আমেরিকা কী জেনেই ভারতের স্বার্থের জালে আটকাচ্ছে!


আমেরিকা কী জেনেই ভারতের স্বার্থের জালে আটকাচ্ছে!

গৌতম দাস

১৯ অক্টোবর ২০২০, ০০:০৬

https://wp.me/p1sCvy-3dR

Biegun-Momen joint Press meeting

আমেরিকান ডেপুটি সেক্রেটারি অব স্টেট বা উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন বিগানের দু’দিনের বাংলাদেশ সফর শেষ হয়েছে। এ নিয়ে প্রথম যে মন্তব্য করার আছে সেটা হল, এতে তাৎক্ষণিক কোনো ফল আসেনি বা আসছে না তা বুঝা গেছে। কিন্তু এর মানে কী আগামীতে আসবে? না। সেটাও একেবারেই অনিশ্চিত এবং সম্ভবত, না। বরং এশিয়ায় আমেরিকা এক চির-অথর্ব শক্তি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা।

যদিও আপাতত, আমেরিকার দিক থেকে বললে তারা যে ফলাফলের আশায় আর যে বুঝাবুঝিতে বাংলাদেশকে রাজি করানোর পরিকল্পনা নিয়ে এসেছিল তা তাৎক্ষণিক ফল দেয়নি, মানে কাজ করছে না, এটা তারা বুঝেছে। এ যাত্রায় তাতে দেরি হবে, সময় লাগবে এমনকি কখনো না-ও হতে পারে। এখন আমেরিকা যদি একটা ইতিবাচক ফল চায় তবে এই রাস্তায় হবে না। ভিন্ন রাস্তা ও কৌশল ধরতেই হবে। তাহলে কী হবে এখন?

ইন্দো-প্যাসিফিক নিয়ে আলাপ হয়েছে নাকি-আলাপ হয়নিঃ
‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ জিনিসটা কী? স্ট্রাটেজি নাকি নেশনস বা ভিশন অথবা জোট বা সমিতি? আজও তা আমেরিকাও জানে না। তবু ভারতের মিডিয়াকে অনুসরণ করে এবার ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজি (বা সংক্ষেপে আইপিএস [Indo-Pacefic Strategy, IPS]) বলতে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের কিছু প্রো-ইন্ডিয়ান মিডিয়াকে। যেখানে খোদ আমেরিকাই এখনো একেক সময় একেকটা শব্দ ব্যবহার করে অস্থিরতা প্রকাশ করে যাচ্ছে। আমেরিকান কূটনীতিকরা আর গ্লোবাল নেতা থাকছেনা বলে আমেরিকার ওজনের ভারে কিছু কাটতে পারছেন না। তারা বললেই হয়ে যাচ্ছে না। বহু কাঠখড় পুড়িয়েও সময়ে তা থেকে কিছুই মিলছে না। সবকিছু দ্রুতই যেন দিন ফুরিয়ে আসছে, এমন দশা। এ দিকে বিগানের বাংলাদেশে আসার পর দেখা যাচ্ছে ইন্দো-প্যাসিফিক “বিজনেস ফোরাম” বলে আরেক নতুন শব্দ তিনি ব্যবহার করেছেন। শব্দটা আগে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। মানে রাষ্ট্র যারা ইন্দো-প্যাসিফিকে যুক্ত হবেন তাদের একটা ইকোনমিক বা বিজনেস জোটও থাকবে, তাই মনে হচ্ছে। আবার প্রধানমন্ত্রী হাসিনার দিক থেকে দেখলে এটা যেন বিগানকে দেয়া তার এক সান্ত্বনা পুরস্কার যে, ‘বিজনেস ফোরাম নিয়ে খুশি থাকো’! এদিকে আবার ‘কোয়াড’ বলে চার-রাষ্ট্রীয় (QUAD) এক জোট  তো আছেই। সেই সাথে আবার এদের সবাইকেই কি ‘এশিয়ান ন্যাটো’ বলে আরেক নামে নামাবে এরও কানাঘুষা উঠছে। তার মানে ইন্দো-প্যাসিফিক বলতে সামরিক-নিরাপত্তা জোট নাকি বিজনেস জোট মুখ্য হবে এ নিয়ে টানাটানির এখনো শেষ হয়নি।

অভ্যন্তরীণভাবে ইন্দো-প্যাসিফিকে এসব অমীমাংসিত বিষয় থাকা অবস্থায়, বাংলাদেশে আমরা দেখছি এবার প্রথম বাধা উদয় হল যে, ইন্দো-প্যাসিফিক নিয়ে বাংলাদেশের সাথে আলাপ হয়েছে, না হয়নি – এ নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের সরকারি অবস্থান হল, ধারাবাহিকভাবে তারা বলছেন- ইন্দো-প্যাসিফিক নিয়ে আলাপ হয়নি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন ও ডেপুটি-মন্ত্রী শাহরিয়ার আলম দু’জনই আলাদা করে ক্যাটাগরিক্যালি বলেছেন “আইপিএসের প্রসঙ্গটা আলোচনায় আসেনি”। অথচ ‘প্রথম আলো’ নিশ্চিত করে লিখেছে তাদের প্রশ্নের উত্তরে বিগান বলেছেন, “আজ (বৃহস্পতিবার) আমি বাংলাদেশ সরকারের সাথে আইপিএস নিয়ে আলোচনা করেছি। ব্যাপকতর অর্থে আইপিএসে যেসব সুযোগ রয়েছে তা নিয়ে কথা বলেছি। অবাধ ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য, যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকার এগিয়ে নিতে আমরা একে অন্যকে কিভাবে যাতে সহায়তা করতে পারি তা নিয়ে আমাদের কথা হয়েছে। এটা বাংলাদেশের জন্য তো বটেই, এর প্রতিবেশী দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অনেক সুফল বয়ে আনবে”।

