বাংলাদেশ ভারতের পক্ষ নিবে না


 চীন-ভারত সংঘাতে

বাংলাদেশ ভারতের পক্ষ নিবে না

গৌতম দাস

০৬ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০৬ সোমবার

https://wp.me/p1sCvy-3PL

_

[সার-সংক্ষেপঃ   চীন-ভারত সামরিক সংঘাত আসন্ন কোন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কার পক্ষ নিবে? চীন না ভারতের পক্ষে? নাকি নিজেরই একটা পক্ষে? সম্প্রতিকালে এসব নিয়ে ‘অনুমিত’ দৃশ্যকল্প এঁকে নিয়ে এর আলাপ তুঙ্গে নিয়েছে মূলত ভারত। আর তাতে ভারতের মন রক্ষার্থে সাথে তাল দেয়া শুরু করেছে আমেরিকাও। এনিয়ে এদিক সেদিক, কার মনে কী আছে তা নামে-বেনামে এমন প্রচুর লেখা ছাপা হচ্ছে। আমেরিকা যদিও ভাব ধরেছে যে সে ভারতকে সাপোর্ট করতে নাকি এই প্রসঙ্গে প্রবেশ করে নাই। আমেরিকা বরং নাকি “ভারতের চোখ দিয়ে বাংলাদেশ দেখা” ছেড়ে দিতে বাংলাদেশকে ভারত থেকে আলাদা নিজের এক পররাষ্ট্র ডেস্ক সাজিয়েছে যেখান  থেকে এখন বাংলাদেশ ইস্যু দেখাশুনা করার পরিকল্পনা নিয়েছে – এসব চাপাবাজি-মূলক বক্তব্য এক সাক্ষাতকারে প্রকাশ করেছে। অথচ ফরেন পলিসি পত্রিকার এই আর্টিকেল উলটা সাক্ষ্য দেয় যে খাসিলত বদলায় নাই, বদলাবেও না।
কিন্তু এসময়ে হঠাত চীন-ভারত সংঘাতের কথা উঠছে কেন? এটা আমেরিকা বা ভারত স্পষ্ট উচ্চারণ না করে এড়িয়ে যাচ্ছে যদিও তা করা হচ্ছে “যেন সংঘাত আসন্ন” এমনটা (given) ধরে নিয়ে। তবে ভারত পরোক্ষে এক আর্টিকেল ছাপিয়ে তা বলেছে। সেখানেও আগাম (given) ধরে নেয়া ঘটনাটা হল ভারত তো জীবনেও তিস্তার পানি দিবে না ফলে এক চীনা তিস্তা প্রকল্প যেহেতু বাংলাদেশ ভাবছে; তা ভাববেই স্বাভাবিক। সেটা হলে এর উলটা প্রভাবে ভারত কী কী হারাবে তা নিয়ে এক এজেন্সি রিপোর্ট ছাপিয়েছিল আমেরিকার ভোয়া বাংলায় মতিউর রহমান চৌধুরী। যেখানে ভারতের পক্ষে এক “ছায়া-ব্যক্তিত্ব”  অংশ নিয়েছিল। যেখানে বেপরোয়া ভয়াবহ সব কথা লেখা হয়েছে। যেমন, বাংলাদেশকে ভারতের সাথে চুক্তি করতে হবে যাতে চীন-ভারত যুদ্ধের সময় ভারত বাংলাদেশের উপর দিয়ে সামরিক যান চলাচল করতে পারে। যেমন লিখেছে – “… বাংলাদেশের সাথে একটি চুক্তি সই করা, যে চুক্তিবলে সংঘর্ষের সময় সামরিক, বেসামরিক এবং ট্রাফিক ক্যারি করা যাবে”। মানে এক ন্যাংটা খোকার মামা বাড়ির আলাপ আর কাকে বলে!!!
এমন এসব এজেন্সী ততপরতায় বাংলাদেশ ভরে গেছে। ডেইলি স্টার এমন  আরেক রিপোর্ট এখানে। এক পুরানা এজেন্ট সিপিডি (CPD) এবার ভারতের আরআইএস (RIS) নামের এক ছুপা থিঙ্কট্যাংকের সাথে যৌথ সেমিনার করেছে ঢাকায়।  ছুপা এজন্য যে এরা একদিকে দাবি করছে তারা স্বাধীন থিঙ্কট্যাংক প্রতিষ্ঠান। অথচ এর পরিচালনা পরিষদ বা গভর্ণিং বডিতে দেখা যাচ্ছে  ভারত সরকারের পাঁচ মন্ত্রণালয়ের সচিব (পররাষ্ট্র, বাণিজ্য, অর্থনীতি ইত্যাদি) এবং সাথে আর এছাড়াও আরএসএস নেতা ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ডিরেকটরেই পরিপুর্ণ।  আর এমন RIS এই প্রতিষ্ঠানের সাথে CPD যৌথভাবে বাংলাদেশের ৫০ বছর পালন করেছে ঢাকায়! কী করে?? সিপিডির রেহমান সোবহান ভারতকে করিডোর দেওয়ার পক্ষের এজেন্সীর হয়ে ২০০৭ সাল থেকে সোচ্চার এবং বিরোধীতাকারীদের মুর্খ ও অশিক্ষিত বলেছিলেন তিনি। আবার এখন   ভারতের রাষ্ট্রপতির বাংলাদেশ সফর নিয়ে কিছু লোক অতি উতসাহে আলোড়ন তোলার চেষ্টা হচ্ছে কিন্তু তা অনাগ্রহে গণবিচ্ছিন্ন আড়ম্বরেই আটকে থেকে যাচ্ছে।

