এক মফস্বলী জেনারেল


এক মফস্বলী জেনারেল

গৌতম দাস

০৮ নভেম্বর ২০২১, ০০:০৫ সোমবার

https://wp.me/p1sCvy-3Nt

 

China Attempting To Reduce India’s Influence In Myanmar, Sea: Bipin Rawat

 

ভারতের জেনারেল বিপিন রাওয়াত [General Bipin Rawat], তার পদবি হল চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ, সিডিএস বা CDS; যা ভারতের তিন বাহিনী প্রধানদেরও উপরের এক পদ ও পদবি। এই পদটি সম্প্রতি তৈরি করা হয়েছে। জেনারেল রাওয়াত ভারতের যখন (২০১৭-১৯) আর্মি চীফ ছিলেন তখন এটা মোদির হাতে তৈরি হচ্ছিল।  বলা যায় আর্মিকে হিন্দুত্ববাদ ও আরএসএসের আলোতে ছাপ দিয়ে সাজানোর প্রথম পদক্ষেপ এটা।  তাই এই পদ সৃষ্টি হলে এর প্রথম পদাধিকারী হয়েছেন ততদিনে অবসর নেয়া ভারতের আর্মি চিফ এই জেনারেল বিপিন রাওয়াত। আর ওর শুরু, গত ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে।

তিনি সম্প্রতি আসাম সফরে গিয়েছিলেন; গত ২০ অক্টোবর এক অভ্যন্তরীণ সভা-সেমিনারে বক্তৃতা দিতে। ঘটনা হল – আসাম পুলিশের এক অনুষ্ঠান ছিল সেটা। সভাটা হল – “প্রথম রবিকান্ত সিং মেমোরিয়াল লেকচার সিরিজ” যা আয়োজিত হয়েছিল ভারতের আইপিএস অফিসার ও পুলিশের এসপি রবিকান্ত সিং স্মরণে। তিনি আসামে তাঁর কাজের জেলা তিনসুকিয়ায় বিচ্ছিন্নতাবিরোধী তৎপরতা দমনের দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু ১৯৯৬ সালে আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র দল ‘উলফা’র হাতে তিনি খুন হয়ে যান। এসবই তাই আসামের আভ্যন্তরীণ ঘটনা।

জেনারেল রাওয়াত ছিলেন সেই স্মরণসভার প্রধান বক্তা। পুরো অনুষ্ঠানে এক তিনি ছাড়া বাকি সবাই ছিলেন সিভিলিয়ান। আর সাথে বক্তৃতার স্টেজে দেখা যাচ্ছে পেছনের টাঙানো ব্যানারে বাংলাদেশে বর্তমান ভারতীয় রাষ্ট্রদূত দোরাইস্বামীর নাম, মানে তিনিও সেখানে বক্তা ছিলেন।

যে উদ্দেশ্যে এই অনুষ্ঠান, তার সাথে ওর দুই প্রধান বক্তা এবং প্রধান বক্তার বক্তব্যের বিষয় ইত্যাদি এসবগুলোর সাথে সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া ছিল কঠিন। বরং দেখা গেছে, খামোখা কোথা থেকে বাংলাদেশ সেখানে আলোচনায় এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেউ না হয়েও। কেন?

কেন বাংলাদেশঃ
“Assam at crossroads: Geopolitical events its Geographical events in its neighbourhood impacting North East India” – এই ছিল সভায় আলোচ্য বিষয়। বাংলা করলে হয়, নর্থ-ইস্ট ইন্ডিয়ার পড়শি দেশের জিও-পলিটিক্যাল ঘটনায় আসাম বড় বিপদে আছে, এরকম।

সেখান থেকে  বাংলাদেশ-সংশ্লিষ্ট মূল কথাগুলো তুলে আনলে, জেনারেল রাওয়াত বলছেন, ” মিয়ানমার, বাংলাদেশে চীন হানা দিচ্ছে এবং তা ভারতের স্বার্থের বিরুদ্ধে (আর নট ইন ইন্ডিয়াস ইন্টারেস্ট’)। আরো বলছেন, “আমাদের সাউথইস্ট এশিয়া ও ভারত মহাসাগরে চীন ঢুকে পড়ছে তার বেল্ট রোড প্রজেক্ট দিয়ে। সম্প্রতি আমরা দেখছি একটা ভূ-কৌশলগত প্রতিযোগিতা এবং বিপুল বিনিয়োগ নিয়ে চীন এই অঞ্চলে আসছে”।

