নষ্টা-সেকুলারিজমের বীণা সিক্রি


নষ্টা-সেকুলারিজমের বীণা সিক্রি

গৌতম দাস

২৩ নভেম্বর ২০২০, ০০:০৭ সোমবার

https://wp.me/p1sCvy-3gD

ব্যাপারটা একটু পুরনো। কিন্তু বারবার ফিরে আসে এমন পুরনো রোগ। বীনা সিক্রি [Veena Sikri ] বাংলাদেশে ভারতের সাবেক এক রাষ্ট্রদূত। গত ২০০৩-০৬ সময়কালে তিনি রাষ্ট্রদূত ছিলেন। ভারতের প্রায় সকলের সব কিছুতে শো-আপ বা বাড়িয়ে বলা বা দেখানো – এটা এমনকি বেসরকারি পর্যায়ে তো বটেই সরকারি পর্যায়েও অভ্যাসের মত হয়ে গেছে। বাংলাদেশে ভারতের রাষ্ট্রদূতদের মধ্যে সম্ভবত শো-আপ করাদের শীর্ষ আছেন বীণা। আর বাংলাদেশে তিনি এটা করার আরো সুযোগ নিয়ে থাকেন কারণ তিনি সরকারি আমলা হিসেবে চাকরি শেষ করলেও এখন সাউথ এশিয়ান উইমেন্স নেটওয়ার্কের (South Asia Women’s Network, SWAN)) আহ্বায়ক বলে জানা যায়, এর সুযোগে।

সিক্রির সেকুলারিজম-বোধঃ
দেখা যায়, তিনি সবসময় আমাদের যেচে ‘হেদায়েত’ করতে ভালোবাসেন আর ইদানীং তা সবচেয়ে বেশি যা নিয়ে, সেই সাবজেক্ট হচ্ছে  সেকুলারিজম। আবার তাঁর সেকুলারিজম ভাবনাটা ‘বিশেষ’। সেটা যেন উল্টো মনে করিয়ে দিতে চায় যে আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কিন্তু মুসলমান। তাই যেন বলতে চান, এরা তো একটু খাটো (!), সেটা এখন এঁরা সেকুলার হলে  সমান পক্ষ হতেও পারে!। যদিও এই সাবজেক্ট নিয়ে তাঁর জানা-বুঝা ঠিক বা যথেষ্ট কি না তা নিয়ে সন্দেহ করার কারণ আছে। এ ছাড়াও অন্য যেসব প্রসঙ্গ তিনি সাধারণত আনেন ও কথা বলেন সেগুলো যেমন – ভারত নাকি পড়শিদের জন্য ‘বড়ভাই’, সে কথাটা আবার উনি নিজমুখেই বলছেন। এমনই ডেস্পারেট এবং যেন  মুল্যবোধের ঘাটতিতে থাকা ও অপ্রয়োজনীয় সংঘাত শো করা মানুষ তিনি। গত ২০১৫ সালে ভারতের এক ওয়েব মিডিয়ায় [livemint] তিনি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন যেটা ঢাকার দৈনিক ইত্তেফাকও পরদিন অনুবাদ করে ছেপেছিল। ওর বাংলা শিরোনাম ছিল- “ভারত এখন দক্ষিণ এশিয়ায় ‘এলডার ব্রাদার’ : বীনা সিক্রি”। আবার ২০১৬ সালের জুলাইয়ে ভারতের এশিয়ান এজ পত্রিকায় তিনি বলেন, “বাংলাদেশ মুসলমান ও বাঙালি পরিচয়ের মধ্যে আটকে গেছে” [Bangladesh is caught between Bengali and Muslim identities: Veena Sikri]। এ ছাড়াও শাহবাগ আন্দোলনের আমলে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে এক ভিডিও সাক্ষাৎকারে বলছেন, সেটা নাকি “৭১-এর প্রজন্মের জেগে উঠা ছিল” – ইত্যাদি ধরনের ভারতীয় ব্যাখ্যা যার সার কথা হতে দেখা যায় যেটাকে আমরা প্রচলিত ভাষায় বলি, ইসলাম ‘কোপানো’র সুযোগ নেয়া আর উচ্ছ্বাস দেখানো। তখন প্রশ্নকর্তা অবশ্য শাহবাগের মধ্যে যা দেখেছিলেন সেটা হল এক না- বুঝা অবুঝ চোখে এক “আরব স্প্রিং” বলে একে ভ্রম। অথচ আরব স্প্রিং (নামেও বোঝা যাচ্ছে) সেকালে ঘটেছিল সাধারণত মুসলমান প্রধান রাষ্ট্রে। আর আমেরিকান এই প্রোগ্রামের লক্ষ্যও ছিল সেটা।  কিন্তু বাংলাদেশের শাহবাগ তো ইসলামবিদ্বেষী হিসেবে পরিচিত কথিত “সেকুলারদের” আন্দোলন!

