“India has no military capability to alter the situation”
– Indian Gen. Panag
[সার-সংক্ষেপঃ লাদাখ, ভারতের উত্তর-পুর্বে চীন-ভারত সীমান্তের নাম। গত ২০২০, মে মাস থেকে এই সীমান্তে চীন ও ভারত মুখোমুখি সেনা সমাবেশ ঘটিয়ে বসেছিল। আর ১৯৯১-৯৪ সালের সময়গুলোতে ভারত-চীন সীমান্ত আলোচনায় আপোষে চীন যেসব ভুখন্ড ভারতের অনুকূলে ছেড়ে দিয়েছিল, যা ভারতের (LAC) এলএসিতে পাওয়া ভুখন্ড মনে করা হয়, সেসব ভূখন্ড চীন মে মাসের ঐ সময়ে ফিরে দখল করে নিয়ে বসে গিয়েছিল।
এই নিয়ে এক সামরিক সংঘাতে ১৫ জুন ২০২০ তারিখে ২০জন ভারতীয় সেনা নিহতও হয়েছিল। কিন্তু তা সত্বেও মোদি সেসময় সংসদে ও রেডিও বক্তৃতায় বলেছিলেন, “... neither has anyone entered Indian territory, nor is anyone present in Indian territory currently, and nor is any Indian post captured”। আসলে চীন গতবছর মে মাসের শুরু থেকেই ১৯৯১-৯৪ সালে ভারতকে ছেড়ে দেওয়া ভুখন্ডগুলোই পুনর্দখল করে বসেছিল। কিন্তু একথা সত্যি হওয়া সত্বেও ২০জন ভারতীয় সেনা হত্যা হওয়ার পরও মোদি অমন বিবৃতি দিয়েছিলেন। কেন?
এর জবাব এখন পরিস্কার জানা যাচ্ছে। আসলে ১৯৯১-৯৪ সালে ভারতকে ছেড়ে দেওয়া LAC-এ পাওয়া ভূখন্ডগুলোই পুনরায় দখল কথার মানে হল এর আগের ১৯৫৯ সালের চীনের দাবিকৃত ভারত-চীন সীমান্তরেখা। এখন ভারত-চীন আলোচনায় ভারত ১৯৫৯ সালের চীনের দাবিকৃত ভারত-চীন সীমান্তরেখাকেই ভারতও তাঁদের স্থায়ী সীমান্তরেখা বলে মেনে নিয়েছে। উভয়পক্ষ এই ভিত্তিতেই সীমান্তে সেনা সমাবেশ ভেঙ্গে দিতে ১৯৫৯ সালের সীমান্তরেখা অনুসারে এর দুই পাড়ে নতুন সীমান্ত বরাবর সেনা প্রত্যাহার করতে সম্মত হয়েছে এবং ধাপে ধাপে সেটির বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সে অনুযায়ী, প্রথম পর্ব ছিল ‘প্যাংগং সো (Pangong Tso) লেকের দুই পাড় থেকে সেনা ও স্থাপনা প্রত্যাহার। গত ১১-১৯ ফেব্রুয়ারি সিদ্ধান্ত মতই এই প্রত্যাহার কোনো ব্যত্যয় ছাড়াই সম্পন্ন হয়েছে। আর ভারতের এই সীমান্তেরই এক সাবেক জিওসি লে জে পরাগ; এই ব্যাপারটাকে দেখে বলেছেন, … the “disengagement” is happening exactly as per China’s 1959 claim line because India has no military capability to alter the situation….it is “good for the long term peace” ।
সোজা বাংলায়, আমাদের সামরিক মুরোদ নাই তাই চীনের দাবি মোতাবেক ১৯৫৯ সালের সীমান্ত আমরা মেনে নিয়েছি। এটা দীর্ঘস্থায়ী শাস্তির জন্য ভালই হয়েছে”। কিন্তু কেন ভারতকে এমন পাওয়া-ভুখন্ড ফিরে ত্যাগ করতে বা হারাতে হচ্ছে?]
Ladakh Stand-Off: India & China, Pangong Tso withdrawal done
একদম বেড়াছেড়া!
পথ চলতে চলতে পথিক কখন কোথায় নিজের জামাকাপড় খুইয়ে এসেছে সে হুশই নাই! যখন খেয়াল হল তখন এক বেড়াছেড়া অবস্থা! কেন? কারণ এখন লজ্জা ঢাকে কী দিয়ে সে এক কঠিন সমস্যা। আরেকদিকে, কৌতূহলী আশেপাশের মানুষকে কিভাবে কেন এসব হল তার ব্যাখ্যাও দিতে পারছে না। কাজেই, এ এক বেড়াছেড়া অবস্থা বটে!
