সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষার কাজটা চীন-ভারতের নয়, নেপালেরই
গৌতম দাস
০১ মার্চ ২০২১, ০০:০৬ সোমবার
ক্ষমতার ভারসাম্য বিন্দু চীন-ভারত নয়, নেপালকেই ঠিক করতে হবে © by Hiroko Oshima/Michael Tsang
–
নেপালের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কে পি ওলি (খাড়গা প্রসাদ ওলি, Khadga Prasad Sharma Oli, ) এখন অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী হয়েও সম্ভবত আগামী মাসের মধ্যে আর ক্ষমতায় থাকতে পারছেন না। নেপালের পার্লামেন্টের আয়ুকাল আরো প্রায় দুবছর বাকি থাকা সত্ত্বেও গত ২০ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী ওলি সংসদ ভেঙে দিয়ে আগামী এপ্রিল-মে মাসে নতুন নির্বাচনের দিন ঘোষণা করেছিলেন। সেই থেকে তিনি নিজেই নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী থেকে নিজেকে অস্থায়ী বা অন্তর্বর্তিকালীন প্রধানমন্ত্রী করে নিয়েছিলেন। তাঁর এ সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রপতিও অনুমোদন দিয়েছিল, যার মূল কারণ অনুমান করা যায় যে রাষ্ট্রপতিও নিজ দলীয় ভগ্নাংশের। কিন্তু তাতে কিছু ‘সংক্ষুব্ধ’ ব্যক্তি ও দলের প্রতিনিধিরা সুপ্রিম কোর্টে নালিশ দিয়েছিলেন। এমন মোট ১৩টি মামলার নিষ্পত্তি করে প্রায় দুমাস পরে গত ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১ কোর্ট তার রায় দিয়েছে । সে রায় হল, প্রধানমন্ত্রী ওলির “সংসদ ভেঙে দেয়া ছিল কনষ্টিটিউশন লঙ্ঘন” [……house dissolution as an unconstitutional act,]। এছাড়াও তাই, আগামি ১৩ ওয়ার্কিং ডে-এর মধ্যে সংসদ পুনরুজ্জীবিত করে আবার চালু বা বসাতে হবে।
এতে এখন এই নতুন পরিস্থিতিতে ওলিকে প্রধানমন্ত্রীত্ব থেকে অপসারণ মানে – সংসদে তাঁর ইমপিচমেন্ট হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে গেল। কারণ ওলির মিলিত কমিউনিস্ট দল আগেই তাঁর বিরুদ্ধে গিয়ে দলের সভাপতির পদ থেকে তাঁকে অপসারিত করে রেখেছে। সে জায়গায় দলের নতুন কো-সভাপতি মাধব কুমার নেপাল (মাধব আগে অ্লির দলের সেক্রেটারি ছিলেন)। “দলের সেন্ট্রাল কমিটিতে ৪৪৬ জন সদস্যের মধ্যে ৩১৫ জনই মাধবের পক্ষে” ভোট দেন”।
এখন সংসদ নতুন করে বসলে প্রথম ইস্যু প্রধানমন্ত্রী ওলিকে অনাস্থা ভোট সামলাতে হবে। যেখানে তাঁর হেরে যাবার সম্ভাবনাও খুবই বেশি। আর এই ব্যাপারটা ফয়সালা হবার পরই দলের অপর অংশের নেতা (প্রাক্তন মাওবাদী) পুস্প কমল দাহাল প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন কিনা তা নির্ভর করছে। এদিকে গত নির্বাচনে (২০১৭ ডিসেম্বর) (অলি ও দাহাল) তাঁদের দুই নেপালি কমিউনিস্ট পার্টি এক হয়ে লড়েছিল ; তবে একদলে মিশে যাবার প্রক্রিয়াও শুরু করে। ঐ নির্বাচনে নেপালের ২৭৫ আসনের সংসদে তারা পেয়েছিল ১৭৩ আসন। দলে অলিকে সভাপতি পদ থেকে অপসারণের পরে এখন দলে দাহাল-মাধব এর যৌথ প্রভাব দলের মধ্যে কতটা এরই পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে। কারণ, কার্যত নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি বিভক্ত হয়ে গেলেও আইনিভাবে সংসদে এটা এখনও একটাই দল হয়ে আছে। এই পরিস্থিতিতে চীন ও ভারত উভয়েই নেপালের রাজনীতিতে প্রবলভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
গ্লোবাল নেতৃত্ব কী জিনিষঃ
“গ্লোবাল নেতৃত্ব”- এই বিষয়টি এমনিতেই দুনিয়াতে সবসময় হাজির ছিল এমন ফেনোমেনা নয়; ফলে সেই ‘গ্লোবাল” নেতৃত্বের মধ্যে আবার একালে কোনো ‘পালাবদল’ আসা – এটাও বারবার ঘটে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেও, ‘গ্লোবাল’ বলে বা ‘দুনিয়াজুড়ে’ কোনো একক বা দুই রাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রভাব বা অর্থনৈতিক প্রভাব বলে কিছু ছিল না। তাও রাজনৈতিক প্রভাব ও অর্থনৈতিক প্রভাব এ দুটোর মধ্যে অর্থনৈতিক প্রভাব সবসময় আগে আসে। আর তাকে ফলো করে রাজনৈতিক প্রভাবও হাজির হয়ে থাকে।
যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-৪৫) আগে দুনিয়াতে ‘গ্লোবাল নেতৃত্ব’ বলে কিছু ছিল না। যদিও কলোনি দখল করতে চায় এমন ছোট-বড় মাতবর গোটা পাঁচেক ইউরোপীয় রাষ্ট্র তখনও ছিল যাদের মধ্যে শেষবিচারে প্রধান দুই কলোনিদখলদার ছিল বৃটিশ ও ফরাসি রাষ্ট্র। আর আমরা তখন ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া কলোনি হিসাবে ছিলাম, প্রায় ২০০ বছর। কিন্তু তবুও সে সময়ের ব্রিটিশরা গ্লোবাল নেতা বা লিডার কিনা এমন কিছু বলার কোন চলই ছিল না।