এখানে বক্তব্যগুলো নেয়া হয়েছে হিন্দুস্তান টাইমস, আসামের নিউজ-লাইফটিভিস্ক্রল (Scroll)ওয়েব ভারতীয় পত্রিকা থেকে। এছাড়া এখানে আলাদা করে বাংলাদেশের বণিকবার্তা পত্রিকার নাম ও রিপোর্টের কথা উল্লেখ করতেই হয়। বিশেষত ভারতীয়  নিউজ বাংলাদেশে স্থানীয় বাংলা পত্রিকায় কী করে রিপোর্টিং করতে হয় এর অনুকরণীয় উদাহরণ হিসাবে। বাংলাদেশের অনেক মিডিয়া যেখানে বিপরীতে এটাকে ভারতীয় প্রপাগান্ডা করে অর্থ আয়ের উপায় হিসাবে নিয়েছে। তারা  “পছন্দের” ভারতীয় পত্রিকা বা ‘র’ এসাইন্ড নিউজের বাংলায় অনুবাদ করে বা অনুবাদের নামে যা খুশি লিখে ছাপিয়ে থাকে।  ঢাকার এমন অন্য বাংলা সব মিডিয়ার জন্য বণিকবার্তা এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত; যদি কেউ ভাল হতে চায় অনুসরণ করতে পারে।

উপরে তুলে আনা জেনারেল রাওয়াতের কথায় ফিরে যাই, তার প্রথম বাক্য  ” মিয়ানমার, বাংলাদেশে চীন হানা দিচ্ছে এবং তা ভারতের স্বার্থের বিরুদ্ধে” – এই  বাক্যতেই তার কথা মিললো না।  যেমন চীন বাংলাদেশে ‘হানা’ দিচ্ছে, এই হানা দেওয়ার মানে কী?  চীন বাংলাদেশের কীভাবে হামলা দিয়েছে? কোন সামরিক হামলা করেছে নাকি? তা অবশ্যই না।  এছাড়া চীন বাংলাদেশে হানা দিলে বাংলাদেশ কি তাতে আপত্তি জানিয়েছে কারও কাছে নাকি? তা তো না।  এমনকি সে কথা কিন্তু রাওয়াতও আমাদের জানাচ্ছেন না। তাহলে?

অথচ – এক. রাওয়াত নিজেই বলছেন, চীন অবকাঠামো বিনিয়োগ নিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। তার মানে ব্যাপারটা বাণিজ্যিক। তাহলে এটাকে রাওয়াত হানা দেওয়া [foray] বলছেন কেন?  মানে সাথে একটা সামরিক  ভাব-ইঙ্গিত তুলছেন কেন? এটা একে বাণিজ্যিক জিনিস তার ওপর ‘অবকাঠামো বিনিয়োগ’ কোনো বাণিজ্যিক বিনিয়োগ নয় – ফলে গ্রহিতা দেশের জন্য খুবই কাম্য; যা  বাংলাদেশকে  দেওয়ার ভারতের  মুরোদ নেই, এখনো হয়নি। বরং পারলে এই বিনিয়োগ ভারত-ই চীনের কাছ থেকে নেয়। তাহলে রাওয়াত এটাকে চীনের বাংলাদেশে ‘হানা দেয়া’ বলছেন কেন? অবকাঠামো বিনিয়োগ দেয়া কী করে ‘হানা’ দেয়া হয়? সেটাও কি ঈর্ষায় বলা কথা? সে জন্য?  নাকি সম্ভবত  রাওয়াত কি সামরিক তৎপরতা আর অবকাঠামো বিনিয়োগ নিয়ে আসা – এ দুয়ের ফারাকই বুঝেন না? একটা বাণিজ্যিক তৎপরতাকে যদি তিনি সামরিক হানা দেয়া বলেন, বুঝেন, তাহলে বলতেই হয় চার স্টার জেনারেল হলে হবে কী তিনি এখনো এক “মফস্বলের লোকই’ রয়ে গেছেন।  মানসিক বৃদ্ধি-বিকাশ কিছুই ঘটেনাই।  মফস্বলিয়া মানে শহরায়ন হয় নাই। জ্ঞানবুদ্ধি, মুল্যাবোধে অপুষ্ট থেকে গেছে যার।  ভারতের মডার্নাইজেশন, এডুকেশন ধারা যথেষ্ট বিকশিত ফলে ওর সামরিক মান তো খারাপ মনে করার কিছু নাই। তাহলে জেনারেল রাওয়াতের বেলায় এমন কেন সে এক প্রশ্ন বটে। তবে আপাতত এটুকু বলা যায় – এটা কোন সামরিক জেনারেলের নুন্যতম স্ট্যান্ডার্ড নয়।

