বাইডেনের দুত জন কেরি ঢাকায়
গৌতম দাস
১২ এপ্রিল ২০২১, ০০:০৬
জন কেরির ঢাকা সফর
গৌতম দাস
১২ এপ্রিল ২০২১, ০০:০৬
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ক্লাইমেট-বিষয়ক বিশেষ দূত, আমেরিকার এক সাবেক সেক্রেটারি অব স্টেট (পররাষ্ট্রমন্ত্রী) – জন কেরি গত শুক্রবার পুরা ‘ওয়ার্কিং ডে’ বাংলাদেশ সফরে কাটিয়ে গেলেন। এর আগে তার দিল্লি সফর শেষ করে তিনি সেখান থেকে বাংলাদেশে আসেন আর এই অবস্থানের সময় ছিল বেলা ১১টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত।
প্রথমত কেন একজন সাবেক সেক্রেটারি অব স্টেট জন কেরিকে বাইডেন বিশেষ দূত করেছেন? অর্থাৎ তিনি ট্রাম্পের মত দায়িত্বজ্ঞানহীন নন বরং উল্টা অবস্থানে; ক্লাইমেট ইস্যুটাকে তিনি অনেক গুরুত্বের সাথে দেখে থাকেন, এছাড়া গত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কারণে ইস্যুটা আমেরিকা প্রশাসনের হাতে খুবই তাচ্ছিল্ল করা হয়েছে সেখান থেকে ফিরে তিনই অনেক সিরিয়াস হতে চাইছেন – এই ম্যাসেজ তিনি দিতে চেয়ে এত সিনিয়র একজন ব্যক্তিত্বকে নিয়োগ দিয়েছেন।
আমেরিকায় দুই প্রধান পুরানা রাজনৈতিক দল ডেমোক্র্যাট [Democrat Party] আর রিপাবলিকান [Republican Party] – এদের মধ্যে মূল ফারাক, আমরা যারা বাইরে থেকে দেখি তাদের মনে হয় প্রথমটা যদি তুলনামূলক “উদার” বলা হয় তবে পরের বা অন্য দলটাকে সেই বিচারে “রক্ষণশীল” বলবেন অনেক। যদিও পশ্চিমা দেশগুলোতে আদৌ উদার বা লিবারেল বলে কোনো রাজনীতি আছে বা হয় কীনা এই প্রশ্নটা নাইন-ইলেভেনের পর থেকে দুনিয়ায় সব কর্নার থেকেই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে গিয়েছে। যদিও একালে সেই প্রশ্ন উঠুক আর নাই উঠুক সবসময়ই “লিবারেল” কথাটার আসল মানে হল, – আমার হাতের ক্ষমতা যতক্ষণ পর্যন্ত না কেউ চ্যালেঞ্জ করছে বা আমি চ্যালেঞ্জড হয়ে যাচ্ছি ততক্ষণ আমি খুবই লিবারেল। অর্থাৎ এর সোজা মানে হল, “আমার ক্ষমতা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে গেলে আমি আমার সবার চেয়ে খারাপ ও নৃশংস রূপটাই দেখাব”। এই কোটেট বাক্যটাই হল, লিবারিজমের প্রকৃত সংজ্ঞা।
তবু আমেরিকান অভ্যন্তরীণ বিচারে উদার বনাম রক্ষণশীলতা, এটাই ডেমোক্র্যাট আর রিপাবলিকান এ দুই দলের আসল ফারাক নয়। এদের মূল ফারাক হল পাবলিকের ওপর (আসলে বড় অংশটাই মূলত ব্যবসায়ীদের উপর) সরকারের ট্যাক্স আরোপ করা না করা নিয়ে। সরকারি ট্যাক্স যত কম আরোপ করা যায় রিপাবলিকানরা হল এমন নীতির পক্ষের দল। এ কারণে অনেকে বলেন এরা প্রধানত ব্যবসায়ী বা বড়লোকদের দল ও সরকার। যদিও ট্যাক্স আরোপ ও আদায়ের আসল মানে হল – স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য স্বাস্থ্য-শিক্ষা ইত্যাদি ধরনের পাবলিক সার্ভিসে অর্থ ব্যয় করার পক্ষে সরকারের সক্ষমতা। তাই ট্যাক্স কথাটার সোজা মানে গিয়ে দাঁড়ায় নানা ধরনের পাবলিক সার্ভিস দিতে সরকার অর্থ ব্যয় করবে কি না বা দায়িত্ব নিবে কি না। ডেমোক্র্যাটরা বলবে হ্যাঁ নিবে আর রিপাবলিকানরা বলবে না নিবে না, যত পারে কম নিবে।
এখন মনে হতে পারে, পাবলিকের থেকে ট্যাক্স সংগ্রহ করে সরকার সে অর্থ জনসেবার ব্যবস্থায় সে অর্থ ব্যয় করবে না এ কথাটা নৈতিক দিক দুর্বল; এছাড়া এই দুর্বল নৈতিকতার কথাটাকে রিপাবলিকানরা প্রকাশ্যে এটা তাদের মূলনীতি এমন কথাটা বলে কী করে? হ্যাঁ, অবশ্যই বাস্তবে এত অনৈতিকভাবে রিপাবলিকানরা তাদের কথাগুলো বলে না। তাদের মনের কথা বলতে যদি পুরো সুযোগ দেয়া হয় তবে জানা যাবে তাদেরও একটি শক্ত যুক্তি আছে বলে তারা মনে করে। সে যুক্তিটা হল, সরকারের হাতে ট্যাক্সের মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থ থাকা মানেই সেই অর্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে এক বিরাট অংশ অপচয় করে ফেলার সম্ভাবনা। দুনিয়ার সবচেয়ে দক্ষ সরকারটাও অপচয়ের অভিযোগ থেকে মুক্ত নয়, এই হলো রিপাবলিকানদের সাফাই যে কেন তাই তারা বেশি ট্যাক্সের বিরুদ্ধ অবস্থান নিয়ে থাকে।
যদিও রিপাবলিকানদের এই যুক্তিতে সবচেয়ে বড় খুঁত ও ফুটাটা হল, ব্যবসা, বাণিজ্য-বিনিয়োগের সোজা মানেই হল, উদ্বৃত্ত-সঞ্চিত অর্থ কেবল কিছু লোকের হাতেই জড়ো হয়ে যাওয়া; অর্থাৎ যা সমাজে ক্রমান্বয়ে মারাত্মক অর্থনৈতিক অসাম্য তৈরি ও আয়বৈষম্য বাড়িয়েই চলবে। এই খারাপ প্রভাব কমাতে চাইলে সরকারের ট্যাক্স আরোপ অন্তত একটি পথ। কারণ এতে একপেশে সঞ্চিত অর্থ রিডিস্ট্রিবিউট করার একটি উপায় পাওয়া যায়। তাই অপচয় হয় কথা সত্য যদি হয়ও, তবু এই কথার আড়ালে অর্থ-সম্পদে ধনীদের পক্ষে যুক্তি সাজানো গ্রহণযোগ্য নয়। তবু এরাই আমেরিকায় রিপাবলিকান!
গত ২০০১ সালের প্রেসিডেন্ট বুশ থেকে একালে ট্রাম্প পর্যন্ত রিপাবলিকানরা কখনোই সারাদুনিয়ার ক্লাইমেট ক্ষতি করার দায় বা পাল্টা পদক্ষেপ নেয়া – তা রিপাবলিকান কোনো প্রেসিডেন্টই তা করেনি। অর্থাৎ রিপাবলিকান দল ও এদের প্রেসিডেন্টরা অবলীলায় দুনিয়া ধ্বংস করে চলবে, দু’হাতে মুনাফা কামিয়ে চলবে কিন্তু কোনো দায় নেবে না এমনই বেপরোয়া হয়ে থাকবে- এটাই বাস্তব রিপাবলিক-ইজম। এই আলোকে পাগলামির ভাব ধরে ট্রাম্প এমনই বিজ্ঞানবাদী হয়ে হাজির হয়েছিল যে মানুষ চাইলে প্রকৃতির ওপর যেন সে যথেচ্ছাচার করতেই পারে, তিনি এমনই বেপরোয়া হুশহারা প্রেসিডেন্টের ইমেজ তৈরি করেছিলেন!
সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময়কালে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে প্যারিসে কপ-২১ নামের এক সম্মেলনে জলবায়ু চুক্তির ব্যাপারে সম্মত হন বিশ্বনেতারা। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের ২০০টি দেশ এতে স্বাক্ষর করে। কিন্তু দায়িত্বজ্ঞান লোপ পাওয়া এক দেউলিয়া ব্যবসায়ী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, তিনি ওই চুক্তি থেকে আমেরিকার নাম প্রত্যাহার করে এনেছিলেন। আর এর বিপরীতে অন্তত তুলনামূলকভাবে দায়িত্ববোধের পরিচয়ে বাইডেন আবার প্যারিস চুক্তিতে আমেরিকাকে অন্তর্ভুক্ত করিয়েছেন।
তবে অন্য আরেক দিক আছে। সময়টা এখন গ্লোবাল অর্থনীতির নেতা বদলের; আমেরিকার বদলে চীনের উত্থান ও আগমন-আবির্ভাবের। ফলে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় ট্রাম্পের কারণে তাঁর দায়ীত্বজ্ঞান লোপ-পাওয়া এক নেতা হিসেবে ট্রাম্প আমেরিকাকে পরিচিতি দিয়েছিলেন ও তাতে আমেরিকা পিছিয়ে পড়েছিল। ফলে এবার বাইডেনের বিজয়ের ফলে ক্লাইমেট ইস্যুতে পরে যেন চীন ও আমেরিকা না কোনো অশুভ-ক্ষতিকর প্রতিযোগিতায় মেতে উঠে যে কে ক্লাইমেট ইস্যুতে মূল নেতা হবে – আমেরিকান থিংকট্যাংকগুলো থেকে এ নিয়ে সতর্ক করা হচ্ছিল। তাদের পরামর্শ ছিল এটি হলে তা বিরাট ভুল হবে। বাইডেন মনে হচ্ছে সে পরামর্শ আমল করেছেন। যেমন বড় অর্থনীতির দেশগুলোকে আর ক্লাইমেট ইস্যুতে কার্বন-নিঃসরণ প্রায় না ঘটিয়েও বাংলাদেশের মতো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো – এমন ৪০ দেশকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বাইডেন এই ভার্চুয়াল গ্লোবাল সম্মেলন আয়োজন করেছেন আগামী ২২-২৩ এপ্রিল। তবে বাইডেনের এই আয়োজনে ইতিবাচক দিক থেকে অনেক কিছুই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে যেখানে, ক্ষতিকারক প্রতিযোগিতা যেগুলো হতে পারে তা এড়িয়ে চলা হয়েছে। যেমন আমেরিকান প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চীনকেও বাইডেনের ক্লাইমেট সম্মেলনে আমন্ত্রণ করা হয়েছে। আর এর চেয়েও বড় আরেক তাৎপর্যময় ঘটনা হলো পুতিনের রাশিয়াকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে [Biden invites Russia, China to first global climate talks]।
বাইডেনের রাশিয়ার পুতিনকে দাওয়াতঃ
এটা অনেক বড় তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা এ জন্য যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন রাষ্ট্র ভেঙে ১৬ টুকরা হয় ১৯৯২ সালে। এরপর রাশিয়াকে বড় অর্থনীতির সাত রাষ্ট্রের ক্লাব “গ্রুপ সেভেন” বা [G7] -এর মধ্যে রাশিয়াকে ঢুকিয়ে সমতুল্য বড় নেতা করে নেয়া হয়েছিল ১৯৯৭ সালে। এতে তা হয়ে যায় জি-এইট ক্লাব। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে বের হওয়া ছোট রাষ্ট্রগুলোতে রাশিয়ার প্রভাব-সম্পর্ক যেন নিঃশেষ হয়ে যায় আর বিপরীতে যেন এসব দেশে আমেরিকা ও ইউরোপের প্রভাব একচেটিয়া হয়ে বেড়ে চলে – পশ্চিমের এই কাড়াকাড়ির নীতির কারণে রাশিয়া-আমেরিকার অবস্থান-সঙ্ঘাত মুখোমুখি হয়ে বাড়তে থাকে। কোন রাষ্ট্রের উপর অন্যরাষ্ট্রের প্রভাব কমবে বাড়বে স্বাভাবিকভাবে। কিন্তু পশ্চিম এটা ন্যাচারালাইজড রাখতে পারে নাই। এতে রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করেছে এই অজুহাতে রাশিয়াকে জি-এইট ক্লাব থেকে বের করে দিয়ে বাকি নিজেরা আবার জি-৭ ক্লাব হয়ে যায় ২০১৮ সালে আর শুধু তাই নয়। ঐবছরই আমেরিকা রাশিয়ার উপর অর্থনৈতিক অবরোধ করেছিল। অন্য ভাষায় বললে, েকালে লক্ষ্য করা যাচ্ছে চীনের সাথে আমেরিকার প্রতিযোগিতা যতই তীব্র হয়ে উঠছে তাতে ক্রমে পেরে না উঠে ঢলে পড়া আমেরিকার যাকেই বড় বেকায়দা প্রতিদ্বন্দ্বি মনে হয় তাকেই সে অর্থনৈতিক অবরোধের অস্ত্র (যা মূলত মার্কিনডলারে বৈদেশিক বাণিজ্যিক পণ্যবিনিময় করতে বাধা দেয়া) অপব্যবহার করে এসেছে, তাতে সে্টা ইরান বা রাশিয়া ইত্যাদি এমন যেই রাষ্ট্রই হোক। আর সেই থেকে আমেরিকাই যেন নিজেই নিজের বিরুদ্ধে চীন-রাশিয়ার এক শক্ত বিশেষ অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোট গড়ে উঠুক সে দিকে ঠেলে দিয়েছিল। তাই স্বভাবতই চীন রাশিয়ার (প্রথমে রাশিয়া পরে ইরানও) তেল ও গ্যাসের সরবরাহ পাবার বিনিময়ে চীনের বিপুল বিনিয়োগ পায় এ দুই দেশ। আর এভাবেই তারা নিজেদের উপর আমেরিকান অবরোধের প্রভাব মারাত্মকভাবে পড়া ঠেকাতে সক্ষম হয়ে টিকে গিয়েছে।
কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ হল, বাইডেন নির্বাচিত হওয়ার পরও রাশিয়ার সাথে প্রকাশ্যে ও নাম ধরে সঙ্ঘাতময় সম্পর্ক প্রকাশিত করে ফেলেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রায় আট বছরের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে রাশিয়াকেও এবারের ক্লাইমেট সম্মেলনে বাইডেন আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এতে বাইডেন যে ম্যাসেজ দিতে চাইছেন তা হল, বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রের সাথে আমেরিকার যতই স্ট্র্যাটেজিক বা বাণিজ্যিক বিরোধ থাক না কেন, ক্লাইমেট ইস্যুতে তিনি এসব বিরোধকে পাশে সরিয়ে রেখে হলেও সব রাষ্ট্রের সাথেই কাজ করতে চান। এর মানে জন কেরির ঢাকা সফরকে আমাদের এই আলোকে দেখতে যেন পরামর্শ দিচ্ছেন বাইডেন! মানে আমেরিকার সাথে আমাদের সরকারের যত টেনশন বা অবিশ্বাস যাই থাক বা না থাক ক্লাইমেট ইস্যুটাকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে দেখতে হবে, এই হলো বাইডেনের ম্যাসেজ! কিন্তু তাই কি?
