বাইডেনকে চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের খরচ দিবে কে?
গৌতম দাস
২১ জুন ২০২১, ০০:০৬ সোমবার
G7 summit Cornwall, UK. – 11-13 June
জো বাইডেন মার্কিন প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার শপথ নেয়ার চার মাসের মাথায় চীনের বিরুদ্ধে জি-৭ জোট (১১-১৩ জুন বৃটেনে G7 summit Cornwall ) আর ন্যাটোকে (১৬ জুন সামিট) দিয়ে আসলে যুদ্ধের হুমকি দিয়েছেন। বিশেষ করে ন্যাটোর জন্ম ম্যান্ডেটের আর্টিকেল ফাইভ এর রেফারেন্স তুলেছেন যা আসলে একেবারেই যুদ্ধ ও আক্রান্ত সংক্রান্ত। মানে ন্যাটোর ৩০ রাষ্ট্রের কেউ আক্রান্ত হলে বাকি সবাই তা নিজের উপর আক্রান্ত মনে করতে বাধ্য। অথচ দুনিয়াতে কোথাও কোন যুদ্ধের ইঙ্গিত না থাকলেও প্রথম আগ বাড়িয়ে যুদ্ধের প্রসঙ্গ তুলে বাইডেন কথা বলে গেলেন। এটা চরমভাবে অযাচিত। এটা দায়ীত্বজ্ঞান সম্পন্ন নয় অবশ্যই। সব চেয়ে ট্র্যাজিক ব্যাপারটা হল, বৈষয়িক উন্নয়নজনিত চীনের গ্লোবাল প্রভাব বৃদ্ধিকে বাইডেন যুদ্ধের ভয় দেখিয়ে মোকাবিলা করতে চাইলেন! এটা কী দুটা সমতুল্য ফেনোমেনা? না ফিট করে? না অর্জনযোগ্য?
আর এতে ক্ষুব্ধ চীন বলেছে, “কয়েকটি ছোট দেশের জোট দুনিয়ার ভাগ্য নির্ধারণ করার দিন শেষ” [সেই দিন অনেক আগেই শেষ: জি–৭–কে চীন – প্রথম আলো]।
[Before the G7 criticism emerged, China pointedly cautioned G7 leaders that the days when “small” groups of countries decided the fate of the world were long gone.]
তবে বাইডেনের ওই সব কথাবার্তা একেবারেই অপ্রস্তুত থেকে বলা। কারণ ঠিক কোথায় কিভাবে তিনি পৌঁছাতে চান, তাতে আমেরিকার লাভ কী? অথবা বলা যায় সেটি সম্ভব কি না, আমেরিকার সেই মুরোদ এখনো আছে কি না, এসব নিয়ে হোমওয়ার্ক যথেষ্ট করেছেন কি না, এসব প্রশ্নের জবাব বাইডেনের সাথে আছে, তা তার পদক্ষেপের মধ্যে ছাপ বা প্রমাণ নেই।
যেমন, বাইডেন আজ ন্যাটোর হুমকি দিতেছেন? অথচ তার কী মনে নেই, কেন ওবামা ইরানের সাথে ২০১৫ সালে আপস করেছিলেন? ইরানের উপর ১৯৭৯ সাল থেকে আরোপিত নানা অবরোধ ওবামা তুলে নিয়েছিলেন আর, ‘P5+1’ [ইউরোপের সাথে মিলে আর জাতিসংঘকে সংশ্লিষ্ট রেখে] এর পারমাণবিক চুক্তি করেছিলেন – কেন? কারণ ইরাকে আইএসের নতুন তৎপরতা ও দখলদারি শুরু হলেও তাতে আমেরিকার খরচ বইবার মুরোদ ছিল না বলে সে আবার ইরাকে সৈন্য পাঠাতে পারছিল না। আর ইরাকে আই এস দমনের কাজটাই ইরানি সেনাবাহিনী করে দিবে বলে এর বিনিময়ে তিনি আপস করেছিলেন, পারমানবিক চুক্তি করেছিলেন। ইরানের উপর অবরোধের অবসান করেছিলেন। কাজেই এখন ন্যাটোকে দিয়ে চীন-রাশিয়াকে হুমকি দিবার আগে বাইডেনের উচিত ছিল তিনি এমন যুদ্ধ হলে এখন এর ব্যয়ভার বইতে সক্ষম কেন ও কিভাবে সেটা আগে দেখানো। এটাই হত সবচেয়ে স্বাভাবিক আর তা না দেখানোতে তাঁর উপস্থিতিতে ন্যাটোর দেয়া বিবৃতিতে এই হুমকি একটা ফাঁকা হুমকি হিসাবে হাজির হবেই। এসব ফাঁকা বুলি ছেড়ে কী লাভ? আমেরিকা কী মানুষের হাসাহাসির পাত্র হতে পণ করেছে?
