মোমেন এটা কী করলেন?


মোমেন এটা কী করলেন?

গৌতম দাস

২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২

গত দু-একদিন ধরে একটা ভিডিও ক্লিপ ফেসবুক মাতিয়ে বেড়াচ্ছে, সেখানে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন কিছু বক্তব্য রাখছেন। এই ধরণের ছবি বা ক্লিপে মোমেনকে দেখে আমাদের কারই ভাল লাগে নাই। আভ্যন্তরীণ ভাবে সরকার বিতর্কিত হতে পারে কিন্তু মোমেন বিদেশে বাংলাদেশের ইমেজের -প্রতিরূপই থাকেন! ফলে আমাদের সবার জন্যই এটা ম্যাটার করে! এঘটনায় সরকারের মানে বাংলাদেশের ইমেজ আরও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
বাংলাদেশের মানুষের কাছে এটা মোটেই সুখকর চিত্র নয় যে তাদেরকে প্রতিনিধিত্বের নামে কেউ বিদেশিদের একাংশের কাছে কাকুতি-মিনতি করছে…!! তাও আবার সেটা ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সামনে – যেখানে বডি ল্যাঙুয়েজ আর ঘটনা ল্যাঙ্গুয়েজ আর পুরা সেটের সেটিংটা হল যে জয়শঙ্কর স্টেজে ডায়াসে আর মোমেন আমজনতা স্তরে নিচে……। আর জয়সঙ্কর আমাদেরকে বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে জ্ঞান দিচ্ছে …… বাহ বাহ কি দৃশ্য!
আসলে ওটা ছিল মোমেনের মুরোদ দেখানোর বেস্ট সুযোগ। জয়শঙ্করের আপত্তি হল চীনা বিনিয়োগ আমরা কেন নিয়েছি। আর চীনা বিনিয়োগ নেয়া মানেই –  তার চোখে, এমন এয়ারপোর্ট বানানো যেখানে কোন বিমান ল্যান্ড করে নাই ইত্যাদি।
আর এখানেই মোমেনের জিজ্ঞাসা করা দরকার ছিল ভারত আমাদের বিআরটিসি-কে লোন (কথিত লাইন অব ক্রেডিট)  দিয়ে ডুবিয়ে দিয়েছে কেন? গত তের বছর ধরে বিআরটিসি এক অলাভজনক গলার কাটা, সরকারি রাজস্ব থেকে উলটা ভর্তুকি দিয়ে এটা টিকিয়ে রাখত্বে হয়েছে। কারণ সর্বশেষ ভারতের লিল্যান্ড-সহ নিজ  অচল গাড়ি কোম্পানিগুলোকে টিকিয়ে রাখতে ভারত সরকার প্রায় দুশ কোটি টাকা ওসব কোম্পানিগুলোকে পরিশোধ করে দেয়। আর এখন ঐ কোম্পানিগুলোর অবিক্রিত গাড়িগুলো কোন দাম যাচাই ছাড়া ইচ্ছামত দামে আমাদেরকে কিনতে বাধ্য করা হয়েছে। আর ঐ দুশকোটির টাকার (এর আগেও দফায় দফায় এই) ঋণ ও এর সুদ বইতে দায় চাপিয়েছে আমাদের উপর, এটাই লাইন অন ক্রেডিট কথার মানে।
তাহলে অলাভজনক এয়ারপোর্ট প্রকল্প ঋণের মত আমাদের অলাভজনক বিআরটিসি কোম্পানিকে ডুবিয়ে দেওয়ার কাজটা কী জয়শঙ্কর সাহেব করেন নাই???
মোমেনের উচিত ছিল এই জবাবদিহিতা জয়শঙ্করের কাছে চাওয়া…। এটা হতে পারত স্মার্ট পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মত কাজ।এছাড়া একই রকম যেসব চীনা বিনিয়োগ ভারত নিয়েছে মোদির প্রথম পাঁচ বছরে সেসব প্রকল্পের তথ্য ভারত ওয়েব সাইট থেকে সরিয়ে রেখেছে কেন? ভারতে চীনা বিনিয়োগের তথ্য আগে জয়শঙ্করের উচিত পাবলিক করে দেয়া। এরপর অলাভজনক এয়ারপোর্ট প্রকল্প ঋণের গল্প আমরা শুনতে রাজি হব। এটাই সমান সমান হতে পারে তাই না!!!!