আসলে সিপিডি  এমনই ভারত অনুগত যে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু প্রসঙ্গ নিয়ে কথা উঠায় কিন্তু সারা ভারতে গত আট বছর ধরে একটা প্রবল হিন্দুত্ববাদের যোয়াড় বইতেছে আর ভারতের এই বন্ধু হওয়া সত্বেও বাইডেন এই প্রসঙ্গে কথা তোলা ছাড়ে নাই। অথচ আমাদের সেকুলার রেহমান সোবহান সাহেব মুখে কুলুপ দিয়েছেন; কি জানি মহাজন রাগ করে নাকি!!  এমন যতই আনুগত্য [subordination] বা অধীনস্ততা দেখাক এথেকে ভারত কোন কিছু অর্জন করতে পারবে না।

তবু নিশ্চিত বলা যায় যত  প্রচেষ্টাই নেয়া হোক, চীন-ভারতের কোন কল্পিত যুদ্ধে বাংলাদেশ ভারতের পক্ষ নিবে না এর কোন সুযোগই আর নাই। বাংলাদেশ ভারতের পক্ষ তো নিবেই না এডিশনালি সাথে বাংলাদেশের নিজের সার্বভৌম বুঝের কোন অবস্থানও থাকতে পারে।  এমনকি তা হাসিনার নেতৃত্বের বাংলাদেশেও না।  মনে রাখা যেতে পারে, কোন শর্তে বা চাপে ফেলেও বাংলাদেশকে কোনদিকে নেওয়ার দিন শেষ, সেই পরিস্থিতিটাই লুপ্ত  হয়ে গেছে। এটা ভারত যত তাড়াতাড়ি  বুঝবে ততই সেটা ভারতের জন্য মঙ্গল হবে। তবে এর আগে নানা গণবিচ্ছিন্ন আড়ম্বর অথবা বহু চাটুকার বা এজেন্টদের ততপরতা  আমরা চলতে দেখব অবশ্যই। আর হাইকমিশনকেও আমাদের মিডিয়া কিনার জন্য আরো বহুদিন ফান্ড ঢেলে যেতে দেখব। ]

DON’T LOOK AT BANGLADESH WITH INDIAN PRISM : USA MEDIA

 

 

‘ফরেন পলিসি’ (Foreign Policy Magazine), ১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই আমেরিকান পত্রিকা; দীর্ঘ দিন ধরে এটা মূলত ডিপ্লোমেসি ও রাজনীতিক ইস্যু নিয়ে চর্চার এক ম্যাগাজিন। আর বলাবাহুল্য, এ’কাজ তারা আমেরিকান স্বার্থের দিক থেকে তাকিয়ে করে থাকে। আর বাইডেন ক্ষমতায় আসার আগে এই ম্যাগাজিনের অনুসৃত লাইন যাই থাক, চলতি বছর থেকে এটা এখন বাইডেনের বড় ‘একটিভ সাপোর্টিং’ পত্রিকা; বিশেষ করে সাউথ এশিয়ার জন্য আর তা কাভার করার দিক থেকে। মাইকেল কুগেলম্যান [Michael Kugelman] ‘উড্রো উইলসন সেন্টার’ [Wilson Center] এই আমেরিকান থিংকট্যাংকের ডেপুটি প্রোগাম ডিরেক্টর ও সিনিয়র ফেলো। তিনি এখন ফরেন পলিসি পত্রিকায় নিয়মিত এক সাপ্তাহিক ‘সাউথ এশিয়া ব্রিফ’ লেখার তত্ত্বাবধান ও প্রকাশ করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত যেটা আসলে বাইডেনের সাউথ এশিয়া নীতির ছাপে ও পক্ষে এই অঞ্চলের বার্নিং ইস্যুগুলোতে তাদের অবস্থান মেলে ধরে। আর তাতে এ অঞ্চলের খুঁটিনাটি ইস্যুতে বাইডেন প্রশাসনের মনোভাব সম্পর্কেও কিছু  আঁচ পাওয়া যায়। এছাড়া অনেক সময় এ’অঞ্চলের মিডিয়াগুলো কী লিখেছে তার ছোটখাটো রিভিউও দেখতে পাওয়া যায় এই ‘সাউথ এশিয়া ব্রিফে’। অর্থাৎ বাইডেনের পক্ষেরই যেন এটি একটা আলাদা ভার্সন কিন্তু যারা বাইডেন প্রশাসনের সাথে অ-সরকারিভাবে ও ইনফরমালি যুক্ত।

