কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাত, নেহরুয়ান খাটোচিন্তার ফসল
গৌতম দাস
০৭ জুন ২০২১, ২০:০৭, ০০:০৬
Modi Vs Mamota in the light of Center Vs State conflict
নেহরুভিয়ান বা নেহেরু স্টাইলের ভারত গড়তে গিয়ে এটা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর এক গুপ্ত-হস্তক্ষেপের রাষ্ট্র। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন করে ভারত-রাষ্ট্রের এসব গুপ্ত-হস্তক্ষেপ ব্যবস্থাদি এখন আবার প্রকাশ্যে চলে এসেছে। কলকাতায় রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হয়েছে গত ২ মে, মানে এক মাসেরও আগে এবং তাতে তৃণমূল কংগ্রেস দলের মমতা তৃতীয়বারের মতো জয়লাভ করেছেন। মানে আবার মমতা ব্যানার্জি সরকার গড়বেন এবং গড়েছেনও। অথচ এই নির্বাচনে প্রচণ্ড মিথ্যা আশ্বাস জড়ো করে ফেলা হয়েছিল যে, মোদীর বিজেপি বিজয়ী হচ্ছেই; এই প্রপাগান্ডা এখন আত্মঘাতী অবস্থায়। তাই বিজেপি কর্মী-সমর্থকদের মানসিক জোর ধরে রাখার জন্য, মিথ্যা উচ্ছ্বাস জীবিত রাখতে গিয়ে প্রতি পদে পদে এখন “কেন্দ্র বনাম রাজ্য” – এভাবে মোদী-মমতা মুখোমুখি সংঘাত জোরদার করে তুলতে চাইছেন মোদী।
ভারতের কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাতঃ
কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাত ভারতের জন্মের সমান বয়সী এক মারাত্মক ক্ষত। এটা মূলত নেহেরু-স্টাইলে চিন্তার পরিণতি। এই চিন্তার মূল বৈশিষ্ট হল, কলোনিদখলদার বৃটিশেরা ভারত ছেড়ে চলে গেলেও (তাদের শাসনের প্রধান রাজ/রানীর প্রতিনিধিকে ভাইসরয় বলা হত) নেহেরু নিজেকে এক “ভাইসরয়-ই” মনে করতেন। যা তাঁর কাজ ও ততপরতার মধ্যে বিশেষত খোদ ভারত-রাষ্ট্র কাঠামোটাই এর সবচেয়ে বড় স্পষ্ট প্রমাণ। অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের পরের ভারতের জনগণের সাথে নেহেরু নিজের সম্পর্কটা কী এই প্রশ্নে নিজেকে এক কলোনিদখলদারের মত করেই ভবেবে নিয়ে দেখেছেন। অর্থাৎ “জনপ্রতিনিধি” শব্দ ও এই মৌলিক ধারণাটাই তিনি আমল করতে চান নাই। ফলে একটা “রিপাবলিক” রাষ্ট্রের মূলকথাটাই তাঁর কখনই জানা হয়ে উঠে নাই। বিপরীতে তার ত্রুটিপুর্ণ চিন্তার মৌলিক দিকটা হল, হবু ভারত-রাষ্ট্রের সমস্ত ক্ষমতা কথিত এক কেন্দ্রের নামে ও এর হাতে কুক্ষিগত করা যায় কী করে সেদিকে সচেষ্ট থেকেই কলোনি-উত্তর ভারতের জন্ম দিয়েছেন; কনষ্টিটিউশন লিখিয়েছেন। এটাকেই আমরা নেহেরুভিয়ান চিন্তা বা নেহেরু-স্টাইলে চিন্তা বলছি। যাকে প্রতীকীভাবে সময়ে নেহেরুর “ভাইসরয়”-চিন্তাও বলেছি।
কাজেই কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাত – এটা আসলে ভারতের রাষ্ট্রগঠনের জন্মগত এক মারাত্মক ত্রুটি। ফলে এককথায় (ফেডারল এক ভারত করে) এর পুনর্জন্ম বা ভেঙ্গে-গড়া যার একমাত্র সমাধান। কিন্তু ভারত-রাষ্ট্র ভেঙ্গে ফেলে সেটা আবার পুনঃর্গঠনের মুরোদ যদি ভারতের রাজনীতিবিদ-ইন্টেলেজেন্সিয়ার থাকে (যার আলামত এখন পর্যন্ত নাই) তবেই এ’থেকে ভারত মুক্ত হতে পারবে না তা বলাই বাহুল্য। নইলে আস্তে আস্তে এটা ব্ল্যাক-হোলের গর্তে হারিয়ে যাবার মত এক ঘটনা হবে। মানে এককালের যুগশ্লোভিয়া, চেকোশ্লোভিয়া অথবা খোদ সোভিয়েত ইউনিয়ন বলে রাষ্ট্র থাকলেও তাদের ভেঙ্গে যাওয়া বা আজ নাই হয়ে যাবার মত আরেক ঘটনা হবে এটা। কথিত একটা কেন্দ্রের নামে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চাইলে পরিণতি এটাই তো হবার কথা!
