ভারত নাকি সুপারপাওয়ার, এখন তৃতীয় বিশ্বে


ভারত নাকি সুপারপাওয়ার, এখন তৃতীয় বিশ্বে

গৌতম দাস

১০ মে ২০২১, ০০:০৫ সোমবার

https://wp.me/p1sCvy-3wM

 

 

India not really a Superpower

গত ২ মে নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি কলকাতায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস দলের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে। বিজেপির ৭৭ আসনের বিপরীতে তৃণমূল ২১৩ আসন পেয়ে বিধানসভায় জিতেছে। কিন্তু আরএসএস-বিজেপি ব্যাপারটাকে যেন ভারতের কেন্দ্রীয় পার্লামেন্ট ও সরকারের নির্বাচনের মত পর্যায়ের  বিশাল গুরুত্বের বানিয়ে ছেড়েছিল। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতায় থাকায় বিজেপি কেন্দ্রীয় সরকারি প্রশাসনকে দুমড়ে মুচড়ে কিভাবে সেই ক্ষমতাকে এক রাজ্যের নির্বাচনে চরম অপব্যবহার করতে গিয়ে হারতে পারে এরই নজির হয়ে থাকবে এই নির্বাচন!

মোদীর কাছে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন কেন গুরুত্বেরঃ
আরএসএস-বিজেপি এই রাজ্য নির্বাচনকে এত গুরুত্বপূর্ণ মনে করা এবং এতে সম্ভবত সর্বোচ্চ অর্থকড়ি ও সময় ঢালার পেছনের কারণ কী?  যেমন একমাসেরও বেশি সময় ধরে  আটপর্ব এইনির্বাচনের শ্লট বানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। আর কোথাও আট পর্বে তা হয় নাই। আবার আটপর্ব যে অপ্রয়োজনীয় ছিল এর প্রমাণ কমিশন অজান্তে নিজেই তুলে ধরেছে। পাঁচপর্ব নির্বাচনের পর কোভিড ভাইরাসের প্রভাব বেড়ে যাওয়াতে কমিশন সর্বদলীয় বৈঠক ডেকেছিল। সেখানে বাকি সবভোট একদিনে নিয়ে সব শেষ করার জন্য মমতা প্রস্তাব দিলে  কমিশন টেকনিক্যাল আপত্তির কথা তুলে তা নাকচ করেছিল।  তা হল, একদিনে ভোট নিতে গেলে মোট যে পরিমাণ ফোর্স লাগবে তা এখন সংগ্রহ করার সময় নাই। তাদের এই কথায় প্রমাণিত যে এত মাস জুড়ে নির্বাচন আয়োজনের দরকার ছিল না। কেবল সময় থাকতে ফোর্স সংগ্রহ করলেই হত। তাহলে  নির্বাচনের মাঝের দিনের গ্যাপ এত বেশি রাখা হয়েছিল ইচ্ছা করেই। আর এই “খেয়ালি” ইচ্ছাটা কার খেয়ালে?  এটাই এখন স্পষ্ট এক রাজ্যের নির্বাচনে  মোদী  নির্বাচন কমিশনকে প্রভাবিত করে রেকর্ড গড়েছেন। যাতে তিনি একমাসের মধ্যে মোট ১৮ দিন কলকাতায় সভা করতে পারেন এবং তা করেছেন। এটাই ক্ষমতার অপব্যবহার আর পশ্চিমবঙ্গের  এবারের  নির্বাচনকে আরএসএস-বিজেপি  কী মাত্রার গুরুত্ব দিয়েছে তার প্রমাণ। তাহলে কথা সোজা, দেখা গেল এবার ‘কলকাতা দখলকে’ আরএসএস-বিজেপি মাত্রারিক্ত গুরুত্ব দিয়েছে। কিন্তু সেটাই বা কেন?