বেড়াছেড়া শব্দটা কথ্য ভাষায় প্রচলিত শব্দ; তাই অনেকে একে ইনফরমাল শব্দ বলবেন হয়ত। তবু ‘বেড়াছেড়া’ শব্দটা আসলে খুবই এক্সপ্রেসিভ মানে, যা ঘটেছে তাকে এক শব্দে ফুটিয়ে তুলতে এক উপযুক্ত-প্রকাশক শব্দ। ইন্ডিয়া, মানে ভারতের মোদি সরকারের আজ এমনই বেড়াছেড়া দশা।
কেন? কী হয়েছে??
এবারে মোদির কাপড় খুলে নেয়ার অবস্থার শুরু বলা যায় গত ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে। লাদাখ – ভারতের ভাষায় তার উত্তরপূর্ব কোণের ভারত-চীন সীমান্ত যেখানে দুই দেশের সৈন্য মুখোমুখি হয়ে বসে আছে গত ২০২০ সালের মে মাস থেকে। ভারত (মিডিয়াও) এটাকে এক ‘অচলাবস্থা’ (standoff) বলে বর্ণনা করে এলেও চীনের কাছে ব্যাপারটা এমন অচল নয়। কারণ পরিস্থিতি ক্রমশ তার পক্ষেই এগিয়ে চলেছে। যেন – এবার ঘুঘু ধরা পড়েছে, অপেক্ষা কেবল তাকে কাচিয়ে উপরে তুলে পাকড়াও করার অবস্থা। এবং তাই হতে যাচ্ছে আসলে।
কারণ অবশেষে মোদি চীনের কাছে ‘ভূখণ্ড হারিয়েছে’ স্বীকার করে নেয়ার পর উভয়পক্ষই যার যার সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে সম্মত শুধু না, তা বাস্তবায়নের প্রথম পর্যায়ও শেষ করে ফেলেছে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি। কথাটার মানে হল, চীন-ভারতের সীমান্তের যত জায়গায় সৈন্য সমাবেশ করা হয়ে আছে/ছিল তার একেকটা এলাকা থেকে ধাপে ধাপে সেনা প্রত্যাহার শুরু হয়েছে। এরই প্রথম এলাকা ‘প্যাংগং সো’ নামে লেকের দুই পাড় থেকে প্রত্যাহার, যা গত দশ দিনে শেষ হয়ে গেছে। এখন পরের পর্বের প্রত্যাহার নিয়ে ফোর্স পর্যায়ে কথা বলা ও বাস্তবায়ন শুরু হবে।
সেনা প্রত্যাহার কোথায় গিয়ে থামবে, নতুন কোন সীমান্তেঃ
কিন্তু মূল প্রশ্ন : উভয়পক্ষ সৈন্য প্রত্যাহার করবে না হয় বোঝা গেল কিন্তু প্রত্যাহার করে কোথায় গিয়ে থামবে? অর্থাৎ কোনটাকে এখন নতুন সীমান্ত বলে উভয়পক্ষ মেনে চলবে? কারণ সব ফাটাফাটি সংঘাত বা মূল বিতর্কের উৎসই তো ছিল সেটাই!
না, নতুন সীমান্তরেখাও এখন আর অমীমাংসিত নয়। লক্ষ করা যায়, চীন পা-ফেলে থাকে সাধারণত অনেক ক্যালকুলেশন করে। আসলে গত বছরের ৫ মে এর শুরু থেকেই চীন নিজের সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়েছিল ১৯৫৯ সালের এলএসি [Line of Actual Control, LAC] বা গৃহীত সীমান্তরেখা মেনে।
যদিও কী মেনে চীন একাজ করছে তা কখনো প্রকাশ্যে বলেনি। কিন্তু “১৯৫৯ সালের সীমান্তরেখায়” ফিরে যেতে বলে চলেছিল ভারতের সাথে সব মিটিংয়েই। আর এখনকার সমঝোতাও হচ্ছে সেই ‘১৯৫৯ সালের সীমান্তরেখা’ মোদির ভারতের মেনে নিতে রাজি হওয়ার বিনিময়ে। কাজেই উভয়পক্ষের সৈন্য ‘১৯৫৯ সালের সীমান্তরেখার’ দুই পাড়ে যার যার দেশের সংলগ্ন অংশে গিয়ে বসবে। আর সেটাই হবে নতুন সীমান্তরেখা।
এটাই সৈন্য প্রত্যাহারের ভিত্তি বলে মেনে নিতে মোদি রাজি হয়েছেন। যদিও মোদীর জন্য এখন এটাই বিরাট সমস্যা আর ইজ্জতের ব্যাপার যে পাবলিকের কাছে তিনি এই ‘ভূমি হারানোর আপস ও বিনিময়ের কথা কিভাবে বলবেন!
