বাংলাদেশের পাসপোর্টঃ বাইডেনের গাজা কারেকশন


বাংলাদেশের পাসপোর্টঃ
বাইডেনের গাজা কারেকশন ও প্রায়োরিটির প্রেক্ষিতে

গৌতম দাস

২৬ মে ২০২১, ২১:৪৮  বুধবার

https://wp.me/p1sCvy-3yF

US President Joe Biden speaks with Representative Rashida Taib (D-Mich), and Representative Debbie Dingell (D-Mich)(R), as he arrives at Detroit, Metropolitan Wayne County Airport in Detroit, Michigan on May 18, 2021. (AFP)

বাংলাদেশ কী ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে? এটা এখন বাংলাদেশে সর্বত্র আলোচনার বিষয়। আলোচনা যেভাবে হচ্ছে, তাকে খারাপ সংবাদই বলতে হয়। আর  বিষয়ের ঠিক এদিকটাই  আমল করতে সরকার মারাত্মক ভুল করছে।

বাংলাদেশে এই ইস্যুতে প্রথম নিউজ করে ‘শেয়ার বিজ’ এই ফাইন্যান্সিয়াল নিউজ পত্রিকা। এটি তাদের ক্রেডিট অবশ্যই। কিন্তু একইসাথে ডিসক্রেডিটও। কেন? কারণ এ ইস্যুটায় প্রধান খবর জড়িয়ে আছে মুখ্যত দুটি আলাদা বাক্য। এক, নতুন পাসপোর্টে “এক্সসেপ্ট ইসরাইল” শব্দ দুটা লেখা নাই। আর দ্বিতীয় বাক্যটা হল, নতুন ই-পাসপোর্টে লেখা রয়েছে “দিস ই-পাসপোর্ট ইজ ভ্যালিড ফর অল কান্ট্রিজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড”।  মানে যার বাংলা করলে হয় – এই ই-পাসপোর্ট দুনিয়ার সব দেশ ভ্রমণের জন্য বৈধ”।
এখন এনিয়ে সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্যাখ্যা যেটা তারা সাথে ছেপেছে সেখানে আছে, “… তবে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে আমরা পাসপোর্টে এক্সসেপ্ট ইসরাইল শব্দ দুটি তুলে দিচ্ছি”। এভাবে ব্যাখ্যা ছাপাটা বিভ্রান্তিকর কাজ হয়েছে। বিশ্বাসযোগ্য তো হয়ইনি। কারণ এখন ‘এক্সসেপ্ট ইসরাইল’ শব্দ দুটি বাদ দেয়াতে অবশিষ্ট বাক্যটা হয়ে গেছে ‘এই পাসপোর্ট দুনিয়ার সব দেশ ভ্রমণের জন্য বৈধ’ – অথচ এটা নিয়ে সরাসরি কোনো প্রশ্ন করে মন্ত্রীকে সচেতন করে দেয়া যে সেক্ষেত্রে – এখন কথা রয়ে গেছে তাহলে এভাবে যে, “এই পাসপোর্ট দুনিয়ার সব দেশ ভ্রমণের জন্য বৈধ” –  মন্ত্রী কী তাই বুঝাতে চেয়েছেন? এই কথাটাতে মন্ত্রী প্রতিক্রিয়া জানা দরকার ছিল। কিন্তু শেয়ার বিজ বা অন্য কোনো মিডিয়ার দিক থেকে এই প্রশ্নটা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে করা হয়নি। আসলে সাংবাদিকেরাই যেন চেয়েছে যে মন্ত্রীরা যেমন দাবি করছেন যে তাঁরা কেবল দুটা শব্দ তুলে নিয়েছেন। ব্যাপারটা তা নয়। কথা ঠিক যে তাঁরা কেবল দুটা শব্দই তুলে নিয়েছে। কিন্তু তাতে বাকি বাক্যের অর্থ একই থাকে নাই।    একথা বলতেই হচ্ছে যে এতে থেকে যাওয়া বাকি শব্দ যে  – “এই ই-পাসপোর্ট সব দেশ ভ্রমণের জন্য বৈধ’ কথাটার সোজা মানে হয়ে গিয়েছে যে বাংলাদেশীদের জন্য ইসরাইল ভ্রমণও বৈধ। অথচ এটাই হলো সবচেয়ে বিপজ্জনক বক্তব্য।

