কোন দিকে কোথায় চলেছে


কোন দিকে কোথায় চলেছে

১৭ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০৫ সোমবার

https://wp.me/p1sCvy-3SI

 

চারদিকে সব কিছু যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনের কথাই ধরা যাক। দৈনিক যুগান্তরের এক শিরোনাম বলছে, “যুক্তরাষ্ট্রের অসন্তোষ, আমাদের ভুল থাকলে সংশোধনের চেষ্টা করব : পররাষ্ট্রমন্ত্রী”।  আর খবরের ভিতরে, মানে বডির শুরুতেই বলা হয়েছে, “কিছু দেশের যদি বাংলাদেশের প্রতি অসন্তোষ থাকে তবে আমরা তা দূর করব। আমাদের লক্ষ্য হলো সব দেশের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করা। কোনো কারণে কিছু দেশের আমাদের প্রতি অসন্তোষ থাকতে পারে। আমরা ওই সব কারণ খুঁজে বের করব”।

প্রথমত, এটা খুবই অসহায়ের এক বক্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর সোজা মানে হল  আপনি অসহায়, নিজের উপরই আস্থা হারায়েছেন। একটা দেশের সরকার মানে অথরিটি বা কর্তা। ক্ষমতার কর্তা। তা হলে ক্ষমতার কর্তা আর অসহায়ত্ব একসাথে? সরি, এ দু’টা একসাথে যায় না। যখনই এমনটা দেখা যায় এর মানে সরকার দুর্বল হয়ে গেছে কিংবা ক্ষমতা অর্ধেক হয়ে গেছে। এটা অকল্পনীয়; কারণ এখান থেকেই এরপর উঠবে ক্ষমতাচ্যুতির আলাপ আলোচনা।

শুধু তাই না, এর আরো অন্যদিক আছে। অন্য প্রতিদ্বন্দ্বি ও দাতা যেমন চীনও ভয় পেয়ে যাবে। সরকারের আয়ু নিয়ে সন্দেহ করবে। আর এসবের প্রথম প্রতিক্রিয়া সাধারণত হইয়ে থাকে যে সম্পর্ক মিনিমাম জায়গায় গুটিয়ে নেয়া, আর অপেক্ষা করা। কারণ বিনিয়োগ খুবই সেনসিটিভ জিনিষ। জোঁক আর নুনের সম্পর্কের মত। একবার যদি অস্থিরতার গন্ধ পায় সে সাথে সাথে নিজেকে গুটিয়ে নিবে। হাতের মুঠি বন্ধ করে দিবে। অস্থিরতা মানেই বিনিয়োগের অর্থ রিস্কের মধ্যে আটকে যাওয়া। তাই বিনিয়োগ এত সেনসেটিভ!

দ্বিতীয়ত, সরকার কার ‘অসন্তোষের’ কথা বলছে? আমল করেছে বলে জানাচ্ছে? বলেছে, “কিছু দেশের” বা “যুক্তরাষ্ট্রের অসন্তোষ”। লক্ষণীয়, এতে সরকার মানে যা সর্বময় ক্ষমতার উৎস হওয়ার কথা হলেও তার উপরে বা বাইরের এক ক্ষমতার কথা বলা হচ্ছে এখানে। এমনকি আবার যার কাছেই সরকার অসহায়ত্ব প্রকাশ করছে!

তাতে এটা পরিষ্কার সেই কথিত  “উপরের” ক্ষমতা পাওয়ারফুল এবং তা পাওয়ারফুল বলে স্বীকার করে নেয়া মোমেনের চোখেমুখে এবং কথায় তা ফুটে উঠেছে। অনেকে এটাকে রাষ্ট্রের সার্বভৌম ব্যাপারের দিক থেকে ব্যাখ্যা করা যায় কি না, সে চেষ্টা করতে পারেন। কিন্তু  সে সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করা ভুল হবে। কারণ যারা সরকারের বিরুদ্ধে  সিরিয়াস মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছে তারা সেসব কথার কোনোটাই বাংলাদেশের কোনো পাবলিক এমনকি কোনো গ্রুপ অব পাবলিকের দিকে তাক করে তুলে নাই। বরং আমেরিকা অভিযোগ করেছে সুনির্দিষ্ট কিছু সরকারি কর্তা আর  সংশ্লিষ্ট সেই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এবং গুরুত্বপূর্ণ যে, এসব অভিযোগ আবার আন্তর্জাতিক আইনে অপরাধ। তবে আমেরিকা এসব অভিযুক্ত ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এবং তাদের সংশ্লিষ্ট নিকট আত্মীয়রা যাতে আমেরিকান নেতৃত্বে থাকা গ্লোবাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ব্যবহারের সুযোগ আর না পায় এমন নিষেধাজ্ঞাই আরোপ করেছে। যেহেতু এ ব্যবস্থাটা মার্কিন ডলার-কেন্দ্রিক তাই আমেরিকার একা নিজ হাতেই কেবল এই বাড়তি সুবিধাটা আছে।

