বাইডেন আফগানিস্তান ছাড়ছেন না দুনিয়াকে শাসন
গৌতম দাস
১৯ এপ্রিল ২০২১, ০০:০৬ সোমবার
America’s Slow-Motion Failure in Afghanistan – FOREIGN AFFAIRS
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের আন্তর্জাতিক আইন বা কনভেনশন হল, হিটলারের উত্থান ও দমনের পর থেকে রেসিয়াল [race or racial] জাতের গর্ব দেখানো, কাউকে রেসিয়ালি অন্যের সাথে তুলনা করা, উঁচা-নিচা দেখানো ইত্যাদি সবই মারাত্মক অপরাধ-কাজ বলে চিহ্নিত হয়ে গেছে। তবু ছোট গ্রুপের চর্চায় ফাঁকে-ফোকড়ে এখনো এসব বিষয় উঠে আসতে ও থাকতে দেখা যায়। যদিও লিখিত অক্ষরে বা প্রকাশ্যে তা আর চর্চা তেমন করা হয় না, তবে প্রমাণ না থুয়ে কানে কানে চর্চাই পথ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন বেশকিছু ব্যতিক্রম, আইন-নিয়ম ভাঙ্গা ট্রাম্পের গত চার বছরের প্রশাসনের আমলে আমরা খোদ আমেরিকাতেই ঘটতেও দেখেছি । সেটাই প্রথম কোন আমেরিকান প্রেসিডেন্টের প্রশাসন যা যতটা সম্ভব প্রকাশ্যে “সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদী” ও রেসিয়াল বা বর্ণবাদী রাজনৈতিক ধারাকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে গেছে। সেটি অনেক কাছ থেকেই আমরা দেখেছি। বিশেষ করে ৬ জানুয়ারি ২০২১ যা JAN6 capitol hill riot নামে পরিচিত সেদিনের অপতরতা-ঘটনা ইতিহাসে লেখা হয়ে গেছে ও থাকবে। কিন্তু সেসব সাদা-কালো অথবা জাত শ্রেষ্ঠত্ববাদের কথা এখানে এখন কেন? মূল কথা হল, জাত শ্রেষ্ঠত্ববাদিতা ব্যাপারটা কেন খারাপ ও অন্যায়-অপরাধ সে সবই এখন গ্লোবজুড়ে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু তা সত্ত্বেও গ্লোবাল নেতৃত্বে পালাবদলের এই সময় যারা হেরে যাচ্ছেন বলে মনে করছেন তাদের কারো কারো মধ্যে ওই হার স্বীকার না করে “সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদিতা” আঁকড়ে ধরে আবার উঠে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখা ও বৃথা চেষ্টা করার ঝোঁক বর্তমান থাকতে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সেটাও তো প্রবল বেড়েছিল ট্রাম্পের ক্ষমতার শেষ কয়েক মাসে যা শেষ হয়ে এখন বাইডেনের ক্ষমতায় আসা তিন মাস পার হওয়ার পর ক্রমে বাইডেনের পাকাপোক্ত হয়ে বসার সাথে সাথে ওসব সাদা-বাদী ঝোঁক তো আপাতত শীতল হয়ে গেছে বা যাচ্ছিল! তাহলে আবার হঠাৎ পুরান অভিযোগ কেন?