এমনিতেই যারা বাংলাদেশে ভারতের রাষ্ট্রদূত হয়ে আসেন এঁদের মধ্যে একটা ‘কলোনি দখলদার মাস্টার’ ভাব কমবেশি থাকতে দেখা যায়; যেন তারা ভারত সরকারের ভাইস-রয় বা ‘কলোনি রাজপ্রতিনিধি, আমাদের দেখভাল বা দেখেশুনে রাখতে ও হেদায়েত করতে এসেছেন। ঠিক যে জিনিসটা ১৯৪৭ সালে আগস্টে কলোনিমুক্ত ও স্বাধীন ভারত হয়ে গেলে নেহরুর মধ্যে দেখা গিয়েছিল বা যেত। বডি ল্যাঙ্গুয়েজে তিনি নিজেকে ‘ব্রিটিশ ভাইসরয়’ ভাবতেন যার সবচেয়ে ভাল ও বিস্তারিত প্রমাণ আমরা দেখতে পাই নেপাল-ভারত ১৯৫০ সালের চুক্তির ভাষায়। কলোনিদখলি চোখ মনে করে দু’টি রাষ্ট্রের মধ্যে সার্বভৌম সমমর্যাদার সম্পর্ক হতে পারে না। কোন সম্পর্ক হলে তা হতেই হয় দখলদার ও অধস্তনের, এই বিশ্বাস তাঁর প্রখর ছিল। ব্রিটিশরা ভারত ত্যাগ করে চলে গেলেও নেহরু যেন ব্রিটিশের উত্তরসূরি; তাই তিনি কলোনি মাস্টারের সেই ভূমিকায় দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। এমন চিন্তার সমস্যার গোড়া হল – নেশন স্টেট বা জাতিরাষ্ট্র চিন্তার মধ্যে; যেখানে দুই রাষ্ট্রের সমমর্যাদার নাগরিক সম্পর্ক বলে কোনো ধারণা বা ইমাজিনেশন থাকে না, কাজ করে না। সব কিছুকেই এরা মাস্টার-স্লেভ বা প্রভু আর গোলামঅধস্তন বানিয়ে ফেলেন এবং সেভাবে দেখে থাকেন। এর বাইরে ভাবতে পারেন না। অথচ মজার কথা এরাই আসেন আমাদেরকে সেকুলারিজম শিখাতে; আর এতে যদিও আমরা তাঁদের ক্লাস-সেন্স দেখি আর প্রীত হই!।

বীণা সিক্রির সেকুলারিজম আসলে একজন হিন্দু জাতিরাষ্ট্রবাদীর ইসলামবিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়ানো বৈ আর কিছু নয়। এটি সবচেয়ে সহজে ধরা পড়ে যখন আমরা দেখি আরএসএস-বিজেপির মতো পাঁড় হিন্দুত্ববাদী দলের মোদী সরকার প্রায় সাত বছর ধরে ভারতে ক্ষমতায়; অথচ বীণা সিক্রির মোদীর বিরুদ্ধে কোনো আপত্তি বা সমালোচনাই নাই; বরং ভাবটা হল একেবারে সব ঠিকঠাক সুন্দরভাবে চলছে। অথচ “জয় শ্রীরাম” বলানোর জবরদস্তি অত্যাচার নিপীড়নে টেকা দায়, মুসলমান নাগরিকের বুকের খাঁচার ওপর লাফিয়ে উঠছে তাঁরা। কিন্তু বীণা সিক্রির তাতে কোন বিকার আছে আমরা দেখি নাই! তার মানে, সিক্রির সেকুলারিজম ভাবনার ফিল্টারেও আরএসএস বা মোদী পার হতে যেতে পারেন। এর চেয়ে তামাশা আর কী হতে পারে! আবার দেখি – বীনা সিক্রি মোদী-অমিতের ভারতের পড়শি দেশের থেকে কেবল ‘না-মুসলমানদেরই নাগরিকত্ব দেয়া’ হবে এই চরম বৈষম্যমূলক আইন গ্রহণ করেছেন বলে প্রকাশ্যে জানাচ্ছেন। এমনকি বীণা সিক্রি মোদীর এই আইনের পক্ষে তিনি নিজে সাফাই গেয়ে বলেছেন, এটা ‘ন্যায্য’। এখানে তাকে “বাহ রে সেকুলারিস্ট” ছাড়া অন্য কিছু বলার সুযোগ দেখি না।

সিক্রির ভারত ‘এলডার ব্রাদার’ তত্ত্বঃ
ভারতের বাইরের মানুষ ভারতের বড় ভাই সুলভ আচরণের বিরুদ্ধে আপত্তি ও নিন্দা জানিয়ে থাকে। অথচ বীণা ভারতের এই অশিষ্ট ও আন-ওয়েলকাম আচরণ এটাকেই ভারতের জন্য গৌরবের বলে মনে করেন বা তুলে ধরে থাকেন।   বীনা সিক্রির এমন বুঝাবুঝির দৌড় দেখে জানা যায়, তার চিন্তা কত স্থুল। আর তিনি মনে করেন, বাকচাতুরি দিয়ে তিনি কথা বলবেন আর এটাকে কূটনৈতিক কথা বলে সবাই তা গ্রহণ করবে বা মেনে নিবে।

বাংলাদেশে ২০০৭ সালের জবরদস্তির তত্ত্বাবধায়ক সরকার কায়েম করে আমেরিকা বাংলাদেশকে ক্রমেই ভারতের হাতে তুলে দিয়েছিল; যাতে ভারত যেমন ইচ্ছা আসামসহ নর্থ-ইস্টের জন্য বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ট্রানজিটের নামে পুরো একটা করিডোর এবং তা বিনাপয়সায় এবং প্রায়রিটিতে আমাদের দুই বন্দরও প্রায় বিনাপয়সায় ব্যবহার করতে পারে। অবশ্য আসাম নিয়ে ভারতের জন্মের সময় (১৯৪৭) থেকেই নেহরুসহ ভারতের শাসকদের দ্বিধা ছিল যে, আসামসহ পুরা নর্থ-ইস্টের জন্য বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে করিডোর মাগনা পেলেও সেটা দরকার কি না, নেয়া ঠিক হবে কি না! এ কথাটা শুনতেই আজব ও অবিশ্বাস্য লাগতে পারে। কিন্তু কথা সত্য।

