দুবাইয়ে শুক্রবার আর সাপ্তাহিক ছুটির দিন নয় কেন
গৌতম দাস
প্রকাশ: ২০ জানুয়ারি ২০২২, ১৭:৩৫
UAE is adopting a 4.5-day workweek
পারস্পেকটিভ [Perspective] শব্দটা ইংরেজি, যার বাংলা পরিপ্রেক্ষিত বা দৃষ্টিকোণ; তবে সহজ বাংলা হল, ‘কোথায় বসে দেখছেন’। মানে একটি ঘটনা কোথায় বসে দেখছেন, তাতে ঘটনার অর্থ-তাৎপর্য ভিন্ন হয়ে যেতে পারে। সেটাই ঘটেছে দুবাইয়ে সাপ্তাহিক ছুটির দিন বদলকে কেন্দ্র করে। দুবাই সরকার সিদ্ধান্তটা নিয়েছে মূলত গ্লোবাল বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসাবে ঐ জগতেব নিজের উল্লেখযোগ্য অবস্থান ধরে রাখতে। অথচ দেশি-বিদেশি মিডিয়া গ্লোবাল পারস্পেকটিভটা বুঝতে না পেরে সেদিক থেকেই নয়, বরং দুবাইয়ের কেবল (নীল কলার) ওয়ার্কিং ক্লাস বা (সাদা কলার) চাকুরিজীবীদের দিক থেকে ব্যাপারটাকে দেখে রিপোর্ট লিখেছে।
বলা যায় এটা এক নতুন ঘটনা ঘটেছে দুবাইয়ে। গত ৭ জানুয়ারি ছিল এ বছরের প্রথম শুক্রবার। আর ইউনাইটেড আরব আমিরাত (UAE) যেটা আসলে সাত আমিরী ভূখণ্ডের এক জোট বা ফেডারেশনের নাম এবং যার রাজধানী আবুধাবি। আর এভাবে দুবাইও ঐ সাত আমিরী (আমিরাত) ভূখণ্ড-এর একটা। আমরা UAE বলতে অনেক সময় দুবাইকেই বুঝি কারণ আমরা এই দুবাইকেই বেশি চিনি। এর পিছনের কারণ, তেল বেচা অর্থ আপনি এরপর ব্যাংকে লগ্নি করে বসে সেই লাভালাভ দিয়ে শুয়ে-বসে অর্থ উড়িয়ে কাটিয়ে দিতে পারেন। আর আরেক পথ হল, ব্যবসা-উতপাদনে সেই অর্থ বিনিয়োগ করেন। দুবাই-ই একমাত্র দেশ যে বিনিয়োগ, বাণিজ্য ও উতপাদনে গিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের সবার চেয়ে বেশি ও সবার চেয়ে আগে। যাকে পিছন থেকে একালে ধরে ফেলার প্রতিযোগিতায় আছে প্রথমে কাতার, পরে অন্যেরা। সৌদি-আরব এব্যাপারে সবচেয়ে পিছনে থাকা। কিন্তু তেলের বিকল্প ইলেক্টিক ভেহিকল নবা গাড়ি দরজায় কড়া নাড়ছে, আর পরিবেশ বা দুনিয়া গরম হয়ে যাচ্ছে, বরফ গলে যাচ্ছে এসব তথ্যও এতদিনের ‘মাটির নিচের তেল পুরিয়ে চলা’ সভ্যতার (অর্থনীতি) দিনের ইতি টানতে চাইছে। যার মানে মাটির নিচে তেল থাকুক আর না থাকুক তেল বেচাবিক্রি করলে উলটা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এমন দিনের দিকে আমরা আগাচ্ছি। এটা টের পেয়েই সৌদি যা কিছু