আরো টু দা পয়েন্টে বললে এখন মানে হয়েছে, বাংলাদেশের ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত আছে, না নেই – সেটা যাই থাক – আমাদের পাশপোর্টে ইসরাইল ভ্রমণও আমাদের জন্য বৈধ হতে পারে।  এ কথাটাই আমাদের পাসপোর্ট এখন বলছে।

অতএব,  ‘ইসরাইল ব্যতীত’ শব্দ দুটা এখন নেই – তাতে আসলে কী হয়েছে, তা বুঝতে হবে। এখন স্পষ্ট করে বলা হয়ে গেছে যে আমাদের পাসপোর্ট ‘সব দেশ ভ্রমণের জন্য বৈধ’- এটাই মুখ্য স্টেটমেন্ট। সব দেশ ভ্রমণ বৈধ হওয়ার অর্থ হল ইসরাইল সফরও বৈধ। তাতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন মুখে যতই ব্যাখ্যা দেন না কেন যে – ‘এই পরিবর্তনে ইসরাইলের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক পরিবর্তনের কিছু নেই’ অথবা ‘আমরা তো ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিই না’ – তাতে কিছুই হেরফের হবে না। এর মূল কারণ, মোমেনের এই বাড়তি ব্যাখ্যার ‘আইনি ভিত্তি নেই’ বা এটা সরকারের ‘আইনি অবস্থান’ নয়।  কারণ, ‘সব দেশ ভ্রমণের জন্য বৈধ’– এটাই পাসপোর্টে লেখাগুলো অনুসারে পাশপোর্ট অফিসের আইনগত অবস্থান।

কেন এমন হলোঃ
এখন আসি, কেন এমন হল বা সরকার এমন সিদ্ধান্ত কেন নিতে গেল? সেটা নিয়ে কথা বলার আগে আরেকটা কথা পরিষ্কার করে বলা দরকার। পাসপোর্টে পরিবর্তনের এই প্রস্তাব সরকারের নীতিনির্ধারণী ব্যক্তির কাছে যে-ই নিয়ে এসেছেন আর তা যতই লোভনীয় করে লাভালাভ দেখিয়ে তিনি পেশ করে থাকেন না কেন এটা সরকারের জন্য নীতিনির্ধারকদের নেয়া এক আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত হয়েছে। বরং সরকারের উচিত ছিল দুনিয়ার কোন কর্নার থেকে এই প্রস্তাব-উদ্যোগটা উঠেছে বা এসেছে সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে খোঁজ নেয়া, আর সে সম্পর্কে আগে এর পুরা পটভুমিটা সম্পর্কে ওয়াকেবহাল হওয়া। সরকার খুব সম্ভবত যথেষ্টভাবে ওই কাজটা না করে ‘এমন দুই শব্দ’ তুলে দিলে সরকারের কী কী লাভালাভ হবে – এর মধ্যেই বুঁদ হয়ে থেকে সিদ্ধান্তটা নিতে গেছে। সব বিপর্যয় ঘটেছে সেখান থেকে।

বলা হচ্ছে আমাদের সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ছয় মাস আগে। হা মোটা মুটি ব্যাপারটা তাই। কিন্তু এর চেয়ে বড় কথা সেই আগের পরিস্থিতিটাও এখন আর বজায় নাই। অনেক কিছুই এখন বদলে গেছে। বিশেষ করে সদ্য ১১ দিনের গাজায় ইসরাইলি হামলাকে কেন্দ্র করে।

ঘটনাটা তাই শেষের দিক থেকে যদি বলি, এটা এক গভীর গোপন পরিকল্পনা যা রচিত হয়েছিল প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের হাতে আর তা ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সাথে বুদ্ধি করে। আসলে এই পুরো বিষয়টাই নেতানিয়াহুর উদ্যোগে করা এক জায়নিস্ট পরিকল্পনা।

