ট্রাম্পের জাতিবাদ ফেল কিন্তু ঘায়েল বাইডেন


ট্রাম্পের জাতিবাদ ফেল কিন্তু ঘায়েল বাইডেন

গৌতম দাস

১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০৬ সোমবার
লেখাটা আজ ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১ দ্বিতীয়বার নতুন করে ছাপা হল, আগেরটা

https://wp.me/p1sCvy-3Jo

[একটা তথ্য জানিয়ে রাখাঃ 
এখন (১৯ সেপ্টেম্বর) এখানে যে লেখাটা দেখছেন সেটা গত ১৩ সেপ্টেম্বর যেটা টাঙ্গিয়েছিলাম সেটা নয়।  যদিওও ছবিটা একই। কোন কারণে সেটা দেখছি মুছে গিয়েছে। সেটার লিঙ্ক এড্রেস ছিল এটা  https://wp.me/p1sCvy-3Ir  ;
যেটা এখন অকেজো কারণ সে লেখাটাই সম্ভবত মুছে গিয়েছে। তাই এখন আজ (১৯ সেপ্টেম্বর) সকালে বসে পুরানা নয়া দিগন্তের লেখাটাকে এবার এডিট করে এখানে তৈরি করে প্রকাশ করলাম। নামের মধ্যে একটাই কেবল ছোট ফারাক আছে নতুন লেখাটায় একই নাম কিন্তু মাঝের কমাটা এখন নাই। নতুন করে লেখাটায় কমা নাই। আর বলাই বাহুল্য এখন লেখার লীংকটাও ভিন্ন।  অর্থাৎ উপরে যেটা দেয়া আছে সেটাই। কারও কাছে আগের লেখাটা থাকলে সেটা এর সাথে মিলবে না। আপনাদের কোন অসুবিধা হলে দুঃখিত।]

বাইডেনের পাবলিক রেটিং বা জনপ্রিয়তা ঢলে পড়েছে। গত জুনে ছিল ৫৪ শতাংশ [from a high of 54 percent approval] আর তা থেকে কমছিল প্রতি মাসেই। আগস্টের শেষ দিকে তার প্রতি জনগণের আস্থা ৪৭ শতাংশেরও নিচে নেমে গেছে। আমেরিকান মিডিয়া এনপিআর বলছে, এটা আরো নিচে ৪৩% [President Joe Biden’s approval rating slipped six points from August to 43%……]। এতে প্রধান কারণ ছিল আফগানিস্তান ফেলে পালিয়ে আসা, [ ……A New Low After The Afghanistan Withdrawal] এর ওপর আবার অনেকে এটাকে ‘অগোছালো পালিয়ে আসায়’ আমেরিকার মতো পরাশক্তির ইজ্জতে লেগেছে বলে মনে করে। আমেরিকার ইজ্জত নষ্ট করেছেন বাইডেন এই হলো অজুহাত। যদিও আমেরিকান এই কথিত ইজ্জত এমনিতেই ক্রমাগত মিলিয়ে যাচ্ছিল এবং তা বহু আগে থেকেই। কিন্তু যারা একালে আমেরিকা প্রবাসী হয়েছেন তারাসহ পুরনো নাগরিক আমেরিকানদের অনেকেই আমেরিকার গর্ব ও ভ্যানিটি এতদিন উপভোগ করতেন। তারা কিছুতেই এই ঢলে পড়াটা দেখিয়ে দিলেও মানতে চাচ্ছিলেন না। কিন্তু এবার সবটা মিলে আর না মেনে উপায় নাই কারো।

কিন্তু কারণ?
কারণ কেবল আফগানিস্তান নয়, আরো বড় অন্য কারণ আছে। সাময়িক আফগান-ইস্যুটা গরম হয়ে বসাতে যেটাকে সবাই ভুলে গিয়েছিল – সেটা হলো, ট্রাম্প আমলে তুঙ্গে ওঠা চীন-আমেরিকার বাণিজ্য যুদ্ধ, যা বাইডেন আমলেও বহমান এবং এই বাণিজ্যযুদ্ধকে কেন্দ্র করে বাকি সব ধরনের টেনশন আর রেষারেষি ছড়িয়ে থাকা!

