম্পের এমন নীতিগুলোর একটা তালিকা তৈরি করে রেখেছে, যার শিরোনামঃ How would Joe Biden change America’s trade policy?। আগ্রহিরা তা পড়তে এই লিঙ্ক অনুসরণ করতে পারেন।

কিন্তু এব্যাপারে আমেরিকার জন্য বাস্তব অসুবিধা হল, কেউ গ্লোবাল অর্থনৈতিক নেতা হবে কি না এটা তার নিজের খেয়ালে নেয়া ইচ্ছায় সিদ্ধান্তের বিষয়ই নয়। অন্যভাবে সরাসরি বললে, মূল কথাটা হল- অর্থনৈতিক কারণে কোনো রাষ্ট্র যখন গ্লোবাল সারপ্লাস সঞ্চয় বা পুঞ্জীভবনের প্রধান কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়, এটাই সেই পূর্বশর্ত যে, সে গ্লোবাল অর্থনৈতিক নেতা হচ্ছে বা হবে কি না।

এক্ষেত্রে চিন্তার জগতের বাস্তব সমস্যটা হল, আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও গ্লোবাল অর্থনীতি বিষয়টা নাড়াচাড়া করার জন্য যাদেরকে একাদেমিক বা প্রফেশনাল দিকের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিত্ব মনে করা হয় এরা হল মূলত যাদের “আন্তর্জাতিক সম্পর্ক” বিষয়ে ডিগ্রী আছে। অথচ গ্লোবাল অর্থনীতি বা ক্যাপিটালিজমকে বুঝা আর সাথে গ্লোবাল রাজনীতিতে এর প্রভাবকে বুঝতে পারার জন্য অর্থনীতির নুন্যতম ধারণা দরকার হলেও এটা তাদের জানা বা পড়ার সিলেবাসেই নাই। ভরসা একমাত্র কেউ যদি আলাদা করে অর্থনীতিও পড়ে নেন বা ডিগ্রী থাকে।  একারণে কেউ গ্লোবাল অর্থনৈতিক নেতা থাকবে কিনা এটাও যেন সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব কারো আছে কিনা আর সাথে ইচ্ছা থাকলেই এটা সম্ভব বলে মনে করতে থাকেন এরা। অথচ ঘটনার অবজেকটিভ দিক বা বাস্তব দশা পরিস্থিতিটা তাদের নাগালের বাইরেই থেকে যায়।

ইন্দো-প্যাসিফিক জোটে গ্লোবাল অর্থনীতির প্রভাবঃ
যেমন ধরা যাক, আমেরিকা এখন খুবই আগ্রাসী হয়ে ইন্দো-প্যাসিফিক জোটের কথা তুলে এগিয়ে আসছে। সম্ভবত তাতে ভারত যতটা ঘনিষ্ঠ হয়ে মাঠে আমেরিকাকে পাশে পেতে আকাঙ্ক্ষা বাড়িয়েছে তা এর চেয়েও বেশি আগ্রাসী। কিন্তু তবু আমরা দেখছি ফাইনালি মোদী চীনের সাথে আপস করতেই ছুটে চলে গেলেন। কেন?

কারণ নরেন্দ্র মোদীর জন্য আবার ঠিক এর উলটা আরেক ফ্যাক্টস হল, তিনি জানেন তাঁর দরকার এখন বিপুল  বিনিয়োগ। করোনা শুরুর আগেও এ সমস্যা ছিল আর করোনার প্রভাবে পরে ভারতের অর্থনীতি এখন একেবারে তছনছ হয়ে গেছে। অথচ এখনও করোনায়  প্রতিদিন নতুন একলাখ জনসংখ্যা আত্রান্ত হচ্ছে আর এক হাজার মারা যাচ্ছে। কাজেই মোদীর ভারতের এখন দরকার বিনিয়োগ – সেটা অবকাঠামো আর এফডিআই (বা সরাসরি প্রাইভেট ব্যবসায়িক বিনিয়োগ) এদুটো অর্থেই। যার একটা – এফডিআই, এটা আমেরিকা এক বিশেষ শর্ত (যা ভারতের স্বার্থের জন্য খারাপ) সাপেক্ষে হয়ত দিতে সক্ষম। সেই এমন বিশেষ সুবিধার শর্ত হল যে, আমেরিকান ব্যবসায়ীদেরই সরাসরি ব্যবসা, কারখানা নিয়ে ভারতে বসতে দিতে হবে। আর অন্যটা মানে, অবকাঠামো বিনিয়োগ, সেটা এখন আর আমেরিকা দিতে অপারগ।  কাজেই এই আমেরিকাকে নিয়ে মোদি কী করবেন? কোন কাজে আসবে? আর এটাই হল, যে রাষ্ট্রের অর্থনীতিতে বিপুল সারপ্লাস এখনও জমছে আর যে রাষ্ট্র এখন সেসব দিন পার হয়ে ফুরিয়ে এসেছে – এদুইয়ের সিরিয়াস ফারাক।