সবাই রাম-পুজারী হিন্দু না, বিজেপির দরকার একই হিন্দুঃ
ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক দিক থেকে বললে ভারত মানে বৃহত্তর উত্তরপ্রদেশের হিন্দু ভারত- এমন ভাবনার আধিপত্য চলে আসছে।  ভারতের কেন্দ্রীয় ক্ষমতার উপর ভারতের জন্ম থেকেই এই আধিপত্য সবসময় ক্রিয়াশীল থেকে আসছে।  আর তাই এর সাথে দক্ষিণ ভারতের বিরোধের কথা আমরা অনেকে কম-বেশি শুনেছি। দক্ষিণ ভারত হিন্দি জানলে বুঝলেও হিন্দি ব্যবহার করে না চল নাই – একথাও আমরা শুনেছি।
হায়দরাবাদের (বা অন্ধ্রের) পরে তেলেঙ্গানা থেকে কর্নাটক, তামিলনাড়ু হয়ে কেরালা পর্যন্ত এই দক্ষিণী অঞ্চল একে ভারতের ভাষায় দাক্ষিণাত্য (ডেকান বা Deccan) বলা হয়।  দক্ষিণদিক কথার সংস্কৃত উচ্চারণ ‘দাক্ষিণাত্য’ আর এই খটমটে শব্দ বৃটিশেরা ইংরেজিতে সহজে উচ্চারণ করতে গিয়ে ‘ডেকান’ বানিয়ে ফেলেছে। ভাষার দিক থেকে এই অঞ্চলের চারটা ভাষাকে একসাথে একে দ্রাবিড়ীয় ভাষার অঞ্চল বলে। এটাই হিন্দিবিরোধী ও আর্যবিরোধী দ্রাবিড় সমাজ অঞ্চল। আসলে দাক্ষিণাত্য বলতে বুঝায়, ভারতের দক্ষিণের পুর্ব ও পশ্চিম উপকুল এবং এক বিস্তৃর্ণ উচু মালভুমি ও পর্বতমালা (plateau and mountain ranges) যার সর্বোচ্চটা আনাইমুদি (২৬৯৫ মিটার), এভাবে এই পুরা অঞ্চলকে।  আর এই বিস্তৃর্ণ মালভুমি ও পর্বতমালা এলাকা টপকাতে পারে নাই বলেই উত্তরের আর্য আক্রমণ ও সম্ভাব্যদখল থেকে দক্ষিণ বেঁচে যায়। প্রাচীনকালের সেই লড়াই প্রতিরোধ এবং এর ফলাফল এখনও সক্রিয় ও কার্যকর ফলে ঐতিহাসিক গুরুত্বের। ফলে দক্ষিণ-ভারতের হিন্দি না-বলা এটা শ্রেফ শখ বা কারও খেয়াল মোটেও নয়।
এছাড়া আরও আছে।  যেমন, ১৯৪৭ সালে স্বাধীনের পর থেকেই এই দ্রাবিড় সমাজ “ব্রাহ্মণ তাদের সমাজে অপ্রয়োজনীয়” বলে এক সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন করেছিল। ব্রাহ্মণ ছাড়াও বিয়ে করা যাবে বলে আইনও তৈরি করেছিল, যা এখনো চালু আছে। এরই উত্তরসুরি আঞ্চলিক ডিএমকে ও আন্না-ডিএমকে দল। ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার আন্দোলনও করেছিল এই রাজ্যগুলো যার কেন্দ্র ছিল তামিলনারু। [আগ্রহিরা  E V Ramaswami (EVR or “Periyar”) এই ব্যক্তিত্বের সংশ্লিষ্ট যেকোন ইতিহাস পড়তে পারেন।] এছাড়াও ১৯৬২ সালে হিন্দিভাষা চাপানোবিরোধী আন্দোলনে জীবন দিয়ে রুখে দেয়ার কারণে আজও ভারতের সুপ্রীম কোর্টের ব্যাখ্যায় ভারতের কনষ্টিটিউশনে উল্লেখিত কোনো “রাষ্ট্রভাষা” নেই – এমন করে রাখা হয়েছে। তবে সরকারি দাপ্তরিক ভাষা আছে আর তা হিন্দি (ঠিক হিন্দি নয় হিন্দুস্থানি) এবং ইংরাজি।  আর্য-হিন্দির আগ্রাসন দক্ষিণে এমন প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিল। আর একইভাবে  একই রকম আর্য-হিন্দির আগ্রাসন  প্রতিরোধ পেয়েছিল বিহার পেরিয়ে বাংলায় প্রবেশমুখে। তাই বাংলাভাষা টিকে যায়, যদিও প্রাচীন বাংলা অঞ্চলের সেই প্রতিরোধ ভারতের দক্ষিণের মত পর্যায়ের প্রবল ছিল না বলে এর প্রচারও কম হয়েছে। এসব প্রতিরোধের চিহ্ন হয়েই এবং সে কারণে এখনও ভারতের সাংস্কৃতিক পরিচয় বৈশিষ্ট বলতে মেজর তিনটা ধারা দেখতে পাওয়া যাবেই – উওর, দক্ষিণ ও পুর্ব  ধারা বা ঘরানার সঙ্গীত ও নৃত্যধারায়।  অবশ্যই এগুলো এথনোলজি  অর্থে [ethnological] ভারতীয় জাতিবৈশিষ্ঠের ভিতরের মৌলিক ভিন্নতা।  এই ভিন্নতা বলতে আলাদা আলাদা ভাষা, খাদ্যাভাস ইত্যাদিতে এথনিক-ধরণের ভিন্নতাগুলো তো  বটেই এছাড়া আরও ভালভাবে  এই ভিন্নতা  সাংস্কৃতিকভাবেও ধরা যায় যেমন নাচ-গানে, বাদ্যযন্ত্রে, ঘরানায় স্পষ্ট সাংস্কৃতিক ট্রেডিশনের ভিন্নতায়।  তাই এককথায় বললে, তামিলনারুর মত কলকাতাও আর্য-হিন্দিবিরোধী আরেক হাব। এজন্য পশ্চিমবাংলা আরএসএস-বিজেপির আরেক মাথা ব্যাথা।  মূল কারণ আগেও বলেছি বিজেপির রাজনৈতিক এজেন্ডা হল ভারতের রাজ্যগুলোতে এথনোলজি-সাংস্কৃতিক অর্থে তারা ভিন্ন ভিন্ন হিন্দু। বিজেপি সেগুলোর উপর এক রাম-পুজারী হিন্দুত্ব চাপিয়ে দিয়ে সবাইকে বেধে এক হিন্দুত্বের জাতিরাষ্ট্র কায়েম করতে চায়।  হিন্দুত্ববাদের আরএসএস-বিজেপি এবার কলকাতায় রাজ্য নির্বাচনে সেই ‘বাংলা’কে বিজয় মানে, জবরদস্তিতে উপর থেকে এক ইউনিফর্ম হিন্দুত্ব চাপানোর খেয়ালে কলকাতায় এসেছিল। এবং পরাজিত হয়ে গেল। বিজেপির যে হিন্দুত্ববাদ বা হিন্দু-শ্রেষ্ঠত্বের জাতিবাদ – এটা তারা সারা ভারতে কায়েম করতে চায়। অর্থাৎ এখনকার ভারতের ২৮ রাজ্যের মোট ৮০ শতাংশ জনগোষ্ঠী সনাতন ধর্মাবলম্বী বলা হলেও এরা সাংস্কৃতিক-এথিনিক অর্থে সবাই একই ধরনের হিন্দু নয়। কিন্তু বিজেপির ভাষায় বললে, তারা ভারতের সব রাজ্যের হিন্দুকে “রামের অনুসারী” হিন্দু বানাতে চায়, এমন এক পরিচয়ে বাঁধতে চায়। যাতে এর ফলে ভারত এক হিন্দুত্ব শ্রেষ্ঠত্বের জাতিরাষ্ট্র হয়।