এখানে ইহুদিবাদী বা জায়নিস্ট [Zionist] শব্দের অর্থ যা বুঝতে হবে তা হল ১. জায়নিস্ট রাষ্ট্র মানে এটা কেবল ইহুদিদের জন্য একক ও  বিশেষ সুবিধার রাষ্ট্র, ২. সেখানে অন্য কেউ যদি নাগরিক থাকেও সে ইহুদিদের সাথে সমান অধিকারের নাগরিক নয়। ৩. এই জায়নিস্ট রাষ্ট্রের কোন ইহুদি সদস্য যদি অন্য নাগরিকের জায়গা-জমি সম্পত্তি দখল করে সেক্ষেত্রে জায়নিস্ট রাষ্ট্র সেটাকে শুধু বৈধ মনেই করবে তাই নয়; উলটা ঐ দখলদারদেরকে সব ধরণের সহায়তা দিবে। ৪. এমনকি জায়নিস্ট রাষ্ট্র প্রয়োজন মনে করলে যুদ্ধ লাগিয়ে দিয়ে ঐ দখলদারদের রক্ষা করবে। আর একাজকে তাদের আত্মরক্ষার অধিকার বলে চালিয়ে দিতে চাইবে। ৫. যেহেতু তারা হিটলারের নৃশংসতার ভিক্টিম অতএব কেবল তাদের বেলায় এসব কিছু করা জায়েজ আছে।  ভিক্টিমহুড – এই বোধের জন্য এই মনকষ্টের জন্য এখন উলটা তাদের এই হিটলারবাদি আচরণ দুনিয়াকেই সহ্য করে নিতে হবে।  ৬. আর সর্বশেষটা হল, যদি আপনি জায়নিস্ট রাষ্ট্রের এসব কাজ ও ততপরতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন তাহলে এই রাষ্ট্র উলটা আপনার বিরুদ্ধেই অভিযোগ তুলবে যে  আপনি এন্টি-সেমেটিক। আপনি ইহুদিদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াচ্ছেন! এর আবার মানে কী আর সেটা কী করে? মানে হল, সেমেটিক=ইহুদি, এই সমীকরণ অনুসারে আপনি ইহুদিদেরকে ইহুদি বলে নিচা দেখিয়েছেন, ঘৃণা করেছেন ছড়িয়েছেন, তুচ্ছ করে দেখিয়েছেন ঠিক যেমন এসব করে জর্মানির হিটলার সেদেশের ইহুদি নাগরিকদেরকে বিভিন্ন নির্যাতন ও পুড়িয়ে মেরে ফেলার আগে করেছিল। তাই তাঁরা এখন জায়নিস্ট (হিটলারের কপি) হবেন বলে আবদার।  সবমিলিয়ে এই হল জায়নিস্ট আচরণ ও তাদের সচেতন মনোবৈকল্য চর্চা।

আগে যেকথা বলছিলাম নেতানিয়াহু  তিনি এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে রাজি করানোর কাজটা করে নিয়েছিলেন ট্রাম্পের জামাই কুজনারের [ Jared Corey Kushner]  তিনিও সেমেটিক=ইহুদি তবে আমেরিকান] মাধ্যমে ট্রাম্পকে কব্জা করে। এদিকে আরবদের দিক থেকে একাজে সংশ্লিষ্ট ছিলেন এমন দুই প্রধান হলেন দুবাই ও সৌদির দুই প্রভাবশালী যুবরাজ। আনুষ্ঠানিকভাবে এই অসৎ পরিকল্পনাটার নাম হল ‘আব্রাহাম চুক্তি’ [আব্রাহাম একর্ড বা The Abraham Accords । এটি অবয়ব পায় হোয়াইট হাউজে বসে ট্রাম্প, নেতানিয়াহু আর সাথে দুবাইয়ের ও বাহারাইনের দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী- এই চারজনের এক চুক্তি স্বাক্ষরে। এটা ঘটেছিল ২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর।
অনেকের মনে হতে পারে এসব কী সত্যি নাকি আমার “মনে হয়” টাইপের কিছু? যেহেতু আমি হয়ত ইহুদি দেখতে পারি না সেজন্য? তাই কী? কারণ কঠিন সত্যি অনেক সময় বিশ্বাস হতে চায় না।

