না চিকিৎসা না পেটে কিছু – হিন্দুত্ব এখন সব ব্যর্থতাই ঢাকতে অক্ষম
গৌতম দাস
২৬ এপ্রিল ২০২১, ০০:০৮
সরকার সঙ্কটে। মোদী সরকারের নির্বাচন কমিশন, সুপ্রীমকোর্ট , মিডিয়া ইত্যাদি এমন প্রধান সব ইনস্টিটিউশনগুলো কোভিড ক্রাইসিসের সময় ভারতকে নিচে নামিয়ে, অকার্যকর করেছে। এক সাক্ষাতকারে এমন মন্তব্য করেছেন ভারতের সুপ্রীমকোর্ট বার এসোসিয়েশনের সাবেক এক প্রেসিডেন্ট, দুষ্মন্ত দুবে।
আর নিচের ছবিতে, ডঃ রামচন্দ্র গুহ একজন স্বনামধন্য ইতিহাসবিদ তিনিও এক সাক্ষাতকারে বলছেন, মোদী ক্ষমতা-লোভী অসুস্থ [megalomaniac]; আর এটাই কোভিডকালে ভারতের প্রশাসনিক মিস-হ্যান্ডিলিং পিছনে মোদীর নেতৃত্বের স্টাইল, এটাই প্রধান কারণ। এখানে সাথে দেয়া লিঙ্কগুলো আসলে সাক্ষাতকারের ইউটিউব লিঙ্ক, পাঠক খুলে দেখতে পারেন।
চারদিকে “হিন্দুত্বের শ্রেষ্ঠত্ব” – এই সুরসুরি বেচে ক্ষমতা দখল আর এভাবেই ২০১৪ সাল থেকে এতদিন করে খেয়ে আসছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কোন ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ববাদ অথবা এমন ধর্ম-ভাষা ইত্যাদির সুরসুরি তুলে নানা কিসিমের জাতিবাদগুলো এভাবেই মানুষের উপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রাজত্ব করে থাকে। তবে আগে ছিল সেটা মোদীর উত্থানের সময়। আর এখন পতনের সময় এর চেয়েও ভয়াবহভাবে তিনি হঠাত পড়তে শুরু করেছেন। ভারতের কোভিড ভাইরাস মোকাবিলা করতে গিয়ে এই দ্বিতীয় ঢেউ [মাল্টিপল বংশ-প্রজাতির ভাইরাস [variant] একসাথে আবির্ভাব ছড়িয়ে পড়েছে] এর কালে মোদী সরকারের হিন্দুত্বের চাপাবাজি ও উন্মাদনা তুলে এবার আর কিছুই ঢাকতে পারছে না। সব ম্যানেজমেন্ট অক্ষমতা আর ব্যর্থতা উন্মোচিত হতে শুরু করেছে। উপরের সাক্ষাতকারের বক্তাদের বক্তাদের বক্তব্যের সারকথা এটাই।
A Naga Sadhu, or a Hindu holy man, waves the Indian flag as he takes a dip in the Ganges river during the first Shahi Snan at “Kumbh Mela”, or the Pitcher Festival, in Haridwar, India, March 11, 2021. REUTERS/Anushree Fadnavis
এদিকে, এটা উত্তরাখন্ড প্রদেশের (আগের উত্তর প্রদেশের অংশ) “হরিদ্বারে কুম্ভমেলা্র” ছবি। এসব ধর্মীয়-স্নান জাতীয় ততপরতার সাথে [সাধু আর পতাকা এদুই এর মিলন এটা খুবই তালমিল-হীন ] ভারতীয় পতাকার কোন সম্পর্ক এর আগে কখনও দেখা গেছে বলে মনে পড়ে না। সম্ভবত, এটা বিদেশিদেরকেও দেখানো [এই ছবিদুটা আলজাজিরা ও জাকার্তাপোস্ট পত্রিকা থেকে নেয়া] যেন এর উদ্দেশ্য। এছাড়াও আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হিন্দুত্বের জোশ-জজবা তুলে ভোট আদায়ের সাথে, মানে হিন্দুত্বের রাজনীতির সাথে সাধুগিরির সামাজিক ততপরতা একে সরাসরি যুক্ত করা হয়েছে বলে এমন; যা আগে পুরানা দিনে কখনও দেখা যায় নাই। এখন হচ্ছে এটাই হিন্দুত্বের ভারতের মোদীর বিরাট নেতি অবদান। মোদীর আরো বড় অবদান হল কোভিড দ্বিতীয় ঢেউ এর মধ্যেই অভয়দান করে এমন লাখ লাখ লোকের জমায়েতের আয়োজন করতে উতসাহ দেয়া। এই মেলায় এমনকি, এখানে কোন লালার স্যাম্পেল না দিয়েই আপনি কোভিড নেগেটিভ বলে সার্টিফিকেট পেতে পারেন, সে ব্যবস্থা আছে [Testing negative without even giving a sample]। মোদী এখন বুঝতেছেন নিশ্চয়, এখানে কে কাকে আসলেই ফাঁকি দিতে পেরেছিল!