নরম-হালকা ভাষায় বললে এটা চীন-আমেরিকার বাণিজ্য বিরোধ বা বড় জোর বাণিজ্যযুদ্ধ বলা শুরু হয়েছিল, যা চলে আসছে কেবল ট্রাম্প আমল থেকে এ পর্যন্ত। কারণ ওবামা আমল পর্যন্ত এটা বিরোধ বা বাণিজ্যযুদ্ধ হিসেবেও দেখা দিতে দেয়া হয়নি। তবে ওবামা পরপর দুবারই (২০০৯ ও ২০১৩ সালে ) প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর চীন সফরে গেছেন আর চীন তাকে একগাদা বাণিজ্য সুবিধা হাতে ধরিয়ে দিয়েছে আর তা দিয়েই সেটা আর কখনো বিরোধ বা কোনো বাণিজ্যযুদ্ধ হিসেবেও হাজির হয়নি। এমনকি ট্রাম্পের প্রথম বছরেও (২০১৭) তিনি এমনই ভাবে সফরে গিয়ে আরো বাণিজ্য সুবিধা নিয়ে ফিরেছিলেন। এমনকি সেবছর কোয়াডকে [QUAD] জন্ম দিয়েও সে ঘটনাকে লঘু-বিষয় করে রেখেছিলেন। একসাথে সদস্যরা সবাই মিলে একটা বিবৃতি দিতে পারেন নাই ও দেন নাই। কিন্তু পরের বছর (২০১৮) থেকে আর ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’ টার্মটা ব্যবহার না করে পারেনি। তাহলে এটা কী ব্যক্তি ট্রাম্পের জাতিবাদী ভাব নিয়ে আগানোর সমস্যা, নাকি এটি অনিবার্য ছিল? জবাব হল, এটি অবশ্যই অনিবার্য ছিল। তবে ট্রাম্পের বোকা আমেরিকান জাতিবাদ এ্টাকে সহজ করবে মনে করে করতে গিয়ে ব্যাপারটাকে আরও জটিল করে তুলেছিলেন।
১৯৬৯ সাল থেকে নিক্সন-কিসিঞ্জারও জানতেনঃ
আসলে এটা যে অনিবার্য তা ১৯৭০-৭১ সাল থেকে নিক্সন-কিসিঞ্জারও জানতেন। আসলে এটা আরো আগে ১৯৬৯ সাল থেকে যখন, চীন-আমেরিকা পরস্পরকে স্বীকৃতি না-দেয়া এক দশা-অবস্থা থেকে আজকের এই গভীর সম্পর্ক পাতানো-পৌছানোর লক্ষ্যে সেকালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আয়ুব খানের মাধ্যমে প্রথম চীন-আমেরিকা উভয়ের কাছে পরস্পরের প্রস্তাব ও মনোভাব পৌছে দিয়েছিলেন তিনি। পরবর্তিতে তা পেকে উঠলে সেটা হল আমরা যখন ১৯৭১ সালে রিফুজি হয়ে ভারতে আশ্রয় খুঁজছি সেই একাত্তরের জুলাইয়ে হেনরি কিসিঞ্জার পাকিস্তান সফরের নামে প্রথম গোপনে চীন সফরে গিয়েছিলেন। তিনিই নিক্সনের সফরের বন্দোবস্ত করে আসেন। ফলে মাওয়ের বিপ্লবের চীন সফরে যাওয়া প্রথম কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট হলেন নিক্সন। তিনি ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে চীন সফরে যান। আর সেই থেকে সেকালের বিনিয়োগ-খরায় থাকা চীনে বিনিয়োগ নিয়ে হামলে পড়ার সুযোগ পেয়ে আমেরিকার বিনিয়োগপাড়া ওয়ালস্ট্রিট হয়েছিল সবচেয়ে খুশি।
কিন্তু সে দিনও ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ সবাই জানতেন এই সুখ সাময়িক। কারণ এতে একদিন চীনই বড় হয়ে এই আমেরিকাকেই চ্যালেঞ্জ জানাবে। কিন্তু সেসব ভুলে বিনিয়োগ গ্রাহক চীনের বিশাল বাজার তাৎক্ষণিকভাবে আমেরিকাকে বিশাল লাভালাভ রিলিফ দেবে, কত কী পাওয়া যাবে – এটিই ছিল মুখ্য বিবেচনা।
মনে রাখতে হবে, ক্যাপিটালিজমের আদি এবং অনিবার্য স্ববিরোধ হল, সে নিজেই ক্রমেই নিজ বাজার সঙ্কুচিত করবেই। তাতে আবার একসময় নতুন বাজার পাওয়ার সঙ্কটে পুরনো মালিকরা দিশেহারা হবেন আর নতুন উত্থিত মালিক তাকে চ্যালেঞ্জ করবেনই। তাই বলছি, সেই ১৯৭২ সাল থেকেই সবাই জানত আজকের এদিন আসবেই। এমনকি এখনকার ওয়ালস্ট্রিটের লিডার (গোল্ডম্যান স্যাক্সে) সহ বুদ্ধিমানেরা তাই ইতোমধ্যেই আমেরিকান রাষ্ট্র-ভক্তি ছেড়ে চীনা রাষ্ট্রের ভক্ত-পরামর্শক হয়ে গেছেন।
বাইডেন এবারের জি-৭ মানে ধনী সাত দেশের এক ক্লাবের বৈঠকে যোগ দিতে আয়োজনস্থল ব্রিটেনের কর্নওয়ালে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেকালের জি৭ আর সত্যিকারভাবে তেমন ধনীদেশ নয়। আজ তাদের চেয়েও ধনীদেশ জি৭ এর বাইরেও আছে। আসলে জি-৭ হল সেকালের গ্লোবাল নেতা আমেরিকার একক সিদ্ধান্তগুলো ইউরোপের সাথে সমন্বয় করে নেয়ার লক্ষ্যে এক সভা যাতে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকসহ গ্লোবাল প্রতিষ্ঠানগুলোতে এক স্বরে পশ্চিমাদেশগুলো যেন কথা বলে বাকি রাষ্ট্রের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে পারে।
আমেরিকার কাগুজে ডলার ছাপানো শুরু বা গোল্ড ক্রাইসিস ১৯৬৮ঃ