চীনের সাথে বাণিজ্যযুদ্ধ মানে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তার প্রশাসন শুরু করেছিলেন এক আমেরিকান জাতিবাদের আওয়াজ উঠিয়ে এটা শুরু করেছিলেন । হ্যাঁ, ট্রাম্পের “আমেরিকা ফার্স্ট” – এর কথা বলছি। সে এক না-বুঝ ও অবুঝ অবস্থান। এটা শুনতে অনেকের কাছে অবাস্তব ঠেকলেও ট্রাম্প এটাই করেছিলেন। কোন্ আমেরিকায়? যে আমেরিকা গত আশির দশকে থেকে দুনিয়ায় গ্লোবাল বাণিজ্য বা গ্লোবালাইজেশনের নেতৃত্ব দিয়ে সবাইকে এতে যোগ দিতে প্রায় বাধ্য করেছিল, সেই আমেরিকা!

আমাদের এদিকে জাতিবাদঃ
দুনিয়ার গ্লোবে আমাদের এদিকটায় এশিয়ায় মানুষের বুঝুক বা আধা বুঝুক বা না বুঝুক, ‘জাতিবাদ’ খুব পপুলার। এরা অন্যকে বা অন্যের “জাতিবাদ”কে খারাপ বললেও নিজের আরেকটা বা নিজধর্মীয় জাতিবাদই সবচেয়ে ভাল পথ বলে মনে করে থাকে। এমনকি কমিউনিস্টরাও কলাম লিখে তালেবানদের আফগান-জাতিবাদী হতে পরামর্শ দিচ্ছেন। ব্যাপারটা এমনই কৌতুকের! এর ওপর আছে, এই জাতিবাদীরা কখনো এবার রাজনৈতিক জাতিবাদী হয় তো, কখনো অর্থনৈতিক জাতিবাদী হয়। “রাজনৈতিক জাতিবাদী” মানে যেমন হিন্দু বা মুসলমান জাতিবাদ, যারা একে অপরের জাতিবাদ করাকে খারাপ কাজ মনে করে কিন্তু নিজ নিজ জাতিবাদটাকে ‘সহি’ মনে করে। আর সুনির্দিষ্ট করে “অর্থনৈতিক জাতিবাদী” মানে যারা যেকোনো বিদেশী পণ্য আমদানি করাকে নিজ দেশকে ভালোবাসায় ঘাটতি মনে করে। এখানে কৌতুকটা হল, এরাই আবার অন্য দেশে রফতানি করে চকচকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের লোভ ছাড়তেই পারে না। যার আদর্শ লোভী ব্যক্তিত্বটা সম্ভবত ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মোদি। যেমন, আরএসএসের এক অঙ্গপ্রতিষ্ঠান “স্বদেশী জাগরণ মঞ্চ” আছে যে ভারতে চীনাপণ্য বর্জনের হাঁক দিয়ে থাকে । মিটিং মিছিল সেমিনার করে বেড়ায়। কিন্তু চীনাপণ্য ভারতে আমদানি  তাতে না কমে আরো বেড়েছে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নাই বা বক্তব্য নাই।

বাস্তবতা হল, গত আশির দশক থেকে আমেরিকা সব দেশকেই গ্লোবালাইজেশনে যুক্ত হতে বাধ্য করে ফেলেছিল। এতে যেমন, “এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন” বা ‘ইপিজেড’ [EPZ] অথবা “রফতানির জন্য উৎপাদন” এই শব্দগুলো আজ গ্রামের অনেক টিনএজ মেয়েও জেনে গেছে। কারণ সে জানে গার্মেন্টে কাজ পাওয়া যায় এভাবে বা এদের কারণেই। এসব কথার সারকথাটা হল, দুনিয়ায় আমাদের এশিয়ান সমাজে তাই অনেক আগে থেকেই জাতিবাদ দেশপ্রেম বলে একটা ভুয়া-বুঝ চালু আছে। আবার অন্য দিকে সেই গার্মেন্টের মতো রফতানি পণ্যের কারখানায় কাজ পেতে আমরাই প্রচণ্ড ‘আগ্রাসী’। এমনকি ঠিকমত বুঝিও না যে দুটা পরস্পর বিরোধী ধারণা।

