চীনবিরোধী বাইডেন হবেন, ব্যালেন্স তো ইইউর হাতে
গৌতম দাস
০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০০:০৬ সোমবার
EU-China investment agreement raises tensions with US
দীর্ঘ ৩০ বছরের সার্ভিস-জীবনের এক ভারতীয় ক্যাডার কূটনীতিক, নাম এম কে ভদ্রকুমার, এখন অবসরে আছেন। পূর্ণ রাষ্ট্রদূত ছিলেন সর্বশেষে তুরস্কে ও উজবেকিস্তানে। এ ছাড়া উপ-রাষ্ট্রদূতও ছিলেন অনেক রাষ্ট্রে – পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরানসহ অনেক দেশেই। কিন্তু এসব বিচারে তিনি বিশেষ কেউ নন; তাঁর বিশেষত্ব অন্যখানে। অনেকে বলতে পারেন, তিনি আন্তর্জাতিক নীতি পলিসি বা অভিমুখগুলো নিয়ে গবেষক ও লেখক। নিয়মিত প্রতি সপ্তাহে, দুহাতে লেখা এই লোকের তিন-চারটি লেখা দেশে-বিদেশের বিভিন্ন পত্রিকায় এখন ছাপা হয়। তবু এগুলোও তাঁর মূল বিশেষত্ব নয়।
চলতি শতকের শুরু থেকেই আমেরিকা ভারতের ওপর মনোযোগ ঢেলে প্রভাব বিস্তারে দেশটাকে নিজ কাজে লাগায়; তার ‘চীন ঠেকানোর’ [China Containment Policy] কাজের ঠিকা ভারতকে দেয়া আর ভারতের একাডেমিক জগতের মাস্টার্স বা হায়ার স্টাডিজের স্কলারশিপ বিতরণ করে লোভ দেখিয়ে আমেরিকান বয়ান মননে ঢুকিয়ে দেয়া, আবার আমেরিকান থিংকট্যাংকের ভারতীয় শাখা খুলে দেয়া ইত্যাদি শুরু হয়েছিল। ফলে ডিপ্লোম্যাটরা চাকরিতে থাকা অবস্থা থেকেই ওসব বয়ানে অনুরক্ত হতে শুরু করেছিলেন যাতে চাকরি শেষে অবসরে যাবার পরেও কোনো থিংকট্যাংকে আবারও চাকরি পাওয়া যায়। এসব বিচারে একেবারেই ব্যতিক্রম হলেন ভদ্রকুমার। তিনি অনেকের চেয়েই সক্ষম এবং স্বাধীন গবেষক ও লেখক। তিনি আমেরিকান বয়ান বা তাদের অর্থ দ্বারা প্রভাবিত কোনও থিংকট্যাংকের সাথে যাননি। নিজের স্বাধীন চিন্তা অবস্থান নিয়ে এখনও লিখে চলেছেন। যেমন ভদ্রকুমারই সম্ভবত একমাত্র ভারতীয় যিনি মনে করেন ভারতের যুক্ত থাকা এমন ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ স্ট্রাস্টেজিক জোট বা ‘কোয়াড’ জোটের, একদম কোনো ভবিষ্যৎ নাই। ফলে ভারতের এই যুক্ত থাকা ‘খামোখা’ মনে করেন। তবে তাঁর ব্যক্তিত্বের আরেক গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, তাঁর নিয়মিত কালেকশনে থাকে প্রচুর তথ্য ও ইন্টেলিজেন্স (রাশিয়ানটা-সহ) যা তিনি নিজের লেখায় ব্যবহার করেন যেটা সম্ভবত তার কূটনীতিক জীবনের ধারাবাহিকতায় প্রাপ্ত প্রবেশ-অধিকারের বদৌলতে।
ইতোমধ্যে বাইডেন প্রশাসনের ক্যাবিনেট সদস্যদের নিয়োগে ‘সিনেটে অনুমোদন’ পাওয়ার কাজ শেষ হয়েছে। তারা এরপর নতুন প্রশাসনের নীতি-পলিসিগুলো নিয়ে নিজেরা পারস্পরিক সমন্বয় শেষে কাজে নেমে পড়ছেন আস্তে ধীরে। সভা সেমিনারে গিয়ে নতুন প্রশাসনের পলিসি নিয়ে মুখ খোলাও শুরু হয়েছে। সেসব নিয়ে ভদ্রকুমারের একটা বড় রচনা ছাপা হয়েছে হংকংভিত্তিক ‘এশিয়া টাইমস’ পত্রিকায়। সে লেখাকে পটভূমিতে রেখে আজকের প্রসঙ্গ।