আসামের অসুস্থ দ্বৈততাঃ বাংলাদেশের করিডোর ভোগ করে কিন্তু মুসলমান খেদাও চায়
ভৌগলিকভাবে, আসামসহ ভারতের পুরা নর্থ-ইস্ট কিন্তু বাকি ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন বা ল্যান্ডলকড নয় একেবারেই। অন্তত ১৮ কিলোমিটার সংযোগ-ভূমির (চিকেন নেক) দ্বারা এটি সরাসরি ভুমিসংযুক্ত। আবার দেশভাগের সময়ের আগে বা পরে কখনোই নর্থ-ইস্টের জন্য করিডোর বা ট্রানজিট দরকার বলে ভারত কখনো এমন কিছু পাওয়ার ইচ্ছা বা আগ্রহই প্রকাশ করেনি। এটাই প্রমাণ করে, ভারত আসামের জন্য করিডোর বা ট্রানজিট চায় না, অন্তত এই প্রশ্নে তাদের বিরাট দ্বিধা আছে। কেন?

কথাটা বুঝা খুবই সহজ। আসাম যে যুক্তিতে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে করিডোর বা ট্রানজিট চাইবে, বাংলাদেশের অগভীর ফিডার বন্দর বা কোন গভীর সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করে পণ্য আনা-নেয়ার সুবিধা চাইবে, এরই সাথে সাথে ঠিক একই যুক্তিতে আসামসহ নর্থ-ইস্টের ওপারে আরো উত্তরে আছে চীন। চীনের ঐ ভূখন্ডের বাসিন্দারা তাঁরা পুরোপুরিই ল্যান্ডলকড বলে, তারাও আসামের ওপর দিয়ে করিডোর বা ট্রানজিট চাইবে আর একইভাবে অসমীয়দের মত বাংলাদেশের উপর দিয়ে নেয়া সব করিডোর ফ্যাসিলিটিই পেতে চাইবে। এর সোজা মানে হবে, ভারতকেও আসামের ওপর দিয়ে চীনকে করিডোর সুবিধা পেতে দিতে বাধ্য হতে হবে। কিন্তু এটাই ভারত কখনো চায় না। এতে নাকি ভারতের আসামের ‘পবিত্রতা ও শান্তি নষ্ট হয়ে যাবে’- এই হল ভারতের প্রকাশ্য যুক্তি।  এটা আসলে নিজ সন্তানকে হাত-পা নুলা করে দিয়ে এবার তাকে দেখিয়ে রাস্তায় বসে ভিক্ষা করানো – এভাবে আয়-ইনকাম করার মত। আসাম ডেভেলপড হয়ে গেলে তা দেখে চীনের সাথে আসামের সীমান্তে লাগোয়া অংশ আসামের উপর দিয়ে করিডোর চেয়ে বসতে পারে তাই, আসামকে নুলা করে রাখতে হবে, এই মনোভাব!
এ জন্যই আমরা দেখি স্থানীয় (অসমীয়, বোড়ো বা অন্যান্যরা) আসামের বাসিন্দারা কথিত ‘বাঙালিদের বহিষ্কার’ চাইত সেই ১৯৫১ সাল থেকে। কিন্তু কখনো বাংলাদেশের ওপর দিয়ে করিডোর বা ট্রানজিট চায়নি। অথচ আবার ভারতের শাসকরা পিছিয়ে পড়া আসামে (১৯৭২ সালের আগে পুরো নর্থ-ইস্টকে আসাম রাজ্যের অংশ গণ্য করা হত) কখনো অবকাঠামো বিনিয়োগই ঠিকমতো দিতে রাজি হয়নি; সম্পদ নাই বা ঘাটতি বলে এড়িয়ে গেছে। আর তাতে আসামই ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার প্রবল সব বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন জেগে উঠেছে (এখনও উঠে আছে), তবু ভারত কিছুই করতে রাজি হয়নি, নির্বিকার।
আমরা নাকি “মাগনা পেলে আলকাতরাও খেতে চাই”- এখন সেই অবস্থা হয়েছে ভারতের। মাগনায় করিডোর পাচ্ছে বলে যেন এখন ভারতের আগ্রহ হয়েছে। কিন্তু ইন্টারেস্টিং হল – বাংলাদেশ বিনাপয়সার পোর্টসহ করিডোর দিচ্ছে; এটা বিজেপির পক্ষ থেকে আসামের বাসিন্দাদের জন্য কোনো উপহার মোদী সরকার এনে দিয়েছে – এটা প্রকাশ্য সত্য হলেও এটা আসামে কোন দলের নির্বাচনী ইস্যু নয়। এখনও এমন মানে বা মনে করা হয়নি। মূল কথা, আসামের এ পাওয়াটা লোপ্রোফাইলে রেখে দিতে চায় ভারত সরকার। কারণ সম্ভবত বাংলাদেশ যে এত বিশাল সুবিধা দিয়েছে এটা বেশি প্রচার করা হলে না বাংলাদেশ থেকে বাংলাদেশ বা মুসলমানবিরোধী ও বিদ্বেষী আন্দোলন বন্ধ (আসামের বাঙালি খেদাও বা এখনকার নাগরিকত্ব যাচাইয়ের নামে অসমীয় মুসলমানদের খেদানো) করার দাবি বের হতে পারে। এ ছাড়া এর প্রচার বেশি হলে কখন আবার চীন না একই সুবিধা দাবি করে ভারতের কাছে চেয়ে বসে আর বাংলাদেশ তাতে সমর্থন দেয়। এটা অবশ্যই বিরাট এক তামাশা যে, পোর্টসহ করিডোর সুবিধা পাওয়া আসামের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের কোনো দলের নির্বাচনে এটা কোনো ইস্যুই কেউ করতে রাজি না…।

