হাত ধুয়ে ফেলাটা মাইলামের পক্ষেও যাবে না
গৌতম দাস
২২ মার্চ ২০২১, ০০:০৬ সোমবার

উইলিয়াম ব্রায়ান্ট মাইলাম, একজন আমেরিকান ক্যারিয়ার ডিপ্লোম্যাট। আনুষ্ঠানিক অবসর নিয়েছেন জুলাই ২০০১ সালে। তবে এরপরও মাঝে মধ্যে ছোট ছোট এসাইনমেন্টে আমেরিকান স্টেট ডিপার্টমেন্টের অধীনে স্বল্প সময়ের খুবই অস্থায়ী রাষ্ট্রদূত বা বিশেষ দূত ধরনের চুক্তিতে নিয়োগ নিয়েছেন। তবে এখন সেসবও ছেড়ে পুরোপুরিভাবে ‘উড্রো-উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার’ নামের থিংকট্যাংকের ফেলো বা সিনিয়র পলিসি স্কলার। তিনি এককালে বাংলাদেশে ও পাকিস্তানে আমেরিকান এম্বাসাডার ছিলেন। তবে বাংলাদেশে তাঁর আরো বিশেষ পরিচয় আছে। প্রশাসনে বৈধভাবেই লবি করার দেশ আমেরিকা; সেখানে আমেরিকান প্রশাসনে বাংলাদেশের রাজনীতিকদের নানান স্বার্থ নিয়ে যারা কোনো লবি করতে চান বা করেছেন, তাদের চোখে মাইলাম একজন ভাল প্রভাবশালী ওজনদার ব্যক্তিত্ব, যিনি পলিটিক্যাল ক্লায়েন্টকে ‘অনেক দূর’ পৌঁছে দিতে পারেন। অনুমান করা হয়, তার এমন পরিচয় তৈরি হয়ে যাওয়ার পেছনে দুটা মূল ঘটনা আছে।
কথিত ‘স্বৈরাচারমুক্ত’ যুগের শুরুর কালেঃ
এরশাদ যুগের পরে গত ১৯৯১ সাল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক “নবজন্মের কাল” বলে খামোখা উচ্ছ্বাস দেখানোর চেষ্টা করতে অনেককে দেখা যায়। সেটা এমন এক অর্থে যেন তা ছিল এরশাদের পতনের পরের কথিত ‘স্বৈরাচারমুক্ত’ যুগের শুরু। বলা বাহুল্য, এটি অতি-আবেগি বাস্তবতাশূন্য ও নিজেকে খামোখা বড় দেখানো এক দাবি মাত্র। আসলে এটার সাথে বুদ্ধি-বিবেচনাহীন আরেক প্রবল আবেগ ঐ সময় কাজ করত যাতে বলা হয়ে থাকে যে, এতে “স্বৈরাচার পতন ঘটিয়ে” নির্বাচিত সরকারের যুগের পথের সূচনা হয়েছিল। এখানে ‘স্বৈরাচার পতন’ বলে গলা কাঁপানো হয়েছে, অথচ আমাদের কনস্টিটিউশন আগেরটাই আছে, বরং সেই থেকে একে ক্রমশঃ আরো এমন ‘দানব’ করে নেয়া হয়েছে যে, একটা বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করার মুরোদও এর নেই। এ ছাড়া আবার চলতি সরকার মনে করছে, বাংলাদেশে বিশ্বাসযোগ্য কোনো নির্বাচন আয়োজন কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজ না; তা পুরোপুরি অপ্রয়োজনীয়। বরং মুজিব হত্যার বিচার ও বাংলাদেশের ৫০ বছরপূর্তিতে তার নাম উজ্জ্বল করে সর্বত্র তা লিখে দিলে এটাই হবে “দেশ ও জনগণের জন্য” বড় অর্জন। নিশ্চয় আজকের এই বাংলাদেশকে দেখার পর পুরনো সেসব উচ্ছ্বাস জ্ঞাপনকারী লোকজনের এখনো কিছু লজ্জা জীবিত থাকলে তাতে তারা নিজেকেই আসলে মূল্যায়ন কিভাবে করেন তা আমরা দেখতে চাইতে পারি।
