মোদী কী হারবেন? তাই ‘বেশি’ পয়দা, বাংলাদেশ নিয়ে হৈচৈ
গৌতম দাস
১৮ অক্টোবর ২০২১, ০০:০৬ সোমবার
[সার-সংক্ষেপঃ আরএসএস প্রধান এই মোহন ভাগবত, ইনার দাবি মুসলমানেরা নাকি বেশি পয়দা করে। এই জ্ঞানী লোকের কাছে জানতে চাই, দেশে ধর্মীয় জনসংখ্যায় ভারসাম্যহীনতা মানে কী? একটা দেশে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের অনুপাতের মধ্যে ভারসাম্য থাকতেই হবে, কেন? দেশে হিন্দু-মুসলমান কী সমান থাকতেই হবে? কেন? ইহা কি বস্তু? যে না থাকলে কী ক্ষতি? যদি নাগরিক মাত্রই সবাই সম-অধিকারের নাগরিক হয় তো উনার সমস্যা কী?
আর এই মোহন ভাগবত তিনি কে? কোন নবাব বা দেশের কোন মালকিন উনি? তার অনুমতি নিয়ে কী মুসলমানদেরকে কী বাচ্চা পয়দা করতে হবে নাকি? তাহলে তো প্রশ্ন করতে হয় হিন্দুরা জনসংখ্যায় বেশি কেন? মুসলমানের সমান না কেন?
একালের ভারতে বা বাংলাদেশে অথবা অবিভক্ত ভারতে কোথাও কখনো কি দেশে হিন্দু-মুসলমানের জনসংখ্যা অনুপাত কী হবে – এ নিয়ে কোনো আইন, কোনো চুক্তি হয়েছিল? ভারতের কনস্টিটিউশনে এ নিয়ে কি কোথাও কিছু লেখা আছে? নাকি থাকতে পারে? উনি কী দিয়ে বুঝেছেন, মেপেছেন যে কোনটাকে ভারসাম্যপূর্ণ আর ভারসাম্যহীন জনসংখ্যা বলে? এমনকি টেকনিক্যালি জনসংখ্যা বিশারদদের কাছে কী এমন কোনো মাপক আছে, থাকা সম্ভব, যা দিয়ে জনসংখ্যার ভারসাম্য বলে কোন বস্তু পরিমাপ করা যায়? ভাগবত সাহেব কী দিয়ে মেপেছেন? ইউজলেস লুজার সব!]
There has been attempt to increase Muslim population and turn India into Pakistan: Mohan Bhagwat
প্রধানমন্ত্রী মোদী কি আগামী নির্বাচনে হেরে যাচ্ছেন বলে এখনই টের পেয়েছেন? ভারতের আগামী নির্বাচন মানে প্রধানমন্ত্রিত্ব নির্ধারণের নির্বাচন বা চলতি ভাষায় অনেকে একে ‘কেন্দ্রের’ নির্বাচন বলে। আর আনুষ্ঠানিক ভাষায় তা ১৮তম “লোকসভার” নির্বাচন। আর সেই নির্বাচনের শেষে ফলাফল হয়ে যাওয়ার কথা ২০২৪ সালের মে মাসের মধ্যে, এই হলো শিডিউল।
অনেকের মনে হতে পারে এখনো সে তো প্রায় আড়াই বছর মানে অনেক দূরে। না, ঠিক দূরে না। ভারতের ভোটের হিসাবে আগামী মার্চ মাস – সেটা হল অনেকটা আমেরিকার মিড-টার্মের মত। আমেরিকায় প্রেসিডেন্টের চার বছর টার্মের মধ্যে মাঝামাঝি, ঠিক দুই বছরের সময় নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সংসদের সব আসনেরই নতুন নির্বাচন হয়। আর সাথে সিনেটের এক-তৃতীয়াংশ আসনেও নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ্টাই মিড-টার্ম নির্বাচন। এর ফলাফল যাই আসুক প্রেসিডেন্ট স্বপদেই থেকে যাবেন, কিছুই হবে না। কিন্তু প্রেসিডেন্ট সম্পর্কে মানুষের মনোভাব বোঝা যাবে, যেটা পরের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট বা তার দলের ভবিষ্যত কেমন এর ইঙ্গিত দিবে।
