মোদির পরাজয় ঘটাতে মমতা, সাথে পিকের কৌশল


মোদির পরাজয় ঘটাতে মমতা, সাথে পিকের কৌশল

গৌতম দাস

২৯ নভেম্বর ২০২১, ০০:০৬ সোমবার

For India’s opposition to recover, the Gandhis should quit

[সার-সংক্ষেপঃ উপরের বা সাথে দেয়া ছবিটা লন্ডন ইকোনমিস্ট পত্রিকার চলতি সংখ্যায় এক আর্টিকেলের প্রচ্ছদ। যদিও আমার এলেখার প্রসঙ্গ তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা ও তার দল। ইকোনমিস্টের  ঐ আর্টিকেলের সারকথা হল, ভারতের বিরোধী দলকে জোটবদ্ধ হতে পিছিয়ে দিয়েছে  ও দিচ্ছে এই গান্ধী পরিবার।  আর ঠিক এজায়গায় প্রত্যক্ষ না হওয়া সত্বেও বিপরীতে মমতা নিজেকে উত্থিত করার যে চেষ্টা করছেন তা সম্পর্কিত।  ইকোনমিস্ট সরাসরি বলেছে গান্ধী পরিবারের ভারতের রাজনীতিকে এভাবে স্থবির করে রাখা “ত্যাগ করা উচিত” । শিরোনামেই সেকথা বলেছে যে “গান্ধীদের ত্যাগ করা উচিত” [Gandhis should quit]।
কিন্তু ততদিন কী তাহলে মমতা অপেক্ষা করবেন? গান্ধী পরিবার কী করে তা দেখার জন্য? একেবারেই না। ভারতের মিডিয়া এনিয়ে অনেক কথা লিখেছে। যেমন যা লেখা শুরু করেছে তা হল,  “দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্রমশই নিজেকে মোদী-বিরোধী শিবিরের ‘মুখ’ করে তুলছেন”।  এমন নেতা  হিসাবে নিজেকে হাজির করার কাজে মমতা অনেক দূর আগিয়ে গেছেন।  আর এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ দল হচ্ছে গান্ধীদের কংগ্রেস।
আরেক পত্রিকা লিখছে, “আঞ্চলিক দলের তকমা ঝেড়ে তৃণমূল এখন সর্বভারতীয় হয়ে ওঠার পথে। চব্বিশের লোকসভা ভোটে মোদিবিরোধী জোটে সোনিয়া, রাহুল কিংবা প্রিয়াঙ্কা নন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই এখন মুখ”
কেন?  কারণ, মমতার নিজেকে এই প্রধান মুখ হিসাবে উপস্থাপনে বিভিন্ন দল ভেঙ্গে বিভিন্ন ব্যক্তি ও গ্রুপ দল বেধে তৃণমূলে যোগ দেওয়ার জন্য যোগাযোগ শুরু করেছে। অনেকে সরাসরি যোগদান করছে।  চলতি নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে মমতার দিল্লি সফরে একটা অন্যতম কর্মসুচি ছিল এমন যোগদানগুলোকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘটিয়ে তা দেখানো।  আর এবার মিডিয়া লিখছে এভাবেঃ একের পর এক উইকেট পড়ছে কংগ্রেসে। দেশের প্রাচীনতম দলটি ক্রমেই জাতীয় রাজনীতিতে তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলছে”। অর্থাৎ অনেক দল থেকে লোক আসছে তৃণমূলে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি যে দল ভেঙ্গে লোক মমতার দলে যোগ দিচ্ছে সেদলটা হল গান্ধী পরিবারের কংগ্রেস।
কোন কোন পত্রিকা তাদের রিপোর্টে ব্যাখ্যা করা শুরু করেছে কেন আভ্যন্তরীণভাবে কংগ্রেস স্থবির ও অগোছালো। যার মূলকথাটা হল, গান্ধী পারিবারিক নেতৃত্বটাই এর মুল কারণ। এই পরিবার এটা কংগ্রেসের তরুণ নেতাদের আকাঙ্খা দাবায় রাখার প্রতীক হয়ে গেছে। আবার কংগ্রেসের বয়স্ক বা পরীক্ষিত নেতারাও মনে করছে তাদের পোটেনশিয়ালিটি বা সম্ভাবনা সব এই পরিবারের জন্যই স্বীকৃতি পাচ্ছে না। মিডিয়ায় লেখা হয়েছে, রাহুল গান্ধীকে দলে অনেকেই মেনে নিতে পারছেন না।  আর এতেই ফলাফলে সবকিছুই স্থবির হয়ে বসে থাকা। আর ঠিক এ’জিনিষটার দিকে নজর ঢেলেছেন পিকে মানে প্রশান্ত কিশোর । যিনি আসলে মমতার পক্ষে ও মমতার নিয়োগকৃত  রাজনৈতিক দলের জন্য  পেশাদার এক  “ম্যানেজমেন্ট কনসালটেন্ট”; ভারতের আনন্দবাজারি ভাষায় “ভোটকুশলী”।  যদিও শব্দটা হবে সম্ভবত ভোটকৌশলী এক্সপার্ট। বাংলায় প্রকৌশলী শব্দের “কৌশলী” শব্দটা যেখান থেকে।

