আমাদের স্মৃতি  ও অসংবেদনশীল লতা


আমাদের স্মৃতি  ও অসংবেদনশীল লতা

গৌতম দাস

১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০৬  সোমবার

https://wp.me/p1sCvy-3UR

 

                                        Lata Mangeskar (1929-2022)

_

সমাজ কোনো ব্যক্তির গুণাবলিকে তুলে ধরতে সহায়তা করে থাকে, তার ভাল গুণ থাকলে তা ফুটিয়ে তোলার কাজটা করে থাকে। উল্টা করে বললে, সমাজের ওপর ভর করেই ব্যক্তি ফুটে ওঠে, ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠে। এমনকি তার গুণের উচ্চতা যদি অনেক উপরের হয় তাতে অনেক সময় তার বড় কিছু ত্রুটি যদিও ওই গুণের উচ্চতার নিচে-আড়ালে চলে যায়, তবু এসব অর্থে আমরা বলি, ব্যক্তিত্ব সমাজের সৃষ্টি।

আবার কোন কোন ব্যক্তিত্ব তার ভাল-মন্দ যাবতীয় গুণ ও ত্রুটিসহই কখনও সমাজের প্রতীক হয়ে উঠতে পারে। তেমনি এক ব্যক্তিত্ব সম্ভবত গত আট যুগের বিখ্যাত গায়িকা লতা মঙ্গেশকর। গত ৬ ফেব্রুয়ারি ৯২ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার কেরিয়ার বা পেশাদার গায়িকা জীবনই অনেক লম্বা, প্রায় ৭২ বছর। এক মারাঠি পরিবারে জন্ম নেয়া লতার পেশাদার গানের জগতে প্রবেশ বা প্রথম তাঁর গলায় সিনেমার গান  রেকর্ডিং বলা হয় ১৯৪৮ সালের আশপাশের সময়ে। ব্রিটিশ-ভারত মানে অখণ্ড ভারত থাকার সময় থেকেই ভারতে সিনেমা – এই নয়া মিডিয়ার জন্ম হয়েছিল। তাতে নির্বাক-সবাক হয়ে চলচিত্রের উত্থানের শুরুর কালেই লতার আগমন। তবে এই সিনেমা নির্মাণ যখন নিজের জন্যই একদিকে নিজের বোদ্ধা দর্শক ও প্রশংসাকারী জড়ো করছে আর অন্য দিকে টেকনিশিয়ানগোষ্ঠী তৈরি করে সাজিয়ে বসতে শুরু করেছিল ততদিনে দেশ ভাগ হয়ে যায়। তবু ভাগ হওয়া আজকের তিন দেশে ভারতীয় সিনেমার প্রতি আগ্রহ ভাগ হয়ে যায়নি বা কমে যায়নি।

সম্ভবত এর মূল কারণ  কমন অরিজিনের এক সাংস্কৃতিক বন্ধন; এ’তিন দেশের সংস্কৃতির মৌল উৎসগুলো একই জায়গার। এথনিক অর্থে মানুষ মাত্রই তার জাতিগত পরিচয় থাকে। আবার আমরা কোনো না কোনো সিভিলাইজেশনের অন্তর্গত থেকে বড় হই। এই বিচারে আমরা সবাই সিন্ধু সভ্যতার অংশ। তাই সিভিলাইজেশন অর্থে এর একই এথনিক জাতি পরিচয় আমরা তিন দেশেরই কমন বৈশিষ্ট্য। সংস্কৃতির অংশ হিসেবে প্রাচীন ভারতের যত প্রকাশ দেখা যায় বা এ সম্পর্কে জানা যায় এর এক বড় চিহ্ন হল সংস্কৃতিতে গানের ধারা এবং ধরনগুলোর স্টাইল ও বৈশিষ্ট্য। যেমন আমাদের এই গানের ধারা পশ্চিমের সভ্যতার কোন ধারা অথবা আরব বা মেসোপটেমিয়ার ধারাও হওয়ার কথা নয়। প্রাচীন ভারত বলতে গেলে এর দাবিদার আমরাও কারণ এর বহু চিহ্নবৈশিষ্ট্য আমরা এখনো বহন করি। যেমন একটা সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য এর কেন্দ্রে আছে; এমন এক চিহ্ন সম্ভবত রাগসঙ্গীত ও এর ঘরানা মানে স্কুলগুলোতে যার প্রকাশ। তাই সভ্যতার চিহ্ন হিসেবে ক্লাসিক মিউজিক একটা খুবই শক্ত চিহ্ন হয়ে আছে। তবে এখন পলিটিক্যালি ডিভাইডেড দেশ তিনটাতে সভ্যতার রূপ-পরিণতিতে কী কী রূপ নিয়ে প্রকাশিত আছে, সেখানে অর্জনগুলো কেমন কী, আর তা কে কত অবিকশিত অর্থে ছোট বা বড় এসবের বিচারের ক্ষেত্রে তুলনায় ফারাক যতই যা নজরে আসুক, ভারত-পাকিস্তান ও বাংলাদেশে সংস্কৃতিতে গানের ভিত্তি বা ফাউন্ডেশন একই।

কোক স্টুডিও-এর যুগেঃ
গত ১৯৪৭ সাল থেকে ভাগ হয়ে যাওয়ার পরও আমাদের গানের ভিত্তি এক হওয়া সত্ত্বেও আমরা কে কেমন কতদূর বিকশিত হয়েছি, অর্জন করেছি তা এক সহজ তুলনা করে বুঝার উপায় হতে পারে এমন কিছু সম্ভবত এখন এসে গেছে। সেটা হল কোক স্টুডিও
এখানে স্টুডিও বলতে মূলত গানের রেকর্ডিং স্টুডিও। অর্থাৎ রসুইখানা যেখানে ফাইনাল প্রডাকশনটা তৈরি হয়েছে। আর কোক বলতে বহুজাতিক পানীয় প্রস্তুত কোম্পানি ‘কোক’ এর কথাই বলা হচ্ছে, অবশ্যই। তবে এখানে এর ভূমিকা কেবল অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা করা সূত্রে যতটুকু; যাতে জোগানো তাদের অর্থের বিনিময়ে এই গানের তৎপরতা ও প্রচারের সাথে জুড়ে থাকার সুবিধায় কোক কোম্পানিও প্রচার ও প্রসার পায়। এ’থেকেই নামের ব্রান্ডিং  আর সেই ব্রান্ড নাম ও শব্দটা হয়ে দাঁড়ায় কোক স্টুডিও