তাই বড় কৌতুকটা হল, ২০১৭ সালে জানুয়ারিতে শপথ নিয়ে আমেরিকায় ক্ষমতায় আসা ট্রাম্পও একই জাতিবাদ- দেশপ্রেম – এই ভুয়া বুঝেরই আরেক স্লোগান “আমেরিকা ফার্স্ট” চালু করেছিলেন। অথচ “আমেরিকা ফার্স্ট” আর গ্লোবাল রফতানিবাণিজ্য একেবারেই পরস্পরবিরোধী।

এমনকি এ দুটোর মধ্যে কোনটা বেশি ভাল এমন বোকার এবং না-বুঝা তুলনাও যারা অনেক পড়াশোনা জানা এক্সপার্ট তারাও করে থাকেন। বলে রাখি  আমাদের বর্তমান সরকার হিসাবে ‘কালো দাগি’; ফলে অগ্রহণযোগ্য কিন্তু সরকার সম্প্রতি চীনের নেতৃত্বের আরসিইপি [RCEP] বাণিজ্য জোটে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং অচিরেই সেখানে আবেদন করতে যাছে এবং এটা এক সাহসী ও সঠিক সিদ্ধান্ত। এই জোটে যোগ দিতে হলে অন্য দেশের পণ্যের ওপর শুল্ক ধার্যে সর্বোচ্চ আট শতাংশের কাছাকাছিও যাওয়া যাবে না। মানে, বিদেশী পণ্যে শুল্ক আরোপকে সরকারের বার্ষিক রাজস্ব আয়ের আর বড় উৎস গণ্য করা যাবে না। তবে নিজ কারখানা উতপাদন থেকে শুল্ক সংগ্রহ – এখানে যেতে হবে। ফলে মারাত্মক চ্যালেঞ্জিং; আবার জিতলে কিন্তু একেবারে গাজী! এমনকি যেমন জাপান ও অস্ট্রেলিয়া হল কঠোর চীনবিরোধী এবং কোয়াডের সদস্য। অথচ তারা আবার আরসিইপি জোটেরও সদস্য।অর্থাৎ তা হতে এরা মরিয়া হয়েছিল যে, এই লোভ সামলাতে পারেনি। মানে আরসিইপি-এর লোভে কোয়াডের প্রতি ‘ঈমান’ রাখতে পারেনি। অর্থাৎ এরা জাতিবাদ-দেশপ্রেম এই ভুয়া স্লোগানগুলোকে  সঠিকভাবেই মেনে চলেনি।

তামাশা হল, এটাই ছিল সেকালে ট্রাম্পের নতুন রাজনৈতিক স্লোগান। কিন্তু বাইডেনের রেটিংয়ের প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে এখানে কেন এলাম? হ্যাঁ, এবার সেই সংযোগটা দেখাব।

ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেই ‘এই জাতিবাদ’ দেখিয়ে আমেরিকান পাবলিককে মোদির মতো সস্তা সুড়সুড়ি দিয়ে নাচিয়েছিল।  আর চীনের সাথে বাণিজ্যিক দরকষাকষি বা বারগেইন করতে গিয়েছিলেন। সাধারণভাবে বললে বারগেইন কোনো সমস্যা নয়। এটা অবশ্যই একটা ফেয়ার বা ইনসাফের সীমার মধ্যে থাকা। কারণ এটা পরস্পর নিজের লাভালাভ এক্সপ্লোর করে দেখা – যে  কার, কী, কোথায় সুবিধা-অসুবিধা এর খোঁজাখুঁজি করে বাজিয়ে দেখে থাকে। এটা গভীর দেয়া-নেয়ার সম্পর্কের সন্ধানে থাকা; কিন্তু কোনোভাবেই এটা ঠিক ‘যুদ্ধ’ নয়। বড়জোর বাণিজ্য প্রতিযোগিতা অর্থে লড়াই। কিন্তু ট্রাম্প এই বাণিজ্য লড়াইয়ের প্রথমপর্ব বাৎচিত শেষ করে ততটুকুকেই একেবারে চুক্তি করে ফেলেছিলেন। কিন্তু এরপরে আর পরের পর্বগুলোতে কখনোই আগাতে পারেননি। ফলে পুরো বাণিজ্য সম্পর্ক সেই থেকে ঢলে পড়েছিল। এরপর জোশে আরো দেশপ্রেম দেখাতে গিয়ে চীন থেকে আমদানি পণ্যের ওপর বাড়তি ২৫ শতাংশ করে শাস্তিমূলক শুল্ক আরোপ করে দেন। এটা দেখে বুদ্ধিমানেরা অবশ্য চুপ হয়ে যান আর গর্দভেরা হাততালি দিয়ে উঠেছিল। শুধু তাই নয়, ট্রাম্প প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলেন, তিনি তার টার্ম শেষের আগে এমন ব্যবস্থা করে যাবেন যাতে পরের অন্য কোনো নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট তার জাতি-প্রেমনীতি থেকে সরতে না পারেন।
তিনি আরো আগ বাড়িয়ে সরাসরি বাইডেনের নাম ধরে বলেছিলেন, আমি চলে গেলে পরের টার্মে চীনারা ডেমোক্র্যাট বাইডেনের সাথে আরামে চুক্তি করতে পারবেন এই কথা চিন্তা করে নাকি তারা ট্য়রাম্পের সাথে চুক্তি করলেন না। এমন অনুমাননির্ভর এক দাবিও করেছিলেন। এতে আরো হাততালি পাওয়া গিয়েছিল যে হ্যাঁ, এবার আমেরিকায় এক খাঁটি দেশপ্রেমিক পাওয়া গেছে! কিন্তু এরপর?

শুরুতে ঘটনা ছিলও তাই। এমনিতে পপুলার ইমেজের দিকে তাকিয়ে কথা বললে, ডেমোক্র্যাট বাইডেন তো উদার; যার বিপরীতে ট্রাম্প আগ্রাসী আনকুথ মানে এক ‘গাঁইয়া’, অসভ্য। কিন্তু বাইডেনের প্রেসিডেন্টের শপথের পরে দেখা গেল তিনি কথা মিষ্টি করে বললেও তার মুখ্য নীতি-পলিসি সবই আসলে ট্রাম্পের ফেলে যাওয়া নীতিরই কুড়িয়ে নেয়া অনুসরণ। এ দেখে আমেরিকানরা হয়তো ভেবেছিল, ট্রাম্প আসলেই কত জাতিপ্রেমী ও দূরদর্শী!

কিন্তু না, চার দিকে হা-হুতাশ উঠে গেছে এবার এই আট মাসেই। আমেরিকার মানুষ বিশেষত, মিডল ক্লাসের একেবারেই নাভিশ্বাস ও আশাহত হয়ে পড়েছে। কিন্তু তা হলেও বাইডেনের জন্য  এটা এতবড় সমস্যা কেন? কারণ, বাইডেনের চার বছর মেয়াদের দু’বছর শেষ অর্থাৎ অর্ধেক সময়কাল পার হলে (আগামি নভেম্বরে) এক নির্বাচন হবে যাকে ‘মিডটার্ম নির্বাচন’ বলে। এতে  কংগ্রেস বা হাউজের ৪৩৫ আসনের পুরোটাই আর সিনেটের তিন ভাগের এক ভাগ আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।  আর সেখানে ফলাফল কী হতে পারে তা নিয়ে ইতোমধ্যে অনেক স্টাডি সার্ভে বা জনমত জরিপ সংগ্রহ ও তার ফলাফল আসা শুরু হয়েছে গত মাস থেকে। এর সার সংক্ষেপটা হলো, এশিয়ান পুঁজিবাজারকেন্দ্রিক রাজনৈতিক পত্রিকা ও হংকংভিত্তিক পত্রিকা এশিয়ান টাইমসের রিপোর্ট মতে, রিপাবলিকান ও ক্ষুব্ধ নিরপেক্ষ ভোটাররাই ইতোমধ্যে ৭০% হয়ে গেছে, যারা এবার ডেমোক্র্যাট বাইডেনের পার্টির বিরুদ্ধে ভোট দেবেন। তাতে ডেমোক্র্যাট দলের সমর্থকদের ভেতরেই বিদ্রোহ দেখা দিয়েছে, ফলে রিপাবলিকানরা একচেটিয়া জিতে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ছে। কিন্তু পাবলিক ঠিক কী দেখে এত ক্ষিপ্ত হয়ে গেল? এটা হলো মুদ্রাস্ফীতি। ওখানে বলা হয়েছে, গত সাত মাসে ‘ইউএস কনজুমার প্রাইজ সাডেনলি জাম্পড ৫% + ইয়ার-টু-ইয়ার; দ্যা থ্রেটস আর রিয়াল’।