আর এর মানে দাঁড়ালো জেনারেল বিপিন তো চীনের বিরুদ্ধে তার অভিযোগটা কী তাই তো প্রতিষ্ঠা করতে পারলেন না। চীনের বাংলাদেশে বাণিজ্যিক প্রভাব বাড়ানোর মুরোদ যদি থাকে ও প্রয়োগ হয় তা নিয়ে ভারতের কিছুর বলার নাই। আর যেকোন দেশ তা করবেই এবং তা বৈধ। তবে বড় জোর রাওয়াতের এনিয়ে ঈর্ষা হওয়া জায়েজ। কিন্তু তবু এই ঈর্ষা হতে হবে গোপনে বা মনে মনে অথবা আভ্যন্তরীণ গোপন নন-পাবলিক দলিলে।  কারণ, প্রকাশ্যে ঈর্ষা দেখানো  ভাল আদব ও রুচির পরিচয় নয়। তবে সবচেয়ে ভাল হবে চীনের যোগ্য প্রতিযোগী হয়ে আরো বড় বিনিয়োগ নিয়ে বাংলাদেশের দরজা খটখটানো।আর এই মুরোদ না থাকলে ভারতের চেপে যাওয়াই ভাল! নয় কী? দেখা যাচ্ছে জেনারেল বিপিন যেন জিদ করেছেন  যে তাঁর এই বোকা ব্যবহার আমাদের সামনে বের করবেনই!

এমন মন্তব্য করেও কেন জেনারেল বিপিন রাওয়াত এমন বোকা বোকা ব্যবহার করতে পারেন আর সেটা কেন কেমন হল এর সম্ভাব্য কারণ খুঁজতে গিয়ে মনে হল, এটা এমনি এমনি সম্ভবত বুঝা যাবে না। তার ‘ভারতীয় মনগঠনে’ প্রবেশ করতে হবে।  একাজে আগে কিছু কথা আগাম ধরে নিতে হবে যেটা সম্ভবত তাঁর মনে ধরে নেয়া আছে। বছর কয়েক আগে ভারতের এক মিডিয়ায় দেখেছিলাম এক অনুমান যে, সারা দক্ষিণ এশিয়া তো বটেই ফলে বাংলাদেশের উপরেও, মানে যেন বাংলাদেশ ভারতের তালুকদারির অধীনে আছে। নিশ্চিতভাবে ধরে নেওয়া এই অনুমানের উপর তারা লিখছিলেন। অনেক ভারতীয় মিডিয়ায় সেকালে দেখেছিলাম লেখা হয়েছে একইভাবে ও অভিযোগে যে, চীন সাউথ এশিয়ায় বিনিয়োগ নিয়ে ঢুকে পড়ছে। আর তাতে বাংলাদেশসহ সাউথ এশিয়া নাকি ভারতের বাগানবাড়ি – এটা আগাম ধরে নিতেই হবে। আর বাগানবাড়ি মানে মূল বাড়ির পেছনের যেমন বাড়ির মালিকের বাগানবাড়ি থাকে, বাংলাদেশ হলো ভারতের সেই বাগানবাড়ির অংশ। বাংলাদেশে মানে ভারতের সেই কথিত বাগানবাড়িতে চীন বিনিয়োগ নিয়ে এসে ঢুকে গিয়েছে।