উথাল-পাতাল বদল দেখছি আমরা। গত দশকে বলা হয়েছিল ২০৩০ সালের মধ্যে সৌদি যুবরাজ দেশের অর্থনীতিক ভিত্তি তেলবেচা থেকে বদল করে বাণিজ্য-শিল্পের দিকে নিবেন। এককথায়, মধ্যপ্রাচ্যেও এক ব্যাপক বদল আসন্ন। পুরানা অর্থনীতিক ভিত্তি এতে বদলে যাবে। এর ফলে আমাদের স্বার্থ যেখানে যুক্ত প্রবাসীদের কাজ পাওয়া তা আরো কমবে না বাড়ারই সম্ভাবনা। তবে এবার দক্ষ-শ্রমিকের চাহিদা বাড়বে।
এই ইউএই [UAE] (একে এরপর থেকে সংক্ষেপে আমিরাত বলব)-তেই গত শুক্রবার থেকে সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার-শনিবার থেকে সরিয়ে শনি-রবিবার করা হয়েছে। অর্থাৎ দুবাইয়ে শুক্রবার এখন থেকে কাজের দিন। ছুটির দিন নয়। যেটা একে মধ্যপ্রাচ্যের বাদশা-আমিরদের দেশ এবং মুসলমান অধ্যুসিত দেশ।
এ নিয়ে দুবাইয়ে পাওয়া যায় এমন সাতটা পত্রিকা ঘেটে দেখার পর জানা গেল আসল কারণ। যদিও সবক্ষেত্রেই নিউজগুলোর উৎস ছিল পশ্চিমা নিউজ এজেন্সি, এক্ষেত্রে তা এএফপি [AFP] অথবা এপি [AP]। তবে সেসব ছাপা হয়েছে পশ্চিমা দেশেরই অথবা মধ্যপ্রাচ্যে বা পাকিস্তানের পত্রিকায়। যার মধ্যে আবার এনিয়ে কেবল নেগেটিভ পাবলিক প্রতিক্রিয়াকে হাইলাইট করে নিউজ করা হয়েছে পশ্চিমা পত্রিকায়। যেগুলো আসলে মানুষ যেমন বলে যে “আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম”, সে ধরনের। যেমন শুক্রবার সকালে অফিস যাওয়াকে কেন্দ্র করে কারও এক টুইট মন্তব্য ছিল, “এটা খুব খারাপ হচ্ছে মনে হচ্ছিল” [‘It just feels so wrong’]। মানে বলতে চাচ্ছেন, ‘বারবার কেবল মনে হচ্ছে এটা ঠিক না’। আর এই কথা কয়টাকেই গার্ডিয়ান ও স্কাই নিউজ যারা দুটাই লন্ডন থেকে প্রকাশিত তারা এই কথাগুলোকেই শিরোনামে নিয়ে এসেছে। এরা বাদে বাকি সবাই আসলে মূলত ঘটনাকে নিয়ে নানান ফ্যাক্টসগুলোকেই শিরোনাম করেছে।
তবে একটু ব্যতিক্রম পাকিস্তানের “দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন” পত্রিকা। এই ট্রিবিউনই আসলে মুখ্য কিছু ফ্যাক্টসকে সামনে এনে তাদের রিপোর্ট করেছে। আমিরাত বা দুবাই মুসলমান মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম লিডার দেশ; অন্তত পশ্চিমা দেশের সঙ্গে বিজনেস কানেকশনে ব্যপ্তির দিক থেকে যে বাকি মধ্যপ্রাচ্য সবদেশের সবার চেয়ে