আসলে এটা ছিল সেকালের আমেরিকার ইউরোপ তোষণ বা ক্ষুব্ধ ইউরোপকে তেল মারা। কেন? কারণ আমেরিকা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছিল। ব্যাপারটার আনুষ্ঠানিক দিক থেকেই যদি বলি ১৮ মার্চ ১৯৬৮ আমেরিকান কংগ্রেস একটা আইন পাস করেছিল যে ডলার ছাপতে গেলে আগে সম-পরিমাণ সোনা ফেড-এর ভল্টে রিজার্ভ রাখতে হবে [Gold backed currency] এই শর্ত প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। আর এতেই লন্ডনের সোনার বাজারে হাহাকার পড়ে যায়। অর্থাৎ আইওএমএফ-বিশ্বব্যাংক জন্মের সময় ডলার Gold backed currency থাকবে। তাই এর ফিক্সড বিনিময়মুল্য ছিল যে এক আউন্স সোনা সমান ৩৫ ইউএস ডলার। গ্লোবাল বাণিজ্যের এই মৌলিক বুঝাবুঝি এতে ভেঙ্গে পড়েছিল। আর সত্যিকারভাবে কার্যত বেশি কাগুজে ডলার ছাপানো শুরু করেছিল ১৯৫৬ সাল থেকে যেটা ১৯৬৮ সালে এসে আমেরিকান কংগ্রেস এই অন্যায় কাজের স্বীকৃতি দিয়েছিল।
আর তা থেকে ক্ষুব্ধ ইউরোপকে ঠান্ডা করতে আমেরিকা এই প্রথম নিজের নেয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আগে তা ইউরোপের সাথে শেয়ার করতে সম্মত হয়ে ১৯৭৩ সালে জি-৭ গ্রুপের জন্ম দিয়েছিল । কারণ কাগুজে ডলার ছাপানোতে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংককে পুণজন্ম দিয়ে ম্যান্ডেট আমার লিখে নেয়া ছাড়া উপায় ছিল না। কারণ এদের ম্যান্ডেট লেখা হয়েছিল ডলার – Gold backed currency এই ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে। তাই ঐ ১৯৭৩ সাল থেকেই জি৭ এর জন্ম। তবুওও জন্মের পর থেকে এভাবে জি-৭ নামে বসাবসির ব্যাপারটা একেবারেই ইনফরমাল। মানে হল যেমন, বিশ্বব্যাংকের উপরে কোনো ফরমাল মাতব্বরি প্রতিষ্ঠান জি-৭ নয়।
এভাবে সত্তরের দশক থেকে জি-৭ এর শীর্ষ বৈঠক ব্যবস্থা চলে এলেও এবারই প্রথম চীনকে পশ্চিমা দেশগুলো তাদের যেন এনিমি করে দেখেই কিছু কথা বলেছে; এমনকি গত ২০১৮ সালের সম্মেলনেও তারা চীন অথবা অন্য কারও নাম উল্লেখ করেনি [Although senior U.S. officials highlighted the references to Beijing, noting that “China wasn’t even explicitly mentioned” in the 2018 G7 communique despite]।
জি-৭ ফ্যাক্টসশিট -FACT SHEET: President’s WHITE HOUSE
এবারের জি-৭ বৈঠক উপলক্ষে হোয়াইট হাউজ থেকে এক ফ্যাক্টসশিট বুলেটিন বের হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ‘বাইডেন চীনের সাথে কৌশলগত প্রতিযোগিতা’ […to discuss strategic competition with China ] প্রসঙ্গে এখানে জি-৭ বৈঠকে নেতাদের সাথে আলোচনা করেছেন। অর্থাৎ চীনের নাম নিয়েই কথাটা তিনি বলেছেন। আবার দ্বিতীয়ত তিনি চীনকে ঠিক শত্রু দেশ বলেননি; বলেছেন যার সাথে তার “কৌশলগত প্রতিযোগিতা” [strategic competition] আছে, এভাবে মোলায়েম করে বলেছেন। অর্থাৎ এবার স্বীকার করে নিলেন চীনের সাথে আমেরিকার কৌশলগত প্রতিযোগিতার সম্পর্ক আছে। কিন্তু সে কথা এবারই প্রথম বলা হল কেন?
আগেই বলেছি, ১৯৭২ সাল থেকে চীন তো আমেরিকার কাছে খুবই আদরের দেশ ছিল। কারণ চীন ছিল সবচেয়ে বড় জনসংখ্যার বড় এক “ঋণ খাতক” দেশ। আর সেই সাথে আমেরিকার হাইটেক পণ্যের আমদানি দেশ। কিন্তু সেই চীনই ২০১০ সালের পর থেকে হয়ে যায় সরাসরি আমেরিকার বাণিজ্যবিরোধের দেশ আর আমেরিকার গ্লোবাল নেতা থাকার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বি ও চ্যালেঞ্জার। যেখান থেকে আজ চীন গ্লোবাল অর্থনীতির নেতৃত্ব আগামীতে আমেরিকা্র থেকে কেড়ে নিতে চায় যে সেই দেশ। তাই এই প্রথম লজ্জার মাথা খেয়ে বাইডেন স্বীকার করেছেন যে, চীন আমেরিকার সাথে কৌশলগত প্রতিযোগিতামূলক সম্পর্কে আছে। ফলে সরাসরি না হলেও নাম উল্লেখ করে স্বীকার করে নিলেন চীনের কাছে আমেরিকা নেতৃত্ব হারাতে যাচ্ছে, তাই ‘কৌশলগত প্রতিযোগী’।
এখন প্রশ্ন হলো আমেরিকা প্রতিযোগিতা করার যোগ্য কী? কতটা? জবাব হলো, না একেবারেই যোগ্য নয়। কারণ আমেরিকা চীনের কাছে হেরে যাবে। ঠিক যেমন এককালে ব্রিটেনও আমেরিকার কাছে হেরে গিয়েছিল। কারণ বিষয়গুলো অবজেকটিভ ফেনোমেনা বা ঘটনা। ক্যাপিটালিজমের কপাল বা পরিণতিই এমন! যেমন এখন পশ্চিমা একাদেমিকদেরই পুর্বাভাস হল ২০২৮ সালের মধ্যেই চীন আমেরিকান অর্থনীতিকে ছাড়িয়ে গ্লোবালি বড় অর্থনীতির দেশ হতে যাচ্ছে।