কাজেই সোজা ভাষায় বললে,  আমেরিকার কোন প্রশাসন কত আন্তরিকতা আর মানসিক দৃঢ়তার শক্তিতে ইন্দো-প্যাসিফিক জোট নিয়ে এগিয়ে আসছে – কত জোরে দৌড়ে ভারতের দিকে ছুটছে – এতে মোদীর কোন দুঃখ আমেরিকা ঘুচাতে পারবে না। আবার এটা মোদীও জেনে গেছেন। অথচ এই সক্ষমতাটার সবই চীনের আছে।ঙ্কিন্তু ভারতের অন্যান্য চীনা-ভীতি বা সীমান্ত বা নেহাতই ঈর্ষা ইত্যাদি চীনকে নিয়ে ভারতের  মনে মনে যাই থাক, মোদীসহ ভারতের সিরিয়াস যেকোন ব্যক্তিত্বই অস্বীকার করে না চীন ভারতের জন্য কত দরকারি ও উপযুক্ত। এবং পারফেক্ট চয়েস।  এমনকি ভারতের এই প্রয়োজনের কাছে চীনের বদলি জাপানও ন্‌ তাও ভারত টের পায়। এটাই ভারতের জন্য এক উভমুখি বা কন্ট্রাডিকটরি সমস্যা ও বাস্তবতা। এর পিছনের মূলকথাটা হল, আমেরিকা ভারতের কাছে এক অতীত আর চীন হল আগামি। আর তা গ্লোবাল অর্থনৈতিক নেতা অর্থেও। কিন্তু তবু ভারতের সকল রাজনৈতিক নেতার চোখে অর্থনৈতিক অর্থে চীন খুবই কাম্য হলেও (যেটা মোদীর চোখে চীন সবার চেয়ে বেশি কাম্য। মোদীই প্রথম চীনকে ভারতের অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগে ডেকে এনেছিলেন। ) কিন্তু ঠিক এর উল্টাভাবে গ্লোবাল রাজনৈতিক অর্থে ভারতের চীনা ভীতি ও নিরাপত্তা নিয়ে ট্রমার কারণে আমেরিকা তার এক নম্বর কাম্য। এছাড়া গ্লোবাল অর্থনৈতিক নেতার পরিপ্রেক্ষিত থেকে বিষয়টাকে দেখা ও বুঝার মত কোন নীতিনির্ধারক পর্যায়ে কেউ আছেন তা জানা যায় না।  কারণ উগ্র বিধ্বংসী হিন্দু ‘জাতি’ বোধ আর অকার্যকর স্বদেশিপনা ভারতের সংকট থেকে বের হয়ে আসার সব সম্ভাবনাকে কুড়ে কুড়ে খেয়ে ফেলছে।

অর্থাৎ বলাই বাহুল্য এই আমেরিকা আর গ্লোবাল নেতার ভুমিকা নয়। অন্তত দৃশ্যত ভারতের কাছে। কিন্তু তা নয় বলে তাতে আমেরিকা মুখে যতই দাবি করুক করলেও কিছু হচ্ছে না, কিছু এসে যাচ্ছে না। এমনকি আমেরিকার সা্থে মোদীর ভারতের মিলন আকাঙ্ক্ষা থাকলেও তা কাজ করতে পারছে না। বরং আর আমাদের সবার মাথার উপরে টিকটিক করা ঘটনাটা হল,  আমেরিকায় যারা এটা মানছে না এরা এই অসম্ভব জিনিসটা মেনে নিতে না পেরে পরিস্থিতিকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়ে নিজেদের ও দুনিয়াকে আরো দুস্থ অবস্থায় ফেলে দিতে পারে।

আমেরিকান গ্লোবাল ভুমিকার পরে এবার আমেরিকান লোকালঃ
লন্ডন ইকোনমিস্ট সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন বাংলাদেশ নিয়ে গত ১৯ সেপ্টেম্বর এক আর্টিকেল ছেপেছে। এর একটা অনুবাদ এখানে পাওয়া যেতে পারে। যার শিরোনাম – “ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক দুর্বল বলে চীনের সাথে বন্ধন শক্তিশালী হচ্ছে”। ইকোনমিস্টের লেখাটায় কোনো লেখকের নাম নেই, কোন ছদ্মনামও নাই। যদিও লেখা পড়ে মনে হয়, প্রো-ইন্ডিয়ান মনের বাংলাদেশের কোন সাংবাদিকের সহযোগিতায় কোন ইন্ডিয়ান বা পশ্চিমা সাংবাদিক এটা লিখেছেন। তবে লেখক যেই হন, তিনি বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক কেন দুর্বল হল অথবা চীনের সাথেই বা কেন সবল হল এর কোন ব্যাখ্যা দেননি। এমনকি তিনি ধরে নিয়েছেন, ভারতের সাথে এখন যে সম্পর্ক দুর্বল হয়ে গেছে বলছেন তা আগে এটা সবল ছিল। কিন্তু আগেই বা এটা সবল ছিল কেন অথবা কবে থেকে সবল ছিল এরও কোনো ধারণা বা ব্যাখ্যা দেয়া নেই এখানে। তবে পুরো রিপোর্টে একটা দুঃখবোধ চারদিকে ছড়িয়ে আছে যে, ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কটা ঢিলা হয়ে গেছে।