বুড়া সিংহ আমেরিকাঃ
এদিকে চলতি শতক থেকে প্রায়ই আমেরিকান প্রশাসনকে অনেকে ‘বুড়া সিংহ’ বলে থাকে। টানা পঁচাত্তর বছর ধরে আমেরিকা দুনিয়াকে ভালো-মন্দ যাই হোক একভাবে দাবড়িয়ে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে। কিন্তু তার সেসব বহু সক্ষমতাই আজ গত হয়েছে; সোজা নাই হয়ে গেছে; বিগত যৌবন হয়ে গেছে। ফলে যেন এটা এখনো সিংহ বটে তবে চামড়া ঢলে পড়া বুড়া সিংহ হয়ে গেছে।

গত ১৯৪৫ সালকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে একটা ভাল ‘জংশনের বছর’ বলা যায়। এই জংশন হল, এক দিকে  বিশ্বযুদ্ধে দুনিয়ায় ভেঙে পড়া পুরনো অসংলগ্ন [discrete] রাজনৈতিক অর্ডার মানে যেটুকু রাজনৈতিক সিস্টেম ছিল তা ভেঙ্গে, পরে ওর অবশিষ্ট নিয়ম শৃঙ্খলাগুলো ক্রমেই সে ত্যাগ করছে আর অন্যদিকে নতুন এক অর্ডারে এক সুষম সংগঠিত ও গ্লোবাল রাজনৈতিক সিস্টেমে দুনিয়া পুনর্গঠিত করে  নিজে চলতে শুরু করার প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে। নতুন সেই গ্লোবাল রাজনৈতিক সিস্টেমে এর  গ্লোবাল ইন্টারন্যাশনাল অর্ডার বা এই নয়াবিধি ‘ব্যবস্থা’ শুরু হচ্ছে মূলত জাতিসঙ্ঘকে কেন্দ্রে রেখে [এটাই প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের ড্রিম]  এবং অন্তত তিনটা বহুরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে নিয়ে। এই বিগত অর্ডারটাকে যদি বলি কলোনি যুগ বা কলোনি ক্যাপিটালিজমের কাল তবে, নতুন যা সেসময়ে গড়ে উঠছে তা আমেরিকান নেতৃত্বে এক গ্লোবাল ক্যাপিটালিজম।  যদিও সোভিয়েত কমিউনিজম, যা তখন ইতোমধ্যে ২৮ বছর বয়স্ক, সে এটা সরাসরি স্বীকার করতে চায়নি। কেবল জাতিসঙ্ঘ গঠনের সময়ে নিজের ভেটো সদস্যপদটা ঠিকঠাক থাকে তা বুঝে নিয়ে বাকি ব্যাপারে  প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে তালে তাল দিয়ে গেছে। অর্থাৎ   আমেরিকা যা করে করুক, পরোক্ষে এভাবে মেনে নিয়েছিল। আর অন্য দিকে আন্তঃরাষ্ট্রীয় ব্যাপক কোন বাণিজ্য যেটা ১৯৪৫ এর আগের দুনিয়ায় যা কোনদিন ছিল না  তা এবার পূরণে এক বিশাল গ্লোবাল বাণিজ্য বিনিময় ব্যবস্থা চালু করতে বা তার নিয়ন্ত্রক বহুরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক এদের জন্ম দেয়া হোক;  আর  তা আমেরিকা গড়ে তুলুক এটাই ইউরোপ মনেপ্রাণে চেয়ে ও সাপোর্ট করে গেছিল। তাই আমেরিকা এভাবে এক গ্লোবাল পলিটিক্যাল সিস্টেম চালু করে নিতে পেরেছিল।
আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক জন্মের টানা ২২ দিনের জন্মসভার হোটেলে বসবাসে সোভিয়েত ইউনিয়নও আমন্ত্রিত হয়ে উপস্থিত থেকেছিল; অংশ নিয়েছিল। কিন্তু ১৯৪৫ সাল থেকে এর প্রাতিষ্ঠানিক কার্যকারিতা শুরু হয়ে গেলে তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন আর চাঁদা দিয়ে সদস্যপদ নেয় নাই বা নিতে আসে নাই। আবার কোনো বাধাও দেয়নি। কেন কী হয়েছিল, কেন সোভিয়েত ইউনিয়নের এমন সিদ্ধান্ত তা প্রকাশ্যে, স্টালিন তখনো জীবিত ও ক্ষমতাসীন- তা সত্ত্বেও কোথাও তিনি তা জানাননি। লিখিত কিচ্ছু নেই। তবে আমেরিকা তার নয়া গ্লোবাল অর্ডার নিয়ে  ঠিকই এগিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই থেকে টানা পঁচাত্তর বছর পরে আমেরিকা এখন এক বুড়া সিংহ যার যৌবন কেটেছে ‘রুস্তমি’ করে। যখন সে কোন কিছু চেয়েছে জানলেই তখন অনেক কিছু হয়ে যেত। সেসব দিন আর নাই। এর বড় কারণ এখন আমেরিকা কাউকে দুর্নীতির  অজুহাতে ধরে অনুগত করতে বেকায়দায় ফেললে এটাই সুযোগ হয়ে উঠে – এই সুযোগে চীন বিপুল অনকাঠামো নিয়ে সে দেশে প্রবেশ করে যেতে পারে। বিশ্বব্যাংকই একমাত্র ও একচেটিয়া বিকল্পহীন সেসব দিন আর নাই। ওদিকে ইতোমধ্যে আমেরিকান আমাদের মত দেশকে অবকাঠামো বিনিয়োগ দিবে সেই সক্ষমতাও শুকিয়ে আসে।