আবার এর বিপরীতও আছে। কিছু আনন্দবাজারি মাথাব্যাথাও দেখে গিয়েছিল যে, এক সাধু অভয় দিচ্ছিলেন – ভগবান আছে সব নাকি তিনিই রক্ষা করবেন……“It’s the voice of god, who says nothing will happen. God won’t let anything happen to us. I have full faith,” said Baba Prakash Puri Maharaj।
আবার মেলার আয়োজক প্রধান বার্তা সংস্থা এএফপি-কে বলেছেন, “আমাদের কাছে বিশ্বাস সবথেকে বড়। মা গঙ্গার উপর মানুষের বিশ্বাস রয়েছে বলেই তো এত মানুষ এখানে স্নান করতে এসেছেন। তাঁরা বিশ্বাস করেন মা গঙ্গা তাঁদের এই অতিমারির হাত থেকে বাঁচাবেন”। এমনকি উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী তীর্থ সিংহ রাওয়াতও বলেছিলেন, ‘‘মানুষের স্বাস্থ্য অবশ্যই গুরুত্ব পাবে। তাই বলে ধর্মকে অবহেলা করতে পারব না”। ভোটের বাজার এতই চড়া। কারণ, এবার হিন্দুত্বকে পিছনে ফেলে ছাপিয়ে উঠেছে কোভিড পরাক্রমশালী। মানে কোভিডে মোকাবিলায় স্বাস্থ্যসেবা ফেল করায় আবার গরীবের কাজ ও পেটের বন্দোবস্ত করতে মোদী সরকার ফেল করায়। অথচ ঠিক উলটা হয়েছিল গতবছর লকডাউনের আগে মারকাজের ইসলামি জমায়েতের বিরুদ্ধে সরকারি একশনে। বিবিসি লিখছে “প্রসঙ্গত, গত বছরের মার্চে দিল্লির নিজামুদ্দিনে তাবলীগ জামাতের যে মারকাজে দেশ-বিদেশের হাজার হাজার মুসুল্লী জড়ো হয়েছিলেন, সেটিকে করোনা সংক্রমণের একটি ‘সুপার স্প্রেডার’ ইভেন্ট হিসেবে সরকারি কর্মকর্তারাই চিহ্নিত করেছিলেন”। যা মুসল্লিদেরকে সাজা খাটতে হয়েছিল, আদালতে দারস্ত হয়ে কোনমতে বাঁচতে হয়েছিল। যদিও ইসলামবিদ্বেষ উঠানো হয়েছিল চরমে এই বলে যে প্রজাতি হিসাবে মুসলমান মাত্রই তাঁরা নিম্নস্তরের জীবন-অভ্যাসের মানুষ এই মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগ ও ঘৃণা ছড়িয়ে ।
এটা এক প্রভাবশালী সাংবাদিক-সম্পাদক রাজদীপ সারদেশাই এর ভাবনা বলা যায়। তিনি বলতে চাইছেন, “অনুপযুক্ত শাসকের [inappropriate Governance] জন্যই কী ভারতের এই পরিণতি হল?
এসব নিয়ে এখন সারকথায় বললে, এতদিন মোদী ও তার হিন্দুত্ব নাকি খুবই পপুলার, মারাত্মক জনপ্রিয়, এসব শুনতে শুনতে কাল ঝালাপালা অবস্থায় ছিলাম আমরা। কিন্তু এবার হঠাত করে মনে হচ্ছে সবার কানে পানি ঢুকে গেছে। কারণ, একেবারে উলটা গান শুরু হয়ে গেছে। মোদী আর হিন্দুত্ব নিয়ে নাকি ভারত আর ভাল নাই। মোদীর জনপ্রিয়তা হঠাত করে ব্যাপক ধ্বসের মুখে! ভারতে এখন প্রতিদিনে কোভিডে নতুন আক্রান্তের সংখ্যা তিন লাখের উপরে। আর সাথে মৃত্যুর সংখা ২৬০০ এর উপরে। কোন কোন রিপোর্ট দাবি করছে টুইটারে হ্যাশটাগ #ResignModi এখন ক্রমশ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। অর্থাৎ ঠিকমত চিকিতসা না পাওয়া – যেমন টিকা বা অক্সিজেনের অভাবে থাকা চিকিতসালয় আর কাজ না পাওয়ায় মানুষ প্রত্যেকের পেটে টান দেওয়াতে এবার মোদী আর আর তাঁর হিন্দুত্বকে পরাজিত করে সবার উপরে জোয়ার বা প্রভাব বিস্তার করেছে মানুষের বৈষয়িক জীবন – যেমন স্বাস্থ্যসেবা আর কাজ পাওয়া। এই বেসিক বাস্তবতা। এতদিন মোদী ও তার বন্ধুরা ভেবেছিল তাঁরা হিন্দুত্ব এই জোশ বা আবেগ দিয়েই বাকি দিনও চালিয়ে যেতে পারবেন। কিন্তু এই প্রথম হিন্দুত্বের উপর কোভিড ক্রাইসিসে মোদীর ব্যর্থতা প্রধান ইস্যু হিসাবে উঠে আসছে। মানুষের বৈষয়িক জীবনের নুন্যতম চাহিদাটুকুও পুর্ণ না হওয়া – এটাই হিন্দুত্বের মোদীকে ধাওয়া করে পরাজিত করতে চাইছে।
হিন্দুত্ব ফেল করেছে কেন?