ভদ্রকুমার হদিস দিচ্ছেন আমেরিকায় নয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী (সেক্রেটারি অব স্টেট) অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন ভারতের মন্ত্রী জয়শঙ্করের সাথে ফোনে কথা বলেছেন। জানা গেল, সে কথা খুবই সংক্ষিপ্ত; মূলত সৌজন্য বিনিময় দিয়ে শুরু করা মাত্র। ফলে ঠিক কী কথা হয়েছে সেটা জানার চেয়ে এই কথা সম্পর্কে ভারত ও আমেরিকা উভয়েই প্রেসের জন্য নোট (Readout) নিজ নিজ ওয়েবসাইটে কী টাঙিয়েছে, সেটা দেখা দরকার।
যেমন দেখা যাচ্ছে সেখানে ভারত অর্থহীন ফুলানো শব্দগুলো ব্যবহার করেছে বেশি। মূলত ভারত ওখানে যা বলতে চেয়েছে তা হল – আমরা আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এগিয়ে নিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এধরণের রুটিন কথা। কিন্তু ভারত সেটাকে ফুলিয়ে বলেছে, “আমাদের বহুমুখী স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ পোক্ত করতে আর বিস্তার ঘটাতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ” […consolidate and expand the multi-faceted strategic partnership]। আর যে কথা মনে করে সম্ভবত এসব লিখেছে সেটা হল, কেবল আমেরিকার অস্ত্র কেনাকেই ভারত এক ‘স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্ক’ বলে জ্ঞান করা হয়েছে। কারণ প্রপাগান্ডা যাই থাক, ভারতের সাথে আসলে পুরা ট্রাম্পের আমলে তেমন কোনো সম্পর্কই ছিল না, ভারতের আমেরিকান অস্ত্র কেনা ছাড়া। আর অস্ত্র কেনাবেচাতে আমেরিকার দিক থেকে বহুবিধ শর্তাবলি থাকে। অস্ত্র কিনতে ভারতের সেসব শর্ত মেনে চলাকেই এখানে মূলত ‘স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ’ বলা হচ্ছে। যেমন এমনই অস্ত্র কেনাবেচার একটা সাইড চুক্তি, ‘ইন্ডিয়া-ইউএস ২+২’ এই শিরোনামে। মানে দুপক্ষ থেকে দুইটা করে মন্ত্রী (পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা) যুক্ত থেকে এই চুক্তি তাই ২+২। তাই আবার ভারতের কথিত ‘বহুমুখী’ (মাল্টিফ্যাসেট multi-faceted) শব্দটা অবশ্যই অহেতুক; কিছুই প্রকাশ করে না এমন, কথার কথা। আসলে ভারত বলতে চেয়েছে, ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ হবুজোট ও ‘কোয়াড’ জোট নিয়ে আমাদের সম্পর্ক আছে। কিন্তু এখন ভারতের সন্দেহও আছে যে, এই কথাগুলোতে আসলে ট্রাম্পের চীনবিরোধী পলিসি ও কিছু বকোয়াজেরও অংশ ছিল, যা আসলে বাইডেনও মেনে চলবেন কি না, নিজের বলবেন কি না তা নিয়ে ভারত নিশ্চিত নয়; সন্দেহ করে। তাই ভারত নিজের রিড-আউটে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ ও ‘কোয়াড’ এই শব্দদুটো ব্যবহারই করে নাই আর বরং তা না করে আরও আবছা এক শব্দ ‘বহুমুখী’ বলে সব ঢাকা দিয়েছে আপাতত। কারণ ভারতের এই প্রেস বিফিং (রিড-আউটটা) ড্রাফটের