এককালে আমেরিকায় কলোনি দখলকারী ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরা যেসব গরিব ব্রিটেনবাসীকে বিনা পয়সায় জাহাজ ভরে সেখানে নিয়ে গিয়েছিল সেখানে চাষাবাদের জমি ও সিড-মানি [seed money] দেয়ার লোভ দেখিয়ে – পরে ১৭৭৬ সালে ঐ গরিব ও চাষাবাদ করে খাওয়া লোকেরাই কলোনি দখলকারী ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের সশস্ত্রভাবে উৎখাত করে নিজেদের আমেরিকাকে স্বাধীন ঘোষণা করেছিল। এরও পরে ১৮৮২ সালের পর থেকে আমেরিকা ক্যাপিটাল একুমুলেশনের [surplus accumulation] বা উদ্বৃত্ত সঞ্চিত সম্পদের দিক থেকে ব্রিটেনকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এথেকেই পরে ১৯৪৫ সালে মহাযুদ্ধ শেষে আমেরিকাই গ্লোবাল নেতা হয়ে যায়। ঠিক যেন একইভাবে এখনকার পূর্বাভাস হল, ২০২৮ সালে চীন আমেরিকাকে ছাড়িয়ে দুনিয়ায় সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ হয়ে যাচ্ছে। আর এটাই হবে চীনের গ্লোবাল নেতা হয়ে উঠতে আরও বড় একধাপ আগানো।
অথচ ক্ষমতায় এসে এখন বাইডেন যে সিদ্ধান্ত নিলেন সেটা এক অবাস্তব স্বপ্ন-কল্পনার দিকে যাত্রা। সে্টা হল, আমেরিকা নাকি আবার দুনিয়াকে শাসন করেই যাবে [……glad America is back]। সে জন্যই গত নির্বাচনের সময় থেকে এবং জিতার পরও এখন তার স্লোগান হল ‘আমেরিকা ইজ ব্যাক’। না এটা আমেরিকার (নেতাগিরিতে) ফেরত আসা নয়, বরং বাইডেন মানে ডেমোক্র্যাটরা ক্ষমতায় ফিরে এসেছেন, মাত্র। আমেরিকা নয়। এভাবেই বলেছেন সিএনএন বা ওয়াশিংটন পোস্টের কলামিস্ট ফরিদ জাকারিয়া। কারণ তিনিও বিশ্বাস করেন নাই। লিখেছেন, Under Biden, American diplomacy is back. But America isn’t. । অতএব, সোজাসাপ্টা বললে বাইডেন মিথ্যা আশ্বাসের স্লোগান দিচ্ছেন।
তা হলে তিনি সঠিক কী করতে পারতেন? বাইডেনের নেতৃত্বে আমেরিকা চীনকে নেতা মেনে নিতে প্রস্তুত হয়ে নিজের অবস্থান যতটা সম্ভব ভালো ও উঁচুতে ধরে রাখার চেষ্টা করে যেতেন অর্থাৎ পরিস্থিতিকে অন্তত খামোখা যুদ্ধ-সঙ্ঘাতের দিকে ঠেলে দেয়া নয়। কারণ পরিস্থিতিকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়ার মানে হবে, স্বাভাবিক অবস্থায় যদি আমেরিকার দ্বিতীয় অবস্থানে থাকার সুযোগ থাকে তবে সেটাকেই নষ্ট বা নড়বড়ে করে ফেলা হয়ে যেতে পারে।

বাইডেনের উপস্থিতিতে ন্যাটো, বুড়া হাড়ে জওয়ানিঃ
কিন্তু কেন আমরা যুদ্ধের কথা তুলছি? বাইডেন তো কেবল চীনের সাথে “স্ট্রাটেজিক প্রতিযোগিতার” কথা বলেছেন, যুদ্ধের কথা তো বলেননি!
হ্যাঁ, জি৭-এর বেলায় এটুকু আপাত-সত্য হলেও বাইডেন আরেক কিছু বড় আকাম করেছেন। যেমন একই নিঃশ্বাসে তিনি প্রায় নাই (ট্রাম্পের প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রায় ঘোষণাই করে দিয়েছিলেন ন্যাটোর প্রয়োজন ফুরিয়েছে) হতে যাওয়া ন্যাটোর (সেক্রেটারির) সাথে মিটিং করেছেন; জি-৭ এর সভা শেষের এক দিন পরে। আর সেখান থেকেই যুদ্ধের উসকানিমূলক কথা বা হুমকি দিয়েছেন। এমনিতেই এটি ছিল বাইডেনের ‘এক ঢিলে অনেক পাখি মারা’র সফর। কারণ তিনি ব্রাসেলসে গিয়ে ইইউ-আমেরিকার শীর্ষ বৈঠকও করে নিয়েছেন আগের দিন। পরের দিন ন্যাটোতে তিনি হাজির। আসলে একদিকে জি-৭, ন্যাটো বা ইইউর সাথে বৈঠক মানে হলো, মূল টপ সাত-দশ রাষ্ট্রনেতার সাথে তিন ফোরামেই বসা মিটিং। একই লোক অথচ ফোরামগুলো ভিন্ন।
ফলে জি-৭ এর বৈঠক থেকেই সব কিছুতে আলোচনার মুলইস্যু হল চীন। আবার বাইডেন ন্যাটোতে এলে ন্যাটোর দেয়া বিবৃতি লিখছে যে, ‘চীনের উচ্চাকাঙ্খা ও চাপানো আচরণ তাদের অ্যালায়েন্সের নিরাপত্তাকে সিস্টেমেটিক চ্যালেঞ্জ (systemic challenges) করছে বিশেষত তাদের আন্তর্জাতিক নিয়ম আইনের প্রতি অনুগত থাকার বিরুদ্ধে” ।
“China’s stated ambitions and assertive behaviour present systemic challenges to the rules-based international order and to areas relevant to alliance security,” the statement said. …… “rapidly expanding its nuclear arsenal, with more warheads and a large number of sophisticated, sophisticated delivery systems”, as well as its military cooperation with Russia and its “use of misinformation”.
