গ্লোবাল এম্পায়ারঃ কোয়াড বা টিকার ভালো-মন্দ বিচার
গৌতম দাস
১৭ মে ২০২১, ২২:১৯, ০০:০৬ মঙ্গলবার
চীন না আমেরিকা, আমাদের জন্য কে ভাল বা আমাদের কার পক্ষে থাকা উচিত বা আমার কাকে পছন্দ – এনিয়ে আমাদের ব্যক্তিগত আগ্রহ, লাভালাভ অথবা ভালো-মন্দ বিচারবোধ থাকতে পারে। কিন্তু এটা ব্যক্তিগত বা সাবজেকটিভ [subjective] বোধবিচার। কিন্তু এই ব্যাপারটাকে অবজেকটিভ [objective] ভাবে বিচার ও বুঝতে হবে, মানে সাবজেক্ট বা কর্তাসত্বা ভাবে নয়। কর্তা-মানুষের কাকে পছন্দ সে ভিত্তিতে ও দিক থেকে বিচার করে নয়। একটা ঘুর্ণিঝড় যেমন বাংলাদেশে কখন ও কোথায় আঘাত হানবে তা মানুষ জানে না। মানুষের হাতে তা নির্ধারিতও না। এমন ঘটনাগুলোকে অবজেকটিভ ঘটনা বলে। মানে সাবজেক্ট এর ইচ্ছার ভিত্তিতে না। আমাদের ইচ্ছার বাইরে প্রাকৃতিক ঘটনা দিয়ে বুঝতে হবে।
গ্লোবাল অর্থনীতিতে চীন বা আমেরিকার নেতৃত্ব অবস্থান কী হবে তা কোথায় দাড়াবে সেটা তাদের নিজেদের নেয়া স্ব স্ব নীতি-পলিসি অবশ্যই দায়ী। তবুও ব্যাপারটা এমন না যে আমেরিকা নিজের নেতৃত্ব অবস্থান ফাইনালি কী হবে কতটা স্থান কী ধরে রাখতে পারবে সেটা আমেরিকা চাইলেই রক্ষা করে ধরে রাখতে পারে। আবার চীন চাইলেই আমেরিকাকে নেতার অবস্থান থেকে ফেলে দিতে পারে তাও না। কারণ সবদেশেরই নীতি-পলিসি যাই নেয়া হোক না কেন এসবের বাইরে কিছু অবজেকটিভ ঘটনা উপাদান থেকেই যাবে যার প্রভাবে ফাইনালি সবকিছু নির্ধারিত হয় ও হবে যে কোন দেশের নেতাগিরি কতদিন ধরে সে ধরে রাখতে পারব আর কে নতুন উঠে আসবে। এই কারণে আমরা চীন বা আমেরিকা কাকে আমরা পছন্দ করব সেটা না। বরং চীন বা আমেরিকার গ্লোবাল নেতৃত্ব অবস্থান কতটা ধরে রাখবে বা পারবে তা নির্ধারণ হয় সেসব অবজেকটিভ ফ্যাক্টর দিয়ে সেগুলোকে আমলে নিতে ও খেয়াল করতে হতে হবে। তাই আমরা চীন পছন্দ করি নাকি আমেরিকা এই ভিত্তিতে কোন একটার পক্ষে ঝাপিয়ে পড়ার মানে হবে না। তবে স্বভাবতই কেউ যদি নিজেকে ভাড়াটে বা দালাল হিসাবে কারও পক্ষে নামতে চায় সেটা অন্য আলাপ আর তা তো ঠেকানো যাবে না।
তবে এ’প্রসঙ্গে বাংলায় “ভগ্নদুত” বলে একটা শব্দের সাথে পরিচিত করে দেয়া যাক। রাজার আমলে কোন যুদ্ধে পরাজয়ের খবর তো কাউকে না কাউকে বয়ে রাজধানীতে রাজার কাছে আনতেই হয়, হত। যে বয়ে আনে তাকে বাংলায় “ভগ্নদুত” বলে। পরাজয়ের খবরের বাহক বলে। কিন্তু রাজাসহ প্রায়ই মানুষ যা ভুল করে বসে তা হল যেন ভগ্নদুতই যুদ্ধে রাজার পরাজয়ের জন্য দায়ী! অথচ তা একেবারেই নয়। অনেকটা টিভি রেডিও তে যখন কোন আবহাওয়াবিদ এসে বিশাল দুর্যোগের পুর্বাভাস দেয় আর আমাদের শ্রোতাদের কেউ কেউ যখন ভেবে বসে ঐ দুর্যোগটাই নিশ্চয় ঐ আবহাওয়াবিদের তৈরি বা বানানো! কাজেই আবহাওয়াবিদকে গালমন্দ শুরু করে, এটা সেরকম! তবু ইতিহাসে ভগ্নদুতেরা অনেকেই খুন হয়েছেন রাজার ক্ষোভে!
কাজেই দেশে প্রো-আমেরিকান বা প্রো-ইন্ডিয়ানদের চোখে আমি ভগ্নদুত অবশ্যই। তাদের চোখে আমি যেহেতু গ্লোবাল নেতৃত্বের পালাবদলের কথা প্রায়শই তুলি ও বলি পুর্বাভাস দেই; আবার বলি যে অ্যামেরিকার পতন আর চীনের উত্থানের কথার নানান দিক…। যদিও আমি পুর্বাভাস দাতা, নেহাতই এক পলিটিক্যাল এনালিস্ট মাত্র।
আবার যেমন দেখেন আমি আমেরিকাকে হয়ত পছন্দ করি না তাই অ্যামেরিকার নেতৃত্ব হারাচ্ছে তা বলি এমন তো নয়। বরং নেতৃত্ব বা সক্ষমতা হারানো এগুলোই তো অবজেকটিভ ফ্যাক্টস। আর এর চেয়েও বড় কথা এই ফ্যাক্টস বা রিপোর্টগুলোর ৯০ ভাগ হল আমেরিকারই সরকারি স্টাডি গবেষণায় পাওয়া ও তাদেরই প্রকাশিত রিপোর্ট। কারণ আমেরিকান খোলা সমাজের কিছু সুবিধা তো আছেই, সেগুলো সহজেই পাওয়া যায়। আর চীনের সরকারি তথ্য খুব কমই পাওয়া যায়। যেটুকু পাওয়া যায় তা হংকং-কেন্দ্রিক বিভিন্ন ওপেন মিডিয়া। যা পশ্চিমা মিডিয়ার বিরুদ্ধে নিজেরা আগেই নতুন গ্লোবাল জগতে নাম কামিয়ে বসে পরতে চাইছে এরা।
কাজেই বাংলাদেশে বসে চীন বা আমেরিকানদের নীতির বিচার করতে হবে আমাদের আর তা অবশ্যই অবজেকটিভ চোখে, আমরা কাকে পছন্দ করি সে ভিত্তিতে একেবারেই নয়। একমাত্র তবেই আমরা চীন-আমেরিকা নিয়ে বিতর্কের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সহজ সমাধান পাওয়া যেতে পারি। আর যারা নিজেকে ভাড়াটে বা দালাল হিসাবে কারও পক্ষে নামতে চায়, তাদের নিয়ে এখানে বলার কী আছে!