Supremacist বা শ্রেষ্ঠত্ববাদিতাঃ
সারা দুনিয়ায় আমিই সুপ্রীম বা শ্রেষ্ঠ এমন শ্রেষ্ঠত্ববাদি [Supremacist] – এই চিন্তার প্রাবল্য জেগে উঠা দেখেছিলাম আমরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালে জর্মান, ইটালি ও জাপানের মধ্যে যার প্রধান ভোকাল নেতা ছিলেন হিটলার।  আমার জাতটা শ্রেষ্ঠ এই জাতগর্ব বা রেসিজম [Racism] – এই হল সমস্যা ও সংঘাতের শুরুর ভাষ্য বা মিথ্যা সাফাই।  কারণ এরপরেই বলা হবে যে আমিই শ্রেষ্ঠ অতএব তাই আমার কথা তোমাকে শুনে চলতে হবে, আমার অধীনতা মানতে হবে, আমি তোমাকে পুড়িয়ে মারব, গ্যাস চেম্বার করব, তোমাকে কলোনিদখল করব ইত্যাদি। অনেক সময় আবার এই জাত বলতে নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব যেটা হিন্দু বা মুসলমান বা অন্যকোনটা হতে পারে অথবা ‘গায়ের রং’ যেমন হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট বা সাদা শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার – ইত্যাদি হয়ে পারে। এগুলো আমরা কমবেশি দেখেছি বা পরিচিত।
কিন্তু সাবধান – কেউ হিন্দু মানেই সে রেসিস্ট বা শ্রেষ্ঠত্ববাদি (হিন্দুত্ববাদী) হবেই এমন নিশ্চিত ধরে নেয়াটা খুবই ভুল হবে। কারণ নাও হতে পারে। েকইভাবে, কেউ মুসলমান মানেই সে রেসিস্ট নাও হতে পারে। পাকিস্তানি পাঞ্জাবী মানেই সেও ব্যক্তি হিসাবে রেসিস্ট নাও হতে পারে। উলটা আমি বাঙালি জাতিবাদি এই ভাব ধরে যখন পাকিস্তানিদের “পাকি” বলে ডাকব – এটাই রেসিজম হবে। তাহলে মূল কথাটা হল কেউ কী করে নিজেকে  প্রেজেন্ট বা হাজির করছি, কী দাবি করছি;  বিশেষ করে দলবদ্ধ হয়ে বা রাজনৈতিক দিক থেকে  – এর উপরই নির্ভর করবে  কেউ  শ্রেষ্ঠত্ববাদি বা রেসিস্ট কিনা।  এই বিচারে  আরএসএস-বিজেপির হিন্দুজাত শ্রেষ্ঠত্ববাদ বা রেসিজমের দল যারা এখন ভারতে ক্ষমতায়।  আর লক্ষ্য করেন, চেক করে দেখেন সেখানে শ্রেষ্ঠত্ব – আমিই শ্রেষ্ঠ, আমারটাই শ্রেষ্ঠ ইত্যাদি ধরণের ভাব বা ধারণা আছে কি না? যদি থাকে তবে অন্যকে নিন্দা করার আগে নিজেকে সংশোধন করে নেন। অনেক সময় আমরা না-বুঝে, না খেয়াল করে অসচেতনে অনেক কিছু করে বসি।