Republicans and independents together comprise more than 70% of the American voting public, and their view of US economic conditions plunged to new record lows in August as inflation ground higher. That’s already provoked a revolt in the Democratic Party against White House spending plans, and sets the stage for a Republican landslide in the 2022 Congressional elections.

এ দিকে যেকোন মুদ্রাস্ফীতির কমন যে ফেনোমেনা দেখা যায়  হল, এতে কেউ সন্তুষ্ট নয়। কারণ এতে বেতনও বাড়বে, তবে ভোগ্যপণ্যের দামও এর চেয়ে বেশি বাড়বে। আমেরিকার অভ্যন্তরীণ মিডিয়া সিএনবিসি লিখছে, মজুরি মাসপ্রতি লাফ দিয়ে বেড়েছে ১.৩% যা বছরে বেড়েছে ১০.৩%, হারে [ …wages jump 1.3% for the month and 10.3% on the year.]। আর সিএনবিসির খবরের শিরোনাম, ‘এ শার্প রাইজ ইন ওয়েজেস ইজ কন্ট্রিবিউটিং টু ওরিজ ওভার ইনফ্লেশন’ [A sharp rise in wages is contributing to worries over inflation]। মানে ‘লাফিয়ে বেড়ে চলা মজুরি মুদ্রাস্ফীতির ওপরে আরো উদ্বেগ বাড়িয়েছে’।

এ দিকে ভোক্তাদের ক্ষুব্ধ মনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে ব্যাপক গবেষণা স্টাডি শুরু হয়েছে। আর তাতে প্রকাশিত ফলাফল বলছে, বাড়ি বা গাড়ির ভাড়া সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। আগের বছরের চেয়ে ১৭% বাড়ির ভাড়া বেড়েছে […renters signing a new lease paid an average of 17% more than the previous tenant]। ২০% পর্যন্ত বেড়েছে পুরনো গাড়ির দাম। ভোক্তামূল্য সূচক যা গড়ে বছরে ২% বৃদ্ধির মধ্যে থাকত তা এখন ১২% এর উপরে উঠে গেছে। গবেষণা স্টাডি নিয়ে সব মিডিয়া রিপোর্টগুলো এরকমই।

কিন্তু কেন এমন মুদ্রাস্ফীতি, পেছনের কারণ কী?
এ নিয়ে এশিয়ান টাইম্সের ১০ সেপ্টেম্বরে রিপোর্টের শিরোনাম, ‘এটা তো মুদ্রাস্ফীতি নয়রে বোকা’, বাইডেন বিদ্রোহের মুখোমুখি [‘It’s the inflation, stupid’ – Biden faces revolt]। আর ভিতরে এবার কারণ বর্ণনা করে লিখেছে, গত বিশ বছর ধরে চীনাপণ্য আমদানি করে আমেরিকা নিজ ভোক্তার জন্য তৈরি করা বহু ভোগ্যপণ্যের দাম কমিয়ে রাখতে পেরেছিল। কিন্তু গত ২০২০ সাল থেকে চীন থেকে আমেরিকার আমদানি করা পণ্যের মূল্য (বাড়তি শুল্ক আরোপ করে) বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

For twenty years, US imports from China helped reduce the cost of finished goods in the United States, but US import prices from China began rising in 2020.

গত ৭ আগস্ট এশিয়ান টাইমস আরেক রিপোর্টে বলেছিল, ‘ট্রাম্পের আমলে চীনা পণ্যের ওপর তার বাড়তি শুল্ক আরোপ আমেরিকায় রেকর্ড মুদ্রাস্ফীতির কারণ ঘটিয়েছে যেটা আবার এখন আগামী ২০২২ সালের মিডটার্ম নির্বাচনে বাইডেনের দলের জেতার সম্ভাবনাকে হুমকিতে ফেলেছে।’ এ কারণে এই রিপোর্টের শিরোনাম ছিল, ‘ইউএস বিজনেস পুশ বাইডেন ফর অ্যা চায়না ট্রেড ডিল’ [US business pushes Biden for a China trade deal]। কেন?