সময়ে তখনও সে জানে না, আমেরিকা তাদের রিড আইটে ঠিক কী লিখে রাখবে। তাই আমাদের এই অনুমানটা দেখা যাচ্ছে সঠিক কারণ এখন আমরা আমেরিকা কী লিখে রেখেছে, রা জানি। কিন্তু তামশাটা হল, ভারত ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ ও ‘কোয়াড’ শব্দ দুটোতে দ্বিধা রেখে তা আর ব্যবহারে করেনি। অথচ আমেরিকা বলেছে, মানে ব্যবহারে এনেছে শব্দ দুটো। যদিও এর অর্থ বদলে দিয়ে। লিখেছে, আমরা ‘ইন্দো-প্যাসিফিকে আমেরিকার হবু পার্টনার হিসেবে ভারতের ভূমিকায় জোর দেই’ এবং ‘কোয়াডের মাধ্যমেসহ একসাথে কাজ ও সহযোগিতার দিকে গুরুত্ব দেই” [The Secretary underscored India’s role as a preeminent U.S. partner in the Indo-Pacific and the importance of working together to expand regional cooperation, including through the Quad. ]।
তাহলে ব্যাপারটা কেমন হল? ভারত শব্দ দুটো উল্লেখ করলই না অথচ বাইডেনের আমেরিকা উচ্চারণ করল কেন? কারণ ভারত জানত, ট্রাম্পের সময়ের এশিয়ার এই দুই ইস্যুকে বাইডেন নিজেরও ইস্যু বলে মানবেন না। কিন্তু বাইডেন চোখবন্ধ করে শব্দ দু’টির ব্যবহার হঠাৎ করে বাদ বা একেবারে ফেলে দিবেন না। কিন্তু সাবধান, তার মানে এটা ধরে নেয়াও ভুল যে, ট্রাম্পও এই শব্দ দু’টি নিয়ে বিরাট কিছু করতেন – তা নয়। আসলে ট্রাম্প এটাকে তার আমলের চীনবিরোধী একটা সামরিক ধরনের জোট ভেবেছিলেন যেন। কিন্তু শেষে এটা আসলে তাও না; বরং একটা কথার হুমকি মাত্র – এমন করে রেখেছিলেন। আর তাই বাইডেনও শব্দ দু’টি ব্যবহারে রাখবেন, তবে তা ‘চীনবিরোধী’ এমন অর্থে বলবেন না। এমনকি এটা সামরিক জোট ইঙ্গিত করেও – এমন কোনো অর্থ তো করবেনই না। হয়তো জোটের সদস্যদের পারস্পরিক ইকোনমিক সমঝোতা ধরনের এক অর্থে রেখে দিতেও পারেন যেমনটা আমরা এখন প্রেস ব্রিফিং বা রিড-আউটে দেখছি, সে রকম। এ জন্য বাইডেন প্রশাসন বা ব্লিঙ্কেন শব্দ দু’টি কোনো সিরিয়াস বা অর্থপূর্ণ অর্থে ব্যবহার করছেন না। শুধু উচ্চারণে রেখে দিচ্ছেন। এ ছাড়া ব্লিঙ্কেনের লিখিত রিড-আউট নোটে কমন কিছু কূটনৈতিক শব্দ ও কথাও আছে; যেমন- ‘পারস্পরিক কমন উদ্বেগ বা আগ্রহের বিষয় নিয়ে আমরা কাজ করব – এসবই বাকি কথা হিসেবে সেখানে আছে। সার কথায়, পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের উভয়ের প্রথম কথা বিনিময়টায় কথার ফুলঝুড়ি অংশটাই বেশি হয়ে থাকল। অর্থাৎ কাজের কথা খুব বেশি আগাবে না, এরই ইঙ্গিত। এর মানে, সামনে ‘তিতা কথা’ বেশি হবে হয়ত।