ভারতের (এখনকার) ছোটবড় মিলিয়ে মোট ২৮ রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে বড় হল উত্তরপ্রদেশ। এরাজ্য একাই কেন্দ্রের মোট ৫৪৩ আসনের মধ্যে ৮০ আসনের; যেখানে এর পরের বড় বড় পাঁচ রাজ্যের আসন হল – ৪৮, ৪২, ৪০, ৩৯, ২৮ এরকম। মানে উত্তরপ্রদেশের পরে অন্য রাজ্যগুলো সবাই অনেক ছোট, প্রায় সবাই এর অর্ধেক আসনের নিচে। তাই উত্তরপ্রদেশের নিজ রাজ্য-নির্বাচন (যা প্রাদেশিক বা লেজিসলেটিভ) ভারতের মিড-টার্ম নির্বাচনের মত বলে মনে করা হয়।
উত্তরপ্রদেশের নির্বাচন আগামী বছর ২০২২ সালের মার্চে, ৪০৩ আসনের রাজ্য নির্বাচন হবে এটা। মনে করা হয় এ রাজ্যে মোদীর দল আগামী মার্চে এবারো জিতলে তা মোদীকে ২০২৪ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় ফিরতে সহায়তা করবে। এ ছাড়াও মনে করা হয়, ভারতের তথাকথিত কেন্দ্রের শাসন মানে হিন্দিভাষীর শাসন, উত্তরপ্রদেশের শাসন বা কালচারালি আর্য আধিপত্যের শাসন ইত্যাদি সব উত্তরপ্রদেশের সাথে যুক্ত।
এখন উত্তরপ্রদেশের রাজনীতি ও শাসন বা আসলে নির্বাচন মানে হল যোগী আদিত্যনাথের দানবীয় নিপীড়নের মুখে দাঁড়ানো। তবুও উত্তরপ্রদেশে আগামী মার্চে কে জিতবে সেটা আজকের এলেখার কোনো ইস্যু নয়। এখানে আজ ইস্যু বা লেখার প্রসঙ্গ হল এখন থেকে সারা ভারতে আরএসএস-বিজেপির নির্বাচনী ইস্যু কী হতে যাচ্ছে, তা বোঝার চেষ্টা করা। কারণ সম্প্রতি আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত “ভাস্ট ডিফারেন্স” বলে ফেটে পড়েছেন। তিনি গত শুক্রবার নাগপুরে (মহারাষ্ট্রে) বার্ষিক বিজয়াদশমী পালন উপলক্ষে বক্তৃতা রাখছিলেন।
কিন্তু ‘ভাস্ট ডিফারেন্স’ মানে কী?
ভাস্ট ডিফারেন্স বা ব্যাপক ফারাক বলতে কী কিসের ফারাক বুঝানো হয়েছে? মুসলমানরা নাকি খালি বেশি বেশি বাচ্চা পয়দা করে। এটা অনেক দিনের পুরানা এক ইতরোচিত রেসিস্ট [racist] বা হিটলারি অভিযোগ; বিশেষত যখন আরএসএস-বিজেপির মনে হয় যুতসই অভিযোগের অভাব ঘটেছে, তখন এটা তারা আবার উঠায় আনে। স্বাধীন হওয়ার পর ভারতে এ’অভিযোগ প্রথম তুলেছিল ১৯৫১ সালে আসাম রাজ্য। সেটা কংগ্রেসের নেতৃত্বে। তবে সারা অসমীয়া বা আসামিজ [Assamese] জনগোষ্ঠী করেছিল। সেই সময় থেকে (পূর্ব পাকিস্তান) বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষ বাঙালিরা মূলত তারা বুঝাত মুসলমানরা, আসামে অনুপ্রবেশ করেছে বলে অভিযোগ প্রথম জোরেশোরে ফোকাস উঠতে থাকে। পরে ট্রাইবাল বা পাহাড়িসহ সব অসমীয়া-জনগোষ্ঠী এক দিকে আর বাকিরা সবাই ‘বিদেশী’, এভাবে এক যুক্তিতে ভাগ করে সর্বাত্মক বিভেদ আন্দোলন শুরু হয়েছিল, যা আর এদের কারো হাতে থাকেনি; অসমীয়া-জাতিবাদীদের চরম-উগ্র আন্দোলন হয়ে উঠেছিল। শেষে ১৯৮৫ সালে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী এক আপস-চুক্তি করেছিলেন এই শর্তে যে, তিনি “আসামে বিশেষ জনগণনা” ও