কেন ধারণাটা আমদানি করতে হল?
কারণ এই উটকো ধারণাটা ছাড়া চীনের সাউথইস্ট এশিয়ায় বিনিয়োগ নিয়ে আসা- এটাকে নেগেটিভ বা খারাপ কাজ বলা যাচ্ছে না।  এটা ভারতের স্বার্থের বিরোধী কাজ তাও বলা যাচ্ছে না। অথচ এতে বেকুবিটা হল –  বাংলাদেশ কী করে ভারতকে বাগানবাড়ি হল? কে দিয়েছে, ও কীভাবে? এর সাফাই কে দিবে সে খবর নেই। কিন্তু এটা আগাম ধরে নেওয়া আছে।
এখন বাংলাদেশ যদি ভারতের বাগানবাড়ির অংশ হয় তাহলে চীনের অবকাঠামো বিনিয়োগ ( রাওয়াত নিজেই বলছেন, ……a tremendous influx of Chinese investments to build community projects and infrastructure.) নিয়ে বাংলাদেশে আসা মানে চীনের ভারতের বাগানবাড়িতে আসাই হয় – আর সেই সুত্রে, তা তো চীনের বাংলাদেশে হানা দিয়ে আসাই হয় – তাতে বিপিন রাওয়াত বলতেই পারেন! নাকি?
এ ছাড়া দুই নম্বর পয়েন্ট হল – রাওয়াত বলেছেন, “বাংলাদেশ অনেক চীনা অস্ত্র কেনে”। (…… countries have been the largest recipients of military-grade weapons from the Chinese)।
হ্যা, তো কিনে! কিন্তু তাতে কী হয়েছে? বাংলাদেশের অস্ত্র কেনা কী বেআইনি? না কি?  ভারতও কী আমেরিকা, রাশিয়া বা ফ্রান্স, ইংল্যান্ড থেকে ‘মিলিটারি গ্রেড’ অস্ত্র কিনে না? আর এমন ক্রয়ের আগে কি ভারত প্রতিবেশী বাংলাদেশের অনুমতি নেয়? না। তাহলে  রাওয়াতের মনে এতে কী সন্দেহ জাগে তাতে আমাদের কী? আর অনেককে নিয়ে অনেকেরই নানা সন্দেহ থাকতেই পারে যা নিজ নিজ বাহিনীর অভ্যন্তরে কৌশলপত্রে থাকে ও এর অংশ হয়। তো  থাক  সেসব কথা। কিন্তু আসামের ঐ প্রকাশ্য সভায় তা উগরানোকেন? এটা কী কোন বুদ্ধিমানের কাজ? মানে এসব কী তাহলে বাংলাদেশকে শুনানো, ভয় দেখানোর জন্য?

দিন সব একই রকম থাকেনা, বদলায়। তাই একালে বিপিন রাওয়াতের এসব ছেড়ে দেয়া উচিত। আগের এক লেখায় বলেছিলাম বোকা মানুষ জেনে না জেনে নিজেই নিজের শত্রু জন্ম দেয়, শত্রু খাড়া করে এবং শত্রুর মধ্যে বিশেষ সব আকার-বৈশিষ্ট্য তাতে এঁকে দেয়। আবার পরে এই মানুষই কান্নাকাটি করে যে, আমার শত্রু এমন কেন হলো! কাজেই রাওয়াতের বুদ্ধিমান হওয়া উচিত, এসব ‘কইরেন না।’ বাংলাদেশকে ভারতের শত্রুর আকার-বৈশিষ্ট দিয়েন না, নিজের খাতিরে।  ভারত চাইলে অবশ্যই এসব কাল্পনিক শত্রু কল্পনায় এঁকে চলতে পারে। এতে এক পর্যায়ে ভারত বাংলাদেশকে চীনের কোলে আশ্রয় নিতে ঠেলে দিতেও পারে। কেননা, অকারণে ও অত্যধিক অসহনীয় চাপ সৃষ্টি হলে যে কেউই নিরাপত্তার জন্য ছোটাছুটি করবেই। তাতে উপায়ন্তর না পেলে সে চীনকে বা যে কাউকে শক্তিশালী ও ভারতবিরোধী পাবে তাকেই ডেকে আনবে। এটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক। তাই বলছিলাম ঠেলেন না!  কাজেই বাংলাদেশ ভারতের  কেমন শত্রু হবে সেটা নির্ধারণ বা নির্বাচনও ভারতের হাতেই আছে, রয়েই গেছে – এটা খেয়াল রেখেন।

ভারতের আরো করণীয় কী?
করণীয় হল – ১. আমরাও ব্রিটিশদের কলোনি ছিলাম যা থেকে ১৯৪৭ সালে মুক্তি পেয়েছি। কাজেই এরপর আমরা কোনোভাবেই ভারতের বাগানবাড়ি নই। সারা সাউথ এশিয়াও নয়। কথাগুলো ভারতের লিখে মনে রাখা উচিত। এছাড়াও লাস্ট ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন কখনোই নেহরুকে পরবর্তী ভাইসরয় করে দিয়ে যাননি। কারণ মাউন্টব্যাটেনই সর্বশেষ। কাজেই নেহেরুর মত  মিথ্যা কল্পনায় স্বপ্ন দেখা বন্ধ করেন। রাওয়াতের মত সবাই বন্ধ করেন যে, বাংলাদেশ ভারতের বাগানবাড়ি আর চীন সেখানে ‘হানা দিতে’ এসেছে।