এ অবস্থায় আরেকটু ভেঙ্গে বললে ভারত-রাষ্ট্রে কেন্দ্র-রাজ্য বিবাদ, এই জিনিসটা কী আসলে? যদিও এই প্রশ্নটাই এখন মোদীর কারণে সর্বত্র সরব হয়ে উঠেছে। এখন যেটা মোদী-মমতা বলা হচ্ছে এটাই কয়েক বছর আগে উঠেছিল রাজ্য-দিল্লিতে, মোদী-কেজরিলাল নামে। আর তা এবার কলকাতা ছাড়িয়ে ভারতের অন্য রাজ্যগুলোতেও ক্রমে ছড়াচ্ছে। সবাই কান-খাড়া করে উঠতে চাইছে।
ফেডারেল মানে কী বুঝবঃ
ফেডারেল [Federal] শব্দটা ইংরেজি। এর একটা বাংলা অনেকে করে থাকেন ‘যুক্তরাষ্ট্রীয়’ বলে। যেমন অনেকে লিখেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ইংরাজি United States of America (USA) এর বাংলা হিসাবে। ফেডারেল ধারণাটা যদি রাষ্ট্র-সম্পর্কিত কোনো বিষয়ের মধ্যে সীমিত থাকে তাহলে হয়ত এমন বাংলা দিয়ে চলতে পারে হয়ত। যদিও এটা ভাল বাংলা নয়। কারণ ফেডারেল শব্দের সাধারণ অর্থ হল, স্বাধীন ও সমতুল্যদের মধ্যে এবং তাদের নিয়ে গড়া এক এসোসিয়েশন। যেমন স্বাধীন ফুটবল ক্লাবগুলোকে নিয়ে গড়া এক ফুটবলের ফেডারেল এসোসিয়েশন বা ফেডারেশন। অথবা স্বাধীন গার্মেন্টস ট্রেড ইউনিয়নগুলোর এক ফেডারেশন। অথবা সবধরনের স্বাধীন ট্রেডের এসোসিয়েশনগুলোরও আবার এক ফেডারেশন। লক্ষ্য করেন, এখানে কিন্তু ফেডারেশন বা ফেডারেল ধারণার ব্যবহার কোনো রাষ্ট্র-বিষয়ক ব্যাপারে নয়। তাই ‘যুক্তরাষ্ট্রীয় শব্দটা এখানে কোনোভাবেই যুতসই তো নয়ই; সোজা কথা তা খাটবে না, অচল। তাই এ লেখায় ফেডারেল শব্দের কোনো বাংলা না করেই তা সরাসরি ব্যবহার করব।
আর ফেডারল শব্দটা আমাদের মানুষের কাছে তাদের নজর ও নাগালে এসেছিল অন্তত দুবার। প্রথমবার ১৯২৮ সালে যখন মুসলিম লীর নেতা জিন্নাহ নেহেরুকে আগামি ভারত (যেটা এখন ভারত ও পাকিস্তান হয়ে গেছে) স্বায়ত্বশাসিত রাজ্যগুলোর একটা ফেডারল ভারত করা হোক বলে প্রস্তাব করেছিলেন। আর স্বভাবতই আমরা উপরে দেখেছি নেহেরু-স্টাইল ছিল ঠিক এর উলটা, তাই তা প্রত্যাখ্যাত বা পত্রপাঠ বিদায় হয়েছিল। আর দ্বিতীয়বার আমরা শুনেছিলাম ১৯৭১ সালে যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বদলে খন্দকার মোস্তাক পাকিস্তানের সঙ্গে এক কন-ফেডারেশন গড়তে চেয়েছিলেন বা সে লক্ষ্যে কিছু চেষ্টা করেছিলেন।
তাহলে এখন কেবল রাষ্ট্র-সম্পর্কিত কোনো ধারণা হিসেবে যদি বলি, এটা একটা ‘ফেডারেল রাষ্ট্র’ বলতে যেমন বললাম, আমেরিকা একটা ফেডারেল রাষ্ট্র, তাহলে কী বুঝব?
সে ক্ষেত্রে এর অর্থ হল, এটা ৫০টা স্বাধীন ও সমতুল্য স্টেটের সমর্থনে গঠিত একটা ফেডারেল রাষ্ট্র অবশ্যই; তবে ফেডারেল রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার আগেই সেগুলো স্বাধীন রাজ্য ছিল এবং আছে বলে তাদের নিয়ে গঠিত এই বিশেষ ধরনের এসোসিয়েশন বা রাষ্ট্রটাকে ফেডারেল রাষ্ট্র বলা হচ্ছে।
তাহলে এখন এক সম্পূরক প্রশ্ন তোলা যাক। তাই, ভারতও কী একটা ফেডারেল রাষ্ট্র? কারণ ভারতেও তো বর্তমানে ২৮টা ছোট-বড় রাজ্য আছে বা নিয়ে গঠিত?
না, একেবারেই তা নয়। ভারত কোনো ফেডারেল রাষ্ট্র নয়; যদিও কেন নয় তা যথেষ্ট না জেনে বুঝেই অনেকে পত্রিকা রিপোর্টে ভারতের কেন্দ্র ও রাজ্যের বিরোধের ইস্যু হলেই তাকে ‘ফেডারেল’ সমস্যা বলে যেচে নিজের জ্ঞানবুদ্ধি জাহির করতে চায় অনেক রিপোর্টার। মানে শব্দটা তারা শুনেছে যেন সেটা বুঝাতে চায়। কিন্তু কথাটা সবচেয়ে বেখেয়ালে বলে ফেললেও ভারত কোনোভাবেই ‘ফেডারেল রাষ্ট্র’ নয়। আর মূলকথাটা হল, একটা রাষ্ট্রের ভিতরে অনেকগুলো প্রদেশ বা রাজ্য থাকা মানেই সেটা একটা ফেডারল রাষ্ট্র – এই অনুমান একেবারেই ভিত্তিহীন ও বাজে কথা।
কিন্তু কেন? ফেডারল বুঝতে এত কঠোর সীমারেখা টানছি কেন?