এর শুরু ২০০৮ সালে পাকিস্তান থেকে। সাধারণত এমন গানের আয়োজন মানে, সংস্কৃতিতে গান এই শিল্পকলা সৃষ্টির আয়োজনে এক কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব লাগে। আর তাঁকে  অর্গানাইজার বা সংগঠক হতে হয়; আর তাঁকে গানের ও সমাজের এমন দুই অর্থেই সংগঠক হতে হয়। অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে, কোক স্টুডিওতে এমন সংগঠক যারা হচ্ছেন  তাদের টেকনিক্যাল গুণ হল তারা সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার ব্যাকগ্রাউন্ড বা মিস্কিং ইত্যাদি এসব অন্তত বুঝেন ভাল; আর সাথে সেন্স অব মিউজিক। স্বভাবতই তা নিশ্চয় পশ্চিমা-কালচারাল গানের বোধ বুঝাচ্ছি না। সেটা থাকলে তা বাড়তি ভাল, তুলনা করে তাঁরা নিজের বোধগম্যতা বাড়াতে পারবেন। কিন্তু মূল জিনিস হল, নিজের এথনিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা ও ইতিহাস সম্পর্কে একটা ভালো রকমের বোধ থাকতে হবে।

পাকিস্তানে গত ২০০৮ সালে পাকিস্তান-কোক-স্টুডিও শুরু হয়েছিল এমন যে কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্বের হাত ধরে তার নাম রোহেইল হায়াত [Rohail Hyatt]। গত ১৯৮৭ সালে পাকিস্তানে গানের কম্পোজার হিসাবে  তাঁর আগমন; এসে পাঁচবছরের মধ্যে তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন শুরু করেছিলেন, বলা হয়। এরপর নানা এলবামে কাজ করার পর তার উল্লেখযোগ্য  সব ছাপিয়ে গুরুত্বের কাজটা হল কোক স্টুডিও, এই প্রডাকশন।  এখানে পাকিস্তান সমাজের কাদের কাদেরকে বেছে তুলে এনে রোহেইল তাঁর গানের ধরন ও বৈচিত্র্য বা কম্বিনেশনের ডালি সাজাচ্ছেন তা লক্ষণীয়। সে দিকটা খেয়াল করলে তার ওজন বুঝা যাবে। পাকিস্তান কোক স্টুডিও-এর সফলতার তিন বছর পরে ভারতে একই আইডিয়াতে ইন্ডিয়ান কোক স্টুডিও শুরু হয়েছিল ২০১১ সালে; দক্ষিণী কম্পোজার বা সুরকার লেসলি লুইসের [Leslee Lewis] হাত ধরে। আরেক দক্ষিণী গায়ক হরিহরণকে সাথে নিয়ে ১৯৯৬ সালে তার বহুল আদর পাওয়া অ্যালবামের নাম “কলোনিয়াল কাজিন” তরুণদের টিভি এমটিভি এর কল্যাণে,  এ’নামেই লুইসকে বেশি মানুষ চেনে।

দুই কোক স্টুডিও-এর তুলনা আমাদেরকে আমাদের একই প্রাচীন উৎস এবং একই সাথে আমাদের ভিন্নতা সম্পর্কে অনেক কথা বলতে পারে, পরিচয়  করাতে পারে। আগেই বলেছি অবিভক্ত ইন্ডিয়ান ধারার সংস্কৃতিতে এক বড় কমন চিহ্ন হল ক্লাসিক মিউজিক যা দেখে নিশ্চিত হওয়া যায় আমাদের কালচারাল উৎস একখানে। ক্লাসিক গান বা রাগ-প্রধান গান শুনে সচেতনরা ছাড়া অন্যদের বোঝা মুশকিল হতে পারে যে, সেটা ভারত না পাকিস্তানের উপস্থাপন।

কিন্তু এরপর যদি ভারত-পাকিস্তান কোক স্টুডিওর মধ্যে ফারাক – মানে কে কোন দিকে গেছে বিকশিত হচ্ছে অভিমুখ কী তা তুলনা করে বুঝতে চাই তা হলে, ভারতের কোক স্টুডিও দেখে বোঝা যাবে ভারতের গানের জগত বাণিজ্যিক ভিত্তি খুঁজে নিতে পেরেছে। বাণিজ্যিক ভিত্তি বলতে “মডার্ন ক্রিয়েটিভ ইন্ডাস্ট্রি” জগতের ভারত যার সবচেয়ে বড় প্রকাশ হল ভারতীয় বাণিজ্যিক সিনেমা। অর্থাৎ ভারতের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি ইন্ডিপেনডেন্ট অর্থে স্বাধীন নয় বরং তা  এক সিনেমা জগতকেন্দ্রিক। ফলে ভারতীয় কোক স্টুডিওতে এর গান, অর্জন ও পারফরমেন্সে এটা মডার্ন এবং সিনেমাকেন্দ্রিকতার ছাপে ভরপুর।