বাংলাদেশ ভারতের তালুকদারি নয়। ইঙ্গিতেও এটা সত্যি না, ভুল। তাই, প্রথমে মিথ্যা স্বপ্নের গল্প বা মিথ থেকে বের হয়ে আসেন। আর জেনে রাখেন, আপনারা আমাদের চাপাচাপিতে ভয় না দেখালে, পুশ না করলে, বাধ্য না করলে (আমরা জানি চীন-ভারত সামরিক সমস্যা বিতর্ক-বিরোধ আছে; তবে) আমরা সেই সামরিক বিরোধে কখনো কোনো পক্ষ নিব না। কারণ ওতে আমাদের ক্ষতি ছাড়া কোনো স্বার্থ নেই। এটা চীন বা কারো কোনো হবু প্ররোচনা বাংলাদেশের ওপর আসার আগে থেকেই আমরা নিশ্চিত, আমাদের স্বার্থ নেই। আর সস্তা বলে চীনের থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করি আমরা, সেটা এক জিনিস। কিন্তু এর মানে কোনো বিরোধে চীনের পক্ষে দাঁড়াতে হবে এমন মুচলেকা কোথাও দেইনি আমরা। এখন বাকিটা হলো বুদ্ধিমান ভারতের হাতে ও উপরে।

কাজেই “আসাম নাকি ক্রসরোডে পড়েছে” – এটা আমাদের জানার কথা নয়। আমাদের কনসার্ণ না।  তাই যদি পড়েও থাকে এর মধ্যে বাংলাদেশ কেউ না এবং নেই। সবটাই আপনারা ভাইসরয় বা বাংলাদেশ আপনাদের তালুক এই- জাতের অসার কল্পনাপ্রসূত চিন্তার সমস্যা। আর নয়তো তা ভারত-চীনের কোনো সামরিক, ভৌগোলিক বা স্ট্র্যাটেজিক বিরোধ যার কোনোটার অংশ আমরা নই। তবে এই অজুহাতে আবার ২০০৮ সালের মত বাংলাদেশের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করতে চান? কে বসবে ঠিক করে দিতে চান? পরের ১২ বছরের জন্য কাউকে বসাতে চান? আসেন চেষ্টা করে দেখেন! তবে মনে রেখেন, কোনো ঘটনা দুনিয়ায় একই রকমভাবে দু’বার ঘটে না! কেবল আবার বলব, নিজের শত্রু কেমন হবে মানুষ নিজেই এর আকার-বৈশিষ্ট্যদাতা!

সত্যি কথা সরাসরি বললে, বিপিন রাওয়াতের কথার আসলে মানে হয় না। প্রথমত বাণিজ্যিক আর সামরিক তৎপরতা বা স্বার্থের ফারাক তিনি পরিষ্কার বুঝেন ও মনে রাখেন বলে আর মনে হয় না।। যেমন ধরেন – আমরা কি বলতে পারি যে, আমার ছেলে কেবল ম্যাট্রিক দিলো তাই পড়শির ছেলে  বুয়েটের পরীক্ষায় টিকে চান্স পাওয়াতে এটা আমার পরিবারের স্বার্থবিরোধী কাজ ও ঘটনা হয়েছে? পড়শির কোন সমৃদ্ধি মানে কী তা আমার স্বার্থবিরোধী? এভাবে বলা যায়? সেক্ষেত্রে, এটা বড়জোর হিংসার কথা, তাও আবার বেকুবি হিংসা কথা হবে!

অথচ রাওয়াতই বলছেন, “চীন তার বেল্ট রোড প্রজেক্ট দিয়ে সাউথ এশিয়া ও ভারত মহাসাগরে ঢুকে পড়ছে” সম্প্রতি আমরা দেখছি “একটা ভূ-কৌশলগত প্রতিযোগিতা এবং বিপুল বিনিয়োগ নিয়ে চীন এই অঞ্চলে আসছে”।  মানে  রাওয়াতের কথাতেই এটা পরিষ্কার যে, এর পুরোটাই বাণিজ্যিক ও অবকাঠামো বিনিয়োগ, সামরিক নয়। কাজেই এটা ভারতের স্বার্থ কি না, এতে ভারতের স্বার্থ আছে কি না ইত্যাদি প্রশ্ন তোলারই তো মানে হয় না, বোকামি। পড়শির ঘরে মেলা বাজার-সওদা আসলে এটা আমার স্বার্থে না, একথা বললে কী মানে হয়? তখন রাওয়াতকে বলতেই হয় যে, হ্যাঁ, অবশ্যই এসব বাজার-সওদা আপনাদের জন্য নয়, কাজেই এটি ভারতের স্বার্থ নয়। কিন্তু সে জন্য কান্নাকাটি করা যায় না, অভিযোগ করা যায় না, কেবল এ ঘটনা আপনাদের স্বার্থবিরোধী বলে চিৎকার করলে আপনাদের পাগলাগারদে পাঠানোই বাকি থাকে!