ফেডারল কথাটা আমরা বুঝতে পারি আমেরিকার জন্মের ইতিহাস দিয়ে এবং সম্ভবত তাতে সবটা সহজে বোঝা যাবে। খুব অল্প কথায় বললে আজকের “ফেডারেল আমেরিকা রাষ্ট্র” এটা ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই জন্ম নিয়েছিল। আজ পর্যন্ত এটাই দুনিয়াতে ফেডারল রাষ্ট্রের সবচেয়ে ভাল উদাহরণ। আর এর আগের (১৭৭৬ সালের আগের) কলোনিয়াল আমেরিকা [American colonies] বলতে তা ব্রিটিশসহ ইউরোপের বহু রাষ্ট্রেরই কলোনিদখল ব্যবসায়ী কোম্পানির মালিকানাধীন ছোট ছোট কলোনি বা দখলকৃত ভূমি হিসেবে ছিল। আর ঐ দখলকৃত ভূমিগুলো আবার ব্রিটিশসহ নানান ইউরোপীয় দখলদাররা নিজ নিজ দেশ থেকে ‘বিনা পয়সায় জমি দেয়া হবে, শুরুর বিনিয়োগ দেয়া হবে’ ইত্যাদি নানা প্রলোভনের কথা বলে গরিব ইউরোপীয় বাসিন্দাদের মাইগ্রেট করে জাহাজে ভরে ভরে এককালে আমেরিকায় এনেছিল।
এসব গরিব ইউরোপীয় বাসিন্দারাই জমি পাওয়ার লোভে মাইগ্রেট করে আমেরিকায় এসেছিল। এরপর এরাই স্থানীয় আদি বা নেটিভ বাসিন্দাদেরকে (‘রেড ইন্ডিয়ান’ বলে এরা ডাকত যাদের) খেদিয়ে দিয়েছিল, কখনো মেরে ফেলা হয়েছিল অথবা আরো গহিন বন জঙ্গলে পালাতে বাধ্য করা হয়েছিল। আর এভাবেই সাদা চামড়ার কলোনি মালিকরা সাদা ইউরোপীয় গরীব মাইগ্রেন্টদের এনে বসতি স্থাপনে বিভিন্ন ছোট শহর বা রাজের আমেরিকা কলোনি স্থাপন সম্পন্ন করেছিল। এই প্রথম পর্বের পরে মালিকরা এরপর সেখানে নিয়ে আসে আফ্রিকানদেরকে ‘কালো দাস’ নামে, একইভাবে মাইগ্রেট করিয়ে। তফাত খালি এরা পায়ে শিকল পরানো দাস হিসেবে এসেছিল এবং তা আফ্রিকা থেকে। আর এই দাসদেরকেই পরিচালনা করত সাদা মাইগ্রেন্টরা তবে সাদা মালিকদের পক্ষ থেকে। আর রাশিয়ান সোভিয়েত শ্রমশিবিরের চেয়েও ভয়াবহভাবে শিকলে বাঁধা দাসশ্রমিক হিসেবে। তবু যতই দিন গেছে, আর কালো মানুষেরা যত “পোষ” মেনেছে, ততই শিকল আলগা করে দিয়েছে শাসকেরা।
ওদিকে ব্রিটিশরা ভারতে কলোনি দখল ও শাসন শুরু করেছিল – আমেরিকার কলোনিমুক্ত বা স্বাধীন হওয়ার মাত্র কুড়ি বছর আগেই। ব্রিটিশরা ভারতীয়দের পায়ে শিকল না দিলেও কলোনির হুকুম ও বাধ্যবাধকতার ভেতরে রেখেছিল যা আমাদের প্রায়ই অসহ্য হয়ে উঠলে বিদ্রোহের ঘটনা ঘটত। কিন্তু আমেরিকার বেলায় নানান শহর ও রাজ্যের সাদা মাইগ্রেন্টরাই এক সময় তাদেরই মাস্টার বা সাদা মালিকদের শাসনের বিরুদ্ধে শুধু বিদ্রোহ নয় একবারে বিপ্লব – মানে পাল্টা ক্ষমতা দখল করে বসেছিল। এটাই আমেরিকান কলোনিতে ‘নয়া আমেরিকান বিপ্লব’ [American Revolution] নামে পরিচিত, যার সময়কাল ১৭৭৬ সালের আশপাশের সময়। সোজা কথা, ব্রিটেনে বসে কলোনি ব্যবসায়ী মালিকরা আমেরিকায় তাদের নানা শহর বা রাজ্যের কলোনিগুলো সাদা ইউরোপীয় মাইগ্রেন্টদের দিয়ে পরিচালনা করবে, এই সুযোগেরই পরিসমাপ্তি ঘটেছিল এতে। এরপর স্বাধীন সেসব শহর ও কোথাও পুরা রাজ্যটাই স্বাধীন হয়ে যায়। এবং এবার তারা একত্রে হওয়ার জন্য সম্মিলিত হয়ে বসেছিল; যেটাকে তারা আমেরিকা মহাদেশীয় সম্মেলন (আমেরিকান কন্টিনেন্টাল কংগ্রেস ১৭৭৫) নামে ডাকে। Continental-Congress বসা ছিল খুবই তাতপর্যপুর্ণ ঘটনা। এরপর পরের বছর ১৭৭৬ সালে এক ফেডারেল আমেরিকা রাষ্ট্রে তারা সম্মিলিতভাবে গঠিত হয় ও এর স্বাধীনতার ঘোষণা [Declaration of Independence (1776)] দেয়।