করিডোর নেয়ার পালটা কী, বাংলাদেশকে কী দিয়ে বুঝ দিবেঃ
কিন্তু সমস্যা আরেক জায়গায়। আমেরিকা আমাদেরকে ভারতের হাতে তুলে দিলেও ভারতের জন্য এটা কিছু চক্ষুলজ্জার যে, কোন কিছু পাল্টা সুবিধা বাংলাদেশকে না দিয়ে করিডোর নেয়াটা কেমন দেখাবে! তাই এই অস্বস্তিটা কাটাতেই ঠিক করা হয়, বাংলাদেশকে “দুধ-ভাত খেলোয়াড়” বানিয়ে খেলায় নিবে। সেটা কী?
মরহুম শেখ মুজিব সেই ১৯৭৪ সালে ভারতকে বেরুবাড়ি দিয়ে দিয়েছিলেন, বিনিময়ে আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন কিন্তু আমাদের ছিটমহলে যাওয়ার করিডোর ভারত দিয়ে দেবে – এই ভূমিবিনিময় চুক্তি হয়েছিল ওই সময়। তাই আমাদের কনস্টিটিউশন সংশোধন করে শেখ মুজিব আমাদের কর্তব্য করেছিলেন তখনই। কিন্তু ভারত তার দায় কখনো গত ৪১ বছরে পূরণ করেনি। অর্থাৎ এটা আমাদের পাওনা অধিকার হলেও ভারত আটকে রেখেছিল। এ ছাড়া তিস্তার পানি পাওয়াও ছিল আমাদের ভাটির দেশের পাওনা ও অধিকার। আর যা কোনো রাষ্ট্রের পাওনা অধিকার সেটি পেতে আবার নতুন করে ভারতকে কোন কিছু দিয়ে ভারতের সাথে বিনিময় করার প্রশ্নই ওঠে না। সেটা হবে অনেকটা যেন সেই ঠগের কারবার যে, আমার থেকে ধার নেয়া টাকা ফেরত দেয় না। কিন্তু একবার যে ফেরত দিবার আগ্রহের নামে এবার আমার থেকেই আবার নতুন করে ধার নিয়ে সেই টাকা দিয়েই আমার আগের ধার শোধ করল বলে দাবি করছে; ঠগের বাটপাড়ি যেমন হয়। ভারত সেই ছিটমহল ভূমিবিনিময়ের আইন এবার ৪১ বছর পরে ২০১৫ সালের মে মাসে পার্লামেন্টে পাস করা হয়েছে। আর তিস্তার পানি? সেটাও আমাদের পাওনা হলেও তা আর কখনোই পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না।

কিন্তু এই ২০১৫ সালের মে মাসে ভারতীয় পার্লামেন্টে আইন পাস হওয়াটাকে নিয়ে বীণা সিক্রির মন্তব্য সাক্ষাৎকারে দেখেন।  “এই চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ভারত তার বড় ভাই (বিগ ব্রাদার) পরিচিতি মুছে দক্ষিণ এশিয়ায় জ্যেষ্ঠ ভাই (এলডার ব্রাদার) হিসেবে সম্মান অর্জন করেছে বলে মনে করেন বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার বীনা সিক্রি” [……By approving implementation of LBA, India has shed its “big brother” tag and acquired an “elder brother” status in South Asia, says Veena Sikri ]। দেখেন কারবার! আসলে টাউটারিতেও তো কিছু সীমা থাকে। সিক্রি সেটাও ছড়িয়ে গেছেন।

শুধু তা-ই নয়, সিক্রির আরো চাপাবাজি হল, তিনি বলছেন – সংসদে এই আইন পাস করে দিয়ে নাকি মোদী তাঁর “প্রতিবেশী প্রথম” [neighbourhood first] মতবাদ কাজে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন”। এ ছাড়া আরো আছে। সিক্রি বলেছেন, এই আইন পাস হওয়াতে নাকি, “ভারতের জন্য ভূখণ্ডগত জাতীয় ক্ষতি হয়েছে” [for India, it’s a notional loss of territory]।  এটা কলোনিদখলবাজ ইংরেজদের চেয়েও শঠতাপূর্ণ কথা। কারণ এটা ছিল ভূমির বিনিময়ে ভূমি নেয়ার চুক্তি। তাই তথাকথিত কোন আত্মত্যাগের বালাই নাই এবং নয় এটা। এটা কারো জন্যই একপক্ষীয় কোন ভূমি হারানোই নয়। আমরাও সমতুল্য ভূমি হারিয়েছি। অথচ সিক্রি এটা এখানে তুলে ধরছেন ‘ভারতের দয়া’ বলে, “একপক্ষীয় ভূমি হারানো” বলে। ফলে সত্যিই আমরা ঠগের পাল্লায় পড়েছি দেখা যাচ্ছে। এটাই হলো, টিপিকাল ছেচরামো! আমরা নির্বাক!

এভাবে সর্বশেষ যে মিথ্যা বলা আর চাপাবাজিটা বীনা সিক্রি করেছেন আর আবার এদেশে লেখা ছাপিয়েছেন, সেটা গত  ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০, বাংলা-ইংরেজি দুভাবেই ছাপিয়েছিল [তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি দ্রুত স্বাক্ষরিত হওয়া উচিত]।

