গান্ধীর সত্য মানে ‘ট্রুথ’ নয়, ফ্যাক্টস


গান্ধীর সত্য মানে ‘ট্রুথ’ নয়, ফ্যাক্টস

গৌতম দাস

১২ নভেম্বর ২০২০, ২১:৩৬

https://wp.me/p1sCvy-3i5

অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়ে অনেকের মূল্যায়ন আমরা দেখে থাকি; কিন্তু কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গেলে, সেখানে অন্তত কোন মানদণ্ডের ভিত্তিতে তা করা হচ্ছে – তা নিয়ে আমাদের পরিষ্কার থাকা উচিত। না হলে তা যথার্থ মূল্যায়ন বলে বিবেচিত না হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আবার কোন মানদণ্ডটা সঠিক? সেটা কী এমন যে চোখে আঙুল দিয়ে পাঠককে দেখাতে হবে? না, ব্যাপারটা ঠিক তাও না। কারণ কোন মানদণ্ড অনুসরণ করে মুল্যায়ন করা হলে বুদ্ধিমান পাঠক তা অবশ্যই ধরে ফেলতে পারবেন। কাজেই কী মানদন্ড ব্যবহার করা হয়েছে তা চোখে আঙুল দিয়ে পাঠককে দেখানোটা জরুরি নয়। কিন্তু পরিস্কার মানদন্ড বজায় থাকতে হবে।

আমাদের পড়া অনেক মূল্যায়নই, সেটা গান্ধীকে (মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী) নিয়েও হতে পারে – তা এমন মানদণ্ডের সমস্যার জালে আটকে থাকতে পারে। তবে গান্ধীর  একাডেমিক লাইফের দুর্বল দিক নিয়ে অনেক নেতি কথা প্রচলিত আছে- যা অনেকের লেখায় আমরা দেখতে পাই। তবে গান্ধী নিজেও বলে গেছেন, তিনি ছাত্র হিসেবে খুবই মধ্যমমানের [mediocre] ছিলেন, মেধাবি ছিলেন না। তবে সেক্ষেত্রেও কারও শিক্ষাগত যোগ্যতা কত দূর, তা জানা দিয়ে তাকে মূল্যায়ন করা সঠিক পদ্ধতি না।

গান্ধী ব্যারিস্টার ছিলেন। সে জন্য কী তাকে বড় বিদ্যাধারী মানতে হবে? না এমন কোনো মানে নেই। এর চেয়ে বরং ব্যারিস্টার কথাটা আমাদের আর কী ধারণা বা চিন্তার আবহাওয়া তৈরি করে দেয় সে দিকে যাওয়া যেতে পারে। মনার্কি বা রাজতন্ত্রের যুগে কেউই ব্যারিস্টারি পড়েনি, আমরা ধরে নিতে পারি।  কারণ, রিপাবলিক না  অধিকারের ধারণার তখন চল ছিল না; শুরু হয়নি বলে চাইলেও পড়া যেত না। এটা বুঝলে ও মানলে আমরা অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারি। কারণ ব্যারিস্টার মানে হল সেটা আর রাজতন্ত্র না, তা ছিল আধুনিক রিপাবলিক রাষ্ট্রের যুগের কথা। যেখানে রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও উৎস জনগণের সম্মিলিত ইচ্ছার হাতে। মানে সব রাষ্ট্রক্ষমতার উৎস ওই পাবলিক- এটা শুরুতেই স্বীকার না করে উপায় নেই। এখন গান্ধী মর্ডান রাষ্ট্র, রিপাবলিক ও রিপ্রেজেন্টেশন ধারণাগুলো কতটা বুঝতেন ও মানতেন এগুলো হতে পারে গান্ধীকে মূল্যায়নের একটা পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া।

দ্বিতীয়ত, গান্ধী সবসময় পকেটে এক খণ্ড গীতার কপি নিয়ে ঘুরতেন বলে জানা যায়। মূলত গীতার ‘সত্য’ তার আকর্ষণের বিষয় ছিল; কিন্তু এই ‘সত্য’ নিয়ে তার বাড়াবাড়ি থেকে বোঝা যায়, তিনি দর্শন পর্যন্ত বা চিন্তার পদ্ধতি কী – ইত্যাদি বিষয়গুলো পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেননি বা এসব বিষয়ে তার আগ্রহ ছিল এমন ধারণা দেয় না।

যদিও ‘গীতা’ যাকে আমরা সাধারণভাবে এক থিওলজিক্যাল এক্সপ্রেশন বলে দেখতে ও বুঝতে পারি, সেখানকার কোনো বক্তব্যের ‘সত্য’ মানে এটা আবার  থিওলজির ‘সত্য”। মানে সেটা আইডিয়েল অর্থে ‘সত্য’- ‘কী হওয়া উচিত’ এই অর্থে। কারণ ধর্মতত্ব আইডিয়েল (ideal বা আদর্শ) বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করে থাকে।