চলতি শতক বা দুই হাজার সাল থেকে আমেরিকার অর্থনৈতিক সক্ষমতা যে ঢলে পড়ছে তা আর লুকিয়ে রাখা যায়নি। বিশেষ করে আফগানিস্তানে ফলহীন যুদ্ধে একতরফা অর্থ ঢালার পর থেকে আরো মারাত্মকভাবে। আর এর বিপরীতে চীনের উত্থান এবং সমৃদ্ধ ও প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে চীন সেই নেতৃত্বের জায়গা নিতে উঠে আসা, সেটাও স্পষ্ট হতে শুরু করেছিল।
মজার কথা হলো, ওবামা আমল (২০০৯-২০১৬) পর্যন্ত যত প্রেসিডেন্ট তারা কেউ স্বীকার করেননি যে, চীন উঠে আসছে, আমেরিকা বুড়া সিংহ হচ্ছে। এই বাস্তব সত্য স্বীকার না করাটাই যেন আমেরিকান সব প্রশাসনের অফিসিয়াল অবস্থান। একমাত্র কিছু ব্যতিক্রম দেখা যায় জিবিগনিউ ব্রেজনিস্কি যিনি চীন-আমেরিকা সম্পর্ককে প্রথম (১৯৭৮) পারস্পরিক স্বীকৃতির রূপ দিতে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিলেন, তার বেলায়। যখন তিনি ছিলেন (১৯৭৭-৮১) প্রেসিডেন্ট কার্টারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (NSA)। তিনি খোলাখুলি চীনা উত্থান প্রসঙ্গে নিজের বইয়ে লিখেছেন। এমনকি ওবামাও আমেরিকান নেতৃত্ব আরো বজায় থাকবে কি না এ নিয়ে সেকালেই যেসব প্রশ্ন উঠে গেছিল তা তিনি মানেন না দেখাতে উলটা দাবি করে বেড়াতেন যে, আমেরিকাই আরো বহুদিন গ্লোবাল নেতৃত্বে থেকে যাবে।

কিন্তু কেন এখানে চীনের গ্লোবাল নেতৃত্বে উত্থান বা আমেরিকান বুড়া সিংহ হয়ে যাওয়ার স্বীকার-অস্বীকার নিয়ে কথা তুলছি?
কারণ উপরে উল্লিখিত ‘ফরেন পলিসি’ ম্যাগাজিনে এবারের ‘সাউথ এশিয়া ব্রিফে’ কুগেলম্যানের সাথে যৌথভাবে লেখা একটি আর্টিকেল ছাপা হয়েছে। ওতে সহলেখকের নাম আনু আনোয়ার [Anu Anwar], জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির যিনি পিএইচডি প্রার্থী। আর ঐ লেখার শিরোনাম হল “আমেরিকার বাংলাদেশকে নিয়ে বাজি ধরা উচিত” [America Should Bet on Bangladesh]। আর উল্লেখ্য যে এ’লেখায় চীনের চেয়ে আমেরিকা অক্ষম হয়ে পড়েছে এর স্বীকারোক্তি করা হয়েছে। সেসব প্রসঙ্গে ঢুকব এখন।

 কিন্তু লেখার প্রসঙ্গ কেন এমন?
গত মাসে, মানে নভেম্বরের মাঝমাঝি এক আমেরিকান ডেপুটি সহকারী মন্ত্রী (সাউথ এশিয়া) কেলি কেইডারলিং [Kelly Keiderling] বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন কোনো এক বহুরাষ্ট্রীয় সভায় যোগ দিতে। ফিরে যাওয়ার আগে তিনি ডেইলি স্টারকে এক সাক্ষাৎকার দেন যার প্রসঙ্গ হল – তিনি দাবি করেন, আমেরিকান স্টেট ডিপার্টমেন্টে বাংলাদেশ আলাদা গুরুত্ব লাভ করেছে, যে কারণে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ এখন থেকে আর ভারতের সাথে একই ডেস্ক থেকে দেখাশোনা করা হবে না। এতে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছিল যে, বাংলাদেশকে আর ‘ভারতের চোখ দিয়ে’  দেখা আমেরিকা  বন্ধ করেছে। তাই কুগেলম্যান ও আনু আনোয়ারের যৌথ লেখাটা হল, সেই বক্তব্যের গুরুত্ব আরো বিস্তারিত একটা সাফাইয়ে তুলে ধরা।
ওই যৌথ লেখা নিয়ে কোন সেন্সিবল বাংলাদেশের যে প্রতিক্রিয়া হবে সবার আগে তা শিরোনাম আকারে বলে রাখি। বাস্তবে ফরেন পলিসির এই আর্টিকেল ভারতের চোখ দিয়ে আমেরিকার দেখার অভ্যাস ত্যাগ করা দূরে থাক, বরং আরো পোক্তভাবে ভারতের তথাকথিত নিরাপত্তাস্বার্থের চোখ দিয়েই বাংলাদেশকে দেখেছে। মানে ভারতের তথাকথিত নিরাপত্তাস্বার্থ বাংলাদেশ কতটা দেখবে অথবা না, সেই আলোচনাই ওখানে করা হয়েছে।