তুলনায় পাকিস্তান কোক স্টুডিওর বৈশিষ্ট্য হল, সে দেখিয়েছে সে পাকিস্তান এলিট ঘরের কিন্তু গভীর মিউজিক সেন্সের তরুণ যারা পপ বা রক ধরনের মিউজিক থেকে খুঁজতে খুঁজতে ক্লাসিকে এসে গেছে; তাদেরকে রোহেইল তুলে এনেছেন। কিন্তু সেই সাথে রোহেইল শেষে একেবারে ক্লাসিক কাওয়ালি বা বুল্লেহ শাহকে পর্যন্ত একাকার করে  পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন আমাদের।  এমনকি বিস্ময়কর এক ব্যক্তিত্ব হলেন সাইন জহুর  যিনি আমাদের মত অক্ষরের-শিক্ষায় জীবন যাপন করেন না। তাঁর ফোনেটিক্যাল মানে শব্দ উচ্চারণের দুনিয়ায় এই মাধ্যমে তাঁর চলাচল। অক্ষর না চিনে নিজের গলার স্বর বা শব্দের উচ্চারণ দিয়ে নিজের জগত গড়েছেন; গানের লিরিক যিনি অক্ষরে দিয়ে না আঁকিবুঁকিতে নোট নেন; তাঁকেও রোহেইল আবিস্কার করে আমাদেরকে পরিচয় করে দিয়েছেন।  পাকিস্তান কোক স্টুডিও আমাদের দেখাচ্ছে পাকিস্তানেরও গানের শক্তিমত্তা কত সমৃদ্ধ কত বিস্তৃত। বুল্লেহ শাহদের আখড়া এখনও কত সক্রিয়, নুসরত ফলে আলীদের ঘরানা এখনও কেমন দাপটের সাথে টিকে আছে। তাঁরা এখনও পাকিস্তানে হারিয়ে যান নাই, নিজের মত সারভাইবালের স্ট্রাগল করে হাজির থাকার চেষ্টা অরে যাচ্ছেন।
তবে একই ক্লাসিক কালচারাল অরিজিনের ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে গানের শক্তিমত্তার দিক থেকে পাকিস্তান সম্ভবত এগিয়ে কিন্তু আবার এই শিল্পকলাকে পেশা হিসেবে নেয়ার ক্ষেত্রে, বাণিজ্যিক ভিত্তি দেয়ার ক্ষেত্রে ভারত অতুলনীয় উঁচুতে উঠে গিয়েছে। যে ভারতে শিল্পকলার মুখ্য বা ফোকাস ইন্সটিটিউশন যদিও ঠিক গান অথবা নাটক থিয়েটার নয়, সিনেমা। ফলে কাউকে বা কারও অর্জন ফেলে দিবার নয়! স্বভাবতই এ কারণে দেশগুলো যার যার বাড়তি সুবিধার বা অর্জনের দিক অথবা অসুবিধা বা অবিকশিত নেতিদিকও অবশ্যই আছে ও তৈরি হয়েছে।

কেন লতার আলাপের মধ্যে এদিকে এত দূরে এলামঃ
মানুষের আবেগ-অনুভূতির ওপর দাঁড়ানো মানুষের শিল্পকলা বা ক্রিয়েটিভিটি [creativity] চর্চার দিক – সাধারণভাবে দেখলে মানুষের জীবনে একটা পেশা খুঁজে পাওয়া বা নেয়া যতটা কঠিন, ক্রিয়েটিভিটির জগতে এটা তার চেয়েও কঠিন।  মানুষের শিল্পকলা-বোধের জন্ম থেকেই এটা এমনই কঠিনতর।  তাই, জন্ম থেকেই শিল্পকলা-বোধের আদি লড়াই হল খোদ নিজ নিজ বিষয়-আশয়ের জীবনের সাথে। সোজা বাংলায়, পেটের সাথে। কেউ যে শিল্পকলা চর্চায় লিপ্ত হবে তো খাবে কী অথবা কে তাকে খাওয়াবে এই হল সেই মুখ্য প্রশ্ন। এটাকেই আরেক শব্দে প্রকাশ করতে বলা হয়”পৃষ্ঠপোষকতা” কে দিবে? মানে কার অর্থে ‘পেটের চিন্তা’ না করেও নিশ্চিন্তে শিল্পকলা চর্চায় ব্যস্ত হওয়া যায়? কোন যুগ-কালেই এই প্রশ্নের কোন জবাব কেউ দিতে পারে নাই। কারণ এর সমাধান নাই। তাই পায় নাই সেকালেরও শিল্পকলা-বোধের মানুষেরা……।

অতএব, এই প্রশ্নে শিল্পকলা সব সময় একটা আপস করেই এপর্যন্ত চলে এসেছে বা টিকে গেছে, আছে। যেমন সেটা হল, যদি সেটা রাজ-রাজড়ার আমল হয় তো রাজাদের স্তুতিমূলক গানের  তৎপরতা কেটেছে। যেমন রাজ-বন্দনামূলক গান।  আর এটাকে বলেছি রাজ- পৃষ্ঠপোষকতা। অথবা অন্যদিকে ফিরলে আমরা পাই মন্দিরে মাজারে আখড়ায় স্পিরিচুয়াল ক্ষুধা মিটানোর গান, ভক্তিসঙ্গীত, ভজন, কাওয়ালির ধরনে চলে যাওয়া। আর এখান থেকে গণমানুষের দান, ভালোবেসে দান, এমন সামাজিক পৃষ্ঠপোষকতায় বেঁচে থাকা। কিন্তু এখানের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল – এই ধারা আরো খুবই সিরিয়াস ক্লাসিক্যাল ধারা।  যেন শ্রেফ ভাল পৃষ্ঠপোষকতা নয়। সে সবকে ছাড়িয়ে মোক্ষলাভের জন্য সে মন্দিরে মাজারে আখড়ায় স্পিরিচুয়াল ক্ষুধা মিটাতে হাজির হয়েছে। নিজ আত্ম-ক্ষুধায় গানের ভিতর দিয়ে সে কোন একক স্পিরিটে পৌছানোর কসরত করছে!! এমনকি জমিদারির কালে, বাঈজি জীবনের মধ্য দিয়ে ক্লাসিক গানকে টিকে থাকতে হয়েছে। সেকালে এমন আরেক রূপ করাচিতে দেখা যেত ‘মুজরা’ বসানো…।  শিল্পকলায় স্ট্রাগল-এর কোন শেষ নাই…।

বলা হয়, আসলে যা “মনের থেকে” ভাল লাগে তার “দাম” [beyound value] হয় না। আবার উল্টা দিকটা হল যে ব্যক্তি এটা শিল্পকলা-বোধে  ‘সৃষ্টি’ করে আপনার সামনে হাজির করেছে তাকে বাঁচিয়ে রাখবেন কী করে, সে খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকবে কী করে? তাই একটা বিনিময় মূল্য তাঁর অবশ্যই লাগবে। এই প্রশ্নও কম জরুরী নয় বরং  আরেক ভাইটাল প্রশ্ন! যার জবাব দিতে হবে বা পেতে হবে!

