প্রতিক্রিয়াঃ চীনা কমিউনিস্ট পার্টির শতবার্ষিকীতে
গৌতম দাস
০৫ জুলাই ২০২১, ০০:০৬ সোমবার
Celebrations for CPC’s centenary
গত পয়লা জুলাই ২০২১, এদিন ছিল চীনা কমিউনিস্ট পার্টির শততম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। অর্থাৎ পার্টির বয়স এখন ১০০ বছর পার হল। আর এসময়ের মধ্যে এর অন্তত দুটা বড় সাফল্য হল, পার্টি জন্ম নেয়ার ২৮ বছরের মধ্যেই চীনে বিপ্লব সম্পন্ন ও ক্ষমতা দখল করে আসীন হয়ে যাওয়া। আর দ্বিতীয়টা হল, চীন ইতোমধ্যেই গ্লোবাল অর্থনীতিতে নেতা হওয়ার পথে। গ্লোবাল অর্থনীতি নিয়ে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি স্টাডি রিপোর্টের পূর্বাভাস হল, আগামী ২০২৮ সালের মধ্যে আমেরিকাকে ছাড়িয়ে চীন দুনিয়ার সবচেয়ে বড় অর্থনীতি হয়ে উঠতে যাচ্ছে [Chinese economy to overtake US ‘by 2028’ due to Covid…]।
China will overtake the US to become the world’s largest economy by 2028, five years earlier than previously forecast, a report says.
নিচে বৃটেনের এক লিডিং গবেষণা ও পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান কোম্পানি, CEBR ; তাদের এক তুলনামূলক গ্রাফ রিপোর্ট যা বিবিসি ছাপিয়েছে সেখান থেকে নেওয়া।
এমনিতেই সাফল্য নিয়ে শত বছর পার হওয়া রাজনৈতিক দল হতে পারা খুব কম ক্ষেত্রে এমনটা ঘটে থাকে। যেমন ১৯১৭ সালে রাশিয়ায়, দুনিয়ার প্রথম কমিউনিস্ট ক্ষমতা দখলকারী পার্টি হল লেনিনের (সোভিয়েত) রুশ কমিউনিস্ট পার্টি। কিন্তু ১৯৯১ এর আগস্টে এর সবকিছু শেষ হয়ে যায়, সোভিয়েত ইউনিয়ন রাষ্ট্রই ভেঙে পড়ে, এতে সরকারীভাবে বিলুপ্ত ঘোষণা করে দেয়া হয়েছিল। এরপরে সেই থেকে এখনও তা রাশিয়াসহ মোট ১৫টি আলাদা রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে যায় । এই বিচারে চীনা পার্টির সাফল্য অনেক বেশি অবশ্যই।
আবার ওদিকে, কমিউনিস্ট বা সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্র বলতে যারা নিজেদের কমিউনিস্ট মনে করে এরা নিজেরা এবং দুনিয়ার বেশির ভাগ তাদের সহমর্মী চিন্তার মানুষেরা মনে করে যে, সেখানে সামাজিক উতপাদনের সমস্ত “মালিকানা ব্যবস্থা সরকারি” কী না- এটাকেই তাঁরা মূল নির্ধারক মাপকাঠি মনে করে আর এই ভিত্তিতেই তাঁরা কথা বলে থাকে। কিন্তু বাস্তবত দেখা যায়, ‘মালিকানা ব্যবস্থা সরকারি’ রেখে একটা সচল অর্থনীতি হাজির রাখতে হিমশিম খাওয়ার পরে তারা এটাকে এক বড় বাধা হিসেবে আগে অনুভব করেছিল, আর তাতে সেটাই প্রথম ভাঙনের সুর বাজছে তারা টের পেয়েছিল । সে কারণে সংস্কারের প্রশ্নটা আমল করা হয়েছিল। সেখান থেকেই তত্ব ও কাজে একটা সংস্কার বা রিফর্ম করে নেয়ার চিন্তা আসে যাতে সংস্কার করে একটা সচল কার্যকর অর্থনীতি লাভ করার পথে যাওয়া যায়। এই প্রশ্নে সোভিয়েত ইউনিয়ন কার্যত ‘সংস্কারের পথে’ যাওয়ার সুযোগ নিতে পেরেছিল একেবারেই শেষের দিকে; মানে মাত্র ১৯৮৫ সালে মিখাইল গর্বাচেভ প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরে। বা বলা যায় লিওনিদ ব্রেজনেভের মৃত্যু বা তার শাসনযুগ ১৯৮২ সালে শেষ হওয়ার পর থেকে। কিন্তু বলতে গেলে অচিরেই গর্বাচেভ বড় সংস্কার কিছু শুরু করার আগেই পুরান সোভিয়েত রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ একেবারেই হারিয়ে ফেলেছিলেন। ফলে ১৯৯১ সালের আগষ্টে গর্বাচেভকেই নিজের মুখে সোভিয়েত রাষ্ট্রের বিলুপ্তি ঘোষণা দিতে হয়েছিল।