উইলিয়াম বি মাইলাম – তিনি বাংলাদেশের ঐ ‘এরশাদ থেকে নির্বাচিত সরকার’ কথিত এই রাজনৈতিক ট্রানজিশনের কালে বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তিনি রাষ্ট্রদূত ছিলেন আগস্ট ১৯৯০ থেকে অক্টোবর ১৯৯৩ পর্যন্ত, এই হলো প্রথম ঘটনাটা। এ ছাড়াও তার আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়ের পয়েন্ট আছে। সেটা হল, তাঁর রাষ্ট্রদূতের এসাইনমেন্টেরই আগে বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট আরেক এসাইনমেন্টে ছিলেন তিনি।
প্যারিস ক্লাবঃ
যাদের জন্ম ১৯৮৫ সালের পরে তারা টার্মটা একাডেমিক পড়াশোনায় অতীতের ঘটনা-ফেনোমেনা হিসাবে শুনে থাকবেন হয়ত; তবে এই ‘সেকাল’ তাঁরা দেখেননি। এমন সেই শব্দটা হল, ‘প্যারিস ক্লাব’ [Paris Club]। জন্মের পর থেকেই বাংলাদেশ প্রতি বছরের রাষ্ট্রীয় বাজেট নিজেই নিজ-রাজস্ব সংগ্রহ করে বাজেট-প্রণয়ন করতে পারতাম না। কারণ রাষ্ট্র-সরকারের রাজস্ব ও অন্যান্য আয় ছিল খুবই কম, ফলে এডিপি [এনুয়াল ডেভেলবমেন্ট প্রোগ্রাম]) বা উন্নয়ন বা বিনিয়োগ ব্যয়ও ছোট রাখতে হত। আবার যত কম উন্নয়ন ব্যয় ততই পরের বছর আরো কম রাজস্ব আয় – এমনই এক চক্রের মধ্যে ধীরে ধীরে ডুবে যাওয়া ঘটছিল আমাদের। এমন চক্রে পড়ে যাবার পিছনে একেবারে মূল কারণ হল, অবকাঠামো খাতে ব্যয়-বিনিয়ো্গের অক্ষমতা; সেটা বাইরে থেকে বা দেশের ভিতর থেকে সংগ্রহ করে আনা বা জোগাড়ের অক্ষমতা। তবে কলোনি আমল থেকেই বাংলাদেশের অর্থনীতির উদ্বৃত্ব পাচার বা লুট হয়ে যাবার ধারা ত সবসময় ছিলই; যেটা আসলে সব কারণের উতস। সবমিলিয়ে আমাদের রাজস্ব সংগ্রহ আর জনগণের ট্যাক্স দেয়ার ক্ষমতাও এতই কম ছিল যে এর থেকে সরকার চালানোর খরচ ও ব্যয়নির্বাহের দায় মানে যা প্রয়োজন আর পকেটে যা আছে – এদুইয়ের মধ্যে ঘাটতি ও ভারসাম্যহীনতাতেই আমাদের দিন যেত। এ ছাড়া সরকারের প্রশাসনিক অদক্ষতায় অপচয়ও ছিল সীমাহীন; তাই সেটাও আরেক বাধা। আবার স্বাধীনতার পর কলকারখানার ব্যাপক সরকারিকরণ তাতে সে কারখানা উতপাদন চালু থাকুক আর নাই, লাভ হোক আর নাই হোক কিছু এসে যায় নাই ফারাক নাই – কিন্তু প্রতিবছর এর বেতন-ভাতা, দুর্নীতি ও অপচয় যোগানোর দায়, এই ব্যয়ের অর্থযোগাড় বাজেটকে অসম্ভব করে তুলছিল। ফলে বাস্তবত প্রথমে কিছু বিদেশী অনুদান আর পরে বিদেশি অবকাঠামো ঋণ-বিনিয়োগ প্রাপ্তি ছিল আমাদের আয়-ব্যয়ের ঘাটতি মেটানোর একমাত্র উপায়।