সন্দেহটা প্রকাশ করার দরকার হত না যদি জন কেরি ক্লাইমেট ইস্যুতে ছাড়া অন্য ইস্যু তুলেও কথা না বলতেন! যেমন ঢাকার মিডিয়া রিপোর্ট : জন কেরি বলেছেন, ‘“২০ কোটি জনগণকে দেয়ার পর টিকা উন্মুক্ত করবে যুক্তরাষ্ট্র’– মানে আমাদেরও টিকা সরবরাহকারী হতে চায় আমেরিকা। আবার সরাসরি বলেছেন, “বাংলাদেশ চাইলে করোনার টিকা দিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র”।
এথেকে আমাদেরকে সোজা বুঝতে হবে এর অর্থ হল, জন কেরি বিশেষ দূত হলেও কেবল ক্লাইমেট ইস্যুতে তিনি ও তার কথা আটকে রাখছেন না। তিনি সাধারণভাবে বাইডেনের দূত হিসেবেও কাজ-কথাবার্তায় হাজির হচ্ছেন আমরা দেখতে পাচ্ছি! এমনিতে কথিত টিকা কূটনীতিতে বাংলাদেশে বেলায় চীনারা তেমন অবস্থায় নয় হয়ত কিন্তু কোনো দেশকে টিকা সরবরাহ দেয়াটাকে ভারত ও আমেরিকা এ দুই দেশই পুরোদমে সরবরাহ-নেয়া ঐ দেশের উপর প্রভাব বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে টিকাকে দেখতে ও ব্যবহার করতে আগ্রহী তা দেখা যাচ্ছে। এমনকি ভারতের সেনাপ্রধান মুকুন্দ নারাভানে যিনি এখন আমাদের সেনাপ্রধানের সাথে সাক্ষাতের সফরে ঢাকায় আছেন; তিনিও এক লাখ ডোজ টিকা সাথে এনেছেন বলে জানাচ্ছেন। অথচ তিনি তো ঠিক কূটনীতিক ব্যক্তিত্ব তাই-ই তো নন। আবার এই টিকা কি চুক্তি অনুযায়ী অর্থ-পরিশোধের পর আমাদেরকে যে টিকা ভারতের এক কোম্পানির সরবরাহ করার কথা তারই অংশ কি না তাও পরিষ্কার নয়। আবার যদি তাও হয় তবে সেনাপ্রধান কী করে এর বহনকারী হন, ইত্যাদি সবই অস্পষ্ট ও সীমাছাড়ানি। কেবল বোঝা যাচ্ছে টিকা এখন অন্য দেশের ওপর প্রভাব বিস্তারের হাতিয়ার করতে চাচ্ছে ভারত-আমেরিকা সবাই। যদিও এই টিকা আমরা অর্থ পরিশোধ করে কিনেছি তারা সরবরাহকারী মাত্র, এই হলো সম্পর্ক। তাই এখানে কেউ কাউকে খাতির করছে ব্যাপারটা একেবারেই তা নয়।
তবে মূল কথা তাহলে জন কেরি কি ক্লাইমেট ইস্যুরও বাইরে, বাইডেনের হয়ে কেবল টিকা-কূটনীতিতে জড়িয়েই থেকে যাবেন, না ‘বঙ্গোপসাগর ইস্যু’ পর্যন্তও যাবেন! যেমন এক আমেরিকান থিংকট্যাংক ফেলো পরামর্শ রেখেছেন, “……শুধু ভারতের ওপর নির্ভরতা নয়, বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতার জন্য ইতিবাচক…’ এমন কিছু করতে হবে। … ‘বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশেরই উচিত নিজেদের স্বার্থ ও বোঝাপড়ার ভিত্তিতে অগ্রসর হওয়া”। এমন এই পরামর্শ মেনে কোনো দিকে ও কতটা জন কেরি বা বাইডেন এই সুযোগে অগ্রসর হতে চাচ্ছেন? সেসব কথা কী তিনই এই সফর থেকে কাউকে বলে গেলেন না আগামি বলার ব্যবস্থা-সুযোগ খুজতেছেন?
বাইডেনের হিউম্যান রাইট ঢলে পড়তে যাচ্ছেঃ
গত ২৭ মার্চ ছিল বার্মা বা মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর প্রতিষ্ঠা দিবস। কিন্তু এ দিনটা বার্মার অভ্যন্তরের চেয়েও এক গ্লোবাল গুরুত্বের দিন হয়ে হাজির হয়েছিল। সেটা হল, বাইডেনের কথিত “হিউম্যান রাইট নীতি” পুরোপুরি অমান্য করার বা defiance -এর দিন হয়েছিল সেটা। এ দিন বাংলাদেশ-ভারত-বার্মাসহ ওদিকে চীন-রাশিয়া মিলে মোট আট রাষ্ট্রের এক কমন অবস্থান তুলে ধরার দিন ছিল সেটা। এই আট রাষ্ট্র এদের কমন পরিচয় ছিল ওসব দেশে পাবলিক