এগিয়ে। শুধু তাই না আসলে, মূলত ভৌগলিক অবস্থান ও (তেলবেচা অর্থ) বিনিয়োগ সক্ষমতার কারণে দুবাই এখন আসলে বাণিজ্যিক দিক দিয়ে আফ্রিকা মহাদেশের প্রবেশদার। মানে আফ্রিকার কোন দেশে কোন কিছু বেচতে বা কিনতে মানে বাণিজ্যিক লিঙ্ক পেতে চাইলে দুবাইয়ের মাধ্যমে করা সবচেয়ে সহজ ও তা সেখানেই “ভাল সাজানো আছে” েমন দেশবলা যায়। অর্থাৎ সবারই অন্তত লিয়াজোঁ বা লিঙ্ক অফিস আছে সেখানে। সেজন্য আফ্রিকার সব্দেশ আর সাথে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো মিলিয়ে মোট দেশ হয় প্রায় ৬৫টি। এই ৬৫ দেশে যে কোনো বাইরের পণ্য প্রবেশের ডিস্টিবিউশন সেন্টার (আমাদের ভাষায় পাইকারি চকবাজার) হল দুবাই। এছাড়াও আরেকটি বিশাল দিক আছে। আমেরিকার ওয়াল স্ট্রিটে দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বড় ও প্রথম গ্লোবাল বিনিয়োগ বা পুঁজি-বাজার। আর এর বাইরে আরও দুটা দেশে একালে গ্লোবাল ‘পুঁজি-বাজার’ বা বড় বিনিয়োগ তৎপরতার কেন্দ্র তৈরি হয়েছে। এমন একটা দেশ হল সিঙ্গাপুর। দ্বিতীয়টা দুবাইয়ে।
কিন্তু এসব দিকগুলোকে উপেক্ষায় ফেলে ছাড়িয়ে আমিরাত বা দুবাইয়ের মুসলমান পরিচয়টি সামনে এনে দেখার কারণে শুক্রবারকে কাজের দিন বানানোটাই যেন এখানে মুখ্য বলে চালিয়ে দেবার চেষ্টা হয়েছে মিডিয়া রিপোর্টে। ফলে এ নিয়ে প্রকাশ্যে বা প্রচ্ছন্ন হাসি-ঠাট্টা টিটকারি বেশিরভাগ মিডিয়ার খবরের পারস্পেকটিভ করা হয়েছে। অথচ ট্রিবিউন যে ফ্যাক্টস বলছে তা হল, দুবাইয়ে মূলত সাপ্তাহিক কাজের ঘন্টা কমানো হয়েছে। অর্থাৎ দুবাইয়ে সপ্তাহে আগে মোট কাজের দিন ছিল পাঁচ দিন। এখন সেটা সপ্তাহে সাড়ে চার দিন করা হয়েছে। আর এতে তবে শুক্রবার এখন কাজের দিন হলেও তা আসলে হাফ দিন মানে কেবল দুপুর ১২টা পর্যন্ত অফিস। আর সাপ্তাহিক ছুটি এখন শনি-রবিবার। এছাড়া সঙ্গে সরকার থেকে এই পরিবর্তনের কারণ ব্যাখ্যা করে এক স্টেটমেন্টও দেওয়া হয়েছে।
A government statement said the move would “ensure smooth financial, trade and economic transactions with countries that follow a Saturday-Sunday weekend, facilitating stronger international business links and opportunities for thousands of UAE-based and multinational companies.”