গরিব-বড়লোকের টিকা বলে ভাগঃ
করোনার টিকা জিনিসটা শেষ পর্যন্ত গরিব-বড়লোকের টিকা হয়েই হাজির হয়ে গেল। আবার একই সাথে তা গ্লোবালি এক ভুয়া এম্পায়ার আর উপযুক্ত এম্পায়ারের দাবি হিসাবে হাজির হয়ে গেল।
গরিব-বড়লোকের টিকা বলতে সবমিলিয়ে দুনিয়ায় ব্যবহৃত টিকাগুলো হল, একদিকে ফাইজার [Pfizer], মর্ডানা [Moderna] আর জনসন [J&J]। অন্যদিকে – এস্টোজেনিকা [Oxford-AstraZeneca] , সিনোভ্যাক, Sinovac, সিনোফার্মা [Sinopharm], স্পুটনিক [Sputnik V] , কোভ্যাক্সিন [Covaxin] ইত্যাদি।
এর মধ্যে প্রথম তিনটা – মানে ফাইজার, মর্ডানা, জনসন হল বড়লোকের টিকা। কারণ এর দাম অনেক বেশি আর এর চেয়েও বড় কথা হল এর সংরক্ষণের তাপমাত্রা আমাদের মত দেশে বজায় রাখা খুবই কঠিন। এদের দাম ২০ থেকে ৩৩ ডলারের মধ্যে। আর সংরক্ষণ তাপমাত্রা (-১৫) থেকে (-৮০) ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে। যেখানে গরিব গোত্রের টিকাগুলোর প্রায় সবই ৪ ডলারের নিচে আর সংরক্ষণ তাপমাত্রা ২-৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড।
সাধারণের বুঝার ভাষায় বললে, বাসায় আমরা যে ধরণের কমন ফ্রিজ ব্যবহার করি (ডিপফ্রিজ না) সেটাই গরীবের ভ্যাকসিনগুলো সংরক্ষণের জন্য যথেষ্ট। আর বড়লোকের ভ্যাকসিন আমাদের মত দেশে যেখানে গরমের সময় তাপমাত্রা +৪০ ডিগ্রি[] পর্যন্ত উঠে যাওয়ার সম্ভাবনা সেখানে সংরক্ষণ কঠিন। তাই বড়লোকের কোন ভ্যাকসিন আমরা বিনা-পয়সায় পেলেও তা ঢাকাতেই ব্যবহার প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে। [এখানে ভ্যাকসিন বিষয়ে তথ্যগুলো বিবিসি বাংলার ১০ এপ্রিলের আর ১৪ জানুয়ারির দুটি রিপোর্ট থেকে নেয়া ]।
তাহলে এটা পরিস্কার যে, আমাদের মত দেশকে এস্টোজেনিকা, সিনোভ্যাক, সিনোফার্মা, স্পুটনিক, কোভ্যাক্সিন – এসব গরীবদের টিকার মধ্যেই থাকতে হবে। এর মধ্যে এস্টোজেনিকা যুক্তরাজ্যে আবিস্কার হলেও এর ফর্মুলা ভারতে এনে তৈরির ফলে এর সস্তা ভার্সান কোভিশিল্ড পাওয়া যায়, যা বাংলাদেশকে বিক্রি করেছিল ভারত এবং এজন্য তারা আগাম বিনিয়োগ হিসাবে টাকা নিয়েও এখন আর টিকা দিচ্ছে না। আগামিতেও দেয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
এখানে স্বভাবতই ভারতে উতপাদিত এস্টোজেনিকা [Oxford-AstraZeneca] অথবা কোভ্যাক্সিন [Covaxin] কে প্রাপ্যতার তালিকা থেকে বাইরে রাখতে হল কারণ ভারতের পক্ষে বিদেশে কাউকে টিকা সাপ্লাই অসম্ভব। এখন তারা উলটা বাইরে থেকে টিকা আনার প্রচেষ্টা শুরু করেছে।
এরপরে, সিনোভ্যাক, সিনোফার্মা এ’দুই টিকা চীনের তৈরি। দুটোই হু-এর [WHO] নোটিশ বোর্ডে ৭৮-৯০% পর্যন্ত কার্যকর দেখা যায়। যার মধ্যে সিনোভ্যাক এর কার্যকারিতা পরে ব্রাজিলে কমে গিয়ে ৫০.৪% হয়েছিল দেখা গেছে, তবে ব্লুমবার্গ ইন্দোনেশিয়ায় দেখা গেছে ফলাফল ৯৪-৯৮%, চিলিতে ৬৭% কার্যকারিতার কথা জানায়। আর সিনোফার্মা [WHO] হু-এর তালিকায় ৭৯% কার্যকর হিসাবে উল্লেখ আছে এখনো। আবার, ল্যানসেটে রাশিয়ান স্পুটনিক এখনো ৯১% কার্যকর বলে উল্লেখ রয়েছে।
খারাপ খবর হল ভারতের অপর টিকা কোভ্যাক্সিন ৭৮% পর্যন্ত কার্যকর দেখালেও এটা তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল শেষ হবার আগেই বাজারজাত শুরু করেছে বলে অভিযোগ আছে বিবিসির রিপোর্টে। দেখেন [What was the controversy around Covaxin?] এই শিরোনামের অংশটা পড়তে পারেন।