আর বাণিজ্যিক সম্পর্কের যুগে এরই এক ধরণের আপাত সমাধান হল, পেশা হিসেবে শিল্পকলার যেকোনো এক শাখায় এতে পেশাদার পারফরমার হিসেবে একদিকে শিল্পকলার চর্চা, অন্যদিকে পেটের চিন্তার সমাধান পেতে হবে বা ব্যবস্থা করতে হবে ও হয়েছে। তবে বলাই বাহুল্য, এই বাণিজ্যিক সমাধান – এটাও এক বড় কম্প্রোমাইজ। জন্ম থেকেই কোন আপোষ করা ছাড়া কোনো শিল্পকলা চর্চা নাই, ঘটে নাই। মানে, মানুষের শিল্প-চিন্তার প্রকাশ সেটাকে “বেচাবিক্রির বস্তু” করতেই হয়েছে। আর বেচাবিক্রির বস্তু  না করে কেমনে নিজের ভরণ-পোষণ হবে – সেই প্রশ্ন  এড়িয়েই শিল্পকলাকে এই আপস করেই  নিজেকে বাস্তব করে চলতে হয়েছে। তাই একেই শিল্পকলা আছে – বলা যাচ্ছে!

এ ব্যাপারে ভারতে যে বিকাশিত রূপটা হাজির হয়েছে সে দিকে তাকিয়ে বললে ভারতে শুধু বা মূলত গানকে পেশা হিসেবে নেয়ার ব্যবস্থা দাঁড় করানোতে যায়নি। বরং আরেকটা আরো বড় মাধ্যম তৈরি করে নিয়েছে; আর এটাই হল সিনেমা জগত। আর সিনেমারই এক গুরুত্বপুর্ণ অঙ্গ হতে পেরেছে বলেই গান এই শিল্পচর্চাটা টিকে গেছে ও আছে, সিনেমার আরেক শিল্পকলা রূপ হিসেবে  গান সাথে জুড়ে গিয়েছে। তাই এখন এভাবে বলা যায়, বাণিজ্যিক সিনেমার ভেতর দিয়ে টিকে আছে ক্লাসিক মিউজিক। তবে ঠিক ক্লাসিক রূপে না, মডার্ন মিউজিক হিসেবে।
এখন অলক্ষ্যে এ দুইয়ের সম্পর্কটা বলে রাখা যাক। সেটা হল ক্লাসিক মানে ব্যাকরণসম্মত দিক এবং যা ভিত্তিমূলক দিক – শুধু তাই না। যেকোন ক্লাসিক দিকের মর্ম উপলব্ধি করতে গেলে “বোদ্ধা ট্রেনিং” থাকা লাগবে। এপ্রিশিয়েশন [appriciation] বোধ হুশ-জ্ঞান লাগবে। সেটা না জানলে প্রশংসা বা মূল্যায়ন করা যায় না – এই হল সুত্র।  কিন্তু আবার আরেক সমস্যা হল কাজটা ক্লাসিক হলেও তা হাজির করতে হবে সাধারণ্যে এবং তা জন-সাধারণের বোধের সীমায় পৌছে দিয়ে। অন্যভাবে বললে তত্ব নয় ব্যবহারিক রূপ লাগবে। আর সেটাই ব্যবহার দক্ষতায় ব্যবহৃত ও সৃষ্ট নতুন রূপটা আম আদমির সামনে পেশ-প্রদর্শন করে তাদের কোনো না কোনো বোধগম্যতায় তা আনা; আর সবচেয়ে বড় কথা, তাদেরকে আনন্দ-মজা দেয়া; সাধারণের জীবন অসংখ্য টেনশনের জীবন – সেটাকে রিল্যাক্স করার বা স্ফুর্তি জাগানো যার লক্ষ্য  – এই রূপটাই আধুনিক গান। সেকারণের যার গানের ক্লাসিক দিক নিয়ে নুন্যতম বোধ অভিজ্ঞতা আছে সেই  ফিরে আধুনিক গানে ভালকিছু করতে পারবে ও দীর্ঘযাত্রায় টিকে যাবে।

তাহলে লতা মঙ্গেশকর আমাদের কে?
সাধারণভাবে বললে, এথনিক-সাংস্কৃতিক সভ্যতায় অরিজিনে মিল অর্থে এখনকার ভারত আসলে আমাদের এক কাজিন যেন; চাচাত-মামাত ভাই-বোন যেমন। যদিও একই ব্লাড, ডিএনএ ইত্যাদি আমাদের। তবুও আপনার কাজিন আপনার চেয়ে বহু ও বেশি গুণে গুণান্বিত হতেই পারে। আবার আপনার থেকে খারাপ এবং কদর্যও হতে পারে। কিন্তু ‘কাজিন’ বলছি কেন? মূল কারণ এথনিক-সাংস্কৃতিক সভ্যতাগত মিল ও একই হবার কারণে।

এখন ভারতেই কেবল শিল্পকলা প্রভাবশালী মাধ্যম হয়ে উঠতে পেরেছে – মুম্বাইভিত্তিক সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি বা বাণিজ্যিক সিনেমা রূপে। আরই এরই বগলে লেগে ঝুলে হাটছে গানের চর্চা। আর লতা মঙ্গেশকর হলেন ওই গানের জগতে টানা এক ৭২ বছরের পেশাদার। ব্রিটিশ-পিরিয়ড থেকে একাল পর্যন্ত কালদর্শী একজন পেশাদার।

কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও লতার সাথে আমাদের কী সম্পর্ক? এনিয়ে আগেই বলেছি শিল্পকলার প্রধান শত্রু হল শিল্পীর ব্যক্তি-বৈষয়িক জীবনের চাহিদা। জীবনে বৈষয়িক চাহিদার মিটানোর উপায় কী হবে তা না খাড়া করে শিল্পকলা চলতে পারে না। ফলে একদিক থেকে বললে এটা  এটাকে পেশা হিসাবে নেয়া মানে তা শিল্পকলার আপোষ, আবার অন্যদিক থেকে বললে এটাই শিল্পকলাকে পেশা হিসেবে নেয়ার ব্যবস্থা ও সুযোগ এবং সম্ভবত একমাত্র সম্ভাবনা। আমাদের এই তিন দেশের মধ্যে ভারতই বাণিজ্যিক সিনেমা এই মিডিয়াকে সফলভাবে শিল্পকলা-সংশ্লিষ্ট মানুষদের পেশা হিসেবে নেয়ার এক স্থিতিশীল ব্যবস্থা হিসেবে হাজির করতে পেরেছে। আর এই এক্সপেরিমেন্ট যখন শুরু হয় সেটাকে বলা যায় ১৯১৩ সালের প্রথম নির্বাক চলচ্চিত্র যা পরে আরো বিকশিত হয়ে হয় ১৯৩১ সালের সবাক চলচ্চিত্র হয়েছে।