এখন ভাষ্যগুলোকে আমরা কী এভাবে নিতে পারি? বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসিফিক ইস্যুতে কথা বলতে চায় না এই অবস্থানটা বুঝিয়ে দিতে গিয়ে যতটুকু যা কথা বলতে হয়েছে, এটা তাই। এ ছাড়া সরকারের অবস্থানটাও  বিগানের ঢাকায় পা-রাখার আগে থেকেই অনেক শক্ত ছিল। অন্তত যতটুকু আর যে শক্ত ভাষায় তারা মিডিয়ায় কথা বলছেন। যেমন, দেশের ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস পত্রিকায় উঠেছে, বিগানের ঢাকায় পা-রাখার আগের দিন মন্ত্রী মোমেনকে এক সাংবাদিক যতবার আমেরিকান প্রস্তাব নিয়ে প্রশ্ন করেছেন তাতে অন্তত বেশ কয়েকবার তিনি বলেছেন ‘উই আর নট ইন্টারেস্টেড’। এর মধ্যে সবচেয়ে কোটেড দু’বাক্য হল এ রকম। মোমেন বলছেন,

“We have no objection to the Indo Pacific Strategy. But they should come forward to the infrastructure development if they want to make the Indo Pacific Strategy more effective”.

“ইন্দো-প্যাসিফিক নিয়ে আমাদের আপত্তির তো কিছু নেই। যদি তারা ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজিকে কার্যকর দেখতে চান, তবে তাদের অবকাঠামোগত উন্নয়নের উপায়গুলো নিয়ে সামনে আসতে হবে। তাদের অর্থব্যয় করতে পারতে হবে; শুধু কথায় কাজ হবে না”। এরপরে ঐ সাংবাদিক নিজে যোগ করেছেন, ‘মন্ত্রী আসলে বাংলাদেশে অবকাঠামোগত উন্নয়ন খাতে আমেরিকার কোনো বিনিয়োগ বা অবদান নেই এ কথার দিকে ইঙ্গিত করছেন”।
এর আগেরদিনও আমেরিকার কেবল অস্ত্র-বিক্রির দিকে আগ্রহকে খোঁচা দিয়ে মোমেন বলেছিলেন, “তারা আমাদের অস্ত্র-বিক্রি (অ্যাপাচি হেলিকপ্টার ইত্যাদি) করতে চায়। কিন্তু আমরা কোনো সঙ্ঘাতের ব্যাপারে জড়িত হতে আগ্রহী নই। তারা চাইলে অবকাঠামো গড়ার ক্ষেত্রে আমেরিকার বিনিয়োগ নিয়ে আসতে পারে”।

“They want to sell arms, but we are not interested in issues related to conflict,”

আমেরিকান ইন্দো-প্যাসিফিক নৌকায় ওঠার প্রস্তাব উপড়ে ফেলে দেয়ার দিক থেকে দেখলে এটা হাসিনা সরকারের ভাল কৌশল যে, এমনভাবে শান্তিবাদী এবং উন্নয়নবাদী সেজে জবাবটা দিয়েছে। আর উল্টা আমেরিকাকে খোঁটা দেয়া যে, – “এখন অবকাঠামো খাতে আর তোমার বিনিয়োগ সক্ষমতা নেই, তুমি অযোগ্য আর এটা তোমার দুর্বল জায়গা”। সাথে যেন বুঝিয়ে দেয়া বাংলাদেশের চীনের প্রতি আগ্রহ বা চীনকে আমার দরকার তোমার চেয়ে বেশি। অতএব “উই আর নট ইন্টারেস্টেড”। কিন্তু বাংলাদেশের এই অবস্থান কত দূর টিকবে? সেটা বলা মুশকিল হলেও এটা আপাতত আমেরিকান স্ট্রাটেজিস্টদের বিরাট বিপদে ফেলে দিয়েছে, সন্দেহ নেই।