আজকাল আবার অনেকে আছেন যারা নিজেরাই মনে মনে মানেন সে তার তত জানাশুনা নাই কিন্তু আবার সেজন্য কেমনে ফস করে   জিজ্ঞাসা করে যে একথা যে সত্যি এর প্রমাণ কী? এমন সবার জন্য কাজটা সহজ আর স্বাধীন করে দেই। The Abraham Accords 2020 – এই কথা কয়টা এখান থেকে কপি করে গুগলে গিয়ে পেস্ট করে সার্চ দেন। এতটুকুই যথেষ্ট হবে। এবার যা ফল পাবেন তা হল – না হলেও ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ দিনের  শ’খানেকবিভিন্ন দেশের ইংরাজি দৈনিকের এই চুক্তি করা বিষয়ক খবরের লিঙ্ক। আর এরই ভিতর একটা লিঙ্ক পাবেন আমেরিকান সরকারি দলিল।  এর শিরোনাম হবে The Abraham Accords Declaration আর চিনবেন কী করে যে এটা আমেরিকার? দেখবেন লিঙ্কে লেখা আছে  state.gov – এই কথা কয়টা। আর এটাই অরিজিনাল চুক্তির কপিটা। ওখানেই সাথে পিডিএফ কপিও নামিতে নিতে পারবেন।
আবুধাবি থেকে প্রকাশিত একটা দৈনিক দ্যা ন্যাশনাল, এদের করা ঐদিনের একটা রিপোর্ট হল যে কে কে উপস্থিত ছিল [ Who attended the Abraham Accord signing] । আবার আমেরিকার বোস্টনভিত্তিক দ্যা আটল্যান্টিক[The Atlantic] এর সম্পাদক  পরের দিন ১৬ সেপ্টেম্বর নিজেই এক আর্টিকেল লিখেছিলেন এই চুক্তিতে কার লাভ কার ক্ষতি বিষয়ে শিরোনাম দিয়েছিলেন – Iran and the Palestinians Lose Out in the Abraham Accords.। সেখানে তিনি লিখেছিলেন, এটা কোন শান্তি চুক্তিওও হয় নাই। কারণ দুবাই বা বাহারাইন কখনই ইসরায়েলের সাথে যুদ্ধ করে নাই। আবার তিনি বলছেন, এর পিছনে সৌদি আরব আছে এর বড় প্রমাণ হল বাহারাইনের উপস্থিতি। বলেছেন সৌদি যুবরাজ, Bin Salman, without whom these Gulf states, Bahrain in particular, would not dare make such a bold and public move,…।

আসলে এই চুক্তিকে আব্রাহাম চুক্তি বলার উদেশ্য হল মনোথিওজমের জনক আব্রাহামের নামে নিয়ে একটা জাঁকজমক আবহ তৈরি করা।  অথচ এর আসল উদ্দেশ্য ছিল ফিলিস্তিনিদেরকেই কোণঠাসা ও উপেক্ষা করে জায়নিস্ট আর মধ্যপ্রাচ্যের বাদশাহরা এক হয়ে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধেই একসাথে কাজ করা। ফলে এটাকেই তারা “আব্রাহাম চুক্তি” বলে চালাতে চেয়েছেন। এছাড়া যদিও এখানে স্বাক্ষরকারিদের মধ্যে আমেরিকা মানে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও আছেন কিন্তু তিনি আসলে ঠিক কোন পক্ষ নন;  বড় জোড় মধ্যস্থতাকারি। অথচ সেখানেও জোড়াতালি দেয়া হয়েছে। কারণ আসল সংঘাত জায়নিস্টেরা তৈরি করে রেখেছে তো প্যালেস্টাইনিদের সাথে। অথচ প্যালেস্টাইনিরা এই চুক্তির কোন পক্ষই নয়।

তবে ছয় মাস আগের পরিস্থিতি এখন নেইঃ
২০২০ সালের আমেরিকান নির্বাচনের দুমাস আগে করা ঐ চুক্তি এখন ট্রাম্প পেরিয়ে বাইডেনের আমলে পৌঁছেছে। কিন্তু বাইডেন এত দিন এই চুক্তিতে যে যালেস্টাইনিদের উপর চাপ সৃষ্টি ও বঞ্চিত করা হয়ে আছে সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে ফেলে রেখেছিলেন। এর বাস্তব অর্থ হয়েছিল যে বাইডেনও যেন ট্রাম্পের অনুসারি।