আবার আরেক চিহ্ন হল,  রেসিজমের মধ্যে –  শ্রেষ্ঠত্ব, মহান বা বেস্ট এসব শব্দ বা ধারণা থাকবেই। ফলে এখান থেকে বের হতে হবে বা এড়িয়ে থাকতে হবে আমাদের।  বিশ্বযুদ্ধের পরে জাতিসংঘের জন্মের ভিতর দিয়ে এই প্রথম আইডিয়া বা  বয়ান হিসাবে শ্রেষ্ঠত্ববাদ বা রেসিজমকে ক্রিমিনাল অপরাধ মনে করা হইয়েছে আর তা বলা বাহুল্যই  নিন্দনীয় করা হয়েছে। কিন্তু তবু ব্যবহারিক চর্চায় মনের কোণায় ছোট রূপে হলেও তা এখনও থেকে গেছে শুধু না, তা আরো  প্রকাশ্য হবার চেষ্টা অনেক প্রবল হয়েছে। যার পিছনের মূল কারণ মনে করা হয় যে সময়টা এখন  -“গ্লোবাল সিস্টেমে নেতৃত্বে পালাবদলের”।  সারা দুনিয়া এতদিন বেশিরভাগ সময়েই বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবেই জনবসতি বা সিভিলাইজেশনগুলো শাসিত ও পরিচালিত হয়ে এসেছে। কেবল শেষ প্রায় পাঁচশ বছর বলা যায় কলোনিদখল সুত্রে দুনিয়া পশ্চিমের সিভিলাইজেশনের অধীনে সংগঠিতভাবে অধীনস্ততা চলে গেছিল।  এরই ভিতর আবার য়ারও শেষের ইমিডিয়েট ৭৫ বছর তা দুনিয়ার আমেরিকান গ্লোবাল নেতৃত্বে কেটেছে। আর এটাতেই পালাবদল আসন্ন হয়ে উঠেছে। কিন্তু এতে  বদল অনিবার্য জেনেও পুরানা শাসনের সুখ যাদের ছাড়তে ও নতুনকে মেনে নিতে ইচ্ছা করছে না এদেরই একটা অংশ এক সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদ আকড়ে উঠে দাড়াতে চাইছে। পুরানা গল্পের উস্কানি  – যে আমাদের কতকিছুতে শ্রেষ্ঠত্ব ছিল – এই কথিত অতীত মহান, গ্রেট, বেস্ট এসব শব্দ দিয়ে – এক শ্রেষ্ঠত্ববাদ খাড়া করার জন্য তারা প্রাণপণ চেষ্টা শুরু করেছে। যদিও তারা জানে কারণ আমেরিকান সরকারি গবেষণার সবগুলো ফাইন্ডিংসই (২০০৮ থেকে সর্বশেষ ২০২১ সালেরটা) তাদের জানিয়েছে এই পালাবদল অনিবার্য অবশ্যই কিছুই তারা ঠেকাতে পারবে না কারণ এই পরিবর্তন অবজেকটিভলি নির্ধারিত। সাবজেক্ট বা মানুষের নিয়ন্ত্রণে আর নয়।  কিন্তু তবু মরিয়া হয়ে সাময়িক বিশৃঙ্খলা তৈরিতে কেউ কেউ এগিয়ে আসা বন্ধ করে নাই।

কেন বিজেপির হিন্দুত্ব বা এক হিন্দু-ভারতের কথিত এক জাতিরাষ্ট্র গড়তে ব্যর্থ হবে?
এর মূল ব্যবহারিক সমস্যাটা হল,  ভারতের সব রাজ্যের বাসিন্দারা শ্রীরামকে তাদের প্রধান দেবতা মানে না বা তাকে ঘিরে প্রধান দেবতাপূজা বা প্রধান উৎসব উদযাপন করে না। যদিও আবার শ্রীরামকে তারা অমান্য করে ঠিক তাও নয়। অর্থাৎ প্রায় সব রাজ্যেই তাদের নিজস্ব ‘প্রধান দেবতা’ ও সে অনুযায়ী এক প্রধান বার্ষিক উৎসবও আছে। ফলে বাংলায় দুর্গা বনাম রামের একটা প্রধান ভিন্নতা আছে এবং এটা প্রধান বাস্তবতা। শুধু তাই নয়, মনে রাখতে হবে, এটা অন্য কারো দেবতাকে অমান্য করা এর মূল বিষয় নয়। কিন্তু নিজ ভাষা, নিজ শিল্পকলা, নিজ গাথাগল্প সাংস্কৃতিক এ ট্র্যাডিশনে অন্য কোনো রাজ্যের, ন্যূনতম অন্যের হস্তক্ষেপ বা আধিপত্য অথবা ডিকটেট, সামান্য চুল পর্যন্ত কোনো বদল আনা এরা একে অন্যের বেলায় বরদাশত করতেই পারবে না। কারণ এভাবেই তো ভারতে একেকটা রাজ্য স্ব স্ব ভিন্নতা নিয়ে হাজির ও ঐক্য হয়ে হাজির আছে। এভাবেই এরা একেকটা  ‘এথনিক-সাংস্কৃতিক’ অর্থে ভিন্ন ভিন্ন জাতি। যেমন, বাঙালি, উড়িয়া, গুজরাতি, মারাঠি রাজস্থানী  ইত্যাদি এরা ‘এথনিক-সাংস্কৃতিক’ জাতি। ঠিক যেমন কলকাতার বাঙালি ‘এথনিক-সাংস্কৃতিক’  জাতিবোধ নিয়ে তারা সবসময় নিজের মতো হয়ে থাকতে ও উঠতে চাইবে। অথচ সবাই মূলত হিন্দু হলেও এই কালচারাল গভীর ভিন্নতা এটাই বার বার বলছে   আরএসএস-বিজেপির রাজনীতি ভুল ও অকেজো অবাস্তব বলে তা ব্যর্থ হবেই। আর সবচেয়ে বড় কথা এটা অপ্রয়োজনীয়।
কিন্তু  তবু আরএসএস-বিজেপি  হিন্দুত্বভিত্তিক জাতিরাষ্ট্রের ভারত গড়ার জিদে আটকে থাকা দল, তারা এমন ভারত গড়ে নিজ একক রাজনীতি ও নিয়ন্ত্রণে ভারতকে আনবেই এই জিদের প্রচেষ্টার দল। তাই আরএসএস-বিজেপি বলা যায়, এই রাজ্য নির্বাচনকে এই প্রথম নিয়েছিল দুর্গার ওপর রামের আধিপত্য কায়েম করা যায় কি না এর উদ্যোগ হিসেবে। সেক্ষেত্রে মমতার দলের বিজয়ের তাৎপর্য হল, বাংলা তার দুর্গা আঁকড়ে ধরে বিজেপির হিন্দুত্ব এবং তার রাজনৈতিক ‘রামকে’ পরাজিত করল। এই অর্থে পুরনো আর্য-বাংলা ঐতিহাসিক লড়াইটা আবার বাংলা জিতে রিনিউ করে নিলো।