এ ছাড়া ন্যাটোর আরো অভিযোগ হল, চীন-রাশিয়া মিলে কেবল পারমাণবিক অস্ত্রের ঢিবি বানাচ্ছে। অর্থাৎ সার কথায় বাইডেন চীনের সাথে আমেরিকার বিরোধকে সামরিকভাবে লড়ার দিকে ঠেলে দিতে চান এই পরিষ্কার ইঙ্গিত এখানে আছে। আর ন্যাটো এই প্রথম যে অজুহাতে ইন্দো-প্যাসিফিক বা কোয়াড জোট গড়া হয়েছিল তা এখন বাইডেনের উপস্থিতির সভা থেকে সেটা ন্যাটোরও অজুহাত হয়ে গেল। কী সেটা?
বাইডেন ও তাঁর বন্ধুদের rules-based international order, এই কথার মানে কীঃ
ঘটনা হল, আপনি যদি কারো বাসার প্রধান প্রবেশমুখ কোন অজুহাতে বাধা বা ব্লক খাড়া করতে যান তবে সেটা আপনার আইনি বা বেআইনি যে যুক্তিতেই হোক তাতে ঐ বাড়িওয়ালা আপনার ততপরতাকেই উলটা উৎখাত করবেই। ভৌগলিকভাবে চীনের কেবল উত্তর-পূর্ব দিকটাই সমুদ্রের দিকে খোলা। বাকি সাড়ে তিন দিকে এটি একেবারেই ল্যান্ডলকড এবং উত্তর ও পশ্চিম দিকটাতো পুরাপুরি হিমালয়-সহ অন্যান্য পর্বতমালায় ঘেরা। এখন আমেরিকার সিনেটের পেশ করা লিখিত পরিকল্পনায় দেখা গেছে মালাক্কা প্রণালী বন্ধ করে দিয়ে চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধকৌশল্গত পরিকল্পনা পেশ করা হয়েছিল।
ম্যাপে দেখা যাবে মালাক্কা প্রণালী [Strait of Malacca] হল আরব সাগর থেকে তেল নিয়ে চীনের সমুদ্র উপকুলে পৌছাবার পথে এই প্রণালী হল এক চিকন পথ, যাকে প্রণালি বা Strait বলা হয় আর যা ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার ভুমি দিয়ে দুদিক থেকে ঘিরে ধরা। এই প্রণালিতে কোন একটা জাহাজ আড়াআড়ি করে ফেলে রাখলেই এই পথে জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দেয়া যায়। তাই আমেরিকান যুদ্ধকৌশলে খুবই পেয়ারের জায়গা মনে করা হয় মালাক্কা প্রণালীকে।
আবার চীনে সমুদ্রপথের একমাত্র প্রবেশমুখের চার দিকে প্রায় ১০টি দেশের সাথে সামুদ্রিক সীমানা আছে। আর বলাই বাহুল্য তা আন-ডিমার্কেটেড। জাতিসঙ্ঘের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান [UNCLOS, United Nations Convention on Law of Sea ] আছে যারা এসব বিরোধ মীমাংসার সালিস করে দেয়। তবে এটি আমাদের রাষ্ট্রের আদালত বা জুডিশিয়ারি ব্যবস্থা নয়। এটা আসলে আরবিট্রেশন অর্থাৎ যেটাকে আমরা গ্রামের সালিসি বা আপসে মীমাংসা বৈঠক বলি, এটা তাই। যেমন মিল মিশে ভাগবাটোয়ারা করে দেয়া তাই এখানে কে অপরাধী তা খুঁজা বা শাস্তি দিবার ব্যাপার নাই। যেমন এখানে দুই পক্ষেরই বিচারক নিয়োগ দেয়ার সুযোগও থাকে।
এখন এই আনক্লসের সালিস আদালতে কেবল চীন-ফিলিপাইনের সমুদ্র সীমানাবিরোধের কেসটাই উঠেছিল। তাতে এই জাপানি বিচারকের ব্যাপারে আপত্তি তুলে, তাকে বদল করে অন্য বিচারক দেয়ার আবেদন করেছিল চীন, যা মানা হয়নি। তাই ক্ষুব্ধ চীন সেই থেকে বিচার কার্যক্রম থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়। আর এতে ব্যাপারটা আর আপস সালিসি না হয়ে (অর্থাৎ বিচারক বদলে না দিয়ে) রাষ্ট্রের আদালতের ভূমিকাই যেন হয়েছিল। আর সেই রায় দেয়া হয়েছিল ফিলিপাইনের পক্ষে। স্বভাবতই চীন সেই রায় মানেনি। আর সেই থেকে ইন্দো-প্যাসিফিক বা কোয়াড জোট গড়ে আমেরিকান প্রপাগান্ডা শুরু হয় যে, আন্তর্জাতিক আইন না-মানা দেশ হল চীন। আমেরিকা ও বন্ধুদের প্রপাগান্ডার ভাষায় চীন হল, rules-based international order না মানার দেশ আর তারা সকলে হল আইন ও গণতন্ত্র চুইয়ে পড়ার দেশ। অথচ শুরু থেকেই এটি ছিল গায়ে পড়ে চীনের প্রবেশপথে বাধা তৈরির জন্য আমেরিকার কৌশল যে কথা ওই সিনেট রিপোর্টে লেখা আছে। এই জন্যই বলেছি দুনিয়ার চোখে চীনের পক্ষে যায় কোন আইন থাকুক আর নাই থাকুক নিজের প্রবেশপথ খোলা রাখতে চীন সকল বাধা সবকিছুকে উপড়ে ফেলবেই। একই ঘটনার উদাহরণ আমেরিকার বেলাতেও ঘটেছে। কেন আমেরিকা ক্যারিবিয়ান সাগর নিজ প্রভাবে রেখেছিল সে কাহিনী পড়ে দেখতে পারি। “আমেরিকান ক্যারিবিয়ান লজিক” নামে প্রবন্ধ আগ্রহী পাঠকেরা খুজে দেখতে পারেন।