আর এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটা হল, এক সময়ে আমরা সবাই অবিভক্ত ভারতের অংশীদার ছিলাম বলে ওর সব অর্জন ও ব্যর্থতারও ভাগিদার ছিলাম। ফলে সিনেমার এই শিল্পকলার বিকাশে মুখ্য ভূমিকা নেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের অবিভক্ত সবার সাথে সে সময়ের পূর্ববঙ্গের বুঝমানেরাও প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে তাকিয়েছিল। নিজের শিল্পকলার ভবিষ্যত খুঁজে ফিরেছিল।

সে আগ্রহ দেশভাগ হয়ে যাওয়ার কারণে পরেও থেমে যায়নি। কারণ আগ্রহটা আমাদের কালচারাল ভবিষ্যৎ নিয়ে। আমরা পাকিস্তান-বাংলাদেশ (পূর্ববঙ্গ) হয়ে গেলেও রাজনৈতিক বিবাদ পাশে সরিয়ে রেখে যতটা সম্ভব পরস্পর কালচারালি কানেকটেড থাকার চেষ্টা করেছিলাম আমরা, যা স্বাভাবিক। ফলে সেই ঐতিহ্যের স্মরণ থেকেই একালে লতা মঙ্গেশকরের মৃত্যুতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইমরান খান পর্যন্ত; তাঁর  শোকবার্তা প্রেরণ খুবই ভ্যালিড ও স্বাভাবিক এক তৎপরতা। অবশ্য এর আরো একটা বড় কারণ ‘স্মৃতি’।

স্মৃতি মানুষকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়ঃ
বড় কারণ ‘স্মৃতি’, যা আমাদের তাড়া করে অনেকেই লক্ষ্য করেছেন হয়ত, ছোটবেলায় শোনা অনেক গান দু-একটা যা তখনই খুব অপছন্দ লাগত ফলে কম বা না শুনতাম আমরা হয়ত ব্যক্তিগতভাবে। অথচ আজ বড় হয়ে ধরা যাক সাবিনা ইয়াসমিনের সেই গান যা আমার অপছন্দের গান সেটাই খুব ভালো লাগছে! কেন, এর কারণ কী? এর কারণটা অদ্ভুত!! মানুষ পরিণত বয়স হলে তখন আমরা আর শুধু গান শুনি না। কোন ভেসে আসা গানশুনার সাথে সাথে আমরা তরুণ বা ছোটবেলার সেসব সময়ের টুকরো টুকরো অসংখ্য স্মৃতি মনে ভেসে উঠতে থাকে। আর এতে গান ছাড়িয়ে ওই স্মৃতিতে ডুবে যাই আমরা। অসংখ্য খারাপ বা ভালোর সুখবোধ আর ওদিকে হয়ত লজ্জা কিংবা অপরাধবোধ, মিলবার আকুতি ইত্যাদি জেগে ওঠে। নস্টালজিক ক্ষোভ হতাশা ফ্যান্টাসি ইত্যাদি সব এসে মাথায় ভিড় করে। আর ভালো লাগাটা মূলত ওখান থেকে। ফলে সাবিনার সেটা ধীর-লয়ের গান ছিল বলেই হয়ত টগবগে তরুণ বয়সে যেটা ভাল লাগেনি, সরিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু পরিণত বয়সে স্মৃতির গুণে  সেটাই এখন মহার্ঘ্য হয়ে উঠতে পারে। অতএব গানের আরেক নাম এখানে গভীর স্মৃতি! লতা আমাদের স্মৃতির আরেক নাম!

তাহলে একালে লতার গান কথার আসল মানে হল আমাদের পুরনো সেসব দিনের ভালো-মন্দ, দুঃখ-সুখের খুটিনাটি স্মৃতি। আমরা ভাগ হয়ে ছিটকে তিন দেশে পড়েছি কিন্তু লতার গান হল আমাদের পুরান সেসব স্মৃতির গ্রন্থি-কার। বুনে বুনে যে আবার তা জোড়া দেয়!!! মোটামুটিভাবে বললে, পঞ্চাশ তো বটেই ষাটের দশক পর্যন্ত আমরা ভারতের  সিনেমাকেন্দ্রিক পেশাদার শিল্পকলার যে উত্থান তার খবর নিতে পেরেছিলাম। এরপর থেকে রাজনৈতিক বিবাদ অনেক ভারী হয়ে যায়, প্রজন্মও বদলে যায়। স্মৃতি ফিকে হয়ে আসতে থাকে। তবু যাদের বয়স এখন ষাট বা এর বেশি তাদের স্মৃতিতে এখনও ভারতীয় সিনেমা বা লতা বাস করে, এটা কম কথা নয়!