কিন্তু এবারের গাজায় ইসরায়েলি হামলায় বাইডেনের চোখ খুলেছে; তিনি  ইতোমধ্যেই তাঁর কাজের প্রায়োরিটি বদল নিয়েছেন। এখন তিনি ওই চুক্তির কারণে যেসব ক্ষতি হয়ে গেছে বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে ওইসবের ক্ষত সারাতে উঠে পড়ে লেগেছেন। সে কাজেরই এক প্রধান অংশ ছিল এবারের গাজায় ইসরাইলি হামলায় ইসরাইলকে যুদ্ধবিরতিতে যেতে বাধ্য করা। তাছাড়া আমেরিকার আগের প্রতিশ্রুত যেসব ত্রাণ ও পুনর্বাসনের তহবিল আমেরিকা গাজায় দিত, যার পুরোটাই ট্রাম্প বন্ধ করে দিয়েছিলেন, সেসব আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে এনেছেন বাইডেন। আর মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন দেশের সাথে সম্পর্কগুলো যা ট্রাম্পের কথিত আব্রাহাম চুক্তির কারণে এলোমেলো হয়ে গেছিল – সেগুলোকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনার জন্য সেক্রেটারি অব স্টেট বিল্কেনের এক লম্বা সফরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

আর বাইডেনের এই নতুন অবস্থানে আসা বা আমেরিকাকে হুঁশে ফিরিয়ে আনার কাজটি মূলত কারা করলেন? এনিয়ে বিবিসি বাংলাতে এক বিশেষ করা হয়েছে যার শিরোনাম, “ইসরায়েল ফিলিস্তিন প্রশ্নে আমেরিকায় ডেমোক্র্যাট শিবিরে গভীর পরিবর্তন। তাতে বলা হচ্ছে, এরা হলেন ডেমোক্র্যাট দলের মধ্যে নতুন যারা তুলনামূলক তাদের ভাষায় ‘প্রগ্রেসিভ’ (আমেরিকান অর্থে প্রগ্রেসিভ যারা রক্ষণশীলের উল্টা, আমাদের মতো দেশের অর্থে প্রগেসিভ মানে কমিউনিস্ট তারা নন)। বিবিসির উপরে উল্লেখিত এই রিপোর্টের ভাষায়,……

“কিন্তু কংগ্রেসের ভেতর দিনকে দিন বৈচিত্র্য আসছে, আর সেই সাথে ইসরায়েলের প্রশ্নে আমেরিকার প্রচলিত নীতি চাপের মধ্যে পড়েছে।
জরিপ সংস্থা পিউ ফাউন্ডেশন স্টাডি বলছে ২০২১ সালের নির্বাচনে প্রতিনিধি পরিষদ এবং সেনেটে নির্বাচিত সদস্যদের ২৩ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ, হিসপানিক, এশীয় এবং আদি আমেরিকান বংশোদ্ভূত । এটি একটি রেকর্ড। বিশ বছর আগে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ১১ শতাংশ। ১৯৪৫ সালে ছিল মাত্র ১ শতাংশ”।

এরা আসলে বাকি ডেমোক্র্যাটদের তুলনায় ফিলিস্তিনিদের পক্ষে বেশি প্রো-অ্যাকটিভ। আর এদের প্রতিনিধি বলতে তিন নারীর কথা বেশি সামনে এসেছে।  বার্তা সংস্থা রয়টার্স এর ভাষায়, “এরাই সেই প্রগ্রেসিভ ডেমোক্রাটস যারা বাইডেনকে গত প্রেসিডেন্ট  নির্বাচনে জিততে শুধু সাহায্য করেছিল তাই না, বাইডেন নমিনেশনও পেয়েছিলেন এদের শক্ত  সমর্থনের জন্য …progressive Democrats, a group that helped Biden win the Democratic nomination and the presidency……]।

