ট্রাম্প ঠিক কার বিরুদ্ধে লড়ছেন, চীন না বাইডেন
গৌতম দাস
১৮ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০৬ সোমবার
ট্রাম্প ঠিক কার বিরুদ্ধে লড়ছেন, চীন না বাইডেন – ফাইল ছবি
ট্রাম্পের চোখে তার বিরোধী কে বা কারা? কার বিরোধিতা করতে তিনি মাঠে নেমেছিলেন? চীন না বাইডেনের? ট্রাম্প আমেরিকান সংসদে হামলা-ভাঙচুর, ভেঙে তছনছ করেছেন, কিন্তু কার বিপক্ষে যাবেন বলে? মূলত এনিয়ে তিনিই বিভ্রান্ত! তাই তিনি নিজে এক সিটিং প্রেসিডেন্ট হয়েও সংসদে হামলা করিয়েছেন! আর এতেই আমেরিকান রাষ্ট্রের সক্ষমতা যতটুকু যা ছিল তা নষ্ট করে দেশটিকে আরো কয়েক ধাপ দুস্থ অবস্থায় নিয়ে ফেলে গ্যালেন! পিউ রিসার্চের ফাইন্ডিংস মতে ট্রাম্পের পাবলিক রেটিং এখন ২৯ শতাংশে নেমে গেছে [Donald Trump is leaving the White House with the lowest job approval of his presidency (29%) ]। এদিকে আমেরিকার এখনকার মারাত্মক অর্থনৈতিক সমস্যা হল মুখ্যত কোভিড ভাইরাস মোকাবেলায় ট্রাম্পের চরম অক্ষমতা-জাত। এক দিকে চার লাখের মত মানুষের ভাইরাসে মৃত্যু, সাথে বেকারত্ব, অর্থনীতিতে ধস প্রভৃতি। যে দিকটা ভেবেই সম্ভবত বাইডেন শপথ নেয়ার আগেই প্রায় ১.৯ ট্রিলিয়ন ডলারের ‘অর্থনীতি রিকভারি পরিকল্পনা” [Biden Seeks $1.9 Trillion for Relief in First Economic Plan] সিনেটে অনুমোদনের জন্য পেশ করতে রেডি করেছেন। সিনেটে বাই-পার্টিজান হয়ে তাই দুই দল একসাথে কেবল ট্রাম্পের ইমপিচমেন্টে নিয়ে মেতে থাকা নয়, বাইডেনের নতুন ক্যাবিনেট অনুমোদন বা অর্থনৈতিক পরিকল্পনা অনুমোদনের মত জরুরি কাজগুলো সম্পন্ন করতেও নিজেদের মধ্যে সময় ভাগাভাগি করে কাজ করার আলাপ-আলোচনা করছেন [Senate to split time ...।]। এখন অন্তত আগামী এক বছরের মধ্যে এসবের ফলাফল যদি ইতিবাচক হয়ে ফলতে থাকে, তবে মধ্যবিত্ত, স্বল্প আয় ও পেশার মানুষের ট্রাম্প সম্পর্কে তাদের ইতি-মূল্যায়ন থাকলে তাতে বদল আসবে। আর এতে তাদের নিজ হতাশ জীবন পেছনে ফেলে সামনে আগাতে তারা ইতিবাচক দিশা পেতেও পারে!