একমাত্র কমন শব্দের শিরোনাম – উইথড্রলঃ
গত ১৩ এপ্রিল সারা পশ্চিমা মিডিয়ার মূল শিরোনামে একমাত্র শব্দ ছিল, উইথড্রল [Withdrawal] বা সেনা প্রত্যাহার। অর্থাত কমন শিরোনামটা প্রায় এরকম যে, “বাইডেনকে আগামী ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে পূর্ণ সেনা প্রত্যাহার করে ফিরে আসতে হবে” [Biden to Complete Full Afghanistan Withdrawal by Sept. 11]।’ লন্ডন ইকোনমিস্ট প্রিন্টেড পত্রিকায় অনেক রিপোর্টের শিরোনাম পরবর্তিতে অনলাইন ভার্সানে বদলে দেয়া হয়ে থাকে, তবে দুটা শিরোনামের রেফারেন্সই থাকে। আর প্রিন্টেডের শিরোনামটা খুবই ছোট রাখা হয়। ওর এক অনলাইন শিরোনাম করেছে, বাইডেন আফগান যুদ্ধে তার দুর্বল বন্ধু ফেলে পালিয়ে আসছেন”, [Joe Biden gives up on the war in Afghanistan, leaving a weak ally]। আর সাথে আরেকটা ছোট শিরোনামও আছে, সেটি বলছে, “চিরদিনের জন্য যুদ্ধ শেষ করে” [Ending the forever war]। কিন্তু এমন করে কথাটা লিখছে কেন? কারণ, এই ছোট অংশটাই বাইডেনের উচ্চারিত কোট-আনকোট কয়েকটা হুবহু শব্দ।
কিন্তু, এর মানে কি আমেরিকা আর কখনো যুদ্ধে যাবে না? তাই কি বুঝাচ্ছে? কিন্তু এর আগে ট্রাম্পও তার ক্ষমতায় আসার প্রথম বছর (২০১৭) থেকেই তো প্রায় একই সেনা প্রত্যাহারের কথা বলে আসছিল। সেটা বাস্তবায়ন হলে এতদিনে ট্রাম্পেরই তো সব ফেলে আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে আসার কথা! কিন্তু তখন তো ইকোনমিস্ট এমন শিরোনাম করেনি? এবার করছে কেন? তার মানে কী ট্রাম্পকে পাগল ভেবেছিল, সিরিয়াসলি নেয় নাই? এখন তাই তো মনে হচ্ছে! আবার এমন কি কেবল ইকোনমিস্ট পত্রিকাই শিরোনাম ও রিপোর্টে করছে? না তা একেবারেই না। আমেরিকা-ইউরোপ মিলিয়ে সারা পশ্চিমের সব লিডিং পত্রিকার টোনই প্রায় একই, এই ইকোনমিস্টের মতনই।
যেমন আমেরিকান ‘ফরেন পলিসি’ শিরোনাম করেছে, বাইডেনের “আফগানিস্তান ছেড়ে আসা কি বিপথগামিতা না অনেক আগেরই বকেয়া?’ [Is Leaving Afghanistan Misguided or Overdue?] তখন ওয়াশিংটন পোস্ট আবার আরো কড়াভাষায় লিখছে, “আমেরিকান-মিথ্যা-গর্বের এক কবরে পরিণত হয়েছে আফগানিস্তান” [“Afghanistan became the graveyard of American hubris“]। ওদিকে নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে, “আমেরিকা আফগান সেনা প্রত্যাহারের পরে কী করে দূর থেকে আবার কোনো যুদ্ধ করার পরিকল্পনা আঁটতে পারবে” [How the U.S. Plans to Fight From Afar After Troops Exit Afghanistan“]। মানে বলতে চাচ্ছে এরপরে আফগান ছেড়ে দূরে বসে আমেরিকা হয়ত ড্রোন ছুড়ে কিভাবে আফগান সামলাবে কী করে?