“কমিউনিস্ট গোঁয়ার্তুমির” খেসারত কী দিয়ে বাংলাদেশে তা শেষ হয়েছিলঃ
কিন্তু এখানে খুব স্বল্প পরিসরে থেকে একটা কথা বলে নেই। বিদেশী ঋণ ও অনুদানে বাজেট তৈরির এই যে বিশেষ রকম ও বাস্তবতা, এটাই শেখ মুজিবের শাসনের সাড়ে তিন বছর আর তাঁর মৃত্যুর পরের বাংলাদেশের প্রধান ফারাক। সেটা কেমন? আগেরটা মানে একাত্তরের স্বাধীনতার পর থেকেই বিদেশী অনুদান ও ঋণ নিব না বলে বুঝি-না-বুঝি এক “কমিউনিস্ট গোঁয়ার্তুমি” করে চলা এটাই ছিল তাজউদ্দীনের অর্থনীতির মূল বৈশিষ্ট। এতেই অর্থনীতি ‘ডুবছিল’ আর একসময়ে দেখা গিয়েছিল ১৯৭৪ সালের জুলাইয়ের দুর্ভিক্ষ। কোন ফরেন রিজার্ভ নাই। আর এখান থেকেই ক্ষুব্ধ মুজিবের সব কিছু নিজ একক কর্তৃত্বে নেয়া, তাজউদ্দীনকে বাদ দিয়ে মন্ত্রিসভা ঢেলে সাজানো আর শেষে ঐ সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্ক জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বৈঠক এটেন্ড করার উসিলায় ওয়াশিংটনে সফর, কিসিঞ্জারের সাথে সাক্ষাৎ, ‘বটমলেস বাস্কেট কেস’ বলে মন্তব্য শোনা এবং বিশ্বব্যাংকের সাহায্য পাওয়ার জন্য বন্দোবস্তের আবেদন ইত্যাদি সেরি তিনি ফিরেছিলেন। কারও উপর ভরসা না করতে পেরে ঐ “সব কিছু নিজ একক কর্তৃত্বে নেয়া” এরই বাইরের দিকটা থেকে দেখানোর নাম ছিল তিনি “বাকশাল গঠন” করেছেন বা তিনি “সমাজতন্ত্রের পথে” রওনা। আমাদের ক্ষতের দিক আমরা ঢেকে রাখি, এটা দেখানোর কিছু নাই। আর এসব ঢাকাঢাকি করতে গিয়ে কতকিছুই না অর্থহীন কান্ড আমরা করি! তাই, বিশ্বব্যাংকের সাহায্য পাওয়ার জন্য বন্দোবস্তের আবেদনকেই পরিচিত করিয়ে দিতে হয় “বাকশাল গঠন” বলে। কিন্তু শেখ মুজিবের দুর্ভাগ্য হল তিনি পপুলার নেতা, যিনি ভুলের জন্য মাফ চেয়ে আবার পাবলিকের সামনে খাঁড়া হতে পারলে আবার তাদের সংগঠিত করে ফেলবার সম্ভাবনা – এমন নেতাদের বেলায় এমন সম্ভাব্য ক্ষমতা সব সময় থেকে যায়। সম্ভবত সে কারণেই বা যেকোন কারণেই হোক বেঁচে থাকতে তিনি আমাদের অর্থনীতিতে বিশ্বব্যাংকের নজর, পরামর্শ ও অনুদান-ঋণ পাওয়া প্রভৃতি দেখে যাবার সুযোগ পান নাই। মুজিবের ঐ আবেদন ও গ্রাউন্ড ওয়ার্কের নড়াচড়া আমরা পরে জিয়ার আমলের শুরু থেকেই পেতে শুরু করেছিলাম।
তাহলে বাংলাদেশের জন্য ‘প্যারিস ক্লাব’ কী?