তার মানে দাঁড়ালো দুনিয়াতে অন্য যত ভ্যাকসিন আবিস্কৃত হয়ে থাকুক না কেন, বাংলাদেশের জন্য “পাওয়া সম্ভব” এবং “উপযুক্ত” ভ্যাকসিন বলতে বাকি থাকল চীনা সিনোভ্যাক, সিনোফার্মা (এটা বেশি উপযুক্ত) আর রাশিয়ান স্পুটনিক।
এদিকে আবার ‘পাওয়া সম্ভব’ আর ‘উপযুক্ত’ হলেও আরো কথা আছে। তা হল, কিনতে আমাদের অর্থনৈতিক সামর্থ আছে কিনা? কতটুকু? এছাড়া যদি নিজে দেশে উৎপাদন করে নিতে হয় সে মুরোদ (বিনিয়োগ ও টেকনিক্যালিটি) কতটা? এসব ক্ষেত্রে তাহলে কী হবে? সে প্রসঙ্গের আগে একটা কথা।
এম্পায়ার (empire):
এম্পায়ার (empire) ধারণাটা এ প্রসঙ্গে বুঝা জরুরি। ইংরাজিতে এম্পায়ার (empire) বলে একটা শব্দ আছে যার মূল বা রুট অর্থ হল – এক বিরাট ভুখণ্ড বা কয়েকটা দেশজুড়ে ভুখণ্ড তবে যা কোন একক শাসকের অধীনে পরিচালিত। বাংলায় এটাকেই আমরা ‘সাম্রাজ্য’ শব্দ দিয়ে চিনি। তবে এই শব্দ দিয়ে যেমন অটোমান সাম্রাজ্য (১২৯৯-১৯১৮) থেকে শুরু করে রাশিয়ান জার সাম্রাজ্য (১৭২১-১৯১৭), ব্রিটিশ সাম্রাজ্য (১৬০০-১৯৪৫) ইত্যাদি চিহ্নিত করার পাশাপাশি অনেকে বিশেষত কমিউনিস্টরা আজকের আমেরিকাকে (১৯৪২-চলমান) ‘সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা’ বলে থাকে। যেখানে সাম্রাজ্য শব্দের সবখানেই মুল কমন বৈশিষ্ট্য বা মানে হল, কয়েকটা দেশজুড়ে বা বিরাট ভুখণ্ড যাতে পরিচালিত হয় একক শাসন কর্তৃত্বে। যদিও কমিউনিস্টদের সাম্রাজ্যবাদ মানে এসবের উপরে আরো অনেক কিছু। আমাদের মত দেশে ক্যাপিটালিজম আর স্বাধীন মত হবে না; যারা আগে যেসব দেশ ক্যাপিটালিজম স্বাধীনভাবে বিস্তার করে নিবার সুযোগ নিয়েছে তাদের বাধার কারণে – ইত্যাদি আরো অনেক কিছু। তবে ১৯৪২ সালের পর থেকে দুনিয়ায় সাম্রাজ্য বলতে কমন ধারণাটায় বদল আসতে থাকে। জাতিসংঘ জন্ম নিবার পরের জমানায় পুরান সাম্রাজ্যগুলোর কেউ নিজেকেই আর সাম্রাজ্য বলে দাবি করে না বা ডাকে না। কেবল কমিউনিস্ট নথিপত্রে আভ্যন্তরীণভাবে আমেরিকাকে সাম্রাজ্যবাদী ডাকার দলিল থাকতে পারে। বর্তমানে কেউ অন্তত আর সরাসরি অন্য দেশ গিয়ে বসে সাম্রাজ্য (বা সাম্রাজ্যবাদী) শাসক বলে দাবি করে উপস্থিত হয়ে শাসন করা বন্ধ হতে গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এমন রাজনৈতিক ভিত্তির উপরেই লড়া হয়েছিল তাই।
যেমন ১৯৪২ সালের (জাতিসংঘের জন্ম ঘোষণা ১জানুয়ারি ১৯৪২) আগের শাসনগুলো ছিল মূলত কলোনি-দখলি শাসন আর ওদেশের অর্থনৈতিক উদ্বৃত্ব সম্পদ ওদেশ থেকে লুট করে শাসকের দেশে পাচার করা বুঝাত। ১৯৪২ এর পর থেকে বিশেষত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষের পর সেই সুযোগই আর বাস্তবে থাকেনি। কারণ কলোনি- দখলি শাসন আইনত নিষিদ্ধ হয়ে যায়।
তবে ১৯৪৫ সালের পরে মূলত প্রত্যেকটা দেশ কলোনিমুক্ত ইন্ডেপেন্ডেন্ট স্বাধীন রাষ্ট্র ধরে নিয়ে তাদের পরস্পরের মধ্যে দুনিয়াজুড়ে এক বাণিজ্য বিনিময় সম্পর্ক শুরুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, যেটা একেবারেই নতুন এক দুনিয়া তৈরি করে আর এরই এক “গ্লোবাল ইকোনমিক অর্ডার” বা নিয়ম শৃঙ্খলা চালু হয়েছিল। এটা আমেরিকার নেতৃত্বেই চালু হয়েছিল এবং এখনও আছে প্রায় ৭৫ বছরের বেশি সময় ধরে আমেরিকার নেতৃত্বে আধিপত্য কিন্তু এখন যা আবার ঢলে পড়ার শেষের দিকে। কারণ আমেরিকার হারানো প্রভাবের জায়গা দখল করার উপযুক্ত হয়ে উঠে আসছে চীন।