এ জন্যই এই নির্বাচন নিয়ে কলকাতার বিশ্লেষকরা বলছেন, এ নির্বাচনে কেবল তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকরাই তৃণমূলকে ভোট দেননি। অর্থাৎ তৃণমুলের  হিন্দু-মুসলমান সমর্থকেরা  মিলেই কেবল তৃণমূলকে ভোট দেননি। এর সাথে আরো আছে বাঙালি অর্থে কংগ্রেস, কমিউনিস্ট; এমনকি বিজেপির সমর্থকদের একটা বড় অংশ যারা নিজ দল ছেড়ে মমতাকে মানে ‘এথনিক-সাংস্কৃতিক’ বাঙালির পক্ষে ভোট দিয়েছে। এই বিশ্লেষকদের দাবি এটা হয়েছে বলেই মমতার পক্ষে মোট প্রায় ৪৮.৫% ভোট পড়েছে দেখা যাচ্ছে। যেমন আনন্দবাজার লিখেছে, “দুই তৃতীয়াংশের বেশি আসন প্রাপ্তি এবং ভোট শতাংশের হিসেব কষে নির্বাচনী বিশ্লেষকদের একাংশের ব্যাখ্যা, বাম, কংগ্রেস এবং বিজেপি-রও একটা অংশের সমর্থন গিয়েছে মমতার ঝুলিতে”।
এবারের নির্বাচন তাই হয়ে দাঁড়িয়েছিল বিজেপির হিন্দুত্বের আধিপত্যের কাছে নত না হওয়া বরং, হিন্দু-জাতিরাষ্ট্র গড়ার প্রপাগান্ডায় কলকাতার বাঙালিদের সেই পাল্লায় না পড়া। তারা নিজ বাংলা এথনিসিটির অর্থে জাতি রক্ষার লড়াইয়ে রাজনৈতিক শ্রীরামকে পরাজিত করতে এগিয়ে এসেছিল। এই অর্থে বাংলার সাথে লেপ্টে লেগে থেকেছে, তাকে ছেড়ে যেতে রাজি হয়নি। অথচ ব্যাপারটা হলো, বিজেপির ভাষ্যের এক আর্য-হিন্দির রাজনৈতিক ‘রাম’-এর ভিত্তিতে জাতিরাষ্ট্র; এ নিয়ে জোরাজুরি করাতেই মমতার জন্য অনেক কিছুই সহজ হয়ে যায় রাজনৈতিক ‘রাম’কে হারানো।

কিন্তু একারণেই আবার অনেকেই আশঙ্কা করছেন এখন; অনেকে বলছেন এটাই বিজেপির হামলার শেষ নয়। আরএসএস-বিজেপির স্টাইল এভাবে হার স্বীকার করে নেয় না। প্রতিশোধ নিতে তারা ফিরে আসে। সাধারণত এরপর আসে মুসলমান হত্যা-নিপীড়নের হুজুগ নিয়ে। মুসলমান নির্যাতন, দাঙ্গা হত্যা নিপীড়ন করা খুবই সহজ – এই সুযোগ নিয়ে তারা কৌশল সাজিয়ে আসে। কারণ দেখা যায়, আরএসএস-বিজেপির একটা স্থির ধারণা হল যে, ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গায় এক চরম মার-হত্যা-নিপীড়ন দাঙ্গা ঘটানো- এই ‘ভয়ের রাজনীতি’ কায়েম করা তাদের হিন্দু শ্রেষ্ঠত্বের জিগির তোলার উস্কানি ও সাংগঠনিক শ্রীবৃদ্ধির প্রধান অস্ত্র ও উপায়। এটা তারা বিশ্বাস করে থাকে। তাই যখনই ভোটে পরাজয় হয় তখনই তারা এ কৌশলের কথা চিন্তা করে। কারণ নিজেদের পরাজয়ের হতাশাকে তারা প্রতিহিংসা দিয়ে পূরণ করে এগোনোকেই সঠিক কৌশল মনে করে।

ঠিক যেমন সর্বশেষ দিল্লির রাজ্য নির্বাচনে সেটাই আমরা দেখেছিলাম। সে সময় নাগরিকত্ব ইস্যুতে দিল্লির নির্বাচনে মুসলমানরা অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টিকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করলে এরপরে দিল্লিতে মুসলমান পাড়াগুলোতে পরিকল্পিতভাবে দাঙ্গা ও হত্যা, তথা ম্যাসাকার হয়েছিল। দিল্লির কোর্ট-হাইকোর্ট আজো সেসব মামলায় কোনো প্রতিকার করতে পারেনি। অথচ মূল নেতা ‘মিশ্র’ সব ধরাছোঁয়ার বাইরে আছেন। বাংলায় মমতার বিজয়ের পরে এ হামলা হবেই এমন বলার কোন মানে নাই; তবে এটা হবেই না – তা বলাও অবশ্যই ভুল। বরং সব দিকে সচেতন ও সোচ্চার থাকাই সঠিক কাজ।
কিন্তু বাংলাদেশে একটি ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে ‘কেন্দ্রীয় শাসনের হস্তক্ষেপ’ চেয়ে চার-পাঁচজনের একটা গ্রুপকে মানববন্ধন নামে দাড়াতে দেখছি আমরা। অনেকটা ‘হিন্দুদের জন্য হিন্দুরা’- টাইপের যুক্তিতে এসব আজব দাবি; যেখানে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে বাংলাদেশের কেউ কোনো পক্ষের নয়। তাই কলকাতার আরএসএস-বিজেপি ঢাকায় এসে ব্যানার নিয়ে জাতীয় প্রেস ক্লাবে দাঁড়ানো – এগুলো অবশ্যই কোনো ভালো লক্ষণ নয়। ফলে অবিলম্বে সরকারের এ বিষয়ে সতর্কতা, পদক্ষেপ নেয়া ও নজর দেয়া উচিত। কারণ সবশেষে এরা সবাই সংখ্যালঘু অজুহাতে ভিকটিম সেজে নিজেদের সব আকাম কাজের দায় চাপাবে আমাদের সরকারের উপরেই!