ফেডারল ধারণা বুঝবার জন্য এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ ও লক্ষণীয় যে, এখানে শহর বা রাজ্যগুলো আগে স্বাধীন ও কলোনিমুক্ত হয়েছিল। এরপরে এই স্বাধীন রাজ্যগুলো একটা রাষ্ট্রে ফেডারেটেড [Federated] ভাবে একত্র হতে এসেছিল। এটাই ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই জন্মের ঘোষণা দেয়া আজকের ফেডারেল আমেরিকা রাষ্ট্র ও এর বৈশিষ্ট্য। তবে আজকের ৫০ রাজ্যের আমেরিকা যা আমরা দেখছি তা অবশ্য শুরুতে এমন ছিল না। শুরুতে মাত্র ১৩টা স্বাধীন রাজ্য কনফেডারেশনে এ ফেডারেল রাষ্ট্র গড়তে সম্মতি দিয়েছিল। কেন? কারণ সদ্য স্বাধীন কলোনিমুক্ত রাজ্যগুলোর সবার মনে ভয় ছিল নতুন এই ফেডারেল রাষ্ট্র গড়তে গিয়ে আবার আগের মত কোনো রাজ্য আরেক রাজ্যের ওপর কলোনির মতো আচরণ শুরু করে কি না – সেটাই সবাই আগে নিশ্চিত হতে চেয়েছিল। তাই দ্বিধা ও দেরি। যেমন শুরুতে ফেডারল আমেরিকার কোন একক কারেন্সি বা ডলার মুদ্রা ছিল না। এমনকি এক রাজ্যের মুদ্রা আরেক রাজ্যে চলত না। প্রত্যেক রাজ্যে প্রত্যেক ব্যাংকের আলাদা আলাদা ছাপানো কারেন্সি ছিল। প্রথম স রাজ্যীর সব ব্যাংকগুলোর মধ্যে একটা কো-অর্ডিনেশনের জন্য ফেডারল রিজার্ভ ব্যাংক (একালের তুলনীয় আমাদের বাংলাদেশ ব্যাংক ) গঠন করা হয়েছিল এই ১৯১৩ সালে। এরপর ১৯১৫ সালে প্রথম ফেড-এর ইস্যুকৃত বাজারে আসে। তাই তা কেবল ৫,১০ আর ২০ ডলারের। তাই ধীরে ধীরে যত আস্থা এসেছে ততই ফেডারল আইনকানুন কী তৈরি হচ্ছে সেগুলো এবং গঠনতন্ত্র কী রাখা হচ্ছে, কাঠামো কী ইত্যাদি দেখে আর কিছুটা প্র্যাকটিসে নিশ্চিত হওয়ার পরে ১৩ রাজ্য থেকে সেটা আজ ৫০ রাজ্যের আমেরিকা উঠে এসেছে। কাজেই ফেডারল ধারণার গোড়ার ধারণা হল, আগে নিজে স্বাধীন থাকা পরে ফেডারল বা এক ফেডারেশনের ছাতার নিচে আসা। নইলে বের হয়ে যেন যেতে পারে – এমন সুযোগ ও বের হয়ে যাবার রাস্তা খুলে রাখা থাকা চাই।
নেহেরুর কেন্দ্র-রাজ্যের ভারতঃ
তাহলে এখন আসেন ১৯৪৭ সালে, নেহরুর গঠিত ভারত সেও তো এমন ২৮-২৯টা রাজ্যে এবং এরা কি প্রত্যেকে স্বাধীন ও কলোনিমুক্ত রাজ্য ছিল? না, একেবারেই নয়। বরং কথিত ভারত বলে একটা বিরাট ভূখণ্ড ছিল বলে ধরে নেয়া হয়েছিল আর যেটাই ব্রিটিশ শেষ ভাইসরয় (রানীর প্রতিনিধি) মাউন্টব্যাটেন নেহরুর হাতে ১৫ আগষ্ট তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেগুলো কোন কোন ভূখণ্ড? এক কথায় বললে, কেবল যেগুলোর প্রশাসন ব্রিটিশদের হাতে তৈরি ও পরিচালিত হত। অর্থাৎ তিন প্রেসিডেন্সি (বেঙ্গল, মাদ্রাজ ও বোম্বাই) ও প্রায় ১৮টা প্রদেশ। আর এর বাইরে ছোটবড় মিলিয়ে ৫৫০ এরও বেশি করদ রাজার রাজ্য ছিল। কিন্তু এগুলো নেহরুকে হস্তান্তরের প্রশ্নই ছিল না।
কারণ এগুলো ছিল ব্রিটিশ শাসনক্ষমতার অধীনস্থ এবং শর্ত সাপেক্ষ মানে, রাজারা বৃটিশ শাসনক্ষমতার সাথে তাদের আদায়কৃত রাজস্বের একাংশ শেয়ার করতেন। কাজেই ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে চলে গেলে ওসব করদ রাজ্য তখন থেকে আবার ফিরে স্বাধীন রাজার রাজ্য হয়ে যায়। আর তাতে, নেহরুর কাছে করদ রাজ্যগুলোকে আর হস্তান্তরের কোনো আইনি অধিকার ব্রিটিশ শাসকের ছিল না।
কাজেই নেহরু যে দুশ্চিন্তায় ‘পাগল’ ছিলেন তা হল, প্রেসিডেন্সি, প্রদেশ ও পুরানা করদ রাজ – এদের সবগুলোকে পিটিয়ে জবরদস্তি করে হলেও, সেনাবাহিনী পাঠিয়ে হলেও – কথিত এক ভারত রাষ্ট্রের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া যায় কী করে! এই হলো জন্মের সময়কালের নেহরুর ভারত। সে কারণে নেহরুর নিজের ভারতের রাজ্যগুলোর জনগণের প্রতি অ্যাটিচ্যুড যেন ভারত কলোনিমুক্ত হলেও তিনি তখনও এক কলোনি ভাইসরয়! যেন নিজেই রাজা বা রানী অথবা প্রধান রাজ-প্রতিনিধি।