তবে এমন কলোনি সাম্রাজ্যের মালিক-রাষ্ট্রের ধারণার এরপর দুনিয়া থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভেতর দিয়ে, যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে ১৯৪১ সাল থেকে অবসান ও বিলুপ্তি ঘটেছিল। এটাই ১৯৪২ সালের ১ জানুয়ারি জাতিসংঘের জন্ম ঘোষণার ভিতর দিয়ে ঘটেছিল। অর্থাৎ ‘দুনিয়াতে রাষ্ট্রগুলোর কেউ কাউকে অধীনস্থ ও কলোনি দখল করে আর রাখতে পারবে না”। এই “অবৈধ গণ্য” করার ভিত্তিতেই রাষ্ট্র-সংঘের [United Nations] জন্ম। মানে, কলোনি অধীনস্থতার সম্পর্ক দুনিয়া থেকে লোপ পাবে – এই নীতিগত দিক তৈরি হয়েছিল তখন। আর তাতেই বিশ্বযুদ্ধে এই ভিত্তিতে পক্ষ-বিপক্ষ দুটো রাষ্ট্রজোট তৈরি হয়েছিল। কলোনি দখল অবৈধ – এ নীতির ভিত্তিতে যারা পক্ষজোট (এদেরকে সেকালে মিত্রশক্তি বলা হত), তারাই আমেরিকার নেতৃত্বে লড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয় লাভ করেছিল। আর তা থেকেই আমেরিকা নিজেকে “গ্লোবাল নেতৃত্বের” আসনে বসাতে সমর্থ হয়েছিল।
তবে বিশ্বযুদ্ধে বিজয়লাভের সাথে আমেরিকার হাতে গ্লোবাল নেতৃত্ব এসে পড়ার পেছনে মূল কারণ ছিল – আমেরিকান বিপুল বিনিয়োগ সক্ষমতা। যদিও সেই বিনিয়োগের সুযোগ হাতে পেতে আগে আমেরিকাকে আরো দুটো বড় খরচের দায় নিতে হয়েছিল। এক. নিজ পক্ষজোটের সবাইকে যুদ্ধের খরচ বা ব্যয়ভার জোগানো; আর দ্বিতীয়ত, যুদ্ধের পর, ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ-বিপক্ষ সব রাষ্ট্রকেই ত্রাণ, পুনর্বাসন ও ভেঙে যাওয়া অবকাঠামোগুলো আবার গড়ে দেয়া ইত্যাদিতে নতুন বিনিয়োগ-ঋণ দেয়া। এটাই ১৯৪৪ সালে জন্মের পরে বিশ্বব্যাংকের কাজের প্রধান ক্ষেত্র হয়েছিল। সবচেয়ে বড় কথা, এসব খরচ আমেরিকা কিভাবে ফেরত পাবে কিংবা তা ফেরত নাও পেতে পারে এমন সম্ভবনা থাকলেও, এদিকটা অনিশ্চিত ও উহ্য রেখেই আমেরিকা এই বিপুল খরচ শুরু করতে হয়েছিল; যা পরে কমবেশি উসুল হয় অবশ্য। কিন্তু তাতেই আমেরিকার ‘সবচেয়ে বড় পাওনা’ দুনিয়ার গ্লোবাল নেতৃত্ব নিজের হাতে চলে আসা। আর সেই থেকে দুনিয়ায় ‘গ্লোবাল নেতৃত্ব’ ধারণাটাও প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়।
আরেক দিক থেকে দেখলে, গ্লোবাল নেতৃত্ব কথাটার তাৎপর্য কী? একেবারে ‘রূট’ মানে গোড়ার দিকে তাকিয়ে বললে এটা সোজাসাপ্টা এক গ্লোবাল ক্যাপিটালিজম। আর ক্যাপিটালিজম মাত্রই এর ভেতরে গ্লোবাল হয়ে উঠার স্বভাবটা সবসময় সুপ্ত থাকে এবং উপযুক্ত পরিবেশ পেলে যা ব্যাপ্তি লাভ করে ছেয়ে বসে। এতে ছোট ছোট পকেট বা ছোট-বড় আঞ্চলিক ক্যাপিটালিজমের উদ্যোগ ও ফেনোমেনাগুলো পরস্পর যুক্ত হয়ে পড়ে; যা পরবর্তিতে এক গ্লোবাল ক্যালিটালিজমের রূপ ধারণ করে বিকশিত হয়ে উঠতে চায়।
এ কারণে ‘কলোনি শাসন অবৈধ’ হয়ে যাওয়ার ভিত্তিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার জয়লাভ কথাটার ব্যবহারিক মানে হয়ে যায়, যুদ্ধ শেষে কলোনিমুক্ত শ-দেড়েকের বেশি স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে দাঁড়ায় আমেরিকার বিনিয়োগ-ক্রেতা। এমন হবার পিছনে আরও বড় ফ্যাক্টর ছিল। যেমন, এসব রাষ্ট্র স্বাধীন-মুক্ত হলেও এতদিন কলোনিদখল লুটেরাদের অধীনে থাকায় উদ্বৃত্ত-সম্পদ সব কলোনি মালিকের দেশ লুটে নিয়ে যাওয়ায় এরা স্বাধীনরাষ্ট্র হবার পরেও অর্থনৈতিকভাবে এরা একেবারে ফোকলা। এ’অবস্থা থেকে আবার বেঁচে সক্রিয় হয়ে উঠার ক্ষেত্রে প্রধান প্রয়োজন ছিল বাইরের বিনিয়োগ-ঋণ, যেটা হতে পারে লুট হয়ে যাওয়া সারপ্লাসের সবচেয়ে ভাল এভেলএবল বিকল্প। এরই স্টোর ও সাপ্লায়ার হয়ে পাশে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল আমেরিকা। কাজেই প্রথমবারের গ্লোবাল নেতৃত্বে ‘আমেরিকা’ কথাটার তাৎপর্য হয়ে উঠেছিল এই যে, কলোনিমুক্ত স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর আমেরিকান নেতৃত্ব গ্লোবাল সিস্টেম থেকে বিনিয়োগের পুঁজি-পণ্য নেয়া্র এক নতুন সম্পর্কে জড়ানো। তবু আরও কিছু কথা পরিষ্কার রাখা ভাল। কলোনি-উত্তরকালে আমেরিকান নেতৃত্বের গ্লোবাল অর্থনৈতিক সিস্টেমের সাথে আমাদের মত দেশের গভীরভাবে পণ্য-পুঁজি বিনিময় সম্পর্কে সম্পর্কিত হয়ে যাওয়া – এ সম্পর্কটাও আগেকার কলোনি দখল হয়ে থাকা সম্পর্কের চেয়ে অবশ্যই তুলনায় ভাল কিন্তু পরিস্কার থাকতে হবে তা হলেও এটাও অসম; এক অসম বিনিময় সম্পর্ক। কিন্তু অবশ্যই তুলনামূলক অর্থে নতুন সম্পর্কটা বেশি ভাল, কলোনিসম্পর্কের চেয়ে ভাল; ‘মন্দের মধ্যে ভাল’ অর্থে।