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের অভিনন্দনঃ
এদিকে আমাদের প্রথম আলোর দিল্লি সংবাদদাতা সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, “পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের বিপুল জয়ের পর দলনেত্রী ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পাঠানো বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের অভিনন্দন বার্তা যথেষ্ট আগ্রহ সঞ্চার করেছে। কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক মহলের একাংশ মনে করছে, মোমেনের ওই চিঠি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ও শাসক দলের অনুসৃত নীতির বিরুদ্ধেও এক প্রচ্ছন্ন বার্তা”। কিন্তু তিনি লিখেছেন এই প্রথম নাকি ভারতে “রাজ্যের নির্বাচনকে ‘ধর্মীয় আধারে’ করার চেষ্টা হয়েছিল। বিজেপি নেতারা ভোট প্রচারে নাকি সরাসরি ‘বিভাজনের নীতিকে’ প্রাধান্য দিয়েছেন”।
সরি, আপনার দাবি গ্রহণ করতে পারলাম না। প্রথমত, ‘বিভাজনের নীতিকে’ প্রাধান্য দেয়া অথবা ‘ধর্মীয় আধারে’ ভারতের রাজ্য নির্বাচন বিজেপির এটিই প্রথম নয়। কলকাতা তো বটেই এমনকি রাজস্থানের নির্বাচনেও বাংলাদেশের মুসলমানদের ভারতে অনুপ্রবেশের ভুয়া অভিযোগ তুলে ‘তেলাপোকা’ বলা হয়েছে। আজ হঠাৎ করে ঘুম থেকে উঠে দেখতে পাওয়ার মত অনুভব হতে পারে কারও; তবু এসব একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। বিজেপি কখনো কি লুকিয়েছে যে, সে প্রায়ই মুসলমানদের জন্য দাঙ্গা ও হত্যার আজাব হয়ে আসে না? তার দলের রাজনীতিই তো হল , হিন্দু শ্রেষ্ঠত্ব বা হিন্দুত্ব প্রতিষ্ঠা এবং ভারতের রাজ্যগুলোর সবাই প্রধান জনগোষ্ঠী হিসেবে সনাতন হিন্দু বলে পরিচিত হলেও বিজেপিসহ যেকোনো শ্রেষ্ঠত্ববাদী দলের এই কমন ফিচার হয় যে, তারা এক একক পরিচয়ে সবাইকে বাঁধতে চাইবেই – এক জাতশ্রেষ্ঠত্ব কায়েম করার চেষ্টা করবেই। যা এক পন্ডশ্রম যদিও! বিজেপি তো এগুলো লুকায় না! কিন্তু যাদের এসব নজরদারি করার কথা সেই নির্বাচন কমিশন বা ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এখানে নজর দিতে রাজি নয়। অথচ ধর্মীয় আধারে বা বিভাজনের নীতিতে ভোট চাওয়া – এটা বিজেপির জন্য দল নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ার মত কৃত অপরাধ, তবু  তা তারা করেই চলছে, অবলীলায়। এখন এসব রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের পরিচালকেরা খোদ নিজেদেরই যদি নিজেদের ভারতের নাগরিক নয়, হিন্দু হিসেবে আবিষ্কার ও গর্ব করে থাকেন ও চলেন তবে ভারতের কনস্টিটিউশনে কী লেখা থাকল তাতে কিছুই আসবে যাবে না। উল্লিখিত ব্যক্তিদের মত সাংবাদিকের চোখেও এগুলো কোনো বড় সমস্যা হিসেবে ধরা পড়বেও না।

উনি আরো লিখেছেন, কলকাতার “ভোটে বিজেপির বিপর্যয় ও তৃণমূল কংগ্রেসের বিপুল জয়ের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পাঠানো অভিনন্দন বার্তায় সেই স্বস্তির ছোঁয়া স্পষ্টতই পরিলক্ষিত। সেটাই রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক স্তরে আগ্রহ জাগিয়েছে”।
তাঁর এ’কথাতে বলা যায়, সেটা কলকাতায় যা হয় হোক কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন এ ছাড়া আর কী বলতে পারতেন? তবে তার অবশ্যই ভারতের কাছ থেকে কোনো কিছু আশা করার মত বোকামি করার কিছু নেই! আবার এতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রটোকলের যে ব্যত্যয় নেই তা তো কূটিল কূটনীতিক পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী মনে করেছেন আর নিজেই সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেন যে, ‘মোমেনের অভিনন্দন বার্তা কূটনৈতিক প্রটোকলের দিক থেকে নিখুঁত”। কাজেই এনিয়ে আমাদের কী আর বলার আছে!