পাঠক যারা কম সময় দিতে চান, কম বিস্তারে পড়তে তারা নিচের ছোট প্যারার অংশটুকু বাদ দিয়ে সরাসরি পরের প্যারায় চলে যেতে পারেন।
‘১৯৫৯ সালের সীমান্তরেখা’ কী?
একটা বড় তথ্য দিয়ে রাখি। ‘১৯৫৯ সালের সীমান্তরেখা’ কথাটা মূলত চীনের প্রস্তাবিত একটা সীমান্ত ধারণা। কিন্তু তা উভয়পক্ষের সম্মতিতে আঁকা কোনো ম্যাপ – ঠিক তা নয়। এটা ১৯৫৯ সালে চৌ এনলাই ও নেহেরুর এ’দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যকার চিঠি চালাচালির ঘটনা যেখানে চৌ নেহেরুকে “ম্যাকমোহন লাইন” [McMahon line] মেনে সীমান্ত টানার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।“ম্যাকমোহন লাইন” প্রসঙ্গে বেশি বিস্তারে যাব না। কমকথায় বললে, এই লাইন টেনে ঝগড়া মিটাবার চেষ্টাটা ১৯১৪ সালের, তিব্বতকে নিয়ে। হ্যাঁ, তিব্বতকে নিয়ে। কিন্তু তিব্বতের দুর্ভাগ্য হল, তিব্বত স্বাধীন নাকি চীনের অধীনে স্বায়ত্বশাসিত প্রদেশ এই নিয়ে বিতর্ক মাও-এর আগের চীনা-জাতিবাদী শাসক চিয়াং কাইশেকের আমলের। যদিও ভারতের দিক থেকে অনেকে সময় ধারণা দিবার চেষ্টা করা হয় যে কমিউনিস্ট মাও খারাপ ও এগ্রেসিভ বলে তিব্বত নিয়ে সমস্যা তৈরি করেছেন তিনি, ফলে দালাই লামাকে নিয়েও।
অথচ ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। ম্যাকমোহন লাইন এর প্রমাণ। এটা ১৯১৪ সালের জুলাইয়ে ঘটনা যখন তিব্বত প্রদেশের সাথে এর সীমান্ত সংলগ্ন বৃটিশ-ইন্ডিয়ার কমন সীমান্ত ম্যাপ কী হলে উভয় পক্ষ তা মেনে নিবে সে আলোচনা চলছিল, এটাই সেকালের দশ মাস ধরে চলা সিমলা কনফারেন্স চুক্তি [Simla Accord] নামেও পরিচিত।
ম্যাকমোহন ছিলেন বৃটিশ-ইন্ডিয়ান সেনা অফিসার ও পরে বৃটিশ-ইন্ডিয়া সরকারের বিদেশমন্ত্রী এবং সে হিসেবে তিনি ঐ সীমান্ত আলোচনার প্রধান নেগোশিয়েটর। তাই তার নামেই ম্যাকমোহন লাইন বলে সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষরের দিন ঠিক হয়েছিল। তিব্বত প্রদেশের প্রতিনিধিসহ কেন্দ্রের চিয়াং কাইশেক সরকারের প্রতিনিধিও উপস্থিত হয়েছিলেন। কিন্তু শেষে কাইশেক সরকারের প্রতিনিধি স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করেন এই যুক্তিতে যে তাঁদের চোখে তিব্বত তো মূলচীনের-ই প্রদেশ। কাজেই তিব্বত কিভাবে স্বাক্ষরদাতা পার্টি হয় এই ছিল তাঁদের আপত্তি।
অর্থাৎ তাঁদের আপত্তি ঠিক বৃটিশ-ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে নয়। তিব্বত স্বাধীন দেশ/ প্রদেশ কিনা সেই বিতর্ক। তাই পরবর্তিতে চীন মাওয়ের বিপ্লবের অধীনে কমিউনিস্ট চীন হয়ে গেলে কমিউনিস্ট চীনের অফিসিয়াল অবস্থান হয়ে যায় এটি যে, তিব্বত চীনের প্রদেশ আর ম্যাকমোহন লাইনই ভারতের সাথে সীমান্তরেখা। কিন্তু ততদিনে আবার নেহেরুর ইন্ডিয়া সেটা গ্রহণ করতে চায়নি। কারণ ইতোমধ্যে ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধে চীন আরও ভুখন্ড দখল করেছিল। যেটা পরে অবশ্য ছেড়েও দেয়। এরপর থেকেই [Line of Actual Control, LAC] বা গৃহীত সীমান্তরেখা কথাটার উৎপত্তি হয়।