বাংলাদেশের অনেকে এখানে একটা ভুল তথ্যের ওপর দাঁড়িয়ে তর্ক করেন যে, “আমেরিকার বাংলাদেশে বিনিয়োগ নাকি এখন সর্বোচ্চ”। অনেকে আরো অ্যাগ্রেসিভ হয়ে ঢাকার আমেরিকান দূতাবাসের ওয়েবসাইটের রেফারেন্স দেন। তাদের বিনয়ের সাথে বলব, বিনিয়োগ বলতে অবকাঠামো বিনিয়োগ বলে যা বুঝায় সেটা সাধারণত কেবল সরকারি ভাবেই হয়। আরেক ধরণের বিনিয়োগ হয় সেটা বেসরকারি। অর্থাৎ ডাইরেক্ট মানে ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট (এফডিআই) [FDI, Foreign Direct Investment]। যেটা সরকারের নয়; আমেরিকান প্রাইভেট কোম্পানির। আমেরিকান সরকার সেটার মালিকও নয়; ফলে এসব কোম্পানি উঠে চলে যেতে বা জেঁকে বসতে চাইলেও তা তাদের মালিক-শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থই মুখ্য করেই সব সিদ্ধান্ত নিবে যেটা ওর শেষ কথা। সেক্ষেত্রে আমেরিকান সরকারের বলার সুযোগ এখানে তাই প্রায় নাই। অতএব, ‘আমেরিকান সরকারি বিনিয়োগ’ বলতে কেবল অবকাঠামোকেই বুঝতে হবে। কিন্তু দূতাবাসের সাইটে ব্যাপারটাকে Bilateral Economic Relations ‘বাংলাদেশে আমেরিকান বিনিয়োগ’  বলে শিরোনামে রাখা হয়েছে। অথচ ভিতরে কেবল এফডিআই এর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সব বিভ্রান্তি সম্ভবত এখান থেকে। যেখানে আবার ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে ঐ বিনিয়োগে সাঙ্গু গ্যাসের জন্য বিনিয়োগটাই ওর বড় অংশ। এটা আসলে শেভরন কোম্পানির বিনিয়োগ। তাই মোট পরিমাণ হিসাবে সেটা ৩.৪ বিলিয়নের। তবু সেখানেও একটা অঙ্কের ফাঁকি আছে। ঐ ফিগারটা বলা হয়েছে ২০১৮ সালের। এ কথার মানে হল তারা ২০২০ সালের পর্যন্ত আপডেটেড তথ্য দিচ্ছে না।, সম্ভবত এর পরের দু’বছরে ফিগারটা কমে গেছে। অর্থাৎ ২০১৮ সালে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ কথাটা মিথ্যাও নয় আবার এটাই সব সত্যি তাও নয়। তবে মন্ত্রী মোমেনের পরিস্কার দাবি – অবকাঠামোতে আমেরিকান বিনিয়োগ নেই। আর একথাটাও ভুল বলে কেউ দাবি করেছেন, দেখা যায়নি।

তাহলে কি এখন আমেরিকা ইন্দো-প্যাসিফিকে বাংলাদেশকে তুলতে না পেরে হতাশ মুখে বসে থাকবে?
না, ঠিক তা নয়। তবে ইতোমধ্যে বিগান ও তার দল তাদের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াটা দেখিয়ে ফেলেছেন মনে করা যেতে পারে। যেমন প্রথম আলোর বিস্তারিত কথোপকথনের রিপোর্টে (১৬ অক্টোবর) দেখা যাবে, যতগুলো ইস্যু বিগান তুলেছেন তাতে তিনি বুঝাতে চেয়েছেন আমেরিকা তা সমাধানে আগ্রহ দেখাবে যদি তাদের ইন্দো-প্যাসিফিক জোটে বাংলাদেশ আগে উঠে, তাহলে। তবেই আমেরিকা প্রধান উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসবে।
যেমন, স্টিফেন বিগানের এই সফরের পাশাপাশি আরেক প্রচেষ্টা চলছে ইউরোপে রোহিঙ্গা ইস্যুতে। তাতে বাংলাদেশ অনাগ্রহ দেখিয়েছে ইতোমধ্যেই। ক্রিটিক্যাল বিচারে ব্যাপারটায় বাংলাদেশের অনাগ্রহ দেখানো খুবই সঠিক। কারণ, ব্যাপারটা হল  এরা ইউরোপিয়ানদের সাথে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান এভাবে জোট বেধে আগামি ২২ অক্টোবর রোহিঙ্গাদের সাহায্যের জন্য একটা ফান্ড তৈরির চেষ্টায় বসতে যাচ্ছে। এমন বিষয়ে এক রিপোর্টের শিরোনাম – “রোহিঙ্গাদের ১০ বছর মেয়াদি মানবিক সহায়তা প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্রের, আগ্রহী নয় বাংলাদেশ”।  এখান থেকেই আসলে পুরা ব্যাপারটায় ভারতের পক্ষে যাতে সুবিধা হয় এমন আমেরিকান পরিকল্পনা থাকা অসম্ভব নয় মনে হচ্ছে। যেমন এনিয়ে বণিকবার্তায় মোমেনের বক্তব্য বা মিডিয়ায় প্রশ্ন রেখেছেন,  এতে মূল হচ্ছি আমরা, রোহিঙ্গা সংকটের শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ। প্রথমে তো আমাদের জিজ্ঞাসা করতে হবে, তারপর এগুলো হবে। যুক্তরাষ্ট্র শুধু মুখে বলে দিয়েছে বৈঠকের বিষয়ে। কী নিয়ে আলাপ করা হবে এ নিয়ে আমাদের পূর্ণাঙ্গ তথ্য দিতে হবে। সেটি জানার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অনুরোধ করা হয়েছে। এটিতে আমরা সবার প্রথমে অংশগ্রহণ করতে চাই। তবে পুরো বিষয়টি বুঝে তারপর”।

চারটি গ্রুপ এ বৈঠকটি মূল হচ্ছি আমরা, রোহিঙ্গা সংকটের শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ। প্রথমে তো আমাদের জিজ্ঞাসা করতে হবে, তারপর এগুলো হবে। যুক্তরাষ্ট্র শুধু মুখে বলে দিয়েছে বৈঠকের বিষয়ে। কী নিয়ে আলাপ করা হবে এ নিয়ে আমাদের পূর্ণাঙ্গ তথ্য দিতে হবে। সেটি জানার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অনুরোধ করা হয়েছে। এটিতে আমরা সবার প্রথমে অংশগ্রহণ করতে চাই। তবে পুরো বিষয়টি বুঝে তারপর। – পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন

অর্থাৎ সোজা মানে হল, রোহিঙ্গা[Rohingya] ইস্যুতে আমরা আশ্রয়দাতা অথচ কোথাকার চার গ্রুপের মিটিং আর আমরা তা জানি না কেন? দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গাদের পালার জন্য অর্থ সাহায্যের চেয়েও বড় প্রয়োজন মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি যাতে তারা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করতে বাধ্য হয়। কিন্তু সেদিকে কোনো উদ্যোগ নেই কেন? আর তৃতীয়ত, তিন বছর হয়ে গেল; এখন কেবল ফান্ডের উদ্যোগ। তাহলে প্রত্যাবাসন নিয়ে আগ্রহ হবে কবে, সে খবর নেই কেন? এই কঠোর সমালোচনা বিগান প্রকারান্তরে মেনে নিয়ে বলছেন- কেবল “এ দেশের জনগণকে যাতে তার বোঝা টানতে না হয়” তাই ফান্ডের অর্থ তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটাতে দরকার আছে। এছাড়া বিগানের দাবি, “এ সমস্যার শুরু থেকেই মিয়ানমারের ওপর যতটা সম্ভব রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র সোচ্চার রয়েছে। বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকারের বিষয়ে। তবে এতে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সমর্থন প্রয়োজন। সব দেশকেই এ সমস্যা সমাধানে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে”।
দেখা যাচ্ছে “আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সমর্থন প্রয়োজন”  বা ‘কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে’- সবই তিনি বলছেন কিন্তু উদ্যোগ কে নিবে – ঘন্টাটা বাধবে কে – সেটাই বলছেন না। বরং এক “অনন্তকালের দিকে” তা ঠেলে দিয়েছেন, এটাই সম্ভবত ষড়যন্ত্রপুর্ণ দিক হয়ে উঠার সম্ভাবনা। এছাড়াও, বিগান যে ভাষায় বলছেন, “শুরু থেকেই মিয়ানমারের ওপর যতটা সম্ভব রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের বিষয়ে” যুক্তরাষ্ট্র করেছে বলে যা বলছেন এটা পুরাপুরি ভুয়া। বরং ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের সীমান্তে ধেয়ে আসার এর প্রথম বছরটা ছিল – আমেরিকা, ভারত ও চীন এই তিন শক্তিরই বার্মিজ জেনারেলদের কে কত তোয়াজ করতে পারে এরই যেন প্রতিযোগিতার বছর। কারণ মূল প্রতিযোগিতাটা আসলে ছিল মায়ানমার থেকে কে কত ব্যবসা বাগাতে পারে সেদেশে, এরই প্রতিযোগিতা।  বার্মীজ জেনারেলরাও এই ব্যবসা বিতরণের টোপ দিয়ে ঐতিনটা দেশকেও নাচিয়ে চলেছিল। ব্যবসা পাবার লোভে আমেরিকা, ভারত ও চীন কারোরই আন্তর্জাতিক দায়দায়ীত্ব বা মানবাধিকার প্রসঙ্গে কোন খেয়াল ছিল না। আর এটার সুযোগ নিয়েই  বার্মীজ জেনারেলেরা রোহিঙ্গাদের ইচ্ছামত হত্যা ও রেপ ও নির্মমতার আয়োজন  করে বাংলাদেশে তাদের ঠেলে দিয়েছিল। শুধু তাই নয়, এভাবে ঠেলে দেওয়ার সাফাই হিসেবে বার্মিজ পুলিশ-আর্মির ওপর কথিত “আরসা (ARSA) বাহিনীর” মিথ্যা আক্রমণের গল্প হাজির করেছিল। অথচ আরসা হল বার্মীজ সেনাবাহিনীরই তৈরি এই বাহিনী – যা একই পুতুল শিয়ালের ছানার মত বার্মীজ সেনাবাহিনী সব জায়গায় হাজির করে বিপদে পড়লেই; বিচ্ছিন্নতাবাদী ফোর্স হিসাবে দেখায়। যেমন সেসময় দাবি করেছিল কথিত আরসা আক্রমনের প্রতিক্রিয়ায় নাকি বার্মীজ সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের মেরে রেপ করে সীমান্তে পাঠিয়েছিল। আর এসবের সবচেয়ে ত্যাদরামো ব্যাপার হল, এ নিয়ে এই তিন শক্তি কে কত ভালোভাবে বার্মীজ সেনাবাহিনীর ঐ সাফাই এর পক্ষে দাড়াতে ও সমর্থন যোগাতে পারে, গল্প  গাইতে পারে এরই প্রতিযোগিতা চলেছিল। সে কারণেই রোহিঙ্গাদের আগমনের ঢল সে সময়ে সহসা বন্ধ করা যায়নি। অতএব প্রথম বছরজুড়ে সেসব দিন ছিল ভয়াবহ, এখন সেসব সত্যতা পাল্টাতে চাইলেই কেউ পারবে না। বরং বিপদ ও শঙ্কার কথা হল, ঐ তিন শক্তির বার্মীজ সেনাবাহিনী তোয়াজের প্রতিযোগিতা আবার না শুরু হইয়ে যায়। যদিও এখন একমাত্র চীনই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়া  নিয়ে সোচ্চার। আর ভারত, আমেরিকার কোনই খবর নাই। এখনও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এদুইয়ের কাছে কোন ইস্যুই নয়।
আসলে বার্মীজ সেনাবাহিনীর সাথে এই তিন শক্তির খাতিরদারি সবকালে একই রকম থাকে নাই। যেমন এখন মুখ্যত ভারত সবচেয়ে কাছে বার্মীজ সেনাবাহিনীর নৌকায়। আর এই ভারতই হল সেই ২০০৭ সাল থেকেই আমেরিকাসহ সারা ইউরোপ এমন সকলকে  বার্মীজ জেনারেলদের সা্থে যোগাযোগের অগ্রদুত বা এডভান্স পার্টি – এই ভুমিকা পালন করে এসেছে। আর চীন এখন একেবারেই বাইরে ছিটকে পড়েছে, মনে হচ্ছে। আর আমেরিকার অপ্রত্যক্ষ যোগাযোগে, যার প্রত্যক্ষ যোগাযোগটা মেইনটেন করে দিচ্ছে ভারত এবং অবশ্যই তা ভারতের বিরাট এক স্বার্থে। সে প্রসঙ্গে একটু পরে আসব।