এ ছাড়াও ভারত-বাংলাদেশ মিলিয়ে গত ২৯ আগস্ট এক ভার্চুয়াল ওয়েবনিয়ার আলোচনায় তিনি আবার আরো মিথ্যা ও চাপাবাজি করতে গেছেন। এটাই তাঁর তথাকথিত নষ্টা-সেকুলারিজম নিয়ে। এর আয়োজক ছিল Indian Council for International Cooperation নামে কেউ। সেখানে তিনি দাবি করে বলেছেন, “বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের কনস্টিটিউশন বঙ্গবন্ধুর লিগ্যাসি এবং ওর মধ্যে সেকুলারিজম, ডেমোক্র্যাসি, সোস্যালিজম ও জাতীয়তাবাদ বলে কিছু বৈশিষ্ট্য আছে – যেগুলো ইন্ডিয়ান কনস্টিটিউশনের সাথে কমন”।   ……….. “ঢাকার ১৯৭২ সালের কনস্টিটিউশন আমাদের দুই দেশের মধ্যে নতুন ধরনের সম্পর্ক শুরু করতে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে”।

ইসলাম-কুপানি নষ্টা-সেকুলারিজমঃ
লক্ষ্য করা যাচ্ছে বীনা সিক্রি ইদানীং সুযোগ পেলেই ‘জ্ঞানী’ লোক হওয়ার আর বাংলাদেশকে সেকুলার হতে জ্ঞান দেয়ার উৎস হিসেবে নিজেকে হাজির করতে চাইছেন। কিন্তু আমরা সত্যিই খুব দুঃখিত! আমরা মনে করি, তার কনস্টিটিউশন বা সেকুলারিজম বিষয়গুলো নিয়ে নুন্যতম কোন জ্ঞান বা ধারণাই নেই। সাথে কিছু ফ্যাক্টস প্রসঙ্গেও একেবারেই জানা নাই। কিন্তু এজ ইউজুয়াল আন্দাজে বলা ঠিকই আছে। বীণা সিক্রি চাইলে  একেবারেই কান খুলে শুনে রাখতে পারেন, নিচের বাক্যটাঃ

কোনো কনস্টিটিউশনে যদি “আমাদের নীতি সেকুলারিজম” জাতীয় কিছু বলে উল্লেখ থাকতে দেখি আমরা তবুও ঐ রাষ্ট্র বা কনস্টিটিউশন সেকুলার বলে গণ্য হবে না। আসলে রাষ্ট্র বা কনস্টিটিউশন সেকুলার বলে গণ্য হওয়ার কোন পথ বা পদ্ধতিই এটা নয়। একেবারেই নয়। এমনকি কনস্টিটিউশনের কোথাও সেকুলারিজম শব্দটা উল্লেখ করা না থাকলেও সেই রাষ্ট্র বা কনস্টিটিউশন সেকুলার বলে গণ্য হতে পারে।

মানুষ মারা যাওয়ার আগে পর্যন্ত শিখে এবং চাইলে শিখতেও পারে। সিক্রি, আপনার উচিত হবে এ বিষয়ে পড়তে বসা, স্টাডি করা। দুঃখজনক হল – নেহরু, গান্ধীসহ যারা আগের ভারতের নেতা ছিলেন এমনকি ইন্দিরা গান্ধী এরা কেউই উপরে যে প্যারাটা লিখেছি, সে কথাগুলো জানতেন তা মনে হয় না। সে কারণে ভারতের কনস্টিটিউশনেও সেকুলারিজম শব্দটা আগে ছিল না। এরা সবাই সেকুলারিজম কী করলে একমাত্র হয় সে বিষয়ে জানাজানি শেষ না করেই মারা গেছেন। সেটা তাঁদের এজেন্ডাও ছিল না মনে করার কারণ আছে। কারণ কংগ্রেস ১৮৮৫ সালে জন্মের পর থেকে যে রাষ্ট্রের ধারণা রপ্ত ও বাস্তব করেছে সেটার মূল বৈশিষ্ট হল –  এক হিন্দু জাতি-রাষ্ট্র।

তাই একটা সত্য আগে জেনে রাখুন। সেকুলারিজম লিখে রাখা নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের দুই কনস্টিটিউশনে এটি কমন কথা এবং কমন ভিত্তি এবং এই কমন ভিত্তির বলে যে নতুন ধরনের সম্পর্ক ইত্যাদি অনেক কথা বীনা বলেছেন তাও অর্থহীন এবং ভিত্তিহীন – অসত্য ও ভুল।