আগে বলেছি মানুষের বৈষয়িক জীবনের নুন্যতম চাহিদাটুকুও পুর্ণ না করেও মোদীর হিন্দুত্ব বিজেপিকে গত সাতবছর ধরে কেবল সার্ভিসই দিয়ে যেতে পেরেছিল। কিন্তু সম্ভবত আর না। সেই রাতারাতি নোট বাতিল (পাঁচশ ও হাজারের নোট বাতিল) সিদ্ধান্তের সময় থেকেও যদি ধরি। মানুষের সহ্যক্ষমতা অপরিসীম তা বলাই বাহুল্য। আজ রিপোর্টারেরা লিখছে, তারা ভেবেছিল, মোদী এটা বেচতে সক্ষম হয়েছিল যে হিন্দুত্বের ঐক্য – এই জাতিবাদ মানুষের জন্য অনেক কিছু এনে দেবে, অনেক সমস্যার সমাধান আনবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য সাধারণ মানুষের। তারা তখনও প্রতারিত, এখনও। এটা তখনও সত্যি ছিল এখনও সত্যি যে মানুষের বৈষয়িক জীবনের নুন্যতম চাহিদাটুকুও পুর্ণ করতে যেমন এক নুন্যতম দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসন প্রয়োজন, মোদী এর কখনই উপযুক্ত নয়, ছিল না। কিন্তু কোভিড ক্রাইসিস এখন চরমে উঠার মাধ্যমে এই ম্যাসেজ কী পাবলিকের কাছে পৌছাবে? আমরা এখনও নিশ্চিত নই। তবে গণহারে পাবলিক যে এক বিরাট ধাক্কা খেতে যাচ্ছে, এটা প্রায় নিশ্চিত। যেটা আরও ভয়াবহ ঘটনা হবে, দরজায় কড়া নেড়ে অপেক্ষা করছে তা হল, কোভিডে ঢলে পড়া অর্থনীতি যা নেগেটিভ প্রবৃদ্ধিতে চলে গেছে ও আছে দেড় বছর ধরে তা কী এই দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কায় আদৌও সামলাতে পারবে? এটাই হয়ে উঠতে পারে হিন্দুত্বের উপর প্রধান নির্ধারক ধাক্কা। ভারতের বাজেট-বর্ষ শু্রু হবার মাস বা কাল হল ১ এপ্রিল। অথচ ভারতের উভয় সঙ্কটটা হল যে, এখনই লকডাউন আরোপ না করলে কোভিড একেবারেই আরো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। আবার উল্টা দিকটা হল, এখন লকডাউনের দিলে এর ধাক্কা সামলানোর মত অর্থনীতি আর চালু থাকবনে না। এছাড়া, মানুষের সুস্থ থাকা ও কাজ থাকার বাস্তবতা আরও শুকিয়ে মরবে। এমন বাস্তবতায় গত সাতবছরে মোদীর হিন্দুত্ব ভারতের জন্য আরো কী কী হারানোর কারণ হয়েছে তা নিয়ে কিছু কথা বলব।
ভারত-পাকিস্তানের সম্পর্কঃ
রাজনীতিবিদ অপেক্ষাকৃত তরুণ কেউ হলে একটা বাড়তি সুবিধা কখনো পেতে বা নিতে দেখা যায়। সেই হল, এপ্রোচ বা আগানোর ধরণ। মানে কোন মনোভাব থেকে বসে একটি সমস্যাকে নেতা দেখবে? তাঁর আগের রাজনীতিক নেতারা যেভাবে দেখে এসেছেন সেভাবেই? নাকি নয়া উদ্যোগে? কোনো নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা বিকল্প পথ খুঁজে দেখে তাতে সমাধান বা অবস্থা বদলের চেষ্টা করবেন? দেখা যায়, রাজনৈতিক নেতা বা প্রধানমন্ত্রী নতুন বা অপেক্ষাকৃত কম বয়সী হলে তিনি অনেক ভিন্ন দিক থেকে সমাধান খুঁজতে চাইছেন, যা আগে ভাবা হয়নি। সমস্যা বা বিরোধগুলোকে বিপক্ষ অংশের সাথে বসে মানে তাদের চোখেও দেখে এক নয়া এপ্রোচে নতুন পথে সমাধান বা বিপক্ষকে মানানোর বা পরস্পরের সমস্যাটা ঠিক কোথায় তা ঠিকঠাক বুঝে এগোনোর পথ এক্ষেত্রে খুঁজে থাকেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তেমনই এক ব্যক্তিত্ব!
ইমরান যখন ২০১৮ সালের আগস্টে প্রধানমন্ত্রীর শপথ নেন, তখন ভারতে বিজেপির মোদীর প্রথম টার্মে ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে চার বছর পার করে ফেলেছেন তিনি। মোদী ভারতের প্রধানমন্ত্রী ২০১৪ সালের মে মাস থেকে। মানে পরের বছর ২০১৯ সালের মে মাসে মোদী আবার নির্বাচনে দাঁড়ানোর কথা তখন। মোদী দ্বিতীয়বার দাঁড়িয়েছিলেন এবং তিনিই ‘বিজয়ী’ বলে নির্বাচন কমিশন ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু ইমরান খান পাকিস্তানের আগের যেকোনো প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে নয়া এপ্রোচ, নয়া উদ্যোগ নেয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন অপেক্ষাকৃত কম বয়সী প্রধানমন্ত্রী অবশ্যই। কিন্তু সার কথাটা বললে, নয়া উদ্যোগের প্রধানমন্ত্রী ইমরানের থেকে মোদীর ভারত নয়া উদ্যোগ বা অ্যাপ্রোচের কোন সুবিধা পেতে বা নিতে চান বা নিয়েছেন; এমন আমরা দেখিনি। কেন?