তবু ঠিক কেন লতা মঙ্গেশকর আজ এখানে প্রসঙ্গঃ
লতা আজ এখানে লেখার প্রসঙ্গ হলেও এনিয়ে আরো কিছু কথা আছে। তবে সেসব অন্যদিকের কথায় এখন যাব…।
এটা এখন সবাই স্বীকার করে নিয়েছে যে, গ্লোবাল অর্থনৈতিক তৎপরতায় বাকি মহাদেশকে ছাড়িয়ে এশিয়াই প্রধান গ্লোবাল কেন্দ্র হয়ে উঠছে। এই কথাটা মাথায় খেয়াল রেখে  আরো অনেক কিছু দিয়ে আমাদের প্রভাবিত করতে আমেরিকার এক থিংকট্যাংক ফেলো মাইকেল কুগেলমানকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে; যিনি আমেরিকান ফরেন পলিসি নামের ম্যাগাজিনে এশিয়ার ঘটনাবলি প্রসঙ্গে সাপ্তাহিক নিজের এক কলাম লিখে থাকেন। কুগেলমানের এবারের প্রসঙ্গে দেখি, লতা মঙ্গেশকর উঠে এসেছে  [Lata Mangeshkar Was a South Asian Icon]। তবু গুরুত্ব দেইনি। কিন্তু তাঁর একটা শুরুর বাক্য ছিল এমন যে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সবার কাছে কমন কিছু ব্যক্তিত্ব হয়ে হাজির হওয়া সহজ নয়। কিন্তু লতা হয়েছেন, এধরণের সেই বাক্যটা। তবু তার ব্যাখ্যাটা পূর্ণ মনে হয়নি। কুগেলম্যান লিখেছিলেন…  “Her music united a region that has few shared heroes and often struggles to come together around common causes.”  অর্থাৎ লতা নাকি এই অঞ্চলকে (তিনি আসলে বলতে চেয়েছেন আমাদের তিন দেশ) ঐক্যবদ্ধ করেছেন যেখানে আমাদের কমন হিরোর সংখ্যা খুবই কম আর একই কারণে একমতে ও একসাথে হবার উদাহরণ অনেক কম।

কুগেলম্যান  কথাগুলো আনাড়ির মত বলেছেন, আর জোর করে মিলিয়ে বলেছেন। ফ্যাক্টস হল, ঠিক লতা মঙ্গেসকর আমাদের তিন দেশকে ঐক্যবদ্ধ করেন নাই। উপরে এতক্ষণ সেকথাগুলোকেই খুঁড়ে বিভিন্ন দিক থেকে তুলে এনে বলার চেষ্টা করেছি। যার সারকথা হল, আমরা তিনদেশ লতার পেশাজীবন শুরুর পরে একটা বড় সময় পর্যন্ত একদেশ হিসাবেই ছিলাম। এবং এখনও সাংস্কৃতিক অরিজিন হিসাবে আমরা একই রূট শেয়ার করি। শত রাজনৈতিক ভিন্নতা সত্বেও লতা  অবশ্যই আমাদের শেয়ারড লাইফের এক প্রতীক। কিন্তু কোথায় আমরা ঐক্যবদ্ধ? এটা তো না থাকলেও জোর করে কাউকে খুশি করার জন্য বলার বিষয় নয়। বাস্তবতার কথাটা বললে অসুবিধা কী? এদিকটা তিনি না জেনে উলটা ব্যাখ্যা করতে গেছেন। তাই এখন নিচে আমরা দেখব আমাদের রাজনৈতিক ভিন্নতার শুরু কোথা থেকে, যেটা কুগেলম্যানের বুঝাবুঝিরই বাইরে…।

কুগেলম্যান আমাদের তিন দেশে ভাগ হয়ে যাওয়া এবং এখনো তা নিয়েই আমাদের মধ্যে বড় রাজনৈতিক মতবিরোধে জড়িয়ে থাকাকে ইঙ্গিত করছেন?  অথচ তিনি লতার হিন্দু মহাসভা, আরএসএস বা বিজেপির মোদির প্রতি রাজনৈতিক আনুগত্য অনুভব করার দিক নিয়ে বেখবর।  আর স্বভাবতই এ নিয়ে লতা মঙ্গেশকরের ব্যক্তি রাজনৈতিক মতামত বা পছন্দের প্রশ্নে তাঁর হিন্দু-মহাসভা থেকে উঠে আসা আরএসএস-বিজেপি মোদির প্রতি ভালোবাসা আবেগ দেখানো; ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে  মোদি যেন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন সেই দোয়া-কামনা পাবলিকলি প্রকাশ করা থেকে শুরু করে, অবলীলায় বাবরি মসজিদ ভাঙার পক্ষে গান গেয়ে দিয়ে অংশ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি আমার মনে পড়া থেকেই তো এটা সবদিক থেকে লিখতে তাগিদ অনুভব করেছি।

আমি আগেও অনেকবার বলেছি, রাজনৈতিক চিন্তায় একটা খামতি কত যুগ ধরে আমাদের তিন দেশকে গর্তে ফেলেছে এর আদর্শ উদাহরণ, এমন ব্যক্তিত্ব হলেন রাম মোহন রায়। গত ১৮১৫ সালে তার ‘আত্মীয় সভা’ নামে পাঠচক্র(?) থেকে (ব্রাহ্মণ নয়)  ব্রাহ্মধর্ম প্রচলনের প্রস্তাব করেন তিনি। সেখান থেকে ব্রাহ্মসমাজ গড়া শুরু করা এটাই এর সবচেয়ে ভাল প্রমাণ। তিনি ভুল অনুমানে বুঝেছিলেন, ব্রিটিশরা একাট্টা অ্যাঙ্গলিকান বা ইংলিশ-ক্যাথলিকভিত্তিক এক ‘জাতি’ বলেই নাকি তারা মডার্ন ব্রিটিশ জাতি-রাষ্ট্র হতে পেরেছে। কাজেই ভারতকেও জাতি-রাষ্ট্র হতে হলে আগে একেও এক জাতি হতে হবে। তাই এক ‘ব্রাহ্ম-জাতি’ হয়ে নিতে হবে আগে। কারণ তাঁর অনুমান আমাদের অবিভক্ত ভারতে সনাতন ছাড়াও মুসলমানসহ অন্যান্য ধর্মও আছে। এর চেয়েও বড় বিষয়, হিন্দুধর্মেই অগুনতি জাতিভেদ বর্ণপ্রথা আছে। কাজেই আগে সবাইকে এক ধর্মে এনে নিতে হবে। নাহলে জাতি-রাষ্ট্র গঠন করা যাবে না। এই হলো তাঁর বোঝাবুঝিতে প্রধান ও পরিপুর্ণ ভুল অনুমান। আর এই ভুলের উপর দাঁড়িয়ে তিনি ব্রাহ্মধর্ম প্রচলন করে নিতে হবে বলে এক পূর্বশর্ত আরোপের কারণ। তবে গুরুত্বপূর্ণ যে দিকটা আমাদের মনে রাখতেই হবে, ভারতীয় কমিউনিস্ট ইতিহাসের চোখে, তাদের লিখিত ইতিহাস অনুসরণের ব্যাখ্যায় রামমোহনই নাকি কমিউনিস্টদের কথিত “বেঙ্গল রেনেসাঁ’র আদিগুরু”।