তবে ভদ্রকুমার বলছেন, ব্লিঙ্কেন এশিয়াতে ভারতেরও আগে পূর্ব-এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর সাথে কথা বলেছেন এবং ঠিক কাজটা করেছেন [ শিরোনাম দেখেনঃ Blinken strikes the right chords toward India]। যেমন – জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ফিলিপাইন ও থাইল্যান্ড এভাবে পর্ব-এশিয়ায় কথা বলেছেন আগে।। যদিও ব্লিঙ্কেন কেবল জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার বেলাতেই একটা মুক্ত ও অবাধ চলাচলের ‘ইন্দো-প্যাসিফিক রিজিয়নের’ কথা উল্লেখ করেছেন। আবার অস্ট্রেলিয়ার বেলায় ইন্দো-প্যাসিফিকের কথা না তুলে কেবল আমেরিকার সাথে তাদের দু’রাষ্ট্র, তাদের ‘ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স’ ও ‘অটুট বন্ধন’ এসবের প্রশংসা করে কথা বলেছেন।
এরপরে ভারতের বেলায় এসে ব্লিঙ্কেন নাকি গলার স্বর নিচা করে (‘টোন ডাউন’ রেফারেন্স) ফেলেছেন; ভদ্রকুমারই বলছেন। সাথে যোগ করেছেন, ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে ভারতকে বাইডেনের আমেরিকার পাশে প্রয়োজন হলেও এই অঞ্চলে সেই ‘আকর্ষণ’ আর শক্ত হচ্ছে না বা দানা বাঁধছে না […To be sure, the US has a great need to keep India on board its “Indo-Pacific” strategy, which is not gaining traction in the region.।
কিন্তু ভারসাম্য ইইউ-এর হাতেঃ
ওদিকে এসবের আগেই আমেরিকার সাথে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্পর্ক আর আগের মত জায়গায় নেই। বিশেষত ট্রাম্পের ‘একলা চলো’, ‘কঠোর চীনবিরোধী হও’ দাবি যেটা ইইউ পছন্দ করে নাই কারণে সেটা আগেই অনেক পরিষ্কার ছিল। এসব ঘটে গিয়েছিল বিশেষত ট্রাম্পের ক্ষমতা ছেড়ে যাওয়ার দুই সপ্তাহ আগেই। ট্রাম্পের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পম্পেও গত ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলের যৌথ অধিবেশনে যখন বাইডেনের বিজয়কে ‘ফর্মাল রায়’ বলে সিল দেয়া হয়, এর পর থেকেই সব জায়গায় বাইডেন প্রশাসনকে যেন (পম্পেও-এর বিষিয়ে দেয়াতে) ইউরোপের বিরূপ মনোভাব সামলাতে হিমশিম খেতে হয়, সে জন্যই যেন পম্পেও আগেই প্রকাশ্যে ইইউকে আহ্বান রেখেছিলেন ইইউকে ‘আমেরিকা না চীন’ এ দুটার একটাকে বেছে নিতে। এরই প্রত্যক্ষ জবাব জানাতে ইইউর ফরেন পলিসি চিফ জোসেফ ব্যারেল পম্পেওর সাথে ঐ বৈঠকের ঘণ্টাখানেক আগেই ঘোষণা করে দেন যে, তারা ‘চীনবিরোধী’ কোনো ‘ট্রান্স-আটল্যান্টিক অ্যালায়েন্স’ মানে আমেরিকা-ইইউ অ্যালায়েন্স গড়ার আহ্বান প্রত্যক্ষভাবেই নাকচ করে দিচ্ছেন। সোজা কথায়, ১৪ জানুয়ারি জোসেফ ব্যারেল জানিয়ে দিয়েছিলেন, ইইউ আমেরিকার সাথে চীনবিরোধী এমন কোনো জোট করবে না।
তিনি আরো স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিলেন, “চীন-আমেরিকা সঙ্ঘাত শুরু হোক আর তারা তাতে কোনো পক্ষ নিক তা তারা কখনো করবে না। কারণ ইইউ মাল্টিলেটারিজম (বহু ধরনের রাষ্ট্ররূপের পক্ষে) ও পারস্পরিক সহযোগিতার পক্ষে। কথাটা এভাবে বলেছিলেন; কারণ চীন পশ্চিমা ধরনের কথিত ডেমোক্র্যাসির দেশ নয়, সে কথা তুলে পম্পেও ‘চীনবিরোধী ডেমোক্র্যাসিগুলোর জোট বাঁধার’ ঘ্যানঘ্যানে এক আহ্বান করে যাচ্ছিলেন। সেই সাথে একটা খুবই কড়া কথা জোসেফ ব্যারেল বলেছিলেন, ‘সামনে যাই আসুক, আমরা ইইউ আমাদের বুঝ মতোই চলব।’