অর্থাৎ উল্টা করে বললে ২৮-২৯ টা রাজ্যে এরা যতই স্বাধীন ততই তা নেহরুর মাথা ব্যথার কারণ। সার কথায়, আমেরিকার মত স্বাধীন রাজ্যগুলো স্বেচ্ছায় যুক্ত হচ্ছে, এমন কোনো ভারত-রাষ্ট্রে তারা সংযুক্ত হয়নি। আর আসলে যে কনসেপ্টটা কাজ করেছে সেখানে যে, মাউন্টব্যাটেন নেহরুকে ভারত বলে কিছু একটা দিয়ে গেছেন; অতএব সে কারণেই ভারতের রাজ্যগুলো স্বাধীন নয়, এমনকি পুরানা করদ রাজ্যগুলোও স্বাধীন নয় – জবরদস্তিতে করার এই অনুমানটাই বাস্তবায়ন করেছেন নেহরু। আর সেকালে ভারত রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে এভাবে। এই রাষ্ট্র তাই নিজেই নিজেকে কখনো অন্তত কনষ্টিটিউশনে “ফেডারেল” বলে ব্যাখ্যা করতে বা তুলে ধরতে যায় নাই। তাহলে ভারত কী? এই হলো ভুতুড়ে ভারত ও তার জন্ম!
এখন এই ভূতুড়ে ভারতটা কে? অনেক সময় মনে হবে এটা বোধহয় ‘উত্তর প্রদেশ’ রাজ্য। কেন? কারণ এর এলাহাবাদ শহরে নেহরুরা বাস করতেন। তার বাবা মতিলাল নেহেরু ওকালতি প্র্যাকটিস করতে কাছের বড় শহর হিসেবে (কাশ্মিরি ব্রাহ্মণ তিনি) এলাহাবাদে এসেছিলেন।
[ইলাহাবাদের শহরের সব পুরানা চিহ্ন শেষ করে দিলেও এখনও এটা বড় শহর। যদিও এর নাম বদলে “প্রয়াগরাজ” [Prayagraj] রাখা হয়েছে মোদীর দলের হাতে ২০১৮ সালে। কিন্তু এখনও উত্তর প্রদেশ রাজ্যের সর্বোচ্চ কোর্ট, হাইকোর্টটা “এলাহাবাদ হাইকোর্ট” নামেই ইলাহাবাদ শহরে থেকেই গেছে।]
এখন তাহলে এই উত্তর প্রদেশ নামক এই রাজ্য কী ভারতের বাকি সব রাজ্যের ওপর শাসনকর্তৃত্বের কর্তা? কিন্তু সে ক্ষেত্রেও এই শাসনের ভিত্তি কী, ক্ষমতার উৎস কী, সে প্রশ্ন থাকবে। যার উত্তর কেউ জানে না। তাই এটা ভূতুড়ে! তাহলে কি এটা সেই ইঙ্গিত যে, উত্তরপ্রদেশ মানে এক আর্য-শাসন বুঝতে হবে? তাহলে আর সেটা সবাই মানলেও বাংলা বা দ্রাবিড়ীয়রা তা মানতে বাধ্য কেন?
এসব প্রশ্নের কোনো দিনই কোনো সমাধান হয়নি। উল্টা উত্তর প্রদেশ বা হিন্দিবেল্ট কেন্দ্রিক ভূতুড়ে এক ক্ষমতা, এরই নাম হয়ে গেছে “কেন্দ্র”। কনস্টিটিউশনেই আবার কখনো একে ‘ইউনিয়ন’ বলা হয়েছে বটে বিশেষত জুডিশিয়ারি অংশে। কিন্তু এটা কাদের ইউনিয়ন? ইউনিয়নে যুক্ত হওয়ার আগে কি তারা স্বাধীন ছিল? নাকি ভারত বলে এক ভাববাচক আগাম ভুতুড়ে ধারণাই ছিল মাত্র? তাহলে কারা এক জায়গায় জড়ো বা ইউনিয়নে যুক্ত হচ্ছে? এসবের কোনো জবাব কোথাও নেই। বরং আগেই বলেছি সারা ভূখণ্ডকে ভারত নামের মধ্যে ধরে রাখবেন কী করে, কিসের আঠা লাগিয়ে, এটা ছিল বরং নেহরুর দুশ্চিন্তা। এই ‘আঠা’টারই হল হিন্দুত্ব। যদিও নেহরু ও গান্ধী বুদ্ধিমান, তাই তারা এ কথাটা প্রকাশ্যে কোথায় লিখে বলতে চাননি। আর সে কারণেই সম্ভবত এই কথিত কেন্দ্র এই ভারত, সেটা কথিত ‘সেকুলার’ কি না তাও নেহরু ও গান্ধী রা কোথাও লিখে রাখেননি। ইন্দিরা গান্ধী কেবল ১৯৭৬ সালে এসে “বাংলাদেশের কারণে” তা লিখিয়েছিলেন।
তবে ভারত মানে উত্তর প্রদেশ কিংবা আর্য-শাসন এসব চিন্তা যে নেহেরুর মাথায় কাজ করত এটা অমূলক নয়। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ ১৯৬২ সালের কিছু ঘটনা। সেটা হল, সারা ভারতে হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা ও অফিসিয়াল ভাষা করতে হবে বলে এক সিদ্ধান্ত নেহেরুর সরকার বাস্তবায়ন করতে গেছিলেন। নেহেরুর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় প্রথম প্রতিবাদ বিক্ষোভ বলা হয় এটাকে যা দ্রাবিড়িয়ান রাজ্য থেকে শুরু হয়েছিল। এবং প্রধানত তামিলনারু থেকে। দ্রাবিড়িয়ান রাজ্য বলা হয়, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গনা, কর্ণাটক, তামিলনারু, কেরালা – এদেরকে। এর দুবছর পরেই নেহেরু মারা যান। আর তিনি বেচে থাকতেই এবং পরের প্রধানমন্ত্রী এই ইস্যুতে আপোষ করে মিটিয়ে নেন। আর সেই থেকে ভারতে রাষ্ট্রভাষা বলেই কিছু নাই (এটাই সুপ্রীমকোর্টেরও রায়) তবে অফিসিয়াল ভাষা আছে যদিও সেখানে হিন্দির পাশাপাশি ইংরাজিও যুক্ত করে নেয়া হয়। আসলে এটাই ছিল কম্প্রোমাইজ ফর্মুলা। কিন্তু এখান থেকে এটা পরিস্কার যে কেন্দ্র মানে “আর্য-শাসন” (যেখান থেকে হিন্দি-প্রীতি) ধরণের ধারণায় নেহেরু ভুগতেন। অনেকে মনে করেন নেহেরুর জীবনে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ধাক্কা ও চ্যালেঞ্জ ঘটেছিল প্রায় একই সময়ে ১৯৬২ সালে। প্রথমটা আর্যশাসন সংক্রান্ত সারাভারত হিন্দিভাষা চালু করতে গিয়ে ধাক্কা খাওয়া। আর দ্বিতীয়টা হল ১৯৬২ সালে চীনের ভারত আক্রমণ। আর এই দুই ঘটনার শোকেই তিনি ব্রেনস্ট্রোক করেছিলেন বলে অনেকের বিশ্বাস আর এই ধারণা যে এতে তিনি এই প্রথম নিজের উপর আস্থা হারিয়েছিলেন। আর এর দুবছরের মধ্যে তিনি মারা যান।
আমরা তাহলে এখন আরো ফোকাসে আসি। সেটা হলো, নেহরুর ভারত তাহলে ফেডারেল দূরে থাক, এটা বরং “কেন্দ্র” নামে ভূতুড়ে ক্ষমতার অধীনস্থতায় থাকা সব রাজ্যগুলোতে, যেখানে মূলকথাটা হল, বহুবিধ জায়গা ও সুযোগ রেখে দেয়া যাতে কেন্দ্র রাজ্যের ওপর চাইলেই হস্তক্ষেপ করতেই পারে। রাজ্যের সর্ববিধ শাসন প্রশাসনকে ওভাররুল করে “কেন্দ্র” নামে এক কর্তৃত্বের অধীনে সব তুলে নিতে পারে।
যেমন গভর্নর ব্যবস্থা, এটা করাই হয়েছে যেন যেকোনো সময় “কেন্দ্র” রাজ্যসরকারকে বাতিল করে এর পরিচালনা নিজের হাতে উঠিয়ে নিয়ে আসতে পারে। রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থতি খারাপ – এই বলে গভর্নর রিপোর্ট দিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে পারেন। তাই আসলে গভর্নর মূলত কেন্দ্রের প্রধানমন্ত্রী হস্তক্ষেপের হাতিয়ার। একইভাবে বাজেট বরাদ্দ নিয়ন্ত্রণ অথবা প্রশাসনিক অনিয়ম, দুর্নীতিরোধ ইত্যাদির বিরুদ্ধে ব্যবস্থ নেয়ার প্রতিষ্ঠানগুলো কেন্দ্রের একক নিয়ন্ত্রণে, মানে প্রধানমন্ত্রীর একক ক্ষমতায় রাখা হয়েছে। ফলে এসব প্রতিষ্ঠান ব্যবহার-অপব্যবহার করে [যেমন মমতার] রাজ্য সরকারের উপর প্রধানমন্ত্রীর [মোদীর] হস্তক্ষেপের সুযোগ রেখে দেয়া হয়েছে। আসলে এভাবেই হস্তক্ষেপের মেকানিজম যেন তথাকথিত ভূতুড়ে কেন্দ্রের হাতে থাকে এমন সুযোগ রেখেই সেকালে কনস্টিটিউশন লেখা হয়েছিল; যাতে নেহরু নিজ হাতে সব নিরঙ্কুশ ক্ষমতা নিশ্চিত করতে পারেন।
আবার এ হস্তক্ষেপগুলো আগাম কোন লিখে রাখা ‘রুল বুক’ (বা চাইলে তা সংসদে পাশ করে নিয়ে রাখা) মেনে চলা হোক, তা সেভাবে রাখাই হয়নি। বরং রাখা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তি বা সাবজেকটিভ ইচ্ছার উপর। কাজেই রাজ্যকে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিইচ্ছার অধীন হতে হবে রাজ্যকে, সোজা কথায় ‘তেল মারতে হবে’। এমনিতেই রুল বুক বা প্রশাসনের বিজনেস রুল বুকের অধীনে না থাকা কোনো ক্ষমতা মানেই তা ভয়াবহ এক দানবীয় হতে বাধ্য। কারণ কোন “রুলবুকের” অধীনে লিখিত এই না থাকার মানেই হলো চরম অরাজকতা। কারণ কেউ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হলেই তার ক্ষমতার প্রয়োগের ব্যাপারটাকে তার ব্যক্তিখেয়ালের হাতে কোনোভাবেই ছেড়ে দেয়াই যায় না। রুল বুকের স্ট্যান্ডিং গাইডলাইন অবশ্যই থাকতে হবে। অথচ তা নেই, রাখা হয়েছে সাবজেক্টটিভলি বা অবাধ ব্যক্তি খেয়ালে।