আগাম অনুমান  
কোন লেখা শুরু করার আগে লেখকের কিছু আগাম অনুমান সেখানে থেকে থাকে। সেই অনুমানটা আমরা এখানে দেখব। যেমন আনুদের লেখাটা সে অনুমানের উপর দাঁড়িয়ে আছে তা এখানে আমরা পাব। আনু লিখছেন, “ভবিষ্যতের কোনো সঙ্কটে বাংলাদেশ যদি চীন অথবা ভারত কোনোটার পক্ষ নিতে হয় অথবা  কোনো নিজস্ব ভূমিকায় হাজির হয়, তা সামরিক অথবা কূটনীতিক যাই হোক না কেন, তাহলে তা এঅঞ্চল বিপদে পড়ার মত ভূরাজনৈতিক পরিণতি ডেকে আনবে [If Bangladesh were to take the side of China or India, or to exert any role, whether diplomatic or military, in future crises, there would be considerable geopolitical consequences for the region. অর্থাৎ মূলকথা বাংলাদেশের নিজের ভুমিকা নেওয়াটাই ভারতের জন্য হবে মারাত্মক – এটাই তিনি বলতে চাইছেন।

If Bangladesh were to take the side of China or India, or to exert any role, whether diplomatic or military, in future crises, there would be considerable geopolitical consequences for the region.”

এখানে একটি কথা বলে রাখি। এ লেখাটায় জিও-পলিটিক্যাল [geopolitical] এই অস্বচ্ছ শব্দটা যথেচ্ছ ব্যবহার করা হয়েছে একেবারে বিরক্তির পর্যায়ে।  এমনিতেই যারা ‘জিও-পলিটিক্স’ শব্দ ব্যবহার করেন তাদের ওপর ভীষণ বিরক্তি লাগে। মনে হয় এসব মানুষের যখন কোনো কিছু বুঝতে বা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নিজের ক্ষমতা টের দেয়, তখন এরা সোজা সেখানে জিও-পলিটিক্স শব্দটা ব্যবহার করে পার পেতে চায়। ফলে এক অর্থহীনতা তৈরি করে। অথচ তারা কোথাও কোন রাষ্ট্রের (কূটনৈতিক) সিদ্ধান্তগুলো বা ততপরতার কারণে যখন  তার স্থানীয় পড়শি রাষ্ট্রের উপরে এর প্রভাব পড়া শুধু নয়, তাতে শুধু আঞ্চলিকও নয় একেবারে গ্লোবাল পর্যায়েও প্রভাব পড়ে – এরা সেই গ্লোবাল প্রভাব কথাটাকে বুঝতে বুঝাতে না পেরে সম্ভবত সেটাকে “জিও-পলিটিক্স” বলে চালাতে চেয়ে থাকে।
এর পেছনের মূল কারণ দুনিয়ায় ক্রমেই গ্লোবাল হয়ে ওঠা অর্থনীতি। এতে সব কিছুই এখন গ্লোবাল; মানে কোনো কিছুই আর স্থানীয় থাকছে না যেহেতু বাণিজ্য এখন গ্লোব-জুড়ে মানে গ্লোবাল হয়ে উঠেছে; ফলে পণ্য-বিনিময়ও গ্লোবাল রূপ নিয়েছে। তাই একটি ভূগোলে (জিও) কিছু একটা ঘটলে এর প্রভাব-পরিণতি স্থানীয় থাকছে না, বরং স্বতঃই তা গ্লোবাল হয়ে উঠছে।

ঠিক আছে, তাহলে লেখক এখন কী নিয়ে উদ্বিগ্ন? বাংলাদেশের সামর্থ্যবান হয়ে যাওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন?  সেটাই বা কেন? কারণ প্রধান প্রশ্ন, তা হলে এর মধ্যে আমেরিকান স্বার্থটা কী? বাংলাদেশ সামর্থবান হলে যদি ভারতের ক্ষতি হয়ে যায় তার মধ্যে আমেরিকান স্বার্থটা কী? এবং কোথায়?

আসলে এখানে আমেরিকার সরাসরি কোনো স্বার্থ নেই। স্বার্থটা মূলত ভারতের আর এটিই আমেরিকার উদ্বেগের কারণ। এই হলো আমেরিকার ধরে নেয়া অনুমান বা নিজের স্বার্থসংক্রান্ত বুঝ। মানে আবার বোঝা যাচ্ছে তা হলে, আমেরিকার বাংলাদেশের জন্যও কোনো উদ্বেগ নেই।

নিজের নয়, কিন্তু ভারতের স্বার্থ নিয়ে আমেরিকা উদ্বিগ্ন কেন? জবাব হল, আমেরিকা চীনের বিরুদ্ধে যা কিছু ভারতীয় স্বার্থ, এসব নিয়ে উদ্বিগ্ন।