তাতে বলা হয়েছে, ‘উইক অ্যান্ড হিসাবে যেসব দেশ শনি-রবিতে অভ্যস্ত সেসব দেশের সঙ্গে ফাইন্যান্সিয়াল, ট্রেড ও ইকোনমিক লেনদেনের বাধা ও অসুবিধাগুলোকে সহজ করতে এটা করা হয়েছে। যাতে হাজারো দুবাইভিত্তিক বা বহুজাতিক কোম্পানির আন্তর্জাতিক বিজনেস লিঙ্ক ও এর সুবিধাদি শক্তিশালী ও সহজতর করা যায়।’
শুক্রবার ওয়ার্কিং ডে ছিল না আগে, তখন কী অসুবিধা হতঃ
আসলে শুক্রবার ওয়ার্কিং ডে না হলে আগে কী অসুবিধা হত? তাতে সেসময় শুক্র-শনি-রবি এই টানা তিন দিন কোম্পানিগুলোর আন্তর্জাতিক তথ্য দেয়ানেয়ার কমিউনিকেশন আদান-প্রদান বা ব্যাংক লেনদেন একেবারেই বন্ধ থাকত। আর এখন অন্তত মাঝের হাফ দিন (শুক্রবারেও) তা চালু থাকবে। আর এটুকু পেতেই সাপ্তাহিক কাজের ঘণ্টা বাকি (শুত্রবারের) আর্ধেক দিন কমিয়ে দেয়া হয়েছে। সেজন্য সরকার এটাকে বলছে, মানুষের “কাজ ও জীবনের মধ্যে ব্যালেন্স” আনার চেষ্টা। অর্থাৎ যথেষ্ট ভাল্ভাবে সরকার সাফাই যুক্তি পেশ করেছে।
গত প্রায় ৭৫ বছরের গ্লোবাল সমাজঃ
গত প্রায় পঁচাত্তর বছরে দুনিয়ার জীবনযাত্রায় ব্যাপক ও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে। এর একটি হল নিজ নিজ দেশে অন্যের কলোনি বা বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা আর নয়। এতে বিচ্ছিন্ন থাকা মানে যেমন, তখন ভারত-শ্রীলঙ্কা কোন সম্পর্ক ছিল না। মানে কী? মানে দুটা দেশই বৃটীশ কলোনি দখলের অধীনে ছিল। ফলে ভারত-শ্রীলঙ্কা বলে কোন সম্পর্ক থাকলেও সেটা আসলে হয় বৃটিশ কলোনি শাসকের সম্পর্ক। দুই ভারতীয় বা শ্রীলঙ্কান বাসিন্দার সম্পর্ক নয়। ফলে আমরা বিচ্ছিন্নই ছিলাম, থাকতাম। ফলে ভারত-শ্রীলঙ্কার মধ্যে কোন পণ্য দেয়ানেয়ার বাণিজ্য সম্পর্ক ছিলই না। মূল্কথা আমরা কেউই নিজ নিজদেশের কর্তা-মালিক ছিলামই না। এভাবে শুধু ভারত-শ্রীলঙ্কাই নয় বরং যেকোন দুই কলোনি হয়ে থাকা দেশের অবস্থা ছিল। কলোনিদখল কালের সম্পর্ককে এভাবে যত সম্ভব খুলে বুঝতে হবে।
আর এই কলোনি দখল সম্পর্কেরই আনুষ্ঠানিক ও আইনগত সমাপ্তি টানা হয়ে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯৪৫ সালের পর থেকে। সর্বপ্রথম এশিয়ার দেশগুলো পরে আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার সবাই কলোনিমুক্ত দেশ হয়ে যায়। পশ্চাশের দশকের মধ্যে সারা এশিয়ায়, ষাটের দশকের মধ্যে আফ্রিকায় এভাবে বেশির ভাগ দেশ স্বাধীন কলোনিমুক্ত দেশ হয়ে যায়। পরে সত্তরের দশকে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া লাওস ইত্যাদি এশিয়ার বাকি দেশগুলো এভাবে সর্বশেষ কলোনিমুক্ত দেশ বলা হয় সাউথ আফ্রিকা, ১৯৯৪ সালে। আর তাতে ইতোমধ্যে এসব বদলের কারণে, বরং নিজ স্বাধীন দেশে থাকা আর প্রতিটা দেশের সাথেই অপর দেশের পণ্যবিনিময় সম্পর্ক করা সম্ভব হয়। এর ফলে গ্লোবাল কানেকটেড জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে বসবাস আজ আমাদের জন্য উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। এই বিচারে ১৯৪৫ সাল প্রথম কলোনিমুক্ত দেশ ও জীবন এবং সঙ্গে একটি গ্লোবাল পলিটিক্যাল সিস্টেম এবং অর্থনৈতিক মুদ্রা বিনিময় সিস্টেমের মধ্যে আমাদের বসবাসের শুরু হয়েছিল।