এছাড়া আরেকটা দিক হল, পশ্চিমা প্রত্যেকটা মিডিয়ায় গত দু-তিন দিনের মধ্যে এই একই প্রত্যাহার ইস্যুতে আট-দশটা পর্যন্ত আর্টিকেল ইতোমধ্যে ছাপা হয়েছে। আর বলাই বাহুল্য, প্রতিটা লেখাতেই যে সুর তা হল – পশ্চিমা মন ভারাক্রান্ত, হতাশ, তাদের সব হারিয়ে গেছে এমন সুর ও টোনে লেখা। এব্যাপারে সবার চেয়ে আগিয়ে সম্ভবত লন্ডন ইকোনমিস্ট। ইংরাজি এক্সোডাস [EXODUS] যার আক্ষরিক অর্থ দেশান্তরি হওয়া বা, ছেড়ে পালানো। আর, ইহুদী ধর্মতত্বীয় ভাষ্য অনুসারে অশুভ মনে করে টের পেয়ে সটকে পড়া। এমনিতেই ইহুদী ধর্মতত্বীয় গল্পের ভাষ্যগুলো মিথ-গল্পে ঠাসা। তাদের সৃষ্টিতত্ব বিষয়ক মিথিক্যাল [Myth-ical] গল্প সব এই দেশান্তর বা ইক্সোডাস ধরণের। তার ৪১ নম্বর গল্পটা যিশুর পিতা জোসেফের মিসরের এক ফারাওয়ের স্বপ্নের অর্থ ব্যাখ্যা করা বিষয়ক যার সফলতাতে জোসেফ দাসজীবন থেকে মুক্তি পেয়েছিল। সাপ্তাহিক তার এর রিপোর্টের শিরোনাম করেছে “Exodus, chapter 41 – Can Joe Biden get America out of the Middle East”।
এখন সোজা মূল পয়েন্টে এসে বললে, কথা হল – সারা পশ্চিমের মনে ভয় ঢুকেছে, হতাশা পেয়ে বসেছে যে, আমেরিকার আফগানিস্তান ছেড়ে (মে-সেপ্টেম্বর ২০২১ এর মধ্যে ) ফেলে পালিয়ে আসার সিদ্ধান্ত এটা কী কোন আরো বৃহত্তর (পরাজয় বা কোন দেশান্তরি) ঘটনার ইঙ্গিত! সৃষ্টিতত্ব বা Genesis! কোন এক্সোডাস বা দেশান্তরির মত ইঙ্গিত? যে এটা আসলে গত প্রায় পাঁচশ বছর সাদা চামড়া বা সুপ্রিমিস্টদের দুনিয়ার উপর তাদের যে শাসন (মানে কলোনি ও লুন্ঠন) চালিয়ে এসেছে এবার এরই সমাপ্তির ইঙ্গিত? তাই আমেরিকা এই আফগানিস্তান প্রত্যাহার কেবল আফগানিস্তানই না, সারা দুনিয়া থেকে আমেরিকানদের মানে কেবল আমেরিকানদেরই না এটা আসলে সাদা পশ্চিমা শাসকদের সারা দুনিয়া থেকেই পাততাড়ি গুটানোর ইঙ্গিত? তারা কী দুনিয়ায় আর কোথাও শাসনে ফিরতে পারবে না সেই ইঙ্গিত? এই আশঙ্কার পটভুমিতে ইকোনমিস্ট যেমন আরেকটা রিপোর্টে ধর্মতত্বীয় ইঙ্গিত ঢুকিয়ে বলছে – এক্সোডাস, সৃষ্টিতত্ব ৪১; বাইডেন কী ধবংস হয়ে যাবার আগেই মধ্যপ্রাচ্য ছেড়ে বের হয়ে পালাতে পারবে?
সুতরাং, এক কথায় বললে, এটা শুধু আমেরিকার আফগান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেয়া নয়, এটা আসলে যেন বাইডেনের আমেরিকার সারা দুনিয়া থেকেই আমেরিকান সেনা ও নেতৃত্ব প্রত্যাহার করে নেয়ার ঘোষণা। আর এমনই আশঙ্কায় – অনুভবে ও সুরে আর্টিকেলগুলো পশ্চিমা মিডিয়ায় লেখা হয়েছে। আর এখানকার এমন মনোভাবটার সঠিক প্রকাশকে ফুটিয়ে তুলতে গেলে বলতে হবে, দুনিয়াতে একদিন সাদা শ্রেষ্ঠত্ব, সাদা শাসন, সাদাদের গর্ব, সাদারাই মরদ এ টাইপের যেসব বক্তব্য ছড়িয়ে পড়েছিল – ঠিক তারই উল্টা ঘটনাই যেন এটা। তাই সাদা-বাদের এই শোক – যখন তারা বুঝে গেছে বাইডেন কথাটা কেবল আফগানকে লক্ষ্য করে বললেও এর উপলক্ষ্য যেন আসলে এর অর্থ সবারই কানেই কু-স্বরে বেজে উঠেছে যে বাইডেন বলছেন, “আমেরিকা আর কখনো কোনো যুদ্ধেই যাবে না” [Ending the forever war]। যেন আমেরিকার ও গোটা পশ্চিমের “দুনিয়াকে নেতৃত্ব দেয়ার দিন শেষ হয়ে গেছে”।