রাস্তায় মিছিল-মিটিংয়ে জড়ো হলে তাতে সরাসরি গুলি চালানো বা যাকে খুশি গুম-খুন করা ইত্যাদি ধরনের কাজ- এক কথায় রাষ্ট্রের নাগরিক মানবিক অধিকার রক্ষা ও মেনে চলাটা এরা গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে না। এই অর্থে এটা তাদের বাইডেনকে কলা দেখানো মানবাধিকার ডিফায়েন্স-এর নীতি বলা যায়। আবার বাইডেন হিউম্যান রাইটের কথা তুলছেন তাই তিনি সাধুপুরুষ নেতা- না তা কখনও নয়। সরি। এটাও বিবেচনা করতে পারছি না। কারণ, মূলকথা, হিউম্যান রাইটকে আমেরিকা চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা বা কাজে লাগানো, বাণিজ্যিক সুবিধা পেলে বিনিময়ে হিউম্যান রাইট বেচে দেয়া ইত্যাদি এসবের দিকে প্রবলভাবে আমেরিকা ছুটছে, বিশেষ করে ২০০৭ সালের পর থেকে নির্লজ্জ হয়ে। গত ২০১৭ সালের বার্মায় জেনারেলদের রোহিঙ্গা বিতারণের সপক্ষে কথিত আরসা সন্ত্রাসের গল্প – এটাকে সাফাই হিসেবে হাজির করেছিল চীন ও ভারতের মতই আমেরিকার এক উপমন্ত্রী; এসব কথা আমরা সবাই কমবেশি জানি। তবে এবারের বার্মায় আট রাষ্ট্রের সামরিক এটাসেদের সম্মিলনের ম্যাসেজ হল – ভারত বলতে চাচ্ছে আমেরিকার ‘হিউম্যান রাইট নীতি’ এতে ভারত ও তার বন্ধুদের বেলায় ছাড় দিতে হবে। না হলে কী হবে?
না হলে যা হবে তা আমরা দেখলাম এবার গত সপ্তাহে কোয়াডের নৌ-সামরিক মহড়ায়। এবার যদিও সামরিক মহড়ায় কোয়াডের চারদেশের সাথে বাড়তি যুক্ত হয়েছে ফ্রান্সও। এদিকে ভারত যদি বাংলাদেশ, বার্মা থাইল্যান্ড, লাওস ভিয়েতনাম আর ওদিকে চীন-রাশিয়া মিলে মোট আট রাষ্ট্রের সাথে বাইডেনবিরোধী নীতিতে জোট পাকায় আবার একই সাথে ভারত যদি কোয়াডের মধ্যেও থাকে এর সোজা মানে হল, এবারের কোয়াড আর অন্তত ঐ আট-রাষ্ট্রের জন্য কোনো সামরিক হুমকি নয়, হতেই পারবে না! কারণ দুই পক্ষের দিকেই ভারত আছে! কাজেই চীন-রাশিয়ার জন্য কোয়াড কোনো ইস্যুই নয়! এক কথায় এমন ভারত একাই কোয়াডকে অকেজো করে রাখার জন্য যথেষ্ট! মানে সারা এশিয়ায় বাইডেনের ভাত নাই, এমন হয়ে যাবে না কি! এখন এই পরিস্থিতিতে বাইডেন কী করবেন? বাংলাদেশকে কোলে তুলে নিতে চাইবেন! ওয়েট অ্যান্ড সি!
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
[এই লেখাটা গত ১০ এপ্রিল ২০২১, দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ওয়েবে ও পরদিন প্রিন্টেও “জন কেরির ঢাকা সফর” – এই শিরোনামে ছাপা হয়েছিল। নয়াদিগন্তে ছাপা হওয়া লেখাগুলোকে আমার লেখার ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ বলা যায়। পত্রিকার কলাম লেখার সুবিধা অসুবিধা দুটোই আছে। প্রথম অসুবিধা লেখার সাইজ মোটামুটি সর্বোচ্চ ২০০০ অক্ষরের মধ্যে রাখতেই হয়। কারণ এটাই কাগজে ছাপা হয় বলে জায়গা সীমিত। আবার সুবিধার দিক হল, এই প্রথম ভার্সানে যেভাবে চিন্তা করে লিখেছিলাম তা নিজেই আবার পরে রিভিউ করে নিয়ে নতুন ফোকাসে এখানে সেকেন্ড ভার্সান হিসাবে তা লেখাও যায়। ফলে আমার এই নিজস্ব সাইটের সেকেন্ড ভার্সান হিসাবে লেখাটাকে পাঠক থিতু ভাষ্য বলে গণ্য করতে পারেন।
সেভাবেইপরবর্তিতে ঐ লেখাকে এখানে আরও অনেক নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে ও নতুন শিরোনামে এখানে আজ ছাপা হল। ]