পরবর্তিতে এর আঠারো বছরের মধ্যে রামমোহনের মৃত্যু হয়, আর ১৮৭২ সালের মধ্যে ব্রাহ্মসমাজ তিন টুকরা হয়ে ওই ব্রাহ্ম প্রকল্প অকেজো হয়ে যায় যদিও তা পরে উনিশ শতকেও কেবল টিকেই ছিল। কিন্তু অকেজো হয়ে যাওয়ার পর থেকে বা বলা যায় এ সুযোগে নতুন তত্বকার বা অভিমুখ দাতা হয়ে আসেন কপালকুন্ডলার বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনিই যুক্তি সাজান যেহেতু ব্রাহ্ম প্রকল্প ফেল করেছে, তাই বিকল্প হিসেবে হিন্দু-জাতির ভিত্তিতে ভারত জাতি-রাষ্ট্রের সংশোধিত প্রকল্প নেয়া হোক। আর এর ভিত্তিতেই পরে কংগ্রেস দলের জন্ম দেয়া হয় ১৮৮৫ সালে। পরিণতিতে ২০ বছরের মধ্যে মুসলিম লীগের জন্ম। আর ওদিকে কংগ্রেসের চেয়েও আরো কট্টর উগ্র হিন্দুত্ব জাতিবাদী দল হিসাবে তৈরি হয় হিন্দু মহাসভা যেটা আরএসএস-বিজেপির আদি বা পুর্ব সাংগঠনিক রূপ।

এখন লতার পছন্দ এই আরএসএস-বিজেপির মোদির রাজনীতি। কিন্তু সাবধান, এটা সাধারণভাবে যেমন বলা হয়, যার যা রাজনৈতিক দল পছন্দ সে তা করবে – এটা এমন ব্যাপার নয়। আপনি দেশের আরেক জনগোষ্ঠী-অংশকে কোপাবেন কাটবেন হত্যা করবেন, নির্মুল করে দিবেন – এটা কোনো রাজনীতি?? এই চিন্তা দিয়ে এক ভারতে সবাইকে ধরে রাখবেন কী করে?? এটা তো কারো পছন্দের রাজনীতি হতে পারে না, ফলে এটা সবার পছন্দের গায়িকা হতে চাওয়া কারও পছন্দের রাজনৈতিক মতামত হতেই পারে না। আবার যিনি সমাজের জন্য গান গাইবেন তিনি এমন রাজনীতি ভালোবেসে একই সাথে সুকুমারবৃত্তির চর্চাও করবেন কিভাবে? এটা দায়ীত্বজ্ঞানহীন, বোধশক্তিহীন চিন্তা ও কাজ।

ফলে এক দিক থেকে আমরা লতাকে  রাজনৈতিক দিক বাদ বা পাশে সরিয়ে রেখে কেবল আমাদের স্মৃতিগুলোকে রক্ষা করতে তাঁর গান মানে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাই; আমাদের দায়িত্ব পরিপালন করেছি। আমরা আমাদের স্মৃতির হত্যাকারী তো হতে পারি না, তাই। কিন্তু একই সাথে একই নিঃশ্বাসে লতার চিন্তার অন্ধত্ব, রাজনৈতিক হিন্দুত্বের প্রতি বেহুঁশ ভালোবাসা থাকা এটা আমাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য; সেটাও জানিয়ে রাখতে চাই!

তবে এটাও সত্য, গানের জগতের বহু বিখ্যাত লোক কিন্তু যারা বুদ্ধিমান তারা তাদের রাজনৈতিক পছন্দ  বাইরে আনেন না। ব্যক্তিগত জগতেই রেখে দেন। মূল কারণ তাদের গান পছন্দকারিরা নানান রাজনৈতিক মতের হতেই পারে্ন। এখন তিনি নিজের রাজনৈতিক মত প্রকাশ্যে দেখিয়ে ওসব পছন্দকারিদের মধ্যে বিভক্তি আনতে পারেন না।   বুদ্ধিমানদের এতটুকু সচেতনতার আছে বলে এজন্য আমরা তাদের নিয়ে ঘাটাতে চাই না।

কিন্তু লতা মঙ্গেশকর এতই বোধশক্তিহীন যে, তিনি প্রকাশ্যেই তার ব্যক্তিগত দিক পাবলিক করে দেন। এবং বেপরোয়াভাবে হিন্দুত্ববাদে লিপ্ত হয়ে যান। ফলে মানুষের সুবৃত্তি আমল করার অযোগ্য ব্যক্তিত্ব তিনি যা শিল্পকলার সাথে আনফিট! অবশ্য অনেক সময় পেটের দায়ে মানুষ শিল্পকলার জগতে এসে পড়ে, সেটাও ঠিক!