তুলনার চীনা পার্টি ‘সংস্কারের পথে’ নেমে যায় ক্ষমতা দখলের মাত্র ১০ বছরের মধ্যে; ১৯৪৯ সালে ক্ষমতা দখলের পরে ১৯৫৮ সাল থেকে। অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়নের চেয়ে অনেক অনেক আগে; যদিও কৌশলগত কারণে, চীনা নেতা মাও এই সংস্কারকে বাইরে নাম-পরিচিতি দিয়েছিলেন “সাংস্কৃতিক বিপ্লব” বলে। আর এর ব্যাখ্যাটা ছিল এরকম যে – তাদের পার্টির নেতারা মন-মানসিকতায় বুর্জোয়া হয়ে যাচ্ছেন তাই নেতা বদলের এক উলটপালট বা ঢেলে সাজাচ্ছেন তিনি। অনেক ক্রিটিক বলে থাকেন, সরাসরি বললে তিনি আসলে করতে চাইছিলেন – চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে এক ক্যাপিটালিজম আগে, পরে ‘সমাজতন্ত্র’।
তবে লক্ষ্যণীয় যে এবারের শতবার্ষিকী পালনের বক্তৃতায় প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেছেন [যেভাবে বাংলা বিবিসি রিপোর্ট করেছে সেই ভাষায়],“একমাত্র সমাজতন্ত্র চীনকে রক্ষা করতে পারবে, এবং চীনা ধাঁচের সমাজতন্ত্রই পারবে চীনের উন্নয়ন ঘটাতে,” [ Only socialism can save China, and only socialism with Chinese characteristics can develop China,”]।
এতে এর মানে দাড়ালো, ১। চীন এখনও মনে করে এটা তাদের পার্টি “সমাজতন্ত্রই” করতেছে। ২। তবে সমাজতন্ত্র বলতে তা অন্যকারো ধারণার সমাজতন্ত্র নয়। তাদের পার্টি যেটাকে “চীনা বৈশিষ্ঠের সমাজতন্ত্র” বলে মনে করে এটা সেই অর্থের সমাজতন্ত্র। ৩। উপরের দুই সুত্র থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারি যে অন্যকারো সমাজতন্ত্র বুঝাবুঝির বিচারে বা মাপকাঠিতে চীনে সমাজতন্ত্র হয় নাই এমন সিদ্ধান্তেও আসতে পারে। যেটা চীন আবার আমল করবে না।
আমরা আবার চীন ও সোভিয়েত সংস্কারের একটা তুলনামুলক আলোচনায় ফিরে যাই। সোভিয়েতের তুলনায় চীনারা তাদের সংস্কার অনেক পরিকল্পিতভাবে করার সুযোগ পেয়েছিল; মানে একটা পরিকল্পনামাফিক আগাতে পেরেছিল। সেটা আবার এই অর্থেও যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষেত্রে যেমন সংস্কারের উদ্যোগ নিয়ে আগিয়ে যাবার মুহুর্তেই সোভিয়েত রাষ্ট্রের ক্ষমতা হাত থেকে ছুটে বের হয়ে গেছিল। কিন্তু চীনের ক্ষেত্রে তারা এমনটা হতে দেয় নাই। মানে যাতে না হয়ে যায় সেদিকটা সামলাতে তারা সক্ষম হয়েছিল। যদিও চীনকে একাজে বহু চরাই-উৎরাইয়ের ধাক্কা তাকে কম সামলাতে হয়নি। এভাবে টানা ১০ বছরের মধ্যে নেতৃত্ব ও চিন্তায় বদলের মূলকাজটা শেষ করে মাও সেতুং পার্টির গঠন কাঠামো ও নেতৃত্ব একেবারে ওপর থেকে নিচে পর্যন্ত ‘সংস্কারি চিন্তায়’ বদলে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। যার ফসল আজকের চীন!