আমেরিকান ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স রিপোর্টঃ গ্লোবাল ট্রেন্ড ২০৪০
উপরের এতক্ষণ সেসব কথাগুলো বলেছি এর অনেকাংশই ইহুদি-খ্রীশ্চান ধর্মতত্বীয় মিথে যা সব আছে সেসবেরই ছায়ায় বসে লেখা। তাই এবার বস্তুগত বা বৈষয়িক ও আধুনিক ভাষায় যেসব শাস্ত্র আছে তার ভিত্তিতে কিছু কথা লিখা যাক। আমেরিকাকে আমেরিকার মতন করে এবং আন্তরিকভাবে না বুঝলে এটা বলা বা লেখা যাবে না। আমেরিকা রাষ্ট্রের রেওয়াজ হল শুধু ঠিক চার বছর পরপর একজন নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে দেয়া না। সেই সাথে নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের হাতে নতুন এক “ইনটেলিজেন্স রিপোর্টও” তুলে দেওয়া। ইন্টেলিজেন্স শব্দের বাংলা আমরা করি ‘গোয়েন্দা’। আর যা গোয়েন্দাদের বিষয় তা যেন আর একাদেমিক বিষয় না, গবেষণা-স্টাডি আর নয় – এই হল আমাদের গোয়েন্দা শব্দের সাথেকার বুঝাবুঝি। কিন্তু আমেরিকান এই রিপোর্টের মুল ফরমাল নাম GLOBAL TRENDS। যেমন এবারের রিপোর্টের নাম ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট, গ্লোবাল ট্রেন্ড ২০৪০। এই গবেষণা রিপোর্টিংয়ের কাজটা নিয়মিত প্রতি চারবছর পরপর করে থাকে “আমেরিকান National Intelligence Council (NIC).- Office of the Director of National Intelligence, এই অফিস।
বিশেষ করে আমেরিকা চীনের কাছে গ্লোবাল নেতৃত্ব হারাচ্ছে গত ২০০৪ সালে এই অনুমান-ইঙ্গিত চাউর হবার পর থেকে গত ২০০৮ সালে এই অফিস থেকে প্রথম যে অফিসিয়াল রিপোর্ট বের হয়েছিল যার নাম ছিল “গ্লোবাল ট্রেন্ড ২০২৫”। অর্থাৎ ২০২৫ সালে দুনিয়ায় গ্লোবাল লিডারশীপ বা রাষ্ট্রগুলোর পরাশক্তিগত বিন্যাস দেখতে কেমন লাগবে। যেখানে ফাইন্ডিংস বা প্রাপ্ত ফলাফলে প্রথম স্বীকার করে নেয়া হয়েছিল যে চীন গ্লোবাল নেতৃত্বে আমেরিকার জায়গা নিতে অবশ্যম্ভাবী ভাবে আসছেই এবং তা আর কোনদিন উলটা পথে যাবে না। মানে আমেরিকাসহ পশ্চিম চিরদিনের মত এশিয়ার কাছে নেতৃত্ব হারাচ্ছেই। আর মনে রাখতে হবে, তা বলছে, আমেরিকারই এক সরকারি সার্ভে রিপোর্ট। সেই ধারাবাহিকতায় এবারের চতুর্থ রিপোর্ট হল, গ্লোবাল ট্রেন্ড ২০৪০।
এখন যারা এই খবরের বিস্তারে যেতে চান, তাঁরা মূল রিপোর্টটা এখানে পাবেন পিডিএফে, না্মিয়ে নিতে পারেন। আর আসলে, এটাই আমেরিকানদের বিউটি যে তাদের এই রিপোর্ট কখনই কোন গোপন রিপোর্ট নয়, সকলেই কপি নিতে পারে। আর যারা প্রথম আলোতে এক আধা বুঝা রিপোর্ট হলেও মোটামুটি কাজ চলবে বলে মনে করেন তারা এখানে গিয়ে এই রিপোর্টটা পড়তে পারেন।
ঝোঁক আকারে দুনিয়াতে কলোনি দখল শুরু বলা হয় ১৫ শতাব্দীতে (১৪০০-১৪৯৯)। আর মোটামুটি ১৬০৫ সাল থেকেই একদম কোম্পানি খুলে কলোনিদখল করার ব্যবসায় নেমে পড়া ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে, এই ছিল সেকালের বৃটেনের প্রধান ও বড় ব্যবসা ধারা। আর এটাকেই সাদাদের শাসনের যুগ, সাদা শ্রেষ্ঠত্ব বা সাদারা ফিটেস্ট ইত্যাদি নাম দিয়ে নানা সাফাই তত্ত্ব চালু হয়েছিল। তাহলে বাইডেনের এই আফগান ঘোষণা, এটাই কি সেই সাদা যুগের অবসান বলে পশ্চিমা মনে কু-ডেকে উঠেছে! সে কারণেই সাদা মনের আহাজারি এগুলো? তাই কী?