জেনারেল বিপিন রাওয়াত, আপনাকে আবার মনে করিয়ে দেই। ভারতের নীতি আসলে – ‘আমরা ভালো প্রতিশ্রুতিশীল পার্টনার হতে পারব না’- এটাই যেন হয়ে আছে। বরং কে কত প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতে পারে, ঠকাতে পারে এরই দক্ষতা দেখানোকেই আপনারা যোগ্যতা মনে করে আসছেন। ভারত বড় দেশ, ১৩৫ কোটির দেশ, তাই ভারতের এসব ‘জুয়াচুরি’ পড়শিরা যেন মানতে বাধ্যই থেকে যাবে। আর এই পরিস্থিতিতে এখন আপনাদের পড়শি দেশে আপনাদের কথিত বাগানবাড়িতে চীন কেন আসবে – আপনারা সেই দুশ্চিন্তায় থাকলে আমাদের কী করার আছে? এটি আপনাদেরই সম্ভবত মানসিক সমস্যা।

বৃহত্তর দিকটা দেখিঃ
ব্যাপার হল, ভারত বাংলাদেশের আইনিভাবে প্রাপ্য ৫৪ নদীর পানিতে আমাদের ভাগ লুটে খাচ্ছে – এটা কি এভাবেই চলতে পারে মনে করেন? কখনোই নয়। ভারত নাকি দক্ষিণ চীন সাগরে সবার অবাধ চলাচলের নেভিগেশনের রাইট চায়? সে জন্য চীনবিরোধী কোয়াড জোট বেঁধেছে। তাহলে আমাদের পানির রাইট দিতে চায় না, জন্ম থেকে পানি আটকে রেখেছেন কেন? যদি বলেন আপনাদের গায়ে বল আছে তাই দিবেন না। এর মানে বুঝেন?  আসলে বলছেন, আমাদেরকে ঠেলছেন যে, ভারতের চেয়ে বড় বা বেশি গায়ের বল নিয়ে আসো। তাহলে এসে নিয়ে যেও। অর্থাৎ বলশালী ভারতবিরোধী দেশের কাছে যেতে বলছেন? বুঝে বলেন কিন্তু!

বর্তমান ক্ষমতাসীন দল ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার সময় আগে থেকেই ভারতের দুই শর্ত হল যে, বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বিনা পয়সায় আসামের জন্য সব ধরনের করিডোর নিবেন। দিতে হবে। এমনকি রাস্তা বা অবকাঠামো নির্মাণের ব্যয়ও বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর চাপাতে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত। আর সেটা আড়াল করতে শর্ত হল, বিনিময়ে ভারত ছিটমহল লেনদেন সম্পন্ন করবে, যেটা শেখ মুজিবকে আনুষ্ঠানিক কথা দিয়ে বাংলাদেশের দিক থেকে বেরুবাড়ি হস্তান্তরের পরও ভারত আমাদেরটা তখনো দেয়নি। সেটাই এবার দেয়ার কথা। এটা কিন্তু দয়া নয়, আমাদের পাওনা। পাওনাটা আটকে রেখেছিলেন। কাজেই এটা তো করিডোর দেয়ার বিনিময়যোগ্য কিছু নয়। তাই আসলে এটাও ছেলেভুলানি!

আর দ্বিতীয় শর্তটা ছিল তিস্তা নদীর পানি। যা ভারত আজও দেয়নি, কখনো দিবে না বলে বুঝা  হয়ে গেছে। ভারতেরই কেউ নাকি বাংলাদেশকে পানি দিতে দেয়নি – এ কথা যদি ভারত বলে তার মানে হবে ভারতেরই কথিত ‘কেন্দ্র’- এর সার্বভৌম মুরোদ নেই। এমন যদি ‘মাজাভাঙা’ হয় তাহলে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি ভারত করে কেন, কী করেই বা করে যা পালন করার মুরোদ নেই? নাকি অজুহাত খাড়া করতে এমন চুক্তি করে?