মোদির বিজেপি ভারতে ক্ষমতাসীন আছে ও নির্বাচন করে যাচ্ছে সাত বছরের বেশি ধরে। তিনি যে ‘এক শ্রীরামের নামে’ [শুধু হিন্দু হলে হবে না] এমন এক পরিচয়ে ভারতের সব রাজ্যের হিন্দুকে নিয়ে হিন্দু জাতিরাষ্ট্র কায়েম করতে চান সেই মেরুকরণের চেষ্টা তিনি সবসময় করে চলেছেন। কিন্তু সাত বছর ধরে, দেব মুখার্জির মত অনেকেই ব্যাপারটাকে প্রশ্রয়ের চোখেই দেখে এসেছেন।

বরং এমন ভারতের সাংবাদিক, কূটনীতিক বা একাডেমিশিয়ানের বিরাট কুল – তাদের চোখে  মোদী এখন ‘বিরাট সফল নেতা’। কারণ এদের চোখে তিনি নাকি ভারতকে এক “পরাশক্তির প্রায় কাছাকাছি’ পর্যায়ে নিয়ে গেছেন বলে অনেকেই মনে করছেন। তাই সেই মোদী বাঙালির দুর্গার উপর ‘শ্রীরামের হিন্দুত্ববাদী’ চাপালেন কি না বা কোনো ‘ধর্মীয় বিভাজন’ টেনে ভোটের জোশ তৈরি করলেন কি না তাতে তাদের কী আসে যায়! বরং মোদী বলতে চেয়েছেন – ন্যায়-অন্যায় ইনসাফ বোধ এসব কোনো ভিত্তি নয়। বরং অন্যায়কারী হিন্দু হলেই সে আপনার ভাই, তার পাশে দাঁড়াতে হবে। এই হলো মোদীর আরএসএস-বিজেপির রাজনীতির ভিত্তি।
এতে মোদীর এই রাজনীতিতে যদি কলকাতায় একটি দাঙ্গা ও হত্যাযজ্ঞের আয়োজন করে ফেলতে পারে , তাতে বাংলাদেশের হিন্দুদের কোন স্বার্থটা উদ্ধার পাবে? নিজেকে রক্ষা পারবে কেন? কার দয়ায়? না, এ নিয়ে তাদের কোনো চিন্তা নেই। চিন্তা করতেই রাজি না। এছাড়া কোনো কেন্দ্র থেকে কোনো মোদি কি তাদের বাঁচাতে আসবেন? আর আমাদের সরকার এ-কোন মোদীর ভারতকে করিডোরসহ অসংখ্য সুযোগ সুবিধা খুলে দিবে যে কলকাতায় একটা দাঙ্গা ও হত্যার আয়োজন করতে চায়?

অতএব যেখানে বসে যে যা বলছেন তা চিন্তা করে দায়-দায়িত্ব নিয়েই মুখ খুলবেন – এটাই আমরা সকলকেই আগাম সতর্ক করতে পারি!

বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো এবং বাংলাদেশ পর্যবেক্ষক শ্রীরাধা দত্ত। যতটুকু শুনেছি এটা  আরএসএস-বিজেপির দল ও চিন্তা প্রভাবিত একটি থিংকট্যাংক। সেখানকার শ্রীরাধা বলছেন, ‘ভারতের অঙ্গরাজ্য হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের সাথে বাংলাদেশের এক আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে, যেখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতিই প্রধান বিবেচ্য।”
এসব মুখস্থ আপ্তবাক্য বা কথার কথা ভারতে অনেক লেখা হয়েছে। তাই এসব শুনলে আমাদের অস্বস্তি লাগে। পারলে বিজেপির ‘শ্রীরামের হিন্দুত্ববাদ’ অথবা ‘ধর্মীয় বিভাজন’ রাজনীতি- এর বিরুদ্ধে লিখে দেখান। পারলে পক্ষেও লিখতে পারেন। কিন্তু চুপ থাকবেন না। এ সময় লিপ সার্ভিস দিয়ে পরিবর্তন আসবে না যদিও বাংলাদেশে আমরা আপনাদের উপর আশা রাখি না। আপনাদের মোদীর ভারতরাষ্ট্র ‘শ্রীরামের হিন্দুত্ববাদ’ থেকে ‘ধর্মীয় বিভাজন’-এর রাজনীতি করে যাবে আর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সব আশা জিইয়ে রাখবেন এটা আর কত চলবে? বা চলতে পারে?  না, চলতে পারে না। এসব বুঝা কী খুব কঠিন!

‘পরাশক্তি’ ভারতঃ
এখন ভারতের সাংবাদিক, কূটনীতিক বা একাডেমিশিয়ানের এক বিরাট দল সব প্রসঙ্গ ছেড়ে এমন প্রচন্ড মোদীভক্ত হয়ে উঠেছেন যে দেখার মত! কেন? তারা কিভাবে মোদীভক্ত হয়েছেন? তাতেই বাকি সবাই নিজে নিজেই বুঝে যাবেন।
ভারতের এখন বিভিন্ন রাজ্যে করোনা মহামারীতে রোগীদের অক্সিজেনের অভাবে বহু লোকের প্রাণ যাচ্ছে। এছাড়া সরঞ্জাম বেড এমনকি মৃত সতকারে শ্বশানেও পর্যাপ্ত  জায়গা পাওয়ায়ো কঠিন হয়েছে। অর্থাৎ মোদী যে ‘সরকার চালাতে’ গিয়ে একেবারেই ব্যর্থ হয়ে গেছেন – এখানে এসে তা আর কারো থেকে তিনি লুকিয়ে রাখতে পারেননি। এ ব্যাপারটাকে ‘সরকার চালাতে’ না বলে ফরমাল ভাষায় বলা হয় ম্যানেজমেন্ট ফেইলিওর; যার চেয়ে দুনিয়ায় আর বড় ফেল বা পরাজয় নেই।