এছাড়া ওদিকে ঠিক বিজেপি না, আরএসএসে আভ্যন্তরীণ বিরোধের টেনশনে্র কথা শুনা যাচ্ছে মোদিকে তৃতীয়বার প্রার্থী না করার ব্যাপারে ফলে আরএসএসের মমতার প্রতি তাদের কিছু আগ্রহের খবরও বাজারে এসেছে দেখা যাচ্ছে। ]

 

মমতার তৃণমূল কংগ্রেস রাইজিংঃ
অসময়ে তৃণমূল কংগ্রেস ও এর নেতা মমতা ব্যানার্জি নিয়ে আজকের প্রসঙ্গ। অসময়ে এজন্য যে, এটা পশ্চিমবঙ্গের কোনো নির্বাচনের আগের অথবা অব্যবহিত পরের সময় অবশ্যই একেবারেই নয়। আবার যদিও একটা পৌরসভা  (ওদের ভাষায় পুরভোট)  বা মেয়র নির্বাচন আসন্ন। তবে  এর রাজনৈতিক গুরুত্ব তেমন নেই। সাধারণত যতটুকু একটি পৌর নির্বাচনের থাকে, এবার তাও নেই। এর মূল কারণ গত   ২০২১ সালের মার্চ-এপ্রিলে মমতা শুধু নিজে ও দলকে টানা তৃতীয়বার রাজ্যের ক্ষমতায় বিজয়ী হয়ে নিয়ে এসেছেন সে জন্য নয়। আসলে এই নির্বাচন ছিল হেভিওয়েট বিজেপি পুরা দলকেই কলকাতা থেকে পুরো উৎখাত করে ফেলা। অথবা বলা যায়, সারা ভারতের বিরোধীরা যখন মোদির সামনে শিশু বা বামন হয়ে যায়, কেবল সেখানে একা মমতা নিজ ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্ব দিয়ে লড়ে প্রমাণ করে দিলেন, এক প্রধানমন্ত্রী মোদির ইমেজের ওপর দাঁড়ানো চালু এদলটিও তার সামনে কিছুই না। ফলে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের আগে যে ভিত্তিহীন প্রপাগান্ডার ঝড় বিজেপি তুলেছিল, সেটাসহ মোদি বা বিজেপি কোনো কিছুকেই মমতা আস্ত রাখেননি। উপড়ে ফেলেছেন। এরপর যারা নির্বাচনের আগ দিয়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন, তাদের এবার বিজেপি ছেড়ে আবার একমাত্র দল মমতার তৃণমূলেই ফেরতের হিড়িক পড়ে যায়; যেন সবাইকেই ফিরে যেতে হবে, বড় ক্ষতি হয়ে গেছে।  এছাড়া “দ্রুত অনুগ্রহ যোগাড় করে” কার আগে কে ফিরে জায়গা নেবে যেন এর প্রতিযোগিতাও শুরু করাতে পেরেছিলেন মমতা।