জুনিয়রদের উঠতে না দেয়াঃ
আবার ভারতেই লতার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের আরেক বড় ও গভীর অভিযোগ হল তিনি নবাগতেরা যেন তাদের কোন প্রতিভায় যেন তারা তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বি হয়ে উঠতে না হতে পারেন, এজন্য নিম্নশ্রেণীর আচরণ পদক্ষেপ বারবার তিনি নিয়েছেন।  এপ্রসঙ্গে ভারতের কিছু গায়িকা যেমন সুমন কল্যাণপুর বা অনুরাধা পরোয়াল [Suman Kalyanpur, Anuradha Paudwal] এদের কথা জানা যায়। এসব গায়িকারা যেন গানের গায়িকা বাজারে কাজ না পায় এমন এক একচেটিয়া অবস্থা সৃষ্টি অভিযোগ লতার বিরুদ্ধে বহু পুরানা। এমন শর্ত তিনি প্রযোজক-পরিচালকদের দিয়ে থাকে। অন্যভাবে বললে একটা একচেটিয়ার ব্যবস্থা কায়েম করে সবস্ময় টিকতে চেয়েছেন তিনি। অথচ তার নিজ প্রতিভা তো কম ছিল না! তাহলে তিনি কী নিজের উপর আস্থা রাখতে পারেন নাই? ইন-সিকিউরিটিতে ভুগতেন কেন??
যেমন  খুব সম্ভবত সত্তর দশের শেষের দিকে্র ঘটনা যতটুকু মনে পড়ে, আমাদের রুনা লায়লাও এর শিকার হয়েছিলেন। একটা সিনেমায় গড়ে পাচটার মত গান থাকতে দেখা যায়। ঐ প্রযোজক পরিচালক রুনাকে দিয়ে তার সিনেমার দুটা গান রেকর্ডিং করিয়েছিলেন। এমনকি সেই গান সিনেমায় ছাড়ার আগেই বাজারেও ছাড়া হয়ে গেছিল। কিন্তু এবার লতা বললেন তিনি বাকি গানগুলো আর গেয়ে দিবেন না। যদি গাওয়াতে হয় তবে সবগানগুলোই (মানে যেদুটা রুনা গেয়ে ফেলেছে  সে দুটা সহ) আবার তাঁকে দিয়েই গাওয়াতে ও রেকর্ডিং করাতে হবে।  প্রযোজক বাধ্য হয়ে সেই শর্ত মেনে নিয়েছিলেন। অর্থাৎ ফলাফল হল এই যে লতার একচেটিয়ার হাতে গান জিনিষটাই জিম্মি হয়ে থেকে গেছিল।

এমনকি পশ্চিমবঙ্গের রানাঘাট রেল স্টেশনে বসে গায়ে গেয়ে  পয়সা তুলে পেটের ভাত যোগাড় করা রানু মন্ডল কিভাবে যেন ঐ গান গেয়েই আধুনিক জগতের টিভি-রেকর্ডিং স্টুডিও পর্যন্ত পৌছে গিয়েছিলেন। তাকেও সহ্য করতে পারেন নাই লতা। বলেছেন রানুরা যেন আগে তাঁর গাওয়া বা রেকর্ডেড হওয়া গান কোন না করেন। কেন? তাঁর গাওয়া সব গানের সব ক্রেডিট কী তাঁর একার? সুরকার, লিরিসিস্ট, এরেঞ্জার, বাদকেরা ইত্যাদি আর কারও কোন অবদান নাই?? শেষ বয়সে এসেও এত উদ্ধত কেন? আচ্ছা তিনি যেটা “শ্রদ্ধাঞ্জলি” নামের প্রায় ৪৫ মিনিটের যে এলবামটা বের করেছেন স্টেজে গেয়েছেন সেটা তো চল্লিশের দশকয়ের গান থেকে শুরু করা হয়েছে যেগুলোর বেশির ভাগই তো অন্যের গাওয়া। তাহলে সেগুলো তিনি ফিরে গেয়েছেন কেন? আবার তারই গাওয়া গান অন্যেরা একালে গাইতে গিয়ে কোন নতুন নোট লাগানো এবং উপযুক্ত কারিশমায় গায়কিতে তা উপস্থাপন কী করা যায় না – এমনকি নয়া কোন এক্সপেরিমেন্ট নি্রীক্ষা করতেও কী তিনি দিবেন না!!!  শুনেছি রানু এখন সবছেড়ে  ফিরে গেছে তার পুরান রেল স্টেশনে…।
এই একচেটিয়াত্ব ও ঈর্ষার শিকার হওয়া থেকে লতারই ছোট বোন আশা ভোঁশলেও বাদ যায় নাই। এসব দিক নিয়ে আরও জানতে আগ্রহিরা ভারতেরই দুটা আর্টিকেল এখানেএখানে পাবেন।

[ফুট নোটঃ আসলে ইন্ডিয়ান ক্যাপিটালিজমের বিকাশ এই  ইতিহাস পাঠের এক বড় অংশ হতে পারে। আর তা ভালভাবে পাঠ করতে চাইলে এর এক ভাল  উপায় হতে পারে  – ভারতীয় সিনেমার বিকাশ  ও এটা একচেটিয়া পথ কেন সে অনুসরণ করল – সেটা স্টাডি  করা।  আর এখান থেকেই নেহেরুর তথাকথিত কমিউনিস্ট ইকোনমির মুখ থুবড়ে পরা পরিণতি এসবকিছুর স্টাডি  করতে হবে সেক্ষেত্রে। এসবই পরিণতিতে ইন্ডিয়ার প্রথম “ব্যালেন্স অব পেমেন্ট এর ক্রাইসিস ১৯৯১” তৈরি করেছিল। যেটাকে  বলা যায় আধা-বুঝের  নেহেরুর কথিত কমিউনিস্ট ইকোনমি কিভাবে আইএমএফের কাছে মুখ থুবড়ে সারেন্ডার করেছিল আর পরে  ব্যাপক সংস্কার করে নিজের ইজ্জত রক্ষা করেছিল এরই ইতিহাস!  ভারতীয় সিনেমা একচেটিয়া ভাবেই বিকশিত হয়েছে, মূলত এমন নেহেরুয়ান অর্থনীতির কারণে। এটাই লতার একচেটিয়া বা নিজে ‘শ্রেষ্ট’ হয়ে থাকার খায়েস – এসবকে কতটা পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে তা নিয়ে কোন এক আগামিতে দেখা হতে পারে… ]

 

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

 

[এই লেখাটা  দৈনিক  “নয়াদিগন্ত” পত্রিকার  ১২ ফেব্রুয়ারি  ২০২২ ওয়েবে আর পরদিন প্রিন্টে    আমাদের স্মৃতি ও অসংবেদী লতা” – এই শিরোনামে  ছাপা হয়েছিল।   ঐ ছাপা হওয়া লেখাগুলোকে আমার লেখার ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ বলা যায়।  আর আমার এই নিজস্ব সাইটের লেখাটাকে সেকেন্ড ভার্সান হিসাবে এবং  থিতু ভাষ্য বলে পাঠক গণ্য করতে পারেন।  আসলে পরবর্তিতে ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ লেখাটাকেই এখানে আরও অনেক নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে ও নতুন শিরোনামে এখানে আজ ছাপা হল। ]

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s