আশির দশকের গ্লোবালাইজেশনঃ
দ্বিতীয় মোড় ঘোরার ঘটনাটা ছিল ১৯৮০ এর দশকের শুরু থেকেই চালু হওয়া গ্লোবালাইজেশন। যার নেগেটিভ দিকটি অনেকে প্রধান করে দেখে থাকে। যদিও এর তাতপর্যময় দিকটা হল এটা ছিল কার্যত অর্থনৈতিক জাতিবাদ ভেঙ্গে দেয়া। যদিও এমন ভেঙ্গে দেয়া এর লক্ষ্য ছিল না। লক্ষ্য ছিল পশ্চিমের হাতে জমে যাওয়া বিপুল উদ্বৃত্ব সঞ্চয়কে বিনিয়োগে নিয়ে আসা। অর্থাৎ প্রত্যেকটা সদ্যস্বাধীন ছোট দেশ কেবল নিজ দেশেই যা যা সম্ভব, তা নানান সীমাবদ্ধতায় উৎপাদন করে আর তা নিজেই ভোগ করে, এই জাতিবাদি ব্যবস্থার বিপরীতে নানান দেশের উৎপাদনগুলোকে আবার নানা দেশে ভোগ-বিতরণের এক নয়া ব্যবস্থায় প্রবেশ করা – এভাবে সবকিছুরই এক গ্লোবাল বিনিময় ব্যবস্থার দিকে আমরা চলে গেছি। যার মূল দিকটি হল আসলে এভাবে গ্লোবাল এক শ্রম-বিনিময় চালু হয়েছে। আর সেখান থেকে প্রত্যেক উৎপাদক দেশের শ্রম মানে ‘এডেড ভ্যালু’, আর তা একই প্রডাক্টের ভেতরে এক দিকে সংশ্লিষ্ট সকল দেশের শ্রম ‘এডেড ভ্যালু’ হিসেবে যুক্ত হচ্ছে আবার সেই ফাইনাল প্রডাক্টের ভোক্তা হচ্ছে ‘ভ্যালু এড’ করা সকল দেশ। এটাকে বলা হচ্ছে ভ্যালু এডেড চেইন, এই যোগে সংশ্লিষ্ট দেশের এক অর্থনৈতিক জোট। এমনই এক জোট হলো Regional Comprehensive Economic Partnership (RCEP)। স্বভাবতই এগুলো আগামী দুনিয়ার অভিমুখ। এবং দুবাই হয়ে উঠতে পারে এরই এক আঞ্চলিক ডিস্টিবিউশন কেন্দ্রদেশ।
এখন আমরা চাই আর না চাই গত চল্লিশ বছরব্যাপী এটা এতই বিকশিত জায়গায় চলে গেছে যে, পিছন ফিরবার পথ নেই। অনেকটা নদী পেরিয়ে এরপর নৌকাডুবিয়ে দেবার মত। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তবু এক উলটা পথে হাঁটার চেষ্টা করে ফেল করে গেছেন। কার্যত তার “আমেরিকান জাতিবাদ” পরাজিত হয়ে গেছে। যদিও এর আরেক রূপ সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদ [পশ্চিমাদেশ মানে সাদা ককেশীয়দের দেশ এবং তাই তাদের শ্রেষ্ঠত্ব সেখানে ফিরে কায়েম করতে হবে, অ-সাদাদের বের করে দিতে হবে ইত্যাদি বয়ান] এখনও জীবিত এবং এরা এখন থেকেই আগামি ২০২৪ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে হাতগুটানো মাসল দেখানো শুরু করে দিয়েছে। আর ট্রাম্পের জাতিবাদি অর্থনীতি করার প্রচেষ্টার প্রভাবে এর খারাপ পরিণতি-প্রতিক্রিয়া এখন এসে পড়েছে বাইডেনের ঘাড়ে, এখনকার আমেরিকান ইকোনমিতে। যেটা এখনকার ভাষ্যে বললে এক ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিয়েছে। যেটা আমেরিকায় এবং গ্লোবাল অর্থনীতিতে প্রধান সমস্যা হিসেবে হাজির।
কিন্তু এগুলোর সঙ্গে দুবাইয়ের সাপ্তাহিক কাজের ও ছুটির দিন বদলের কী সম্পর্ক?