এমন চিন্তায় সংস্কার করতে মাওয়ের সফলতা ও ক্ষমতায় টিকে যাওয়ার পেছনে প্রধান সাফল্যের কারণ সম্ভবত – মাওয়ের উপর পার্টি ও জনগণের আস্থা ঢিলা হওয়ার আগেই তিনি সংস্কারের উদ্যোগ নিতে এবং তা শুরু ও শেষ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তুলনায় সোভিয়েতের ক্ষেত্রে তারা সংস্কার করতে গেছেন একেবারের তাদের ক্ষমতা যুগের শেষের দিকে যখন পার্টি ভেঙ্গে পড়ার খুব কাছে এবং সবচেয়ে বড় কথা, সংস্কার কাজটা শুরুতেই শুরু না কড়ায় ততদিনে খোদ পার্টি ইতোমধ্যে বহুবিধ অনাস্থার সংকটে পড়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে যেসব রাষ্ট্র বা ভুখন্ড এতদিন সেই ১৯২২ সাল থেকে সোভিয়েত রাষত্রের ভিতরে জুড়ে নেওয়া হচ্ছিল মূলত তারাই তখন বের হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার জন্য গর্বাচেভের উপর প্রবল চাপ তৈরি করতে সক্ষম হয়ে গেছিল।
তবে চীনের ক্ষেত্রে আরেক বাড়তি সংকট ছিল। চীনের মাও সংস্কার শুরু করলে তাতে আবার ওই সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন যেন আবার অসন্তুষ্ট হয়ে সৈন্য পাঠিয়ে মাওকে ক্ষমতাচ্যুত করে না ফেলে এবং তা অভ্যন্তরীণ কোনো চীনা নেতার সহযোগিতায়- সেদিকটা নিশ্চিত করতে আগেই সোভিয়েত পার্টির সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করে নিয়েছিলেন মাও। শুধু তাই নয়। এর কারণ হিসেবে, সোভিয়েত ইউনিয়নই আমেরিকার মতই “আরেক সাম্রাজ্যবাদ” হয়ে গেছে বলে ব্যাখ্যা ও প্রচার করতে শুরু করেছিলেন তিনি। সোভিয়েত এর আগে সেকালের অন্য কমিউনিস্ট দেশে [রোমানিয়া (১৯৪৪) ও চেকোশ্লোভাকিয়ায় (১৯৬৮) ] এমন জবর দখলদারি কাজ করেছিল। ঠিক একইভাবে যেমনটা পরে অকমিউনিস্ট আফগানিস্তানে (১৯৭৯ ডিসেম্বরে) করা হয়েছিল ১৯৭৯ সালে, মূলত ইরানি বিপ্লবের ভয়ে। এগুলো বুঝতে পারলে বুঝা যাবে মাও সাবধানতা কেন নিয়েছিলেন!
তবে “সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ” এমন শব্দাবলিতে (এখন সাবেক) সোভিয়েত ইউনিয়নের গায়ে দাগ লাগিয়ে দেওয়ার কারণ হল – আমেরিকাকে কমিউনিস্টরা “সাম্রাজ্যবাদ” বলে থাকে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নকেও তা বলতে চাইলে এর অসুবিধা হল, অন্তত মালিকানা প্রশ্নে সোভিয়েত ইউনিয়নের সবকিছুই রাষ্ট্রীয় মালিকানায় থাকায়, যা আমেরিকার মত একেবারেই নয়। তাই মাওয়ের চীনের চোখে, এই সোভিয়েত ইউনিয়ন হল ‘সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী’ রাষ্ট্র। আর মাও এই মূল্যায়ন চালু করেছিলেন। এই বয়ান বা নামকরণ – এটা বাংলাদেশের চীনা কমিউনিস্টদের মধ্যে আশির দশকজুড়ে সক্রিয়ভাবে চালু ছিল। নব্বই দশক থেকে এটা ঝিমিয়ে পড়তে শুরু করতে করতে এখন আর এই ‘সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী’ মূল্যায়ন করতে কাউকে দেখা যায় না, দেয়াল-লিখনেও না। এর বড় কারণ ১৯৯১ আগষ্ট থেকে সোভিয়েত রাষ্টটাই বিলুপ্ত করে দেয়া হয়েছিল।