আসলে মন্ত্রী মোমেনের বক্তব্য আমেরিকার এই সক্ষমতাটাকে বৈধ বলে মেনে কথা বলা হয়ে গেছে। যেন বাইডেনের আমেরিকা বলছে, ‘বাংলাদেশ সরকার তুমি তোমার নাগরিক যারা, এমন বেশ কিছু জনগণের অংশের বিরুদ্ধে অপরাধ করেছ। যদি তুমি বাংলাদেশের পাবলিকের সরকার হয়ে থাক তবে তোমার যেখানে উচিত ছিল তাদের অধিকার রক্ষা করা। অথচ তুমি করেছ উল্টা, তাই তুমি অপরাধী’।

এখন একটা হতে পারত যে সরকার বুক ফুলিয়ে দাবি করত, প্রমাণ দিত যার সারকথা হত যে, আমি এসব অপরাধ করিনি। কিন্তু এখানে তা হয়নি। মন্ত্রী মোমেন বলেছেন, “আমাদের ভুল থাকলে সংশোধনের চেষ্টা করব”; “অসন্তুষ্ট দেশকে সন্তুষ্ট” করার চেষ্টা করব ইত্যাদি; অর্থাৎ একেবারেই সাবমিসিভ [submissive] বা অধস্তন করে ফেলেছেন তিনি নিজে-সহ পুরা বাংলাদেশকেই, এই হল তাঁর অবস্থান। এর মাধ্যমে সরকার নিজেও আর ‘বাইরের’ ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করছে না। আর তাতে শুধু সে অধস্তনই নয়, নিজেকে অনুগ্রহ লাভের প্রার্থী হিসেবে হাজির করেছে। আর এখান থেকেই, আমাদের সরকার নিজ জনগণের আর কোনো প্রতিনিধিই নয়, দায়িত্বপ্রাপ্ত জনঅধিকার সুরক্ষাকারীও কেউ নয়; নুন্যতম প্রতিনিধিত্বও করছে না আমাদের কেউ না – এমন হয়ে গেছে।

বরং সরকার ব্যস্ত হয়ে গেছে কেবল নিজেকে (সরকারকে) রক্ষা এবং কেবল ওই সব সরকারি কর্তাকে কী করে রক্ষা করবে, সেই কাজে। আর এ’কাজে বাংলাদেশের সরকার নিজেই আমেরিকান সরকার-প্রশাসনের অনুগ্রহ-প্রার্থী হয়ে গেছে। অর্থাৎ এখানে প্রধান লক্ষণীয় হল, যারা সরকারের চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত নাগরিক, যারা গুম হয়েছেন, যাদের ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হয়েছে ইত্যাদি, এরা কিন্তু এখানে কোনো প্রসঙ্গই নয়। করা হয় নাই। প্রসঙ্গটা হল, সরকার টিকানো এবং সরকার, সরকারি কর্তা ও অফিসের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা কিভাবে প্রত্যাহার করে নেয়া যায়। যেন মামলাটা হল – বাংলাদেশের পাবলিক নয়, সরকারের নিজ স্বার্থ আর আমেরিকার প্রশাসনের মধ্যকার! মোমেনের বক্তব্য প্রকারান্তরে ইস্যুটাকে সেখানে নিয়ে গেছে।  যার সারার্থ হল, সরকার বলতে এখানে কিছুই নাই…। কেবল গুটি কয়েক ব্যক্তিস্বার্থবাজ লোক তারা সরকার বলে ভান করছে।