তাই এখনকার মত স্টিফেন বিগানের সফর শেষ হল এই বলে এবং এই মুলা ঝুলিয়ে যে, তাদের নৌকায় উঠলে তবেই তারা রোহিঙ্গা ইস্যুসহ বহু কিছুরই সমাধানে এগিয়ে আসতে পারে।

তাই এখনকার মত স্টিফেন বিগানের সফর শেষ হল এই বলে এবং এই মুলা ঝুলিয়ে যে, তাদের নৌকায় উঠলে তবেই তারা রোহিঙ্গা ইস্যুসহ বহু কিছুই সমাধানে এগিয়ে আসতে পারে। এর মানে কি তারা এখন একেবারেই চলে যাচ্ছে?
অবশ্যই না। তারা অবশ্যই আবার আসার কথা ভাববে। তবে সেটা খুব সম্ভবত আমেরিকার নির্বাচন সমাপ্তির আগে না; পরেই নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের হাত ধরে, হয়ত। যদি তা ঘটে তবে সেটা হবে বাংলাদেশের উপর আরো চাপ নিয়ে, আরো প্রলোভন নিয়ে এবং আমাদের সরকারকে যতভাবে বাধ্য করার সুযোগ তাদের হাতে আছে সব নিয়ে। এছাড়া আরো অনেক ‘কিন্তু’ আছে।

স্টিফান বিগানের এই সফরের মুল সাফাইঃ
মনে রাখতে হবে, ইন্দো-প্যাসিফিক জোট গড়তে চাওয়া এটা আসলে ইতোমধ্যেই একটা ফেইল্ড প্রজেক্ট ছিল; ২০১৬ সালেই ওবামার হাতে ‘এশিয়া পিভোট’ নামের এই প্রকল্পটা ব্যর্থ হয়ে যায়। ইন্দো-প্যাসেফিক সমুদ্র-অঞ্চলের পাশের একটা দেশও সেকালে ওবামা নিজ নৌকায় তুলতে পারে নাই। তারপরেও স্টিফেন বিগান কিন্তু এখন প্রথম আলোকে যে নতুন গল্পটা দিয়েছে তা এরকমঃ স্টিফেন বিগান বলেন, “দুঃখজনক হলেও সত্যি, এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরে আমাদের নিরাপত্তার অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। আর এটা আমি অস্বীকারও করতে চাই না। আমাদের নিরাপত্তাজনিত কিছু উদ্বেগ রয়েছে। এ বিষয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের অনেক দেশেরও উদ্বেগ রয়েছে। বিশেষ কারো কথা উল্লেখ করব না। যেমন হিমালয়ে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গালওয়ান উপত্যকায় চ্যালেঞ্জ আছে। সেনকাকু দ্বীপ নিয়ে জাপান সাগরে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। তাইওয়ানে উত্তেজনা রয়েছে। হংকংয়ে ক্রমবর্ধমান দমন পীড়ন চলছে। তিব্বতের শিনজয়ানে উত্তেজনা বিরাজ করছে। অস্ট্রেলিয়ার জনগণের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা বাড়ছে। এসব উত্তেজনা আর চ্যালেঞ্জ যুক্তরাষ্ট্রসহ এ অঞ্চলের অনেক দেশকে সতর্ক করে তুলেছে”।
এখানে প্রথম বাক্যে ‘আমাদের’ লেখা, এই আমাদের বলতে কারা? কারণ, ওবামার সেই কালেও এশিয়া-প্যাসিফিকের (এশিয়া-পিভোট নাম ছিল তখন ) কোনো দেশই আমেরিকার নৌকায় উঠেনি। এমনকি এই ভারতও না। যদিও তাতে অনেক দেশই আছে যারা সেসময় হয়ত জেনুইনভাবেই চীনের ওপর অসন্তুষ্ট, ক্ষুব্ধও এবং অনেক কিছুই ছিল। কিন্তু তাই বলে আমেরিকার যুদ্ধ-নিরাপত্তা ফেরি করার জোটে তারা কেউ উঠেইনি। তাহলে এটা এখনও আমেরিকার “আমাদের” নিরাপত্তা’ চ্যালেঞ্জ হল কেমনে? আমাদের মানে, তাহলে এই চ্যালেঞ্জ তো আসলে আমেরিকাকে একাই! অর্থাৎ আমেরিকার গ্লোবাল নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জড হয়ে গেছে আর তা হয়েছে চীনের হাতে। এবং বড় কথা তা ন্যাচারাল!  আর মানতে হবে কেউই দুনিয়ায় স্থায়ী নেতা নয়। তাই, এমন ধরে নেয়ার কোনই ভিত্তি নাই। কাজেই “আমাদের” বলে এই মিথ্যাটা বলার দরকার কী? আর এতে কী আমেরিকার দুঃখ ঘুচবে? এছাড়া একালেও তো কোয়াডের তিন দেশ ছাড়া আর কেউ এখনও আমেরিকার সাথে জোট করেনি? আবার এই তিন রাষ্ট্রও আবার আধামন দিয়ে ও দ্বিধাগ্রস্থ অবস্থায়। অতএব আগের এশিয়া পিভোটের মত এবারো ইন্দো-প্যাসেফিক উদ্যোগও যে ফেল করবে না, তেমন নতুন কিছু তো ঘটেনি। আমেরিকা তা দাবিও করতে পারছে না।  আর ভারত? সেও আধামনে ও দ্বিধায় যতটুকু ভিড়েছে আর যা করছে এর কারণ ভিন্ন। ভারত তা কেবল নিজদেশের লোক আর মিডিয়ার মনোবল যেন চাঙ্গা থাকে সে জন্য করেছে – যেন বলতে চাইছে “ভয় নাই, বড় মুরুব্বি দেশ ভারতের পাশে আছে”। কিন্তু আসলে আছে কী?