বিবিসি লিখেছে, কংগ্রেসে তরুণ, প্রগতিশীল কয়েকজন সদস্যের একটি জোট – যেটি স্কোয়াড নামে পরিচিতি পেয়েছে -, তার মধ্যে রয়েছেন মিশিগান থেকে নির্বাচিত ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত রাশিদা তালিব এবং মিনেসোটা থেকে নির্বাচিত সোমালিয়ান বংশোদ্ভূত ইলহান ওমর।]

এদের একজনের সাথে বাইডেন-কমলা বিমানে উঠার আগে টারম্যাকে আন্তরিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু আলাপ করছেন, এমন একটা ছবি অনেক জায়গায় ঘুরছে।

মূল কথাটা হল, এনিয়ে রয়টার্সের একমাত্র এক এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট ছাপা হয়েছে গত ২১ মে। সেখানে বহু প্রসঙ্গে ডিটেইলড বর্ণনা আছে। যার শিরোনাম হলো, গাজা কনফ্লিক্ট ফোর্সেস রিঅর্ডারিং অব বাইডেন’স পলিসি প্রায়োরিটিস প্রশ্নে ব্যাখ্যা [Analysis: Gaza conflict forces reordering of Biden’s policy priorities]। এককথায় বললে, বাইডেন ট্রাম্প-নেতানিয়াহুর শয়তানি পরিকল্পনার ‘আব্রাহাম একর্ড’ ভেঙে আমেরিকাকে বের করে আনতে সচেষ্ট হয়েছেন।

কিন্তু এর সাথে আমাদের পাসপোর্ট ইস্যুর কী সম্পর্ক?
হ্যাঁ, সেটাই সবচেয়ে মজার। আব্রাহাম একর্ড ২০২০ সেপ্টেম্বরে স্বাক্ষরের পরে ঐ সময় এর বাস্তবায়নের দায় পড়ে মূলত দুই যুবরাজের (দুবাই, সৌদি) উপর। এই চুক্তিতে দৃশ্যত সৌদি আরব নেই। কিন্তু পশ্চাদ-পটভূমিতে সর্বত্র আছে। এনিয়ে আটল্যান্টিকের আরেক রিপোর্ট Why the UAE Made Peace With Israel দেখা যেতে পারে। এছাড়া ঐ চুক্তিস্বক্ষরের সময় আরও পাইপলাইনে ছিল (আছে বলতে পারছি না) আরো দুই দেশ ওমান, সুদান ইত্যাদি।

আব্রাহাম একর্ড করার মূল লক্ষ্য কী ছিলঃ
কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। প্রশ্ন হলো, এই আব্রাহাম একর্ড কেন তারা করেছিলেন? কেন পক্ষগুলো এর দরকার অনুভব করেছিল? সেটাই মূল ঘটনার আরেকটা দিক। ওই মূল ঘটনা হলো, ইরান; মানে চীন-ইরান ২৫ বছরের চুক্তি বাস্তবে হাজির হওয়া। আর এর বিরুদ্ধেই জায়নিস্ট আর মধ্যপ্রাচ্যের বাদশাহরা মিলে এক হয়ে কাজ করা জোট পাকানো আর একারণেই রিপাবলিকান ট্রাম্প তাতে মদদ নিয়েছিলেন। বলাই বাহুল্য,  ইরানের এই নব উত্থানে ইসরাইল ভীত। আবার জিসিসির বাদশাহ-দেশগুলো মধ্যে সম্ভবত কাতার ছাড়া সব বাদশাহ-রাষ্ট্র ও বিশেষ করে দুই যুবরাজের (দুবাই, সৌদি) – তারাও ভীত। এখানে ইসরাইলের ভয় হল যে এই (চীনের বলে বলিয়ান) ইরান এখন আরো বড় ক্ষমতা ও প্রভাব নিয়ে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে দাঁড়াবে। হামাস-হিজবুল্লাহ এর সাহায্যে। এছাড়া আমেরিকার সাথে পারমাণবিক ইস্যুতে ইরান আর ফিরে কোন চুক্তিতে বাধা পড়তেও সম্ভবত চাইবে না। এগুলোই ইসরাইলের মাথা খারাপ করে দেয়া তাদের মূল শঙ্কা।