ঐ চিঠি চালাচালিতে বর্ণনামূলক অর্থে কথা বলার সময় কারও দখলে থাকা ভুমি বুঝাতে চীন এই [LAC] ব্যবহার করেছিল। যেটা অবশ্যই উভয়পক্ষের সম্মতিতে গৃহিত কোনো কমন ম্যাপের স্টাটাস নয়। তাই টেকনিক্যালি ভারত কখনই ১৯৫৯ সালের কোনো সীমান্ত বুঝাতে [LAC] শব্দটা ব্যবহার করতে চায় না। তবে চীন-ভারত সীমান্ত সম্পর্কে সবচেয়ে ভাল সুসময় বলা যায় ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল।
১৯৯১ সালে নরসীমা রাও-এর প্রধানমন্ত্রীত্বের আমলে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি পেং ভারত সফরে এসেছিলেন। আর তাতে উভয়পক্ষের সম্মতিতে [LAC] কোনটা হবে এনিয়ে বিস্তর আলোচনা ও রফার শুরু হয়েছিল। এতে নরসীমার ফিরতি চীন সফর ঘটেছিল ১৯৯৩ সালে এবং সেই সফরকালে উভয়পক্ষ [LAC] এর দুই পাড়ে শান্তি বজায় রাখার লক্ষে এক সীমান্ত চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল। আর তখন থেকেই ভারতও অফিসিয়ালি [LAC] কথাটা মেনে নিয়েছিল ও ব্যবহার শুরু করেছিল। আর সেই থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত বহুবার তাঁদের বিভিন্ন সীমান্তে নতুন করে সম্মতিতে সীমান্তরেখা টানা হয়েছিল যেগুলো ঐ বছরের [LAC] যেমন, [LAC 1994] এভাবে বলার চল শুরু হয়েছিল।
সারকথায়, ১৯৯১ সাল থেকে এবারের বলা [LAC] এর বাড়তি অর্থ হল তখন থেকে [LAC] মানে উভয়পক্ষের সম্মতি নিয়ে আঁকা সীমান্তরেখা। কিন্তু এত সম্মতির পরেও আবার ২০২০ সালে কেন সীমান্তে সেনা সমাবেশ?
এর একমাত্র কারণ হল, ভারতের কনষ্টিটিউশনের ৩৭০ ধারা বাতিল ঘোষণা করে ২০১৯ সালের ৫ আগষ্ট সংসদে অমিত শাহের সারা কাশ্মীরই (পাকিস্তান ও চীনা অধিকৃত অংশসহ) ভারতের অংশ দাবি করা। অর্থাৎ এখানে আসলে মোদি-অমিতের সরকার দাবি করে ফেললেন যে ১৯৯১ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত যত কিছু সীমান্ত সমঝোতা ও চুক্তি হয়েছিল তা তারা মানেন না। এবং এই না মানা একপক্ষীয় ভাবে। আর একপক্ষীয়ভাবে কোনো চুক্তি বাতিল করে দেয়া মানে উভয়পক্ষ বসে কোনো আলোচনায় থেকে নয় – যেটি কূটনীতিতে খুবই অশিষ্ট [rogue] আচরণ গণ্য করা হয়, তাই ঘটানো হয়েছিল।]
কিন্তু তা সত্ত্বেও চীন-ভারতের ভাল সম্পর্কের সময়ে, ১৯৯১-৯৪ এই পাঁচ বছরে সীমান্ত নিয়ে আপস আলোচনায় ফলাফলের ভিত্তিতে সে সময়ে প্রতি বছরই উভয়ের সম্মতিতে চীন নিজের দাবিকৃত অংশ থেকে বেশ কিছু ভূখণ্ড ভারতকে ছেড়ে দিয়েছিল। এ থেকেই এলএসি৯১, এলএসি৯২, এলএসি৯৩ ও এলএসি৯৪ এর জন্ম। তাহলে এখন ১৯৫৯ সালকেই আবার ফিরে নতুন করে সব সীমানার ভিত্তি মেনে নিয়ে এখনকার মোদির আপসনামার অর্থ কী?