সে যাক, কিন্তু ১৯৪৫ সালের পরের আমেরিকান নেতৃত্বের গ্লোবাল অর্ডারের মধ্যে গরিব দেশগুলো কলোনিমুক্ত অর্থে স্বাধীন হয়ে যায় বটে কিন্তু নিজ নিজ অর্থনীতি কার্যকরভাবে চালানোর উপযুক্ত অর্থে স্বাধীনভাবে তারা টিকে থাকতে পারছিল না। যোগ্য ছিল না। এর মূল কারণ, আগের দু’শ’ বছর ধরে যেমন বাংলাদেশের মত দেশ থেকে এমন সম্পদ লুট আর পাচার হয়েছে যে তার কিছু অংশ অন্তত কোনো শর্তে আবার ফিরিয়ে না আনতে পারলে এসব স্বাধীন দেশ অর্থনীতি জাগবে না; বরং না খেয়ে মরার অর্থনৈতিক দশায় পড়েছিল। সেসব শর্তেরই সাধারণ দিক হল কিছু সুদে আগের পাচার হওয়া অর্থই যেন ফেরত এনেছিলাম আমরা। আমরা একা নই এটাই নতুন গ্লোবাল ইকোনমিক অর্ডার। এছাড়া আমরা যতটুকু তাদের / আমাদের জন্য অর্থনৈতিক ভাবে সচল হব যতটা তাদের পণ্য ও বিনিয়োগ কিনতে চাহিদা তৈরি হবে ততটাই তাদেরও বিরাট লাভ। ফলে আমাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর তাগিদ তাদেরও বা তাদেরই কম ছিল না। আর এ কাজেই ওসব অনুদান বা প্রায় না সুদের ঋণের আয়োজন। আর এতে প্রধান ও প্রায় একক বিরাট ভূমিকা রেখে এসেছে আমেরিকা।
গ্লোবাল এম্পায়ার আমেরিকাঃ
আমেরিকার এই ভূমিকাটা্র একটা মন্দের ভাল দিক আছে। ফলে আমরা একে মন্দের ভাল বলতে পারি। তবে কথাটাকে এভাবে বলতে হবে যে, এটা গরিব দেশকে সাহায্য করতে, তাদের একটা ভায়াবল অর্থনীতির গড়ে দিবার জন্য করা আমেরিকান বিনিয়োগ – না ঠিক এতটুকু তা নয়। এটা উলটা, মূলত আমেরিকার হাতে জমে যাওয়া বিনিয়োগহীন বিপুল উদ্বৃত্ব সম্পদের হিল্লা করার জন্য, গরিব দেশে বিনিয়োগের সুযোগ খুঁজে বের করা হয়েছিল। আর সেটা করতে গিয়ে আগে গরীব দেকে মুক্তি আর এরপর প্রায় না সুদে বা অনুদানে (আসলও ফেরত দিতে হয় না যেখানে) অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করা হয়েছিল। যাতে আমাদের অর্থনীতি যত সচল হবে ততই আমরা তাদের পণ্যের ক্রেতা হব। আমরা চাহিদাহীন বন্ধ্যা এক অর্থনীতি হয়ে থাকলে এতে আমেরিকা বা গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের বিরাট ক্ষতি। এছাড়া, অর্থনীতি যত বড় হতে হতে আরও সমৃদ্ধ হবে যাতে ন্যুনতম চার পার্সেন্টের উপরে সুদে বিনিয়োগ পাওয়ার যতই যোগ্য হব আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক ততই সব বন্ধ করে দিবে। সুতরাং অ্যামেরিকার লক্ষ্য যেন আমরা আরও বড় বড় বিনিয়োগ নেবার যোগ্য হই। তাদেরকে সরাসরি ব্যবসা বিনিয়োগ করতে দিতে পারি এমন যোগ্য অর্থনীতির দেশ হই। এভাবে সারা দুনিয়া জুড়ে গ্লোবাল বাণিজ্য বিনিময়, দুনিয়ার আরো কোণে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এই অর্থে আমেরিকার এই ভূমিকাটা মন্দের ভাল। কারণ আমাদের অর্থনীতি ক্রমশ তুলনামূলকভাবে ভাল হবার কিছু সম্ভাবনা এর ভিতর আছে। ফকির হয়ে থেকে ধুকে মরার চেয়ে। কমিউনিস্টদের শোষণতত্ব অনুসারে আমেরিকা যে শোষক এটা অবশ্যই এজন্য ভুলে যাবার দরকার নেই। কিন্তু আমরা কী সেজন্য আমেরিকাকে গালমন্দ করে, পেটে খিদা নিয়ে না খেয়ে বসে থাকব? ধুকে মরব? এটাও কোন কাজের কথা না। এতটুকু প্রাকটিক্যাল হওয়ার কথা বলছি। যাতে আমরা এই গ্লোবাল অর্থনীতির ভিতরে প্রবেশ করে অংশ হয়ে এর ভিতরেই আমাদের জন্য যেসব তুলনামূলক সুবিধা জেগে উঠতে দেখা যাবে সেগুলোর সুযোগ নিয়ে স্ট্রাগল করে উঠে এক ভায়াবল অর্থনীতিতে আসার চেষ্টা করব? এই হল সেই লড়াই। আর অবশ্যই আমেরিকান সম্পর্কে কমিউনিস্টদের শোষণতত্ব অস্বীকার বা না ভুলেই তা করা সম্ভব। দুর্ভিক্ষে না খেয়ে আটকে থাকা কোন কাজের কথা না! এককালের গরীব চীন আজকে দেবারেবল কিন্তু অবজেকটিভ সুযোগ পেয়ে কী অ্যামেরিকার উপর উঠে যেতে রুল করতে চাইছে না!