আমেরিকান প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতার আয়ু আর মাত্র দুই দিন। কিন্তু ক্ষমতার টার্ম শেষ হওয়ার শেষ দুই সপ্তাহ যেন কঠিন থেকে কঠিনতর অসহায়ত্বের দিন হয়ে ট্রাম্পের কেটেছে। প্রতিদিনই নতুন আরেকটা খারাপ কিছু ঘটে চলেছে। এভাবে গত ১৩ জানুয়ারি আমেরিকান সংসদে (হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভে) তিনি ইমপিচড হয়েছেন [Trump Impeached for Inciting violent Insurrection]। নিজ দলের ১০ জন সদস্যও তাঁর বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন। অর্থাৎ আইনত তিনি এখন দাগী বা ইমপিচড। আর তার বিরুদ্ধে ‘ইনসাইটিং ভায়োলেন্ট ইনসারেকশন’ [inciting violent insurrection] বলে এবারের ইমপিচমেন্টে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ তোলা হয়েছিল। যার বাংলা হল – প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেই ‘সহিংস বিদ্রোহ-বিশৃঙ্খলা করতে উসকানি’ দিয়েছেন। যদিও এটা আংশিক, মানে ইমপিচমেন্টের পুরো আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়নি এখনো। কারণ আমেরিকান সংসদ আমাদের মত একটা না দুইটা, মানে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট। অর্থাৎ আমেরিকার আরেক সংসদ আছে যেটাকে ওরা সিনেট বলে। প্রতি রাজ্য থেকে দু’জন নির্বাচিত সিনেটর নিয়ে এই সিনেট গঠিত। তবে আমেরিকান কনস্টিটিউশন অনুসারে, সংসদ সদস্য বা আইনপ্রণেতাদের দুটো কক্ষ (সিনেট ও হাউজ) থেকেই একই বিল অনুমোদন পেলে তবেই এরপর সেটি ‘পালনীয় পূর্ণ আইন’ বলে বিবেচিত হয়। তাই এখন সিনেট থেকেও ট্রাম্পের ইমপিচমেন্ট প্রস্তাব পাস হওয়ার অপেক্ষায়; প্রস্তুতি চলছে।
ট্রাম্প ক্ষমতা ছাড়ার আগে কি সিনেটেও ইমপিচমেন্ট শেষ হবে?
এর একেবারেই সংক্ষিপ্ত জবাব, মনে হয় না। পরিস্থিতি সম্পর্কে এক্সপার্ট এক্সপ্লেনারের ব্যাখ্যা হল, এটা সম্ভব নয়। এক কথায় বললে ট্রাম্প ২০ জানুয়ারি তার টার্ম শেষে হোয়াইট হাউজ ছেড়ে যাওয়ার পরেই কেবল সিনেটে ওই ইমপিচমেন্ট প্রস্তাব উঠবে। এটাই এক্সপার্ট অপিনিয়ন। এর মানে, তাহলে ট্রাম্প আর প্রেসিডেন্ট না থাকলেও সিনেটে তাঁকেই ইমপিচমেন্টের প্রস্তাব কী জীবিত থাকছে? হ্যাঁ, ঠিক তাই, থাকছে। আর এর একটা কারণ হল, সংসদ বা হাউজে উঠা প্রস্তাব ও তা পাস হওয়ার পর তা সিনেটেও পেশ ও পরিণতিতে ভোটাভুটিতে যাই হোক তা সম্পন্ন হতেই হবে। কারণ প্রস্তাব একবার উঠেছে যখন, এর প্রক্রিয়া শেষ হতে হবে। আর দ্বিতীয় কারণ হল, যদি সিনেটেও ইমপিচমেন্ট প্রস্তাবটা পাস হয়ে যায় তখন এরপরেও আরেক বাধ্যতামূলক কাজ বাকি থাকবে। সেটা হল, সিনেটের প্রস্তাব পাস হওয়া মানে তখন সেটা গৃহীত হয়ে যাওয়া এক আইন। যার