আবার  শুরুর প্যারায় লেখার প্রসঙ্গ হল, সিলেটের এয়ারপোর্ট নির্মাণের টেন্ডারে ভারতের এক কোম্পানি হেরে গেছে, আর চীনের এক কোম্পানি কাজ পেয়েছে। কিন্তু এটা কী করে চীন বা ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের দুর্বল বা সবল হওয়ার উদাহরণ হয়? এটা লেখক বলেননি। একটা টেন্ডারে ভারত হেরে গেলে কার কী করার আছে? এটা তো বাংলাদেশের কারো সাথে সম্পর্ক সবল নাকি দুর্বল এর প্রমাণ হতে পারে না। ফলে পাঠকদের মনে এই প্রশ্ন উঠতেই থাকবে বা থেকেই যাবে।

আবার বলা হয়েছে, গত জুন মাসে চীন বাংলাদেশের চীনাপণ্য আমদানিতে ৯৭ ভাগ পণ্যে ডিউটি ফ্রি সুযোগ দিয়েছে। অথচ বটম লাইন ফ্যাক্টস হল, এটাও ঠিক এখন কোন দেয়া সুবিধা নয়। এসব প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল ২০১০ সালে ‘কম্প্রিহেনসিভ কোঅপারেশন’ নামে যে আলাপ শুরু হয়েছিল শেখ হাসিনার প্রথম চীন সফরের সেই সময় থেকে। আর পরে, এতে ২০১২ সালে এ নিয়ে ডেইলি স্টারে চীনা রাষ্ট্রদূতের বিস্তারিত সাক্ষাতকার ও রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল। সেসব চীনা প্রস্তাব এই প্রথম এখন কিছুটা কার্যকর করা হয়েছে দেখা যাচ্ছে, এই আর কি।  এ ছাড়াও ইকোনমিস্টের  লেখায় বলা হয়েছে – বাংলাদেশে কিভাবে ভারতের দখলদারসুলভ দম্ভ ও খারাপ আচরণে বাংলাদেশীদের মধ্যে ভারতবিরোধী সেন্টিমেন্ট বাড়ছে।

মজার দিকটা হল, আসলে ইকোনমিস্টের ওই রিপোর্ট অনেক জায়গাতেই নানাবিধ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। আর তা যে যার মত করে নিজের কাজে লাগাচ্ছে। যেমন বিবিসি বাংলা পরোক্ষে ওই রিপোর্ট নিয়ে আরেকটি রিপোর্ট করেছে। যেন ইকোনমিস্টের ঐ রিপোর্ট নিয়ে কংগ্রেসের কী প্রতিক্রিয়া সেটা জানা এর উছিলা। সেখানে ফোকাস বক্তব্যটা হল – আসলে ভারত না – আবার কংগ্রেসও না, মোদী সরকারের কারণেই বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক ঢিলা হয়ে গেছে। আর সম্পর্ক যে ঢিলা হয়েছে এর প্রমাণ হল ইকোনমিস্টের ঐ রিপোর্ট। রাহুল গান্ধীও ইকোনমিস্টের ওই রিপোর্টের বরাতে মোদীর বিরুদ্ধে লম্বা টুইট করেছেন।

তবে এখানে লেখকের প্রো-ইন্ডিয়ান ঝোঁক-অবস্থান সবচেয়ে ভালোভাবে ধরা পড়েছে। যেমন তিনি লিখছেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়াটাকে বলেছেন, “ভারতের অবদান”। আর দাবি করছেন সেই থেকে নাকি “দুই দেশের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ হয়ে আছে”। অথচ এটাই সবচেয়ে ধুর্ত ভারতীয় বয়ান। যদিও এ’কথাটা কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বুঝেন, এমন লেখক বলতে পারেন না। তবে রাস্তার ধারে টংয়ের চা দোকানে বসে গুলতানির আলাপ হতে পারে হয়ত। কারণ দুই রাষ্ট্রীয় কোনো সম্পর্কের ভিতরে কখনও দয়া বা দান-ধ্যান ধরনের আলাপ-ধারণা থাকে না। দুই রাষ্ট্র দু’পক্ষের কোনো বিষয়ের মধ্যে উভয়েই নিজের নিজের স্বার্থ দেখতে পেলে একমাত্র তখনই তারা ঐ প্রসঙ্গে একসাথে কাজ করে, পদক্ষেপ নেয়। পরস্পরের পক্ষে খাড়া হতে সম্মত হয়। স্বার্থ কমন না হলে এটা করতেই পারে না, ঘটেও না। তাই এখানে কেউ কাউকে ‘দয়া’ করার কিছু নেই। বাংলাদেশকে সহায়তা করতে ভারতেরও স্বার্থ ছিল। আর থাকলেই একমাত্র এমন করা সম্ভব। বিশেষত এতে ভারতের অবস্থান পাকিস্তানের উপর আরো শক্ত হবে, সীমান্ত ইস্যু এবং কূটনীতিক সভা ও ফোরামগুলোতে ভালো অবস্থান সৃষ্টি হবে – এসব স্বার্থেই ভারত বাংলাদেশকে সেসময় সহায়তা করেছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তখনকার পাকিস্তানের অর্ধেকের বেশি সীমান্তে পাহারার দায় ও টেনশন কমে যায়। এটাও ভারতের এক বিরাট লাভ, যা বাংলাদেশের অবদান! তাই তো হয় নাকি? কাজেই দয়া করে বাংলাদেশের জন্ম দিয়ে দিলাম টাইপের কথা এগুলো হীন মানুষের বাংলাদেশকে নিচা দেখানোর চেষ্টা মাত্র।