ফ্যাক্টসটা হল – বাংলাদেশ স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার সময় রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার এই তিন নীতি লেখা হয়েছিল, ১৯৭১ সালের এপ্রিলে ১১ বা পরে আনুষ্ঠানিকভাবে ১৭ এপ্রিল ১৯৭১।  এরপরে ১৯৭১ সালের অক্টোবরেও – ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেক এই অনুরোধ প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার থেকে তত দিনে তিনবার চাওয়া হলেও ভারত তা দেয়নি। কারণ ইন্দিরা গান্ধীর রাষ্ট্র বিষয়ক ধারনায় অস্পষ্টতা ছিল। কিন্তু যেটা তাকে তাড়া করছিল তা হল,  ভারত মানে মূলত একটা হিন্দু-জাতিরাষ্ট্র ভারত যার জন্মের শত্রু পাকিস্তান যে পাকিস্তানের পুর্ব অংশ যা বাংলাদেশ নামে সাধীন হতে চাইছে কিন্তু সব ছাপিয়ে ইন্দিরাকে যা খোঁচা দিচ্ছে এরা তো নব্বই ভাগই মুসলমান – এই মুসলমানদের স্বাধীন হতে তিনি কেন গাটছাড়া বাধবেন? তাই তিনি একটা নিশ্চয়তা চাচ্ছিলেন, একটা রক্ষাকবচ চাইছিলেন। যদিও সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সবগুলো পক্ষই এলাইয়েন হয়ে যাবার কারণে বাংলাদেশ স্বাধীন করতে সবাই সক্রিয় হবেনই এটা নির্ধারিত হয়ে গেছিল একাত্তরের আগষ্টেই। যেমন বাস্তবত সুযোগ ছি না নাহলে ইন্দিরাই মন শান্তির জন্য তিনি হয়ত অনুরোধ রাখতেন তোরাও ভারতের মত একটা হিন্দু-জাতিরাষ্ট্র হয়ে যা। তাই এরই বিকল্প শব্দ যা সম্ভবত তার পরামর্শকেরা তাকে দেয় সেটা হল “সেকুলারিজম”।  কিন্তু একটা রাষ্ট্র বা কনস্টিটিউশন কী করে সেকুলার গণ্য হয়, কী করে তা নিশ্চিত করতে হয় তা তারা কেউ জানতেন না।  জানতেন না এত কঠিন শব্দ উচ্চারণ করে বলছি এজন্য যে  – এই কাজটা অন্তত “আমরা সেকুলার” অথবা “আমাদের রাষ্ট্রনীতি হল সেকুলার” এভাবে  তা কনষ্টিটিশনের প্রতিটা পাতায় লিখে রাখলেও তা হবে না। ফলে ইন্দিরার “আমাদের রাষ্ট্রনীতি হল সেকুলার” – লিখে রাখা দেখেই নিশ্চিত বলা যায় যে তাঁরা এটা কেউই জানতেন না। ইন্দিরার ভয় যে বাংলাদেশ না কথিত ইসলামি রাষ্ট্র হয়ে যায় – এটাই ছিল তাঁর আসল ভয়। কিন্তু তিনি জানেনই না এই ভয় তাড়ানোর পথ কী। তাই পুরা আনাড়ী হয়ে সেকুলারিজম শব্দটা তিনি আকড়ে ধরেন।  এতে তখনকার মত বাংলাদেশ অস্থায়ী সরকারকে ভারতের ইন্দিরা গান্ধীর যে  ড্রাফট বা পরামর্শটা পাঠান যাতে তিনি সররত আছেন জানান  সেখানে – সেকুলারিজম, ডেমোক্র্যাসি, সোস্যালিজম ও জাতীয়তাবাদ বলে নতুন করে এই চার নীতির কথা উল্লেখ করে- এটাই ভিত্তিতে বাংলাদেশ যেন নতুন করে অনুরোধ পাঠায় ইনফরমালি তাই বলা হয়েছিল।

আরেকটু বলে রাখা ভাল, হিন্দু-ভারত ও প্রগতিধারীরা ইসলামি রাষ্ট্র বা মুসলমান রাষ্ট্র হয়ে গেল কিনা এনিয়ে প্রবল শঙ্কায় থাকে যদিও ভারত নিজেই যে হিন্দু-জাতিরাষ্ট্র হয়ে জন্ম হয়ে আছে সে খবর তাঁদের নাই। তারা প্রায়ই আপত্তি তুলে পাকিস্তান একটা ইসলামি রাষ্ট্র বা মুসলমান রাষ্ট্র হয়েছিল। কিন্তু কেউই বলতে পারবে না কি দেখে তারা তা বুঝেছিল তাও বলতে পারবে না। কেবল আপাত জ্ঞানীরা দাবি করবে পাকিস্তানের ফরমাল নাম দেখে – সেটা হল ইসলামি রিপাবলিক অফ পাকিস্তান। এই নামের মধ্যে ‘ইসলাম” লেখা থাকার কারণে। কিন্তু শব্দটা আসলে ডেকোরেটিভ বা নেহায়তই সাজানোর জন্য।  পাকিস্তান রাষ্ট্রের মূল বৈশিষ্টমূলক শব্দ হল রিপাবলিক, একমাত্র যা দিয়ে ওর ক্যারেকটর প্রকাশ পায়। এর অর্থ হল, এটা নাগরিকের ভোটে প্রতিনিধিত্বে নির্বাচিত ক্ষমতার রাষ্ট্র এবং সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ কথা হল, এই নাগরিক হিন্দু এবং মুসলমান দুধরণের যেকেউই হতে পারে। মানে হিন্দু নাগরিকের ভোটটা অর্ধেক বলে গণনা হবে তা নয়। একজন মুসলমান নাগরিকের ভোটের মত সমান হিন্দুর ভোটটাও ঐ এক ভোট বলেই গণনা হবে। যদিও পাকিস্তান রাষ্ট্রে নাগরিক বৈষম্যমূলক কিছুই ছিল না এমন দাবি এখানে করা হচ্ছে না।

জাতিরাষ্ট্রের ভুল নয়, দরকার বৈষম্যহীন সম-অধিকারের নাগরিক রাষ্ট্রঃ
যাহোক কথা শেষ করতে এখন সংক্ষেপ করব। আসলে বাই ডেফিনেশন রিপাবলিক শব্দের মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত যে আরেক অর্থ আছে তা হল এখানে নাগরিক বলতে সবাই বৈষম্যহীন সমান অধিকারের নাগরিক হতেই হবে ধরে নেয়া হয়েছে। তাতে নাগরিকদের মধ্যে  ধর্মীয় বা গায়ের রঙ, বা পাহাড়ি-সমতলি ধরনের ইত্যাদি যত ভিন্নতাই থাকুক না কেন। আইডিয়েলি এটাই হল রিপাবলিক ধারণা। সেটাকে আরও স্পষ্ট রাখার জন্য “সাম্য নীতির” কথা অনেকে আলাদা করে উল্লেখ করে রাখে অনেক কনষ্টিটিশন। আর যে কনষ্টটিউশন সাম্যনীতি মানবে বলে পাবলিককে প্রতিশ্রুতি দেয় সেটাই (কোন ধর্মবিদ্বেষী নয়) সত্যিকার সেকুলার রাষ্ট্র বলে বিবেচিত হবার জন্য যথেষ্ট। তাই মূলকথা ” নাগরিক সাম্যনীতি মানবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়াই – যথেষ্ট। এরপরে ঐ রাষ্ট্র আর সেকুলার কিনা এটা বোকার প্রশ্ন। ধর্ম কুপানোর বদ-চিন্তার সাথে নষ্টা-সেকুলারিজম এতে বিদায় হতে পারে। ধর্ম থেকে রাষ্ট্র আলাদা করা এটাও আরেক বদ-চিন্তা, মূলত অপ্রয়োজনীয় চিন্তা।