অর্থ হচ্ছে, ১৯৯১-৯৪ এই পাঁচ বছরে চীন-ভারত সীমান্ত নিয়ে আপোস আলোচনায় যা কিছু ভূখণ্ড ভারত পেয়েছিল তা আর ভারতের হাতে থাকল না। ভারত এই ভূখণ্ডের দাবিই যেন ছেড়ে দিল। সেটা ভারতের অনিচ্ছাকৃত হলেও মোদি-অমিতের “পুরা কাশ্মীরই ভারতের ভুখন্ড”, সংসদে এই দাবি করাতে এমন অর্থই তৈরি হয়ে গেছিল।
এর সোজা মানে হল মোদীর এখন ‘১৯৫৯ সালের সীমান্তরেখা’ মেনে আপোস করাতে ভারত চীনের কাছে বড় ভূখণ্ড হারাচ্ছে সেটা স্বীকার করে নিল। শুধু তাই না, এর আরেক বিশেষত্ব আছে।
আগে মীমাংসিত ছিল এমন ভূখণ্ড এবার আবার চীনকে ছেড়ে দেওয়া হয়ে গেল। কিন্তু কেন? এমন তো আগে কখনো হয়নি! মোদি কি যেকোনোভাবে একটা সেনা প্রত্যাহারের চুক্তিতে আসার স্বার্থে পাগল হয়ে এমনটি করছে? একেবারেই যে তা নয় সেটা বলা মুশকিল। কারণ এই করোনাকালের আগে থেকেই মোদির ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই নাজুক। তাই এই সময় সেনা প্রত্যাহার, খরচ কমানো এবং সাথে টেনশনও কমানো ইত্যাদি মোদীর জন্য এক বিরাট চাহিদা তো বটেই। সেকারণে এই আপোস মীমাংসা মানে সেনা প্রত্যাহার বা [disengagement] এটির মূল শর্ত হলে মোদি তাতেও রাজি।
পাঠকের কাছে ব্যাপারটা আমাদের ভাষ্যে না বলে টাইমস অব ইন্ডিয়া গ্রুপের মিডিয়ায় ছাপা হওয়া এক সাবেক কমান্ডার লে. জেনারেল পানাগের [Lt Gen HS Panag (Retd)] বয়ানে তুলে ধরব। তিনি পরপর দু’বার রাষ্ট্রীয় মেডেলপ্রাপ্ত সেনা অফিসার।
লে. জে. পানাগ বলছেন, ‘… এই সৈন্য প্রত্যাহার ঘটছে একেবারে ঠিক চীনের দাবিকৃত ১৯৫৯ সালের সীমান্তরেখা অনুসারে। কারণ এ পরিস্থিতিকে ভিন্ন কোনো বিকল্প আকার দেয়ার মতো সামরিক যোগ্যতা ভারতের নাই।’
তিনি আরো বলেন, তবুও দীর্ঘস্থায়ী শান্তির জন্য এটাই ভালো [……” that the “disengagement” is happening exactly as per China’s 1959 claim line because India has no military capability to alter the situation. However, he said, it is “good for the long term peace”………”The plan, he presumed, will include acceptance of McMohan Line in Northeast with some give and take between New Delhi and Beijing, as per the 1959 proposal.”]।
কিন্তু এই জেনারেল যে কথা কোনো রাখঢাক না করে গড়গড়ে বলে গেলেন মোদির সে সক্ষমতা নাই। কারণ লাদাখ বা সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে মোদির নেয়া সব পদক্ষেপেই সততার অভাব ছিল। মোদীর অসততা হল, তিনি নিজ ভোটবাক্স ভরাতে সীমান্তে তিনি বীর, বীরত্ব দেখাচ্ছেন তিনি, হিন্দুত্বের বিজয় আনছেন তিনি ইত্যাদি ভুয়া বয়ানের সুরসুরি তুলতে এসব করেছেন।
তিনি কাশ্মীর দখল করেছেন। পুরা কাশ্মীর ভারতের মধ্যে এনেছেন তাই তিনি ও তার দল হিন্দুত্বের বীর। এসব জাতশ্রেষ্ঠত্বের জজবা উন্মত্ত জোশ, আধা সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে মিশিয়ে তিনি এনেছেন যেকোনো অ-হিন্দুর বিরুদ্ধে। যার সবকিছুর উদ্দেশ্য ভোটবাক্সকে হিন্দুর-ভোটবাক্স এই জোয়ার তুলে।