আবার চীনের বাইরের দেশে যেমন- বাংলাদেশের কমিউনিস্টদের মধ্যে, সম্পদ বা উৎপাদন রাষ্ট্রীয় মালিকানাতে আছে বা চলছে কি না – যদি চলে তবে এটাই সমাজতন্ত্র বা কমিউনিস্ট রাষ্ট্র – এই ‘প্রধান নির্ণায়ক চিহ্ন’ হয়ে আজো থাকতে দেখা যায়। যদিও এর বাইরেও ব্যতিক্রম অনেক রূপই থাকতে পারে, কিন্তু এটাই প্রধান ধারা। এই ধারার ভেতরে যারা পড়েন তাদের মুখ্য অনুমান যে – রাষ্ট্রীয় মালিকানাই সমাজতন্ত্র বা কমিউনিস্ট রাষ্ট্র। তবে একটা ডিসক্লেমার হল, এসবের সঠিক-বেঠিকতা নিয়ে আমি এখানে কথা বলছি না, সেটা আমার বক্তব্যও নয়। এর বাইরে বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন ব্যাখ্যা আছে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কাউকে নাকচ করা বা কাউকে সঠিক /বেঠিক বলার কোনোই উদ্দেশ্য এখানে নাই।
তবে সাধারণভাবে এখন বাংলাদেশে যে প্রধান ধারণা বিরাজ করে বলে আমার অনুমান তা হল, এদের অনুমান বা অবস্থান হল, ১৯৭৬ সালে মাওয়ের মৃত্যুর পরে চীন আর কমিউনিস্ট বা সমাজতন্ত্রী দেশ নয়। যদিও মনে রাখতে হবে যে, চীন আর কমিউনিস্ট বা সমাজতন্ত্রী হোক আর না হোক, চীন গ্লোবাল অর্থনীতির নেতা হতে চলেছে, এটা আরেক বাস্তবতা। আমি এই বাস্তবতা নিয়েই মূলত লিখছি।
চীন কিভাবে বদলে আজকের জায়গায় এলোঃ
পরে ১৯৬৮-৭৭ চীনের এই সময়কালকে বলা যায় চীনের নিজের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, জাতিসঙ্ঘের ভেটোক্ষমতাসহ সদস্যপদ ফেরত পাওয়া নিশ্চিত করা আর বিনিময়ে মূলত আমেরিকাসহ বিদেশী পণ্য ও বিনিয়োগ পুঁজির চীনে প্রবেশের ব্যবস্থাদি চূড়ান্ত করতেই ব্যয় হয়ে যায়। ১৯৭৮ সালের পয়লা জানুয়ারি থেকে চীন-আমেরিকা তারা পরস্পরকে স্বীকৃতি দান শেষে এর প্রকাশ হিসেবে দুই দেশই অপরের রাজধানীতে অ্যাম্বাসির কার্যক্রম চালু করেছিল। এরপর থেকে চীন হয়ে উঠে আমেরিকার জন্য বিনিয়োগের স্বর্গ। তবে সাবধানতা হিসেবে আমেরিকার কারা আগে চীনে বিনিয়োগ নিয়ে যাবেন এর ক্রাইটেরিয়া হিসেবে, বহু আগে থেকেই যেসব চীনা অরিজিন ব্যবসায়ী আমেরিকায় আসন গেড়ে বাস করছিলেন চীন তাদেরই প্রায়োরিটি দিয়েছিল। কারণ এই বিনিয়োগ নিবার ভালো-মন্দের দিকগুলো বুঝে আইন-কানুন ও রেওয়াজ (গুড প্র্যাকটিস) চূড়ান্ত করার গুরুত্বপুর্ণ দিকের কাজ তখনও বাকি ছিল। এভাবেই চীন-আমেরিকা সম্পর্ককে ব্যবহারিক আইন-কানুন ও গুড প্র্যাকটিসে হাজির দেখা শেষ করতে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত লেগেছিল। এর পরেই কেবল ২০ বছর ধরে (১৯৯১-২০১০) টানা ভাইব্রেন্ট ডাবল ডিজিটের চীনা অর্থনীতির সূচনা হয়েছিল। অবশ্য শেষের দিকে মানে ২০০৮ সালের গ্লোবাল মহামন্দার কারণে তা কিছুটা ঝুলে গিয়েছিল।
চীন ও বিশ্বব্যাংকের সম্পর্কঃ