প্রত্যেকের “নাগরিকত্ব চেক বা যাচাই” করে কথিত বিদেশী বাংলাদেশীদের চিহ্নিত করে বের করার বন্দোবস্ত নেবেন। রাজীব গান্ধীর ভাষায় তিনি এই আপস না করলে আসাম ভারত থেকে আলাদা হয়ে যেত। তাই তিনি এমন আপস করেছিলেন। কিন্তু তিনি পরে এ নিয়ে কোনো বাস্তবায়নে যাননি। ফলে অসমীয়-জাতিবাদ আরো চরম উগ্র হয়ে উঠতে থাকে। আর তাদের এই উগ্রতার জোরে তারা একেবারেই নিশ্চিত হয়ে যায় যে, আসামের “সব দুঃখের কারণ” হল বাংলাদেশের বাঙালি। (অথচ নেহেরুর আসল ভয় হল আসাম ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চীনের অংশ হয়ে যেতে পারে অথবা অন্তত চীন আসামের উপর দিয়ে করিডোর নিতে পারলে বাংলাদেশে প্রবেশ করে এরপর বঙ্গোপসাগরকে বন্দর হিসাবে ব্যবহারের সুযোগ পেয়ে যেতে পারে – এই ভয়ে তারা আসামকে সবসময় যোগাযোগ অবকাঠামো দুর্বল করে ফেলে রাখতে চেয়ে এসেছে। আর এটাই আসামের পিছিয়ে পড়া রাজ্য হয়ে থাকার মূল কারণ। ) তাই তাদের অসমীয়-জাতির জন্য জীবন দিয়ে ফেলতে পারে এমন চাওয়া অসমিজ ইন্টেলেকচুয়ালরা আদালতের মাধ্যমে ওই দাবি বাস্তবায়নে আগানোর বা বলা যায় এক সেমি-ষড়যন্ত্রের পথ ধরেন। এর এক কুতুব নেতা বলতে পারি আমরা ভারতের সুপ্রিম কোর্টের এক বিচারক রঞ্জন গোগই [Ranjan Gogoi], এই অসমিজের নাম করতে পারি। এক বেআইনি কাজকে তারা আইনি রূপ দিয়ে হালাল করেছেন বলা যায়। বিচার বিভাগ গায়ের জোরে নির্বাহি বিভাগের কাজ হাতে তুলে নিয়েছিল। আসামের মাঠের নাগরিকত্ব যাচাই আদালতের কাজ ছিল না। তবু তারা তাদের মুসলমান-ঘৃণা ও অনুপ্রবেশকারি তত্ব সত্য প্রমাণ করতে একাজ করেছিল। এবং তাতেও ব্যর্থ হয়। বাংলাদেশীদের কথিত অনুপ্রবেশ তাদের সব দুঃখ ও সম্পদ হারানোর কারণ’ একথা তারা মাঠের গণনা ও শতভাগ নাগরিকত্ব পরীক্ষা করেও দেখেছেন – কথা সত্য নয়, প্রমাণ করতে পারেন নাই।
বাস্তবে এই গণনা পরিচালিত হয়েছিল পুরোটাই আসামের কোনো প্রশাসন নয়, খোদ ভারতের সুপ্রিম কোর্টের নিজস্ব তত্ত্বাবধানে। আর অন্য প্রদেশ (মধ্যপ্রদেশ) থেকে ক্যাডার অফিসার এনে আর মূলত বিচারক রঞ্জন গোগইয়ের সরাসরি তত্ত্বাবধানে এ কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং যখন এর শেষ ১৩ মাস তিনি ভারতের চিফ জাস্টিস সেসময়ে। কিন্তু সব চেষ্টার পরও শোচনীয়ভাবে অসমীয়া-জাতিবাদীরা তাদের দাবির বাস্তবতা প্রমাণ করতে পারেনি। এমন পরিস্থিতি ও ফলাফলে তারা তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। বিজেপি (তখন রাজ্য সরকারে) প্রস্তাব করে মুখরক্ষার্থে আবার ১০-২০ শতাংশ বাংলাদেশসংলগ্ন আসাম সীমান্ত অংশে আবার গণনা করতে বিচারক রঞ্জন গোগই যেন এক আদালতের নির্দেশ জারি করে দেন। উদ্দেশ্য ছিল এবারের পুণঃগণনায় কারচুপি করে মুসলমানদের ‘অনাগরিক’ বলে বেছে বের করে দেয়া হবে। কিন্তু রঞ্জন গোগই আর নোংরা একাজে নিজেকে