কিন্তু সাবধান লেখাই যথেষ্ট না। সামাজিক রাজনৈতিক প্রাকটিস বা চর্চায় সেকথাকে বাস্তব করে দেখানো এটা আলাদা কাজ। সেটা আলাদা করে অর্জনের বিষয়। কনষ্টিটিউশনে লিখে রাখার প্রায় দুশ বছর পরেও আমেরিকায় – “ব্লাক লাইফ ম্যাটারস” বলে আন্দোলন করে মানুষে হুশ ফিরাতে হয়।

যারা সেকুলারিজম জিনিষটাই খায় না মাথায় দেয় বুঝে না তারাই কনষ্টিটিউশনে সেকুলারিজম লিখে এবার প্রবল্ভাবে ইসলামবিদ্বেষী চর্চায় মেতে উঠে।

বীণা সিক্রির কথায় ফিরি আবার। এখন সার করলে, এর মানে- ১. সেকুলারিজম, ডেমোক্র্যাসি, সোস্যালিজম ও জাতীয়তাবাদ বলে নতুন করে এই চার নীতি করার শর্তেই নিরুপায় বাংলাদেশকে ভারতের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেতে হয়েছে। ২. তখনও ভারতের কনস্টিটিউশনে এই চার নীতির কোনো শব্দই ছিল না। তা অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হয়েছে আমাদেরও ১৯৭২ সালের সংবিধানের অনেক পরে, ১৯৭৬ সালে, নতুন করে ভারতের কনস্টিটিউশন সংশোধন করে নিবার সময় [THE CONSTITUTION (FORTY-SECOND AMENDMENT) ACT, 1976]। এবং বলা বাহুল্য ভারতের সমাজ রাজনীতিতে যার কোন ইম্প্যাক্ট বা ভুমিকা নাই। কারণ, থাকলে আরএসএস বা মোদী সরকারের জন্ম হবার কথা না। তাই মূলত কাজটা ইন্দিরা গান্ধীসহ ভারতের যারাই এই কথিত ও নষ্টা-সেকুলারিজমের ভক্ত অথবা যারা রাষ্ট্র বা কনস্টিটিউশন সেকুলার হয় কিভাবে বুঝেন না তাদের সবার চরম অজ্ঞতাই প্রকাশ করে এবং এ অজ্ঞতা চিহ্ন হয়ে থেকে গেছে – সেকুলারিজম লিখে রাখা না রাখা পর্যন্তই এদের জ্ঞান।

এক দিকে নতুন রাষ্ট্র গড়ার সময়ে কী কী বিষয়ের দিকে খেয়াল রাখতে হয়, সেসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় যথেষ্ট ধারণা না রাখা, অন্য দিকে মূলত ইসলামবিদ্বেষ ও ঘৃণার পরিণতিই হলো আমাদের তিন দেশে (ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তান) অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা ও সব অসাম্যের সবচেয়ে বড় কারণ।  কারও মনের দগদগে ধর্মবিদ্বেষ ও ঘৃণা যেন সন্তুষ্টি লাভ করতে পারে এজন্য সেকুলারিজম ধারণাটাকেই এর সাফাই-হাতিয়ার করে হয়েছে। নষ্টা-সেকুলারিজমকে – সেভাবে ব্যবহার করা হয়ে এসেছে এত দিন।

আবার তাজউদ্দিন যা লিখতেই বাধ্য হয়ে থাকেন, বাংলাদেশের মানুষরা সচেতন, তাই তাদের প্রতি এই বিদ্বেষ ও ঘৃণা তারা টের পেয়েছে। তাই তারাও কনস্টিটিউশনে ‘সেকুলারিজম’ বলে এক শব্দ লিখে রেখে সকল নষ্টামি চিন্তাকে প্রতিরোধ ও শায়েস্তা করতে, কিছুটা রাগে ক্ষোভে পাল্টা – আল্লাহর ওপর অগাধ বিশ্বাস বা রাষ্ট্রধর্ম ধরনের শব্দ বা ধারণা ঢুকিয়ে রেখেছে। যদিও তারা ভালোই জানে, এগুলো লিখে রাখা বা না রাখার সাথে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস নড়াচড়া হবে না, হওয়ার কোনোই সম্পর্ক নেই।

যারা নষ্টা-সেকুলারিজমের শয়তানি থেকে বেরিয়ে শুদ্ধ হতে চান, তারা আরেকটু একটু খোঁজখবর করতে পারেন। রাজা রামমোহন রায় যাকে ভারতের কমিউনিস্ট-প্রগতিশীলরা ভারতে, বিশেষ করে বাংলায় ‘রেনেসাঁর আদিগুরু’ বলে সবাই জানেন ও মানেন, তিনিই তো ব্রাহ্মসমাজ ও ব্রাহ্মধর্ম চালু করেছিলেন, ১৮১৫ সালে। তা হলে এখানে রেনেসাঁর আদিগুরু ধর্ম চালু করেন কেমনে? আর সেই ধর্ম এখানে ইতিবাচক হয় কেমনে?