সমাজতন্ত্রী বনাম গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমঃ
কিন্তু সমস্যা দেয়া দিয়েছিল অন্যখানে। কলোনিমুক্ত স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে এবার আমরা কি ‘কথিত সমাজতন্ত্রী’ হবো নাকি গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের অংশ হবো? মানে পরেরটা অসম বিনিময় সম্পর্ক হলেও তুলনামূলক ভাল বলে এই অসম বিনিময় সম্পর্কে প্রবেশ করতে পারব এমন সুযোগ হাজির হয়েছিল। সেই সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এ্টাই হয়ে পড়েছিল পরের দীর্ঘ চার দশকের ‘সমাজতন্ত্রী’ হওয়া না হওয়ার দ্বন্দ্ব। পরে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন আর চীন ষাটের দশক থেকেই ক্রমশ ‘কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে ক্যাপিটালিজম’ – এভাবে গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের সাথে যুক্ত হওয়ার পথ নেয়ায় আমাদের মত সব রাষ্ট্রের জন্য পথ বেছে নেয়া সহজ হয়ে যায়। ফাইনালি আমরা সবাই এখন আমেরিকান নেতৃত্বের গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের অংশ – আমরা এটা পছন্দ করি আর নাই করি। আর এটা অসম বিনিময় সম্পর্কের হওয়া সত্ত্বেও ‘মন্দের ভাল’ বলে, এভেলএবল পথ বলে। অর্থাৎ কলোনি-উত্তরকালে গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের এক সিস্টেমের অংশ হয়ে উঠার পথটাই অন্তত আপাতত টিকে যায়, প্রধান ধারা হয়ে যায়।
তবে ইন্টারেস্টিং দিকটা হচ্ছে, সমাজতন্ত্রী ব্যবস্থার রাষ্ট্রগুলো ভেঙে পড়ার ক্ষেত্রে গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের প্রত্যক্ষ কোনো ভূমিকাই ছিল না। তারা নিজ গুণ বা দোষেই ভেঙে পড়ে অকার্যকর হয়ে গেছে। এর মূল কারণ সম্ভবত একমাত্র যা করলে সবারই টিকে থাকা সম্ভব হবে, অর্থাৎ সারভাইবাল কোন রকমে নিশ্চিত করা ছিল সবার কাছে সবার উপরে একেবারেই মুখ্যবিষয়। এছাড়াও আর সবার চেয়ে বড় কথা – সমাজতন্ত্রীদের বড় বড় খামতির দিক তো ছিলই। যেমন – গ্লোবাল বাণিজ্য বা দুনিয়াজুড়ে রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একটা লেনদেন বিনিময় ব্যবস্থা হাজির থাকা আদৌ এসেনশিয়াল কি না এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে মৌলিকভাবে এখনো একেবারেই বেখবর হয়ে আছে সমাজতন্ত্রীরা। ইস্যুটাই কানে ঢুকে নাই এখনও এমন অবস্থা!
গ্লোবাল নেতৃত্বে পালাবদলঃ
এদিকে এই শতকে এসে প্রায় সত্তর বছর চলার পরে আমেরিকান গ্লোবাল নেতৃত্ব এরই মধ্যে চ্যালেঞ্জড হয়ে গেছে এবং ঢলেও পড়ছে। তাই গ্লোবাল নেতৃত্বে পালাবদল আসন্ন এই বাস্তবতা প্রায় সবাই মেনে নিয়েছে। কিন্তু কেন আমেরিকা ঢলে পড়ল? আগামী ঐতিহাসিকরা সম্ভবত মূলত এর দুটো কারণ উল্লেখ করবেন। এক. আফগানিস্তানঃ এই রাষ্ট্র আমেরিকার সাথে যে তুলনায় অযোগ্য ও অবিকশিত একথা তুচ্ছভাবে বলতে পারেন অনেকেই। কিন্তু আমেরিকার এই ঢলে পড়া বা পতন ঘটানোর অন্যতম ‘হিরো’ তবু এই আফগানিস্তান। সে একটাই কাজ করেছে। তা হল, আমেরিকাকে সে এমনই ‘নেভার এন্ডিং’ এক অনন্তযুদ্ধে ঢুকিয়ে দিয়ে টেনে নিয়ে গেছে যে এখান থেকে বের হবার পথ নাই ফেলে পালানো ছাড়া। আর তাই ঘটেছে। শুধু তাই না ওদিকে এতে, যুদ্ধের নিজখরচ জোগানোর সামর্থ্য গ্লোবাল নেতা আমেরিকার অর্থনীতির আর নাই। মনে রাখতে হবে, ২০০৮ সালের যেটা ‘গ্লোবাল মহামন্দা’ বলে জানি আমরা, যেটা দেখা দিয়েছিল ১৯৩০ সালের প্রথমটার পরে দ্বিতীয় বড় মহামন্দা বা রিসেশন [global recession]। ২০০৮ সালের মহামন্দার মূল কারণ কিন্তু যুদ্ধের খরচ বইতে গিয়ে ফেল করা আমেরিকান অর্থনীতি। শেষে ওবামা প্রশাসনের ১০ হাজার বাদে (২০১১-১৪) সব সেনা ( অন্যান্য দেশেরসহ ন্যাটোর সেনাও) ফিরিয়ে আনার প্রধান কারণ এই ফেইল্ড অর্থনীতি। অথচ এই যুদ্ধে গিয়ে বলার মত কোন কথিত “লক্ষ্য” অর্জনও করতে পারে নাই।
