‘অবরোধের’ অভিমুখ, এছাড়া কোথাও অন্য আলাপ নেই
গৌতম দাস
২৭ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০৬ সোমবার
The Impact of the U.S. President on Economic Sanctions
An exterior view of the building of US Department of the Treasury is seen on March 27, 2020 in Washington, DC. – US Treasury Secretary Steven Mnuchin on Friday pledged to quickly send cash to Americans as part of the a massive $2.2 trillion relief package aimed at rescuing the coronavirus-battered economy. (Photo by Olivier DOULIERY / AFP) (Photo by OLIVIER DOULIERY/AFP via Getty Images)
চার দিকে মার্কিন অবরোধ ছাড়া বাংলাদেশে এখন যেন কোনো আলোচনার বিষয় নাই। গত ১০ ডিসেম্বর বাইডেন প্রশাসন এক স্যাংশন বা অবরোধের তালিকা প্রকাশ করেছিল। ওই তালিকাটা প্রকাশ করার পরে সবচেয়ে বড় চাপ তৈরি হয়ে আছে বাংলাদেশে। তালিকায় ভুক্ত অন্য দেশগুলো হল – উগান্ডা, উত্তর কোরিয়া, চীন, বেলারুশ, শ্রীলঙ্কা ও মেক্সিকো। এখানে আমেরিকার দিক থেকে এই অবরোধ আরোপের কারণ কী? সে কারণ বলা হয়েছে ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে অবরোধ আরোপ’ …“gross violations of human rights,”…। তবে বাংলাদেশসহ এই সাত দেশের যেসব সরকারি কর্মকর্তার ওপর অবরোধ আরোপ হয়েছে তারা মোট ১২ জন [designated 12 government officials ]। অথচ এই ১২ জনের মধ্যে একা বাংলাদেশেরই ছয়জন। যারা একই প্রতিষ্ঠানের র্যাব [RAB] থেকে। মানে আগের মহাপরিচালক বেনজির ও এখনকার বর্তমান মহাপরিচালক এবং সাথে এখনকার চলতি অতিরিক্ত মহাপরিচালক সাথে আরো সাবেক তিন অতিরিক্ত মহাপরিচালক – এভাবে মোট ছয়জন। [ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের মূল নিষেধাজ্ঞার প্রেস রিলিজে এই ছয়জনের নাম দেয়া আছে।] তাই সম্ভবত বলা যায় বড় চাপ অথবা ‘বড় থাবা’তে যে আমেরিকা বাংলাদেশকে ধরেছে তা অনুমান করা যায়। এখান থেকেই বাংলাদেশের সর্বত্র চা দোকান থেকে আলিশান ড্রয়িংরুম বা ক্ষমতার করিডোরগুলোতে প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়েছে এই মার্কিন অবরোধ।
কিন্তু এই অবস্থার কারণেই আবার বাংলাদেশের বাইরে অবরোধের প্রতিক্রিয়া কী হচ্ছে, কিভাবে পড়ছে সেদিকটা প্রায় নজর শূন্য হয়ে পড়েছে বাংলাদেশের। অথচ সেটাও বাংলাদেশের দিক থেকে দুনিয়ার পরিবর্তন বুঝার জন্য কম গুরুত্বপূর্ণ নয় মোটেও। তবু প্রথমেই বলে নেই, এখানে ‘বাংলাদেশের বাইরে’ বলতে শুধু অবরোধ তালিকায় থাকা উগান্ডা, উত্তর কোরিয়া, চীনসহ ছয় দেশের কথা বুঝাচ্ছি না। এর বাইরেরও দেশ যারা আছে, যাদের নাম তালিকায় থাকার কথা কিন্তু শেষবেলায় এসে আমেরিকা যার নাম তালিকায় রাখেনি। যেমন, এমন অন্যতম দেশ হল, ভারত।