আবার এই মিথ্যা বীরত্বের দাবি করতে গিয়ে যেমন – ভারত-চীন প্রত্যক্ষ সেনা সংঘাতে ভারত যখন ২০ জন সৈন্য হারিয়েছিল তার পরে মোদি সর্বদলীয় বৈঠকে দাঁড়িয়ে এবং ‘মন কি বাত’ নামের রেডিও প্রোগ্রামে বিবৃতি দিয়েছিলেন যে, ‘চীন ভারতের কোনো ভূখণ্ড দখল করে নাই, কোনো অনুপ্রবেশ ঘটেনি’ ইত্যাদি। তার সোজা অর্থ হলো, ভারতের সৈন্যরাই চীনে অনুপ্রবেশ করে মার খেয়ে মরেছে। অথচ আসলে মোদীর ওই বিবৃতিতে স্বীকার করে নেয়া হয় যে, চীনা দাবিকৃত ‘১৯৫৯ সালের সীমান্তরেখাই’ তাদের উভয়ের প্রকৃত সীমান্ত। যদিও মোদি কখনোই তার ওই কথার কোনো ব্যাখ্যা দেননি। সংসদে আলোচনাও তুলতে দেননি।
কাজেই এখনকার ‘সেনা প্রত্যাহার’ নিয়ে মোদির বড় সমস্যা হল, তার সংসদ বা নাগরিকের কাছে তিনি কিভাবে খুলে বলবেন যে তার উগ্র জাতিবাদী হিন্দুত্ব শ্রেষ্ঠত্বের রাজনীতি আর হুঙ্কার আসলে সব অচল আর ভুয়া! ১৯৫৯ সালের সীমান্তরেখা মেনে নেয়ার বিনিময়ে তিনি চীনা সৈন্যদের ঠাণ্ডা করতে যাচ্ছেন। কিন্তু সেজন্য তিনি বাৎচিত শুরু করছেন আরেক শঠতার আশ্রয়ে।
এক. তিনি যে ১৯৫৯ সালের সীমান্তরেখা মেনে নিয়ে বিনিময়-সওদা করছেন- এ কথা একেবারে লুকিয়ে ফেলেছেন।
দুই. এই বিষয়ে পাবলিকের সামনে কথা শুরু করছেন চীনারা সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়ে যাচ্ছে – এখান থেকে। যেন এটা দু’পক্ষেরই সেনা প্রত্যাহার নয়, যেন শুধুই চীনা সৈন্য প্রত্যাহার হচ্ছে। অর্থাৎ যেন চীনা সেনারা ভারতে এসেছিল, এখন পালিয়ে গেল। এটাই যেন এক বিরাট সুখবর আর মোদী সরকারের বিজয়- এমন ভাব দেখাচ্ছেন। অন্তত দুটো মিডিয়া দ্যা হিন্দু আর দ্যা প্রিন্ট এ কাজে মোদির ইজ্জত বাচানোর মত করে এমন ভাষ্য লাগাতার তৈরি করে যাচ্ছে।
অথচ সত্যিকার ব্যাপারটা হল, ভারতীয় সেনারা ‘পিছিয়ে’ ১৯৫৯ সালের সীমান্তরেখায় ফিরে গেল আর চীনা সৈন্য প্রত্যাহার নয় বরং ওই ছেড়ে যাওয়া ভূখণ্ডের দখল নিয়ে সামনে এগিয়ে গেল।
মোদীর ইজ্জত বাঁচানোর চেষ্টায় আরেক মন্ত্রী ভিকে সিংঃ
মোদি তাই ‘চীনারা সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়ে যাচ্ছে’ এমনই কাছাকাছি কিছু একটা ব্যাখ্যায় প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথকে দিয়ে সংসদে বিবৃতি পড়ে শোনান, ঐ ১১ জানুয়ারি যেদিন ভারতীয় সেনা ইতোমধ্যেই মাঠে সেনা প্রত্যাহার শুরু করে দিয়েছিল সেদিন। তবু এতকিছুর পরেও আগেই আরেক বিরাট বিপর্যয় ঘটে গেছিল। সে ঘটনাটা ঘটিয়েছিল মোদীর আরেক মন্ত্রী ভিকে সিং।
তিনি আসলে ভারতের সাবেক সেনাপ্রধান, এক ফোর-স্টার জেনারেল। সম্ভবত মোদি তাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন মিথ্যা অ্যাডভ্যান্স ঢোল পিটানোর – ১৯৫৯ সালের সীমান্তরেখা মেনে নিয়ে মোদি আপোস করছেন এদিকটা লুকিয়ে কথা শুরু করার জন্য। তিনিই প্রথম বলতে নামেন যে এই সেনা প্রত্যাহার এটাই নাকি মোদীর বিজয়। কিভাবে?