আবার এরপরে,  ১৯৭২ থেকে “দুই দেশের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ হয়ে আছে” এটা অবাস্তব ও অমূলক কথা। অন্তত যদি তাই হত তবে ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবের মৃত্যুর পরে আমাদের পাহাড়িদেরকে ফুসলায়ে ভারতে নিয়ে এরপর তাদেরই হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে আবার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সীমান্তে হামলা করতে পাঠিয়েছিলেন কেন? এটা কোন মনগড়া ক্যাম্পেইন নয়। এ্টাই সুবীর ভৌমিকের পিএইচডি থিসিস এর কনক্লুশন বা উপসংহার; যা পরে বই আকারেও প্রকাশিত।

এছাড়াও হার্ড ফ্যাক্টস হল, ২০০৭ সালে আমেরিকা বাংলাদেশকে ভারতের হাতে “তুলে দিয়েছিল”; আমেরিকার পক্ষে চীন ঠেকানোর জন্য ভারতের কাজ করে দেয়ার বিনিময়ে ‘উপহার’ হিসেবে। কাজেই ২০০৯ থেকে ২০১৯ মোটামুটি এই সময়ে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ভারতের নিজের জন্য তা স্বর্ণযুগ বিবেচনা করা হয়, যেটা এর আগে কখনো বা ১৯৭২ সালেও ছিল না। আর ফাইনালি এখন সেটাই নানান কারণে চলতি বছর থেকে নানান সমীকরণে ক্ষমতাসীন সরকার আবার অনেক বেশি চীনমুখী হয়ে থাকাটা পাবলিকের স্বার্থ হোক আর নাই হোক, সরকারের ক্ষমতায় থাকার জন্য জরুরি মনে করা হচ্ছে।

কিন্তু এ নিয়ে কোন রিপোর্ট লিখতে বসে, ভারতমুখী করে যা ইচ্ছা ব্যাখ্যা দেয়া তো অর্থহীন। বরং এতে ইকোনমিস্ট গ্রুপের সম্মান ইজ্জত ও ইন্টিগ্রিটি বা সততাকে ধুলায় লুটাবে। আমাদের কী মনে নেই, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে, যেটাকে দেশের মানুষ ‘নৈশভোটের নির্বাচন’ বলে চিনে, তাকে ইকোনমিস্ট গ্রুপের ‘ইন্টেলিজেন্স ইউনিট’ প্রেডিকশন দিয়েছিল যে ১২ ডিসেম্বর ২০১৮ ‘লীগ সরকার পুনর্নির্বাচিত হবে’ বলে। অথচ এটা কেমন নির্বাচনী পূর্বাভাস বা ইন্টেলিজেন্স? এর মানে কি ইকোনমিস্ট জানত যে, এটা নৈশভোট হবে? তাই কী? ইকোনমিস্ট গ্রুপ কখনো এ নিয়ে অন্তত লজ্জা পেয়েছিল বলে শুনিনি।
আবার লেখকের কাণ্ডজ্ঞান দেখে আমাদের অজ্ঞান হওয়ার দশা। তিনি আরো ঐ রিপোর্টের সাথে বাংলাদেশে চীনা ও ভারতীয় ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগের এক তুলনামূলক গ্রাফ দিয়েছেন। আচ্ছা, দুনিয়ার কোনো দেশে বিদেশী বিনিয়োগকারী হিসেবে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের কি খুব নামডাক? তারা কি খুবই যোগ্য আর অতুলনীয়? তাও আবার প্রবল উঠতি অর্থনীতির হবু নেতা চীনের সাথে তুলনায়? আবার তামাসাটা হল, তাতে ফলাফল কী দেখানো হয়েছে? বলা হয়েছে যে, এটি ১:১২ অনুপাতে। মানে, ভারতের এক হলে চীন এর ১২গুণ বিনিয়োগকারী, চীনের আধিপত্যে। তাহলে এটা দিয়ে কী বুঝানো গেল? আর এতে কি উল্টা ভারতকে তুচ্ছ দেখানো হয়ে গেল না?
লেখক বলছেন “চীনা মুগ্ধতা দেখানো অশোভন ইঙ্গিত” [Cue a Chinese charm offensive]। কেন, তা কিছুই বোঝা গেল না। কেবল পরের বাক্যে তিনি বলছেন, চীন বাংলাদেশকে সাম্প্রতিককালে সাতটি ফ্রেন্ডশিপ ব্রিজ বানিয়ে দিয়েছে। হ্যাঁ দিয়েছে, এগুলাই বুডিগঙ্গা ফ্রেন্ডশীপ ব্রিজ। আর এর সাথে একটি আধুনিক অডিটোরিয়ামও তৈরি করে দিয়েছে (আগারগাঁওয়ে যা বঙ্গবন্ধু অডিটরিয়াম), আর সবই বিনা পয়সায়। প্রথমে চীনারা তা বানিয়ে দিয়েছিল ঋণের অর্থে, পরে সব ঋণ তারা মাফ করে দিয়েছে অনুদান হিসেবে।