ভারতের আধা-মনে, দ্বিধায় দিন গুজরানঃ
ভারতের আধা-মনে মানে হাফ-হার্টেড হয়ে দ্বিধায় দিন কাটছে। চলতি অক্টোবর মাসের ছয় তারিখে জাপানে যে কোয়াড (QUAD) পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক হয়ে গেল এটা তো আসলে ভারতেই হওয়ার কথা ছিল। [“But he (Biegun) added that the Quad grouping is expected to meet in New Delhi this autumn..…. ] কিন্তু ভারত আগেভাগেই গত মাসে মাফ চেয়ে হোস্ট হতে অপারগতা জানায়। কারণ ভারতের আসল অবস্থান হল – একপা আগে দুইপা পিছে, এমন টলমলে। কেন?

মোদী গত ২০১৮ সালে ১ জুন সিঙ্গাপুরে আটল্যান্টিক জোট ‘সাংগ্রিলা” এর বার্ষিক সম্মেলনে প্রধানবক্তার বক্তব্যে হিন্দু বেদের বরাত দিয়ে; ভারত ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলে কারো বিরোধী হয়ে কোন জোট গড়ার বিরুদ্ধে- বক্তব্য দিয়েছিলেন। বলেছিলেন ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলে ভারতের নিজের সংশ্লিষ্টতা এমন হতে হবে যে ভারত কারো বিরুদ্ধে না [মানে এখন যেভাবে আমেরিকা বলছে চীনের বিরুদ্ধে জোট তা নয়] বরং ইনক্লুসিভ বা সবাইকে নিয়ে হতে হবে। এবার ধর্মগ্রন্থ বেদের বরাত দিয়েছিলেন – एकम सत्यम, विप्राः बहुदावदंति বাংলায়, সত্য একটাই, জ্ঞানীরা তা বিভিন্ন উপায়ে প্রকাশ করে থাকে। তাই ভারত বহুত্ববাদে, একসাথে পাশাপাশি বসবাসে, খোলামনে আর ডায়লগে বিশ্বাস করে। যারা এর রেফারেন্স চান তারা ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের ওয়েব সাইটের এই রেফারেন্স লিঙ্কে পুরা বক্তৃতাটা দেখতে পারেন।

In conclusion, let me say this again: India’s own engagement in the Indo-Pacific Region – from the shores of Africa to that of the Americas – will be inclusive. We are in-heritors of Vedanta philosophy that believes in essential oneness of all, and celebrates unity in diversity एकम सत्यम, विप्राः बहुदावदंति (Truth is one, the learned speak of it in many ways). That is the foundation of our civilizational ethos – of pluralism, co-existence, open-ness and dialogue. The ideals of democracy that define us as a nation also shape the way we engage the world.

এছারা এই আলোকেই একবার এই গত জুলাই ২০২০ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর প্রকাশ্যেই বলে ফেলেন যে, ভারত কোন সামরিক বা নিরাপত্তা জোটে যাবে না [India will never be a part of an alliance system, says External Affairs Minister Jaishankar]। কারণ ভারত জোট-নিরপক্ষে সেই সোভিয়েত কোল্ড ওয়ারের আমল থেকে। এই নীতিতেই ভারত এখনো থাকবে। তার মানে হল, যতটুকু অন্য দেশে গিয়ে কোয়াডের মিটিং-এ ভারত যোগ দিয়েছে সেটা লোক দেখানোর জন্য। আর খুব সম্ভবত তা প্রধানত বর্তমান চীনের চাপে মারখাওয়ার মুখে নিজ পাবলিক ও মিডিয়ার মনোবল ঠিক রাখতে। তাই এবার একবার যদি ভারত কোয়াডের হোস্ট হয়ে যেত তবে সেখান থেকে যে ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়া ফোকাস ভারতের জন্য তৈরি হয়ে যেত তাতে ভারত আর কোয়াডের সিরিয়াস ও সক্রিয় কেউ নয় বা সে তখনও জোট-নিরপেক্ষ  – এসবকথা এরপর দাবি করা খুবই কঠিন হয়ে যেত। সেটা হলে হয়ত পাবলিকলি অনেক কিছুই ভারতকে মুখে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফেলতে হত যা করতে ভারত একেবারেই প্রস্তুত নয়। এই বিড়ম্বনা ও সম্ভাব্য ‘বেইজ্জতি’ থেকে বাঁচতে বা এড়াতে সে কোয়াড মিটিংয়ের আয়োজক না হয়ে এড়িয়ে যায়।