পশ্চিমাশক্তি বলতে রেসিয়াল প্রতীক আকারে বললে,অনেক সময় তারা নিজেরাই বলে যে তারা হোয়াইট ককেশিয়ান। বিপরীতে নতুন ও আসন্ন গ্লোবাল নেতা হিসেবে এবং রেস বা প্রজাতি পরিচয়ে দেখলে চীনারা সম্ভবত মঙ্গোলয়েড প্রজাতি-ভাগের। যদিও এই ২১ শতাব্দীতে এসে জাত্যাভিমান, জাতগর্ব, শ্রেষ্ঠত্ব ইত্যাদি সব ধরনের জাতবাদিতা এমনকি ধর্মীয় জাতবাদিতা, ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্ববাদিতা ইত্যাদি সবই ভয়ঙ্কর রকমভাবে সবার জন্যই প্রবল ক্ষতিকারক হবে। এই মেসেজ যারা আমল করবেন তা তাদের কাছে পৌঁছে গেছে। আর যারা আমল করবেন না, বুঝমান নন তাদেরকে বলেও লাভ নেই। তবে সম্ভবত এককালে সাদাদের “সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট” ধরনের আর্গুমেন্ট আমাদের আর কাউকে মুখোমুখি দেখতে হবে না! আশা করি! তবু, আমরা কি পারব এই নতুন সময়কে সামলাতে! কোনো আরেক জাত বা ধর্ম শ্রেষ্ঠত্ব সামলাতে? তবে এবারও মঙ্গোলয়েডদের সাথে আরেক অর্থে পূর্ব-ইউরোপীয় (রাশিয়ান বা অন্যরা) অর্থে আরেক ধরণের সাদা ককেশিয়ানও থাকবে। এ ছাড়া সাথে থাকবে ব্যাপক বাদামি এশিয়ান আর আফ্রিকানও। অর্থাৎ প্রথম সাদা-বাদের একক উত্থানের তুলনায় এবার অনেক সম্মিলিত, মিশ্রিত জনগোষ্ঠী উত্থিত হবার সুযোগ পাবে ও নিবে – যারা মিশ্রিত ব্যাপক রেঞ্জের জনগোষ্ঠী জড়িত ও সংশ্লিষ্ট হওয়ার সুযোগ পাবে। আশা করব সাথে আবার কোনো ‘ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের’ নামে কোনো কিছুর উত্থান ঘটবে না, আমাদের সেই হেদায়েত নিজ থেকেই জেগে উঠুক সে কামনা করি! তবে আজ যেমন উচ্চশিক্ষার জন্য, উচ্চ-ট্রেনিং ওরিয়েন্টেশনের জন্য আমরা পশ্চিমামুখী হই এটাও নিশ্চয় দিক বদলাবে। সেই ঝোঁকটাই তবে এবার সেটার অভিমুখ হতে পারে পশ্চিম থেকে এশিয়ামুখী, এমন দেখতে পাওয়াটা আর অসম্ভব থাকবে না সম্ভবত!