ভারতে গত ১৬ বছরের এক ভ্যানিটি বা অহমিকা ভারতের আমলা-রাজনীতিবিদরা চালু করে রেখেছিলেন যে যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগেও বিদেশী সাময়িক সাহায্যও নেয়া যাবে না। কিন্তু কেন কংগ্রেস-বিজেপিসহ সব আমলা-রাজনীতিবিদ সাহায্য না নেয়ার এমন জিদ করেছিলেন? মিলিয়ে দেখুন, ১৬ বছর মানে হলো ২০০৫ সাল থেকে। তার সোজা মানে হলো, বুশের আমলে ভারত যখন চীনের বিরুদ্ধে আমেরিকার থেকে ‘চীন ঠেকানোর’ ঠিকা পেয়েছিল, সে সময়ের সিদ্ধান্ত এটা। বাংলাদেশকে অ্যামেরিকার ভারতের হাতে  তুলে দিবার সিদ্ধান্তও এর একটু পরে ঘটেছিল। কিন্তু ভারত সিদ্ধান্ত নেয়, এ সুযোগে নিজেকে এক ‘পরাশক্তি’ হিসেবে অসত্য হলেও তুলে ধরবে, দেখাবে। তাই তারা ১৬ বছর আগে মুরোদে না কুলালেও দুর্যোগেও বিদেশী সাময়িক সাহায্য নেয়া নিষিদ্ধ করেছিল।
তা হলে এখন সে কথা কেন তুলছি?

কারণ অক্সিজেন সঙ্কটের শুরুতেই মোদি আর (সাহায্য না নেয়ার) ‘ফুটানিকা ডিব্বা’টা বহন করতে রাজি হননি কিংবা বলা ভালো এটাই তা ত্যাগের মোক্ষম সময় যে এই সুযোগে তিনি ভ্যানিটি ছেড়ে পালিয়ে বাঁচার সুযোগ নিয়ে ফেলেন। সে কারণের যেন মোদী এবার মোট ২০টি দেশের কাছ থেকে সাহায্য গ্রহণ করেন, যার মধ্যে চীন আছে। এমনকি ক্ষুদ্র ভুটানও।

আর এতেই তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে সাংবাদিক-ইন্টেলেকচুয়ালরা। এ নিয়ে তাদের মনোভাব সবচেয়ে ভালো পাঠ করা যায় দ্যা প্রিন্টে ছাপা এক আর্টিকেলে। ওর শিরোনামটাই তাদের চিন্তা পাঠ করার জন্য যথেষ্ট। ওই আর্টিকেলের শিরোনাম হল, ‘ভারত কি তৃতীয় বিশ্ব হয়ে ফেরত গেল? মশকরাটা হল, আমাদের পরাশক্তির আকাঙ্খাটা এভাবে কোভিডের হাতে পড়ে ন্যাংটা হয়ে গেল”  [Is India back to being ‘Third World’? Irony of an aspiring superpower exposed by Covid crisis]।

একই মনোভাব ‘দ্যাহিন্দু’র সুহাসিনী হায়দারের। তিনি প্রায় চ্যালেঞ্জের মত মোদিকে লিখেছেন তিনি কেন বিদেশী সাহায্য নিতে গেলেন? [Why has India accepted foreign aid after 17 years?]  এভাবে লিডিং সাংবাদিককুলের মধ্যে হতাশার ছায়া নেমে আসতে দেখছি আমরা।

মূল কথাটা হলো, মোদীর ‘শ্রীরামের হিন্দুত্ববাদ’ থেকে ‘ধর্মীয় বিভাজন’- এসব দিকের জন্য তারা মোদীকে কাঁধে বসিয়ে তুলে ধরতে কোনোই শরম বোধ করেন না। কারণ এই হিন্দুত্বের মোদী তাদের মিথ্যা হলেও পরাশক্তির স্বাদ চাটিয়েছে বলে মনে করে তাঁরা। এখন মোদী সেই মিথ্যা গর্ব বা ভ্যানিটিটা কেড়ে ফেলে দেয়ায়ই তাদের এত হইচই।

কাজেই হিন্দুত্ব কলকাতায় মার খেয়ে গেল কি না আর তাতে দিল্লির মত কলকাতার মুসলমান মারার উৎসব আসন্ন কি না!  না, এগুলো তাদের অ্যান্টেনার নজরে আসার যোগ্য হয়নি। এই জয় শ্রীরামের জয়জয়কার থেকে ভারতকে কে বাঁচাবে?

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

 

[এই লেখাটা  গত ০৮ মে  ২০২১, দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ওয়েবে ও  পরদিন প্রিন্টেও  “ভারত এখন তৃতীয় বিশ্ব ” – এই শিরোনামে  ছাপা হয়েছিল।
নয়াদিগন্তে ছাপা হওয়া লেখাগুলোকে আমার লেখার ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ বলা যায়।  আর আমার এই নিজস্ব সাইটের লেখাটাকে সেকেন্ড ভার্সান হিসাবে,  পাঠক থিতু ভাষ্য বলে গণ্য করতে পারেন। সেভাবেইপরবর্তিতে ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ লেখাটাকেই এখানে আরও অনেক নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে ও নতুন শিরোনামে এখানে আজ ছাপা হল। ]

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s