এছাড়া আমেরিকান গ্লোবাল নেতৃত্ব ইতোমধ্যে চ্যালেঞ্জ হওয়ার দ্বিতীয় কারণ, পাশাপাশি চীনের উত্থান; ‘কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে এক ক্যাপিটালিজমের’ চীন – এর কাছে আমেরিকার গ্লোবাল নেতৃত্ব হারানো।
গ্লোবাল নেতা মানে কোন সামরিক সক্ষমতার ধারণা নয়ঃ
একটা বড় ভুল ধারণা আবার ভেঙ্গে দেই। অনেকের মানে সাধারণ মানুষসহ অনেক আমেরিকান দ্বিজ্ঞজদেরও ভুল ধারণাটা হল, “গ্লোবাল নেতৃত্ব” মানে বুঝি সামরিক শক্তির সক্ষমতা। কিন্তু কোন রাষ্ট্রের গ্লোবাল নেতা হয়ে উঠতে গেলে প্রধান শর্ত হল বিপুল পরিমাণে অর্থনৈতিক উদ্বৃত্ব বা সারপ্লাস জেনারেট করার স্তরে নিজ অর্থনীতিকে পৌছানো আর তাতে ঐ উদ্বৃত্ব মানে অন্যদেশে বিপুল বিনিয়োগ সক্ষমতার ক্ষমতা নিজ হাতে আসা। এতে অন্য সবদেশের প্রায় সবকিছুকে প্রভাবিত করার বিপুল ক্ষমতাধারী হয়ে উঠা – এটাই গ্লোবাল নেতৃত্ব। বলা বাহুল্য এর ফলে এটা নিজ দেশকেও সামরিক, রাজনৈতিক দিক থেকেও প্রভাবশালী করে গড়ে তোলা ও উঠার কারণ হয়ে যায়। অর্থাৎ গ্লোবাল নেতৃত্ব-এর স্তরে পৌছানোটা একটা বৈষয়িকভাবে হয়ে উঠার বিষয় যা রাজনৈতিক নয় বা সামরিকও নয়। যেমন, আমেরিকার এখনও চীনের চেয়ে ছয়গুণ বেশি সামরিক সক্ষমতার ধারক। কিন্তু তা দিয়ে চীনের উত্থান ঠেকানোতে আমেরিকা যোগ্য না।
চীনের নেতা হিসাবে উত্থান, এটাকেই ‘গ্লোবাল নেতৃত্বে পালাবদল’ বলা হচ্ছে। নেপালসহ আমাদের মতো রাষ্ট্র বিশেষত যাদের দক্ষিণ এশিয়ায় চীন ও ভারতকে সাথে নিয়ে বসবাস, তাদের জন্য এই ‘পালাবদল’ এক কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
চীনের সাথে ভারতের নাম কেন?
আবার চীনের সাথে ভারতের নাম নেওয়ার মানে এই নয় যে ভারতও অর্থনীতিতে কিছু একটা হয়েছে, তা নয়। ভারত এখনও বিপুল সারপ্লাস জেনারেট করা বলতে যা বুঝায় তেমন কোন আলামতের দেশই নয়। বরং বিনিয়োগ-ঋণ গ্রহীতা দেশ। সেই বিচারে বাংলাদেশ লেবার রপ্তানি আর গার্মেন্ট বেঁচে ওর থেকে অর্থনীতিতে (এত চুরি আর পাচারের পরও) ভাল অবস্থায়। তাহলে ভারতের এমন শো-আপের পিছনের মুল কারণ কী? সেটা হল, বুশ প্রশাসনের শেষে আর ওবামা প্রশাসনের শুরুর সময়ে এক আমেরিকান সরকারি স্টাডি থেকে আমেরিকা নিশ্চিত হয়ে গেছিল যে “চীন আসছেই”। কিন্তু একটা শয়তানি উদ্যোগ তারা নিয়েছিল – ভারতের পিঠে হাত রেখে ভারতকে “চীন ঠেকানোর” [China Containment] কাজে ঠিকা দিয়ে নামানো। যদিও এখন সবাই মানে তা কোনই ফল দেয় নাই; আমেরিকার ভারত চীনের উত্থানকে ঠেকাতে পারে নাই। কারণ তা যায় না বলে বাস্তবেও তা এখন প্রমাণিত। তাই গত ট্রাম্পের আমলেই আমেরিকার ভারতকে দেয়া আগের সব সুযোগ সুবিধা কেড়ে নেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই থেকে ভারতের – “আমিও প্রভাব বিস্তার করতে পারি”, বা এশিয়ায় আমারও “প্রভাবাধীন এলাকা” আছে ধরণের মুই কী হনুরে – এই ফলস ক্লেইম ও স্বপ্নের জামা পড়ে ভারত সেই থেকে এখনও ঘুরে বেড়ায়।
এ’পরিস্থিতি ঠিক কী প্রকৃতির, অভিমুখ কী, সম্ভাবনা কী, নেতিবাচক দিক কী ইত্যাদি সম্পর্কে আমাদের পরিষ্কার ধারণা থাকা খুবই জরুরি। যারা এর ঠিকঠাক বোঝাবুঝি-মূল্যায়নে সফল হবেন ও এক্ট করতে পারবেন, কেবল তারাই টিকে যাবেন। আর বাকিরা এ পালাবদলের সাথে সাথে টিকতে না পেরে এর ধাক্কায় হারিয়ে যা্বার সম্ভাবনায় থাকবে। আবার এ পরিস্থিতিতে চীন নিজেই নিজের যোগ্যতা বা ঘাটতি অথবা ইতি ও নেতি দিক সবটা বোঝে- এ্টাও সবটা সত্যি নয়। সবচেয়ে বড় কথা চীন বড়জোর কেবল গ্লোবাল অর্থনৈতিক দিকের (রাজনৈতিক দিকের নয়) নেতা হতে পারে। আর ঠিক ততটাই আমেরিকার তুল্য বিচারে গ্লোবাল রাজনৈতিক নেতা হওয়া – এক্ষেত্রে চীন এখনো অযোগ্য। চীনের বিরাট দুর্বলতা হল, ‘মাস পাবলিক’ মানে আম-জনগণের সাথে উপস্থিত চীনা-রাষ্ট্রের সম্পর্ক এখনও একেবারেই কোন ‘রাজনৈতিক সম্পর্ক’ নয়। কারণ, চীনা কমিউনিস্ট পার্টির চোখে – মানুষ মানে, এখনো অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-চিকিৎসা-বাসস্থান ইত্যাদি বৈষয়িক চাহিদার একটা ‘ডিব্বা’ মাত্র। যেন মানুষ মানেই এক বৈষয়িকতা, বিষয়সম্পদের চাহিদা মাত্র। আর এই ধারণার কারণে তাদের কাছে “রাজনৈতিকতা (Polity), স্পিরিচুয়ালিটি” – এগুলো অনেক অনেক দূরের এবং অজানা জিনিস। কাজেই এই চীন দুনিয়াকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিবে কিভাবে? যদিও গ্লোবাল অর্থনৈতিক নেতা সে নিশ্চিত হচ্ছেই!