তবে বছরের শুরুতে মার্চ-এপ্রিল ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের পরেও আবার ওরই  উপনির্বাচনও ইতোমধ্যে হয়ে গেছে অনেক আসনে; কারণ করোনার জন্য আটকে থাকা, শিডিউলে থাকা অনেক উপনির্বাচন দীর্ঘ দিন হতে পারেনি।  আর সেই উপ-নির্বাচনেও বিজেপি আরেক দফা আরো তুচ্ছ হয়ে যায়।
এসব কারণে এখন পৌর নির্বাচনের গুরুত্ব এবার আরো কম বা নাই; কারণ গত ৩০ সেপ্টেম্বরে, ছয় মাসের মধ্যে ঐ উপ-নির্বাচন হয়েছিল। আর এবার সুযোগ পেয়ে একসাথে সারা ভারতেও অনেক উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। আর তা ছিল ভারতের ১৩টি রাজ্যের লোকসভা ও রাজ্য বিধানসভা মিলিয়ে মোট ২৮টি আসনে উপনির্বাচন। এতে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার আসন ছিল চারটি। আর ওদিন আরো তিন রাজ্যের তিন লোকসভা আসনে উপনির্বাচন হয়। রাজ্য তিনটি হলো – হিমাচল, মধ্যপ্রদেশ ও কেন্দ্রশাসিত রাজ্য দাদরা ও নগর হাভেলি; যার  মধ্যে বিজেপি জিতেছিল কেবল মধ্যপ্রদেশে; আর বাকি দুই রাজ্যে বিজেপি হেরে যায়। এ বছরের কলকাতায় মমতার রাজ্য নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের পর থেকে সেই জোয়ার এতই তীব্র  উঠেছিল যে, এই উপনির্বাচনে ছয় মাসের ব্যবধানে এক লাখেরও বেশি ভোটে উল্টো বিজেপি প্রার্থীরা এবার হেরে যান। আর বিজেপি প্রার্থী প্রায় সবার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গে মোদির এই ব্যাপক হার গত প্রায় আট বছরের মোদির শাসনামলে এই প্রথম, যা তার বিজেপি দলসহ তাকে এই প্রথম সমূলে এত বড় আঘাত হেনেছে মনে করা হচ্ছে। একটা পত্রিকা লিখেছিল,

উপনির্বাচনের ফল ঘোষণার পর বিজেপি শিবিরে প্রচণ্ড উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে যেভাবে বিজেপিবিরোধী তৃণমূলের পালে হাওয়া লেগেছে, তাতে মনে করা হচ্ছে, সেই হাওয়ায় সত্যিই এবার বিজেপির বাগান তছনছ হয়ে যেতে পারে?

এ ছাড়াও প্রথমে মনে করা হয়েছিল, মোদির ওপর এ আঘাত বোধহয় কেবল পশ্চিমবঙ্গেই। কিন্তু এখন একেবারেই পরিষ্কার, এটা ভারতজুড়েই বিরাট ছাপ ফেলেছে।
আসলে এটা এক ‘আন্ডার কারেন্ট’ যেখানে সেটা নদীর যত তলদেশে ততই সেখানে স্রোতের বেগ তত বেশি। অথচ পুরো ব্যাপারটা বাইরে থেকে তেমন বোঝাই যায়নি। কিন্তু কী সেটা?
বিজেপি বা মোদিবিরোধী সব বিরোধী দলের অভ্যন্তরেই প্রচণ্ড অভ্যন্তরীণ সঙ্ঘাত ও ক্ষোভ বর্তমান। এসব ক্ষুব্ধ ভগ্নাংশ বা গ্রুপগুলোতে অভ্যন্তরীণ সঙ্ঘাত এতই তীব্র কিন্তু তারা দল ছাড়ার কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে সেদিকে ফায়সালার পথ বেছে নেবে, তা ঘটছিল না। সম্ভবত তাদের দ্বিধার মূল কারণ, এসব ক্ষুব্ধ গ্রুপ ভেঙে বেরিয়ে যেতে চাইলেও তারা কোথায় যাবে কোন দিকে বা গন্তব্যে? এটা স্পষ্ট খুঁজে না পাওয়ায়ই তারা উদ্দেশ্যহীন হয়ে পুরনো নিজ দলের সাথে লেপ্টে থেকে গিয়েছিল।