তাহলে দাঁড়াল যে, এই আর্টিকেলটা বাংলাদেশ নিয়ে মনে হলেও আসলে এটা ভারতের স্বার্থরক্ষা নিয়ে উদ্বিগ্ন আমেরিকার পক্ষে লেখা এক আর্টিকেল। তার মানে, সেই একই পুরান কথাটাই হল যে, এখানেও আসলে আমেরিকার ভারতীয় প্রিজমের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশকে দেখছে – সেই পুরনো অভ্যাসের ধারাবাহিকতা। সেই ২০০৭ সাল থেকে চলে আসা আমেরিকার পুরনো কায়দাটাই।
তা হলে যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, ‘বাংলাদেশ যদি চীন অথবা ভারত কোনোটার পক্ষ নেয় মানে নিজের কোনো ভূমিকা নিয়ে হাজির হয়,…তো খারাপ ভূরাজনৈতিক পরিণতি ডেকে আনবে’  – এর মধ্যে সারকথাটা হল, বাংলাদেশ যদি চীনের পক্ষ নেয় বা আরও নিজের কোনো ভূমিকা নিয়ে হাজির হয় – এসব ক্ষেত্রে এক উদ্বিগ্ন আমেরিকাকে আমরা দেখতে পাচ্ছি।

অথচ কথাটা একেবারেই সোজা।  চীন-ভারত দ্বন্দ্বের ইস্যুতে এমন দুটোর মধ্যে বাংলাদেশ ঠিক কী করবে তা যাই করুক সেটা তো বাংলাদেশের একান্ত সিদ্ধান্ত এবং স্বভাবতই বাংলাদেশ চাইবে তার সার্বভৌম সিদ্ধান্ত নিজের কাছে রেখে দিতে। এমনিতেই বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে সঠিক অবস্থান হবে কোন দুপক্ষের বিবাদে কোনই পক্ষ না নেয়া; এ বিষয়ে তাদের উভয় থেকে দূরে থাকা।

আর এখানে আবার আমেরিকা চাচ্ছে আমরা যেন ভারতের পক্ষে থাকি, যেটা অ্যাবসার্ড ও অলীক। আর সেটা কোন ভারত বা কোন আমেরিকা? যে আমেরিকা বাংলাদেশকে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে?  আহা রে কিউট বাবুটা! সত্যি এ এক অদ্ভুত আবদার!

এ ছাড়া এই প্রসঙ্গে আরেকটা মজার দৃশ্যপট পরীক্ষা করা যাক। আসলেই কি চীন-ভারত কোনো সঙ্ঘাতে খোদ আমেরিকাই ভারতের পক্ষে দাঁড়াবে? যুদ্ধ করবে? সত্যি?  এটা তো সুখে কান্না চলে আসার মত বেবি!  আচ্ছা, দুই বছর আগে লাদাখে চীন-ভারত সীমান্ত সঙ্ঘাতে কমপক্ষে ২০ ভারতীয় সৈন্য নিহত ও বহু আহত হয়েছিল (যখনিকার ভারতীয় সৈন্যদের কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকা বা কান্নার দৃশ্যের ভিডিও নেটে প্রায়ই প্রকাশিত হতে দেখি আমরা), সেই উত্তেজনার সময়েও কি আমেরিকা ভারতের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল? প্রশ্নই আসে না। আমেরিকা আসেনি। এমনকি আমেরিকার পক্ষ থেকে ভারতকে কোন সান্ত্বনাবাণী দানের কথাও আমরা জানি না। তাহলে? আমেরিকা আসলে কার পক্ষে? আর আমরা কোন পক্ষ নিব তা নিয়ে আমেরিকা উদ্বিগ্ন হওয়া কী সাজে???  টু উ উ মাচ!