সুনির্দিষ্ট করে নেপালঃ
একটু পেছনে ফিরি ও সুনির্দিষ্ট করি নেপালকে ঘিরে। নেপাল নিয়ে অনেক হিস্টোরিয়ান গর্ব করে থাকেন যে, নেপাল কখন কলোনি শাসনে যায়নি। এ ক্ষেত্রে সমতুল্যভাবে আমরা বলতে পারি, ব্রিটিশ-ইন্ডিয়াতেও সাথে ৫৫০টারও বেশি ‘করদরাজ্য’ (প্রিন্সলি স্টেট বা Princely states) ছিল যারা পালনীয় কিছু শর্তসাপেক্ষে ‘স্বাধীন’ রাজা ছিল বলে দাবি করত। নেপালও প্রায় সে রকম আসলে এক রাজার প্রিন্সলি স্টেট। ঠিক যেমন বৃটিশ আমলে কাশ্মীরের রাজা হরি সিং ছিলেন। আর ঐ ধরনের করদ-চুক্তিতে যা থাকত তা হল, রাজা যা খাজনা-রাজস্ব সংগ্রহ করবেন এর একটা অংশ ব্রিটিশদের দিয়ে যেতে হবে রেগুলার। আর ব্রিটিশরা ছাড়া অন্য কোনো বিদেশী শক্তির সাথে সম্পর্ক বা যোগাযোগ করতে পারবে না; এমনকি বাণিজ্যিক সম্পর্কও স্থাপন করতে পারবে না। বাইরে থেকে অস্ত্রও কিনতে পারবে না। তবে তাদের প্রশাসন ব্রিটিশদের হাতে নয় রাজার নিজের হাতে রেখে পরিচালিত করতে পারবে; তবে ব্রিটিশদের থেকে রাজারা নিজ প্রশাসক স্টাফদের জন্য ট্রেনিং বা এধরণের অন্যান্য সহায়তা পেতে পারবে। কাজেই এই ‘করদ’ সম্পর্ককে কখনও “কলোনি হয় নাই” বলে কথার ফুলঝুরি সাজানো অমূলক ও অপ্রয়োজনীয়।
নেপালের ক্ষেত্রে আরও যা ‘বিশেষ ছিল’ তা হল, ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের সময় তারা বৃটিশ শাসকদের সহায়তায় পক্ষে যুদ্ধ করেছিল। বিনিময়ও পেয়েছিল ভালই। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে নেপালি গোর্খা সৈন্য দিয়ে সহায়তা করায় বাড়তি কিছু ছাড় পেয়েছিল। যেমন ভূমি ছাড় (মাধেসি অঞ্চল ফিরে পাওয়া), বাইরের দেশ থেকে অস্ত্র কেনা ইত্যাদিসহ ১৯১৫ সালের সুগৌলি চুক্তি, ১৯৬০ সালের চুক্তিতে “তরাই অঞ্চল” ফেরত পাওয়া, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের পক্ষে যুদ্ধ করায় আরো ছাড় দেয়ায় সর্বশেষ ১৯২৩ সালের চুক্তি। তবে ঐ ১৯২৩ সালে চুক্তিতে লেখা ছিল যে, এটা ১৯৫০ সালে আবার রিভিউ হবে। আর তত দিনে স্বাধীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহরু এবার নেপালের সাথে আগের চুক্তির আদলেই ১৯৫০ সালের চুক্তি করেছিলেন। সেটারই মূল কথা হল, ভারতের অর্থনীতি ও ব্যবসার অধীনে থেকে একটা নেপালি অর্থনীতি গড়ে তুলতে হবে। যেমন ভারতের অনুমতি ছাড়া এবং ভারতীয় ব্যবসায়ীর মাধ্যমে ছাড়া নেপালের বিদ্যুৎ বিদেশে (যেমন বাংলাদেশে) নেপাল বিক্রি করতে পারবে না। আর নেহরু এ ধরনের চুক্তির ড্রাফটটা পেয়েছিলেন ব্রিটিশ আমলের ১৯২৩ সালের চুক্তি থেকে। এটাই হল ‘কলোনিমুক্ত নেপাল’ এমন ফলস গর্বের নমুনা। তাই স্বভাবতই নিজেদের প্রটেকশনের জন্য নেপালের রাজশাসকেরা এই নেহরু বা ভারত-অনুরক্ত এক নেপালি রাজতন্ত্র গড়তে খুবই আগ্রহী হয়ে থেকেছিলেন। আর এটাই ছিল নেপালে ১৯৯৬ সাল থেকে শুরু হওয়া মাওবাদী সশস্ত্র আন্দোলনের মূল কারণ। আর যেখানে অন্যান্যের সাথে ঐ আন্দোলনের প্রধান দুই দাবি ছিল – রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে নেপালকে ‘রিপাবলিক’ ঘোষণা আর এই ১৯৫০ সালের চুক্তি বাতিল (রিভিউ) করতে হবে।
যদিও ঐ আন্দোলন শেষে অন্যান্য দলের সাথে মিলে নেপালের রাজতন্ত্র উৎখাত করতে সক্ষম হয়েছিল। আর এই ক্ষমতা দখলের মধ্যে ২০০৭ সালেই অন্তর্বর্তী সরকার গঠন সম্পন্ন হয়েছিল। পরে রাজতন্ত্র উতখাতের স্বপক্ষে আনুষ্ঠানিক রেজুলেশন হয়েছিল নেপালের প্রথম কনস্টুয়েন্ট অ্যাসেম্বলির নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পরে। সেই অ্যাসেম্বলিতে ২০০৯ সালে। আর রিপাবলিক নেপালের কনস্টিটিউশন রচনা সম্পন্ন হয়েছিল ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে। কিন্তু এতে সবচেয়ে অখুশি এবং প্রকাশ্যে বিরোধিতা ও অসহযোগিতা শুরু করেছিল ভারত। এমনকি ল্যান্ডলকড যে নেপাল ভারতের ওপর দিয়ে ছাড়া কিছু আমদানি করতে পারে না, অখুশি ভারত এরপর দীর্ঘ ছয় মাস ভারতের ওপর দিয়ে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে অবরোধ করে রেখেছিল। নেপালে ব্যবহার্য রান্নার গ্যাস সিলিন্ডারসহ সব ধরনের জ্বালানি ভারত সরবরাহে চুক্তিবদ্ধ থাকলেও তা বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। আর এতেই সারা নেপালের সব শ্রেণীর মানুষই নিজ নিজ স্বার্থে ও কারণে প্রবলভাবে অ্যান্টি-ইন্ডিয়ান হয়ে উঠেছিল। কোনো রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক বক্তব্যে আকৃষ্ট হওয়ার চেয়েও নিজ নিজ বৈষয়িক ও সারভাইভালের স্বার্থেই তারা হয়েছিল। যেটা এখনও মনমজ্জায় প্রবেশ করে যাবার মত যে এখনও তা প্রবল!