তাহলে এর মধ্যে আবার ‘প্যারিস ক্লাব’ কী? এটা হল, বিদেশি অনুদান-ঋণ দাতাদের এক ইনফরমাল জমায়েত। প্রতি বছর আমাদের বাজেটের আগে (এখনও রেওয়াজ অনুযায়ী আমাদের বাজেট পেশ করা হয় প্রতিবছর ১২ জুন।) এপ্রিল মাসে কেবল বাংলাদেশের জন্য আমেরিকাসহ পশ্চিমের দাতা দেশগুলোর এক সমন্বয় বৈঠক বসত, প্যারিসে। তাই ‘প্যারিস ক্লাব’ নামকরণ। এরই ব্যাকগ্রাউন্ড কর্তা থাকে স্থানীয়-বিশ্বব্যাংক। সরকারের অনুদান-ঋণ পাওয়ার অনুরোধে পেয়ে যারা অনেক আগে থেকেই সেগুলো বাছাইয়ের কাজ শুরু করে থাকে। পরে সরকারের সাথেও বসে। আর ফাইনালি যেসব প্রকল্পগুলো নিবার পক্ষে সুপারিশ তৈরি করত যেমন, কী কী প্রজেক্ট সে অনুদানের জন্য বা ঋণের জন্য স্থানীয় বিশ্বব্যাংক অফিস প্রাক-অনুমোদন দিয়েছে সেসবের উপরে যাতে দাতারা ফান্ড দেয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। বিশ্বব্যাংকের আইডিএ (IDA) লোন ও অনুদান পাওয়ার ব্যবস্থাটা কাজ করে এভাবে। আর ঐ প্যারিস বৈঠকে প্রাপ্ত ফান্ড অনুমোদন বা প্রতিশ্রুতির ওপর ভরসা করেই পরের জুন মাসে আমাদের বাজেট তৈরি হত। আমাদের আজ যা কিছু অর্থনৈতিক রূপান্তর ও উন্নতি এর সব সেখান থেকেই। তবে পরবর্তীকালে এরই এক পর্যায়ে এপ্রিলের বৈঠকটা ঢাকাতেই বসা শুরু হয়েছিল। এর মূল কারণ তত দিনে আমরা অনেক স্বাবলম্বী; ফলে লোন ও অনুদানের পরিমাণ কমে এসেছিল। ফলে দাতাদের জন্যও ফান্ডের প্রতিশ্রুতি দিতে দাতাদেশের তেমন বড় কর্তা না হলেও চলে এমন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল আর এটাই মূল কারণ বলা যেতে পারে। আর সেটাই এখনও চলছে কিন্তু একেবারেই রুটিন, আমরা আরো অনেক স্বাবলম্বী বলে এখন দেখা যাচ্ছে। মধ্য আয়ের দেশের পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার অবস্থায় গেছি বলে গর্ব করতে দেখা যাচ্ছে। আমরা গরীব ছিলাম বলে বিশ্বব্যাংকের খাতায় আইডিএ ক্যাটাগরিতে ঋণের যোগ্য আমাদের এমন জায়গা হয়েছিল। আইডিএ ক্যাটাগরি মানে একেবারেই স্বল্পসুদে মানে ০.৭৫% যা ঠিক সুদ নয় সার্ভিসচার্জ) ঋণ এবং এছাড়া বিনাসুদে-বিনাফেরতে কিছু অনুদানও পাওয়া যেত। তবে এই জমানায় মধ্য আয়ের দেশ বলে দাবি – এমন করার জন্য বিশেষ কিছু অনুদান ছাড়া, আগের আইডিএ ঋণ এখন প্রায় সব বন্ধ। আর লোনে সুদের হারও বেড়ে হয়েছে ২-৪ শতাংশ পর্যন্ত। কিন্তু সেসবের সাথে আমাদের এখানের প্রসঙ্গ – মাইলামের কী সম্পর্ক?
ডেপুটি এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি মাইলামঃ
গত ১৯৯০ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হওয়ার আগে, (১৯৮৫-৯০) উইলিয়াম মাইলাম তিনি টানা পাঁচ বছর ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের (১৯৮১-৮৯) ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি, [Deputy Assistant Secretary of State for International Finance and Development.]। মানে যার দায়িত্ব ছিল বিদেশে আমেরিকার দান-অনুদান দেয়া মানে “ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট” ডিপার্টমেন্ট দেখাশোনা করা। আর এই সূত্রে তিনি বাংলাদেশের জন্য ঐ ‘প্যারিস ক্লাবে’ দাতা আমেরিকার প্রতিনিধি হয়ে হাজির থাকতেন [He represented the United States at the Paris Club]।