চীনের দিক থেকে ঐ মালাক্কা প্রণালী হয়ে চীনের একমাত্র উত্তর-পূর্ব সমুদ্র প্রবেশপথেই মধ্যপ্রাচ্য থেকে চীনের সব জ্বালানি আসে। তাই এই পথ ও এরও বিকল্প নানা পোর্টও চীন খুঁজবে, না থাকলে চীন তা বানিয়ে নিতে চাইবে বিনিয়োগ করবে, সেটাই স্বাভাবিক। সে কারণে পাকিস্তান, বাংলাদেশ (প্রস্তাবিত), মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কায় গভীর সমুদ্রবন্দর বানানো্র আগ্রহ চীনের নিজের স্বার্থেই এই আলোকেই চীন জরুরি মনে করে। অথচ এসব দেশে চীন বন্দর বানাতে গেলে এবার ভারতকে দিয়ে আমেরিকা কান্নার রোল উঠাবে যে, “আমাকে চীন চার দিকে ‘মুক্তামালা’র মতো ঘিরে ফেলল!” এজন্য ভারতে মুক্তমালা বা String Of Pearls’ বলে কান্নার রোল একটা খুবই ফলস তবে মারাত্মক মিথ্যা দেশপ্রেমের জিগির জাগানিয়া (অরিজিনালি আমেরিকান) প্রপাগান্ডা। এর সোজা মানে চোর উল্টো পুলিশ ডাকে! যাহোক, এগুলো ছাড়াও এমনকি থাইল্যান্ডের ভূখণ্ড কেটে সুয়েজ খালের মতো আরেকটা মালাক্কা বাইপাস তৈরির আলাপ চলছে চীনের থাইল্যান্ডের সাথে।
ওবামার পিভোট ফেল করা থেকে কী বাইডেন শিক্ষা নিবেন নাঃ
ভৌগলিকভাবে আমেরিকা দেশের ভূখণ্ডগত অবস্থান এশিয়াতে নয়। তা হলে ইন্দো-প্যাসিফিক বা কোয়াডে আমেরিকার এই নেতাগিরি করতে আসা কেন? আমেরিকা বলবে আমার বন্ধুরাষ্ট্রগুলা এখানে আছে তাদের রক্ষা করতে। এই অজুহাতও না হয় মেনে নেয়া যাক।
এখন প্রেসিডেন্ট ওবামা ছিলেন সেই লোক যিনি এশিয়া পিভোট (PIVOT) পলিসি [ “Pivot to East Asia”] চালু করতে গিয়েছিলেন ২০১১ সালে এবং শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হন। কিন্তু কী ছিল সেটা?
উপরে যেটা বলেছিলাম চীনের প্রবেশপথের দুই দিকেসহ চার দিকে প্রায় ১০টি দেশ আছে (যাদের বেশির ভাগই আবার আসিয়ান, ASEAN জোটের সদস্য) এবং যাদের সাথে চীনের সমুদ্রসীমা মীমাংসিত নয়। আমেরিকার সব প্রশাসনের খুবই মন-কামনা যে, সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ এরা সবাই চীনের সাথে সামরিক বিরোধে ঘুড়িয়ে দেক, যুদ্ধে জড়াক। আর তাতে আমেরিকা তাদের সবাইকে নিজের কোলে বা কোনো জোটে তুলে নিয়ে এবার তাদের পক্ষ হয়ে চীনের সাথে বিরোধে আমেরিকা সামরিক নেতা হিসেবে হাজির হোক। এটিই ছিল ওবামার আমেরিকার দিবাস্বপ্ন বা আমেরিকার পিভোট বা ভরকেন্দ্র-ভূমিকা; চীনের বিরুদ্ধে এক আলগা মাতবর হতে চাওয়ার আমেরিকা।
আলগা বললাম কেন? বললাম এ জন্য যে, বাস্তবে অমন প্রায় ১০ দেশের কেউ আমেরিকার প্ররোচনায় পা দেয়নি। তাদের অবস্থান খুবই বুদ্ধিমানের। সেটি হল, তারা মনে করে, চীনের সাথে সমুদ্রসীমা অমীমাংসিত বলে বিতর্ক আছে সত্য। কিন্তু সে জন্য আমেরিকার সামরিক জোটে যাওয়া খুবই বিপজ্জনক এবং মূলত অপ্রয়োজনীয়। তারা মনে করে, চীন বিরোধিতার স্বার্থে আমেরিকার কোলে উঠে বসার মানে হয় না। আবার এখনই আমেরিকার কোলে না উঠলে বিশাল ক্ষতি হবে তা তো না। যেমন সমুদ্রবিরোধে চীনের সাথে এখনই আপসে যেতে হবে তাও না। কারণ এখন এটা ফেলে রাখলে চীনের পালটা তাদের দাবির কোনটাই তো তামাদি হয়ে যাবে না। দাবি লোপাট হবে না।
আবার ওই ১০ দেশের কমবেশি সবার বাণিজ্য স্বার্থের দিক থেকে চীন তাদের কাম্য। কারণ চীন অবকাঠামো-ঋণ দেয়ার যোগ্য এমন উত্থিত দেশ। এ ছাড়া তাদের কোন কোন পণ্যের চীনে রফতানির বাজার পাওয়াও সম্ভব। কাজেই এসব স্বার্থকে মেরে ফেলাও তো বোকামি। একারণে ওই সব দেশের (এমনকি চীনের বিরুদ্ধে আনক্লসে জিতে যাওয়া ফিলিপাইনও) কেউ আমেরিকার কোলে ওঠেনি। উল্টো চীনের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি সাম্প্রতিককালের ইন্দোনেশিয়া যার সাথে চীনের ঠিক সমুদ্রসীমা বিতর্ক নেই, তবে জেলেদের মাছ ধরার রাইট নিয়ে বিরোধ আছে, সেও এই টিকা পাওয়ার কালে চীনা টিকার টেস্টে অংশগ্রহণ ও টিকা কেনার সম্পর্কে জড়িয়েছে। আর প্রকাশ্যে বলছে, দুটো আলাদা ইস্যু, আমরা আমাদের মাছ ধরার রাইট ছাড়িনি।
এক কথায় বললে এটা ওবামার পিভোট শুধু পাত্তা না পাওয়া নয়, এশিয়াতেই আমেরিকার পা ফেলার জায়গাও কেউ দিতে বা কোন যুদ্ধে জড়াতে কেউ রাজি না হওয়া। এমনকি নিউজিল্যান্ডও না। তবেঁ অষ্ট্রেলিয়া হা। কারণ সে ফেঁসে গেছে। গত ২০১৬ সালে আমেরিকা অষ্ট্রলিয়ায় এক সামরিক ঘাটি চালু করেছে। বোকারা ভেবেছিল তারা বিরাট আগায় থাকবে। এখন আমেরিকার সাথে বিশেষ বা ঘনিষ্ট সম্পর্কই হয়েছে কাল।
এই ব্যর্থ পিভোটের পটভুমি যদি বিবেচনায় রাখি তাহলে, এখন ওবামার আমেরিকার এত বড় ব্যর্থতার পরও বাইডেন একই ফর্মুলা নিয়ে আবার েখন এসেছেন কেন? যারা কেউ পিভোটে যোগ দেয়নি তারা কেন আবার ইন্দো-প্যাসিফিক বা কোভিডে যোগ দেবে সক্রিয় হবে বলে বাইডেনের আশাবাদের ভিত্তি কোথায়? তাহলে কিসের ভরসায় তিনি জি-৭ বা ন্যাটোকে দিয়ে চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুমকি দিতে ও ঢোল বাজাতে এলেন? আর এটা আমেরিকার কোথায় ফেরত আসা? যুদ্ধের কোন শ্বশানে?