এ নিয়ে ইদানীংকালের প্রশাসন, বাইডেন প্রশাসনের দুর্গতি আরো ভয়াবহ। একালের এই আমেরিকা এখন সব ব্যাপারে আসলে লিম্ব মানে ঝুলে থাকে, কোনো পরিস্থিতিতে কোন  দিকে নড়ে না। যেমন আমেরিকান (Countering America’s Adversaries Through Sanctions Act) বা CAATSA আইনে কেউ রাশিয়ান এস-৪০০ মিসাইল কিনলে সেই রাষ্ট্রের উপর আমেরিকান অবরোধ আরোপ হবে। সে বিচারে এমন মিসাইল কেনায় ভারতের উপরে অবরোধ আরোপ হয়ে যাবার কথা। কিন্তু তা কী স্টাটাস অবস্থায় আছে কেউ ঠিক জানে না- ব্যাপারটা ‘লিম্ব’ হয়ে ঝুলে আছে।
আবার ওদিকে তাইওয়ান নিয়ে অযথা খোঁচাখুঁচি ব্যাপারটা আবারো একেবারে ছেচড়ামোর পর্যায়ে নেয়া হয়েছে। “এক চীননীতি” [One china policy] মানে হল তাইওয়ান আলাদা দেশ নয়;  বরং একই চীনা ভূখণ্ডের অংশ – এটা কোন রাষ্ট্র না মানলে সে রাষ্ট্রের সাথে চীন কূটনৈতিক সম্পর্ক করে না। সেই বিচারে ১৯৭১-৭৭ সাল পর্যন্ত নানান ইস্যুতে দীর্ঘ আপস আলোচনার পরে আমেরিকার এক চীননীতি মেনে নিয়েই চীন-আমেরিকা কূটনৈতিক সম্পর্ক শুরু করেছিল ১৯৭৮ সালের শুরু থেকে।
এভাবেই দীর্ঘ পথ চলার পরে  ট্রাম্পের আমলে এসে তিনিই প্রথম এক চীননীতি মানি-মানি না টাইপের লিম্ব তৈরি  করেন। । শেষে এবছর গত  অক্টোবর মাসে এসে চীন তাইওয়ান ইস্যুতে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করলে বাইডেন এবার তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা সুলেভানিকে দ্রুত চীনের সাথে বৈঠকে বসেই সোজা ১৯৭৮ সালের এক চীননীতিটাই বাইডেনের আমেরিকা এখনো বজায় রেখেছে বলে ঘোষণা দিয়ে দিলেন। এভাবে চীনের সব ক্ষোভ মিটিয়ে দিলেন। কিন্তু আবার গত দুই সপ্তাহ ধরে পুরানা চুলকানি! বাইডেন তার ‘গণতন্ত্র সম্মেলনে’ এবার তাইওয়ানকেও রাষ্ট্র হিসেবে দাওয়াত করেছেন।  অথচ তাইওয়ান জাতিসংঘের সদস্য নয় ঐ ১৯৭১ সাল থেকে। যখন থেকে সেটা কেড়ে নিয়ে মাওয়ের চীনকে আসল চীন বলে ভেটোসহ ঐ সদস্যের হকদার বলে মানা হয়েছিল। তাই মূল চীনাভুখন্ডের একচীন নীতি জাতিসংঘের চোখেও ভ্যালিড। এটা স্রেফ কোন গোয়ার্তুমি নয়। )  তাই আবার খামোখা টেনশন! অর্থাৎ এ কালের  বুড়া সিংহ  আমেরিকা  যে মুরোদ হারাচ্ছে তার আরেক প্রমাণ হল এসব ছেচরামো। এরই আরেক প্রকাশ হল, সিদ্ধান্ত নিয়ে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বারবার ঝুলে থাকতে সবচেয়ে ভালো পারে!

বাংলাদেশ কেন চীনের বিনিয়োগ পাওয়ার দিকে ঝুঁকেছে তা বর্ণনা করতে গিয়ে আনু নিজেই বলছেন, “চীনের অল্প সময়ের ভেতর বিপুল বিনিয়োগ সমাবেশ ঘটানো বা জোগাড়ের ক্ষমতা এবং তাও আবার তুলনামূলক অল্প কিছু শর্তে। যেটা নয়াদিল্লি তো বটেই ওয়াশিংটনেরও কম্ম নয়, তাদের এমন মুরোদ নেই” [Bangladesh, like many countries housing BRI investments, is attracted to Beijing’s ability to quickly deploy large amounts of capital with relatively few conditions. This is not something that New Delhi—or, for that matter, Washington—is able to do.]”।

Bangladesh, like many countries housing BRI investments, is attracted to Beijing’s ability to quickly deploy large amounts of capital with relatively few conditions. This is not something that New Delhi—or, for that matter, Washington—is able to do.”

আমার মনে হয়, লেখক আনু আনোয়ারের  এত খোলাখুলিভাবে চীনের চেয়ে আমেরিকার অক্ষমতার কথা এই কঠিন সত্যকে প্রকাশ করা, কোনো আমেরিকান লেখায় আগে আসেনি। এ্ইটা বুড়া সিংহের নিজেকে বুড়া হিসাবে  এক আপন স্বীকারোক্তি!

তবু লেখক এখানেই থামেননি। পরামর্শ দিয়েছেন আমেরিকাকে আবার তার যৌবন কালের মতো নয়া অবকাঠামো বিনিয়োগ বাংলাদেশে আনতে [By funnelling more investments into Bangladesh……]। কারণ একথাটা অবাস্তব তিনি জানেন। কিন্তু এটা বলা ছাড়া তার লেখাটাই দাড়ায় না, অর্থহীন হয়ে দাড়ায়।  সবাই জানে, আমেরিকার সে ‘ব্যবসা’ মানে যোগ্যতা চলে গেছে বহু বছর আগেই। তবু ‘গপ্প ফলিয়ে বেড়ানো’ আমেরিকা ত্যাগ করেনি। গত জি-৭’ বৈঠকে সবাইকে সাথে নিয়ে তারা নতুন উদ্যোগে অবকাঠামো বিনিয়োগ আনবেন, যেটা নাকি আবার চীনা বেল্ট-রোডেরও প্রতিদ্বন্দ্বী হবে। কিন্তু এসবই গল্প যা এখন পর্যন্ত কোনো রকমের বাস্তব প্রকল্প হিসেবে শোনা যায়নি। তাই শেষে আনু নিজেই স্বীকার করে নিচ্ছেন যে, ‘চীনের মতো দ্রুত আর বিশাল বিনিয়োগ সমাবেশ ঘটানোর মুরোদ আমেরিকার নেই”।