প্রথমত, এটা ঠিক মোদীর বিরুদ্ধে যতটা অভিযোগ, এর চেয়ে বরং বলতে হবে মোদির পক্ষে আসলে এমন কোনো আশা দেখতে পাওয়া বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার নয়া উদ্যোগর পথে আগোনো অথবা ইমরানকে উৎসাহ দেয়া ইত্যাদি কোনটাই আসলে মোদির পক্ষে সম্ভবই ছিল না। সেই প্রসঙ্গেই এখানে বলব।
তবে এর আগে সাধারণভাবে ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তান এই তিন দেশের দুর্ভাগ্য যেখানে আটকে গেছে ও আটকানো শুরু হয়েছিল তা নিয়ে দু’টি সাদা কথা বলে নেব।
ভারত-পাকিস্তানের দ্বিপক্ষীয় বিরোধের ইস্যুগুলো এমন যে, এর অন্তত কিছু গূঢ়-ইস্যু নিয়েই অনন্তকাল বিবাদ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব। মানে কোন সমাধানের দেখা পেতে এখানে কতগুলো প্রজন্ম লাগবে এর হদিস কেউ জানে না। কাশ্মির ছাড়াও জন্ম থেকেই বিরোধের সূত্রপাত এমন অনেক ইস্যু আছে।
কিন্তু এসব বিরোধের আসল উৎস কী তা স্বল্প কথায় বললে – এর প্রধান উৎস হলো ব্রিটিশরা কলোনি-ইন্ডিয়া ত্যাগ করে চলে গেলে কলোনিমুক্ত ভারত কেমন রাষ্ট্র হবে এ নিয়ে অপরিপক্ব জবাব দেয়ার চেষ্টা এবং রাষ্ট্র নিয়ে খাটো চিন্তা-ধারণা হাজির করা থেকেই আজকের ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তান- এ তিন দেশ সেই থেকে সাফার করে আসছে, ধুঁকে মরছে।
সমাজের কোন একদল নিজ ধর্মীয় বা যেকোনো আইডেনটিটিরই এক জাতি-রাষ্ট্র করবে বলে, বুঝে বা না বুঝে যদি গোঁ ধরে তবে এর পরিণতিতে তা বাকি সব পক্ষই আরেকটা করে ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম বা ভাষা অথবা অন্য যেকোনো ভিন্নতার আইডেনটিটির ভিত্তিতে জাতি-রাষ্ট্র গড়তেই তো চাইবেই। সব বিবাদের শুরু এখান থেকে, আর এথেকে নানান দিকে তা যাবেই। এটাই অনিবার্য আর তাই হয়েছিল। এই সরল সত্য ও বাস্তবতা বোঝার যোগ্যতা যারা প্রধান নেতৃত্ব দাবি করেছিল তাদের কারো ছিল না; বরং সবাইকে একটা আইডেনটিটির জাতি-রাষ্ট্রে আনতেই হবে আর সেটা হতে হবে এক হিন্দু-জাতিরাষ্ট্রই; এভাবে তা বাকি সবার ওপরে চাপিয়ে দিয়ে হলেও যেন ‘এটাই হতে হবে’। কংগ্রেসের এই জবরদস্তি, এ থেকেই সব বিরোধের আরো ডালপালায় বিস্তার এখনো চলছে। এর শুরু বা আদিপাপের রচয়িতা-কর্তা মুসলিম লীগ বা জিন্নাহ একেবারেই নয়। এই মিথ্যা প্রপাগান্ডাও চালু আছে। তবে এরা অবশ্যই নিরুপায় হয়ে অনুসারী মাত্র। সেই মূল রচয়িতা-কর্তা হলেন রাজা রামমোহন রায়; এবং বিগত ১৮১৫ সাল থেকে শুরু করা তাঁর ব্রাহ্মসমাজ গড়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টা। এই ব্যর্থতা থেকেই পরে বঙ্কিম-প্রমুখেরা এক “হিন্দু জাতিরাষ্ট্রের” জন্ম দেয়া বা গড়াই কংগ্রেসের লক্ষ্য সেট করেন। আর তাতে সব বিবাদের শুরু হয় এখান থেকে। রামমোহন, তিনি বোকা নাকি ইসলামবিদ্বেষী? সে যাই হোক, পাঠক বিচার করবেন, তবে কমিউনিস্টদের চোখে রামমোহনকে তারা মানেন ‘বেঙ্গল রেনেসাঁর আদিগুরু’ হিসাবে! এখন তাহলে কমিউনিস্ট-প্রগতিশীলেরাই ব্যাখ্যা করে দেন যে, কমিউনিস্টদের চোখে ধর্মচর্চা তো এখনোও খুবই খারাপ কাজ। অথচ এই বহু কথিত রেনেসাঁর আদিগুরু রামমোহন, তিনি কী করে নতুন একটা আস্ত ধর্ম – ব্রাহ্মধর্ম চালু করেছিলেন? এ কোন বিপ্লবীপনা? আবার এটা নিয়েইবা সব রেনেসাঁবাদী কমিউনিস্টরা আজও বেমালুম চুপচাপ নির্বিকার কেন? কিভাবে? এর সাফাই কী এবং কৈ? তারা কেউ বলেন না! কেন?