সর্বসাকুল্যে এর খরচ সেকালের হিসাবে মাত্র কয়েকশ’ মিলিয়ন ডলার। আর এছাড়া তা সাম্প্রতিককালের ব্যাপার নয় আর বাংলাদেশের দুই দলের সরকারের আমলেই ঘটেছে এমন পুরনো ঘটনা এগুলা। কিন্তু মূল কথাটা হল, যে চীন আমেরিকার বদলে গ্লোবাল এম্পায়ারের আসনে বসতে যাচ্ছে তার জন্য বাংলাদেশেও প্রভাববিস্তারের দরকার, এটাই স্বাভাবিক। আর সেজন্য কয়েকশ’ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করা কি বেশি ব্যয়? গত ৭২ বছরের নেতা আমেরিকা কি এমন কয়েকশ’ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে পরে মাফ করেনি, অনুদান দেয়নি? এশিয়া আফ্রিকায় এমন কতগুলো দেশের নাম চান? গুগলে (HIPC) heavily indebted poor countries  লিখে সার্চ দিলেই টের পাবেন। এখনও অন্তত ৩৯ টা দেশের নাম পাবেন।  গ্লোবাল আম্পায়ার হতে গেলে এমন অনেক খরচ করতেই হয়। গত সত্তর বছর ধরে এটাই আমেরিকান প্রাকটিস, তাই নয় কী?

আসল ঘটনা  বা কথা অন্য জায়গায়। এককথায় বললে,  আমেরিকা বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক করার কৌশলেও চীনের কাছে হেরে গেছে। আর তা মূলত আমেরিকার তথাকথিত ‘বাংলাদেশী এক্সপার্টদের’ ভুয়া আকামের পরামর্শের কারণে।

আমেরিকা একে তো বিনিময়ে কিছু না পেয়ে বাংলাদেশকে তারা ভারতের হাতে “তুলে দিয়েছে”। আর শুধুমাত্র এ’জন্যই আমেরিকা বাংলাদেশ থেকে চির-বিতাড়িত হয়ে যেতে পারে। সেজন্য অন্তত কারেকশন হিসেবে আমেরিকার একবার মাফ চেয়ে আবার শুরু করা উচিত। দেখানো উচিত, আশস্ত করা উচিত সে শিক্ষা নিয়েছে – সংশোধিত হয়েছে। এখনো বাংলাদেশে তার পজিটিভ রাজনৈতিক ভূমিকা রাখার সুযোগ সম্ভবত সব শেষ হয়নি, যদিও ইতোমধ্যেই তা যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমেরিকা নিজেই নিজেকে ডুবিয়েছে। আর বাকিটা তার কথিত  “বাংলাদেশ এক্সপার্ট” আর ইউএসএইড ফান্ডেড দেশী ‘বোকা’ এনজিও কর্তাদের কারণে। এরা এখন দাবি করেন, চীন-ভারত নাকি বাংলাদেশের সব ক্ষতি করে ফেলছে। এরা এখন টের পেয়েছেন, ভারতই নাকি বাংলাদেশে পাকিস্তানের চেয়েও বড় শোষক ইত্যাদি…। আসলে এরা না বাংলাদেশের জন্য না আমেরিকার জন্য প্রয়োজনীয়, বা কোনো কাজের ভূমিকা রাখতে পারছেন।

চীন নিজের কাজ ও লক্ষ্য ঠিকমতোই বুঝে। কাজেই চীন বাংলাদেশের অবকাঠামো, বিদ্যুৎ ও টেলিকম ইত্যাদি সব খাত দখলে নিয়েছে বলে এখন আপসোস করার কী আছে? যেটা ঐ রিপোর্টে করা হয়েছে। চীন যে বাংলাদেশে ব্যবসায় বিনিয়োগ-বাণিজ্য ও প্রভাব চায়, আর তা কী করে নিজে পেতে হয় – প্রতিযোগিতার এই যুগে চীন তা ভালোই জানে আর প্রয়োজনীয় হোমওয়ার্কসহ সবকিছু তারা করে এসেছে। চীনের দিক থেকে এটাই তো স্বাভাবিক। এনিয়ে চোখ টাটানোর কী আছে? হবু গ্লোবাল ইকোনমিক এম্পায়ার চীনকে তো এমনই তো হতে হবে। ঠিক আমেরিকা যেমন তার উত্থানের কালে গ্লোবাল এমপের’র (Emperor) হয়েই গত ৭২ বছর ধরে রাজত্ব করেছে, আমেরিকা তো এমনি এমনিতে টিকে ছিল না! কিন্তু ‘শেষ বয়সে’ তার বাংলাদেশে নেয়া পদক্ষেপগুলো ছিল ধারাবাহিকভাবে ভুল আর ভুল। যেমন দেখেন, পদ্মা সেতুর দুর্নীতি ইস্যুতে বিশ্বব্যাংক যদি প্রশ্নই তুলে থাকে, তবে প্রশ্নের মীমাংসা করল না কেন, শেষ করল না কেন? প্রমাণ করল না কেন? উল্টা মামলাটাই প্রত্যাহার করে সব ছেড়ে পালাল কেন? আর এমনভাবে ও এমন সময়ে পালাল যাতে বিশ্বব্যাংকের প্রতিযোগী ও বিকল্প হিসেবে চীনের নিজেকে হাজির করা যেন তাতে সবচেয়ে সহজ হয়ে গেল। এটা তো হাস্যকর ভাবে “করিয়া ভাবিবার” আদর্শ লক্ষণ হয়ে গেল!