সাধারণত কোনো নুন্যতম সৎ-ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নিয়ম হল, তার বিরুদ্ধে কোনো বড় অভিযোগ উঠলে একটা কোন স্বাধীন নিরপেক্ষ আইনি কমিশন গঠন করে তাদেরকে দিয়ে তদন্ত করা এবং সত্য উদঘাটন (ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং) করা। কিন্তু এখানে কী চলছে? পুরা উল্টা। বলা হচ্ছে, কেউ মার্কিন সরকারকে “ভুল বুঝিয়েছে” কি না। যদিও মার্কিন  নিষেধাজ্ঞা আরোপের উৎস প্রথমে আমেরিকান সংসদ ও সিনেট কমিটি আর সেখান  থেকে পরে প্রেসিডেন্ট, এভাবে। তার মানে এখানে বাংলাদেশে  কোনো ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং হচ্ছে না, বসছে না এবং  হবে না। ভিকটিম বা ক্ষতিগ্রস্ত নাগরিকরাও এখান থেকে নুন্যতম কিছু প্রতিকারও পাবে না।

দুই দিন আগে বিবিসি একটা রিপোর্ট করেছে, শিরোনাম “মার্কিন নিষেধাজ্ঞা : বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা বিধিনিষেধ প্রত্যাহারে কী তৎপরতা চালাচ্ছে?”। এতে বাংলাদেশ সরকারের সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক বলছেন, “নিশ্চয়ই আমেরিকা সরকারকে কনভিন্স করা হয়েছে। কাজেই যে তথ্যের ভিত্তিতে দিয়েছে, সেই তথ্য যতটুকু আছে সেটি কতটুকু সত্য কতটুকু মিথ্যা বা সঠিক কী সঠিক নয়- এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে একটা বক্তব্য যাবে”।……। “এ ছাড়া আমেরিকাতে লবিস্ট নিয়োগের একটি কালচার আছে, সেই লবিস্ট নিয়োগ করে আমেরিকান সরকারকে বোঝাতে হবে। আর ব্যক্তিদের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা সেটি প্রত্যাহার চেয়ে আমেরিকা সরকারের কাছে আপিল করতে হবে”।  অর্থাৎ তিনিও কোন ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিশন  নয়,  বাইডেন প্রশাসনের সাথে এক’টা ‘ডিল’ করার কথাই বলছেন; অর্থাৎ লক্ষণীয় মুখ্য পয়েন্ট ইন্ডিপেনডেন্ট ফ্যাক্টস যাচাই নয়, একটা লেনদেন বা ‘ডিল’ হয়ে উঠেছে সরকারের প্রধান বিবেচ্য ও করণীয়!

এর আগে ডয়েচ ভেলেতে ছাপা হওয়া ‘আসক’ [আইন সালিসি কেন্দ্র]-এর দেয়া সংগৃহিত পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে তারা লিখেছিল,” আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কথিত ক্রসফায়ারে ২০১৬ সালে মোট ১৭৭ জন নিহত হয়েছেন। ২০১৭ সালে এ সংখ্যা কমে ১৪১ জনে নেমে আসে। এর পর থেকে গতি আবার বাড়তে শুরু করে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন ও মাদকবিরোধী অভিযান ক্রসফায়ারের নতুন প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল। পরের বছর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত ৪২১ জন, যা আগের বছরের চেয়ে তিনগুণ বেশি। ২০১৯ সালেও এই ধারা অব্যাহত ছিল, ৩৬১ জনের বেশি”। নির্বাচনের আগেই এনিয়ে আপত্তি প্রতিরোধ হৈচৈ -গুলোকে দাবিয়ে দেওয়ার জন্য এটা করা হয়েছিল।
সেই ধারাবাহিকতা বজায় ছিল। এখান থেকে অনুমান করলে বের হয়ে আসে যে, সরকার ক্রমেই এমন ‘হত্যা-নির্ভরশীল’ একটা সরকার হয়ে গেছে। সাধারণত যেটা দেখা যায়, একটা ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করে ফেলতে পারলে সেটা সরকারের জন্য খুব কাজের হয়। কোনো সরকার একবার এতে সফল হয়ে গেলে পরে দেখা যায় এর পর থেকে সে বিরোধিতাহীন বা বাধাহীন এক সরকার হয়ে উঠতে পারে।