তিনি গত ৭ জানুয়ারি ভারতের দক্ষিণে তামিলনাড়ুর মাদুরাই শহরে সফরে গিয়ে জনগণকে ব্যাপারটা ‘সহজ করে বুঝিয়ে বলার’ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু এতে তিনি হিতে বিপরীত করে ফেলেন। তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন চীন-ভারত সীমান্ত সম্পর্কগুলো কত সহজ ফলে অন্যের দেশে অনুপ্রবেশ ঘটানো -এগুলো কোনো ব্যাপার না। এই ধারণা তৈরি করতে গিয়ে বলে বসেন যে ভারত কতবার যে চীনা ভূখণ্ডে ‘অনুপ্রবেশ’ করেছে এর শেষ নেই।
আরো এক কাঠি ওপরে গিয়ে বলেছেন, “চীনারাও অনুপ্রবেশ করেছে তবে আমাদের চেয়ে কম। চীনারা ১০ বার করলে আমরা ৫০ বার করেছি” [“Let me assure you, if China has transgressed 10 times, we must have done it at least 50 times,”।
বলাই বাহুল্য, এরপর এটাই সমালোচনার মুখ্য বিষয় হয়ে যায়। এমনকি এ নিয়ে চীনে চীনা সরকারি মুখপাত্রকে জিজ্ঞাসা করাতে তিনি কয়েক শব্দে এক মন্তব্য করেন যে, “সত্যি কথা সবসময় অজান্তেই মুখ দিয়ে বের হয়ে পড়ে।”
আসলে ভিকে সিং সেখানে আরেক ভুয়া দাবি করে ১৯৫৯ সালের সীমান্তরেখা মেনে নেয়াকে আড়াল করতে গিয়েছিলেন। তিনি তাই মনে করায় দিয়ে বলার ছলে বলেন, চীনা পণ্য বর্জন প্রোগ্রাম নিয়েছিল বিজেপি ও এর অঙ্গসংগঠনগুলো। আর সরকার চীনা বিভিন্ন অ্যাপ-প্রোগ্রাম ভারতে নিষিদ্ধ করেছিল, ভারতে বাণিজ্যে বা টেন্ডারে অংশ নেয়া বন্ধ করেছিল। আর তাতেই নাকি চীনারা চাপে পড়েছিল তাই তারা সেনা প্রত্যাহারে রাজি হয়েছে।
কিন্তু তার এই দাবিও আসলে ভুয়া। কারণ পরিসংখ্যান বলছে যে, বরং চীন থেকে কাঁচামাল বা তৈরি পণ্যের আমদানি বেড়ে গিয়েছে। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ এক দাবি ভিকে সিং শুরুতেই করেছিলেন সেখানে। তিনি বলে বসেন, চীনের সাথে অফিসিয়াল সীমান্তরেখা বলে কোনোকিছু কখনও আঁকাই হয় নাই; [……” official border with China has never been demarcated.“।
তার মানে চীনা প্রধানমন্ত্রী লি পেং ১৯৯১ সালে ভারতে আসেন নাই, নরসীমা রাও-ও ১৯৯৩ সালে পাল্টা চীন সফরে যান নাই। অতএব ১৯৯১-১৯৯৩ এই সময়কালের মধ্যে [LAC] নিয়ে চীন-ভারত উভয়পক্ষের মধ্যে প্রথমবারের মত কোনো সমঝোতা হয় নাই?