একালে আমেরিকার ওয়ার অন টেরর ক্রমশ আরেক বিশাল প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে, এমনিতেই শুরু থেকেই এতে মুসলমানদেরকে বৈষম্যমূলক ট্রিটমেন্ট সহ্য করতে হয়েছে, হচ্ছে। আর তা থেকে প্রতিকার হিসাবে অনেকে এথেকে মুসলিম আইডেনটিটির ভিত্তিতে কেবল মুসলমানের এক গ্লোবাল উত্থানের স্বপ্ন দেখছে। অনেকে এথেকে প্রতিক্রিয়ায় এক গ্লোবাল খেলাফত ব্যবস্থা কায়েম হবে এমন স্বপ্ন-কল্পনাও হাজির হয়েছে বলছেন। যা আবার এর বাস্তবায়ন কেন সম্ভব বা কেন অসম্ভব সে আলোচনা এখন পর্যন্ত উহ্য থাকছে বলছেন অনেকে। তুলনায় আবেগ ও স্বপ্ন দিয়ে বাস্তবতা বিচারের ঝোঁক আর এর ভিত্তিতে আকাঙ্খার তীব্রতা অনেক বেশি।
তবে এসব তর্ক উহ্য রাখা হোক আর নাই হোক, উপরে গ্লোবাল অর্থনৈতিক পরিবর্তনের যে অভিমুখ কিছুটা এঁকেছি সেই অর্থনৈতিক অভিমুখের সঙ্গে এই ‘গ্লোবাল খেলাফতের স্বপ্ন-কল্পনার’ সম্পর্ক সংঘাতের। কিন্তু এই সংঘাতের বিশেষত্ব হল, এটা এক বাস্তব ও অবজেকটিভ ফেনোমেনার (গ্লোবাল অর্থনৈতিক অভিমুখের) সঙ্গে কিছু মানুষের আইডিয়া বা কল্পনার সংঘাত। আর সবচেয়ে বড় কথা, এসব ক্ষেত্রে সাধারণত বাস্তব অবজেকটিভ ফেনোমেনাকে (যেমন জলোচ্ছ্বাসের মতো অবজেকটিভ ঘটনা) পরাজিত করা সবসময় অসম্ভব হয়ে যায়। এসব কল্পনা যতটা অবাস্তব আন-রিয়েলিস্টিক তার হেরে যাওয়া বা টিকতে না পারার সম্ভাবনা তত বেশি হয়ে থাকে।োল
কাজেই এখান থেকে সারকথাটা হল, নতুন যেকোন রাজনৈতিক আইডিয়াকে গ্লোবাল অর্থনৈতিক অভিমুখের সাথে তাল মিলিয়ে হাজির করতে হয়। সরাসরি মুখোমুখি সংঘাত এড়িয়ে চলতে হয়। নইলে সব পন্ডশ্রম হয়ে উঠতে পারে। দুবাইয়ের শাসকেরা এসব দিক বিচারে নিজেদের প্রধান বিবেচ্য করণীয় বা প্রায়োরিটি ঠিক করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
যেমন দুনিয়ার মূল অপ্রতিরোধ্য অভিমুখ হল, দুনিয়ার সব কোণের সব শ্রম পরস্পরের সঙ্গে আরো ঘনিষ্ঠভাবে লেনদেনে সম্পর্কিত হয়ে উঠতে চাইছে ও চাইবেই। শ্রম বা ভ্যালু যোগ হওয়া পণ্য বিনিময় ঘনিষ্ট হয়ে উঠতে চাইছে। এবং তাতে কার কী রাজনৈতিক, এথনিক, রেসিয়াল ধর্মীয় পরিচয় ইত্যাদি সব নির্বিশেষে মাখামাখি সম্পর্কিত হয়ে উঠতে চাইছে। এর বিরুদ্ধে মুসলমান পরিচয়ে একটি আলাদা দুনিয়া, কিংবা নিদেনপক্ষে কোল্ডওয়ারের জমানার মতদুই ব্লক দুনিয়া খাড়া করার কল্পনা একেবারেই আন-রিয়েলিস্টিক। যেমন চাল আর ডাল মিশানোর আগে পর্যন্ত সব ঠিক আছে; কিন্তু একবার মিশিয়ে ফেললে তা আর আলাদা করা যায় না।