কিন্তু দেখা যাচ্ছে আজ এটা প্রমাণিত যে, তৃণমূলের মমতা হলেন সেই হ্যামিলনের বংশীবাদক যার বাঁশির পেছনে ওসব ক্ষুব্ধ গ্রুপ একেবারে সদলে এসে একের পর এক যোগদান শুরু করেছে এখন। আর তাতে রাতারাতি মমতার তৃণমূল দল এক আঞ্চলিক দলের পরিচয় থেকে বেরিয়ে সর্বভারতীয় দলের পরিচয় ধারণ করতে যাচ্ছে।

সর্বভারতীয় দল’ মানে কীঃ
ভারতে এখন ছোট-বড় মিলিয়ে মোট রাজ্যের সংখ্যা ২৮টা। কোনো একটা রাজনৈতিক দলের প্রত্যেকটা রাজ্যেই বা বেশির ভাগ রাজ্যেই উপস্থিতি মানে কমিটি থাকলে সাধারণত চলতি অভ্যাসে তাকে “সর্বভারতীয়” দল বলে বুঝানো হয়ে থাকে। তবে স্বভাবতই এটা আইনি বা নির্বাচন কমিশন প্রদত্ত সংজ্ঞা নয়। কমিশনের মতে, তাদের কতগুলোর শর্তের একটা পূরণ করলেই সেটা ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে ‘জাতীয় রাজনৈতিক দলের’ মর্যাদা লাভ করে থাকে। এছাড়াও সময়ে সময়ে নির্বাচন কমিশন এই মর্যাদা কোন দলের জন্য সে দল “প্রাপ্ত বা কেড়ে নেয়া” হল বলে ঘোষণা দিয়ে থাকে।

যেমন এমন কিছু শর্তগুলো হল, দলটাকে ভারতের যেকোনো তিন রাজ্য থেকে লোকসভার (কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের লক্ষ্যে যেটা) নির্বাচনে মোট ভোটারের কমপক্ষে ২ শতাংশ পেতে হবে। অথবা দলটিকে লোকসভা বা বিধানসভা (রাজ্য সরকার গঠনের লক্ষ্যে) নির্বাচনে যেকোনো চার বা ততোধিক রাজ্য থেকে মোট ভোটের ৬ শতাংশ পেতে হবে। আর সাথে আরো চারটি লোকসভা আসন জিততে হবে। অথবা দলটাকে চার রাজ্যের যেকোনো একটাতে ‘রাজ্য দল’ হিসেবে স্বীকৃতি পেতে হবে।

যেমন, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ থেকে কমিশন ঘোষিতভাবে ভারতে আটটা ‘জাতীয় রাজনৈতিক দলের’ মর্যাদাপ্রাপ্ত দল আছে যদিও সম্প্রতি এদের চারটির অবস্থা খারাপ যে, সম্ভবত তারা নয়া রিভিউয়ে বাদ পড়বে। তবে তৃণমূল কংগ্রেস কখনো ‘জাতীয় রাজনৈতিক দলের’ মর্যাদাপ্রাপ্ত দল নয়; যদিও গত ২০০১ সালের রাজ্য নির্বাচনের সময় থেকে তৃণমূল খুবই কঠোর চেষ্টা শুরু করেছে। আর আগামী বছর মানে সারা ২০২২ সালে পাঁচটি রাজ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এগুলো হল – গোয়া, মনিপুর, উত্তরখণ্ড, পাঞ্জাব ও উত্তর প্রদেশ। এতে একমাত্র উত্তর প্রদেশের নির্বাচন হবে মে মাসে আর বাকি চারটি নির্বাচনই হবে মার্চ মাসের বিভিন্ন সময়ে। বাংলা ভাষায় এগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিধানসভার নির্বাচন’ বলে পরিচিত। ইংরেজিতে যা ‘লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি’ বা সংক্ষেপে শুধু “অ্যাসেম্বলি” নির্বাচন বলার চল আছে।
আর সার কথাটা হল, তৃণমূল কংগ্রেস এখনো ‘জাতীয় রাজনৈতিক দলের’ মর্যাদাপ্রাপ্ত নয়। তৃণমূল মূলত আঞ্চলিক দল মানে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যভিত্তিক দল।