এবার কথাগুলো অন্য দিক থেকে বলিঃ
জো বাইডেনের শপথ নেয়ার দিন থেকে হিসাব করলে তার প্রশাসন বা সরকারের আয়ু আগামী ২০ এপ্রিলে মাত্র তিন মাস পূর্ণ হবে। গত ২০ জানুয়ারিতে শপথ গ্রহণের পর থেকে দুনিয়ার সব কোণে তিনি আশা জাগিয়ে চলছিলেন। কিসের আশা? একটাই মূল বক্তব্য যে আমেরিকাকে তিনিই আবার ২০০১ সালের আগের (নাইন-ইলেভেনে টুইন টাওয়ার হামলার আগের) অবস্থায় নিয়ে যাবেন যে আমেরিকা ছিল গ্লোবাল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নেতা, যা ছিল গত টানা প্রায় ৭৫ বছরের।
এমনকি, বাইডেনের এই আশা জাগানি ছিল বাঘের মুখ থেকে ইউরোপ – এই বন্ধু-পার্টনারকে ছিনিয়ে আনার মতও। মানে? ইউরোপ আমেরিকার বন্ধু-পার্টনার গত ৭৫ বছর ধরে। যখন সেই ইউরোপ, অন্তত ৩০০ বছর (১৬৫০) আগে, সেই কলোনিযুগের নেতা ইউরোপ যখন – আমেরিকা না, ইউরোপই ছিল প্রধান শক্তি। হ্যাঁ, কলোনি মাস্টার ইউরোপ, ব্রিটিশ-ফ্রান্সের ইউরোপ ছিল প্রধান শক্তি। কিন্তু কপালের ফেরে পড়ে শেষে হিটলারের হাতে সর্বস্ব, সম্পদ ও ভূমি (নিজ ভূখণ্ডসহ কলোনিতে পাওয়া ভূমিও) হারানোর দশায় পড়ে যায় ব্রিটিশ-ফ্রান্স সহ ইউরোপের এসব শক্তি, বিশেষ করে গত শতকের ত্রিশের দশকের পর থেকে ক্রমে। বিগত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ঐ সময়ে অবস্থা এতই খারাপ জায়গায় পৌঁছায় যে তাদের জন্য একটাই অপশন খোলা ছিল; তা হল – আমেরিকাকে গ্লোবাল নেতা মেনে নেয়া, দুই. তার নেতৃত্বে ও তারই অর্থ ব্যয়ে হিটলারের অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামা আর তৃতীয়ত, ওই যুদ্ধে বিজয়ের পরে সব দখলি কলোনি ত্যাগ করে প্রাক্তন কলোনিগুলোকে স্বাধীন-মুক্ত করে দিয়ে ব্রিটিশ, ফ্রেঞ্চ, ডাচ, পর্তুগিজ, স্প্যানিস ইত্যাদি কলোনিশক্তিগুলোর সবারই নিজ নিজ দেশে ফিরে চলে যাওয়া। আমেরিকার কথা মেনে একমাত্র এই পথে গেলে তবেই সে ক্ষেত্রে কেবল কলোনি-মাস্টাররা তারা কেবল অন্তত নিজ ভিটামাটি-দেশ রক্ষা করতে পারে, আবার চাই কি আমেরিকান দান-সাহায্য-বিনিয়োগের সহায়তায় আবার অর্থনৈতিকভাবে তাদের রাষ্ট্র উঠে দাঁড়াতেও পারে। আর তাই-ই হয়েছিল। আর সেই থেকেই ইউরোপ অনেকটা আমেরিকার ছোট-পত্নীর মত এমন মর্যাদা পেয়ে আসছে।
এতে আমেরিকাও ইউরোপকে আপন পাশেই রেখে আসছে, নেতৃত্ব নিজের হাতে রেখেছে বটে, তবু ইউরোপকে ছোট-পার্টনারের মর্যাদা দিয়েছে। গত ৭৫ বছরের আমেরিকার গ্লোবাল নেতৃত্ব মানে সবসময় ইউরোপকে ছোট-পার্টনারের মর্যাদায় রাখা। আর সাথে এতদিন যত যুদ্ধের খরচ, যেমন ইউরোপে বা জাপানের কোন ব্যারাক চালানোর সব ব্যয় ও ন্যাটো পরিচালনার ব্যয়ভার সব কিছুর লায়ন-শেয়ার একা আমেরিকা বহন করে এসেছে। এনজিওও দান-অনুদান কিংবা অবকাঠামো বিনিয়োগ ইত্যাদির নব্বই ভাগ ব্যয় যোগান দিয়ে আসছে আমেরিকা। যদিও আমেরিকার ঢলে পড়া অবস্থায় ওবামার সেকেন্ড টার্মের সময় থেকে ন্যাটোর অভ্যন্তরীণ মিটিংয়ে ইউরোপ কেন কোনো ব্যয়ের দায় নেয় না – আমেরিকা ইউরোপের এই অযোগ্যতার কথা তুলে খোঁচা দেয়া শুরু করেছিল। আর চরম ও বিরাট ব্যতিক্রম ঘটে যায় ট্রাম্পের চার বছরে। ট্রাম্প নিজেকে জাতিবাদী-আমেরিকা বলে ঘোষণা দিয়ে নেয়াতে (মানে সে আর গ্লোবাল নেতা থাকতে চায় না) ইউরোপ বুঝে যায়, আমেরিকার কাছে ইউরোপ আর সেই ছোট-পত্নীর মর্যাদাতেও থাকছে না।
দিন বদলে যাচ্ছে দ্রুত। এরই প্রকাশ ঘটে যায় আরসিইপিতে [RCEP] (এটা সাধারণ বাণিজ্যজোট নয়, চীনের নেতৃত্বে এক ভ্যালু-এডিশন শেয়ারড প্রডাকশনের এক নয়া উতপাদন ব্যবস্থা)। চীন এই ব্যবস্থাটা করেছিল মূলত আসিয়ান-দেশ কেন্দ্রিক, সাথে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দ: কোরিয়া ইত্যাদি যারা কেউই এর বাইরে থাকতে চায় না তাই তাতে তাদের মধ্যেই আবার কেউ কেউ যতই কোয়াড [QUAD] জোটেরও সদস্য হোক না কেন! আর পরবর্তিতে এই আরসিইপি জোটের সাথে ইইউ মিলিয়ে Comprehensive Agreement on Investment (CAI) গড়ে তুলেছিল; শেষ সময়ে। মানে? মানে হল, সে সময়টা হল গত বছরের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে। কারণ, চীন চাইছিল বাইডেন পরের মাসে, ২০ জানুয়ারি শপথ নেয়ার আগেই ইইউর সাথে সিএআই (CAI) চুক্তিটা সম্পন্ন করে ফেলা। কারণ বাইডেনের মূল পরিকল্পনা ছিল আবার ইইউকে আমেরিকার নেতৃত্ব ও আস্থায় ফিরিয়ে আনা। শুধু তাই নয়, চীনের বিরুদ্ধে ইইউর সাথে মিলে চীনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। চীনের হিউম্যান রাইটের খামতির কথা তুলে প্রবল চাপ সৃষ্টি করা যাতে চীন তাদের সম্মিলিত চাপের কাছে হার মানে। তাই, এর বিপরীত দিকে, পাল্টা আমেরিকাকে বাইরে রেখে চীন ইইউর সাথে আগেই (CAI) চুক্তি করে ফেলতে পেরেছিল বটে।
কিন্তু চীনা জিনজিয়াংয়ে উইঘুর ইস্যুতে অভিযোগের আঙুল তুলে আমেরিকাও ঠিকই ইইউকে সাথে নিয়ে একসাথে হিউম্যান রাইটের অভিযোগ তুলতে সক্ষম হয়ে যায়। যদিও পুরা জিনিসটাতে পশ্চিম আর তাতে চীনকে হিউম্যান রাইট কমপ্লায়েন্স করার লক্ষ্যের জায়গায় থাকেনি, বরং চীনের দিকে আঙুল তুলে বাণিজ্য সুবিধা চীনের থেকে বাগিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যেই নেংটাভাবে উন্মুক্ত হয়ে যায়। কারণ এখন পর্যন্ত চীনের বিরুদ্ধে পশ্চিম কী চায়? তারা কী চীনকে হিউম্যান রাইট কমপ্লায়েন্স করে তুলতে চায়, নাকি চীনের নির্মুল চায় তা স্পষ্ট করে না বললেও তারা যেন চীনের উতখাত ও নির্মুল চায় তাই মানে হয়ে আছে। অর্থাৎ সারা পশ্চিম নিজেই দুনিয়াকে হিউম্যান রাইট কমপ্লায়েন্স করে গড়ে তোলার পক্ষের