আজকের চীন বিশ্বব্যাংকের চেয়েও অনেক বড় ও সক্ষম বিনিয়োগ বা অনুদান দাতা। সেই সাথে সে উদীয়মান, পরিকল্পিত ও স্ট্র্যাটেজিক এবং সর্বোপরি তার প্রকল্পে লোকাল এজেন্ট বা কমিশন ব্যবস্থা সে রাখে। যে গ্রহীতা সরকার যেভাবে সন্তুষ্ট হয় সেটাই সে অনুসরণ করে। এটা কি ২০১৩ সালের আগে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট বা বিশ্ব ব্যাংকের স্ট্র্যাটেজিস্টরা বুঝেন নাই যে, প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে চীন এসে যাচ্ছে? যদি না বুঝে থাকেন এটাই তো প্রমাণ, চীন উত্তম ও যোগ্য গ্লোবাল ইকোনমিক এমপেরর হয়ে উঠেছে, যার সাথে তুলনায় আমেরিকার দিন ফুরিয়ে গেছে।

আবার গ্লোবাল রাজনৈতিক দিক, যে খাতে চীনের দেয়ার কিছুই নেই বরং আমেরিকান রাজত্ব আছে। অথচ আমেরিকার কথিত এক্সপার্টদের কারণে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে আজ আমেরিকার কোনো আবেদন নেই। এর এক নম্বর কারণ খোদ আমেরিকায় – মুসলমানদের সাথে তার বিদ্বেষী আচরণ। আমেরিকান রাষ্ট্র আর তার বেকুব প্রশাসন – বুশ থেকে ট্রাম্প পর্যন্ত – এরা সকলে ভুলে গিয়েছিল আমেরিকান রাষ্ট্রের মানবাধিকারের প্রতি কিছু প্রতিশ্রুতি আছে যা রক্ষা করতে পারলেই কেবল সে আমেরিকা রাষ্ট্র আর, গ্লোবাল পলিটিক্যাল লিডার হয়ে টিকে থাকতে পারে। নইলে সব মিথ্যা আর ফাঁকা আওয়াজ হয়ে যায়!

মূল কথাটা হল, যারা আমেরিকান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নেয় কেবল সেই ব্যক্তিরাই আমেরিকান রাষ্ট্রের শত্রু। এটা খুবই কমন কথা। দুনিয়ার সব ধরণের রাষ্ট্রের কনষ্টিটিউশনে এই একই কথাটাই লেখা থাকে ও থাকতেই হয়। কিন্তু আমেরিকান হোমল্যান্ড সিকিউরিটি এর অর্থ করেছে – না “মুসলমানরা” আমেরিকার শত্রু। অথচ কনষ্টিটিউশনের মতে তারা মুসলমান বলে আমেরিকার শত্রু নয়, একেবারেই নয়। কেবল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ার জন্য তারা এনিমি অব দা স্টেট। সেজন্য যা বিচার হয় তারা করুক। কিন্তু মুসলমানবিদ্বেষী প্রপাগান্ডা কেন? এটা তো রাষ্ট্রের কাজ না। অথচ হোমল্যান্ড এটা ছড়িয়েছে যে  ‘মুসলমানরা’ আমেরিকার শত্রু। আর এতে কোনপক্ষই আবার এটাকে ভুল বলে আপত্তিও তুলে নাই।  এভাবে যেখানেই মুসলমান পেয়েছে তারা কিছু করুক আর নাই করুক সবাইকে হোমল্যান্ড উঠিয়ে এনেছে। নির্যাতন, কথা আদায় সবই করেছে। অথচ আর সবার মত দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের ও পেশার মুসলমানেরা ভাগ্য অন্বেষনে আমেরিকায় এসেছিল ন্যাচারালাইজড আমেরিকান সিটিজেন হয়ে যেতে। তাদের সকলের স্বপ্ন গুড়িয়ে দিয়ে রাষ্ট্র দানব হয়ে হাজির হয়েছে, তাতে দাড়িয়েছে যেন মুসলমান হওয়াটাই তাদের অপরাধ।  এভাবে বুশের আমল থেকে এ পর্যন্ত ভুল পথে আমেরিকা হাঁটছে। এতে আমেরিকান রাষ্ট্রের ‘কবর’ ঐদিন থেকেই দেয়া হয়ে গেছে। এটা হয়ে গেছে, কারণ মুসলিমবিদ্বেষী আর নাগরিক বৈষম্যের কোন রাষ্ট্র যে নিজের প্রতিশ্রুতি বা কনস্টিটিউশনই ধরে রাখতে পারে না, মানে না; সে তো আসলে মৃত।