এদিকে আজকের বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে যা কিছু হয়েছে বা আরো হওয়ার সম্ভাবনা, ভাল-মন্দ মিশিয়ে এরই ভিত গড়া হিসেবে অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কারটা (তাতে বহু বড় বড় ধরণের নেগেটিভ দিক আছে তা সত্ত্বেও) ঘটেছিল ঐ আশির দশকে ১৯৮২ সালে এরশাদের ক্ষমতা দখল থেকে। সেকালে এর আনুষ্ঠানিক নাম ছিল, “স্ট্রাকচারাল এডজাস্টমেন্ট প্রোগ্রাম” বা [SAP] এবং যা প্রগতিশীলদের কাছে এক “স্যাটায়ারিক্যাল” শব্দও বটে। বিগত ১৯৮৫ সালের পরের সেসব দিন থেকে মাইলাম বাংলাদেশের সাথে একারণে অনেকভাবে জড়িত হয়ে যান। বিশেষ করে পরে ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার আমলে প্রথম তিন বছর মাইলাম এ’দেশে আমেরিকান রাষ্ট্রদূত বলে নিয়োগ পাওয়ায় সম্ভবত বিএনপির নেতাদের সাথে ব্যক্তি-সম্পর্ক অন্য সবার চেয়ে বেশি হওয়াতে, এমনটা মনে করা হয়। উইলিয়াম বি মাইলামের সাথে বাংলাদেশে পরিচয় ও সম্পর্কের সংক্ষিপ্ত বয়ান এখানেই শেষ করব আমরা।
সম্প্রতিকালের উইলিয়াম বি মাইলামঃ
আগেই বলেছি সেই উইলিয়াম বি মাইলাম এখন ‘উড্রো-উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার’ নামের থিংকট্যাংকের ফেলো। গত মাসের ১৭ ফেব্রুয়ারি মাইলামের এক রচনা-মন্তব্য অনেক মিডিয়ায় ছাপা হয়েছে। ওর শিরোনাম ‘পলিটিক্যাল হিপোক্রাসি নোজ নো বাউন্ড অর বর্ডারস’ [Political hypocrisy knows no bounds or borders]। নিজ দায়িত্বে এর একটি ভাব-বাংলা করলে দাঁড়ায়, “রাজনৈতিক ভণ্ডামির কোনো সীমা বা সীমান্ত থাকে না”।
অনেক কিছুই সীমাহীন হতে দেখা যায়। যেমন, অমুক ফ্যানক্লাব অমুকের সীমাহীন সমর্থক; এমন হতেই পারে। কিন্তু মাইলাম বলছেন, শুধু সীমা না। ‘সীমান্তও’ থাকে না। কেন? কারণ তিনি বাংলাদেশের সরকারপ্রধান আর আমেরিকান কিছু সিনেটরের সাম্প্রতিক আচরণ-বক্তব্যকে তুলনা করছিলেন। তুলনা করছিলেন দুটাই তাঁর চোখে “রাজনৈতিক ভন্ডামি” সমতুল্য উদাহরণ বলে। এবছরের শুরুতে ট্রাম্পের টার্ম শেষের পরে, তাঁকে নিয়ে “সিনেট ইমপিচমেন্ট” বা (দোষী ঠাউরানোর প্রক্রিয়া) শুরু হয়েছিল। আর সেখানে কিছু সিনেটর-পলিটিশিয়ানের তিনি তুলনা করছিলেন। মাইলাম ঐ রচনায় বলছিলেন, আমেরিকান কোন এক জার্নালে ঢাকার ডেইলি স্টারের একটা খবর কোট করা হয়েছে যেখানে প্রধানমন্ত্রী নাকি বলেছেন বলে লেখা হয়েছিল যে, “আমাদের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতার জন্য গণতন্ত্রে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল অবশ্যই থাকতে হয়। কিন্তু আমাদের বর্তমান সংসদের বিরোধী দলগুলো উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস কাঙ্খিত স্তরে অর্জন করতে পারেনি।’ [……The Daily Star, that I saw the article in which Sheikh Hasina is quoted as saying, “[F]or a democracy, a strong opposition party is a must as we want our democratic trend to continue.” She went on to say, according to the article, “The present opposition parties in Parliament could not attain the confidence and trust of the people at the desired level due to lack of leadership.”]। আমেরিকান সিনেটের কিছু সদস্যের ট্রাম্পের ইম্পিচমেন্টকে বাতিলের পক্ষে ভোট দেয়ার সময়ে দেয়া বক্তৃতার সাথে হাসিনার এই মন্তব্যকে তুলনা করেছিলেন মাইলাম। আর তাতে এসবকে “সীমা ও সীমানা” অতিক্রম করে যাওয়া দুই ‘ভণ্ডামি’ হিসেবে দেখাচ্ছিলেন মাইলাম।
আমরা মাইলামের ঐ লেখার আরও ডিটেলের দিকে আর আগাচ্ছি না। তবে মাইলাম তার এ রচনায় যা সিদ্ধান্ত টেনেছেন যেটা তার রচনার শুরুতে শিরোনামের নিচে সারসংক্ষেপ হিসেবে দেয়া আছে, সেটাতে চলে যাবো। কারণ সেটিই আমাদের প্রসঙ্গ। মাইলাম বলেছেন, ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্র ব্যর্থতায় ডুবে যাওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনাই দায়ী যদিও, বিরোধী দলের ওপরও কিছুটা দায় বর্তায়।’ [Awami League and Sheikh Hasina are responsible for the failure of democracy in Bangladesh, but the opposing party also bears some responsibility, writes William Milam] তাই কী? বাংলাদেশের দুর্দশায় বিদেশি বন্ধুদের কোনো দায় নেই?