প্রগতিশীলদের এক প্রিয় ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তিনি ব্রাহ্মধর্মের অনুসারী ছিলেন। কারণ তার দাদা দ্বারকানাথ শুধু রামমোহনের অনুসারী ছিলেন না, ১৮৩৩ সালে রামমোহন মারা গেলে তিনিই ব্রাহ্মসমাজের দায়িত্ব নিয়েছিলেন এবং রবীন্দ্রনাথ ১৯১১-১৫ সময়কালে ব্রাহ্মসমাজের মুখপাত্র ‘তত্ত্ববোধিণী’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।

কিন্তু তবু সেকুলারিজম বলি আর নাই বলি, বৈষম্যহীন সার্বজনীন সম-নাগরিক অধিকারের রাষ্ট্র কেন কায়েম হয় নাই আমাদের তিন রাষ্ট্রে – আমাদের সেই আদি-পাপ অন্যখানে – সেকথা এখনও বলা হয় নাই। রামমোহন ভাবতেন ১. রাষ্ট্র মানেই তা নেশন-স্টেট, ২. আর নেশন বা জাতি মানেই ধর্মের ভিত্তিতে জাতি।

এই বোধটাই বৈষম্যহীন সমান অধিকারের নাগরিক ধারণা বা রিপাবলিক ধারণা বুঝতে না পারা বা পৌছাতে না পারার প্রধান বাধা, মুল কারণ – যেটা রামমোহন রায়ের আদি-পাপ। আমরা তিন রাষ্ট্র যার ভুক্তভোগী সাফারার!

আর এসব ধারণা মূলত কলোনিবৃটিশ রাজের আমলের জাতি বা জাতিরাষ্ট্র এর ধারণাজাত। কিন্তু হিটলারের উত্থান ভয়াবহতা দেখার পরে ১৯৫৩ সাল থেকে ইউরোপের ৪৭ রাষ্ট্র এক কনভেনশন ডেকে নিজেদের ভূল সংশোধন অরে নিয়েছিল। আমরা যার খবর জানি না।

তবু রামমোহন উদ্দেশ্যমূলকভাবে এমন করেছিলেন সেটা মনে করা ভুল হবে।  আসলে ভারতের সবাইকে ব্রাহ্মধর্মে নিয়ে গিয়ে এরপর সবাইকে নিয়ে এক ব্রাহ্মধর্মীয়-জাতিরাষ্ট্র গড়তে পরিকল্পনা নিয়েছিলেন বলেই এই ধর্ম চালু করেছিলেন। তবে তা সফল হয়নি। যদি সফল হত তবুও এটা রাষ্ট্র বিষয়ে ভুল ধারণা ।  আর প্রথম ধর্মের ভিত্তিতে জাতিরাষ্ট্র গড়ার পরিকল্পনাকারী এই রামমোহন রায়। তা হলে ১৯০৬ সালে মুসলিম লিগ গঠন এবং জিন্নাহকে ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র গড়ার দায়ে অভিযোগ আনা কিভাবে সঠিক হয়? সর্বোপরি ১৮৮৫ সালে জন্ম নেয়া কংগ্রেস দল সেটা তো এই রামমোহন রায়ের উদ্যোগেরই শেষ পরিণতি।

তবু একজনের কথা এখানে উল্লেখ করে রাখি যার “ধর্মের ভিত্তিতে জাতিরাষ্ট্র গড়ার” ইচ্ছাটা উদ্দেশ্যমূলক। বাকিটা পাঠকেরা আরও খোঁজ করেন। তিনি হলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধায়। ১৮৭৯ সালে তাঁর লিখিত এক প্রবন্ধপুস্তক – নাম ছিল ‘সাম্য’। কিন্তু বইটার দ্বিতীয় মুদ্রণের সময় তিনি তা প্রত্যাহার করে নেন, আর ছাপান নাই। রামমোহন বলা যায় অকালেই অসুস্থ হয়ে মারা যান। কিন্তু এরপরেও যারা ব্রাহ্ম প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন বটে কিন্তু কার্যকর হচ্ছে না এটা সকলেই বুঝতে পারছিলেন। শেষে ১৮৭২-৭৮ সালের মধ্যে এটা তিন টুকরা ভেঙ্গে যায়। এরপর যারা ব্রাহ্ম প্রকল্প ফেল করেছে বলে এটাকে সাফাই হিসাবে ব্যবহার করে হিন্দু প্রকল্প মানে হিন্দু জাতিরাষ্ট্র প্রকল্প করে আগিয়ে যান তাঁদের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র অন্যতম। এসবেরই পরিণতি ১৮৮৫ সালের কংগ্রেস। কিন্তু মুসলমানেরা কেউ একটা হিন্দু জাতিরাষ্ট্র প্রকল্পকে নিজের মনে করে নিবে সেকথার কোন জবাব দেয় নাই। বরং এদের স্বাধীন ভারত রাষ্ট্র চিন্তা যে হিন্দু জাতিরাষ্ট্র প্রকল্প চিন্তা তা ক্রমশ লুকিয়ে চলার কৌশল নিয়েছে। সামনের হিন্দু শব্দটা উচ্চারণ এড়িয়ে চলেছে। তবু প্রধান চিন্তার ভুল বা আদি-পাপ হল রাষ্ট্র মানেই ব্রাহ্মধর্মীয় জাতিরাষ্ট্র এই রাষ্ট্র-বুঝ।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

 

[এই লেখাটা  গত  ২১ নভেম্বর ২০২০, দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ওয়েবে ও  পরদিনই প্রিন্টেও  “বীনা সিক্রির নষ্ট সেকুলারিজম” – এই শিরোনামে উপ-সম্পাদকীয়তে ছাপা হয়েছিল।  পরবর্তিতে ঐ লেখাটাকে এখানে আরও নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে ও নতুন শিরোনামে এখানে আজ ছাপা হল। ]

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s