ভিতরের খবরের মূল কথাটা হল, ‘আমেরিকার রাজনৈতিক ইতিহাসে যা কখনো আগে ঘটেনি তা হলো আমেরিকার পুরো ব্যবসায়ী মহল- আমেরিকার ৩০টির বেশি ব্যবসায়ী সমিতি (রয়টার্সের হিসাবে ৩৬টিরও বেশি), এরা এক জোটে ও এক স্বরে গত ৫ আগস্ট বাইডেন প্রশাসনের কাছে চীনের সাথে বাণিজ্য আলোচনা আবার শুরু করা এবং চীনা পণ্য আমদানিতে বাড়তি শুল্ক আরোপ বাতিলের দাবি জানিয়েছে”।

Never before in US political history has the whole of the American business community—more than thirty major business organizations—spoke with one voice as it did in an August 5 appeal to the Biden administration to eliminate tariffs on imports from China.

বিবিসি বলছে, ‘২০১৯ সালের মে পর্যন্ত ট্রাম্প শুল্ক বাড়াতে বাড়াতে তা ২৫% পর্যন্ত করেছিলেন।’ তবে সিএনএন বলেছে, কোনো কোনো পণ্যে এটা আসলে ৬৬% পর্যন্ত [The US still has tariffs on 66% of Chinese exports]।

ট্রাম্পের স্বদেশীপনার ঠেলায় বাইডেন ‘নিহত’ হতে যাচ্ছেন!
হ্যাঁ ঠিক তাই। এটাই হলো ট্রাম্পের জাতিবাদী স্বদেশীপনার পরিণতি। তবে আত্মঘাতী এই আকামটা ট্রাম্প করেছিলেন নিজ আমলে। কিন্তু এর পরিণতি আসতে সময় লেগেছিল। আর বোকা বাইডেন, ট্রাম্পের চীনা বাণিজ্যযুদ্ধ ও শুল্কহার পলিসি যেমন ছিল তা বজায় রেখেছিলেন। কিন্তু ট্রাম্পের শুল্কহার বাড়ানোর খারাপ প্রতিক্রিয়া ও পরিণতি যখন দেখা দেয়া শুরু করে তখন সেটা বাইডেনের আমল বলে এবার তিনিই তাতে “কাটা পড়ছেন”। তাই, এতে তার দলের আগামী মিডটার্ম নির্বাচনে ফল খারাপ করবেন বলে পূর্বাভাস বেরিয়েছে।

কিন্তু কেন এমন প্রতিক্রিয়া হলো? এর পেছনের কারণ কী?
অল্প কথায় বললে মূল বিষয়টা এখানে ওয়ার্কারের ‘ন্যূনতম মজুরি’, মিনিমাম ওয়েজ [minimum wages]। পশ্চিমা বা অগ্রসর দেশে সাধারণ জীবনযাত্রার ব্যয় আমাদের তুলনায় অনেক বেশি, ফলে সে মোতাবেক তাদের মজুরিও বেশি রাখতে হত। এর মানে পশ্চিমের উৎপাদিত পণ্যের মূল্য বেশি হতো তাতে। কিন্তু আবার, পশ্চিমের তুলনায় এশিয়ায় (এমনকি চীনেরও) “ন্যূনতম মজুরি” কম। আমাদের মতো দেশের ন্যূনতম মজুরি চীনের চেয়েও কম। ফলে আমাদের মত দেশে উৎপাদিত পণ্যের মূল্য পশ্চিমের চেয়ে অনেক কম রাখা যায়, থাকতে দেখা যায়।