আমাদের অনেকের মনে হতে পারে, ভারত-পাকিস্তানের ক্যাঁচাল থেকে বাংলাদেশ এখন স্বাধীন হয়ে অনেক দূরে গিয়ে বেঁচেছে। কিন্তু তা একেবারেই না। এমন মনে হলেও এটা সত্য নয়। কারণ অখণ্ড ভারতে আমাদের মূল বিবাদ ছিল, ভাষা বা ধর্মীয় আইডেনটিটির জাতিরাষ্ট্র খাড়া করে সমাধা পাওয়ার খায়েশ থেকে শুরু হওয়া নানা লড়াই থেকে বিভক্তি। তাতে বাংলাদেশে আমরা এখন ভৌগোলিকভাবে ভারত-পাকিস্তানের কেউ না বলে তাদের ক্যাঁচালের কেউ না – এই আত্মপ্রসাদ পেতে চাইলেও যা আমরাও সাথে নিয়েই হাঁটছি তা হল, বাংলাদেশ এখনো একটা ভাষা বা ধর্মীয় আইডেনটিটির জাতি-রাষ্ট্রই। সেই আদিপাপ আমরা ত্যাগ করতে পারিনি। বাংলাদেশ বাংলা ভাষাভিত্তিক আইডেনটিটির এক জাতি-রাষ্ট্র। আর তা কোন ধর্মীয় আইডেনটিটির জাতি-রাষ্ট্র থেকে কোন অর্থেই আলাদা কিছুই না? মূল কারণ যেকোনো আইডেনটিটির জাতি-রাষ্ট্র মাত্রই একটা অস্থিতি ও নতুন বিবাদের উৎস হয়ে তা থেকে যাবে বলে এ থেকে বের না হতে পারার বিবাদ থাকবে। যেমন বাংলাদেশের কেউ কেউ মুসলিম জাতিরাষ্ট্র হতে চাইবে। পাহাড়িরা যেমন জুম্মু জাতিরাষ্ট্র। এ কারণে হিন্দু-মুসলমান নিয়ে বিবাদে আমরা এখনো সবাই প্রায়ই আক্রান্ত হই,আটকে আছি। আর এতে সামাজিক-অর্থনৈতিক সব অর্জনই সময়ে ম্লান হয়ে যায়।
বাংলাদেশ এখনো একটা ভাষাভিত্তিক আইডেনটিটির জাতি-রাষ্ট্রই। সেই আদিপাপ আমরা ত্যাগ করতে বা বের হতে পারিনি। বাংলাদেশ বাংলা ভাষাভিত্তিক আইডেনটিটির এক জাতি-রাষ্ট্র। আর তা কোন ধর্মীয় আইডেনটিটির জাতি-রাষ্ট্র থেকে কোন অর্থেই আলাদা কিছুই বা বিবাদের বাইরে না? মূল কারণ যেকোন আইডেনটিটির জাতি-রাষ্ট্র মাত্রই একটা অস্থিতি ও নতুন বিবাদের উৎস হয়ে তা থেকে যাবে বলে – এ থেকে বের না হতে পারার বিবাদ থাকবে। যেমন বাংলাদেশের কেউ কেউ মুসলিম জাতিরাষ্ট্র হতে চাইবে। পাহাড়িরা যেমন জুম্মু জাতিরাষ্ট্র চাইবে। এসব কারণে হিন্দু-মুসলমান নিয়ে বিবাদে আমরা এখনো সবাই প্রায়ই আক্রান্ত হই,আটকে আছি। আর এতে সামাজিক-অর্থনৈতিক সব অর্জনই সময়ে ম্লান হয়ে যাবে। অথচ দরকার ছিল নন-আইডেনটিটি ও এক; সবাই সমান নাগরিক এই ভিত্তিতে এক “রাজনৈতিক সাম্য”; মানে সমঅধিকারভিত্তিক রাষ্ট্র।
এখন আমাদের প্রসঙ্গ মোদী-ইমরানের মধ্যে সীমিত করব। ভারত-পাকিস্তানের অবস্থা এখন এমন যে, সবাই ন্যূনতম এক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চায় হয়ত; সব পক্ষেরই কাম্য। কিন্তু একই সাথে এর সমস্যা অন্যখানে। কারণ এক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এমনকি বিজেপি-আরএসএসের মোদীরও হয়ত অকাম্য নয়। শান্তি পেয়ে গেলে তা মোদীর জন্য খারাপ কিছু হতো না। কিন্তু সমস্যা হল প্রায়োরিটির, অর্থাৎ মোদীও পাকিস্তানের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চান না অথবা কম বয়সী প্রধানমন্ত্রী ইমরান ক্ষমতায় এসেছেন তার সাথে নতুন উদ্যোগ নিতে চাইবেন, তা করতেও মোদির কোনো আপত্তি আছে – ব্যাপারটা তা নয়, তা একেবারেই নয়। সমস্যা হলো প্রায়োরিটির।