শক্তি কিনা এই প্রমাণ নাই। হলে তো অন্তত তাদের তোলা অভিযোগ সত্য কিনা এর জন্য নিরপেক্ষ ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি ইত্যাদির দিকে আলোচনা আগাত……এমন কোন আলোচনাই শুরু হয়নি! অর্থাৎ তারা হিউম্যান রাইট এর লোক না, তারা চীনের কাছ থেকে পালটা সুবিধা নিয়ে হিউম্যান রাইটের সওদা করতে চায়! তবে বাঘের মুখ থেকে বন্ধু-পার্টনারকে ছিনিয়ে আনার কথা যেটা বলছিলাম যে বাইডেন ইইউকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে তিনি ট্রাম্পের উল্টা পথে যাবেন, ২০০১ সালের আগের আমেরিকান অবস্থানে যাবেন – এই লোভ দেখিয়ে ইউরোপকে আস্থায় নিতে পেরেছিলেন।
কিন্তু না, সেটাও এখন তলানিতে আর সব কিছু ওদিকে ভেঙে পড়েছে! কেন?
কারণ, বাইডেনের আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের কথাটা সারা ইউরোপে সাদা পশ্চিমা শক্তিরই কানে দুনিয়া থেকে সাদা-শাসনের দিন ও সুযোগের চিরসমাপ্তি হিসেবে পশ্চিমা মনে অনুরণিত হয়েছে। আফগান সেনা-প্রত্যাহার মানে গোটা পশ্চিমা শক্তিরই দুনিয়া থেকেই শাসনের পাততাড়ি গুটানো হিসেবে কানে বেজেছে!
এদিকে দিনকে দিন গত চার বছর ট্রাম্প যেসব অবস্থান নিয়ে কট্টর চীনবিরোধী তবে জাতবাদী, সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদী ডানাও মেলেছিলেন সে সবের সাথে বাইডেনের নীতিগত পার্থক্য কমে প্রায় শুণ্য হয়ে যাচ্ছে। ট্রাম্প ও তার সঙ্গীরা এই কথাটাই বলে গেছিলেন যে ট্রাম্পের নীতির বিরোধী কোনো অবস্থান যেন বাইডেন না নিতে পারেন এবং বাইডেন ট্রাম্পবিরোধী হতেই পারবেন না। বাস্তবত, ব্যাপারটা সে দিকেই ক্রমশ যাচ্ছে !
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
[এই লেখাটা গত ১৭ এপ্রিল ২০২১, দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ওয়েবে ও পরদিন প্রিন্টেও “কাকে ছাড়ছেন বাইডেন, আফগানদের না দুনিয়া শাসন” – এই শিরোনামে ছাপা হয়েছিল। নয়াদিগন্তে ছাপা হওয়া লেখাগুলোকে আমার লেখার ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ বলা যায়। পত্রিকার কলাম লেখার সুবিধা অসুবিধা দুটোই আছে। প্রথম অসুবিধা লেখার সাইজ মোটামুটি সর্বোচ্চ ২০০০ অক্ষরের মধ্যে রাখতেই হয়। কারণ এটাই কাগজে ছাপা হয় বলে জায়গা সীমিত। আবার সুবিধার দিক হল, এই প্রথম ভার্সানে যেভাবে চিন্তা করে লিখেছিলাম তা নিজেই আবার পরে রিভিউ করে নিয়ে নতুন ফোকাসে এখানে সেকেন্ড ভার্সান হিসাবে তা লেখাও যায়। ফলে আমার এই নিজস্ব সাইটের সেকেন্ড ভার্সান হিসাবে লেখাটাকে পাঠক থিতু ভাষ্য বলে গণ্য করতে পারেন। সেভাবেইপরবর্তিতে ঐ লেখাকে এখানে আরও অনেক নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে ও নতুন শিরোনামে এখানে আজ ছাপা হল। ]