চীনের সাথে আমেরিকার গ্লোবাল নেতৃত্ব নেয়া বা দেয়া নিয়ে বিরোধ আছে, যাকে ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’ বলা হচ্ছে। কিন্তু সেটাকে ফয়সালার জন্য বাইডেন এটাকে একমাত্র যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েই সমাধান খুজতে হবে কেন? আর এতে এশিয়ার দেশগুলো আমেরিকার পক্ষে যুদ্ধে যেতে পোলারাইজড হতে যাবে কেন? ইতোমধ্যেই এটি পরীক্ষিত যে তারা কেউ যাবে না এবং পিভোট প্রকল্প আজ মৃত!
তা হলে এবার ইউরোপ অনেক সাড়া দিচ্ছে বা দিবে তা বাইডেনের মনে করবেন; সেটা কেন? খুব সম্ভবত এটা এক ‘সাদা’- শ্রেষ্ঠত্ববাদী [white Supremist] শঙ্কা ও তা থেকে ইউরোপের সাথে একাত্মবোধ। এ ভয়টাই বাইডেন ইউরোপে বিক্রি করেছেন। কথাটাকে প্রতীকীভাবে অনেক সময় বলা হয়, এশিয়া বা চীন গ্লোবাল নেতৃত্বে শক্ত হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার মানে কী? মানে হল, হয়ত আমরা দেখব, গুলিস্তানের কামানের পাশ দিয়ে সাদা পশ্চিমা তরুণরা ক্লান্ত হলে ফাইল হাতে হেঁটে বেড়াচ্ছে, চাকরি খুঁজছে। ঠিক যেমন এখন আমেরিকার কুইন্সে বা পশ্চিমের কোন শহরের বাঙালি পাড়ায় আমরা ভিড় করি- কখনো চাকরি কখনো স্কলারশিপের লোভে! এ ভয়টাই বাইডেন ইউরোপে বিক্রি করেছেন সম্ভবত। যে চীনের গ্লোবাল নেতা হওয়া মানে পশ্চিমের তরুণদের ফাইল বগলে করে এশিয়ার রাস্তায় ঘুরে ফেরা। এসব চিত্রকল্পের ইমেজ তুলে ধরলে ইউরোপের নেতাদের ভীতি দ্বিগুণ হওয়াটাই স্বাভাবিক। হয়ত এভাবেই কিছু বলে তিনি নিজের পেছনে ইউরোপকে জড়ো করেছেন যে, দেখি না চীনের নেতা হয়ে যাওয়াকে ১০ বছর ঠেকিয়ে রাখতে পারি কি না!
চিত্রকল্পগুলো একেবারেই অবাস্তব তাও অবশ্য নয়। যেমন ইতোমধ্যেই পশ্চিমের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফান্ডের সংকট আর হাহাকার ওদিকে বিপরীতে পালটা চীনের বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলারশিপ পবার সম্ভাবনা এখন বাড়তি বা রাইজিং।
বিল্ড ব্যাক বেটার ওয়ার্ল্ড (B3W)
বাইডেন জি-৭ বৈঠকে শুধু চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উসকানি তুলেছেন তাই নয়, সাথে আরেক চালচুলাহীন কর্মসূচি চালুর ঘোষণা করেছেন। সেটার কথা বিনা তুলনায় বললে বুঝতে কষ্ট হবে। বলতে হবে এটা চীনের বেল্ট-রোড উদ্যোগের [BRI] বিকল্প এক বাইডেন জোটের কর্মসূচি। এর নাম দেয়া হয়েছে- ‘বিল্ড ব্যাক বেটার ওয়ার্ল্ড (B3W)’। প্রথম তিনটি শব্দ ইংরেজি ‘B’ দিয়ে বলে B3 আর পরে ওয়ার্ল্ডের W। এ কারণে সংক্ষিপ্ত B3W। এক কথায় বললে, বেল্ট-রোড ধরণের বিনিয়োগ অবকাঠামো গড়ার খাতের ঋণ বিতরণের উদ্যোগ, তবে এর ঋণের পরিমাণ বিশাল হতে হয়। কিন্তু B3W এর কি বিশাল পরিমাণের ঋণ বিতরণের মুরোদ আছে?