নেপালের রাজনীতিতে চীনের প্রবেশঃ
চীন নেপালের রাজনৈতিক আসরে এই প্রথম প্রবেশ করেছিল তখনই, এই ২০১৫ সালে। কারণ ল্যান্ডলকড নেপালের জনগণ নিজ দেশের বাইরে যেতে ভারতের ভূমি পেরিয়ে বাইরে বের হবার বিকল্প খুঁজছিল। ভারত নেপালের এক উত্তর দিক বাদে বাকি সবদিকজুড়েই।
আর পুরো উত্তরাংশজুড়ে চীন-সীমান্ত হলেও তা আরো পাহাড়ি উচ্চতায় এবং দুর্গম বলে কখনো একে তেমন বিকল্প বলে ভাবা হয়নি। কিন্তু একালে চীনা উত্থানের যুগে চীনা অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থায় হেভি-ডিউটির রেলযোগাযোগ যুক্ত হয়েছে যেটা সমুদ্রবন্দরের সাথেও যুক্ত এমন উন্নত। কিন্তু নেপাল সীমান্তের সবচেয়ে কাছাকাছি চীনের এমন রেলপথটাও নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে দিয়ে চলে গেছে। এতে প্রমাণ হয় নেপালকে নিয়ে চীনের আগ্রহ কেমন কোন সূদুরে ছিল! তবে চীন সম্প্রতি এই ১০০ কিলোমিটার রেলপথ এক্সটেন্ড করে নেপালকে বহির্বিশ্বের সাথে কানেক্ট করে দিয়েছে। যেটা নেপালের কাছে বিরাট কিছু, এক অতুলনীয় বিকল্প।
কিন্তু সারা নেপাল অ্যান্টি-ইন্ডিয়ান হয়ে ফুঁসে উঠার সেই কালেই নেপালে কোয়ালিশন সরকার হওয়ার শর্ত ওলির কমিউনিস্ট পার্টির টার্ম আসে আর এতে দলের পক্ষে ওলি প্রধানমন্ত্রী হয়ে আসেন। আর তাতে, এন্টি-ইন্ডিয়ান সেই পপুলার সেন্টিমেন্ট ভাসা নেপালকে জনগণের পক্ষে সফল ব্যবহার করেন ওলি, একজন মাস পপুলার লিডারের যা করা উচিত সেভাবে। মূলত ওলি বা তার দল সবসময়ই নামকাওয়াস্তেই শুধু কমিউনিস্ট ছিলেন, কাজে নয়। যেমন রাজতন্ত্রী নেপালের যুগে নেপালে রাজনৈতিক দল বলতে সবাই রাজতন্ত্রকে মেনে চলা রাজনৈতিক দল। যে রাজতন্ত্র মেনে চলে সে কেমন কমিউনিস্ট তা তো বুঝাই যায়। এরাই রাজ-সরকারের মন্ত্রী থাকার লোভে রাজার মন জুগিয়ে চলা দল হয়ে কাজ করত। এমন প্রথম চামচা ছিল নেপালি কংগ্রেস দল, আর পরেরটা হল ওলির কমিউনিস্ট দল (CPN (UML))। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওলি পপুলিজম বোঝেন বলেই সেসব পিছনে ফেলে ২০১৫ সালে পপুলার নেতা হয়ে যান। তিনি মাওবাদী দলের নেতা পুষ্প কমল দাহালের (মাওবাদী সশস্ত্র দল হয়ে থাকার সময় তাঁর নিকনেম ছিল ‘প্রচণ্ড’) চেয়েও পাবলিকলি পপুলার। তাই সবমিলিয়ে ইতোমধ্যে ভারত যতই নেপালের চোখে অনিষ্টকারী হয়ে উঠেছিল, চীনা সরকারের সাথে দুই কমিউনিস্ট দলেরই ঘনিষ্ঠতা ও ওয়ার্কিং রিলেশন ততই ঘন হতে থাকে। এমনকি ট্রাডিশনাল নেপাল কংগ্রেস দলও তখন ভারত থেকে দূরত্ব মেনটেন করত। এ দিকে নেপালের ২০১৭ সালের নভেম্বরের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসছিল। তাই ব্যক্তিগতভাবে চীনা নেতারা পরামর্শ দিয়েছিলেন ওলি [সিপিএন-ইউএমএল ] ও দাহালের [সিপিএন (মাওয়িস্ট সেন্টার)] এ’দুই কমিউনিস্ট পার্টিকে একদল হয়ে নির্বাচন করতে। তাতে ঐ নির্বাচনী ফলাফল খারাপ হয়নি। তারা প্রায় দু-তৃতীয়াংশ আসন (১৭৩ / ২৭৫) লাভ করে তাতে ভারত বা নেপালি কংগ্রেসকে আরো ক্ষুদ্র বানিয়ে ফেলেছিল।
মূল সমস্যার গোড়া ওলি নিজেইঃ
কিন্তু সমস্যার গোড়াটা ছিল অন্যখানে। প্রথমত, মাওবাদী দাহালের নিজদলের আজন্ম দুর্বলতা বা খারাপ কপাল হল – এক. ২০০৯ সালের নির্বাচন ছাড়া আর কখনোই পপুলার ভোটের বেলায় দাহালের দল ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পায়নি। সবসময় তৃতীয় স্থানে থেকে গেছে। অথচ ভারতের চরম বিরোধিতা অসহযোগিতা সত্ত্বেও ওলির দল, নেপালি কংগ্রেস ও নিজ দলকে একসাথে রেখে দাহাল পরিস্থিতি মোকাবেলার অর্থে মুখ্য ভূমিকাটা পালন করে গেছিল। দাহাল দল বা রাজনীতির জন্য খুবই ভাল সংগঠক, বিশেষত বভন্ন মতবিরোধের মধ্যেও একসাথে কাজ করে লক্ষ্য অর্জনের দিক থেকে। কিন্তু পাবলিক ইমোশন হ্যান্ডলিংয়ে ঠিক ততটাই যেন তেমন নন। দ্বিতীয়ত, ওলি ব্যক্তিত্ব হিসেবে একজন ফিউডাল লর্ডের মত। তার কাছে দল মানেই, তিনিই এতে একমাত্র ইচ্ছাদাতা, হুকুমদাতা। কিন্তু তার বড় গুণ হল, পপুলার মাস ইমোশন হ্যান্ডলিং ভালো বুঝেন ও পারেন।