ওদিকে ইরানের প্রভাব যেভাবে বেড়ে যাচ্ছে আর তাতে সে মধ্যপ্রাচ্যে কোন বাদশাগিরিই আর রাখবে না – এই অবস্থান নিতে পারে এই হল  জিসিসির [GCC] বাদশা-আমীরদের মূল শঙ্কা। আর চীন গ্লোবাল নেতা হয়ে গেলে, তাতে আমেরিকান প্রভাবের পতন ঘটবে, আর তাতে মধ্যপ্রাচ্যে বর্তমান সৌদিদের মুখ্য ভূমিকাটা নিয়ে বসবে ইরান। এটাও তাদের শঙ্কা। একারণে, নেতানিয়াহু জামাই কুজনারের মাধ্যমে শ্বশুর ট্রাম্প (ও তার দল রিপাবলিকানদের) কব্জা করে আমেরিকান মধ্যস্থতায় এই আব্রাহাম একর্ড করে নিয়েছিলেন তারা সকলে মিলে যেন এই চুক্তি একটা তাদের জন্য প্রতিরক্ষা। তা আসলে ইরান-চীনবিরোধী এবং ইরানি উত্থানে ভীত আরব বাদশাহ আর ইসরাইলিদের কমন এনিমি ইরানের বিরুদ্ধে তাদের জোট। অতএব এই যুবরাজদের চোখে ভরসা হয়ে দেখা দিয়েছিল  ইসরাইল। তাদের ভীত মনের অনুমানে, ইসরাইলই একমাত্র তাদেরকে ইরানের হাত থেকে বাঁচাতে পারে। এই মনোভাবটা টের পেয়েই নেতানেয়াহু “আব্রাহাম একর্ড” পরিকল্পনা নিয়ে আগানো শুরু করেছিল।

একারণে আবার আব্রাহাম অ্যাকর্ডের বাস্তবায়ন মানে ইসরাইল দাবি করেছিল  যে তাহলে  যুবরাজ-দ্বয়ের কাজ হল, তারা মুসলমানপ্রধান রাষ্ট্রগুলো থেকে ইসরাইলকে স্বীকৃতি এনে দিক। আর ওই কাজে যুবরাজের অন্য অনেকের মত পাকিস্তানের (এবং বাংলাদেশও) ওপরে চাপ সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ইমরান যেকোনো মূল্যে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে বসে। আর তাতে দুবাই পাল্টা ব্যবস্থায় সমস্ত পাকিস্তানি (মূলত মাইগ্রেন্ট লেবারদেরকে) দুবাই থেকে বের করে দেয় বা প্রবেশ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কিন্তু করোনা আমল বলেও অনেকে ধরে নেয়, এটা বোধহয় করোনা-পদক্ষেপের কারণে হচ্ছে। যেমন এই রিপোর্টে কারণ কী তা ব্যাখ্যা দেয়া বা উল্লেখ করা হয় নাই। এই প্রসঙ্গে সৌদি আচরণের রিপোর্ট এখানে ।  আর এনিয়ে ভারতের খুশি লক্ষ্য করেন এখানে।মজার কথা হল, বাংলাদেশের নাম ওই সময় দুবাইয়ের নিষেধাজ্ঞা তালিকায় উঠেনি। এখান থেকেই অনুমান যে আমরা স্বীকৃতি দেয়ার অনুরোধকে পালটে নিয়ে আপাতত – এভাবে পাসপোর্টে ‘ইসরাইল ব্যতীত’ পর্যন্ত শব্দগুলো উঠিয়ে দিতে রাজি হয়েছিলাম। বলাই বাহুল্য, এটা ভাল সিদ্ধান্ত হয়নি যা এখন বাস্তবায়িত হচ্ছে।

তবে এই প্রসঙ্গে এখন সুনির্দিষ্ট করে বলা যায়, সরকারের উচিত হবে অবিলম্বে পাসপোর্ট ইস্যুতে সব সিদ্ধান্ত স্থগিত করে পুর্বাবস্থায় ফিরে রেখে দেয়া আর পুরো ইস্যুটা যেসব বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল তা এক কমিটি করে রিভিউ করতে বসানো। মনে রাখতে হবে এখনকার বাইডেন, তিনিই যেখানে ট্রাম্প-নেতানিয়াহুর অবস্থানে থাকতে চাইছেন না। নিজের প্রায়োরিটি বদলে ফেলার পথে রওনা দিয়েছেন তাহলে অন্ততপক্ষে এই সুযোগে আমরাও আমাদের ভুল সংশোধন করে নিতে পারি।

এছাড়া আরো দিক আছে। ইতোমধ্যে দুবাইয়ের সাথে চীনের সম্পর্ক কিছু উন্নতি হয়েছে বলতে হবে। আর এর প্রকাশ হল দুবাই করোনা টিকা ইস্যুতে পুরোপুরি চীনা টিকা-নির্ভর। সম্ভবত এটাতে তাদের কথা বলার পথ খুলেছে।

আবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে নীতির পক্ষে আমাদের দাড়াতে হবে তা হল, ইরানের পিছনে চীনের সমর্থন আছে বলে এই নতুন ইরান সে আর যাই করুক মধ্যপ্রাচ্যে বাদশাদের রাষ্ট্র-এর ওপর হস্তক্ষেপ করবে, বা-হাত ঢুকাবে, সরকার বদলাবে কী রাষ্ট্রপদ্ধতি বদলে দিবে – এটা একেবারেই কাম্য নয় ও অগ্রহণযোগ্য। এটা হতে পারে না। দুবাই বা সৌদি আরবে আভ্যন্তরীণভাবে সরকারে কে বসবে রা সরকার পদ্ধতি কী হবে তা একমাত্র তার অভ্যন্তরীণ জনগণই নির্ধারণ করবে – এই নীতির বাইরে আমরা কেউ যেতে পারি না। আমরা ওয়ার অন টেররের জুনিয়র বুশ হয়ে যেতে পারি না।

কাজেই দুবাইয়ের সাথে চীনের কত দূর কী আলাপ হয়েছে আমরা জানি না। তবে দুবাই অন্তত এখন অনেক আশ্বস্ত তাই আমরা লক্ষ্য করছি। কারণ অন্তত  ইসরাইলকে ত্রাতা জ্ঞান করার আগের  দুবাই অনেকটাই এখন শীতল বলে মনে হয়।

তবে চীনকেও অবশ্যই নীতিগত অবস্থানে শক্ত হতে হবে, আর চীন-ইরান চুক্তি হয়েছে বলে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন আরেক বিশৃঙ্খলা কাম্য নয়। তা চীনেরও পক্ষে যাবে না। একমাত্র নীতিগত অবস্থান ধরে দাঁড়ানোই চীন দায়িত্ববান গ্লোবাল নেতার ভূমিকায় স্বাগত লাভ করতে পারে।

সারকথায় আমাদের পাসপোর্ট ইস্যুতে আরো বড় ক্ষতি হয়ে যাবার আগেই অবিলম্বে সিদ্ধান্ত স্থগিত ও রিভিউয়ের অবস্থানে চলে যাওয়াই কাম্য। এটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। সারা জীবন আমরা ফিলিস্তিনের পক্ষে থেকে এখন তাদের হাত ন্যূনতম শিথিল করার কোনো অর্থ নেই, এটা হতেই পারে না! আশা করি, আমাদের সরকার  বদলাবার সুযোগটা নিবেন!

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

 

[এই লেখাটা  গত ২৫ মে  ২০২১, দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ওয়েবে    “বাংলাদেশের পাসপোর্ট : প্রেক্ষাপট বাইডেনের প্রায়োরিটি” – এই শিরোনামে  ছাপা হয়েছিল।
নয়াদিগন্তে ছাপা হওয়া লেখাগুলোকে আমার লেখার ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ বলা যায়।  আর আমার এই নিজস্ব সাইটের লেখাটাকে সেকেন্ড ভার্সান হিসাবে এবং  থিতু ভাষ্য বলে পাঠক গণ্য করতে পারেন। পরবর্তিতে ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ লেখাটাকেই এখানে আরও অনেক নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে ও নতুন শিরোনামে এখানে আজ ছাপা হল। ]

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s