সোজা অর্থ, ট্রাম্প দোষী ও অযোগ্য বলে প্রমাণিত। তাই এর সাথে তখন যে প্রশ্নটা উঠবেই যে, তা হলে ট্রাম্প কী এরপরও পাবলিক অফিসে কোনো জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার জন্য যোগ্য থাকবে? এ বিষয়টির মীমাংসা করতে হবে। কারণ সেটা মীমাংসা করতে আবার কেবল সিনেটেই আরেকটা প্রস্তাব তুলতে হবে। সেটা হলো, ইমপিচড হয়ে যাওয়া ট্রাম্প এরপরে পাবলিক অফিসে কোনো জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার জন্য যোগ্য কি না – এ প্রস্তাব নিয়ে ভোটাভুটি করা।
তবে এখানে আমাদের একটা জিনিস পরিষ্কার রাখা দরকার। ইমপিচমেন্টের প্রস্তাব হাউজে যখন প্রথম তোলা হয়েছিল, সেখানে তা পাস হওয়ার নিয়ম ছিল, সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা হলেই পাস মনে করা যায় সেখানে। মানে ঐদিন উপস্থিত সদস্যদের মধ্যে ‘সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠের’ (৫০%+) পক্ষভোট পেলেই যথেষ্ট। আর তাতে ট্রাম্প হাউজে ইমপিচড হয়েছিলেন ২৩২/১৯৭ ভোটে। কিন্তু এরপর ওই প্রস্তাব সিনেটেও পাস করতে গেলে সেখানে এবার তা হতে হবে দু-তৃতীয়াংশ (৬৭%) ভোটে। কিন্তু আবার এরপরে সিনেটেই অভিযুক্ত ট্রাম্প জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার জন্য যোগ্য থাকবেন কি না এ প্রস্তাব ভোটে উঠলে তখন এবার সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় হলেই তা পাস হয়ে যাবে। এভাবেই ইমপিচমেন্টের পুরো প্রক্রিয়াটা কনস্টিটিউশন অনুসারে সম্পন্ন হবে বলে মনে করা হয়।
এদিকে যদিও নিয়ম অনুসারে হাউজে ইমপিচমেন্ট প্রস্তাব (একে আর্টিক্যাল বলা হয়ে থাকে) পাস হওয়ার পরে এরপর সিনেটে তা পৌঁছে দেয়ার দায়িত্বটা কনস্টিটিউশন দিয়েছে হাউজ স্পিকারকে (এখানে ডেমোক্র্যাট স্পিকার ন্যান্সি পেলোসিকে)। কথা আরো আছে, তিনি কবে তা সিনেটে পাঠাবেন এর বিবেচনার ভার কনস্টিটিউশন স্পিকারের নিজের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এছাড়া স্পিকারের আরেকটা বড় কাজ আছে। ঐ প্রস্তাব হাউজে কী প্রেক্ষিতে পাস হয়েছে, তা সিনেটে গিয়ে সেটা নিয়ে ব্রিফ ও ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য আগেই স্পিকার ৯ জন ম্যানেজার বা এজেন্ট সিলেক্ট করে সিনেটে নাম পাঠিয়ে দিবেন বা দেয়ার কথা। ইমপিচ-প্রস্তাব আলোচনার সময় সিনেট এদের থেকে তা শুনে নিবে। সেই ম্যানেজার নিয়োগের কাজও পেলোসি শেষ করেছেন এরই মধ্যে।