তা হলে এ তথ্যাবলি আরেকটা ইঙ্গিত দেয় যে, ধরা যাক আমরা একটা উপরে কথিত মতে ‘ডিল’ যদি দেখতে পাইও এছাড়া সেই ডিল উপস্থিত সরকারকে ক্ষমতায় রেখেই যদি করতেই হয়, তবে সেই সাথে এসব ক্রসফায়ার বা গুম প্রভৃতিতে মাসে মাসে কমপক্ষে ৩৫-৪০ জনকেও “বলি” দিতে রাজি থাকতে হবেই। কারণ প্রশাসন ভয়ের সংস্কৃতি বা হত্যা-নির্ভরশীল হয়ে গেছে! এই ক্ষিধাও পূরণ করতেই হবে। নইলে সরকার টিকবে না। মানুষে মানবে না। এই প্রসঙ্গে বিবিসিকে লিখেছে, “মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নকেও গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এ বাস্তবতায় র‌্যাবের কার্যক্রমে একটা সংস্কারের সুযোগ আছে বলেও মনে করেন সাবেক আইজিপি শহীদুল হক”।…..”সংস্কার করতে হলে বেপরোয়াভাবে যেন কিছু না হয়। সব কিছু কন্ট্রোলের মধ্যে রাখতে হবে”। …… তিনি বলেন, “আপনি গুলি করবেন এনকাউন্টার, আপনি বিপদে পড়েছেন, দুষ্কৃতকারীরা আপনাকে হামলা করছে সে ক্ষেত্রে ব্রাশফায়ার করে মানুষ মারতে থাকলে তো হবে না। আপনাকে বাঁচানোর জন্য যতটুকু করার দরকার অতটুকুই করতে হবে। এ সংস্কারটা আনতে হবে”।  তার মানে তামাশাটা হল, সাবেক এই আইজিপিও এখন একটু কম হত্যার এক সংস্কারের কথা বলছেন; অথচ তার নিজের আইজি কার্যকালে (২০১৫ সালের শুরু থেকে ২০১৮ সালের জানুয়ারি) গুম ও ক্রসফায়ারের কিছু পরিসংখ্যান উপরে দেখেছি।

মাছ খাবো নাঃ
বিড়াল কি মাছ খাবো না বলতে পারে? মানে যেটা স্বভাব হয়ে গেছে বা যাতে অভ্যস্ত হয়ে যায় তা কি সে ছাড়তে পারে? তাই সাবেক আইজিপির কথিত সংস্কারটাও যদি করে নেয়া হয় তবুও উপস্থিত সরকারকে তিনিও ক্ষমতায় রাখতে পারবে না। কারণ, এরা হত্যা-নির্ভরশীল সরকার হয়ে গেছে। সেটার কী হবে???

তা সত্ত্বেও এমনকি ধরা যাক, কোনো ডিল হয়ে গেল। বিবিসির ঐ রিপোর্টে এক ইন্ডিয়ান-অরিজিন আমেরিকান পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষক প্রশান্ত পরমেশ্বরণের কথা এনেছে। তিনি বলছেন, “যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে যেহেতু কিছু সুনির্দিষ্ট আচরণকে (তিনি বলতে চাইছেন র‍্যাবের গুম-হত্যা ক্রসফায়ার) তুলে ধরা হয়েছে, তার (এই সমস্যার) সংশোধন বা সমাধানের কথা বলেছে”। কিন্তু তিনিও একটা ডিল বা রফা করার ইঙ্গিত করেছেন। বলেছেন, “বহুমুখী পন্থায় কাজ’ করতে। ‘সুনির্দিষ্ট আচরণ’ যেগুলো নিয়ে অভিযোগ তোলা হয়েছে, ‘তার সংশোধন বা সমাধান করে’ নিতে বলেছেন আগে। অথচ আমরা উপরে দেখেছি সরকার হত্যা-গুম জাতীয় কাজে অভ্যস্ত বা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে, যা ছাড়া সরকার চালানো বা টিকানো অসম্ভব। এ ছাড়াও এমনকি আরেক মারাত্মক ইঙ্গিতে তিনি এনে বলেছেন, “এশীয় প্রশান্ত অঞ্চলে বাইডেন প্রশাসনের পররাষ্ট্র নীতির অগ্রাধিকার কী- সেখানে বাংলাদেশকে ভূমিকা রাখতে হবে। বিশেষ করে চীনের ব্যাপারে”

বাইডেন প্রশাসনের পররাষ্ট্র নীতির অগ্রাধিকার কী- এটুক বলে তিনি ফারদার কিছু খোলসা করেননি। কিন্তু আমেরিকা চাইছে কী?
এনিয়ে যতটুকু জানা যাচ্ছে যেমন, কক্সবাজারে এয়ারপোর্ট রানওয়ে প্রকল্প যেটাকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক যাত্রী ও কার্গো বিমানের ব্যবহার-উপযোগী করে গড়ে তোলার একটা প্রকল্প। বলা হয়েছে, এটাকে আন্তর্জাতিক বিমান চলাচলের রুটে একটা হাব [hub] ও রিফুয়েলিং স্টেশন হিসেবে গড়ে তোলা হবে। এতদূর পর্যন্ত এটাকে বাণিজ্যিক দিক থেকে এক উপস্থাপনই হল। বিবিসি বাংলাতেও গত ২৮ আগস্ট ২০২১ এক প্রতিবেদনে এটাকে বাণিজ্যিকভাবেই দেখানো উপস্থাপন করা হয়েছে।