মোদী-মমতা বা কেন্দ্র-রাজ্য বিবাদঃ
এবারের রাজ্য নির্বাচনে দলের হারার পর মোদীর আচরণ ও তৎপরতা বলছে তিনি মমতার সাথে সঙ্ঘাতেই থাকতে চান। অনেকটা যেন তিনি বলতে চান, নেহেরু মহাশয় প্রধানমন্ত্রীর হাতে এসব অবাধ হস্তক্ষেপের বহুবিধ সুবিধা দিয়ে গেছেন। ফলে কংগ্রেস তাকে কিছু বলতে পারবে না। কাজেই তিনি সেসব সুবিধা বিজেপি দলের স্বার্থে ব্যবহার করবেন না কেন? যেমন সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় পরবর্তি পরিস্থতিকে তদারকির উছিলা করে মোদী মমতার সাথে এক মিটিংয়ে বসতে চান বলে ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। কিন্তু মোদীর ইচ্ছা সেখানে তিনি রাজ্য বিরোধীদলের নেতা হিসেবে তার দলের লোককেও উপস্থিত রাখবেন এবং এতে সম্ভবত দলীয় কর্মীদের দেখাবেন যে কলকাতার বিরোধী নেতাও অনেক ক্ষমতা রাখেন। এখন এই প্রসঙ্গে মমতার দাবি, মোদী এই ব্যাপারটা একা ঠিক করতে পারেন না যে, রাজ্য থেকে সচিব ও প্রশাসনিক স্টাফসহ সাথে আর কোন কোন জনপ্রতিনিধি তাদের দুজনের সভায় উপস্থিত থাকবেন। আর এসব বিধি বা কনস্টিটিউশনে নেই বলে দাবি করেছেন মমতা।
এমনিতেই এটা দৃষ্টিকটু যে প্রধানমন্ত্রী ব্যুরোক্র্যাট আর মুখ্যমন্ত্রীর মতো জনপ্রতিনিধিকে একই প্রটোকলে ট্রিট করছেন। এর উপর সবখানেই মোদীর এটা প্রদর্শনের ইচ্ছা যে, মুখ্যমন্ত্রী যেন প্রধানমন্ত্রীর এক অধীনস্থ প্রশাসনিক স্টাফ! এমনিতেই নেহরু কথিত কেন্দ্রের হস্তক্ষেপের বহুবিধ সুযোগ রেখে দিয়ে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক সাজিয়ে গেছেন। কারণ তার অযথা ভয় থেকে অযাচিত ক্ষমতার চর্চা যে রাজ্য যদি কেন্দ্রের কথা না শুনে; তাই সবসময় রাজ্যকে দাবড়ে রাখার সব মেকানিজম, দ্বৈত ক্ষমতাকর্তৃত্ব-ব্যবস্থা- এসবই হবে এর হাতিয়ার। এর উপর মোদী নিজেই মমতাকে একটা শিক্ষা দিয়ে অধীনস্থতায় আসতে বাধ্য করতে চাচ্ছেন। তাই সব মিলিয়ে এটা ভয়াবহ।
এখন মমতা ওই সভায় রাজ্যের প্রধান সচিবকে সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু ইচ্ছা করেই সম্ভবত কেবল মোদীর সাথে সাক্ষাৎ করেই, কোনো মিটিং না করেই ফিরে চলে আসেন। শুধু তাই নয়, নিজ রাজ্যের মুখ্যসচিবকেও সাথে নিয়ে মোদীর মিটিং বর্জন করে চলে আসেন।
স্বভাবতই এটা মোদির জন্য অপমানবোধের। তিনি মুখ্যসচিবকে শোকজ করেন এবং দিল্লিতে এসে রিপোর্ট করতে বলেন। কিন্তু মুখ্যসচিব এর জবাবে লিখেন, তিনি মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে মানে কথা শুনেই মোদীর ওই সভায় থাকতে পারেন নাই। অর্থাৎ তিনি যেন বলছেন, আমিও কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারী অবশ্যই। কিন্তু আমার বর্তমান রিপোর্টিং জনপ্রতিনিধি হলেন মুখ্যমন্ত্রী; প্রধানমন্ত্রী নন। কাজেই মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশকেই তাকে ফলো করতে হয়েছে। অর্থাৎ এটাও আসলে এক দ্বৈত ক্ষমতা ব্যবস্থার পরিণতি এবং তা ব্যুরোক্র্যাসিতে।