আবার ইতোমধ্যে সিনেটেরও কিছু ডেভেলপমেন্ট বা নতুন ঘটনা আছে। চলতি সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠতায় আছে রিপাবলিকানরা আর এর নেতা হলেন ম্যাক-কনেল [Mitchell McConnell Jr.]। কিন্তু ২০ জানুয়ারি থেকে নতুন নির্বাচিত সিনেটে, সেখানে ভোটের স্টাটাস হয়ে যাবে রিপাবলিকান-ডেমোক্র্যাট সমান সমান ৫০, এরকম। তবে আমেরিকান কনস্টিটিউশনে এরও সমাধান দেয়া আছে। রাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট যিনি থাকেন তিনিই পদাধিকারবলে সবসময় সিনেটের প্রেসিডেন্ট হন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট হলেও তিনি ঐ সিনেট অধিবেশনে সভাপতিত্ব করতে আসেন কেবল কোন বিশেষ অনুষ্ঠান হলে অথবা সিনেট অধিবেশনে পক্ষে-বিপক্ষে সমসংখ্যক ভোট পড়েছে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হলে। কারণ কেবল তখনই তিনি সিনেটের ভোটাভুটিতে কোন একটা পক্ষে নিজের ভোটটা প্রদান করে প্রস্তাবে সিদ্ধান্তমূলক ফলাফল এনে দেন। অর্থাৎ এটা বলা যায় যে এবার সিনেটে ডেমোক্রাটদের পক্ষে। নইলে সাধারণ সময়ে, সিনেট পরিচালনা করে থাকেন সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা যিনি থাকেন তিনিই পদাধিকারবলে এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে।
এসবের সোজা মানে এখন সিনেটেও ট্রাম্পকে ইমপিচমেন্টের প্রস্তাব পাস হতে গেলে ৬৭টা ভোট লাগবে, অর্থাৎ ন্যূনতম ১৬টি রিপাবলিকান ভোট লাগবে। আর সাথে ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসেরও ভোটটা, এমন হতেই হবে। কিন্তু কমলা হ্যারিস শপথ নেবেন বাইডেনের সাথেই আগামি ২০ জানুয়ারি। আর এদিকে চলতি সিনেট যা ১৯ জানুয়ারি পর্যন্ত চলে টার্ম শেষ করবে এতে ডেমোক্র্যাটরা ৫৭/৪৭-এ মাইনোরিটিতে আছে।
এসব বিবেচনায় আমেরিকান মিডিয়ার দুটো (এপি আর নিউ ইয়র্ক টাইমস) এক্সপ্লেনার রিপোর্ট বলছে, আগামী ১৯ জানুয়ারির আগে পেলোসির ইমপিচমেন্ট প্রস্তাব সিনেটে পাঠানোর সম্ভাবনা নাই। কারণ তখনই একমাত্র ডেমোক্র্যাটরা সিনেটেও শক্তিশালী হবে। এছাড়া বর্তমান মেজরিটি লিডার রিপাবলিকান ম্যাক-কনেল জানিয়েছেন, ১৯ জানুয়ারির আগে সিনেট বসার কোন শিডিউল এখনো পর্যন্ত নাই। আর ইমপিচমেন্ট প্রসঙ্গে তার অবস্থানটা হল, তিনি ট্রাম্পের ইমপিচমেন্টের পক্ষেই ভোট দিতেন হয়ত কিন্তু তিনি নিজে উদ্যোগী হয়ে প্রস্তাব আনতে চান না। আবার ১৯ জানুয়ারি পর্যন্ত তার সদস্য থাকার শেষ দিন। এথেকে বুঝা যায় যে, এবিষয়ে এক্সপ্লেনারদের ব্যাখ্যা কেন ব্লছে যে ২০ তারিখের আগে কিছু হবে না!
সাথে আরেকটা খবর দিচ্ছে রয়টার্স যে, ক্ষুব্ধ ক্ষ্যাপাটে ট্রাম্পকে সামলাতে তার স্টাফরা পেরেশান দশায়। আর ২০ জানুয়ারি শপথের দিনেই সকালে ট্রাম্প হোয়াইট হাউজ ও ওয়াশিংটন ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। সম্ভবত ফ্লোরিডায়, থাকবেন সেখানেই।
এবার আসা যাক ট্রাম্প আমেরিকাকে কোথায় নিয়ে এনে ফেললেন তাহলে? এর পরিণতি কী হবে?