তাই সারকথায় ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের এই আর্টিকেলটা লেখা অথবা বাংলাদেশের আলাদা ডেস্কের কথা বলে লোভ দেখানো  – এসবই আসলে লিপ সার্ভিস বা কথার কথা। সিংহ বুড়া হয়ে গেলে তারা আর কী করে?  তবু তাদেরকে এসব চাপাবাজি করে যেতেই হয়। তাই এসব করেই চীনের বিরুদ্ধে “ভারত নাকি পরাশক্তি” একথা বলেই পরিচয় করিয়ে দিতে হয় আমেরিকাকে।

খামোখা কূটনৈতিক শোডাউনঃ
গত মাসের শেষ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত এদিকে আরেক চাপাবাজি চলবে, একই কারণে। মানে ফরেন পলিসির আর্টিকেলের সাথে ঢাকায় ভারতের কূটনৈতিক নড়াচড়া সম্পর্কিত ঘটনা ততপরতার কথা বলছি। যেমন, দোরাইস্বামীর প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ, বিদেশ সচিব হর্ষবর্ধনের ৭ ডিসেম্বরে ঢাকা সফর  –  আর এসবই আগামী ১৬ ডিসেম্বর ভারতের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর উপলক্ষে।

“বাংলাদেশ ভারতের সৃষ্টি, ভারতেরই ফসল, কাজেই বাংলাদেশ ভারতের প্রভাব বলয়ের বাইরে যায় কী করে” – ভারত যখন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোনো কথা উচ্চারণ করে তখন অলক্ষ্যে এ খামোখা বয়ানটাই তার কূটনীতিকরা তাই মনে মনে আওড়াতে থাকেন। অতএব চীন-ভারতের কোনো সঙ্ঘাতে বাংলাদেশ তো ভারতেরই, ভারতের প্রভাব বলয়ের জবাইযোগ্য এক নধর খাসি যেন!  কাজেই বাংলাদেশ আর যাবে কোথায়! এই দুই সপ্তাহ ধরে ভারতীয় স্বার্থগুলো এসব বয়ানেরই জপ করতে থাকবে।

কিন্তু তাদের কাঙ্ক্ষিত ফলাফল, মানে কোন রিটার্ন কী আসবে? না, আসবে না। বরং ফলাফল একদম হবে শূন্য। এমনকি বর্তমান  হাসিনার বাংলাদেশও ভারতের পক্ষে যাবে না, মুভ করার সে সুযোগটুকুও নেই। বাস্তবতা এমনই। কিন্তু তাই বলে সে বাস্তবতার কথা আবার সরকারের দিক থেকে ভারতের কাছে মুখে উচ্চারণও করা হবে না। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা ঢাকা সফর উপলক্ষে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিডিয়াকে বলছেন, “আমি ঢাকায় থাকলে তার সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ হতে পারে”। কাজেই কী পরিমাণ প্রাণহীনভাবে এ’দুই সপ্তাহ কাটবে, এখান থেকে অনুমেয়; অর্থাৎ কেবল মুখেই বলা হবে না যে, বাংলাদেশ ভারতের পক্ষে নেই। আর কার্যত এটা ভারতেরও পরিস্কার করেই অজানা নয়। তা হলে ভারত চীনের কাছে তার ‘হবু ও কথিত’ শিলিগুড়ি করিডোর অথবা সাত রাজ্য হারানোর কথা যে লেখক আনু তুলেছেন, তার কী হবে?

আমেরিকান থিংকট্যাংকের দিগগজেরা আর কথিত ‘পরাশক্তি’ ভারত কী করে নিজেদের রক্ষা করবে, তা তো তাদেরই বিষয়। সাধারণভাবে বললে, এটা তাদের জবরদস্তিতে তোলা ইস্যুতে  খানিক এক ভীষণ উত্তেজনা মাত্র। আর বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন কোন মানুষ এর ভেতরে নিজেকে সংশ্লিষ্ট করে না। তাই সাধারণ মানুষের কাছে এটা মৃত এক ভারতীয় উদ্বেগ যাকে চাবুক মেরে জাগানোর চেষ্টা দেখছি আমরা। এমনকি যার শেখ হাসিনা সরকারের কাছেও কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। সত্য নয়।

তবুও ঢাকায় দুই সপ্তাহ ধরে নয়াদিল্লি-ঢাকা কত কাছাকাছি, কত নিকটাত্মীয় ও বাংলাদেশ ভারতের প্রভাবাধীন তা প্রদর্শনের এ ধরনের কিছু ইমেজ ফাঁপা ডেকোরেটেড উত্তেজনা তৈরি করা হতে দেখব অবশ্যই!

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

 

এই লেখাটা  গত  ০৪ ডিসেম্বর ২০২১, দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ওয়েবে ও পরদিন প্রিন্টে   “বাংলাদেশ ভারতের পক্ষে যাবে না”  – এই শিরোনামে  ছাপা হয়েছিল।   নয়াদিগন্তে ছাপা হওয়া লেখাগুলোকে আমার লেখার ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ বলা যায়।  আর আমার এই নিজস্ব সাইটের লেখাটাকে সেকেন্ড ভার্সান হিসাবে এবং  থিতু ভাষ্য বলে পাঠক গণ্য করতে পারেন। পরবর্তিতে ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ লেখাটাকেই এখানে আরও অনেক নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে ও নতুন শিরোনামে এখানে আজ ছাপা হল। ]

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s