এই ২০০১ সাল শুরু হয়েছিল, এটা ধরে নিয়ে যে ভারত তখন থেকে আমেরিকার ঘোরতর স্ট্র্যাটেজিক বন্ধু হয়ে গেছে। আসলে এক ভয়ঙ্কর ইসলামবিদ্বেষ [islamophobia] এক ফোবিয়া যা কোনভাবেই গ্রহনযোগ্য নয় কারণ তা ধর্মের বিরুদ্ধে অন্য এক ধর্মের এথনিক ঘৃণা ছড়ানোর হিটলারি তৎপরতা। অথচ এটাই আবার ভারত ও আমেরিকার কমন চরম অনৈতিক ও নির্মুলের [ক্লিনজিং-এর] স্বার্থ। এমন দগদগে স্বার্থই তাদের গত শতকের বেশিরভাগ সময় জুড়ে যে সব পুরনো বিবাদ ছিল তার সব ভুলে কাছাকাছি ও নতুন বন্ধু হতে উৎসাহিত করেছিল।
অন্যভাবে বললে আমেরিকার “ওয়ার অন টেরর”পলিসিতে বড় সমর্থক হিসেবে এশিয়ায় ভারতকে পেতে ভারত-আমেরিকা কমন ইসলামোফোবিয়ার ভিত্তিতে পরস্পর তারা নতুন বন্ধুত্ব শুরু করেছিল। আর এটা এমনই পরস্পরের পিঠ চুলকে দেয়া বন্ধুত্ব যে, মনে করা হত তাদের পরস্পরের এই ‘পার্টনারস ইন ক্রাইম’-এর বন্ধুত্ব – এটা সহসাই নষ্ট হচ্ছে না; হবে না বা ভাঙবে না।
অনেকের মনে হতে পারে কেন আমি এটাকে ভারত-আমেরিকার – “ইসলামোফোবিয়ার ভিত্তিতে পরস্পর তাদের নতুন বন্ধুত্ব শুরু” বলছি? একটা ছোট ঘরোয়া উদাহরণ দিব। বিভিন্ন দেশের মাইগ্রেন্ট হতে চাওয়াদের নিয়ে নিজ দেশে নাগরিকত্ব দিচ্ছে এমন দেশগুলোর মধ্যে কানাডা অন্যতম। আর বাংলাদেশের অনেক বাসিন্দা এমন সুবিধা নেওয়ার ক্ষেত্রেও অন্যতম। তাতে বাংলাদেশ থেকে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে অনেকে এমন নাগরিকত্ব নেয়া শেষ করেও ফিরে দেশেই থেকে গেছে অথবা কানাডায় বসবাস শুরু করেছে। সম্প্রতি গত সপ্তাহে কানাডা আবার আরো চার লাখের মত নতুন মাইগ্রেন্ট নিবে বলে ঘোষণা করেছে। এমন প্রেক্ষিতেই আমাদের এই স্টোরি।
এনিয়ে দুই উচ্চ-শিক্ষিত হিন্দু নারীর কথোপকথন যারা বহু পুরানা কানাডায় নাগরিকত্ব নেয়া বাংলাদেশি মাইগ্রেন্ট। তারা আক্ষেপ করে বলছেন, নয়া এই আরো মাইগ্রেন্ট নেওয়ার সিদ্ধান্তের কারণে, তাদের দৃষ্টিতে কানাডা আর তাদের বসবাসের জন্য উপযুক্ত স্থান থাকবে না। কেন, এমন অনুমান? কারণ এতে কানাডিয়ান বাংলাদেশিদের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা ব্যাপক বেড়ে যাবে। আর তাদের অনুমানে ধরে রাখা আছেই যে মুসলমান মাত্রই তারা “পশ্চাতপদ, আনকুথ, আনকালচার্ড” ইত্যাদি। ওরা সেই কথা চিন্তা করে এই কথা বলছেন। মানে বৃটিশ আমল থেকেই “প্রগতিশীলতা নামে” যা তাদের মনের গভীরে প্রোথিত তা আসলে এক এথনিক ঘৃণা, এক ক্লিনজিংয়ের আকাঙ্খা, এক “হিটলারি মনোরোগ”। সেসবই এখানে নব-পরিসরে প্রকাশিত হয়েছে।