ইংরাজি ভাষায় ট্রুথ[Truth] আর ফ্যাক্টস[Facts] এই দুটা শব্দেরই আমরা বাংলা করি “সত্য”। যদিও ফ্যাক্টস মানে সত্য – এখানে সত্য বর্ণনা অর্থে সত্য। মানে ঠিক বলছি কীনা এই অর্থ ‘সত্য’ ধারণা।  আর ট্রুথ শব্দটা ধর্মতত্বের সত্য ধারণা।   এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। তবে আমাদের জন্য লক্ষ্যণীয় যে, গান্ধীর ‘সত্য’ আর গীতার ‘সত্য’ ধারণা ও প্রসঙ্গ এক না। বরং গান্ধীর সত্য হল “ফ্যাক্টস”। কাজেই এ নিয়ে এত হৈ চৈ ফেলানোর কিছু নেই। অর্থাৎ কোনো মানুষের চিন্তা যখন খুবই প্রাথমিক স্তরে থাকে, তখনকার আলাপ এগুলো বলা যায়। অথচ এটা নিয়ে গান্ধীর ‘সত্যাগ্রহ’ আন্দোলন বলে বুঝে-না বুঝে কত আড়ম্বর করা হয়েছে। আর তাতে গান্ধীর ‘সত্যের’ সীমাবদ্ধতাই প্রকাশ পেয়েছে আরও ভালোভাবে। কারণ গান্ধীর ‘সত্য’ থিওলজির ধারণার মতো নয়। তাতে পকেটে গীতা রাখা, না রাখায় কোনো ফারাক নেই। তাই বলা যায় গীতার সত্য মানে কোনো থিওলজি বা ধর্মতত্ত্বীয় সত্য ধারণা নিয়ে গান্ধী নাড়াচাড়াই করেননি।

প্রসঙ্গ আরও আছে। গান্ধী সারাজীবন হিন্দুধর্ম গ্রন্থগুলো থেকে এর নানা তাফসির বা ব্যাখ্যাকর্তা হিসেবে সমাজে হাজির থাকতে চেয়েছেন; কিন্তু এতে ঘোরতর সমস্যাটা হলো যে, আপনি কোন ধর্মের তাফসিরকারী আর রাজনীতিবিদ একই সঙ্গে এটা হতে পারে না। দ্বিধা তৈরি হবে। রাজনীতিবিদ মানেই আপনি সব নাগরিকের জন্য নেতা হয়েছেন, ধর্ম নির্বিশেষে সবাই আপনার ‘কনস্টিটুয়েন্সি’ এটা মেনে নিয়েই রাজনীতিতে যেতে হয়। ‘কনস্টিটুয়েন্সি’ মানে হলো আপনি তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি বা নেতা হতে চান। এই ‘কনস্টিটুয়েন্সি’কে এক সঙ্গে বাঁধা ও গড়াই তো রাজনীতি; কিন্তু গান্ধী ‘কনস্টিটুয়েন্সি’ ভঙ্গ করেছেন। হিন্দুধর্ম গ্রন্থগুলোর তাফসিরকারী হয়ে বক্তৃতা দিয়ে বুঝিয়েছেন যে, তিনি কেবল হিন্দুদের জন্যই রাজনীতিবিদ। তাও আবার হিন্দুদের সবাই নয়। কেন? সেখানেও বিভক্তি টেনেছেন। কেবল সেসব হিন্দু যারা তার করা তাফসিরের অনুসারি ভক্ত বা সঠিক মনে করেন, কেবল তাদের। কাজেই তিনি ভারত স্বাধীনকারী রাজনীতিবিদ হতেই পারেন না। এ ক্ষেত্রে তিনি ন্যূনতম ধরনও মানেননি। ফলে তিনি এ সেক্টরে অযোগ্য।

তাহলে কী আমি ধর্ম আর রাজনীতি আলাদা করতে পরামর্শ দিচ্ছি? একেবারে তা না কিন্তু। সোজা জবাবটা হল, যে কোনো থিওলজি মানেই হলো তা আর রাজনৈতিক পরিভাষায় হাজির থাকে না। এছাড়া কোন একটা থিওলজি মানেই হল তা আর সার্বজনীন অর্থাৎ ধর্মনির্বিশেষে সবার জন্য প্রযোজ্য নয়। তা কেবল নির্দিষ্ট কোন ধর্মের অনুসারীদের জন্য প্রযোজ্য। তবে থিওলজির গভীর জ্ঞানের কথাগুলোকে ঠিক রেখে শুধু পরিভাষা বদলে নতুন করে রাজনৈতিক পরিভাষায় স্থাপন করে সার্বজনীন রূপে সব নাগরিকের জন্য অবশ্যই হাজির করা যাবে। বা তা করা উচিত; কিন্তু এমন কোন যোগ্যতা গান্ধীর ছিল বলে আমার জানা নেই।