পুরানা সোভিয়েত ব্লক এখন ভেঙে গেছে শুধু না, তারা এখন রাশিয়া-সহ ১৫ রাষ্ট্রে আলাদা হয়ে গেছে। আবার ওই ১৫ সবাই-ই এখন আইএমএফের সক্রিয় সদস্য। অর্থাৎ সারা দুনিয়াই এখন প্রায় সবদেশের সাথে তারা একই গ্লোবাল অর্থনীতির সদস্য। এবং সবার সাথে বাণিজ্য বিনিময়ের উপযুক্ত হয়ে গেছে। তাই সবার সঙ্গে সবার সব ধরনের পণ্য-শ্রম-পুঁজি এরা বিনিময়ের যোগ্য হয়ে গেছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে এটা ফিরে আগের জায়গায় যাওয়া সম্ভব নয় [reversible নয়]। কাজেই এই ১৫ দেশকে আবার কোন সোভিয়েত বা অন্য নামের ব্লকে ফেরত নিয়ে যাওয়া এখন অসম্ভব। খিচুরির চাল-ডাল একবার মিশিয়ে দিলে আর আগের জায়গায় ফিরিয়ে চাইলেও তা নিতে চাল ও ডাল আলাদা করা যায় না।
এমন সম্পর্কের আরেক উপযুক্ত উদাহরণ হল, চীন-ভারতের অর্থ-বাণিজ্যিক সম্পর্ক। একদিকে এদুই দেশের মধ্যে সামরিক, রাজনৈতিক স্ট্রাটেজিক স্বার্থ সংঘাত বেড়ে চলেছে। অথচ উল্টা কথাটা হল, ভারতে চীনাপণ্য আমদানি-বাণিজ্য গত তিন বছরে না কমে আরো বেড়েছে। ভারতে চিনাপণ্য আমদানি ৪৩% এর বেশি বেড়েছে।
কাজেই এভাবে বলা যায় দুবাইয়ের ওয়ার্কিং-ডেতে বদল গ্লোবাল অভিমুখের সঙ্গে দুবাইয়ের আমীরেরা তাদের নিজেদের সমন্বয় করা উচিত বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে- এই পারস্পেক্টিভ থেকে দেখলে ও বুঝলেই কেবল অর্থবোধকভাবে অনেক কিছুই ফুটে উঠতে পারে।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[এই লেখাটা সাপ্তাহিক “সাম্প্রতিক দেশকাল” পত্রিকার ১৫ জানুয়ারি ২০২২ ওয়েবে “দুবাইয়ে শুক্রবার ওয়ার্কিং ডে চালু” – এই শিরোনামে ছাপা হয়েছিল। ঐ ছাপা হওয়া লেখাগুলোকে আমার লেখার ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ বলা যায়। আর আমার এই নিজস্ব সাইটের লেখাটাকে সেকেন্ড ভার্সান হিসাবে এবং থিতু ভাষ্য বলে পাঠক গণ্য করতে পারেন। আসলে পরবর্তিতে ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ লেখাটাকেই এখানে আরও অনেক নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে ও নতুন শিরোনামে এখানে আজ ছাপা হল। ]