এই কথোপকথনের পরে আরো কিছু শেষ অংশটা এখন কী ও কেমন হতে পারে সেই ছবিটা এঁকে দেয়া যাক। সেটাও কম ভয়ঙ্কর নয়। ইসলামোফোবিয়া-সহ যেকোন ফোবিয়া [phobia] বা এথনিক ঘৃণা-বিদ্বেষ আসলে কিন্তু খুবই ছোঁয়াচে। মানে কী? মানে হল তা শ্রোতার মনেও পালটা এথনিক ঘৃণা-বিদ্বেষ জাগিয়ে তুলতে পারে। যেমন ইসলামোফোবিয়ার কমন অনুষঙ্গ বা সাথে বড় হওয়া ভাবনা হল মুসলমান নির্মুল বা ক্লিনজিংয়ের প্রবল আকাঙ্খা। কিন্তু তাতে কী সমস্যা? সমস্যাটা হল, এতে ইসলামোফোবিক দিকটা টের পেলে মুসলমানদের মনেও প্রথম প্রতিক্রিয়াটা হয় আত্মরক্ষা। মানে, মনে আত্মরক্ষার চিন্তা আসা। যা সবচেয়ে কমন ও স্বাভাবিক! কিন্তু এই আত্মরক্ষার উপায় বা পথ হিসাবে সে এরপর যা বেছে নেয় সেটাও আরেকটা তবে অন্যভাবে বলা আমরা-তোমরা। যেটা হল আমার ধর্মটাই শ্রেষ্ঠ। যেটা পরিণতিতে এমন এক দুনিয়ার কল্পনা হিসাবে হাজির হয় যে দুনিয়াটাতে মুসলমান ছাড়া আর কেউ নাই। অর্থাৎ আত্মরক্ষার বেস্ট মানে যেন এমন এক দুনিয়ার কল্পনা করা যেখানে মুসলমান ছাড়া আর কেউ না থাকে। তাহলে এখানে সারকথাটা হল, যেকোন ফোবিয়া মাত্রই অন্যান্য অসংখ্য ফোবিয়ার জন্ম দেয়া। যেগুলো সমান মাত্রায় বিপদজনক।
ইংরাজি এথনিক [ethnic] মানে বাংলায় আমরা একেও ‘জাতি’ বলি। এছাড়াও ইংরাজিতে আরেক জাতি [race] আছে। বাংলায় একেও আমরা জাতি বলি। দুটার ফারাক হল, রেস মানে রক্ত বা জিন [gene] -গত বায়োলজিক্যাল ফারাক। এই অর্থে জাতিগত মানুষে-মানুষে ফারাক বুঝায়। যুগ যুগ ধরে নানান ধর্ম, কালচার, ভাষা, খাদ্যাভাস ইত্যাদির ভিত্তিতে জনগোষ্ঠিগত সামাজিক ফারাক হতে দেখা যায় এটাই এথনিক-জাতিগত ফারাক।এখন কোন একটা রেস অথবা এথনিক জাতি যদি “অপর” জাতির উপর ঘৃণা-বিদ্বেষে চরমে উঠায় বা ‘ফোবিক’ হয়ে যায় এটাই “হিটলারি ফেনোমেনা”। সবচেয়ে বড় কথা এক ফোবিয়া বাকি সকলের মধ্যে একই নতুন নতুন ফোবিয়ার জন্ম দেয়, ডেকে আনে। এর সবচেয়ে ভাল উদাহরণ হল, হিটলারের “ইহুদি-ফোবিক” হয়ে যাওয়া। আবার পরিণতিতে এথেকে ছোঁয়াচে ঘটনায় এবার ইহুদিদের মধ্যে জায়োনিস্ট আইডিয়ার ব্যাপক উদ্ভব ও জনপ্রিয়তা। জায়োনিজম তাই দুনিয়ার বাকি সব-জাতি [race and ethnic উভয় অর্থে] জনগোষ্ঠিকে প্রবলতম ঘৃণা-বিদ্বেষ করে থাকে, এমন চরম ফোবিক এক ফেনোমেনা হয়ে গেছে। সে নিজেকে বাদে বাকি সব-জাতি [race and ethnic উভয় অর্থে] জনগোষ্ঠি্র উপর আক্রমণ ও নির্মুলের আকাঙ্খাকে স্বাভাবিক মনে করে; অর্থাৎ যেকোন “অপর” এর উপর তাদের নুন্যতম আস্থা-বিশ্বাস নাই, সব উঠে গেছে।
কিন্তু এমন সব গাঢ় অনুমানকেও প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে বাইডেনের অবরোধের তালিকা প্রকাশ। ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে অবরোধ আরোপ’- এই ভিত্তিতে সেই তালিকা; তবে বেছে বেছে ‘কিছু দেশের’ ওপর বাইডেন প্রশাসনের অবরোধের পদক্ষেপ নিতে তাদের দেশের নাম তালিকায় রেখেছেন। বেছে বেছে কিছু দেশ বললাম এজন্য যেমন দেখেন, বাইডেন নিজের ঘোষিত নীতি ভারতের বেলায় প্রয়োগ করার মুরোদ দেখাতে পারেননি। কিভাবে সেটা?