এখানে চীনের সেকালে এসব পরিবর্তন নিয়ে বিশ্বব্যাংকের কিছু অবজারভেশন এখানে তুলে আনা যেতে পারে। যেটা বিশ্বব্যাংকের এক সাইট থেকে নেয়া। যেমন, বিশ্বব্যাংকের সাথে চীনের ব্যবহারিক সম্পর্ক শুরু হয় ১৯৭৮ সালের শুরুতে আভ্যন্তরীন সংস্কার শেষ করার পরে ১৯৮০ সাল থেকে। বিশ্বব্যাংক বলছে চীন তখন সম্পর্ক শুরু করেছিল বিশ্বব্যাংকের আইডিএ [IDA] লোন গ্রহিতা সদস্য হিসাবে। IDA মানে হল International Development Association, যেটা আসলে ব্যাখ্যা করা যায় এভাবে, বিশ্বব্যাংকের সদস্য দেশের লোন পাবার যোগ্যতা তা বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করা থাকে; এরই সবচেয়ে নিচের ক্যাটাগরি যা গরীব দেশের জন্য এটাই IDA লোন। এর নিচেও আরেকটা ক্যাটাগরি আছে সেটা হল যারা কোন লোন নিলে তা ফেরত (সুদ বা আসল কোনটাই) দিবার যোগ্যতাও রাখে না বা তৈরি হয়নাই তাদের ক্যাটাগরি। অর্থাৎ এদেরকে তাই গ্রান্ট বা অনুদান ক্যাটাগরির গ্রাহক বলা হয়। এদেরকে অনুদান দিয়ে অবস্থা একটু ভাল করে পরের ধাপ IDA এর লোন পাবার যোগ্য করা হয়। IDA, এই ক্যাটাগরিতে ১.০% এর নিচে (০.৭৫%) সুদসহ আসল খুবই লম্বা প্রায় ৪০ বছর ধরে সময় নিয়ে ফেরত দিবার সুযোগ দেয়া হয়। তবু এটা আসলে সুদ না, বলা যায় বিশ্বব্যাংকের স্থানীয় অফিস চালানোর খরচ তুলে আনা। বাংলাদেশ ১৯৭৬ সালে লোন গ্রহিতা হওয়ার শুরু থেকেই এই ক্যাটাগরিতে ছিল। তবে একই সাথে অনুদানও পেয়েছে। সম্ভবত এখনও “সেফটি নেট” কর্মসুচিতে অনুদান এখনও পাশাপাশি চালু আছে। চীনও IDA, এই ক্যাটাগরি থেকেই ১৯৮০ সালে যাত্রা শুরু করেছিল। ব্যাংকের ভাষায় IDA হল … fund for the poorest। কিন্তু চীন অচিরেই বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এরপরের ক্যাটাগরি হল – “লোয়ার মিডিয়াম বা মধ্যম আয়ের দেশের” ক্যাটাগরি যেখানে সুদের হার ২% [Lower mid $1,036 and $4,045]। বাংলাদেশে এখন এই ক্যাটাগরিতে। আর চীন ১৯৯৭ সালের এসব অতিক্রম করে চলে যায়। আর ২০০৭ সাল থেকে উলটা ঋণদাতা বা ডোনার দেশ হিসাবে হাজির হয়েছিল। এতে চীনের ১৯৮০ সাল থেকে গড়ে প্রতিবছর জিডিপি বেড়েছিল ১০% করে। বলাই বাহুল্য এটা খুবই উঁচু পর্যায়ের রাইজিং ইকোনমির দেশের বেলায় ঘটে থাকে। এভাবে ২০০৭ সালের মধ্যে চীন তার জনগোষ্ঠির ৮০ কোটি (বর্তমান জনসংখ্যা ১৪০ কোটি) লোককে প্রভার্টি বা দরিদ্র স্টেজ থেকে উঠিয়ে এনেছিল। উপরের এই তথ্যগুলো এই লিঙ্ক থেকে নেওয়া। আর বিশ্বব্যাংকের সাথে চীনের পার্টনার সম্পর্ক করার ত্রিশ বছরের মধ্যেই ২০১০ সালে চীন বিশ্বব্যাংকের তৃতীয় বড় মালিক হয়ে উঠেছিল। চীনের এর উপরের মালিক হতে আমেরিকা নাকচ করাতেই মূলত চীন নিজে আলাদা বিশ্বব্যাংক-তুল্য ব্যাংক [AIIB] ও BRICS ব্যাংক গড়ার দিকে রওয়া দেয়।