প্রথম কথা, এখনো যে দিকে বেশির ভাগ মিডিয়া বা আলোচক ফোকাস করতে চাইছে না; তা হল ট্রাম্পের সমর্থক কারা, আমেরিকান সমাজের কোন অংশ? এবং কেন? নিশ্চয় আমরা মনে করব না যে ট্রাম্পের সমর্থকরা সব ট্রাম্পের মতোই পাগলাটে অথবা যাদের আচরণের দিশা বুঝা বা কার্যকারণ বের করা সহজ না। রাজনৈতিকভাবে দেখলে ট্রাম্পের সমর্থকরা মূলত হোয়াইট সুপ্রিমিস্টরা। বিভিন্ন নামে এদের সংগঠন আছে, ডেরা আছে। এদের সাথে ট্রাম্পের প্রমোটার যারা ট্রাম্পকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে ২০১৬ সালে পেশ করেছেন, এমন লোকদের বুঝাপড়া আছে যে, ট্রাম্প সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদিদের দাবি ও তাদের চিন্তাগুলো পপুলার করতে সহায়তা করবেন। এছাড়া আবার ট্রাম্পের ভোটার-সাপোর্টার যারা তাদের বড় অংশ হল মূলত স্বল্প আয়ের বা ছোট এন্টারপ্রাইজ, ছোট উদ্যোক্তা অথবা গ্লোবাল নেতৃত্বে পালাবদলের ধাক্কায় চাকরি হারানো নানা ধরনের মানুষের বিরাট অংশ।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দুনিয়া এখন গ্লোবাল অর্থনৈতিক নেতৃত্ব এক পালাবদলের জাংশন পয়েন্টে। চীনা উত্থানের এই পর্বে সব দেশের তো বটেই, এমনকি পুরনো গ্লোবাল নেতা আমেরিকার অর্থনীতিতেও এর বড় ছাপ পড়বেই। আগের নেতা হিসেবে আমেরিকার অভ্যন্তরীণ যেসব পেশা বা প্রডাক্টকে সে সহজেই জন্ম ও প্রটেক্ট করতে পারত, সেই ক্ষমতা আমেরিকার কমে যাচ্ছে, কমে নিঃশেষ হওয়ার পথে যাচ্ছে। তবে এসব পেশা উদ্যোক্তাদের জীবনের আর কোনই সম্ভাবনা নেই, ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। বরং ব্যাপারটা একটা ঢেলে সাজানো ধরনের কিছু; যা পুরনোদের একেবারেই বাদ দেয়া নয়। বরং নতুন কিছু করা, কিছুর বেলায় নতুন পরিস্থিতির সাথে খাপখাইয়ে নেয়ার সুযোগ বের করা, কিছুতে নিজের প্রতিযোগী অবস্থান ধরে রাখতে নিজে লাভ ছাটাই করে প্রতিযোগিতায় নেমে যাওয়া ইত্যাদি এসব করে পেশা উদ্যোক্তাদের অনেকটাই বাঁচানো সম্ভব। আর সর্বোপরি চীনের সাথে একটা বড় বারগেন করা। যত বেশি পারা যায় (কৃষি বা শিল্পপণ্যের) বাজার ছাড় চীনের থেকে নিয়ে আসা, তেমন রাজনৈতিক নেগোসিয়েশন করার সুযোগ এখনো যা আছে তা ব্যবহার করা। এক কথায় চীনকে গ্লোবাল নেতৃত্ব ছেড়ে দেয়ার বিনিময়ে নিজের পক্ষে বাজার ছাড় যতটা সম্ভব ফিরিয়ে হাতে আনা, ধরে রাখার জন্য দরকষাকষি করা – এই মূলনীতিতে চলা। বাইডেন সম্ভবত সে দিকেই যাচ্ছেন। কিন্তু এমন অনুমানের ভিত্তি কী? কারণ হংকংভিত্তিক এশিয়ান টাইমসে এমন রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে কুর্ট ক্যাম্পবেল [Kurt Campbell] এই নামের ওবামা আমলের এক সহকারি-পররাষ্ট্রমন্ত্রীর [assistant secretary of state for East Asian and Pacific affairs] কথা বলা হয়েছে। যদিও তিনি ভুমিকা রাখবেন বাইডেন প্রশাসনের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল অফিসে, পররাষ্ট্র দফতরে নয়। আর সেটা