নতুন আরো বিশাল বড় কারণঃ
যদিও এর পেছনে আরো বড় কারণ আছে। আসলে এখন ক্রমশ পরিস্কার হয়ে যাচ্ছে শুধু কোয়াডের চার দেশ – ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়া – আর এদেরকে নিয়ে আমেরিকা, এদের নিয়েও কোনো ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজিক জোট গড়া একেবারেই সম্ভবই নয়। কেন? এত বড় কথা কেন?
মূল কারণ মিয়ানমার ইস্যু। অথবা বলা যায় ভারতের আসল ইচ্ছা বা ঘটনায় মোঁচড়।
মূল প্রশ্নটা হলঃ মিয়ানমার ইস্যুতে আমেরিকা্র রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে বাধ্য করাসহ মিয়ানমার জেনারেলদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর যেকোনো ভূমিকা – এটা নেয়া কি আদৌ সম্ভব? উত্তরটা কন্ডিশনাল বা শর্ত সাপেক্ষ। মানে আমেরিকাকে যদি তা সম্ভব করতে তুলতে চায় তাহলে কোয়াড অথবা ইন্দো-প্যাসিফিক কোনো জোট খাড়া করার চিন্তা আমেরিকাকে এখন থেকে একেবারেই বাদ দিতেই হবে। কারণ কী?

কারণ, নিশ্চয় আমেরিকা জানে যে মিয়ানমারকে সাবমেরিন দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ভারত। আর এতে ভারত মুখে সাফাই দিয়েছে, চীনের ভয়ে তাকে নাকি এটা করতে হয়েছে। অর্থাৎ ভারত-মিয়ানমার এখন এক ঘোষিত সামরিক-অ্যালাই বা পক্ষজোট হয়ে গেছে। তাহলে আমেরিকার এই ভারতকে নিয়েই কোয়াড অথবা ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজিক জোট গড়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো কী করে সম্ভব?
এর সোজা মানে হল, যত দিন মিয়ানমার-ভারতের সম্পর্ক ভারতের কাছে সবার উপরে বা আগে অগ্রাধিকার-সম্পর্ক হয়ে আছে বা থাকবে তত দিন আমেরিকা ভারতকে নিয়ে  ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলে কোন ব্যাপারে কিছুই করতে পারবে না। এশিয়ায় কাউকেই কোনো সাহায্যে হাজির হতে বা কিছু করতে পারবে না যা ভারতের স্বার্থবিরোধী। এর মানে আমেরিকার আসলে হাত-পা বাঁধা পড়তে যাচ্ছে। এক অথর্ব শক্তি হচ্ছে। এসব আমাদের আগেই বুঝতে পারা কি খুব কঠিন? বার্মীজ জেনারেলেরা বহু চিন্তা করে  ঠিক এটাই করতে চেয়ে আমেরিকা-চীন-ভারতের মধ্যে ভারতকেই বেছে আলাদা করে কাছে টেনে আপন করে নিয়েছে। আর তা থেকেই এতকিছু ঘটা শুরু হয়েছে।
এখন এসবের সোজা মানে স্টিফেন বিগানের এই সফর এখন তাহলে দাড়াচ্ছে যে এটা পুরাটাই লোক দেখানো বলে হাজির হতে পারে। যদিও এমনিতেই আগামী ৩ নভেম্বর আমেরিকার নির্বাচনের পরে পরিষ্কার হয়ে যাবে কোয়াড অথবা ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজিক জোট এরা আসলে সিরিয়াস না নির্বাচনী দেখন-শোভা ছিল; নির্বাচনের পরেও কি এরা বেঁচে থাকবে, তৎপর থাকতে পারবে, কিভাবে?
এরপরে নতুন প্রেসিডেন্ট তিনি যদি চান – এইবার আমেরিকা যে অথর্ব নয় তা প্রমাণ করতে গেলে আমেরিকার জন্য সেক্ষেত্রে একমাত্র অপশন হল, ভারতের বিরুদ্ধে সামরিকসহ সবভাবে খাড়া হতে আমেরিকাকে রাজি থাকতে হবে – এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারা। অর্থাৎ বাংলাদেশের কাছে দেখাতে হবে যে আমেরিকা ভারতবিরোধী সামরিক কোন জোটনেতা বা শক্তি – এভাবেই একমাত্র হাজির হতে হবে। সেক্ষেত্রে তাহলে এর মানে হবে এশিয়ায় আমেরিকার ভারত বলে কেউ নাই, দাঁড়াবার জায়গাই নাই। এমন হয়ে যাবে যা চিন্তা করা আমেরিকার জন্যই খুব কঠিন। আর আমাদের জন্য আমেরিকা তেমন দুর্দশায় পড়েছে সেটি চোখে না দেখলে আমরা কেউ বিশ্বাস করব না।