তবুও এখনো পুরান কমিউনিস্ট ধারার অনেকেই চীনের এই গ্লোবালি রাইজিং অর্থনীতি, এটা ‘কিছুই হয় নাই’ বলে নাকচ করতেই পারেন। তবে সে ক্ষেত্রে কী ভিত্তিতে তিনি তা বলছেন, তা বুঝার জন্য সেদিকে মনোযোগ দেয়া যেতে পারে। কারণ চীন সম্পর্কে আমাদের সিদ্ধান্তের ফারাক হতেই পারে। তবে এই ফারাকগুলো মূলত কী ভিত্তিতে কথা বলছি মানে কোন কাঠিতে মাপছি, এগুলো আসলে সেই মাপকাঠির ফারাক। এটা বুঝলে বা জানতে পারলেও অনেক লাভ।
এ দিকে দেখা যাচ্ছে এবার বিবিসি জানাচ্ছে, ‘একমাত্র সমাজতন্ত্র চীনকে রক্ষা করতে পারবে এবং চীনা ধাঁচের সমাজতন্ত্রই পারবে চীনের উন্নয়ন ঘটাতে” – চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং নাকি শতবার্ষিকী পালনে এমন বক্তব্য দিয়েছেন।
যদিও এখনও চীনে এটা সমাজতন্ত্র হয়েছে কিংবা হয়নি- এ নিয়ে কাউকে কাউকে আমরা বিতর্ক করতে দেখতে পারি। কিন্তু তাতে চীনের গ্লোবাল অর্থনীতির নেতা হওয়ার অভিমুখ বদলাচ্ছে না।
শতবার্ষিকীতে চীনের বাইরের দেশের প্রতিক্রিয়াগুলোঃ
এবারের এই বার্ষিকী যতটা না চীনের অভ্যন্তরীণ এর চেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া বিদেশের এবং তা এমনকি চীনের বন্ধু-শত্রু, অথবা চীনের প্রতি ঈর্ষাধারী কিংবা কৌশলগত কারণে যারা পছন্দ বা উচ্ছ্বাস-প্রকাশকারী নির্বিশেষে সবার মধ্যেই প্রতিক্রিয়া হতে দেখা গেছে।
এসবের মধ্যে পশ্চিমের মিডিয়া রিপোর্ট আর তাতে প্রকাশিত মন্তব্য ও অ্যানালাইসিসে প্রকাশিত প্রতিক্রিয়াগুলো লক্ষণীয়। এসব লেখায় এবারই প্রথম দেখা গেল, চীন যে নিজেকে এখনো কমিউনিস্ট বলে দাবি করে একথা এরা মেনেই নিয়েছে। সেটা এই অর্থে যে এনিয়ে কোন বিরূপতার এবার আমরা দেখি নাই। আর এই ‘কমিউনিস্ট নামে রেখেই’ চীনের উঠে আসা সাফল্য বা চ্যালেঞ্জ পশ্চিমের সাথে চীন বরাবর বা সমান প্রতিদ্বন্দ্বী এবং যা পশ্চিমকে ছাড়িয়েও যেতে পারে, যেন তারা মেনে নিচ্ছে। কোনো প্রশ্ন তোলেনি তারা। এমনকি চলতি একুশ শতকের শুরু থেকে প্রথম ১৫ বছরও আমরা দেখেছিলাম চীন পশ্চিমের সাথে কম্পাটেবল বা তুলনীয় নয় বলে আমেরিকা সরকারি আপত্তি তুলছে। ওবামা আমলেও প্রায়ই এমন দাবি উঠতে দেখেছি আমরা। তাদের দাবি, চীন নিজের ‘মুদ্রার মান’ কমিয়ে রেখে সাফ। যদিও ২০০৮ সালের মন্দায় পরের বছরগুলো অন্তত একদশক জুড়ে জাপান তার ইয়েনের ‘মুদ্রার মান’ কমিয়ে রেখে চলেছিল। এক ডলার সমান ৯২-১০৮ ইয়েন এভাবে ভ্যারি করেছিল। কিন্তু আমেরিকাকে আপত্তি তুলতে দেখা যায়নি।
এখানে আমাদের পাঠকের অনেকের কাছে মুদ্রার মান কমে যাওয়ার ব্যাপারটা পরিষ্কার নয় হয়ত। তাই কিছু সংক্ষিপ্ত ধারণা দিয়ে নিব। যদিও ভারতের জাতিবাদী রাজনীতির চোখে, ডলারের তুলনায় রুপির মান কমে যাওয়া (মানে বেশি রুপী দিতে হওয়া) দেশবিরোধী কাজ বা ঘটনা মনে করা হয়। অর্থাৎ ভারতের সরকার ও জনগণ সবার চোখেই এটা ভারত স্বার্থবিরোধী নেতিবাচক কাজ। কিন্তু এখানে আমরা দেখেছি আমেরিকা চীনকে অভিযুক্ত করছে যে, ইউয়ানের মুদ্রামান চীন ইচ্ছা করে কমিয়ে রেখেছে আর এটা অন্যায় কাজ বলে আমেরিকা দাবি করে যাচ্ছে। এমন হচ্ছে কেন? আর এর মানে কী তাহলে?