উড্রো-উইলসন সেন্টারের দুই ফেলোঃ
মাইলামের মত আরেক বাংলাদেশী-অরিজিন স্কলার ড. আলী রিয়াজ; তিনিও ‘উড্রো-উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার’ থিংকট্যাংকের ফেলো। তবে বর্তমানে রিয়াজ নিয়োগকর্তা বদলে নিয়ে ‘আটলান্টিক কাউন্সিল’ [The Atlantic Council ] নামে আরেক আমেরিকান থিংকট্যাংকের সিনিয়র ফেলো। আর গত ১৮ মার্চ থেকে আলী রিয়াজ চার পর্বের এক মতামত-কলাম যৌথ নামে ঢাকার প্রথম আলো পত্রিকায় ছাপা শুরু হয়েছে। সেই লেখার প্রথমপর্বটাই যার শিরোনাম “ভূরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ” – এটাই যেন একটি সাক্ষ্য দলিল। সেখানে তিনি আমাদের জানিয়েছেন যে, বুশ প্রশাসন একান্তই নিজের সঙ্কীর্ণ রাষ্ট্রস্বার্থে কিভাবে ও কেন বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ করে ১/১১-এ ক্ষমতা নিয়ে ছিল আর ভারতের হাতে তুলে দিয়ে বাংলাদেশকে বেচে দিয়েছিল। এনিয়ে তাঁর লেখার কিছু অংশ এখানে নিচের প্যারায় তুলে এনেছি যেটা, প্রেসিডেন্ট বুশের বাংলাদেশ হস্তক্ষেপ সম্পর্কে আলী রিয়াজের এক সাক্ষ্য-ভাষ্য হিসাবেও অবশ্যই তা পাঠ করা যায়।
আলী রিয়াজ লিখছেন,
“নাইন-ইলেভেনের হামলার পর মুসলিমপ্রধান দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে বিবেচনার কারণে বাংলাদেশ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। নিরাপত্তার বিষয়কে প্রাধান্য দেয়া এবং বুশ প্রশাসনের কথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ বিবেচনা থেকে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে বাণিজ্যের সাথে যুক্ত হয় নিরাপত্তা সহযোগিতার বিষয়। জর্জ ডব্লিউ বুশের আমল থেকেই যুক্তরাষ্ট্র মূলত ভারতের চোখেই বাংলাদেশকে দেখে এসেছে। এর পেছনে একটি বড় কারণ হচ্ছে, এ অঞ্চলে ভারতীয় আধিপত্য নিশ্চিত করে যুক্তরাষ্ট্র পরাশক্তি চীনকে ঠেকাতে চায়।’
এ প্যারাটা আসলে শত কথার বদলে মাত্র কয়েকটা কথা। প্রথমত, রিয়াজ সাক্ষ্য দিচ্ছেন তার কথায়, “আমেরিকা ভারতের স্বার্থের চোখে বাংলাদেশকে দেখেছিল”। কিন্তু কেন? এর জবাব পরের বাক্যে। বলেছেন, “আমেরিকা এশিয়ায় ভারতের আধিপত্য নিশ্চিত করতে চায়”। মানে শুধু দেখা নয়, আমেরিকা ভারতের আধিপত্যই একেবারে নিশ্চিত করতে চায়। সেটাও বা আবার কেন? কারণ আমেরিকা “পরাশক্তি চীনকে ঠেকাতে চায়”। মানে চীনের অর্থনৈতিক উত্থানের বিরুদ্ধে এটা ঠেকাতে আমেরিকা “চায়না কনটেইনমেন্ট”[China Containment] বা চীন ঠেকানো করতে চায়। যদিও এই অবজেকটিভ ফেনোমেনা আদৌ ঠেকানো যায় না, সেই চেষ্টা করা বৃথা ও অকার্যকর হবে এবং হচ্ছে তা জানা সত্ত্বেও।