আবার আমাদের এদিকে এশিয়াতে তারা ভারতের সাথে কৌশলগত মিত্রতা করেছে। এই ঐক্যের ভিত্তিও এ’দুই রাষ্ট্রের মুসলিমবিদ্বেষ, যারা মুসলমানদের নিজের রাষ্ট্রের শত্রু মনে করে থাকে। এটা তো হতেই পারে না। যা সবার জন্য সমান রাষ্ট্র নয়, সেটা আদতে কোন রাষ্ট্র নামে ডাকার যোগ্য নয়। কারণ, রাষ্ট্র নিয়ে মৌলিক বোঝাবুঝিটা হচ্ছে, যেকোনো জনগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্য বা অসাম্য করা, এটা নিজ রাষ্ট্রকে বিলুপ্ত করে ফেলার সামিল। তাই আমেরিকা বা ভারত মুসলিমবিদ্বেষী রাষ্ট্র বলে নিজ বিলুপ্তির পথে কয়েক ধাপ আগিয়ে যেতে বাধ্য, হয়েছেও তাই।
আমেরিকার আত্মস্বার্থও যারা বুঝে না আর মনভর্তি মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা নিয়ে আছে যারা; এমন কিছু আমেরিকান প্রজন্ম চলতি শতকের শুরু থেকেই আমেরিকার প্রশাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে গেছে।

এবার, যারা আমেরিকার চোখে “বাংলাদেশ এক্সপার্ট” বা আমেরিকার বন্ধু ও কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করেন তাদের দিকে দেখি। তারা মনে করেন, একজন ইসলামিস্ট কতদূর সেক্যুলার বা আধুনিকতা থেকে দূরে আছে তা মেপে রায় দেয়াটা তার কাজ। এর অর্থ, তাহলে একজন আল্লামা আহমদ শফী হুজুরকেও যেন তিনি মেপে বলতে আহ্বান জানাচ্ছেন যে, দেখুন তো, আমি আমেরিকান এক্সপার্ট কতটুকু ইসলামিস্ট হয়েছি। তাই নয় কী? বলাই বাহুল্য, এতে শফী হুজুরের মত কোনো আলেমকে দাওয়াত দিয়ে আনা আর তাকে দিয়ে বলানো যে, আমি তো আপনার মতো কওমি মাদরাসায় পড়িনি তাই আমি আধুনিক বলে আমাকে নাকচ করে দেন। অথচ এটাও কোনো ইসলামিস্টের কাজ নয়।
ব্যাপারটা হল, আমরা কেউ আরেকজনকে তার ইডিওলজি মেনে নিতে বা নিয়ে চলার দাওয়াত দিতে বা দাবি করতে পারি না। কারণ এগুলো একটাও আমাদের কারোই কাজ নয়। হতেই পারে না। বরং সব ইডিওলজির লোকেরা যেন পাশাপাশি বৈষম্যহীনভাবে সমান ও একই সুযোগসুবিধাসহ বসবাস করতে পারি এমন নীতি ও অধিকারভিত্তিক একটা রাষ্ট্রের জন্য সবাই ঐক্যমত্য হওয়া, কাজ করা ও গড়ে তোলা, এটাই আমাদের সবার কাজ। এতে এরপর থেকে সবাই ঐ  রাষ্ট্রের কমন নীতিগুলো মেনে চলা সাপেক্ষে সবার নিজ মতাদর্শ সবাই কারো সাথে একমত না হয়েই বাধাহীনভাবে চর্চা করতে পারব।

অথচ তারা খুঁজতে গেছে কওমিরা কীংবা ইসলামিস্টরা কত খারাপ, কত পশ্চাদপদ, কতটা তাদের মত নয় এইসব। বরং নুন্যতম কী না হলে সকল ইডিওলজি বা ধারা একই রাষ্ট্রে থাকতে সমস্যা হবে, আর তা কেন হবে, এর সমাধান কী ইত্যাদি সেসব নিয়ে আলোচনা তর্ক এবং মীমাংসায় পৌছানোর চেষ্টার চেয়ে ইসলামিস্টদের কথিত ‘সেকুলার’ বানানো যেন তাদের কাজ এমন গোঁ ধরে তারা।

মানে কথিত এক্সপার্টরা আসলে নিজের আসল কাজটা কী তাই তো বুঝেননি। তারা ভেবেছেন, একজন ইসলামিস্ট যে প্রগতিশীল নয়, কথিত সেকুলার নয় হতেও চায় না এই ফতোয়া দেয়া ও জারি রাখাই তার কাজ। ইসলামিস্টরা কত পশ্চাদপদ তা দেখিয়ে প্রপাগান্ডা করাই যেন তার কাজ। ফলে এরই পরিণতি হল ঘৃণা, ঘৃণা আর ঘৃণার চর্চা বাড়িয়ে চলা।