আমেরিকার এই দিন শেষের বেলায়? এখানে আমেরিকান বিনিয়োগ বলতে বিশ্বব্যাংক বা এডিবির মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠানের জন্মকালে যা চাঁদা / বিনিয়োগ আমেরিকা দিয়েছিল। একালে সেসব বিনিয়োগ বাড়ানোর সুযোগ আবার নতুন করেও হবে মনে হয় না। তবেঁ ইউএসএইডের [USAID] মত সরকারি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যে দ্বিপাক্ষিক বিতরণের অর্থ কমা-বাড়ার তাতপর্য তেমন নয় এর স্বল্প পরিমাণের কারণে। আবার তুলনায় চীনের এমন এনজিও বা ইউএসএইড টাইপের উন্নয়ন এর চিন্তায় এখনও প্রবেশই করে নাই। নট নেসেসারিলি আমেরিকার মতন (সামাজিক অবকাঠামোর ) উন্নয়নের শ্লোগান চীনকেও নিতে হবে। ফলে এখানে চীনের সাথে তুলনার সুযোগ এখনও নাই। তবে B3W প্রসঙ্গে বাইডেন আশাবাদ রেখেছেন ব্যবসায়ীদের তারা মটিভেট করে এখানে বিনিয়োগে আনবেন! বাণিজ্যিক বিনিয়োগকে (যার কাছে সুদ লোভনীয় হতেই হবে) অবকাঠামো বিনিয়োগে (এর অর্থ প্রায় বিনা সুদে) নিয়ে আসাই কঠিন। তবু যেটুকু সম্ভব হয়েছিল তা জন্মের সময়ই, এককালে। কিন্তু এমনিতেই বেল্ট-রোডের বিনিয়োগ পরিমাণের দিক থেকে এত বড় যে তা বিশ্বব্যাংকই এর সাথে তুলনীয় নয়। তাই এটা কল্পকাহিনী হয়ে হাজির হবার সম্তুভাবনাই বেশি। তাই বাইডেনের পরামর্শকদের উচিত হবে সম্ভবত, বিশ্বব্যাংকের জন্য ফান্ড তুলতে ওর জন্মের সময় ওয়াল স্টিট পাড়ায় মিটিংয়ের পর মিটিং করে বাণিজ্যিক বিনিয়োগ কোম্পানিকে কি কী লোভ দেখিয়ে বুঝিয়ে রাজি করতে কী কষ্ট করতে হয়েছিল তা স্মরণ করা।
এবার এই প্রসঙ্গে চীন কিভাবে বেল্ট-রোডের ফান্ড যোগাড় করেছিল? চীন একালে বিপুল সারপ্লাস একুমুলেশনের দেশ। সেই সরকারি ফান্ডটাই পরে কোথায় কোথায় লাগানো যায় সেই বুদ্ধি করতেই প্রসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মাথায় কেউ বুদ্ধি দিয়েছিল বলেই তিনি ২০১৩ সাল থেকে বেল্ট-রোডের জন্ম দিয়েছিলেন। এখন একটা হল অনিশ্চিত আর ফকিরি চাঁদা তোলা এক ফান্ডমাত্র – সে কী করে চীনা সরকারি বিপুল সারপ্লাসের সাথে প্রতিযোগিতা করবে? আমেরিকার হাতে বিপুল সারপ্লাস সম্পদ সঞ্চিত হচ্ছে, সেই আমেরিকা কবেই মরে গেছে। সেই বুড়া বাঘকে এখন নয়া চাবুক দিয়ে চাবকালেই কি সে বাঘ তরুণ হয়ে চীনের সমতুল্য বা প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারবে? না সম্ভব? এগুলো কি স্বপ্ন কল্পনার গল্প দিয়ে পূরণ হওয়ার মতো কাজ? আর ওদিকে এমনিতেই অবকাঠামো বিনিয়োগে জাপানি ঋণের সুদের হার সবার চেয়ে বেশি ফলে এখানেও তা কমপিটিটিভ হওয়া মুশকিল!
আবার মনে করিয়ে দেই। বেল্ট-রোডের বেলায় আমেরিকা বগলে ইন্ডিয়াকে নিয়ে প্রপাগান্ডা চালিয়েছিল এটি নাকি ঋণগ্রহিতা
রাষ্ট্রকে ঋণগ্রস্ত করে দিয়ে সে দেশের সম্পদের মালিকানা চীনের নিয়ে নেয়ার ব্যবসা। তা হলে এখন বাইডেন B3W করতে চাচ্ছেন কেন? একই ঋণব্যবসা করতে? এর জবাব কী দেবেন বাইডেন?
আরেকটা লেটেস্ট তথ্য হল, এদিকে আফ্রিকায় চীনা এমন বিনিয়োগ নিয়ে যারা এতদিন প্রপাগান্ডা চালিয়েছিল তাদের আজকাল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ এক নয়া সার্ভে রিপোর্টে যা ছাপা হয়েছে জাপানি ফান্ডেড মিডিয়া ডিপ্লোম্যাটে আফ্রিকায় চীনা সাকসেস নিয়ে গবেষণা রিপোর্ট বের হয়েছে। সেখানে শিরোনামে সারকথাটা হল, New research shows Chinese loans provide a significant boost ।
শেষ কথা হল, বাস্তব বিনিয়োগ আর গল্প আসলে এক কথা নয়। ‘ট্যাকার মুরোদ’ থাকা লাগে চাচা!
[অসমাপ্ত, বাকি কথা পরের আরেক শেষ পর্বে]
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
[এই লেখাটা গত ১৯ জুন ২০২১, দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ওয়েবে ও পরদিন প্রিন্টে “বাইডেনের ন্যাটো-যুদ্ধের খরচ দেবে কে?“ – এই শিরোনামে ছাপা হয়েছিল।
নয়াদিগন্তে ছাপা হওয়া লেখাগুলোকে আমার লেখার ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ বলা যায়। আর আমার এই নিজস্ব সাইটের লেখাটাকে সেকেন্ড ভার্সান হিসাবে এবং থিতু ভাষ্য বলে পাঠক গণ্য করতে পারেন। পরবর্তিতে ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ লেখাটাকেই এখানে আরও অনেক নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে ও নতুন শিরোনামে এখানে আজ ছাপা হল। ]