কিন্তু এখন দুর্জনরা বলছে, এই প্রকল্প চীনকে দেয়া হয়েছে এক স্ট্র্যাটেজিক (যুদ্ধকৌশলগত) কারণে। আর মালদ্বীপে চীনের যে জাহাজ চলাচলের অবজারভেটরি স্থাপনা আছে তার সাথে এটাকে সম্পর্কিত করে দেখতে হবে। অন্য দিকে এসবেরই পাল্টা বহুদিনের আমেরিকান এক আবদার হল, বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে তার সপ্তম নৌবহরকে স্থায়ী নোঙর করতে দিতে হবে। এটা ঘটার বিরুদ্ধে চীনের চেয়েও ভারত এই প্রশ্নে বেশি চরম কঠোর আমেরিকাবিরোধী।
অথচ আমেরিকার এই খায়েশকেই সম্ভবত বিশ্লেষক প্রশান্ত পরমেশ্বরণ আমেরিকার ‘পররাষ্ট্রনীতির অগ্রাধিকার কী- সেখানে বাংলাদেশকে ভূমিকা রাখতে হবে’ বলে অস্পষ্ট রেখে ছেড়ে রেখে দিয়েছেন! এসব ইঙ্গিত খুবই খারাপ ও বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর! কারণ এর অর্থ হবে সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির প্রশ্নটা শেষে না পিছলে গিয়ে তা আমাদের ভূখণ্ডকে যুদ্ধক্ষেত্র বানিয়ে আমেরিকা-চীন ও ভারত তাদের নিজ নিজ স্বার্থের লড়াই শুরু করে দেয়!

অথচ বাংলাদেশের নিজস্ব স্বার্থ হল, যে অবস্থানে এলে এই তিন দেশকে নিউট্রাল রাখা যায়; কারণ আমরা কারো যুদ্ধের পাটাতন হতে পারি না।

কিন্তু সমীকরণ যে দিকেই মিলাই আমাদের হত্যা-নির্ভরশীল উপস্থিত সরকার মনে হচ্ছে না কাউকে সাহায্য করতে পারবে; অর্থাৎ তার নিজের টিকে থাকা – এই স্বার্থ, এটাই চতুর্থ ও মুখ্য স্বার্থ হিসেবে সবার উপরে হাজির হয়ে থাকতে চাইছে। অথচ বাস্তবতা হল, হত্যা-নির্ভরশীল সরকার-প্রশাসন সাবেক আইজির কথিত নামকাওয়াস্তে কোনো সংস্কার করতেও অক্ষমই থেকে যাবে।

উভয় সঙ্কটঃ
বর্তমান সরকার আসলে মারাত্মক উভয় সঙ্কটে। এখনকার উভয় সঙ্কট হল, যেকোন সরকার নিজের বিরোধী দলদেরকে তাদের জনসমাবেশের অধিকার দিতে বাধ্য। কিন্তু আমাদের সরকারের অবস্থা এমন যে  যদি সরকারবিরোধীরা মিছিল সমাবেশ করতে চায় তাতেই সে কাত! সে ভীত যে, এটা না  সরকারবিরোধী গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। কারণ জমে থাকা পাবলিকের ক্ষোভ তাতে উপলক্ষ করে প্রকাশ্যে বের হয়ে যদি আসে! এ অবস্থায় সে যদি তাদের মিছিল-মিটিংয়ের অধিকার মেনে নেয় তো তাকে নিজ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনার মধ্যে বাস করতে হবে। আর যদি উল্টা নির্বিচারে আগের মত গুম-খুন ক্রসফায়ারে তা দমন করে চালাতে যায় তবে সেটা আরও বড় মার্কিন অবরোধের কারণ হতে পারে। আর এর আগেই বাংলাদেশ হয়ে উঠতে পারে এক রক্তাক্ত রণভূমি!