তাহলে এখন কেন বাংলাদেশ আপনাকে যোগ্য পার্টনার মনে করবে? আবার দেখুন, গত পঁচাত্তর বছর ধরে এমন বড়ভাইয়ের ভয় দেখিয়ে ভারত চলে আসছে। তাহলে এখন, চীন কেন পড়শিদের দেশে বিনিয়োগ নিয়ে আসে, এ নিয়ে আপনাদের জ্বলুনি দেখেই তো বোঝা যাচ্ছে, ভারতের হাত ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে সব নিয়ন্ত্রণ? তাহলে আপনাদের কথিত প্রভাব এখন কোথায়? কাজেই সাবধান হওয়া উচিত! কী চাচ্ছেন, মানে কিভাবে আপনার হবু শত্রুর আকার আমাদেরকে দিচ্ছেন – এ দুটি বুঝেই  কথা আগাবেন আশা করি। এটা মনে রেখে সিদ্ধান্ত নেবেন।

বিপিন রাওয়াত কে?
২০১৭ সালের শুরু থেকে জেনারেল বিপিন রাওয়াত ভারতের আর্মি চিফের দায়িত্বে এসেছিলেন। সেই থেকে জেনারেল রাওয়াত সম্পর্কে বাংলাদেশের মনোভাব কেমন তার এক সারসংক্ষেপে জানা যেতে পারে।

৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ পর্যন্ত তিন বছর রাওয়াত ছিলেন ভারতের সেনাপ্রধান। তিনি তিন বছরের আর্মি চিফের পোস্টে আসীন ছিলেন রুটিনভাবেই। তবে সে সময়ই নতুন পদ সিডিএস সৃষ্টি করা হয় এক বিশেষ উদ্দেশ্যে। এই পদ ভারতের তিন বাহিনী প্রধানদের উপরের পদ হলেও এটা শুরু থেকেই পোশাকী মানে উর্দি বা সামরিক পদ ছিল। কিন্তু এটা ঠিক, তিন বাহিনী প্রধানদের উপরের আগের যে যারা যেখানে সরকারি পদ যা একেবারে প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত যার যা দায়িত্ব কর্তব্য ও কমান্ড যা ছিল সিডিএস [CDS] পদ সৃষ্টির পরেও, আগের সে কাঠামোতে কোনো বদল আনা হয়নি।
আনুষ্ঠানিকভাবে তাই যা আগে বলা হয়েছিল, চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ বা সিডিএস পদ তৈরির পরও তাতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। এর সোজা মানে, সিডিএস তিন বাহিনী প্রধান আবার বাইরের কাউকেও কমান্ড করতে পারবেন না। আনুষ্ঠানিকভাবে সিডিএসের কাজ হল তিন বাহিনী প্রধানের মধ্যে সমন্বয় সৃষ্টি করা। আর সাথে কোথাও কোথাও আকার-ইঙ্গিতে বলা হয়েছে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাথেও সমন্বয় করা।

একারণে, এটাই অনুমান আকারে ভারতে প্রচলিত আছে যে, আরএসএস-মোদি ভারতের প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠানকেও হিন্দুত্বের ছাপ দিতে চায়। একারণেই এই নতুন পদ তৈরি করা হয়েছে। বাইরের চোখে যা একটা কথিত কো-অর্ডিনেশন।

জেনারেল বিপিন রাওয়াত আর্মি চিফ থাকার সময় থেকেই প্রধানমন্ত্রী মোদির সাথে যেন তিনি বিজেপি কর্মী এমন আচরণ ও তাল দেয়া শুরু করেছিলেন; যার প্রথম বড় অ্যাসাইনমেন্ট বলে মনে করা হয় ২০১৯ মার্চ-মে মাসের নির্বাচনের ঠিক আগেই পাকিস্তান হামলার ভনিতা সাজানো। বিজেপি ও মোদি চেয়েছিলেন পাকিস্তানে সাজানো হামলা ও এভাবে প্রতিশোধ নেয়ার জোশ তোলা। তাতে যেন মোদির নেতৃত্বে বীরত্বের সাথে প্রতিশোধ নিয়ে আসা হয়েছে- এই জোশ তুলে হিন্দু ভোটার পোলারাইজেশন ঘটানো ও তা বিজেপির বাক্সে জড়ো করা। অর্থাৎ মেসেজটা হলো, অ্যান্টি পাকিস্তান মানে অ্যান্টি মুসলমান মানে এবার হিন্দুরা জোটবদ্ধ হয়ে একমাত্র মোদির দলকে ভোট দাও এই ছিল ২০১৯ নির্বাচনের স্লোগান সূত্র। এখন বিজেপির ওই ভোট রাজনৈতিক প্রোগ্রামে আর্মি কেন আসতে বা সায় দিতে রাজি হবে, এটাই নিশ্চিত করার দায়িত্ব ছিল এই রাওয়াতের।