ডাভোসে মার্কেলের আরও কড়া অবস্থানঃ
ঘটনা সেখানেই থেমে গেলে হয়ত এক রকম হত; কিন্তু তা হয়নি। এরপর সুইজারল্যান্ডের ডাভোসে এবারের জানুয়ারিতে “ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের” [WEF]’ সম্মেলনও এবার স্বাভাবিক সিডিউল মত আয়োজিত হয়েছিল ২৫-২৯ জানুয়ারি, তবে ভার্চুয়ালি। মানে, যার যার দেশে বসে কিন্তু অনলাইনে। সেখানে জার্মান চ্যান্সেলর মার্কেল ‘বোমা টা ফাটান’। ইউরোপীয় ‘পলিটিকো’ [Politico] পত্রিকা বলছে, তিনি ডাভোসে পরিষ্কার করে বলেন, ‘আমি খুবই চাইব, কোনো ধরনের ব্লক তৈরি এড়িয়ে চলতে চাই। আমি কল্পনা করি না যে, আমাদের বলতে হয়, এই যে দেখো এটা হলো আমেরিকা আর ওই দূরেরটা হলো চীন আর এভাবে আমরা গ্রুপে বিভক্ত হয়ে গেছি। সামনের দিনে এমনটা হতেই হবে- এটা আমার বোঝাবুঝি নয়। এমন হলে অন্য ধরনের সমাজগুলোর (আমাদের মতো নয় বলে) প্রতি অবিচার করা হবে” [“I would very much wish to avoid the building of blocs,” Merkel told the Davos World Economic Forum. “I don’t think it would do justice to many societies if we were to say this is the United States and over there is China and we are grouping around either the one or the other. This is not my understanding of how things ought to be.”] ।
মার্কেল এখানেই থামেননি। ডাভোসে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, তিনিও অনলাইনে উপস্থিত ছিলেন। মার্কেল তার রেফারেন্স তুলে বলেন, চীনা প্রেসিডেন্ট কালকে (আমার সাথে) বক্তৃতা করেছেন। সেখানে তিনি ও আমি একমত হয়েছি যে, আমাদের এক বহু রাষ্ট্রীয় (বহু ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থা) ব্যবস্থাই দরকার [Referring to Xi’s speech at the same forum, Merkel said: “The Chinese president spoke yesterday, and he and I agree on that. We see a need for multilateralism.”]। … তবে সেখানে আরেকটা প্রশ্নও ছিল। প্রশ্নটা সম্ভবত আমরা যখন বিভিন্ন সোস্যাল মডেলে বসবাস করি সে সংক্রান্ত। এতে কখন হস্তক্ষেপের শুরু আর কোথায় এর শেষ? আর কখন আমরা এক মৌলিক মূল্যবোধের ওপর দাঁড়াতে পারব যা আমাদেরকে আর বিভক্তিতে ফেলবে না? মার্কেল এতদূর পর্যন্ত বলেছেন [“But there is one question where we are not in immediate agreement. Probably the question of what it means when you have different social models. When does interference begin and where does it end? When do you stand up for elementary values that are indivisible?”] । তিনি একই সাথে সম্প্রতি স্বাক্ষরিত হয়ে যাওয়া চীন-ইইউ ‘কম্প্রিহেনসিভ অ্যাগ্রিমেন্ট অন ইনভেস্টমেন্ট’ বা সিএআই [CAI] চুক্তি নিয়ে নিজের সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।