এখন এই যে আমাদের মত দেশের অর্থনীতিতে আমেরিকার (তার নিজের স্বার্থে) সাহায্য আমরা পাচ্ছি বা আমেরিকা সাহায্য করছে – এটাই আমেরিকার ‘ইতিবাচক এম্পায়ার ভূমিকা’। এই যে ১৯৭১ সালের পরে আমরা বিশ্বখাদ্য কর্মসুচি (WFP) খাদ্য সাহায্য নিয়ে টিকে বেচে ছিলাম এটা নিশ্চয় খারাপ হয় নাই। এখন WFP কে ফান্ড দিয়েছিল কে? এসব লিল্লাহ ফান্ডের প্রায় ৭০ ভাগ এখনও আমেরিকা যুগিয়ে থাকে। কেন? কারণ আপনি আমেরিকা গ্লোবাল নেতা মানে, আপনি অ্যামেরিকার উপর এক এম্পায়ারের দায়িত্ব আপনাতেই বর্তায়, বর্তাবেই। আপনি আমেরিকা তো নিজের জন্য প্রবল প্রভাবের সুবিধা তো নিবেনই। আমরা ঠেকাতে পারব না। কাজেই গ্লোবাল এম্পায়ারের দায় ভুমিকা – রোল প্লে করাই আপনার কাজ। আর আমাদের দিক থেকে এটাই মন্দের ভাল, গ্লোবাল নেতা ইতি ভুমিকা।
আবার দেখেন যেমন, আমাদের ১৯৮৮ সালের বন্যা। আমেরিকা প্রায় না সুদে বা কোনটা কম সুদে বা অনুদানে অবকাঠামো খাতে আরো ঋণ-বিনিয়োগ না করলে আমরা হয়ত সেই সময় বন্যার ক্ষতি থেকে উঠে আসতেই পারতাম না বা বিরাট কষ্ট হত, অথবা ঘুরে দাঁড়াতে দেরি হত। আবার আমেরিকার দিক থেকে ঐ নতুন অবকাঠামো খাতে ঋণ-বিনিয়োগটা সেসময় আরো না যোগালে তাদেরই আগের দেয়া কোন ঋণ-বিনিয়োগ আমরা ফেরত দেবার যোগ্য থাকতাম না হয়ত। তাই এটা ছিল আমাদের আগে তাদেরই বিরাট মৌলিক স্বার্থ।
এই হলো সেই “এম্পায়ারঃ কথাটার বিশেষ মানে। এম্পায়ার এর ভুমিকা কথাটা বুঝতে হবে ভাল করে। মানে অ্যামেরিকার সাথে সামগ্রিক নেতিবাচক সত্ত্বেও কিছু ইতিবাচক ভূমিকা, তবে সেটাও এম্পায়ারের স্বার্থেই। এটাই গত প্রায় ৭৫ বছরের আমেরিকার কিছু ইতিবাচক ভূমিকাও রেখে গেছে। এবং পরের গ্লোবাল নেতাকেই এই দায় নিতেই হবে। মানে এটাই আবার গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের নেতৃত্বে যখন পালাবদল ঘটে আর তাতে নতুন যে নেতা আসে তাকেই এই দান-অনুদানে খরচের দায় নিতে হয়। অর্থাৎ ইতিবাচক এম্পায়ার রোল নিতে হয়। চীন এখন সে রোল নিচ্ছে ক্রমশ।
ঠিক যেমন শুরুতে রাজাও খাজনা, ট্যাক্স, সেলামি বা পুণার্হ ইত্যাদি নানান নামে চাঁদা তোলে। কিন্তু প্রজাদের জন্য এর কোন অংশই রাজা ফিরে খরচ করে না। কিন্তু কোন সাম্রাজ্যের সম্রাট তিনিও আরও বেশি চাঁদা তুলেন হয়ত। কিন্তু ওর বিরাট অংশ তিনি সিভিল ইউটিলিটি মানে পাবলিকের জন্য রাস্তাঘাট, নিরাপত্তা বা পানির ব্যবস্থা নির্মাণ ইত্যাদিতে ব্যয় করেন। এজন্য এম্পায়ার রাজার চেয়ে অনেক বেশি কাম্য – তারা দু’জনেই জোর করে বসা শাসন ক্ষমতা হলেও এর মধ্যে মাত্রার পার্থক্য রয়েছে।
সার কথা হলো, পজিটিভ এম্পায়ারের ভূমিকা বলে একটা ব্যাপার আছে। গ্লোবাল অর্থনীতির নেতা আমেরিকা এতদিন সে দায় ও ভূমিকা পালন করেছে, অকাতরে অর্থ ব্যয় করেছে আরও সুবিধা পাবার জন্য। এখন তার গ্লোবাল নেতাগিরি ঢলে পড়লে নেতার সবার আগে যে সামর্থে টান পড়ে তা হল – এই ‘পজিটিভ এম্পায়ারের খরচ করার ভূমিকা’। আর ঠিক ততটাই যেন নতুন বা আসন্ন গ্লোবাল নেতাও ঐ ভূমিকাটা পালনের জায়গা নিতে যোগ্য হয়ে উঠে। অর্থাৎ চীন সেই ‘পজিটিভ এম্পায়ারের দায় ও ভূমিকা’ নেবার অনেক যোগ্য এখন!
কেন এম্পায়ারের কথা তুললামঃ
সারকথায় আমরা কেউ সাবজেকটিভ বা ব্যক্তি অর্থে আমেরিকাকে না চীনকে পছন্দ করি তাতে কিছুই যায় আসে না। আমেরিকাকে না চীন কাকে কার উপরে বেশি ভালোবাসি সেই সাবজেকটিভ বিচার এখন প্রসঙ্গের বাইরে তুলে রাখতে হবে, অপ্রাসঙ্গিক বলে। বরং এদের মধ্যে কে এখন ‘পজিটিভ এম্পায়ারের দায় ও ভূমিকা’ নেবার যোগ্য – এই ব্যাপারটা অবজেকটিভভাবে নির্ধারিত হচ্ছে। সেদিকটায় তাকাতে হবে। কে বেশি যোগ্য বা উপযুক্ত সেই অবজেকটিভ বাস্তবতাকে মানতে হবে, একমাত্র সেদিকে দিয়েই বাস্তবতা নির্ধারিত হবে। আমরা তা না করতে পারলে সেটা ভাঁড়ামো মানে আমাদের আমেরিকান (বগলে ভারতীয়) ভাঁড়ের দালালের ভূমিকায় নামা হবে।
তাহলে? বাংলাদেশে আমরা ব্যাপারটাকে কিভাবে বিচার করব?