অর্থাৎ আমরা দেখছি আলী রিয়াজ ক্লিয়ার ও ক্যানডিড হয়েই কথা ‘তিনটি’ বলেছেন। যার কোনো দুই রকমের মানে নেই। এর ভেতরে এশিয়ায় চীনের বদলে ভারতীয় আধিপত্য ছেয়ে ফেলা নিশ্চিত করেছে আমেরিকা – এ স্বীকারোক্তির মধ্যে রিয়াজ কোনো সমস্যা মনে করেছেন বা অন্যায় দেখেছেন, তা মনে হয়নি। স্বাভাবিক হিসাবেই দেখেছেন। অথচ এরপরেও আবার ভারতকেই দায়ী করে বলেছেন, “প্রায় এক দশক ধরে ভারত আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদী সরকারব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করেছে”। যে আমেরিকা ভারতকে দানব বানালো এখন সেই ভারত কেন বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদী সরকার আনলো এর জন্য আমেরিকাকে না ভারতকেই দায়ী করছেন আলী রিয়াজ।
আমরা তা হলে দুই থিংকট্যাংক ফেলোর বক্তব্য জানলাম। রিয়াজ আমাদের পরিষ্কার সাক্ষ্য দিয়ে জানাচ্ছেন বুশের আমল থেকেই আমেরিকান প্রশাসনগুলোর বাংলাদেশে ঢুকে পড়া ও হস্তক্ষেপগুলো কত গভীরে ছিল। এছাড়া দেখা যাচ্ছে, আমেরিকার সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়া বলে আসলে কিছু ছিল। ছিল এর আড়ালে বাংলাদেশ দখল করে নেয়া ও ভারতের হাতে তুলে দেওয়া।
তা হলে দেখা যাচ্ছে আলী রিয়াজ আমেরিকান সব হস্তক্ষেপ স্বীকার করে নিলেও আজকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দুর্দশাগুলোর জন্য মানুষের যে সাফোকেশন, শ্বাস নিতে পারছে না দশা এ জন্য মাইলাম আমাদের সরকার আর বিরোধী দলকেই পুরো দায়ে দায়ী করছেন। এভাবে মাইলাম নিজের দেশ আমেরিকার প্রশাসনের হাত ধুয়ে ফেললেন; এটি কী ঠিক হল? না এটা বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্য হবে? এ নিয়ে তার ব্যাখ্যা দেয়া উচিত। নিজ দল-গোষ্ঠীর কাজের দায় অস্বীকার করা কোনো কাজের কথা নয়। ভুল মনে করলে তা স্বীকারের সৎসাহস দেখানোই আমরা আশা করব। স্টার্টার হিসেবেও এসব খুবই অখাদ্য! একাজ তাঁকেও কোন সুবিধা দিবে না। বরং মানুষ হিসাবেও তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকবে!
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
[এই লেখাটা গত ২০ মার্চ ২০২১, দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ওয়েবে ও পরদিন প্রিন্টেও “মাইলামের হাত ধুয়ে ফেলা অগ্রহণযোগ্য” – এই শিরোনামে ছাপা হয়েছিল। নয়াদিগন্তে ছাপা হওয়া লেখাগুলোকে আমার লেখার ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ বলা যায়। পত্রিকার কলাম লেখার সুবিধা অসুবিধা দুটোই আছে। প্রথম অসুবিধা লেখার সাইজ মোটামুটি সর্বোচ্চ ২০০০ অক্ষরের মধ্যে রাখতেই হয়। কারণ এটাই কাগজে ছাপা হয় বলে জায়গা সীমিত। আবার সুবিধার দিক হল, এই প্রথম ভার্সানে যেভাবে চিন্তা করে লিখেছিলাম তা নিজেই আবার পরে রিভিউ করে নিয়ে নতুন ফোকাসে এখানে সেকেন্ড ভার্সান হিসাবে তা লেখাও যায় এবং তাই এখানে করেছি। ফলে আমার এই নিজস্ব সাইটের সেকেন্ড ভার্সান হিসাবে লেখাটাকে পাঠক থিতু ভাষ্য বলে গণ্য করতে পারেন।
সেভাবেইপরবর্তিতে ঐ লেখাকে এখানে আরও অনেক নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে ও নতুন শিরোনামে এখানে আজ ছাপা হল। ]