তাই এখন পশ্চিমা দেশ এক নয়া ধান্দা করেছে। পাশ্চাত্য নিজ ন্যূনতম মজুরি কম (যা প্রকারান্তরে নিজ উৎপাদিত পণ্যের মূল্য কম রাখতে তাদের সাহায্য করবে ) রাখার একটা কৌশল তারা বের করেছে। তা হল, আমাদের মতো দেশ থেকে তাদের মজুর বা ওয়ার্কিং ক্লাসের কিছু ভোগ্যপণ্যের আমদানি বাড়ানো। যেমন গার্মেন্টসঃ  এটা শ্রমঘন আর কম জটিল টেকনোলজি এতে জড়িত। তাই এমন ধরণের পণ্য আমাদের থেকে আনলে পশ্চিম তার শ্রমিককে দেয় মজুরিতে পোশাকের মূল্য অংশ কম দিলেও চলবে। আর এতে সামগ্রিক ন্যূনতম মজুরি কম রাখতে পারবে। এ জন্যই ‘পশ্চিম’ আমাদের দেশ থেকে গার্মেন্টস আমদানি করে থাকে। আর যদিও ভাব করে যে, আমাদেরই যেন তারা দয়া করছে!

ঠিক একইভাবে পশ্চিমের ভোগ্যপণ্যে আরেকটা শব্দ ব্যবহার করা হয় ‘ডিউরেবল গুডস” [durable goods]। বাংলায় বললে, যা অনেক দিন টিকে এমন পণ্য। মানে হল মধ্যবিত্ত ক্রেতা যে পণ্য কিনবার পরে আরামে তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে তা ব্যবহার করে থাকে। যেমন একটা ওয়াশিং মেশিন বা কাপড় ধোয়ার মেশিন বা ওভেন (চুলা) ইত্যাদি।

চীনে তৈরি এমন ‘ডিউরেবল গুডস’ এতে আমেরিকান মধ্যবিত্ত বা ওয়ার্কিং ক্লাসের কাছে খুবই কাম্য। কারণ এটা আমেরিকায় তৈরি করা হলে দাম বেশি পড়ত যা হয়ত  আমেরিকান ওয়ার্কিং ক্লাসের  ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যেত; যার সোজা মানে এসব ভোগ্যপণ্য আমেরিকায় তৈরি হলে এর বাড়তি মূল্যের কারণে আমেরিকার ন্যূনতম মজুরি অনেক বেশি দিতে হত।

এখন এমন পণ্যতেই সমসয়া বা অসন্তোষ চরম হয়েছে। কারণ এমন চীনা পণ্যের  উপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করে – ট্রাম্প বা বাইডেন সেই একই অবস্থা তৈরি করেছেন যদিও ভিন্নভাবে। ট্রাম্প এসব ‘ডিউরেবল গুডস’-এর  উপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করে ভেবেছেন, এতে চীনা পণ্য আমেরিকায় ঢুকে পড়া ঠেকিয়ে দেবেন। আর তাতে চীন পণ্য উতপাদক নিশ্চয় খুবই চাপে পড়বে। কিন্তু প্রতিক্রিয়া আসতে সময় লেগে যাওয়ায় ট্রাম্প ‘বেঁচে গেছেন’। ফল হয়েছে উল্টো, আমেরিকান ক্রেতাই  উল্টো চাপে পড়েছে – আর তবে তা বাইডেনের সময়ে।

কিন্তু ফলটা কেন এমন হল? কারণ ট্রাম্প বা বাইডেন হিসাব করেননি যে তারা এশিয়ান দেশ থেকে সস্তা ভোগ্যপণ্য আমদানি করেই নিজ দেশে ন্যূনতম মজুরি কম করে রাখতে পারেন। অন্য কোনভাবে নয়। আর এভাবেই একমাত্র  নিজ উৎপাদিত পণ্যমূল্য প্রতিযোগিতামূলক ও কম রাখার জন্য আমেরিকার এটাই একমাত্র চাবিকাঠি। অর্থাৎ পাশ্চাত্য এশিয়ার  উপর এব্যাপারে পুরোটাই নির্ভরশীল আর এই নির্ভরশীলতা স্থায়ী। এখান থেকে পশ্চিমা দেশের বের হবার কোন পথ নাই।  অথচ ট্রাম্প বা বাইডেন উভয়েই এই গুরুত্বপুর্ণ দিকটা উপেক্ষা করেছেন।

এক কথায় তাই, এটাই গ্লোবাল বাণিজ্য, লেনদেন বিনিময় ধেয়ে আসা বা আমেরিকা মুদ্রাস্ফীতি ক্রমবৃদ্ধির পেছনের মূল কারণ।