মোদির প্রায়োরিটি হল মানে এসবের আগে আরেকটা কাম্য জিনিষ আছে। সেটা হল, ভারতের নির্বাচনে ‘হিন্দু-ভোটের মেরুকরণ’ হতে হবে, পরিস্থিতিকে এমন হতে বাধ্য করতে হবে, যাতে সব হিন্দু-ভোট বিজেপির বাক্সমুখী হয়, এমন এক জজবা-উত্তেজনা সৃষ্টি করা। কারণ ইমরান ক্ষমতায় আসার পরের বছর ২০১৯ সালের মে মাসে মোদীকে আবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার নির্বাচনে জিততে হবে। তাই পাকিস্তানের সাথে মিথ্যা করে হলেও সীমান্ত-উত্তেজনা সৃষ্টি করা, সেভাবেই ভারতের সেনা ও সিভিল প্রশাসনকে সাজানো আর ঠিক নির্বাচনের আগে এই সীমান্ত বিবাদকে কোন একটা উসিলায় চরমে তোলা- এটাই হয়ে পড়েছিল মোদীর প্রায়োরিটি। যার মূল্কথা, পাকিস্তানের ইমরানের সাথে ভাল সম্পর্কের খারাপ সম্পর্কই মোদীর জন্য বেশি ফলফায়ক। এমনকি সম্পর্কখারাপ এতা দেখানোতেই বেশি ফলদায়ক হবে – এই ছিল মোদীর চাওয়া। অর্থাৎ ভোটের বাক্সে হিন্দু মেরুকরণের ভোট, এটাই মোদির সবার উপরের প্রায়োরিটি হয়ে পড়েছিল। তাই ছদ্মযুদ্ধ লাগানো, পাকিস্তানে ভারতের মিথ্যা বোমা ফেলে আসার দাবি বা ছলনা তৈরি, ইত্যাদিই খুবই টপ প্রয়োরিটি ছিল মোদির কাছে। আর ৩৬ ইঞ্চি ছাতি দেখিয়ে মোদীই একমাত্র ভারত রক্ষাকারী নায়ক – এই ইমেজ ছিল নাকি ভোটে মোদীর ‘তুরুপের তাস’!
অন্য ভাষায় বললে, মোদির হিন্দুত্ব মানে হিন্দু জাত-ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব- এমন দাবি করে যে রাজনীতি মোদী খাড়া করতে চান, অর্থাৎ কেউ হিন্দু হলেও বাস্তবত বরং সে হিন্দু-শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার নাও হতে পারে, এমন হিন্দুত্বের রাজনীতির বাহক তিনি নাও হতে চাইতে পারেন – কিন্তু এটাই মোদী কখনোই এটা হতে দিতেই চান না, পারেন না। পরিষ্কার করে, মোদী মানে দিতে চান উল্টা। বলতে চান, কেউ হিন্দু মানেই সে মোদীর হিন্দুত্ব রাজনীতির বাহকও। এই একমাত্র অর্থ এবং ব্যাখ্যা ও বয়ানে মোদী পুরা ব্যাপারটাকে আটকে রাখতে চান। এটাই বিজেপি-আরএসএসের রাজনীতি এবং এটা হিন্দু-শ্রেষ্ঠত্ববাদ। এটাই হিটলারের জার্মানি আর্য-নীল চোখের শ্রেষ্ঠত্ববাদ অথবা ট্রাম্পের সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদ – এদের সবারই আরেক ভাই হিসেবে মোদী হিন্দুত্বের এক উত্থান ঘটাতে চেয়ে এসেছেন।
মনে রাখতে হবে, পাকিস্তান রাষ্ট্রের ইতিহাসে ইমরান খানই প্রথম প্রধানমন্ত্রী – যিনি পাকিস্তানের তরুণ; নতুন করে যারা পাকিস্তানকে নিয়ে চিন্তা করতে চান এরই প্রতীক হলেন ইমরান। ইমরানই প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন, পাকিস্তানি নাগরিক সে যে ধর্মেরই হোক – পাকিস্তানের সব নাগরিকের মতই সবার সমান অধিকার আছে। ব্লাসফেমি আইন – যেটা মূলত এতদিন জমিজমার দখলের সঙ্কীর্ণ স্বার্থ উদ্ধারের কাজে করা মামলা হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছে, এমন আসামিদের মামলার বিচারে সুপ্রিম আদালত যাকে খালাস দিয়েছে, নির্বাহী সরকারপ্রধান হিসেবে ইমরান তার মুক্তি নিশ্চিত করেছেন ; ইচ্ছামতো দেশ-বিদেশ যাওয়া বা চলাচলের অধিকার। ইমরান এটাকেই তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের জন্য কর্তব্যজ্ঞান করেছেন।
অথচ চরম সঙ্কীর্ণ ও হিন্দুত্বের ভোট জোগাড়ে ব্যস্ত বিজেপির মোদী এমন ইমরানের কাছ থেকে ভারতের জন্য কোনো সুবিধাই চাইতে বা নিতেই পারেননি। কারণ মোদীর লক্ষ্য অন্য সংকীর্ণ কিছু। মোদীর লক্ষ্য মুসলমান-পাকিস্তানের সাথে টেনশন তুলে বা জিইয়ে রেখে সেই ইত্তেজনা নিজ দেশের নির্বাচনে হিন্দুভোট পোলারাইজ করতে ব্যবহার করা। তাই ভারত-পাকিস্তানের বিবাদের ইস্যুগুলোর কোনো একটার বেলায় কিছু হাল করতে বা উদ্যোগী হতে পারেননি মোদী। মোদীর সবার আগে দরকার বা প্রায়োরিটি হল, ইমরানকে মুসলমান দেশের নেতা ফলে শত্রু হিসাবে চিত্রিত করণ। এতেই মোদী তার সব ফয়দা দেখেছিলেন। যেমন এই আমলে, ভৌগোলিকভাবে পাকিস্তানে পড়েছে যে কার্তারপুর-এর শিখ গুরুদুয়ারা, তা ভারতের পাঞ্জাবের শিখরা এখন যেকোন ভ্রমণকারীর মত মাত্র ২০ ডলার ফি দিয়ে ভ্রমণ করে আসতে পারেন। মানে গুরুদুয়ারা তীর্থ করে আসতে পারেন। প্রধানমন্ত্রী ইমরানের কারণে এটি সহজেই বাস্তব হয়ে গেছে।