এতে যে নতুন জিনিষটা সামনে এসেছে তা হল, এতদিন মনে করা হত কেন্দ্র-রাজ্য বিবাদের ইস্যুটা বোধহয় কেবল রাজনৈতিক। ফলে রাজনৈতিক নেতাদের কেবল এতে সংশ্লিষ্ট হবেন বা সাফার করবেন। কিন্তু না। এবার প্রমাণ হল যে বুরোক্রাসির সব অফিসারেরাও (ভারতে কেন্দ্রীয় ও রাজ্যের ) এর মধ্যে সংশ্লিষ্ট হবেনই এবং তাদেরকে পক্ষও নিতে হবেই। আসলে এভাবে একসময় সারা ভারতই অনুভব করবে যে সকলের সরাসরি স্বার্থ জড়িয়ে আছে এই ইস্যুতে। দেখা যাচ্ছে বুরোক্রাসিও এখন এই তর্কে পক্ষ নিচ্ছেন। যদিও এখনও অনেকেই রাষ্ট্রগঠন ব্যাপারটা বুঝেন না বলে ভেবেছেন ভারতের এই দুঃখ বোধহয় বুরোক্রাসির সীমাবদ্ধতা। শ্যাম সরণ একজন অবসরে যাওয়া ক্যাডার কূটনীতিক ও সাবেক নিরাপত্তা উপদেষ্টা। তাঁর ভাবনায় এই সংঘাতের পলিটিক্যাল ত্রুটি বা সীমাবদ্ধতাটা দেখতে চান নাই বা তার চোখেই পরে নাই হয়ত। তাই তিনি এটাকে বুরোক্রাসির রিফর্ম করেই রাজনৈতিক চিন্তা বা রাষ্ট্রগঠন-বিষয়ক রাজনীতিবিদদের চিন্তার ঘাটতির সমাধান করে ফেলবেন ভেবেছেন। যা একটা ফলস অনুমান।
এমনিতেই সবখানে জাতিবাদ বিশেষ করে জাতিগত-শ্রেষ্ঠত্ববাদের তোড়ে ভারত ডুবছে। এর ওপর তাদের আরেক ভ্যানিটি হল, ভারতের ব্যুরোক্র্যাসি নাকি ‘স্টিলের তৈরি’, [Anarchy, dents Sardar Patel’s IAS steel frame’ ] তাই এটা এতই শক্ত। আর এর ক্রেডিট হল নাকি সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের যিনি এর প্রণেতা, মন্ত্রী। প্যাটেল, তিনি মহাত্মা গান্ধীর মতই এক গুজরাটি লোক ও বাসিন্দা। তাই মোদী গুজরাটে তার রেকর্ড উঁচু (৫৯৭ ফুট) এক স্ট্যাচু বানিয়ে নিজেই আরো বিখ্যাত হওয়ার চেষ্টা করেছেন। আর সেই প্যাটেল হলেন আবার নেহরুর সব আকাম বা জবরদস্তি ঘটানো যে কোনো কাজের ডানহাত। যেমন ১৯৪৭ সালে সেনাবাহিনী পাঠিয়ে করদ রাজাদের ভারতে অন্তর্ভুক্ত হতে বাধ্য করার নেতা তিনি ছিলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে।
এখন বাস্তবে এই স্টিলের ব্যুরোক্র্যাসির যে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতা চর্চার দিক থেকে মূলত এক দ্বৈত শাসনব্যবস্থা আর সেটাই ভেঙে পড়তে যাচ্ছে তা বুঝতে পারা বা বিপদ অনুভব করার কেউ আছেন এমন দেখা যাচ্ছে না।
কাজেই এভাবে চললে মোদীর টার্ম শেষ হতে হতে ২০২৪ সাল নাগাদ নেহরুর ছাপ মারা এই ভারত মানে, এই নেহরুভিয়ান ভারতরাষ্ট্র তার জন্মদুর্বলতায় ক্রমেই আরো কয়েক ধাপ ভাঙনের দিকেই এগিয়ে যাবে। এর সোজা প্রকাশ আমরা দেখতে পাবো পরবর্তীতে কথিত কেন্দ্রীয় সরকার গঠনে। আমরা হয়ত দেখব, কোনো সর্বভারতীয় দল যেমন কংগ্রেস বা বিজেপি – এরা আর কেন্দ্রে সরকার গড়তে পারছে না। আঞ্চলিক দলের কোয়ালিশনই একমাত্র ভরসা হিসেবে উঠে আসার সম্ভাবনাই বড় হবে।
এটাই রাষ্ট্র ভেঙে পড়ার পূর্বাভাস। এমনিতে রাষ্ট্র ভেঙে পড়া মানেই তা খারাপ, তা কিন্তু নয়। কারণ গড়তে গেলে তো আগে তা ভাঙতেই হবে। কিন্তু এটাই বিরাট বিপদের হবে যখন ভাঙার পরে গড়বেন কিভাবে, কী গড়তে চান, এ নিয়ে আপনি একেবারেই অপ্রস্তুত ও পরিকল্পনাহীন! সারা ভারতের দশা আবার এটাই বলে মনে হয়!
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
[এই লেখাটা গত ৫ জুন ২০২১, দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ওয়েবে ও পরদিন প্রিন্টে “নেহরুভিয়ান এক গুপ্ত-হস্তক্ষেপের রাষ্ট্র“ – এই শিরোনামে ছাপা হয়েছিল।
নয়াদিগন্তে ছাপা হওয়া লেখাগুলোকে আমার লেখার ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ বলা যায়। আর আমার এই নিজস্ব সাইটের লেখাটাকে সেকেন্ড ভার্সান হিসাবে এবং থিতু ভাষ্য বলে পাঠক গণ্য করতে পারেন। পরবর্তিতে ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ লেখাটাকেই এখানে আরও অনেক নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে ও নতুন শিরোনামে এখানে আজ ছাপা হল। ]