বাইডেন যাকে ন্যাশনাল সিকিউরিটি এডভাইজার বলে পছন্দ করেছেন সেই জ্যাক সুলেভান [Jake Sullivan] হলেন ক্যাম্পবেলের পলিসি পেপার লেখার সহ-লেখক। তাঁদের যৌথভাবে লেখা ও ফরেন এফেয়ার্সে প্রকাশিত তাঁদের সে লেখার শিরোনাম “Competition Without Catastrophe: How America Can Both Challenge and Coexist With China,” । অনুমান করা হচ্ছে এটাই হবে বাইডেনের চীন-নীতির প্রধান অভিমুখ। লেখার শিরোনামটা বাংলায় বললে তা হবে, কোন বিপর্যয় না ঘটিয়ে প্রতিযোগিতা করাঃ কি করে আমেরিকা চীনকে চ্যালেঞ্জও করবে আবার চীনের সাথে একসাথে টিকে থাকার নীতিতে চলতে পারে”। এই কথাটাকেই উপরে বলেছিলাম, – “চীনকে গ্লোবাল নেতৃত্ব ছেড়ে দেয়ার বিনিময়ে চীনের থেকে আপোষে নিজের পক্ষে বাজার ছাড় যতটা সম্ভব ফিরিয়ে হাতে আনা, ধরে রাখার জন্য দরকষাকষি করা – এই মূলনীতিতে চলা”।
যদিও গত চার বছর ট্রাম্প এর উল্টো পথে চলেছেন। ট্রাম্প ও তার প্রমোটার ও অদৃশ্য উপদেষ্টারা ভেবেছেন, এগুলো হোয়াইট সুপ্রিমিস্টদের মত সংগঠন বা তাঁদের চিন্তা দিয়ে পরিচালনা করতে হবে। আর কথিত আমেরিকান “জাতিকে” চীনের বিরুদ্ধে সংগঠিত করতে পারলেই মোকাবেলা করা সম্ভব হবে। এছাড়া যদিও একথা সত্য যে, আমেরিকা এখনো সামরিকভাবে চীনের থেকে ৬-৮ গুণ বড় বা শ্রেষ্ঠ। কাজেই এদের অনুমান, এই কারণে আমেরিকা কেন চীনের কাছে হেরে যাবে বা হার স্বীকার করবে! কিন্তু এদের এমনই চিন্তার ত্রুটির দিকটা হল এরা মনে করে, চীনের গ্লোবাল অর্থনৈতিক সামর্থ্যকে পাল্টা যেন আমেরিকার সামরিক সক্ষমতা দিয়ে মোকাবেলা করা সম্ভব!
গত ৮ জানুয়ারি রয়টার্স একটা ইন-ডেপথ নিউজ করেছে; যার শিরোনাম হল – ‘ট্রাম্পের ফ্যানরা সহিংসতার নিন্দা করে কিন্তু তাই বলে ট্রাম্প এজন্য দায়ী তা আবার মনে করে না [Trump’s fans condemn violence, but they aren’t about to blame him]।’ গত ৬ জানুয়ারি আমেরিকান সংসদে হামলার পর রয়টার্স দেখানোর চেষ্টা করেছে যে ট্রাম্পের ভোটার সমর্থক কারা? কেমন পেশার লোকজন আর সংসদে হামলা নিয়ে তাদের ক্ষোভ বা বক্তব্য কী? দেখিয়েছে, এরা ছোট শপে, রেস্টুরেন্টে বা সিকিউরিটি কোম্পানিতে চাকরি করে। তাদের দাবির সারকথা হিসেবে রয়টার্স বলছে, তারা কেউই এখনোও ট্রাম্পকে ত্যাগ করতে চায় না। বরং তাঁদের ধারণা ট্রাম্প হল তাদের আর্থিক অবস্থা-পরিস্থিতির পক্ষের প্রবক্তা, তুলে ধরার লোক। কিন্তু তাই বলে তারা সংসদে ভায়োলেন্স বা সহিংসতার দায় নিতে চায় না। ট্রাম্পের উপরেও দিতে চায় না। কারণ এতে আইন ভাঙ্গার দায় আছে। যা তাঁদের শ্রেণীর লোকেরা অবশ্যই জড়িত নয়। মূলত কর্মজীবি তারা ঐদিন সংসদে হামলা করতে সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের সাথে সঙ্গী হয় নাই।