এ কারণে ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধ, বাড়তি শুল্ক আরোপ, জাতিবাদ-দেশপ্রেম এবং আমেরিকা ফার্স্ট ইত্যাদি সব বয়ানই আসলে ভুয়া, মৃত ও অকার্যকর!  জাতিবাদ-দেশপ্রেম এসব কথা গ্লোবাল বাণিজ্যের বিপরীত প্রতিপাদ্য বলে, (অর্থনৈতিক ধরনের) জাতিবাদ এক মিথ্যা স্লোগান!

খুব সম্ভবত ঠিক এ কারণেই বাইডেন  এবার আর লাজলজ্জার বালাই ত্যাগ করেছেন। তিনি এই সপ্তাহে চীনের প্রেসিডেন্টের সাথে ফোনালাপ (বাইডেন ক্ষমতায় আসার পরে এটা দ্বিতীয়) করে নিয়েছেন। কিন্তু তাতেও বাইডেন ইজ্জত কিছু তো গেছেই। এক বৃটিশ মিডিয়া ফিনানশিয়াল টাইমসে খবর বেরিয়েছে যে বাইডেনের প্রস্তাব চীন সাড়া দেয় নাই। ফলে পাত্তা দেয় নাই ধরণের ইঙ্গিত সেখানে বের হয়েছে। ফলে বাইডেনের ইজ্জত নিয়ে টানাটানি লেগেছে। কথাটা আসলে ছড়িয়েছে ট্রাম্পের প্রপাগান্ডিস্টেরা। আসল ঘটনা একেবারেই মিথ্যা তা নয়। বাইডেন প্রস্তাব রেখেছিলেন সরাসরি দুই সরকার প্রধান বা প্রেসিডেন্ট লেবেলে বৈঠকে বসা যায় কিনা। চীনা প্রেসিডেন্ট শিং তাতে সাড়া দেন নাই ঠিক তা বলা ভুল হবে। বলা যায় সায় দেন নাই। বরং বলেছেন, তাদের দুদেশের মধ্যে যে পরিমাণ তিক্ততা ও রেষারেষিমূলক আবহাওয়া ছড়িয়ে আছে আগে সেগুলোর কিছু হাল করার ব্যাপারে সচেষ্ট হতে নিতে বলেছেন চীনা প্রেসিডেন্ট শি [Xi apparently intimated that the tone and atmosphere of the relationship needed to be improved first,” ]।

এছাড়া ওদিকে ইতোমধ্যে ক্লিনটনের আমলের আমেরিকান এক প্রাক্তন ট্রেজারি সেক্রেটারি প্রফেসর লরেন্স সুমারস বেইজিংয়ে গিয়ে এক প্যানেল আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন। তিনি সেখানে মন্তব্য করেছেন, তিনি ‘আমেরিকার মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন’ [I do have considerable concerns about inflation ]।

এখন ডেমোক্র্যাট-রিপাবলিকান নির্বিশেষে আমেরিকা কি ‘আরেকবার বলিলেই খাইব’ দশায় যে, চীন-আমেরিকা বাণিজ্য আলোচনা অচিরেই বসবে?

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

[এই লেখাটা  গত  ১১ সেপ্টেম্বর আগষ্ট ২০২১, দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ওয়েবে ও পরদিন প্রিন্টে   “কিভাবে ট্রাম্পের ‘স্বদেশীপনা’য় বাইডেন আহত “– এই শিরোনামে  ছাপা হয়েছিল।
নয়াদিগন্তে ছাপা হওয়া লেখাগুলোকে আমার লেখার ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ বলা যায়।  আর আমার এই নিজস্ব সাইটের লেখাটাকে সেকেন্ড ভার্সান হিসাবে এবং  থিতু ভাষ্য বলে পাঠক গণ্য করতে পারেন। পরবর্তিতে ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ লেখাটাকেই এখানে আরও অনেক নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে ও নতুন শিরোনামে এখানে আজ ছাপা হল। ]

 

One thought on “ট্রাম্পের জাতিবাদ ফেল কিন্তু ঘায়েল বাইডেন

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s