সবশেষে বলবো গান্ধীর যুগের সবাই ডুবেছিল জাতি বা নেশন ধারণার কারণে- যা তাদের অযোগ্য করে দিয়েছিল। এ নিয়ে সংক্ষেপে বলব। তারা সবাই আধুনিক রিপাবলিক রাষ্ট্র বলতে এই জাতিরাষ্ট্রই বুঝতেন। তাও আবার নেশন বলতে কোনো না কোনো ধর্মীয় অর্থে জাতি, যেমন ব্রিটিশ জাতি মানে তারা বুঝতেন ‘এঙলো ক্যাথলিক খ্রিস্টান’ ধর্মীয় নেশন। তাই এরই অনুকরণে তারা ভারতেও হিন্দু ধর্মীয় জাতির এক জাতিরাষ্ট্র- এমন এক রাষ্ট্র কায়েমের স্বপ্ন মনের ভেতরে পুষে নিয়েছিলেন।

তবে ব্যাপারটা আরও একশ’ বছরের পুরনো। গান্ধী ভারতের রাজনীতিতে প্রবেশ করেন ১৯১৪-৫ সালের দিকে। এর একশ’ বছর আগে ১৮১৫ সালে রামমোহন রায় প্রথম ভারতে জাতিরাষ্ট্রের ধারণা নির্মাণ করেছিলেন। তিনিই প্রথম ব্রিটিশদের বুঝেছিলেন ‘এংলো ক্যাথলিক খ্রিস্টান’ ধর্মীয় নেশন হিসেবে। তবে এর অনুকরণে আগে তিনি ভারতের সবাইকে একেশ্বরবাদী ব্রাহ্ম ধর্মে দ্বীক্ষিত করতে ১৮১৫ সালে ব্রাহ্ম-ধর্ম প্রকল্প নিয়ে ব্রাহ্ম সমাজ গড়ে তুলেন। এর মাত্র আঠারো বছরের মধ্যে ১৮৩৩ সালে রামমোহন মারা যান। পরে অনেক চেষ্টা করেও ব্রাহ্ম সমাজ আর এগোতে পারেনি, উল্টা তা দুই/তিন ধারায় বিভক্তও হয়ে যায়। আর তাতে হিন্দু নেতারা সবাই এবার ব্রাহ্মধর্ম ফেলে হিন্দুধর্মীয় এক জাতিরাষ্ট্র গড়া ছাড়া উপায় নেই যুক্তিতে গোপনে বা প্রকাশ্যে তৎপরতা শুরু করেন।  অর্থাৎ অখন্ড ভারতের জন্য এক হিন্দু-জাতি-রাষ্ট্র কায়েম করাকে জায়েজ মানা শুরু হয়েগেছিল। আর এতেই বলা বাহুল্য  এজন্য এটাই এখনো ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের আদি পাপ হয়ে আছে। বিশেষত নেহেরু-গান্ধীও হিন্দুধর্মীয় এক জাতিরাষ্ট্র রাজনীতির অনুসারী হয়ে উঠেন। স্বাধীন ভারতের চূড়ান্ত রূপ দেয়া হয়েছে- এ দুই নেতার হাতে। আর এ কারণে এখন কম-বেশি ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সবাই অস্থিরতা ও সংঘাতে রয়েছে।

জাতিরাষ্ট্র চিন্তার বিকল্প দুনিয়া এখন হাজির; কিন্তু কেউ সেদিকে আগ্রহ দেখায় না। অন্তত ভারতের কেউ করে না। বরং আরও জোরেসোরে জাতির স্বার্থ বলে এক শব্দে হিন্দুধর্মীয় জাতিরাষ্ট্র ধারণাটাকেই আবার হাজির করে। আরএসএস-বিজেপির রাষ্ট্রচিন্তা হল এই হিন্দু জাতি রাষ্ট্র ভারতেরই আরও দানব ভার্সন।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক

 

[এই লেখাটা  গত ২৮ অক্টোবর ২০২০, সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল পত্রিকার ওয়েবে ও  প্রিন্টেও  “গান্ধীকে নিয়ে মূল্যায়ন” – এই শিরোনামে  ছাপা হয়েছিল।  পরবর্তিতে ঐ লেখাটাকে এখানে আরও নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে ও নতুন শিরোনামে এখানে আজ ছাপা হল। ]

One thought on “গান্ধীর সত্য মানে ‘ট্রুথ’ নয়, ফ্যাক্টস

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s