যদিও বলছি, গত চার বছর ট্রাম্প চলেছেন উল্টো বা ভুলনীতি নিয়ে। নিজের ক্ষ্যাপাটে নীতিতে। একটা উদাহরণ এখানে টানলে বাস্তবতাটা আরও স্পষ্ট বুঝা যাবে। যেমন ট্রাম্প এতদিন সাধারণভাবে আমেরিকায় উপস্থিত চীনা কোম্পানির উপর বা বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হওয়ার নীতিতে চলেছিলেন। চীনা কোম্পানিমাত্রই, বিশেষ করে টেলিফোন কিংবা ইলেকট্রনিকস সম্পর্কিত প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো আমেরিকা থেকে তথ্য পাচার করছে অথবা এরা চীনা সামরিক বাহিনীর সাথে জড়িত ভাড়াটে অথবা বাহিনীর হয়ে তথ্য পাচার করছে, – ইত্যাদি এগুলাই ছিল ট্রাম্প প্রশাসনের কমন অভিযোগ বা উছিলা। কিন্তু কোনোটার বেলাতেই তিনি কোনো প্রমাণ সাথে হাজির করেননি। নেহায়তই কখনো কোনো চীনা লোকের বিরুদ্ধে আদালতে যা ক্ষুদ্র বা পেটি মামলা দেয়া হয়েছে প্রপাগান্ডার সুবিধার জন্য, তাও বেশির ভাগই আদালতেও টিকাতে পারেননি। কিন্তু জাতিবাদী বা বিদেশবিরোধী প্রপাগান্ডা যা ট্রাম্পের এক বিশেষ অস্ত্র যা সাদা সুপ্রিমিস্টদের জন্য খোরাক ও ভুয়া সুসংবাদ – এসব ঠিকই এই পেটি অভিযোগগুলো ব্যবহার করে চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেয়া হয়েছে। যেমন টিকটক সোশ্যাল মিডিয়াভিত্তিক প্রতিষ্ঠানকে নিয়েও একইভাবে তিলকে তাল বানানো হয়েছে; অতথ্য পাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে। আবার যতই আমেরিকা গত নভেম্বরের নির্বাচনের দিকে আগাচ্ছিল, সেখানে ভোট পেতে পাবলিককে প্রভাবিত করতে ততই তিনি এসব প্রপাগান্ডা চরমে তুলছিলেন। এতে শেষের দিকে তিনি আরেক নতুন নীতি হাজির করলেন। যেমন – চীনা টেক জায়েন্ট কোম্পানি – টাইটানস [Titans], আলিবাবা [Alibaba], টেনসেন্ট [Tencent], বাইদু [Baidu] ছাড়াও আরো ৯ বড় জায়ান্ট চীনা কোম্পানির নামের একটা লিস্টর বানিয়ে ট্রাম্প এবার দাবি করলেন, এগুলো চীনা সেনাবাহিনীর সাথে জড়িত কোম্পানি। এরপর সরকারি নির্দেশ জারি করলেন যে, এসব কোম্পানির সাথে আমেরিকানরা বিনিয়োগ-ব্যবসায়িক সম্পর্ক রাখতে পারবে না।
কোনো দেশ গ্লোবাল পাওয়ার হতে গেলে বা গ্লোবাল পাওয়ারের লক্ষণ হিসেবে কী থাকতে হবে এই প্রশ্নের জবাবে দুনিয়াতে মানা হয় যে ঐ দেশটা হাইটেকে কত এগিয়ে আছে, কত তার দখল এবং সর্বোপরি হাইটেকে তার মোট বিনিয়োগ কী পরিমাণ ইত্যাদি এগুলোই হল সেই বিচারের লক্ষণ।
সম্প্রতি হংকংভিত্তিক এশিয়ান টাইমস এক রিপোর্টের শিরোনাম করেছে, চীনের টেক কোম্পানি টাইটান নিয়ে। লিখেছে “ট্রাম্প চায়না টেক জায়েন্ট কোম্পানি টাইটানস-কে সাদা পতাকা দেখিয়েছে” [Trump waves white flag at China’s tech titans]।’ এখন কেন? অথচ নভেম্বর নির্বাচনের আগের ট্রাম্পের প্রপাগান্ডায় তো মনে হচ্ছিল এই তথ্য পাচার বা বিদেশি সেনা প্রসঙ্গ [যেটা জাতিবাদি রাজনীতিতে কথিত দেশপ্রেমি পাবলিককে ক্ষেপিয়ে তুলার খুবই সহজ অস্ত্র মানা হয়] তুলে তারা না চীনের সাথে যুদ্ধি না বাধিয়ে দেয়! তাহলে এখন কেন ট্রাম্প সুর বদলিয়ে নিচ্ছেন? গত নভেম্বরেরই তো নির্বাচনের আগে ট্রাম্প নির্বাহী নির্দেশ জারি করেছিলেন চীনা টেক কোম্পানির বিরুদ্ধে। অথচ আজ এর উল্টো করছেন। কেন?