আমেরিকার কুমিরের কান্না নাকি অথর্ব হয়ে যাওয়াঃ
অতএব রোহিঙ্গাদের জন্য আমেরিকান চোখের পানি কুমিরের কান্না হয়েই থাকার সম্ভাবনা প্রবল।  তাহলে  গত দুবছর ধরে স্টিফেন বিগানের ততপরতা ফল কী এবার উল্টা ফলতে যাচ্ছে? এশিয়াতে আমেরিকাই ভারতের স্বার্থের অধীনে কেবল ততপর থাকবে? আর এটাই কী এবার স্টিফেন বিগানের ভারত সফরের ফলাফল হবে!
তাই এখন এই অথর্ব আমেরিকা যে ভারতের কারণে উত্থান-রহিত হতে যাচ্ছে (আগামি ৩ নভেম্বর আমেরিকার নির্বাচনের পরেই পরিষ্কার হয়ে যাবে), এই আমেরিকাকে লইয়া কেবল হাসিনা নয়, পুরা বাংলাদেশই বা ‘কী করিবে’?  এই অথর্ব আমেরিকা আমাদের কোন কাজে আসবে? ভারত তার নিজের সঙ্কীর্ণ স্বার্থের ফাঁদে, অগ্রাধিকারের ফাঁদে খোদ আমেরিকাকেই আটকে ফেলতে যাচ্ছে, সম্ভবত!
তার মানে আমেরিকা কী জেনেই ভারতের স্বার্থের জালে আটকা পড়তে চাইছে! নাকি এটাই যৌথ উদ্যোগ?

সবশেষে একটা বাড়তি প্রসঙ্গ কথিত ভুরাজনীতিঃ
বিগানের সফর উপলক্ষ্যে বাংলাদেশের মিডিয়ার দুর্দশা দুর্গতি কী মাত্রায় তা সব উদাম হয়ে গেছে। এক কারো দালালি বা এজেন্ট হওয়া ছাড়া কোনকিছুই এদের করার দূরে থাক ইস্যুটা বুঝবারও সামর্থের সংকট প্রবল হয়ে ধরা দিয়েছে।  আর যখন কোন কিছু বুঝার ব্যর্থতা হাজির হয় তখন তা ঢাকতে এদের অনেকে একটা শব্দ ব্যবহার করে – ‘ভুরাজনীতি’। এ’এক কঠিন সমস্যা হয়ে হাজির হয়েছে। অথচ শব্দ না বুঝলে তা ব্যবহারের দরকার কী? এছাড়া ভুরাজনীতি শব্দটাই ভাল শব্দ নয়, আসলে তা  এমন আবছা। যেমন গ্লোবাল অর্থনীতি বা কোন গ্লোবাল অর্ডার নিয়ম বলে যে দুনিয়ায় কিছু আছে তা ভুরাজনীতি শব্দটা কাভারই করে না, তাই এই প্রসঙ্গটা কিছুই বুঝবার উপায় নাই। এই কথিত ভুরাজনীতি মানে কী, তা তাদের লেখা পড়েও কিছু বুঝার সুযোগ নাই। আরেক দল আছে যারা নিজের অসহায়ত্ব টের পেয়ে বুদ্ধিমান হতে চেয়ে ভারতের মিডিয়াকে কপি করে রিপোর্ট লিখেছে। অথচ এই ইস্যুতে বাংলাদেশের সরকারি অবস্থানই ভারতের বিরুদ্ধে সে খবর তাদের নাই। তারা খেয়ালই করে নাই। ওদিকে স্টার গ্রুপ বা প্রো-আমেরিকান মিডিয়া যারা, তারা ভাব ধরতে গেছে তারা সরাসরি আমেরিকান অবস্থান হাইলাইট করছে। কিন্তু হায়! তারাও বুঝে নাই যে এই ইস্যুতে স্টিফেন বিগানও মায়ানমারের বিরুদ্ধে কিছু বলতে চাইছেন না। যদিও তিনি ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছেন ‘আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক’ উদ্যোগ নিলে আমেরিকা আছে। মানে তিনি আসলে ইস্যুটাকে অনন্তকালের দিকে অমীমাংসিত ঠেলে দিয়েছেন। মানে কোন উদ্যোগ না নেওয়া, মানেই ত ভারতের অবস্থান। আবার বিগানের  “আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক” উদ্যোগ মানে কী? চীন উদ্যোগ নিলে তারা যাবে না সে তো বলাই বাহুল্য। ফলে এটাও এক কথার কথা।  সারকথায় রোহিঙ্গা বা মায়ানমার ইস্যুটাকে স্বাধীনভাবে বুঝবার তাগিদ বা সম্ভবত মুরোদ আছে মিডিয়ার তা বেশিরভাগ মিডিয়া রিপোর্ট পড়ে টের পাওয়া যায় না। আবার প্রথম আলোর বাংলা অনুবাদের এক উদাহরণ হল, চীনের বেল্ট-রোড উদ্যোগের বাংলা করেছে  – “অঞ্চল ও পথের উদ্যোগে (বিআরআই)”। ফলে এক কঠিন দশা। আর এসবের সার ফলাফল হল বাংলাদেশের পাবলিককে মুল ইস্যুটা কী তা বুঝাতেও মিডিয়ার ব্যর্থতা। এতে সবমিলিয়ে ক্ষতিটা হয়েছে বাংলাদেশের স্বার্থের। আর এটা বলার সময় হয়েছে যে সরকার সরকারের অনুগামি মিডিয়া (ফার্মের মুরগীর মত) তৈরি করে রাখলে এর কী পরিণতি হয় তাও আমরা দেখলাম!

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

 

 

[এই লেখাটা  গত  ১৭ অক্টোবর ২০২০, দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ওয়েবে ও  পরদিনই প্রিন্টেও  “ভারতের স্বার্থে আটকা পড়ছে আমেরিকা!” – এই শিরোনামে উপ-সম্পাদকীয়তে ছাপা হয়েছিল।  পরবর্তিতে ঐ লেখাটাকে এখানে আরও নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে ও নতুন শিরোনামে এখানে আজ ছাপা হল। ]

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s