কারণ এটা গ্লোবাল বাণিজ্যের যুগ। মানে এটা আর তথাকথিত জাতিবাদী উৎপাদন বা জাতিবাদী অর্থনীতির যুগ নয়। অর্থাৎ যখন কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ ভোক্তাদের দিকে তাকিয়ে উৎপাদনের চেয়ে রফতানির জন্য উৎপাদন অর্থনীতিই দেশের প্রধান অর্থনৈতিক তৎপরতা হয়ে ওঠে – সেটা দেখে বুঝা যায় এটাই গ্লোবাল বাণিজ্যের যুগ। এক কথায়, দেশীয় ভোক্তার জন্য উৎপাদনের তুলনায় রফতানির জন্য উৎপাদন তুলনায় বেশি সুবিধা ও মনোযোগপ্রাপ্ত সেক্টর হয় যখন। আর এ ক্ষেত্রে মুদ্রা মান কম করে রাখা বা আপনাতেই যদি কমে যাওয়া ঘটে কখনো তবে তা রফতানিকারক দেশের জন্য বেশি লাভ ও সুবিধাজনক হয় সাধারণত। কিভাবে?
মুদ্রা মান কমে যাওয়া মানে যেমন (ধরা যাক) আগে, বাংলাদেশ থেকে এক ডলারে একটা শার্ট কিনতে পাওয়া যেত এমন হলেও এখন দেড় ডলারে দুইটা পাওয়া যাবে এরকম হয়েছে। স্বভাবতই এখন বিক্রেতা হিসাবে আমরা কম মূল্য পাব। কিন্তু এতে আবার বিক্রির পরিমাণ বেড়ে যাবে। কারণ এখন প্রতিদ্বন্দ্বি ভিয়েতনামের ক্রেতারা কম দামের সুবিধা নিতে বাংলাদেশমুখী হবে। এতে বিক্রি বেশি হওয়াতে মুদ্রামান হারানোর লস কাভার হওয়ার পরও আমাদের বেশি লাভ হতে পারে। অর্থাৎ সময়ে নিজ মুদ্রার মান কমা, এটা নিজের জন্যই ইতিবাচক হতে পারে। আর ভারতের চিন্তাটা কুপমন্ডুক ও পুরানা (যখন রফতানির জন্য উৎপাদনের যুগ আসে নাই ) কথিত ‘দেশপ্রেমিক’ চিন্তা।
ভারতের প্রতিক্রিয়াঃ
পয়লা জুলাইয়ের ভারতের ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকা জানাচ্ছে এ বিষয়ে। বলছে, “কংগ্রেস বা বিজেপি এই দল দুটার কেউ চীনা কমিউনিস্ট পার্টিকে জন্ম-শতবর্ষ পার করানোতে কোনো শুভেচ্ছাও জানায়নি। তবে এক কমিউনিস্ট দল, সিপিএম জানিয়েছে”। আর কংগ্রেসের এক সিনিয়র নেতা এনিয়ে বলেছেন, “বর্তমান রাজনৈতিক আবহ আমাদের দুই পার্টির মধ্যে রাজনৈতিক শুভেচ্ছা বিনিময়ের উপযোগী নয়”। আসলে তিনি সম্ভবত বলতে চাইছেন লাদাখে চীন-ভারত সীমান্ত উত্তেজনার কথা। গত বছর সেখানে অন্তত ২০ জন ভারতীয় সেনা চীনাদের হাতে নিহত হয়েছেন। সে ঘটনাটাকে পাশে সরিয়ে রেখে সৌজন্য দেখাতে গেলে তাতে কংগ্রেস বা বিজেপি যেই দেখাতে যাক অপর দল তাতে ‘মাইলেজ’ নিতে অপরের বিরুদ্ধে পাবলিক সেন্টিমেন্ট উসকে সুবিধা নিতে চাইতে যাবে বলে তারা একে অপরের ভয়ে ভীত। তাই তারা দুই-পার্টি কেউ শুভেচ্ছা জানানোর ধারে কাছে যায়নি। যদিও এটা খুব ভাল যুক্তি বা অজুহাত তা মানা যাচ্ছে না। যেমন এক ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে ভারত ৯১% নির্ভরশীল। তা তো ঠিকই তবু চলছেই। আবার ভারতের মোবাইলের বাজারে সবগুলো ব্যান্ডই মূলত কোন না কোন চাইনিজ। তরুণেরা চীনা মোবাইল ব্যবহার ছাড়ার চিন্তা করছে এমনটাই গত দুবছরে কখনই শোনা যায় নাই। আর সামগ্রিকভাবে চীনা পণ্য আমদানি এসময়ে বেড়েছে বই কমে নাই। তাই এই সাফাই দুর্বল অবশ্যই। যদিও শেষ বিচারে এটা যার যার পারশেপশন নিয়ে আর কিছু বলার থাকে না!