কারণ ট্রাম্পের ওই সিদ্ধান্তের পর ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল, রয়টার্সের মতো আরো গ্লোবাল মিডিয়া এ সিদ্ধান্তের ব্যাপক সমালোচনা করেছিল। ওয়ালস্ট্রিট কী লিখেছিল তা এখানে জানা যাচ্ছে । আলিবাবা বাইদু নিউ ইয়র্কে রেজিস্টার্ড কোম্পানি, টেনসেন্ট হংকংভিত্তিক। এই তিন কোম্পানির মোট বিনিয়োগ হলো ১.৪ ট্রিলিয়ন ডলার, যা অস্ট্রেলিয়ার ইকোনমির চেয়েও বড়। ট্রাম্পের কী সে খবর আছে?
অর্থাৎ আসলে ওরা বলতে চেয়েছে, আমেরিকার পক্ষে এমন পাল্টা ট্রিলিয়ন ডলারের টেক কোম্পানি জন্ম দেয়ার সক্ষমতার দিন পেরিয়ে গেছে। কাজেই ওসব কোম্পানির সাথে আমেরিকার ব্যবসায়িক সম্পর্কও যদি ভেঙে দেয়া হয়, তবে আমেরিকা ততই আরো এই টেকনোলজিতে “কেউ না” হয়ে যাবে। যেমন এদিকে মোবাইল ফোনের ৫জি টেকনোলজিতে চীন এরই মধ্যে লিড নিয়ে ফেলেছে। আর আমেরিকাই কেউ না হয়ে গেছে। যেখানে আমেরিকা কিছু ভুল সিদ্ধান্তের কারণে চলতি শতকের শুরু থেকেই ফোন টেকনোলজি থেকে ছিটকে পড়ে আমেরিকা ‘কেউ না’ হয় গেছে। আর ইউরোপ কেবল কোন মতে ৫জিতে ছোট তরফের কোম্পানি হয়ে আছে।
সারকথায় কোন গ্লোবাল নেতার মূলত অর্থনৈতিক সক্ষমতা ঢলে পড়লে তখন থেকে আর এর সবাইকে শাসানো কিংবা ডমিনেট করার ক্ষমতা কোথাও থেকে যোগাড় করতে পারে না। সাধারণভাবে আমেরিকা ও বিশেষ করে ট্রাম্পের আমেরিকা এখন এমন লুজার হয়ে গেছে। তাই এই অবস্থায় ট্রাম্পের মত জাতিবাদী নেতারা তখন আর আমেরিকা ফার্স্ট বা জাতিবাদী স্লোগান বা সাদা সুপ্রিমিস্ট জজবা তুলে কিছুই ঠেকাতে পারবে না। চেয়ে চেয়ে কেবল নিজের হার আর দুর্দশাই দেখার দিকেই এরা ক্রমশঃ যাচ্ছে!
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
[এই লেখাটা গত ১৬ জানুয়ারি ২০২১, দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ওয়েবে ও প্রিন্টেও “ট্রাম্পের শত্রু কে, চীন না বাইডেন” – এই শিরোনামে ছাপা হয়েছিল। পরবর্তিতে ঐ লেখাটাকে এখানে আরও নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে ও নতুন শিরোনামে এখানে আজ ছাপা হল। ]