ঘটনার শুরু গত ২০২০ সালে বাইডেন যখন প্রেসিডেন্ট প্রার্থিতা নিশ্চিত করেন। তবে এরও আগেই কিছু আমেরিকান (মুসলমান ও নন-মুসলমান) কংগ্রেস সদস্য কাশ্মিরে ভারতের মুসলমানদের ওপর নির্যাতন, নিপীড়ন আর সর্বোপরি কাশ্মিরের (ভারতের জন্ম থেকেই দেওয়া) স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা ক্ষুণ করে জবরদস্তিতে সারা কাশ্মিরই ভারতের মূল ভুখন্ডের অংশ বলে (২০১৯ আগস্টের ৫ তারিখে) মোদি সরকারের সংসদে ঘোষণা – এরপর থেকে ক্রমাগত কাশ্মিরের বাসিন্দাদের ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘন চরমে উঠেছিল বলে এসব ঘটনাকে আমলে নিয়ে এর বিরুদ্ধে মার্কিন কংগ্রেসে প্রস্তাব এনেছিল। আর প্রার্থী বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হলে এই প্রস্তাবের পক্ষে পদক্ষেপ নিবেন বলে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছিলেন। আর এটাই বাইডেন-মোদির সংঘাতের সম্পর্কের ঘটনার উৎস। আর এমন ঘোষণা মোদি সরকার ভালোভাবে নেয়নি, বিপদ দেখেছিল। এই ঘোষণা থেকেই মোদির পিছটান ও আমেরিকান সম্পর্ক ছেড়ে পালানোর উপায় বের করা শুরু হয়েছিল। তাই বাইডেন বিজয়ী হওয়ার পর থেকে মোদি সরকারের অঘোষিত টেনশন শুরু হয়ে যায়।
তবে সেই টেনশন আরো বাস্তব হয়ে উঠতে বাইডেন প্রশাসন শপথ নেয়ার পরেও ১০ মাস সময় লেগে যায়। এবার ১০ ডিসেম্বরে বাইডেন অবরোধের তালিকা প্রকাশ করেছেন। এদিকে ইতোমধ্যে মোদি সরকারের মুসলমানদের ওপর একের পর এক নির্যাতন, নিপীড়নের পাপ আর কেবল কাশ্মিরেই আটকে থাকেনি। ভারতজুড়ে সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিল। এছাড়া বাইডেনের সাথে বিবাদ বাড়ার আরও ঘটনা ছিল যা যোগ হয়েছে। কোন্ কোন্ দেশের নাগরিককে তার দেশের সরকার নিজ নিজ ধর্মপালনে বাধা দিচ্ছে বা ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে তা লক্ষ্যরাখা ও নোট নেয়ার জন্য আমেরিকায় এক রাষ্ট্রীয় স্বাধীন কমিশন [USCIRF] আছে যার কাজ হল সেসব লঙ্ঘনকারি সরকারের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য যে প্রশাসনই আমেরিকায় ক্ষমতায় থাকে তার কাছে বার্ষিক সুপারিশ রিপোর্ট পাঠিয়ে দেয়া। এবারের ২০২১ সালের এমন রিপোর্টে ভারতকে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী ক্যাটাগরির দেশ [CPC (“country of particular concern,”] হিসেবে ভারতের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেয়ার সুপারিশ পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল।