দুনিয়া এখন কোভিড-১৯ ভাইরাসের কবলে পড়ে হাসপাস করছে। কে কতদিন আর কীভাবে বাঁচে তা অজানা। গ্লোবাল অর্থনীতি ক্রমশ দেবে গিয়ে ঢলে পড়ছে। গ্লোবাল অবকাঠামো ব্যাংকগুলো তা ঠেকাতে চেষ্টায় নানান উদ্যোগ নিয়েই যাচ্ছে। সবারই একই লক্ষ্য রিকভারি- মানে ক্ষতি সামলে আবার জেগে উঠার চেষ্টা। অর্থাৎ উল্টা ভাইরাসের উপরে আধিপত্য বিস্তার করা, অন্তত কিছু প্রতিরোধ ব্যবস্থা খাড়া করা।
এই কাজে প্রধান পদক্ষেপ, হা সেই পদক্ষেপ হতে পারে সোজা কথায় ব্যাপক হারে উপযুক্ত টিকা বিতরণ হতে পারে একটা প্রতিরোধ ব্যবস্থার জন্য প্রধান কাজ। কিন্তু গাফিলতি, অযোগ্যতা, পরিকল্পনায় মারাত্মক ত্রুটির কারণে বাংলাদেশে টিকাকরণে যতই দেরি হচ্ছে ভাইরাস ততই নিজেকে আরেক রূপ বা ভেরিয়েন্টে হাজির করার সুযোগে দুর্দমনীয় হয়ে উঠছে। অর্থাৎ দ্রুত ও একসাথে সবাইকে (অন্তত ৭০ ভাগ) টিকা দিয়ে শেষ করাই একমাত্র জিতবার পথ।
আর এখানেই গ্লোবাল নতুন বা পুরানা নেতার একটা ‘পজিটিভ এম্পায়ারের ভূমিকা’ নেয়ার আছে, যা খুবই গুরুত্বপুর্ণ। আবার তা আসলে একটা মাপক, কে দুনিয়ার যোগ্য নেতা। আর কার দিন ফুরিয়েছে। কারণ, প্রচুর পরিকল্পনার ব্যাপার এখানে আছে। আগে বিনিয়োগের প্রয়োজন। যেমন গবেষণায় বিনিয়োগের ব্যাপার তো আছেই। সেই সাথে এরপর ঐ লাইসেন্স নিয়ে উৎপাদন এবং সুষ্ঠুভাবে টিকা বিতরণে বিনিয়োগ ও টেকনিক্যালিটির একটা ব্যাপার আছে। এখন একটা ওপেন কোশ্চেন করা যাক! একাজে গ্লোবাল নতুন বা পুরানা নেতার একটা ‘পজিটিভ এম্পায়ারের ভূমিকা’ নেয়াতে কে বেশি যোগ্য?
প্রথমত, আগের ডোনান্ড ট্রাম্প তো নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে স্বীকারই করেননি যে এটা করোনা একটা মহামারি ও সমস্যা। মাত্র এবছরের শুরুতে বাইডেন ক্ষমতায় আসার পরে এটা আমেরিকানদের জন্যই প্রথম ও উপযুক্ত মনোযোগ পায়। মানে গ্লোবাল রোল দূরে থাক আমেরিকা আগে নিজ জনগণের প্রতিই ঠিকমতো মনোযোগ দেয়নি। বরং ভাইরাসকে দুনিয়ায় বিস্তার লাভ করতে যেন পরোক্ষে সাহায্য করেছে যেন!
এরপর বাইডেন, তিনি কথিত কোয়াডের মিটিং ডাকলেন। সদস্যরা সবাই বিশেষ করে ভারত লাফিয়ে উঠে এখানে কর্তা বা প্রধান নায়কের ভাব ধরল। চীনের বিপরীতে ভারত যেন গ্লোবাল নতুন নেতার একটা ‘পজিটিভ এম্পায়ারের ভূমিকা’ নেওয়ার বেশি যোগ্য – খামোখা এই ভন্ড হামবড়া ভাব নিয়েছিল ভারত। যে কখনও ক্যালকুলেটরই টিপে দেখে নাই ভারতের মোট জনসংখ্যাকে টীকাকরণ করতে সে নিজে কতটা মুরোদে সামর্থবান, যোগ্য। সে সভার শুরুর দিকে বাইডেন যতই পরিষ্কার করে বলার চেষ্টা করছিলেন তিনি মূলত দ্রুত কেবল আমেরিকান নাগরিকদেরকে টিকাকরণের জন্যই এসেছিলেন যাতে এখাতে জাপানি বাড়তি বিনিয়োগ নিয়ে ভারতের টিকা উৎপাদনের সক্ষমতা তিনি আমেরিকানদের জন্য কাজে লাগাতে পারেন। কিন্তু ততই চীনকে পরাজিত দেখানোর লোভে আর বাস্তব হোক না হোক চীনের চেয়ে ভারত যোগ্য দেখানোতেই দিল্লি চাপাচাপি শুরু করে। আর ভারত এর এক মুখরোচক নাম দেয় – ‘টিকা কূটনীতি’। যা অবাস্তব তো বটেই প্রয়োজনীয়ও ছিল না। শেষে বাইডেন মিথ্যা হলেও কোয়াডের হয়ে “এশিয়াকে টিকাদাতা” হিসাবে হাজির হবার মিথ্যা কথা দিয়ে রাজি বলার পরই কেবল ঐ সভা শেষ করতে পারেন।
অথচ আজকের বাস্তবতা হল, আমেরিকা ভারতের টিকা পায়নি বা নেয়নি। তবে বাইডেন নিজেই অন্যান্য উৎস থেকে টিকা সংগ্রহ বাড়াতে সক্ষম হন। আর এদিকে ভারত আমাদের দেশের বেক্সিমকোর মাধ্যমে ভারতীয় টিকা পেয়ে যাচ্ছে সাথে নগদ লাভও হচ্ছে এই মিথ্যা বাস্তবতা খাড়া করে। এতে আমাদের চীনা টিকা ও লাইসেন্স পাওয়া ভন্ডুল করে দিতে তারা সমর্থ হয়। কারণ আমরা লোভি হয়ে পড়েছিলাম। সময়মতো চীনকে সাড়া দিতে ব্যর্থ হয়েছিলাম। ভারত আমাদের টিকার সব সমাধান দিয়ে দিয়েছে আবার পকেটও ভরবে এই অবাস্তব চিন্তায় আমরা বাস্তব দুনিয়াটা উপেক্ষা করেছিলাম।
আর ওদিকে এখন ভারতের জন্য কঠিন বাস্তবতা হল, বিদেশের কাউকেই তার টিকা দেয়ার সামর্থ নেই। সেটা দূরে থাক। তারপরেও ভারতের নিজ জনগোষ্ঠির সবাইকে টিকা দিতে আগামি দু’বছরে পারবে কিনা সন্দেহ। যার মানে নিজ জনগোষ্ঠীকেই টিকাকরণ করতে ভারতের সামর্থ নেই। তাই ভারত ইতোমধ্যেই বাইরে থেকে টিকা আমদানির অনুমতি দিয়েছে। তাহলে এই ভারত আমেরিকা এবং বাংলাদেশসহ সারা এশিয়াকে টিকা কূটনীতিতে ছেয়ে ফেলার যে হুঙ্কার- এটা কেন দিয়েছিল? এতেই প্রমাণ হয়, গ্লোবাল নতুন বা পুরানা নেতার একটা ‘পজিটিভ এম্পায়ারের ভূমিকা’ নেওয়ার কাজটা ভারত কোনদিন বুঝেছে বলে আমাদের মনে করার কোন কারণ নেই। কেবল দুচোখ ভরে জ্বলজ্বল করা লোভ ছাড়া তাদের কোন মুরোদই নাই যেন!