তাহলে ২০২১ সালের মার্চ-এপ্রিলের নির্বাচনের পর এবার তৃণমূলকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও হইচই ওঠার কারণ কী?
এক কথায় বললে, পশ্চিমবঙ্গের গত এপ্রিল নির্বাচন হয়েছিল মোদির নামে, মোদির সুনাম বা ক্রেডিটকে দেখিয়ে, তাঁকে সামনে রেখে। এমনকি বিজেপি দলের চেয়েও মোদির নাম এগিয়ে রাখা হয়ে থাকে সবসময় ঠিক যেমন গত সাত বছর ধরে বিজেপি একা মোদির নাম ও ক্রেডিটের উপরে নির্বাচন করে যাচ্ছিল। সবচেয়ে বড় কথা, এতে কলকাতায় এমন প্রপাগান্ডা ঝড় তারা তুলেছিল যেন নির্বাচনের পরে সারা পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ছাড়া “আর কোনো দল থাকছে না”। ফলে অন্যান্য দল থেকে সুযোগসন্ধানীদের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে যায় যে, নিজ নিজ দল ছেড়ে কার আগে কে বিজেপিতে যোগ দেবে। অথচ ফলাফল প্রকাশের পরে পেলে দেখা গেল, কিছুই বাস্তব-সত্য নয়, সব প্রপাগান্ডা। পশ্চিমবঙ্গের ২৯৪টি আসনের মধ্যে ২১৩টিতে জিতেছিল তৃণমূল কংগ্রেস। বিজেপি পায় ৭৭টি আসন। অথচ মোদি-অমিত আওয়াজ দিয়েছিলেন বিজেপি নাকি ২০০ এর বেশি আসন পাবে। বাস্তবে  তাও আবার সেই ৭৭ এখন ৭২ হয়ে গেছে। অর্থাৎ  ঐ পাঁচজন তৃণমূলে আবার ফেরত গেছেন।

শুধু তা-ই নয়, বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের জোটের সাথে ফুরফুরা শরিফের পীরজাদা ‘সেক্যুলার ফ্রন্ট’ নামে নতুন একটি রাজনৈতিক দল  জোট গঠনের ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু পীরজাদার দলের একটা আসন পাওয়া ছাড়া এই পুরো দল বা জোট এবার আর কোনো আসন পায়নি। অনেকে এটাকে ব্যাখ্যা করেছিলেন, এটা গত ২০১৯ সালের কেন্দ্র নির্বাচনে সিপিএমের নিজ কর্মের শাস্তি বা প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে। কেন?
সিপিএমের বামফ্রন্ট ২০১১ সালে ক্ষমতা হারানোর পর থেকে কংগ্রেসের সাথে জোট করে নির্বাচন লড়ে আসছে। কিন্তু যেহেতু মমতাই তাদের ৩০ বছরের সাজানো দুর্গ ২০১১ ভেঙে দিয়ে প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হন, তাই মমতার দলই তাদের প্রধান শত্রু ও বিরোধী তা আজও এরা মনে করে থাকে। তাতে ভারতের কেন্দ্রে ক্ষমতায় যে দলই থাক। কিন্তু এখানে ফাঁকিটা হল, এতে ক্ষমতাসীন মোদি কমিউনিস্টদের ভাবধারার অলক্ষ্যে এবং একথা তারা মুখে না বললেও পরোক্ষে  সিপিএমের দোস্ত হয়ে উঠেছে। এরই চরম অবস্থাটা আমরা দেখে ২০১৯ সালের কেন্দ্রের নির্বাচনে। তারা বিজেপির সাহায্য নিয়ে মমতা উৎখাতের পরিকল্পনা করে ভোটকেন্দ্রে বিজেপির পক্ষে কাজ করে দিয়েছিল। এই কৌশল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মত বয়স্ক নেতারা পছন্দ না করলেও সেবার তারা পাত্তা পাননি। তাদের আপত্তি দলের কেউ শুনে নাই।  আর তাতে হঠাৎ বিজেপি তিন আসন থেকে এক লাফে ১৮ আসন লাভ করেছিল যেখানে মোট পশ্চিমবঙ্গের ভাগে মোট আসন ৪২টা আর তৃণমূল একাই প্রায় সবটা পেয়ে থাকে। এ কারণেই ২০২১ সালের রাজ্য নির্বাচনে একটা সিটও না পাওয়াকে সিপিএমের কর্মের শাস্তি বলা হচ্ছে। এ ছাড়া তারা পীরজাদাকে জোটের সাথে নিয়ে মূসলমান ভোট ভাগ করতে চেয়েছেন, যাতে বিজেপির সুবিধা হয়। কিন্তু মুসলমান ভোটাররাই সব রুখে দেন, তারা ভোট ভাগ হতে দেননি। মমতার এত আসন পাওয়া বা বাম-কংগ্রেস সাথে পীরজাদার জোট মাত্র একটিই আসন পাওয়ার ঘটনাকে এভাবেই ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে।