এ কারণে, পাকিস্তানি বিরাট ঘাঁটিতে ব্যাপক বোমাবর্ষণ করা হয়েছে বলে ভারতীয়রা সাফল্য দাবি করলে পরে ইমরান খান কূটনীতিকদের স্বচক্ষে সেই হামলাস্থলে নিয়ে গিয়ে দেখান, একটা মরা পাখি ছাড়া সেখানে কোনো প্রাণী আহত-নিহত কিছু নেই। তবে মাটিতে বোমা ফেলায় গর্ত হয়েছে অনেক, এর সচিত্র বর্ণনা তারা দেখিয়েছিল। কিন্তু তত দিনে ভারতের নির্বাচন সমাপ্ত হয়ে যায়। ফলে এর কোনো প্রভাব সেখানে ছিল না।

এর অনেক আগে অবশ্য বিপিন রাওয়াত যে আনুগত্য প্রদর্শনে সম্মতি জানিয়েছেন তাও পরীক্ষা করে নেয়া হয়েছিল। অনেকের মনে থাকতে পারে ঘটনাটা। কাশ্মিরের এক তরুণ কথিত সন্দেহভাজন জঙ্গি। তাকে ভারতীয় আর্মি তাদের এক জিপ গাড়ির বনেটের উপরে সামনে বসিয়ে দড়ি দিয়ে বেঁধেছে। এরপর সেই গাড়ি নিয়ে সারা শহর ঘুরানো হয়েছে। এই নৃশংস অমানবিক কায়দায় এবং আইনবহির্ভূত অবস্থায় তাকে বসিয়ে সারা শহরে ফুল স্পিডে গাড়ি চালানো হয়েছিল। এটা মিডিয়ায় রিপোর্ট হওয়ার পর হইচই উঠেছিল। আর সামরিক কর্তারা সাফাই দিয়েছিলেন, বন্দীর বন্ধুদের ভয় দেখাতেই নাকি এমন করা হয়েছিল। অথচ বন্দীর সাথে এই আচরণ বেআইনি। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে আর্মি চিফ বিপিন রাওয়াত সে সময় এর স্বপক্ষে সাফাই দিয়েছিলেন। এর আগে ভারতের কোন আর্মি চীফ এমন দলবাজ হতে দেখা যায় নাই। নিজের পেশার প্রতিওই অনুরক্ত থেকে কাজ করেছেন। অনুমান করা হয়, মোদি এভাবেই তাকে পরীক্ষা করে নিয়েছিলেন। মনে করা হয়, এটাই তার হিন্দুত্ববাদী-রাজনীতির পক্ষে প্রথম অ্যাক্ট ও অফার, ফলে তা এক অন্তর্ভুক্তি ও সম্মতি। কারণ, একই সময় মুম্বাইয়ের কিছু অভিনেতাও বিজেপিতে রিক্রুট করা হয়েছিল। সাধারণভাবে অভিনেতাদের কাছে ব্যাপারটা টাকা নিয়ে অভিনয়ের মতোই রাজনৈতিক অভিনয় করে দেয়া। এমন অভিনেতাদের অনেকের মধ্যে ছিলেন সস্ত্রীক অনুপম খের, পরেশ রাওয়াল, কঙ্গনা রানাউত ইত্যাদি। পরেশ রাওয়ালসহ অনেকেই জিপে বেঁধে ঘুরানোর ওই ঘটনায় বিপিন রাওয়াতদের পক্ষে প্রপাগান্ডামূলক পাবলিক আর্গুমেন্ট দিয়েছিলেন।

তাই জেনারেল বিপিন রাওয়াত এখনো যা করছেন তা এক আরএসএস ক্যাডারেরই তৎপরতা যেন। আর এতে আমরা দেখলাম, আরেক ক্যাডার বিপিন রাওয়াত  আসামে কী করলেন!

 

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

 

[এই লেখাটা  গত  ০৬ নভেম্বর ২০২১, দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ওয়েবে ও পরদিন প্রিন্টে   “এক জেনারেল – এই শিরোনামে  ছাপা হয়েছিল।
নয়াদিগন্তে ছাপা হওয়া লেখাগুলোকে আমার লেখার ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ বলা যায়।  আর আমার এই নিজস্ব সাইটের লেখাটাকে সেকেন্ড ভার্সান হিসাবে এবং  থিতু ভাষ্য বলে পাঠক গণ্য করতে পারেন। পরবর্তিতে ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ লেখাটাকেই এখানে আরও অনেক নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে ও নতুন শিরোনামে এখানে আজ ছাপা হল। ]

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s