পরাক্রমশালী করোনার সামনে মোদীর হিন্দুত্বও খাটোঃ
কিন্তু পরাক্রমশালী করোনাভাইরাস মোদীর মত যারা হিন্দু-শ্রেষ্ঠত্ববাদী রাজনীতিক তাদেরকেও সোজা করতে পারে। অনেক কিছুই করতে বাধ্য করতে পারে, তাই মনে হচ্ছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয় মুখে স্বীকার না করেও মিডিয়া রিপোর্ট হাজির হতে দিচ্ছিল যে ভারত-পাকিস্তান আলোচনা চলছে কখনো গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই আর ‘র’-এর মধ্যে। অথবা প্রশাসনিক কর্তা পর্যায়ে এবং মিডিয়া থেকে দূরে থেকে। এমন আলাপ আগের কংগ্রেস বা বিজেপি আমলেও হয়েছে, আর সেসব হয়েছিল মূলত ব্যাংককে। এবারো তা ব্যাংককে বা দুবাইয়ে হচ্ছে বলে মিডিয়া রিপোর্ট দিচ্ছে।
কিন্তু কেন তারা এত লুকোচুপি করে আবার দেখাও করছে? এবং তা নিজ নিজ দেশের বাইরে করছে? কেন?
একমাত্র কারণ মোদীর ‘ভোটবাক্স’ প্রায়োরিটি, যা আগে বলেছি। ভারতের কল্পিত বিরাট শত্রু মুসলমান পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মোদী একাই লড়ে ভারতের হিন্দুস্বার্থ রক্ষা করে চলেছেন, এই ইমেজ মোদীর ভোটবাক্সের জন্য খুবই দরকারি। কিন্তু এর অবস্থা এখন খুবই সঙ্গীন। যেমন কাশ্মিরে লাদাখ সীমান্তে যখন চীনের সাথে ভারতের সামরিক টেনশন চলছিল তখন মোদীর-সেনাদের টেনশন বাড়ছিল যে, কখনো যেন ভারতকে চীনের পাশাপাশি পাকিস্তান – এই দুই দেশের সাথে না তাদের নিজ নিজ সীমান্ত দুটা যুদ্ধক্ষেত্রে লড়তে না হয় এটাই নিশ্চিত করা। তাই সে সময় চীনের পাশাপাশি পাকিস্তানের সাথেও কথা বলে ভারত ধারণা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় যে, ভারত পাকিস্তানের সাথেও সঙ্ঘাত চায় না। এটা অবশ্যই ভারত পাকিস্তান দুই দেশের জন্যই লাভজনক ছিল। কারণ যুদ্ধের ফ্রন্ট খুললে তা পাকিস্তানের অর্থনীতির জন্য কোনো ইতিবাচক ঘটনা ভাবার কারণ নেই। আর এ বাস্তবতার সুবিধাটাই ভারত উঠিয়ে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু পাবলিকলি দেখা করলে মোদীর ভোটবাক্সে টান পড়বে। আর সে কারণেই এত লুকোচুরি।
এখানে কোভিডের আরেক সুবিধা বা অসুবিধার কথাও বলা দরকার। গত দেড় দুই বছরে মিডিয়া প্রশ্নে মোদী সরকার বিরাট সুবিধা ভোগ করে চলেছে। ভারতের লিডিং প্রায় সব মিডিয়া এখন মোদীর অনুগত, পায়ের কাছে ঘুরঘুর করার অবস্থা! কেন? কোন মন্ত্র বলে? কারণ প্রতিটি মিডিয়া কোভিডের ঠেলায় বিক্রি ও বিজ্ঞাপন কমে এক অর্থনৈতিক টানাটানিতে ডুবে গেছে। ফলে কর্মীদের ৪০ শতাংশ বেতন দেয়ার প্রতিশ্রুতিও রক্ষা করতে মিডিয়া ম্যানেজমেন্ট হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থাটাই বোঝা যাবে এটা দেখলে যে, ধনী-গরিব প্রতিটি মিডিয়াই এখন পাবলিক ডোনেশনের চাঁদা চেয়ে নোটিশ টাঙ্গিয়ে রেখেছে। কাজেই সবাই এখন একমাত্র ও সহজ উপায় হিসেবে দেখছে বিজেপির রাজনীতির পক্ষে সাফাই দেয়ার কাজকে। এমন মিডিয়া হয়ে যাওয়ার বিনিময়, সরকারি দল বা সরকারি ফান্ড হাতিয়ে নেয়া – এভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টাই এখন সব মিডিয়ার প্রধান ট্রেন্ড বা ধারা। তবে মিডিয়াগুলো আরেক নয়া কৌশল ধরেছে। তারা বলতে চাচ্ছে, তারা আরএসএস-বিজেপির হিন্দুত্ববাদের ঠিক প্রমোটর নয়। কিন্তু তারাই আবার দাবি করছে, তারা আসলে সেটা করেনি। তারা বরং হিন্দু-জাতি-রাষ্ট্রের সরকার, সরকার যেই হোক তাকে সমর্থন দেয়া এটাই দ্য হিন্দুর সুহাসিনী হায়দারের কর্তব্য, অথবা দ্য প্রিন্টের শেখর গুপ্তের কর্তব্য – এরা এই আড়াল টেনে কাজটা করে যাচ্ছে।