এ তো গেল শুধু পশ্চিমবঙ্গের হিসাব, সাথে এখন তৃণমূলের বিস্তৃতি বাইরের রাজ্যেও। সর্বভারতীয় দল হিসেবে তৃণমূল নিজের নতুন কেন্দ্রিয় কমিটি সাজিয়ে নিয়েছে। আর এতে একেক করে অন্যান্য রাজ্যের দলের নেতাকর্মীরা যোগ দেয়া শুরু করেছেন; যার মধ্যে গোয়া আর ত্রিপুরা সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তুলেছে।

এবার গত সপ্তাহে (২৫ নভেম্বর) মমতা দিল্লি সরকারি সফরে গিয়েছিলেন। কিন্তু আসলে এর ফাঁকে নিজ দলের শুভযাত্রার অনেক কাজ করে এসেছেন তিনি, যাতে অন্তত তৃণমূলকে এখন এক সর্বভারতীয় দল মনে হয়। আসলে বিভিন্ন দল থেকে মমতার দলে যোগদান করতে আসছেন; এরই এক অনুষ্ঠান ছিল এবারের মুখ্য আকর্ষণ। যেসব রাজ্য থেকে পুরনো দল ছেড়ে নেতারা (সাবেক বা বর্তমান) এমপিরা তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন এদের মধ্যে আছেন উত্তর প্রদেশ, হরিয়ানা, বিহার, ঝাড়খণ্ড, ত্রিপুরা, মেঘালয়সহ বিভিন্ন জায়গা থেকে; বলা হচ্ছে হিন্দি বলয়ের তিন সাবেক সাংসদ কীর্তি আজাদ, অশোক তনওয়ার ও পবন বর্মা যোগ দিয়েছেন। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা লিখছে, “দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্রমেই নিজেকে মোদিবিরোধী শিবিরের ‘মুখ’ করে তুলছেন।”

আসলে বলা যায়, এটাই হল মমতার মুখ্য মেসেজ। অর্থাৎ মোদিবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর জোট গড়তে গেলে এর সম্ভাব্য নেতা কে কে হতে পারেন – এই বিচারে মমতা নিজেকে সর্বভারতীয় নেতার ইমেজ দিয়ে রাখলেন। কিন্তু কেন এটা?

প্রশান্ত কিশোর বা পিকেঃ
রাজনীতিতে কনসালটেন্সি বা ভারতে একালের ভোটযুদ্ধে দলের পক্ষ থেকে প্রফেশনাল এক্সপার্ট নিয়োগ দিয়ে নির্বাচনে পরিকল্পনা করে ভোটে নামা শুরু হয়েছে। ভারতের রাজনীতি ষোলোআনাই নির্বাচননির্ভর। তাই “ভারতে রাজ্যের বা কেন্দ্রের নির্বাচনের আগেই কেবল রাজনীতি করো। বাকি সময় দলের বাতি ধরে রাখলেই হবে”। এই হলো ভারতের রাজনীতি। ফলে দলের হয়ে নির্বাচন ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করা, লড়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আসলে যেহেতু এটা ‘পরিচালনা’ মানে ডিরেকশন বা নির্দেশনা দেয়া; কাজেই ব্যাপারটা আসলে একটা ম্যানেজমেন্ট বিষয়ক কাজ যার এক বাংলা করতে পারি পরিচালনা বা ম্যানেজ করা বা সামলানো। কাজেই এজন্যই তো “ম্যানেজমেন্ট কনসালটেন্ট” নিয়োগ। তাই না?