পরিণতিতে কী হচ্ছে?
সেটাই কি কাওয়ালি অনুষ্ঠানেও হামলা? সরকার দলীয় হামলা করে চলা অবস্থায় আয়োজন কাওয়ালীর অনুষ্ঠান ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। অথচ  সরকার এখনো কার্ড দেখাতে পারেনি, প্রকাশ্যে বলতে পারে নাই যে, তারা এ হামলার পক্ষে না বিপক্ষে? এসব খারাপ লক্ষণ। তাতে সরকারের লাভ না ক্ষতি হয়েছে। অথচ বাস্তবতা হল, সরকারবিরোধীরা সবাই জোটবদ্ধ হয়ে কাওয়ালির পক্ষে দাঁড়িয়ে গেছে। প্রথম আলো-স্টার থেকে ছোটবড় বা কড়া ইসলামিস্ট সবাই একত্রে মিলে গেছে। অথচ এমন না যে, কাওয়ালি নিয়ে তাদের আপত্তি নেই; বরং অনেকেরই বড় বড় কঠিনতম আপত্তি আছে। সেকুলার-প্রগতি অথবা ইসলামিস্ট সবারই নিজ নিজ স্টাইলে-ব্যাখ্যায় আপত্তি আছে।  অথচ ক্ষমতার তাণ্ডবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও ঐক্য দেখাতে তারা সেসব আপত্তি মাটি চাপা দিয়েছে। সরকারের বিরুদ্ধে তারা একত্র, এই ব্রডবেজ ইউনিটি শোকরেছে তারা; এই  বিরোধীতায়  তারা জোটবদ্ধতা শো করতে চায়। অবশ্য এমনটাই হয়ে থাকে। কমন এনিমি এই বড় শত্রুবিরোধী বিরূদ্ধতা-জ্ঞান সবসময় এভাবেই কাজ করে থাকে!

আবার হামলাকারী যারা সঞ্জিত-সাদ্দাম গং, এদের পক্ষে কথিত প্রগতিশীলতার নামে হিন্দুত্ববাদের কোনো হাইকমিশন এর পক্ষে কি?  তা হলে আমরা এরই প্রকাশ্যে অবস্থান এখানে আমরা দেখে ফেললাম? নেত্রী কি এটাই চেয়েছেন? তা এখনো স্পষ্ট করা যায়নি! মানে সরকার কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না!!! আবার ঘটনার তিন দিন পার হয়ে গেল কোনো অবস্থান না দেখানো সত্ত্বেও, তাহলে পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই, অন্যরা যা খুশি করছে ভাঙছে, তা কি? সরকার কি তা হলে কর্তৃত্ব হারিয়েছে, এমন অনেক কথা উঠছে। সরকার কিছুই না বললে এমন উলটাপালটা গুজব কানাঘুষা অর্থই তো হবে!!! এবং এটা সামনে আরো বাড়বেই!

এমনিতেই মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর থেকে সরকার, অনেকখানি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃত্ব হারিয়ে ফেলেছে। যা খুব খারাপ ইঙ্গিত! এর উপর আবার দলের ভেতরে ততোধিক যেন উপধারা বা উপস্বার্থের আবির্ভাব ঘটেছে। বেশির ভাগ নেতা কমপক্ষের দুটো স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করছেন, ঘুরছেন। মুখে বলছেন একটা করছেন আরেকটা। এর মধ্যে আবার ‘আপার’ অবস্থান কোনটা  বুঝা যাচ্ছে না। এরই “আদর্শ প্রকাশ” স্থল হচ্ছে এখন নারায়ণগঞ্জের সিটি নির্বাচনে। কে যে কার পক্ষে কাজ করছেন, তাল পাওয়া যাচ্ছে না। নারায়ণগঞ্জের পুলিশ রাতে ছাত্রলীগের নেতাদের বাসায় গিয়ে হুমকি দিচ্ছে কেন? নানক শামীম ওসমানকে হুমকি দিয়ে কথা বলছে কেন ……। যেন এক পথ হারানো পরিস্থিতি!!

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

 

এই লেখাটা  দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকার  ১৫ জানুয়ারি  ২০২২ ওয়েবে আর পরেরদিন  প্রিন্টে  “দণ্ড কার হাতে, কোথায় চলেছি”  – এই শিরোনামে  ছাপা হয়েছিল।   ঐ ছাপা হওয়া লেখাগুলোকে আমার লেখার ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ বলা যায়।  আর আমার এই নিজস্ব সাইটের লেখাটাকে সেকেন্ড ভার্সান হিসাবে এবং  থিতু ভাষ্য বলে পাঠক গণ্য করতে পারেন।  আসলে পরবর্তিতে ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ লেখাটাকেই এখানে আরও অনেক নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে ও নতুন শিরোনামে এখানে আজ ছাপা হল। ]

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s