আয়না-ছবিঃ
আমেরিকার হোমল্যান্ড সিকিউরিটি যে মুসলমান সেগরিগেশন বা বিচ্ছিন্নকরণ ও বিদ্বেষী ততপরতা শুরু করে দিয়েছিল এরই আরেক অর্থ হল, আমেরিকানদের মনে দুনিয়ায় কোন মুসলমান নাই বা না থাকে যেন – এমন এক অবাস্তব দুনিয়ার আকাঙ্খা জাগিয়ে তোলা।  এর তামশার দিকটা হল আমেরিকায় আঁকা আকাঙ্খিত সেই দুনিয়াটাই যখন পরে সে বাংলাদেশের মত মুসলমান-অধ্যুসিত দেশে দেখতে পায়, [তবে বাংলাদেশেরটা আসলে আমেরিকারই এক ‘আয়না-ছবি’ – মানে ঠিক আপনি না তবে, আপনি আয়নার সামনে দাঁড়ালে যে ছবিটা আয়নায় ফুটে উঠে সেটাই আপনার আয়না-ছবি] – বাংলাদেশে সেই ছবিটাই ফুটে উঠলে এবার আমেরিকা আঁতকে উঠেছে।

কারণ বাংলাদেশের ছবিটা হল এবার কেবল মুসলমানেরাই আছে এমন এক দুনিয়া পাবার আকাঙ্ক্ষার ছবি। এটা বাংলাদেশে এখন অনেক বেড়েছে আপনি আমেরিকা দাবি করবেন বা দেখাতে পারবেন হয়ত। আপনি আমেরিকান শাসক – এটা দেখে হয়ত ভাববেন দেখেছো তারা কত খারাপ। তারা প্লুরাল (plural) না, এই ইসলামিস্টরা এদের স্বভাব হল যারা তাদের মত না এমন কাউকে তারা সাথে নিতে একসাথে বসবাস করতে চায় না। বরং নির্মুল করতে চায়, তারা inclusive না; তারা সেকুলার না। ইত্যাদি এমন কতকিছু অভিযোগ আপনার থাকবে হয়ত।

এখন বুঝেন আপনি যদি মুসলমান-ছাড়া এমন কোন দুনিয়ার কল্পনা করতে পারেন তাহলে এটা পরিণতিতে কেবল মুসলমানেরা আছে এমন এক দুনিয়া পাবার আকাঙ্ক্ষা যাদের আপনি ইসলামিস্ট বলছেন, তাদেরই হাতে আপনার এমন এক আয়না-ছবিই কী আপনি দেখবেন না? এটা তো আসলেই আপনারই আয়না-ছবি! কাজেই এদের দেখে আপনি আঁতকে উঠেন কেন? বরং নিজেকে জিজ্ঞাসা করেন সাহস থাকলে যে, আপনি নিজে কেন এমন? অধঃপতিত! কেন হয়েছিলেন? তাই, কারও দিকে আঙুল তোলার আগে নিজেকে জিজ্ঞাসা করেন ব্যাপারটা আপনারই তৈরি বা এক ‘আয়না ছবি’ নয়ত?

কাজেই এখন দেখেন আপনি আসলে ঠিক কী হতে চান? এবার জেনেশুনেই ঠিক তাই হতে চান, না উলটা তওবা পড়বেন! মাফ চেয়ে নিয়ে নতুন কিছু করার শপথ নিবেন? সিদ্ধান্ত আপনার!

আমেরিকা আবার উঠে আসার চেষ্টা করছে আমরা টের পাচ্ছি। হিউম্যান রাইটের উপর শক্তভাবে হয়ত দাঁড়াতে ইচ্ছা করবে, পারব কতটুকু সেটাই প্রশ্ন ! বাংলাদেশে আমেরিকা তার প্রভাব ফিরুক, এটা সে চাইবে সম্ভবত, অনুমান করি। কিন্তু সেটা কী ফিরবে?  কিন্তু এর আগে আমেরিকা কি নিজেদের সংশোধন করে হাজির করতে সক্ষম হবেন? আমরা অপেক্ষা করব দেখার জন্য! তবে তারা কিছু মাত্রায় সংশোধন হয়েছেন কিনা এর একটা চিহ্ন হবে মনে হয় যে তারা তাদের এক্সপার্ট ও এনজিও ব্যক্তিত্ব বদলে নিইয়েছেন কিনা! যারা বাংলাদেশের মানুষের চাওয়া ও স্বার্থটাই বুঝেন না তারা আপনাদের পরামর্শক হবেন কী করে?

তবে ইকনোমিস্ট ঐ লেখায় সব শেষে তাদেরই এক রিডিং জানিয়েছে। বলেছে, “চীনের কাছে খুব বেশি দায়বদ্ধ হয়ে যাওয়া নয়, আবার ভারতের প্রতি অবজ্ঞাপূর্ণ আচরণ না করা নিয়ে সতর্ক বাংলাদেশ” [It is wary of becoming too indebted to China, and is careful not to snub India. ]।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

 

[এই লেখাটা  গত  ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ওয়েবে ও  পরদিনই প্রিন্টেও  “সংশোধিত আমেরিকা দেখব কি? ” – এই শিরোনামে উপ-সম্পাদকীয়তে ছাপা হয়েছিল।  পরবর্তিতে ঐ লেখাটাকে এখানে আরও নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে ও নতুন শিরোনামে এখানে আজ ছাপা হল। ]

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s