তাহলে ওরকম পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কী করতে পারত? মানে টিকা বা টাকা ফেরত কোনোটাই না পেয়ে বাংলাদেশের তখন কোথায় যাওয়ার বাকি ছিল? আমেরিকার কাছে?
আগেই বলেছি, টিকা উৎপাদন গরিব-বড়লোক বলে ভাগ হয়ে আছে। আমেরিকায় উৎপাদিত টিকা বিনা পয়সায় দিলেও আমাদের কাজে লাগানো কঠিন। তবু, আমাদের প্রায় ১৩ লাখ একডোজ নেয়া গ্রহিতা বিপজ্জনক অবস্থায় আছে। কারণ ভারত তাদের জন্য দ্বিতীয় ডোজের টিকা দেয়নি, আবার কখনও দিবে সে সম্ভাবনাও নেই। আবার অন্য উৎস থেকে আমেরিকার হাতে প্রায় ৫ কোটি এস্টোজনিকা মানে আমাদের মত একই টিকা থাকার কথা জানা গেছে। তাই সেখান থেকে মাত্র ঐ ১৩ লাখ ডোজ আমরা চেয়ে আমরা অনুরোধ করেছিলাম কিন্তু আমেরিকাও এখনও কোনো সাড়া শব্দ করেনি।
তাহলে এখন চীন ভরসা ছাড়া আমাদের টিকা পাবার উপায় কী? এটাই সবচেয়ে কঠিন বাস্তবতা। আর এই দুরাবস্থায় আমাদেরকে ফেলে গেছে ভারত ও তার হামবড়া ভাব! অতএব টিকা পেতে হলে আমাদের আগের লোভ ও ভুল সিদ্ধান্তের জন্য চীনের কাছে গিয়ে সরি বলে আবার তাকে রাজি করানো ছাড়া উপায় কী ছিল? এছাড়া বিনিয়োগ ও টেকনিক্যালিটি ইত্যাদি সবকিছুতেই আমাদের ঘাটতি আছে। অর্থাৎ আমাদের এক মুরোদ ওয়ালা এম্পায়ার দরকার! আর ঠিক বিপরীতে চীনের সেই এম্পায়ারের দায় ও ভূমিকা নেয়ার সামর্থ আছে। এটাই বাস্তবতা।
আমাদের অনেকের মনে হতে পারে, আমরা স্পুটনিক টিকা পাবার চেষ্টা করতে পারি। এটাও বাস্তবতার খবর না নিয়ে কথা বলা। রাশিয়ার আর কাউকে টিকা উৎপাদন করে সাপ্লাই দিবার সক্ষমতা নেই। তাদের কারখানা ওভার অকুপায়েড মানে সক্ষমতা সব পূরণ হয়ে গেছে। এছাড়া ঐ টিকা দিতে পারলেও সে টিকার দাম পড়বে ১৫ ডলারেরও বেশি কারণ তাদের উৎপাদন খরচ বেশি। ভারতে দিতে চেয়েছে হাজার রুপিতে। এছাড়া কৌশলগত দিক থেকে চীন কোন দেশকে না করে দেয় তবে তাকে টিকা দিবার সিদ্ধান্ত রাশিয়া আর নিবে না। তাদের কৌশলগত পারস্পরিক সম্পর্ক এরকমই। আর রিয়েলিটি হল, আমাদের স্পুটনিক টিকা উতপাদনের লাইসেন্স পাবার নিশ্চয়তার প্রসঙ্গে, চীনের হাতে (চীনা সরকারি নিয়ন্ত্রণে চীনা প্রাইভেট কোম্পানি) বাংলাদেশে উৎপাদনের জন্য রাশিয়া সহজেই লাইসেন্স দিতে রাজি হবে। নইলে নয়। কাজেই আগামী চার মাস নিয়মিত চীনে তৈরি টিকার সাপ্লাই পাওয়া আর ঐ চার মাসের মধ্যে বাংলাদেশে নিজেদের অন্তত দু/তিনটা প্রাইভেট কোম্পানিকে টিকা উৎপাদনে যোগ্য করে সাজিয়ে দিয়ে তাদের দিয়ে বাংলাদেশের নিজ উৎপাদন যোগাড় ইত্যাদিতে চীনকে রাজি করতে পারলেই একমাত্র টিকা দ্রুত পাওয়া সম্ভব।
তাহলে সোজা কথা চীনের এই গ্লোবাল এম্পায়ার ভূমিকাটাই আমাদের জন্য কাম্য ও মুখ্য। এখন চীন যদি আমাদের কাছে বিনিময়ে নিশ্চয়তা চায় যে আগের মত আমাদের আবার পা পিছলাবে না? ভারত বা আমেরিকার কাছে লোভে ফাঁসবো না আমরা – চীন সেই গ্যারান্টি যদি চায় তাহলে কী হবে? এমনিতেই সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে চীন সে নিশ্চয়তা আমাদের কাছে চাইতেই পারে। এটা তার অধিকার।
এখন প্রথমত, বিচার করেন আমাদেরকে চীনের কাছে ফিরে হাত জোড় করে অনুরোধ করার ভূমিকায় দাঁড় করালো কে? ভারতে মিথ্যা আশ্বাস ও প্রফিটের শেয়ারের লোভ। আর সেই সাথে কোয়াড, টিকা কূটনীতি এসব মিথ্যা বোলচাল। অথচ গ্লোবাল নেতার একটা ‘পজিটিভ এম্পায়ারের ভূমিকা’ নেয়া- এই মুরোদ তো আমেরিকাসহ কোয়াডের কিছু করার নাই, আমরা দেখলাম না!