জড়াতে রাজি হননি। তিনি ওই প্রাপ্ত গণনাকেই ফাইনাল বলে রায় দেন। তাতে কিন্তু অসমীয় নেতা-পাবলিকেরাও এবার বিজেপি থেকে আলাদা হয়ে আন্দোলন শুরু করার চেষ্টা করে; কারণ তাদের বিভেদের পয়েন্ট হল, বিজেপি চাইছিল বাংলাদেশী সাধারণভাবে নয়, কেবল বাংলাদেশের কথিত মুসলমানদের বের করে দিতে নতুন কিছু করে। আর অসমিজরা বলছিল, তারা হিন্দু-মুসলমান সব বাংলাদেশীকে বের করতে চান, যা তাদের অরিজিনাল দাবি ছিল।
এদিকে গত ২০১৯ সালে আসামে আবার রাজ্য নির্বাচন হয় এবং বিজেপি আবার ‘কোন জাদুমন্ত্রে’ ক্ষমতায় আসে। কারণ এই নির্বাচনের আগে অসমীয় ন্যাশলালিজম এত উগ্র হয়ে উঠেছিল খোদ বিজেপির বিরুদ্ধে যে মোদী পাঁচবার এসেও মিটিং করতে পারেন নাই, ফিরে গেছিলেন। আর এবার নতুন চালে নতুন করে এবারের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে আসেন হিমন্ত বিশ্ব শর্মা। আর এসেই এরই মধ্যে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, “মুসলমানরা নাকি খালি বেশি বেশি বাচ্চা পয়দা করে। তাই ওই কথায় গত জুলাই মাসে আনন্দবাজার লিখেছিল, “জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সেনা’ নামাতে চলেছে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার। মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা খোদ বিধান সভায় এমন ঘোষণা করেছেন। তবে নমনী অসম, যেখানে মূলত মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের মাস, সেখানেই এই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ অভিযান চালানো হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। এমনকি আনন্দবাজারও ওই রিপোর্টের শেষ বাক্যে লিখেছে, ‘তবে মুসলিম জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটছে বলে দাবি করলেও, তার সপক্ষে কোনো প্রমাণ দিতে দেখা যায়নি হিমন্তকে।’
“জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগী অসম সরকারও। তার জন্য ১ হাজার ‘জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সেনা’ নামাতে চলেছে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার। মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা খোদ সোমবার বিধানসভায় এমন ঘোষণা করেছেন। তবে নমনী অসম, যেখানে মূলত মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের বাস, সেখানেই এই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ অভিযান চালানো হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।” – আনন্দবাজার ২০ জুলাই ২০২১।