সব মিলিয়ে এখন ২০১৭ নির্বাচনের পরের দুই বছরের মধ্যে যা দাঁড়ালো তা হল, ওলি আরো দুর্দমনীয়, একক নিজ হুকুমে চলা, কোনো ফোরামের সিদ্ধান্ত বা কারো কথা না শুনে চলা ব্যক্তিতে পরিণত হলেন। ওদিকে কমিউনিস্ট দুই দল মিলেমিশে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন বলে ওলির পক্ষের দলের সবার সাথে মিলে মিলিত দলের কমিটি গড়তে দাহাল খুবই সফল ব্যক্তিত্ব, কিন্তু ওলির দলের লোকেরাই ওলির প্রশ্নে দাহালের সাথে দাঁড়িয়ে যায়। আগে ওলির সাথে যারা ছিলেন যেমন মাধব চন্দ্র নেপাল, ঝালা নাথ কানাল বা বামদেব গৌতম সহ সবাই থাকলেও তারা এখন দাহালের পক্ষে। তাঁদের দাবি তাঁরা ওলির একগুয়েমি ও ক্ষমতা ক্কুক্ষিগত করার বিরুদ্ধে লড়ছেন [… They were protesting PM Oli’s monopoly in the party and government] আর এটাই একপর্যায়ে ওলিকেই দল থেকে বহিষ্কার করে দেওয়ার অবস্থায় চলে যায়। এই বহিষ্কার ঘটেছে মাত্র তিন মাস আগে, অর্থাৎ ওলির সাথে মিলিত দলের সবার বিরোধ প্রকাশ পাওয়ারও প্রায় দু’বছর পরে।
চীনের অতি আগ্রহঃ
কিন্তু তাহলে, কেন এত সময় লাগল? এটাই চীনের অনুরোধের ‘ঢেঁকি গেলা’; চীনের অতিরিক্ত জড়িয়ে যাওয়া যা অযাচিত পর্যায়ের। গত ২০১৭-৮ সালের দুই কমিউনিস্ট দলে ঐক্য করে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সময় থেকে চীন ক্রমশ একেবারেই লাগামছাড়া ভাবে নেপালের রাজনীতির হাত ঢুকাতেই থাকে।
মাওয়ের “সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ”?
যার সোজা অর্থ চীনা কমিউনিস্টরা যেমন কোল্ডওয়ারের যুগে বাংলাদেশের মত দেশগুলোতে থাকা চীনা কমিউনিস্ট দলের সাথে অধীনস্ত নির্দেশগ্রহিতা আচরণ ও সম্পর্ক স্থাপন করে চলত যেন সেই যুগ আবার ফিরে এসেছে। একই অবস্থা ছিল সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির বেলাতেও। তারা আমাদের মত দেশে অর্থ ও তত্বের যোগানদার হলেও মুখ্য সবকিছুতে হাত ঢুকিয়ে বসে থাকত। আসলে আমাদের মত দেশের নেতারাই সেটা চাইত। অথচ আলাদা রাষ্ট্র মানেই আলাদা আলাদা একান্ত স্বার্থ। নেপালের রাষ্ট্রস্বার্থ কখনও চীনা রাষ্ট্রস্বার্থ নয়। তেই পারবে না, পারে না।তাতে দুদেশেই কমিউনিস্টরা ক্ষমতাসীন হলেও কোন হেরফের হয় না। হ কারণ রাষ্ট্র মানেই কেবল নিজ ভুখন্ডের বাসিন্দাদের স্বার্থ দেখা ও সবার উপরে জায়গা দেয়া। এগুলো রাষ্ট্র সম্পর্কে খুবই নুন্যতম ও বেসিক ধারণা। আদর্শের কথা তুলে রাষ্ট্রস্বার্থের ভিন্নতাকে আড়ালে ফেলা যাবে না। কাজেই নেপাল ও চীনের দুই কমিউনিস্ট পার্টি কখনই কেউ কারও কথা শুনে অনুগত হয়ে চলতে পারে না। এমন সম্পর্ক যদি চালু করা হয় তবে এর অর্থ হয়ে যাবে নেপাল আর আলাদা রাষ্ট্র নয়, চীনেরই এক্সটেন্ডেড কোন প্রদেশ মাত্র। কমিউনিস্টদের এমন অযাচিত ভয়ঙ্কর চর্চা সোভিয়েত পতনের পর আপনাতেই হারিয়ে গেছিল। চীন কেন সেই হারানো অভ্যাস আবার ডেস্পারেট হয়ে সামনে আনছে আমরা জানি না। কিন্তু এটা মারাত্মক বিপদজনক এবং চীনের জন্যও আত্মঘাতি। এটাকেই তো মাও “সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ” বলতেন! নয় কি?