বিহারের প্রশান্ত কিশোর (পিকে) হচ্ছেন আপাতত ভারতের একমাত্র এমন পলিটিক্যাল কনসাল্ট্যান্ট। এটা আসলে জনমত যাচাই, পাবলিক মনোভাব আগাম বুঝা, নির্বাচনে ভোটারদের মুখ্য আশা-আকাঙ্খা কী, কী হলে তারা খুবই খুশি হবে, দলের সবচেয়ে খারাপ দিক কোনটা, দলের পজিটিভ-নেগেটিভ সব জেনে নেয়া ইত্যাদি সবকিছুই এর কাজের মধ্যে পড়ে। এসব কাজের জন্য একেবারে স্যাম্পল ডাটা সংগ্রহ করে গবেষণা স্টাডিতে নেমে পড়া; আর সে স্টাডির ফলাফল অনুসারে দলকে পরিচালিত হতে, নড়াচড়া করতে নির্দেশ দেয়া, এটাই কনসালটেন্টের কাজ। পিকে এর আগে পুরান পেশা হিসাবে পেশাদার কনসাল্ট্যান্ট হিসেবে জাতিসঙ্ঘে এমন স্টাডি গবেষণার কাজ করতেন। এরপর কী খেয়ালে সেসব ছেড়ে এখনকার কাজে নেমে এসেছেন। এ’পর্যন্ত কোনো দলের সাথে (ও পক্ষে) পরামর্শদানের চুক্তি করে সে দল কখন ঐ নির্বাচনে হারেনি। ফলে এটা তার এক ভালো রেকর্ড। এককালে বিজেপিকেও এমন পরামর্শ দিয়েছেন। কংগ্রেসকেও। বর্তমান অন্ধ্রপ্রদেশের ক্ষমতাসীন রাজ্য সরকারকেও। আবার পাঞ্জাবসহ এমন অনেক রাজ্যকেই। মমতার সাথে  তাঁর  সম্পর্কের শুরু ঐ ২০১৯ সালে; সেবারের কেন্দ্র নির্বাচনে খারাপ ফলাফলের প্রেক্ষিতে এরপর থেকেই মমতা পিকে-কে নিয়োগদান করেছিলেন; যার ফলাফল পরেরবার মমতার ২০২১ সালের রাজ্য নির্বাচনে মোদি হারানোর জয়জয়কার লাভ করেন। কিন্তু এরপর থেকেই কেন্দ্রের নির্বাচনে মমতার দলের পক্ষে নেমে পড়া, নতুন চুক্তি হাতে নেন পিকে। আনন্দবাজারের ভাষায় এটাই ‘ভোট-কুশলীর কাজ’। শব্দটা ইংরেজি স্ট্রাটেজিস্ট শব্দটার বাংলা কৌশলী আর সেখান থেকে ব্যক্তি কুশলী। এটা কুশল বিনিময়ের কুশল নয়। আসলে, এটা প্রকৌশলী লিখতে যে কৌশল শব্দ ব্যবহার করি সেই কৌশল শব্দ থেকে কৌশলী হবে।

পিকে তার কাজের শুরুতেঃ
গত মে মাস থেকে কাজে নেমেই পিকে ‘বিরোধী জোটের ঐক্য’ গড়া দিয়ে কাজ শুরু করতে চেয়েছিলেন। ঘোষণাও করেছিলেন, কংগ্রেসকে সাথে নেয়া ছাড়া এ কাজ শুরু করার মানে নেই; এ ধরনের বক্তব্যও দিয়েছিলেন। কিন্তু কিছু দিনের মাথাতেই অগ্রগতি না দেখে এবার আবিষ্কার করেন যে, খোদ কংগ্রেস দল ও এর অভ্যন্তরীণ বর্তমান দশাই সব সমস্যার উৎস। আর এরপর থেকেই তিনি প্রকাশ্যেই কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো কী তা বিভিন্ন ঘটনার সময় প্রকাশ্যেই তুলে ধরতে শুরু করেন। ইঙ্গিত দিতে থাকেন কংগ্রেস যোগ্য দল নয়; তাই সে নেতৃত্ব দিতে পারবে না। এর পরই তিনি মমতাকে নেতা হিসেবে ‘প্রজেক্ট’ করা শুরু করে দেন। খুব সম্ভবত তারই পরিকল্পনায় মমতার এবারের দিল্লি সফর।