তাই মোদি সরকারের আশঙ্কা ছিল বাইডেন ট্রাম্প প্রশাসনের মত তার ফেভারেবল সরকার নয়। যে ট্রাম্প প্রশাসন এসব রিপোর্ট উপেক্ষা করে ফেলে রেখে চলেছিল। এছাড়া চলতি ডিসেম্বরের ৯-১০ তারিখ বাইডেন ‘ডেমোক্র্যাসি সামিট’ আহবান করেছিল আর এখান থেকে যে এই অবরোধের তালিকা প্রকাশ করা হবে তা আমেরিকার দিক থেকে আগেই ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। ফলে সেসব কথা ভারত জানা ছিল গত অক্টোবর মাস থেকে, বিশেষ করে নভেম্বরের শুরুতে প্রকাশ্যে সামিটের দাওয়াতপত্র বিতরণ শুরু হওয়া থেকে।
আর এখান থেকেই মোদি সরকার আমেরিকার ওপর পাল্টা চাপ সৃষ্টির কৌশল ও পদক্ষেপ নিতে জরুরী বোধ করা শুরু করেছিল। সেই পদক্ষেপ হিসাবে ভারত প্রকাশ্যেই রাশিয়ার সাথে তার ঘনিষ্ঠতা প্রকাশ করতে শুরু করে। অনেকে ধারণা করত চীন ও রাশিয়া যেহেতু আমেরিকার বিরুদ্ধে তারা এক-জোট; এই অবস্থা গত ১০ বছরের বেশি ধরে বহাল রেখেছে কাজেই এর বিপরীতে চীন-ভারত প্রকাশ্য বড় শত্রুতায় আছে বলে একে পাশ কাটিয়ে ভারত-রাশিয়া ঘনিষ্ঠতা খুব একটা কার্যকর হবে না।
আসলে ২০০১ সালে ওয়্যার অন টেরর নীতির কারণে ভারত ও আমেরিকার মধ্যে যে ঘনিষ্ঠতা শুরু হয়েছিল তাতে বলা যায় আমেরিকা ওই প্রথম রাশিয়া থেকে ভারতকে বিচ্ছিন্ন ও আলাদা করে অনেক দূরে নিয়ে চলে যায়; যার মূল টোপ বা কারণ হল, বুশের আমেরিকা ভারতকে পরমাণু-অস্ত্রবিষয়ক টেকনোলজি ও কাঁচামাল-উপাদান সরবরাহের যেসব আইনি বা কনভেনশনের বাধা (এনপিটি NPT) ছিল তা উপেক্ষা করে সহায়তার হাত বাড়িয়েছিল। স্বভাবতই এর লোভেই ভারত তার এতদিনের জিগার- যে ভারতকে রাশিয়ান অস্ত্রে সজ্জিতকারী এত পুরনো বন্ধু, সেই রাশিয়াকে উপেক্ষা করে আমেরিকার স্ট্র্যাটেজিক বন্ধু হওয়ার জন্য ছুটে গিয়েছিল।
ভারতের ‘সরকারি কালচারে’ কোনটাকে তারা ‘সুখ’ বা অর্জন বলে বুঝে এর কিছু বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি বা এটিচ্যুড-ভঙ্গিমা আছে। যেমন আমেরিকা ভারতকে গুরুত্ব দিয়ে গত প্রায় ২০ বছর চলেছে কাজেই ভারত পরাশক্তি হয়ে গেছে। এমন অর্থহীন মিথ্যা হামবড়া কংগ্রেসের প্রণব মুখার্জি করে গেছে আর এখন মোদি করে যাচ্ছেন। তবে কৌওলটা হল এটা সরকার নিজে পাবলিকলি প্রচার না করে, প্রপাগান্ডা সাংবাদিকদের দিয়ে করানো! সে উদ্দশ্যে তারা সরকারের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের সাথে কাজ করে এমন সাংবাদিকদেরকে তা বিশ্বাস করিয়েই ছেড়েছিল। এ ছাড়াও আমেরিকা যেসব ঢংয়ে ভারতকে গুরুত্ব দেয়া প্রকাশ করেছিল সেটা নিশ্চয় ভারতের জন্য খুবই সম্মানের- এই অনুমানটাই সরকারি কালচারে বর্তমান।