আর ওদিকে অসমীয়া দেশপ্রেমী ভাইয়েরা, তাদের কী খবর? তারা ক্রমেই এখনো ‘অসমীয়া জাত-শ্রেষ্ঠত্ববাদ [Assamese culture superior to RSS ideology] – এই জাতিবাদের ঝাণ্ডা সবখানে উঁচিয়ে চলেছেন। কিন্তু বিজেপির বয়ান ও বাক্সে ঢুকে গেছেন সেটা এখন ভুলে আছেন। গত মাসে আসামের বৈধ-মুসলমান নাগরিককে প্রায় ছয় হাজার একরেরও বেশি বৈধ নিজ জমি থেকে মুখ্যমন্ত্রী তাদের উৎখাত করে দিয়েছেন। প্রথমে বলা হল শিবমন্দির বানাতে মুসলমানদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে দেখেন বিবিসির রিপোর্ট আসাম: শিবমন্দির বানাতে মুসলিম উচ্ছেদ, বিক্ষোভে পুলিশের গুলি। পরে বলা হল যে না একটা কৃষি খামার করবে হাজার একরের।
“বেশ কয়েক মাস ধরেই আলোচনা হচ্ছিল এই উচ্ছেদ আর তার পরের পুনর্বাসন নিয়ে। সরকারের দাবি এই জমি তাদের। গ্রামবাসীরা দখলকারী। তাই তাদের সরে যেতে হবে। “কেন এটা সরকারি জমি হবে? আমাদের পূর্বপুরুষরা উচিত দাম দিয়ে এই জমি কিনেছিল। সেই দলিলও আমাদের কাছে আছে,” বলছিলেন আজিরুন্নেসা নামের এক নারী।
সরাসরি সেই হত্যার ক্লিপ আর বিবিসির সরেজমিন রিপোর্ট আপনারা দেখেছেন, যেখানে নিহত ব্যক্তির স্ত্রীর বক্তব্য যেটা শিরোনাম করা হয়েছে যে, আসামে মুসলিম উচ্ছেদ: ‘আমাদের দোষ একটাই – আমরা মুসলমান’ বলছিলেন ধলপুরের এক গ্রামবাসী।
এই হলো হিন্দু-মুসলমান জনসংখ্যার ‘ভাস্ট ডিফারেন্সের’ মানে, ব্যাপক ফারাকের গল্প। এত দিন ভাবা হয়েছিল, বিজেপি এমন করে আসামে বা বিক্ষিপ্তভাবে উত্তরপ্রদেশে যোগীর রাজ্যে জোর করে ভ্যাসেকটমি করা বা ‘জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সেনা’ নামানো হতে পারে।
কিন্তু না। এটা আর শুধু বিজেপির না, এটা এখন একেবারে আরএসএসের কেন্দ্রীয় প্রোগ্রাম, মানে এটাই আরএসএস-বিজেপির প্রার্থী নরেন্দ্র মোদির মূল কর্মসূচি। সে কথাই ঘোষণা করেছেন মোহন ভাগবত গত শুক্রবার।
‘Vast differences’ in growth rate of religions
ভাস্ট ডিফারেন্স থিওরি। ভাগবত গত ২০১৫ সালের তাদেরই এক পুরনো প্রস্তাব বের করে এনেছেন, বলেছেন এটি নাকি তাদের ‘পপুলেশন পলিসি’। তবে তিনি মোদি সরকারকে যত দ্রুত সম্ভব ‘জাতীয় জনসংখ্যা নীতি’ বানাতে বলছেন। আর দাবি করছেন, বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রুপ জনগোষ্ঠীর জন্মহার বৃদ্ধির ব্যাপক ফারাক, অনুপ্রবেশ ও ধর্মান্তকরণের ফলে আমাদের ধর্মীয় জনসংখ্যার অনুপাত ভারসাম্যহীন হয়ে গেছে। বিশেষত সীমান্ত এলাকাগুলোতে, যা আমাদের দেশের ঐক্য, সংহতি ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের ওপর হুমকি হয়ে উঠতে পারে। তিনি হুঁশিয়ারি দেন যে ‘অনুপ্রবেশ ও উচ্চ জন্মহার এমন দুভাবেই মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি ভারতের ঐক্যের জন্য বিরাট হুমকি’।
Friday called for a National Register of Citizens (NRC) and a review of the population policy, pointing out “demographic imbalance” due to “vast differences” in the growth rate of different religions and infiltration in border areas.