কিন্তু তবু সম্প্রতি আরো কিছু উইকেটের পতন ঘটেছে। এটা শ্রুতি কপিলা [SHRUTI KAPILA] নামে এক লেখকের দ্য প্রিন্ট পত্রিকায় এক মন্তব্য-রিপোর্ট। তিনি বলছেন, টুইটারে ‘রিজাইন মোদি’ এই হ্যাশট্যাগ পপুলার ভিত্তি পেয়ে উঠছে [The trending of #ResignModi on Indian Twitter…… ]। তিনি দাবি করেছেন, এটি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, কোভিড মহামারী এবার এই প্রথম ‘রাজনৈতিক’ হয়ে উঠছে। [It finally signalled that the Covid pandemic had become political.] মানে, রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে উঠছে।
তিনি লিখছেন, “গত বছরের এনিয়ে বিপর্যয়ের সময়ও মহামারী ছাপিয়ে উঠা সত্ত্বেও নিজ পপুলারিটি নিয়ে ‘চির-স্ট্রং’ মোদী এসবের ঊপরে থাকতে চেয়েছিলেন। বহু সার্ভেতেই দেখা গেছে, তিনি উপরে আছেন”। মিস কপিলা এর কারণ ব্যাখ্যা করে বলতে চান, গত বছরের কোভিড পরিস্থিতি কোনোভাবেই কম চ্যালেঞ্জিং ছিল না। কিন্তু জনগণ এরপরও সম্মিলিতভাবে মোদীর উপর (তাঁর হিন্দুত্বের উপর) আস্থা রেখেছিলেন যে, তাদের হিন্দুত্বের ঐক্যবদ্ধতার কারণে মোদী সবাইকে রক্ষা করে নেবেন।
মিস কপিলা আরো লিখছেন, ‘ভারতে এখন প্রতিদিন নতুন আক্রান্ত কোভিড-রোগী ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৬৯১ জনের; এমন সংখ্যা এটাই সম্ভবত প্রধানমন্ত্রী মোদীকে আর মাফ করতে পারছে না। কমতেছে। টুইটারে প্রকাশিত ট্রেন্ড, ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া হতাশা, এগুলোই সম্ভবত মোদীর হিন্দুত্বের সমর্থন হারিয়ে ফেলার প্রথম ইঙ্গিত! এখন ক্রমেই তাদেকে দেখা যাচ্ছে ভয়ের বদলে ‘বিক্ষুব্ধ’ হয়ে উঠাকে প্রাধান্য দিতে। সম্ভবত এদিকটা খেয়াল করেই, মোদি সম্প্রতি পাবলিককে ডিসিপ্লিন থাকার জন্য আকুল আবেদন করেছেন”।’
তাহলে দেখা যাচ্ছে এবারে মোদীর হিন্দুত্ব – এটা আর মহামারীর কারণে সরকারের উপর পাবলিকের আস্থার সঙ্কট কমে যাবার বিপর্যয় ঠেকাতে পারছে না? কোভিডের মহামারীতে চিকিৎসার অভাব আর পেটের টানের বিরুদ্ধে এবার ‘হিন্দুত্ব’ আর কিছুই ঢেকে ফেলতে পারছে না! হিন্দুত্বের জোশ আর কি কাজ করছে না? মোদী এবার সব লুকিয়ে আগলে রাখতে কি ফেল করবেন! মোদি কী পাবলিকের আস্থাহীন নেতা হয়ে যাবেন? দেখা যাক! পানি কতদুর গড়ায়!
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
[এই লেখাটা গত ২৪ এপ্রিল ২০২১, দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ওয়েবে ও পরদিন প্রিন্টেও “হিন্দুত্ব ফেল, কোভিডে চিকিৎসাস্বল্পতা ও পেটের টানে” – এই শিরোনামে ছাপা হয়েছিল।
নয়াদিগন্তে ছাপা হওয়া লেখাগুলোকে আমার লেখার ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ বলা যায়। আমার এই নিজস্ব সাইটের লেখাটাকে সেকেন্ড ভার্সান হিসাবে, পাঠক থিতু ভাষ্য বলে গণ্য করতে পারেন। সেভাবেইপরবর্তিতে ঐ লেখাকে এখানে আরও অনেক নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে ও নতুন শিরোনামে এখানে আজ ছাপা হল। ]