যেমন প্রায়ই আমরা একটা কথা শুনব যে “২+২ ডায়ালগ”। এটা তাদের অনুমান বিচারে খুব উচ্চমার্গের ব্যাপার। এমনকি রিপোর্টের শিরোনামেও এই শব্দগুলো তারা এনেছে। কেন? কারণ এটা আমেরিকা ভারতকে অফার করেছিল। তাহলে নিশ্চয় এটা দামি কিছু না হয়ে যায়ই না……!! এবং এই কালচার চালু করেছিল। অথচ ব্যপারটা স্রেফ আর কিছুই না, আমেরিকার ভারতকে অস্ত্রবিক্রি গছানোর মাত্র কায়দা একটা। সেখানে ‘২+২’ বলতে খাঁড়া মানে, দুদেশেরই পররাষ্ট্র আর প্রতিরক্ষামন্ত্রী এভাবে এখানে চারমন্ত্রীর একসাথে বসে অস্ত্র কেনাবেচার লক্ষ্যে কোন মিটিং করা। এটা এতদিন আমেরিকান স্টাইল ছিল, ভারতকে জাতে তোলার। তাই এবার পুতিনের সফরে ভারতও রাশিয়ার সাথে এক ‘২+২ ডায়ালগ’ করেছে। এর এক পরোক্ষে ‘প্রদর্শনী অর্থ’ আছে যে, আমরা আমেরিকা ছাড়াই রাশিয়ার সাথেও এমন গুরুত্বের ডায়ালগ করেছি। আর ভারত সব সময় (ভুয়া এক সুখ) অনুভব করতে চায় যে দুনিয়ার পরাশক্তিদের সাথে ভারতের ‘২+২ ডায়ালগ’ – এসব করা মানে ভারতও এতে পরাশক্তি হয়ে গেছে। এর লক্ষণ এসব!!!
এছাড়া সাথে আরেকটা মিডিয়া কাভারেজে আমরা দেখতে পাই ওই একই দ্য-প্রিন্ট [the-print] ওয়েবপত্রিকায় যেটা লিখবেন জ্যোতি মালহোত্রা। তার লেখা পড়ে পেইড লেখা মনে হবে। ‘যেমন তেমনই’ লেখাটার শিরোনাম হল Putin’s visit is a defining moment for India-Russia ties. It’s a telling message to China। আজিব ঘটনাটা হল, এটাই নাকি “চীনকে (চোখ টাটিয়ে) বলা এক মেসেজ’। মানে অন্য লেখায় নয়নীমা বসুর লেখাটা যদি বিদেশ মন্ত্রণালয় তাকে প্রভাবিত করে লেখানো লেখা বলি তাহলে মালহোত্রার লেখাটা হল একেবারে অর্ডার দিয়ে লেখানো! কিন্তু কেন এটা ‘ডিফাইনিং মোমেন্ট’ বলা হচ্ছে এর ব্যাখ্যা নেই। আর এমন তো নয় যে, রাশিয়া ভারতের সাথে কোনো ডিফাইনিং মোমেন্ট তৈরিতে যেতে চাইছিল! না; তা তো নয়। বরং ভারতই আমেরিকার সাথে তাকাতে রঙিন চশমা দিয়ে দুনিয়া দেখার সুযোগ নিচ্ছিল আর এটা ভারতকেই আটকে রেখেছিল রাশিয়ার কাছে ছুটে যাওয়া থেকে। তাহলে ডিফাইনিং মোমেন্টের নাগাল ভারত এতদিন পায়নি নিজের বোকামিতেই…।
তবে এতে যেটা হয়েছে তা হল, ভারত আমেরিকা থেকে আরো অনেক দূরে চলে গেছে যেখান থেকে ফিরে আবার আমেরিকার কাছে যাওয়াটা অনেক কঠিন হয়ে গেল। অনিশ্চিতও হয়ে গেল।