ওদিকে, সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির চীনা পার্টিকে লিখিত শুভেচ্ছা দেয়ার কথা পত্রিকাটা আমাদের জানাচ্ছে। এই লিখিত শুভেচ্ছাকে বলা যায় – ইয়েচুরি নিজেও কমিউনিস্ট এবং তাদের কমিউনিস্ট পার্টির দিক থেকে এটা আলাপ ও খাতিরমূলক শুভেচ্ছা এটা – তাই তিনি বুঝাতে চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, “চীন কিভাবে নিজের ভুল চিহ্নিত ও সংশোধন করে তার পলিসিগুলো দাঁড় করিয়েছে গত শতক এর সাক্ষী হয়ে থাকবে”। ‘সিপিএম গুরুত্ব দিয়ে যেতে চায় যে, “মার্কসবাদ-লেনিনবাদ এক সৃষ্টিশীল বিজ্ঞান। এটা শ্রেষ্ঠ ডগমাবিরোধী। তাই এটাকে কখনো কোনো আগাম সেট করা ফর্মুলা হিসেবে হাজির করা যাবে না”। আবার তিনি বলছেন, “যদিও এক সৃষ্টিশীল বিজ্ঞান হওয়া সত্বেও এটা সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতির সাথে খাপখাইয়ে নেয়ার সময় বিপ্লবী প্রিন্সিপল ও মুক্তিলাভের উদ্দেশ্য শক্ত করে আকড়ে থাকে”। তিনি লেনিনের উদ্ধৃতি দিয়ে আরো বলেন, “সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতির সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণ ডায়লেক্টিক্সের জীবন্ত সারকথা”। এছাড়া ইয়েচুরি, চীন যেভাবে করোনা মহামারীর সামলিয়েছে এর ভূয়সী প্রশংসা করেন।
কথাটা এত দীর্ঘ করার মূলকথা হল, সিপিএম চীনের ‘বিস্তারিত সংস্কারের’ (১৯৫৮ সাল থেকে সম্ভবত সবই) সব কিছুকেই অনুমোদন দেয়, তাই ইয়েচুরি জানিয়ে রাখার সুযোগ নিয়েছেন। তবে এই কমিউনিস্টের বিজ্ঞানবাদীতা খুবই দৃষ্টিকটু এবং পুরান কমিউনিস্টের নিচু চিন্তা পদ্ধতির লক্ষণ।
এর মধ্যে বড় বিপজ্জনক হল, বর্তমান ভারতের পরিস্থিতি হিন্দুত্ববাদী ভোটের জমানার। ভোটের সময় সিপিএম এই কমিউনিস্টেরা হিন্দুত্ববাদের বিরোধিতার চেয়ে কিভাবে এর সাথে খাপখাইয়ে চললে কিছু ভোট বা ভোট পলিটিক্সে লাভ হবে সেটাই সিপিএম করে থাকে। এমনকি তৃণমূলকে হারাতে সে বিজেপির কোলে উঠে বিজেপি দলকে জিতাতে কাজ করতে দ্বিধা করে না। তাই এখন এমন বক্তব্য তাদের দলের বিরুদ্ধেই যেতে পারে।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
[এই লেখাটা গত ০৩ জুলাই ২০২১, দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ওয়েবে ও পরদিন প্রিন্টে “চীনা কমিউনিস্ট পার্টির শতবার্ষিকী“ – এই শিরোনামে ছাপা হয়েছিল।
নয়াদিগন্তে ছাপা হওয়া লেখাগুলোকে আমার লেখার ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ বলা যায়। আর আমার এই নিজস্ব সাইটের লেখাটাকে সেকেন্ড ভার্সান হিসাবে এবং থিতু ভাষ্য বলে পাঠক গণ্য করতে পারেন। পরবর্তিতে ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ লেখাটাকেই এখানে আরও অনেক নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে ও নতুন শিরোনামে এখানে আজ ছাপা হল। ]