“আমাদের জনসংখ্যার মধ্যে ভারতীয় ধর্মীয় অরিজিন যারা এরা ছিল ৮৮ শতাংশ, যা ১৯৫১-২০১১ এ সময়ের মধ্যে নেমে এসেছে ৮৩.৮ শতাংশে। অথচ এর বিপরীতে মুসলিম জনসংখ্যা যা আগে ছিল ৯.৮ শতাংশ বেড়ে হয়ে গেছে ১৪.২৩ শতাংশ” । এ ছাড়াও শেষে মোহন ভাগবত যা বলেছেন, তাতে তারই মানসিক স্থিরতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেবে। তিনি বলেছেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের গত নির্বাচনের পরে সে সহিংসতা শুরু হয়েছে এবং আর তাতে রাজ্য সরকার যে বর্বরতা ও জনসংখ্যার (হিন্দু-মুসলমান) ভারসাম্যহীনতাকে তোয়াজ করেছে, তাতে হিন্দুদের দুস্থ অবস্থা উঠেছে চরমে।’ এখানে উদ্ধৃতিগুলো নিতে হয়েছে শনিবারের ভারতের ওয়েব ম্যাগাজিন বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড থেকে।
This resolution says the share of religions of “Bharatiya origin” — including Hinduism, Buddhism, Jainism and Sikhism and excluding Islam and Christianity — came down to 83.8 per cent in 2011 census from 88 per cent in 1951 while the Muslim population increased to 14.23 per cent from 9.8 per cent during that period.
বাংলাদেশে পুজাঃ
এদিকে বাংলাদেশের দুর্গাপূজার শেষ দুই দিন স্বাভাবিকভাবে শেষ হতে পারেনি। আবার আমাদের মুসলমান জনগোষ্ঠীও প্রচণ্ড অস্বস্তিতে, তারাও ক্ষুব্ধ; তাদের জন্যও ধর্মীয় অবমাননাকর ঘটনার জন্য। আবার সরকারও খাচ্ছে হিমশিম; আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে গিয়ে তাদের নাজেহাল অবস্থা হয়েছে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে কোনোপক্ষই সন্তুষ্ট নয় একেবারেই। এক কথায় বললে, কোথাও একটা স্যাবোটাজ হয়েছে,আমাদের আন্তঃজনগোষ্ঠীর মধ্যে ঘৃণা ছিটানো হয়েছে, যা সরকারের অনুমানের নিয়ন্ত্রণসীমাকেও ছাড়িয়ে গেছে। আমরা সবাই একটি লজ্জায় পড়ে গেছি। আমাদের আন্তঃধর্মীয় সম্পর্ক সমসাময়িককালে এমন খারাপ হয়নি এবং দুর্দশায় কখনো পড়েনি। এরই মধ্যে আমরা দেখলাম বিজেপির কলকাতার সংসদীয় দলের নেতা শুভেন্ধু অধিকারী একটা স্পষ্ট ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তিনি লিখিতভাবে (যে চিঠি বিবিসিতে প্রকাশিত) প্রধানমন্ত্রী মোদীর কাছে বাংলাদেশে ‘হস্তক্ষেপ করতে’ আহ্বান রেখেছেন! অর্থাৎ সকালে মন্দিরে কোরান শরীফ রেখে আসার ঘটনা আর সন্ধ্যায় মোদীকে বাংলাদেশে হস্তক্ষেপের জন্য ডাক দেয়া?
তার নিশ্চয় অজানা নয় যে, আরেকটা দেশে হস্তক্ষেপ করতে প্রকাশ্যে আহ্বান জানানোর অর্থ-তাৎপর্য ও এর দায়-দায়িত্ব কী? দেখা যাচ্ছে তিনি আগে থেকেই যেন সব জানতেন। তবে বিবিসি তার প্রপাগান্ডা করতে রাজি হয়নি না হলেও তাকে দুরেও ফেলে নাই। তার আহবানের চিঠি ঠিকই প্রচার করে দিয়েছে! তা হলে বাংলাদেশের সহিংসতায় তার সংশ্লিষ্টতা কী সেটি পুরাটা এখন খুলে বলার দায় বিজেপির কলকাতার সংসদীয় দলের নেতা শুভেন্ধু অধিকারীর। আর বাংলাদেশের উচিত হবে এ ব্যাপারে ভারত সরকারের কাছে ব্যাখ্যা দাবি করা।
যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, মোদির আগামী নির্বাচনে জয় না পাওয়া নিয়ে তিনি কি নিশ্চিত? না হলে মুসলমানরা নাকি ‘বেশি বাচ্চা পয়দা’ করে অথবা জনসংখ্যা ‘ভারসাম্যহীন’- এসব কথা যে রেসিজম বর্ণবাদিতা, তা জেনেও এমন কথাগুলো তাদের র্যাংক অ্যান্ড ফাইল- আরএসএস থেকে বিজেপি সব নেতাকর্মী মুখ্যমন্ত্রী মরিয়া হয়ে উচ্চারণ করতে শুরু করেছে কেন? সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষ এমন কথা বলতে পারে না।
এই মোহন ভাগবত, এই জ্ঞানী লোকের কাছে জানতে চাই, দেশে জনসংখ্যার ভারসাম্যহীনতা মানে কী? মানে একটা দেশে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের অনুপাতের মধ্যে ভারসাম্য থাকতেই হবে, কেন? এটা কি বস্তু?