কিন্তু মোদি আমেরিকার সাথে সম্পর্ক ছেড়ে রাশিয়ার সাথে ভারতের পুরান সম্পর্কটা ফিরে জাগাতে এত সিরিয়াস কেন? প্রথমত মোদি তা করতে গেছেন নিজ সরকারের স্বার্থে নয়। বরং মোদির আসন্ন সব নির্বাচনে বিজয়ের স্বার্থে। ভারতের বিরুদ্ধে বাইডেনের মানবাধিকার লঙ্ঘন বা মুসলমান দমনের অভিযোগ বরং মোদিকে আগামি ২০২৪ সাল পর্যন্ত নির্বাচনে বেকায়দা অবস্থায় ফেলবে; এই হলো মোদির অনুমান। করোনার সেকেন্ড ওয়েভ থেকেই মোদির পাবলিক রেটিং এরপর থেকে যারপরনাই খারাপ। আর সেটাকে চাঙ্গা করতে মোদি এখন আরো বেপরোয়াভাবে মুসলমান নির্যাতন শুরু করেছেন, অন্তত ২০২৪ পর্যন্ত করে যাবেন। যেমন, ‘পাবলিক প্লেসে নামাজ পড়া যাবে না। ভোটের আগে ত্রিপুরায় মসজিদে হামলা বা কমিউনিটিতে হামলা করলে অন্য বিরোধীরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে আগিয়ে আসে নাই। এই ভয়ে যে এতে সেই বিরোধী দল হিন্দু-ভোট হারাবে”। আবার চার দিন আগে উত্তরাখণ্ডের হরিদ্বারে তথাকথিত কিছু সাধুদের দিয়ে (নাম তার খুব বাহারি – যতি নরসিংহানন্দ স্বরস্বতী) প্রকাশ্যে জনসভায় ঘোষণায় আহ্বান জানালেন মুসলমানদের হত্যা করার জন্য। অথচ কেউ মামলা করেনি, এই অজুহাতে পুলিশ চুপ করে বসে আছে। তাই কলকাতার মমতার দল তৃণমূলের এক উপস্থিত সদস্য বাদি হয়েছে। তিনি নির্বাচন কমিশনেও নালিশ দিয়েছেন। মোদির দলের মুখ কুলুপ! অর্থাৎ এগুলো হল, আগামী মাসে উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে আবার জিতে আসার জন্য মোদির একমাত্র ও শেষ উপায়।
তাই এই অবস্থায় মুসলমানের ওপর নির্যাতন বা হত্যার অভিযোগ আবার আমেরিকান মানবাধিকার লঙ্ঘনে বড় হয়ে উঠুক এটা মোদি নিতে পারবেন না। তাই আমেরিকার কাছ থেকেই ভারতের এই পলায়ন। তাতে ভারত রাষ্ট্রের স্বার্থ যাই হোক সেটা সেকেন্ডারি, পরে দেখা যাবে। মোদির মূল স্বার্থ এখন নির্বাচনে বিজয়। নির্বাচনে নিজের দলকে বাঁচানো।
তাই এই ডিসেম্বর মাসেই বাইডেনের ওপর পাল্টা চাপ তৈরি করতে মোদির ভারত এবার মরিয়া অবস্থায় রাশিয়ার পুতিনের ভারত সফর আয়োজন করেছিল। পুতিনের ভারত সফর ছিল ৬ ডিসেম্বর এবং তা কেবল পাঁচ ঘণ্টার জন্য। কিন্তু আয়োজন, আলোচনার বিষয়বস্তু প্রসঙ্গে ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের প্রপাগান্ডা ছিল শিখরে।
ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয় তাদের দেশীয় মিডিয়ায় কিভাবে হাজির থাকতে চায়, এর কিছু তরিকা দেখতে পাওয়া যায়। দা-প্রিন্টের নয়নীমা বসু বলতে চান যে, ভারত আর শুধু রাশিয়ান অস্ত্রের ক্রেতা নয়। ভারত এখন অস্ত্রবিষয়ে জয়েন্টভেঞ্চারে উৎপাদক। এমনকি অস্ত্রবিষয়ক গবেষণাতেও অংশীদার হতে যাচ্ছে।
তাহলে সারকথাটা কী?