এতে বড় ভুলের এক নম্বরটা হল, একধরনের ‘কমিউনিস্ট ভাই ভাই’ অযথাই খুঁজে বের করে চীনের সাথে সম্পর্ক গড়া ও রাখার চেষ্টা সুপ্ত আছে এতে। এটার ফল চীন ও নেপাল দুরাষ্ট্রের জন্যই আত্মঘাতি হতে বাধ্য। এটার প্রকট প্রকাশ আমরা দেখেছি নেপালে চীনা রাষ্ট্রদুত Hou Yanqi এর অবাধ ততপরতায়। এছাড়া সাথে দেখা যায়, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) আন্তর্জাতিক বিভাগের উপমন্ত্রী গুও ইয়াজহু (Guo Yezhou) কে। প্রায়ই তাঁর কাঠমান্ডু সফরে, দুই কমিউনিস্ট অংশকে ধরে রাখতে। নিঃসন্দেহে এগুলো নেতি-ইমেজের কেলেঙ্কারি ছাড়া এ’দুই দেশকে আর কিছুই দিবে না।
অথচ ‘চীন’ বলে যাকে আমরা দেখছি সে হল হবু গ্লোবাল নেতা যার স্বার্থ অনেক জটিল ও আলাদা। তাই ‘নট নেসেসারিলি’ নেপালের কোনো দল বা নেপালরাষ্ট্রের স্বার্থের সাথে মিলবেই অথবা মিল থাকাটা জরুরি। আর শেষ বিচারে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতিটি দেশের মধ্যে ভারত ও চীনের যে প্রবল স্বার্থ- লড়াই তাতে এ দু’জনের যাকেই আমাদের বেশি ভালো লাগুক না কেন শেষ বিচারে নিজ রাষ্ট্রস্বার্থই সব কিছুর ঊর্ধ্বে রাখতেই হত। এবং যেকোন পরিস্থিতিতে হতেই হবে। কিন্তু এটা থাকেনি। এতে এখন যদি নেপালি কংগ্রেস দল আমেরিকা বা ভারতের নেতাদেরকে নেপালে নিয়ে এসে দলীয় সভা শুরু করে তাহলে সেটাকে ক্ষমতাসীন কমিউনিস্টরা কি বলে বাধা দিবেন?
অথচ পালাবদলের এই কালে যখন আরও সতর্কতা ও দুরত্ব রক্ষার অনুশীলনের দরকার ছিল। তা বজায় রাখলে চাইলে নেপালকে চীন, ভারত ও আমেরিকা থেকে একটা সম-দূরত্ব অবশ্যই বজায় রাখতে হবে। তবেই একমাত্র নেপালের নিজ রাষ্ট্রস্বার্থ বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হতে পারে। দ্বিতীয়ত, এখান থেকেই আসে নিজ দেশের দলগুলো চীন, ভারত বা আমেরিকা এই তিন দেশের একেকটার প্রতিনিধি বা দালাল হয়ে খাড়িয়ে যেন না যায় এব্যাপারে সকল দলের সতর্কতা। এটা হতেই পারে না, এ্মনটা বন্ধ করতে হবে। দেশের দলমাত্রই সবাইকে একমাত্র নিজ রাষ্ট্রস্বার্থের রক্ষকই হতে হবে। যদি এসব কথা উপেক্ষা করা হয় পরিণতি হবে নিজ রাষ্ট্র অকার্যকর হয়ে পরা।
অথচ গত দুই বছরে যতবারই অলির বিরুদ্ধে তার দল সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে গেছে চীন বারবার ভেতরে হাত ঢুকিয়েছে। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হতে দেয় নাই। এটা টু মাচ, সীমা পার হয়ে গেছে। বিশেষত যেখনে ওদিকে ওলি ভারতের গোয়েন্দা বাহিনী র এর প্রধানকেই প্রকাশ্যে দাওয়াত দিয়ে নেপালে এনেছিলেন। বুঝা যাচ্ছিল তিনি ভারতের সমর্থনে ক্ষমতায় থাকতে চাচ্ছিলেন।
যদিও এক কম্বোডিয়া ছাড়া কোথায় চীন এমন করেনি। তাই দাহালের উচিত ছিল এর সমস্যার দিকটা খোলাখুলি বুঝিয়েই চীনকে নিবৃত্ত রাখা এবং এ কাজে তার অসফল হওয়ার কোন স্কোপ নাই। আবার চীনের অনুমান যে, ওলিকে বহিষ্কার করে দিলে তিনি নেপাল কংগ্রেস ও ভারতের সাথে মিলে পাল্টা সরকার গঠনসহ বিরাট কিছু করে ফেলতে পারেন- এ অনুমানও এত দিনে ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়েছে। আর তা যদি হয়েই যায় তবে সেটাও নেপালের রাজনীতিকদেরই নিজেদের মোকাবিলা করতে হবে। চীন-ভারত নয়, আগে নেপালকে নিজে বাঁচতে হবে। অন্তত একালের তিন বিদেশ রাষ্ট্র চীন, ভারত ও আমেরিকা থেকে দূরে এক “সম্পর্কের ভারসাম্য বিন্দু” অবশ্যই তৈরি ও মেইনটেন করে চলতে হবে।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
[এই লেখাটা গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১, দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ওয়েবে ও পরদিন প্রিন্টেও “চীন-ভারত নয়, নেপালের নিজে বাঁচা” – এই শিরোনামে ছাপা হয়েছিল। আমার নয়াদিগন্তে ছাপা হওয়া লেখাগুলোকে আমার লেখার ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ বলা যায়। পত্রিকার কলাম লেখার সুবিধা অসুবিধা দুটোই আছে। প্রথম অসুবিধা লেখার সাইজ মোটামুটি ২০০০ অক্ষরের মধ্যে রাখতেই হয়। কারণ এটাই কাগজে ছাপা হয় বলে। আবার সুবিধার দিক হল, এই প্রথম ভার্সানে যেভাবে চিন্তা করে লিখেছিলাম তা নিজেই আবার রিভিউ করে নিয়ে নতুন ফোকাসে এখানে সেকেন্ড ভার্সান হিসাবে লেখাও যায়। ফলে আমার এই নিজস্ব সাইটের সেকেন্ড ভার্সান হিসাবে লেখাটাকে পাঠক থিতু ভাষ্য বলে গণ্য করতে পারেন।
সেভাবেইপরবর্তিতে ঐ লেখাকে এখানে আরও অনেক নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে ও নতুন শিরোনামে এখানে আজ ছাপা হল। ]