মোহন ভাগবত তিনি কে? তার অনুমতি নিয়ে মুসলমানদেরকে কী বাচ্চা পয়দা করতে হবে? তাহলে তো প্রশ্ন করতে হয় হিন্দুরা জনসংখ্যায় বেশি কেন? মুসলমানের সমান না কেন? ইউজলেস লুজার সব!
একালের ভারতে বা বাংলাদেশে অথবা অবিভক্ত ভারতে কোথাও কখনো কি দেশে হিন্দু-মুসলমানের জনসংখ্যা অনুপাত কী হবে- এ নিয়ে কোনো আইন, কোনো চুক্তি হয়েছিল? ভারতের কনস্টিটিউশনে এ নিয়ে কি কোথাও কিছু লেখা আছে? নাকি থাকতে পারে? ইনি কী দিয়ে বুঝেছেন, কোনটাকে ভারসাম্যপূর্ণ আর ভারসাম্যহীন বলে? এমনকি টেকনিক্যালি জনসংখ্যা বিশারদদের কাছে কী এমন কোনো মাপক আছে, থাকা সম্ভব, যা দিয়ে জনসংখ্যার পরিমাপক করা যায়? ভাগবত সাহেব কী দিয়ে মেপেছেন?
ভারতের কনস্টিটিউশনে বা কোন আইন অনুযায়ী, মুসলমানরা কথিত কোন ভারসাম্য ভেঙেছে? আর সেটি তিনি ডিকটেট করার কে? তিনি কোন মহারাজা?
মোহন ভাগবত কি জানেন ভারতের সরকারি ভাষ্য হলো, মুসলমানদের জনসংখ্যা বেশি হওয়াটা স্বাভাবিক?
আবার এসমস্ত বক্তব্যই তো এক রেসিস্ট বক্তব্য। তিনি নিজেই মনেও হচ্ছে, জলাতঙ্ক রোগীর মতো মুসলমান-আতঙ্কে ভুগছেন! এত ভয়াবহ অসুস্থতা! এটি তো হিটলারের অন্য জাতি-ঘৃণা বা অন্য জাতি-আতঙ্ক এসবেরই কপি। ভারতের কনস্টিটিউশনাল কোর্টের উচিত হবে এই দাঙ্গাবাজ অসুস্থ উসকানিদাতাকে থামানো, স্বপ্রণোদিত হয়ে অন্তত কিছু পদক্ষেপ নেয়া। নইলে এসব অসুস্থ লোক এ অঞ্চলে আগুন লাগিয়ে ছারখার করে দেবে, নিজেরাও পুড়ে মরবে। াশা করি ভারতে কিছু সুস্থ লোক এখনো বেঁচে আছে!
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
[এই লেখাটা গত ১৬ অক্টোবর ২০২১, দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ওয়েবে ও পরদিন প্রিন্টে “বেশি পয়দার বিরুদ্ধে মোদির সংগ্রাম“– এই শিরোনামে ছাপা হয়েছিল।
নয়াদিগন্তে ছাপা হওয়া লেখাগুলোকে আমার লেখার ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ বলা যায়। আর আমার এই নিজস্ব সাইটের লেখাটাকে সেকেন্ড ভার্সান হিসাবে এবং থিতু ভাষ্য বলে পাঠক গণ্য করতে পারেন। পরবর্তিতে ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ লেখাটাকেই এখানে আরও অনেক নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে ও নতুন শিরোনামে এখানে আজ ছাপা হল। ]