সারকথাটা হল, অবরোধের অভিমুখটা এখন থেকে যতই দিন যাবে ভারত ততই আমেরিকা থেকে দূরে চলে যেতে থাকবে। যার একটা পর্যায়ে ভারত-আমেরিকান সম্পর্ক আর আগের জায়গায় ফেরার সব সম্ভাবনা নিঃশেষ ও লুপ্ত হয়ে যাবে। অবস্থা দ্রুতই সেদিকে যাচ্ছে। আর সেটার এখনই যে অবস্থা তাতে বাংলাদেশের উপর আমেরিকান চাপ প্রয়োগ যে হারে বাড়ছে তাতে এথেকে বাংলাদেশকে নুন্যতম রিলিফ দেওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের কোন ভুমিকা রাখার সুযোগ এখনই প্রায় নাই। ফলে আমাদের সরকারকে সহায়তা দিবার ক্ষেত্রে বাকি থাকল কিছু পুরান কমিউনিস্ট রাষ্ট্র যারা মনে করে শ্রেণী স্বার্থের নামে রাষ্ট্রের হাতে নাগরিককে হত্যা কিংবা, গুম-খুন করার সুযোগ তো থাকতেই হবে। সেই সুত্রে, রাষ্ট্র-নাগরিক সম্পর্ক সেটা আবার কী? অথবা ধরেন, নাগরিক বলে কাউকে সুরক্ষার দায় রাষ্ট্রকে নিতে হবে? কেন? এসব তারা মানে না। তাদের রাষ্ট্র ধারণায় এসবের বালাই নাই। আছে কেবল তথাকথিত শ্রেণীস্বার্থের শ্রেণীবোধ – শ্রেণীর রাষ্ট্র ধারণা ইত্যাদি। আসলে এগুলো এমন সব শত বছরেরও বেশি পুরান অর্থহীন সব কমিউনিস্ট প্রলাপ!! যা রিভিউয়ের সাহস, নিজেকে সংশোধন ও পুনর্গঠনের সক্ষমতা একালে কারও মধ্যেই নাই!
তবুও ব্যক্তিগত স্বার্থ বা আত্মরক্ষার্থে হাসিনা সরকারের অভিমুখ দিনকে দিন সেরকম ক্যাম্পের দিকেই হবে। আবার এর উল্টাটা যে, আমেরিকান বিরাট কোন স্বার্থ আছে যেমন বঙ্গোপ্সাগরে সপ্তম নৌবহর নোঙর করানোর সুযোগ মিলবে – এই লোভে সে কোন স্বৈর শাসকের বিরুদ্ধে খাড়া হয়ে যেতেও পারে। সেটা হয়ত পারে, হয়ত তা সে করবে হয়ত না। কিন্তু এসব স্বার্থে আমেরিকান কোন পদক্ষেপ নিবার ক্ষেত্রেও আমেরিকান সক্ষমতার মুরোদ নিঃশেষ হবার দিক যাচ্ছে আর সম্ভবত বাইডেনই হতে যাচ্ছেন তাতে শেষ আমেরিকান প্রেসিডেন্ট। তাও আবার যা করার তা আগামি বছরের মাঝামাঝির পরে তাও লোপ পেয়ে যাওয়ার অভিমুখে হাটছে!!! বিশেষত আমেরিকান – সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদী রাজনীতিক উত্থানের ধাক্কায় – রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ গঠন তা সামলাতে অক্ষম হয়ে যেতে পারে, এমন স্বার্থ সংঘাত বিপুল বেগে বাড়ছে!
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
এই লেখাটা দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকার ২৫ ডিসেম্বর ২০২১ ওয়েবে আর পরেরদিন প্রিন্টে “অবরোধ’ ছাড়া কোথাও আলাপ নেই” – এই শিরোনামে ছাপা হয়েছিল। ঐ ছাপা হওয়া লেখাগুলোকে আমার লেখার ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ বলা যায়। আর আমার এই নিজস্ব সাইটের লেখাটাকে সেকেন্ড ভার্সান হিসাবে এবং থিতু ভাষ্য বলে পাঠক গণ্য করতে পারেন। আসলে পরবর্তিতে ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ লেখাটাকেই এখানে আরও অনেক নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে ও নতুন শিরোনামে এখানে আজ ছাপা হল। ]