আসলে এটা তিনি বলছেন কারণ মোদি নিজেই এই “অস্বীকারের” [১৯৫৯ সালের সীমান্তরেখা মেনে নিয়ে] ফাঁদে পড়েছেন। তাই ইতিহাস উল্টাতে ভিকে সিং সারা ভারতকে সেই ফাঁদে ফেলতে চাইছেন। ওদিকে, কংগ্রেস গত সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী একে এন্থনী অভিযোগ করে বলেন, লাদাখের এই সেনা প্রত্যাহার আসলে চীনের কাছে সারেন্ডার “Disengagement in Ladakh is surrender to China,” ছাড়া কিছুই না।
যা হোক, এই সেনা প্রত্যাহার মনে হচ্ছে সফলতার দিকেই যাবে, তাতে ভারতকে যে শর্তই পালন করতে হোক না কেন। তবে ঘটনা আরো কিছু আছে।
আসলে এখন মোদির এত দ্রুত আপোস করে ফেলার পেছনের সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। মোদি আশা করতেন, চীন-আমেরিকার বাণিজ্য বিরোধটা যদি সামরিক দিকে গড়ায় তাহলে তিনিও এর আড়ালে, ভারতের চীনের সাথে বিরোধকে সামরিক দিকে ঠেলে দেয়ার সুযোগ নিতে পারবেন। কিন্তু তা হয়নি, মোদির কপাল খারাপ!
কিন্তু রেকর্ড বলছে, ট্রাম্প তার চার বছরে পরিস্থিতি কখনোই সামরিক দিকে যেতে দেননি। যদিও অনেক গরম কথা, হুঙ্কার দিয়েছেন। আর ওই চার বছরে তিনি মোদিকেও বাকচাতুরি ছাড়া কোনো ফেভারই দেননি। কিন্তু উল্টা ভারতে অস্ত্রবিক্রির সুবিধা নিয়েছেন। সেটা যাই হোক শেষে বাইডেন এসে যাওয়াতে এসব দিকে মোদির সরকার এখন একেবারেই হতাশ। কেবল অপেক্ষা করছেন বাইডেনের সাথে প্রথম মোলাকাতে কী আলামত দেখেন তা জানতে। পছন্দ না হলে এবং বিশেষ করে মানবাধিকারের চাপ খেলে জয়শঙ্করের তৈরি আরেকটা অবস্থান আছে সে দিকে যাবেন। সেটা হলো তিনি বলবেন, এখন থেকে চীন-আমেরিকার বিরোধে ভারত আর কোনো দিকে নেই, গ্যালারির দর্শকমাত্র হয়ে থাকবে। যেন অনেকটা ঘরে খাবার নাই বলে উপোস রাখছি এমন বলে বেড়ানো হবে সেটা আর কী।
সবশেষে, চীন গত বছর সীমান্তে সেনা সমাবেশের শুরু থেকেই আগে ভারতকে ১৯৫৯ সালের সীমান্তরেখা মেনে নেয়ানো মানে, এলএসি৯১, এলএসি৯২, এলএসি৯৩ ও এলএসি৯৪ এর মাধ্যমে যেসব ভূমি ফেরত দিয়েছিল তা আবার কেড়ে নিতে এগিয়েছিল কেন?
স্বল্পকথায় বললে, ব্যাপারটা ২০১৯ সালে মোদির “পুরা কাশ্মিরই ভারতের”- সংসদে এই দাবি করার খেসারত। সংসদে ৩৭০ ধারা বাতিল করার পরে অমিত শাহ একটা বিবৃতি দিয়েছিলেন ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট। তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, কাশ্মিরের তিন অংশ- ভারত ও পাকিস্তানের দখলের অংশ এবং চীনের দখলে থাকা অংশ- এই পুরো কাশ্মিরই ভারতের ভূখণ্ড। এই ঘোষণাতেই সবকিছুর ট্রিগার টিপে দেয়া হয়েছিল।
আজ মোদি সরকার “১৯৫৯ সালের সীমান্তরেখা” মেনে নিতে বাধ্য হলেন। দুনিয়ার সব উগ্র জাতিবাদীর পতনের মত এই হিন্দুত্ব জাতিবাদ এখানেও হেরে গেল।
চীন বলতে চাইল, ভারত আপোস আলোচনায় সীমান্তবিরোধ মিটানোর মত কোনো পার্টনারই নয়, যোগ্য নয় তাই!
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
[এই লেখাটা গত ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১, দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ওয়েবে ও পরদিন প্রিন্টেও “সেনা প্রত্যাহারে গিয়ে মোদির যে দশা” – এই শিরোনামে ছাপা হয়েছিল। পরবর্তিতে ঐ লেখাকে এখানে আরও অনেক নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে ও নতুন শিরোনামে এখানে আজ ছাপা হল। ]