ঘটনা যতটুকুই যা, তা সঠিক হোক বা না; বাস্তবতা হলো পিকের কৌশলে মোদিবিরোধী জোট গড়তে এখনো অগ্রসর হতে পারেন আর না পারেন, মমতাই যে কিছু করার ক্ষমতা রাখেন, এই ইমেজ তিনি (পিকের মাধ্যমে) চার দিকে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন, সন্দেহ নেই। এরই সোজা মানে হল, পিকে সঠিকই ধরেছেন, মোদিবিরোধী দল বা কর্মীরা কোন নেতা, কোন পরিকল্পনা, কোন দল ও জোট ইত্যাদি, এমন সব কিছু আছে এমন একটা জায়গা যে খুঁজে ফিরছে – তা পিকে ধরে ফেলেছেন। আর সেজায়গাটাই হতে যাচ্ছে মমতার তৃণমূল।  বিভিন্ন দল ও গ্রুপে তারা যে এখন পুরান দল ছেড়ে বের হয়ে আসবে, সাহস করবে, মমতাকে দেখে তারা পথ খুঁজে পেয়েছে মনে করবে –  তা ফল দেয়া শুরু করেছে। আর এ কাজটা করতেই রাহুল বা সোনিয়ার নেতৃত্বের কংগ্রেস আনফিট, সেটিই সম্ভবত প্রমাণ হতে যাচ্ছে। ইকোনমিস্ট সেকথাটাই বলেছে

বাংলাদেশের বাংলা ট্রিবিউনে তাদের কলকাতা প্রতিনিধি লিখেছেন শিরোনাম দিল্লি দখলের পথে মমতা!। বলছেন, ‘একের পর এক উইকেট পড়ছে কংগ্রেসে। দেশের প্রাচীনতম দলটি ক্রমেই জাতীয় রাজনীতিতে তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলছে। অন্য দিকে বাংলার বুকে কংগ্রেস ভেঙে তৈরি হওয়া তৃণমূল আজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে দেশে বিজেপিবিরোধী রাজনীতিতে শক্ত অবস্থানে। আঞ্চলিক দলের তকমা ঝেড়ে তৃণমূল এখন সর্বভারতীয় হয়ে ওঠার পথে। চব্বিশের লোকসভা ভোটে মোদিবিরোধী জোটে সোনিয়া, রাহুল কিংবা প্রিয়াঙ্কা নন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই এখন মুখ্য। এমনটিই বলছে রাজনৈতিক মহল। তবে কী ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোর ‘মহামিশন ২০২৪’-এর গেমপ্ল্যানকে লক্ষ্য করে এখন দিল্লি দখলের পথে মমতা!”।
কথা সঠিক; এখন পর্যন্ত যে দলটা সবচেয়ে বেশি ভেঙে দলে দলে নেতাকর্মী বের হয়ে তৃণমূলে যোগ দিচ্ছে এদের বেশির ভাগই পুরনো কংগ্রেস দলের।

তবে আমাদের অতি উচ্ছ্বসিত হওয়ার কিছু নেই। আপাতত মনোযোগে পর্যবেক্ষণই আমাদের কাজ বোধ করি!

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

 

এই লেখাটা  গত  ২৭ নভেম্বর ২০২১, দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ওয়েবে ও পরদিন প্রিন্টে  মোদির পরাজয় ঘটাতে মমতা ও পিকে”  – এই শিরোনামে  ছাপা হয়েছিল।   নয়াদিগন্তে ছাপা হওয়া লেখাগুলোকে আমার লেখার ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ বলা যায়।  আর আমার এই নিজস্ব সাইটের লেখাটাকে সেকেন্ড ভার্সান হিসাবে এবং  থিতু ভাষ্য বলে পাঠক গণ্য করতে পারেন। পরবর্তিতে ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ লেখাটাকেই এখানে আরও অনেক নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে ও নতুন শিরোনামে এখানে আজ ছাপা হল। ]

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s