এ থেকে এখানে অনুমান করে একটা কথা আগেই বলে দেয়া যেতে পারে যে, আগামীতে বাইডেন প্রশাসন চীন-আমেরিকা হবু-সম্পর্ককে যেখানে নিয়েই থিতু বা শেষ করুক না কেন তা আর দুনিয়াকে (চীন ও আমেরিকা ব্লক) দুই ভাগ করতে পারছে না। কারণ ব্যালেন্স বা ভারসাম্য তৈরির ক্ষমতা এখন ইইউর হাতে। চীন-ইইউ চুক্তিই সেই ব্যালেন্স- মানে ভারসাম্যের উৎস। অর্থাৎ বাণিজ্যযুদ্ধ নয় বরং একটা ‘ওয়ার্কেবল বাণিজ্য সম্পর্ক’ এর মধ্যেই বাইডেনকে বাণিজ্যবিরোধের রফা খুঁজতেই হবে। তা তাদের দুই দেশকেই। কারণ চীনবিরোধী কোনো ইইউ-আমেরিকা জোট পাকানোর সব সম্ভাবনা এখন শেষ।
ভদ্রকুমার তাই এখন এই পটভূমিতে বলছেন, ব্লিঙ্কেন দায়িত্বভার নেয়ার শুরুতেই প্যারিস, বার্লিন, লন্ডন বা ব্রাসেলস যাদেরই পররাষ্ট্র দফতরের সাথে কথা বলেছেন সেখানে কোথাও ‘ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি’ শব্দটাই তিনি ব্যবহার করেননি, আমেরিকার রিড-আউট তাই বলছে।
ভদ্রকুমার আরো জানাচ্ছেন, ব্লিঙ্কেন সিনেটে অনুমোদন পাওয়ার তিন দিন পর এসব উল্লেখ করেছিলেন। এরও দুই দিন আগে ২৭ জানুয়ারি ভারত ও আমেরিকা দুই দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী পর্যায়েও টেলিফোনে সৌজন্য বিনিময় হয়েছে। অর্থাৎ খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো কথা সেখানে ছিল না।
ব্লিঙ্কেনের আফগানিস্তান ও পাকিস্তানেও ফোনঃ
এ দিকে ভদ্রকুমার আরো জানাচ্ছেন, ঐ দিনই ব্লিঙ্কেন আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথেও একইভাবে কথা বলেছেন। সেখানে ট্রাম্পের ফেলে যাওয়া আধাখেঁচড়া এক কারবার হল, তালেবানদের সাথে যে সমঝোতা ডিল তিনি করেছিলেন, তা ট্রাম্পের শেষ সময় থেকেই অকার্যকর “ঢলে পড়া” শুরু হয়েছিল। বাইডেনকে তাই এখন আবার তালেবানদের সাথে কথা শুরু করতে হবে। আর তাতে আমেরিকার জন্য আবার পাকিস্তান খুবই গুরুত্বপূর্ণ পার্টনার হতেই হবে। তাই ভদ্রকুমার মনে করেন, বাইডেন রেডি হচ্ছেন পাকিস্তানের সাথে আগের মতই ঘনিষ্ঠ পার্টনারের সম্পর্ক করতে। আবার মোদীদি সরকারকে সাবধান করে তিনি লিখেছেন, বাইডেন প্রশাসন যদি এই পর্যায়ে চীনের কোন সহযোগিতা চেয়ে বসে তাতে ভারত যেন অবাক না হয়!
দুনিয়া আসলেই বদলে যাচ্ছে যা আগে কল্পনাও করা যায়নি!
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
[এই লেখাটা গত ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১, দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ওয়েবে ও পরদিন প্রিন্টেও “চীনবিরোধী হবেন, ব্যালেন্স ইইউর হাতে” – এই শিরোনামে ছাপা হয়েছিল। পরবর্তিতে ঐ লেখাটাকে এখানে আরও নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে ও নতুন শিরোনামে এখানে আজ ছাপা হল। ]