জাস্ট কল্পনা করেন। ঈদের পরের ঢাকায় আক্রান্ত লোকের সংখ্যা যদি বেড়ে যায়, সেইসাথে ভারতীয় ধরণের ভাইরাস যদি ছড়িয়ে যায়? এদিকে দেশে ইতোমধ্যে আমাদের টিকা পাওয়া লোকের সংখ্যা এখন যেখানে মাত্র দু-তিন পার্সেন্টের মত তখন ঐ পরিস্থিতিতে আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াব?
গত ১০ মে বিবিসি রিপোর্ট করেছে ‘কোয়াড’ এ বাংলাদেশের অংশগ্রহণ চীন ও বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে যথেষ্ট খারাপ করবে বলে চীন মন্তব্য করেছে। আমাদের অতিউৎসাহী প্রো-ইন্ডিয়ান-আমেরিকান লোকজন এনিয়ে আমেরিকার কাছে নালিশ নিয়ে গিয়েছিল। আর এতে আমেরিকান প্রতিক্রিয়া হলো ‘চীনের রাষ্ট্রদূত যে মন্তব্য করেছেন, তার ওপর নজর আছে যুক্তরাষ্ট্রের’। বাস এখানেই শেষ। মনে হচ্ছে না অ্যামেরিকার এম্পায়ার ভুমিকা দেখানোর কোন মুরোদ বা ইচ্ছা আছে। এতো দেখি নালিশ করে বালিশ পাবার মত ঘটনা! কাজের কাজ কিছু নাই। আমরা দেখতে চাই অ্যামেরিকার ইতি এম্পায়ার ভুমিকা? কোথায় সেটা? তাহলে আমরা টিকা পাব কী করে? সেটাব জবাব কী আমেরিকা বা ভারত অথবা দেশের এই অতিউৎসাহী প্রো-ইন্ডিয়ান-আমেরিকানদের আছে? এনিয়ে তাদের বক্তব্য কি? আমরা শুনি না।
ব্যাপারটা খেয়াল করেন! বাংলাদেশ চীনের কাছে ফিরে টিকা চাইতে যেতে হচ্ছে এমনই খারাপ অবস্থায় যখন চীনের কাছে আমাদের কোনো পজিটিভ ইমেজ নেই। কারণ আমরা চীনের আগের অফার কোন সদুত্তর ছাড়াই এর অবজ্ঞা, অপব্যবহার করেছি। কাজেই চীন আমাদের আগের আচরণের বিরুদ্ধে এবার নিশ্চয়তা তো চাইতেই পারে! একই ভুল কাজ করব না এর গ্যারান্টি তো চাইবেই!
আর এ ঘটনাকে চীনের রাষ্ট্রদুতের মন্তব্য বিবিসি রিপোর্ট করেছে এভাবে,
“এ ধরনের ছোট গোষ্ঠী বা ক্লাবে যুক্ত হওয়াটা ভালো না।
বাংলাদেশ এতে যুক্ত হলে তা আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক যথেষ্ট খারাপ করবে”।
আর প্রো-ইন্ডিয়ান-আমেরিকান লবিস্টরা এটাকে ব্যাখ্যা করছে ‘চীনা হুমকি’ হিসেবে। অথচ বিবিসির পুরা রিপোর্টে ‘হুমকি’ বলে কোনো শব্দই নেই। এর মানে এটা লবিস্টদের উস্কানি দেবার জন্য কিছু মিডিয়ার ব্যবহৃত নিজস্ব শব্দ ও ব্যাখ্যা। এবং কিছু বিশেষ মিডিয়া কোন রেফারেন্স ছাড়াই ইচ্ছামত ব্যাখ্যা দিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কথা বলে তা রিপোর্ট করে চলেছে।
আবার দেখি কেউ কেউ লিখছেন তারা নাকি বিস্মিত হয়েছেন। আর আসলে আমরা তাদের আচরণ দেখে বিস্মিত হচ্ছি। তারা টিকা পাবার কোনো পাল্টা উৎস বা প্রপোজাল কি দিয়েছে?
একমাত্র অবজেক্টিভ চোখেই কোয়াড, টিকা পাওয়া বিষয়ের ভালো-মন্দ বিচার করার মত যদি আমাদের অবশিষ্ট কিছু যোগ্যতা থেকে থাকে তবেই হয়ত আমরা এ যাত্রায় পার পেয়ে যেতেও পারি!
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
[এই লেখাটা গত ১৫ মে ২০২১, দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ওয়েবে “কোয়াড-টিকার ভালো-মন্দ বিচার” – এই শিরোনামে ছাপা হয়েছিল।
নয়াদিগন্তে ছাপা হওয়া লেখাগুলোকে আমার লেখার ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ বলা যায়। আর আমার এই নিজস্ব সাইটের লেখাটাকে সেকেন্ড ভার্সান হিসাবে আর থিতু ভাষ্য বলে পাঠক গণ্য করতে পারেন। সেভাবেইপরবর্তিতে ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ লেখাটাকেই এখানে আরও অনেক নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে ও নতুন শিরোনামে এখানে আজ ছাপা হল। ]