মোমেন কোন অনুষ্ঠানে গিয়ে আপনাকে সাধারণ্যে বসতে হতেই পারে, এড়ানো যায়না এমন স্তরে বা পরিস্থিতিতে। কিন্তু সেক্ষেত্রে তাই বলে সেটাকে আরও কোন রাজ-সভাসদের অর্থ তৈরি করতে পারেন না – যেখানে আপনাকে অনুগ্রহপ্রার্থি প্রজা মনে হয় এমন পরিস্থিতি নিজেকে নিচা দেখানোর বা নিচে ফেলার তো দরকার নাই! নাকি???
ওখানে ভুলে যাওয়া হয়েছে যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন আপনি ওখানে ব্যক্তি মোমেন নন। আপনি সেখানে অবশ্যই সব রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের সাথে সমান মর্যাদার আরেক ও নিজ রাষ্ট্রের প্রতিনিধি। কিন্তু মোমেনের বক্তব্য দেয়া আর প্রশ্ন করার মধ্যে সেটাই অনুপস্থিত ছিল। যেন ব্যক্তি মোমেন কিছু বাকা প্রশ্ন করতে চাইছেন, মান-অপমানের কথা ভুলে।
ঘটনা হল বাংলাদেশ চীনের সাথে গভীর সম্পর্ক গিয়ে নিজেকে জড়িয়েছে। সুনির্দিষ্ট এখনকার বাংলাদেশ সরকার সঠিক বা বেঠিক যেভাবেই হোক তা করেছে। কিন্তু সেজন্য আমরা কারও কাছে জবাবদিহিতা করতে যাব কেন?? আমরা তা করতে যেতে পারি না! সেজন্য মোমেন ইন্ডিয়ার মাধ্যমে প্রায় সত্তরটা দেশের কোন সভায় গিয়ে জবাবদিহিতা করতে যাবেে কেন? তাও কার্যত ভারতের জয়শঙ্করের মাধ্যমে???
মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্স বা এমএসসি [MSC], ১৯৬৩ সালে জন্ম নেয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর পরিস্থিতিতে গ্লোবাল সিকিউরিটি প্রসঙ্গে ডায়লগের একটা জোট। ওর নিজ ভাষ্য অনুসারে তা ট্রান্স-আটলান্টিক মানে আটল্যান্টিকের দুইপাড়ে মানে আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপ-কে নিয়ে করা এক জোট।
এখন কোন যুক্তিতেই আমরা ট্রান্স-আটলান্টিক ভূগোলের কেউ নই। অথবা কোন বড় অর্থনৈতিক স্বার্থ বা অর্থনীতির কেউ হই নাই। তাহলে আমরা এমএসসি তে গেছি কেন?? কোন সুখে?? আমাদের কোন স্বার্থই এখনও নাই, হয় নাই যে ওমন সভায় যাওয়া যখন প্রয়োজনীয় হয়েছে!! একমাত্র যদি আমাদের অপমানিত হবার সাধ না হয়ে থাকে! অথচ কার সামনে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে ক্ষমতা রক্ষার বন্দোবস্ত কখনও দুনিয়াতে কেউ অর্জন করতে পারে নাই।
এই হল সরকারের প্রথম মারাত্মক অসংগত আচরণ!
ফলে যেন নিচা হবার জন্য ওখানে মোমেন গিয়েছেন!
ঘটনা হল, ঐ এমএসসি সংগঠন জন্ম থেকেই কোল্ড ওয়ার যুগে এন্টি-সোভিয়েত এক ডায়লগের জোট। কিন্তু একালে সেসব হারিয়ে তা এখন কার্যত এক চীন-বিরোধী টান্স-আটল্যান্টিক জোট হয়েছে। তাও আবার এখন এমন এক সময়ে যখন ইইউ বাইডেনের সাথে আর এক সুরে নাচবে না, স্টেপ মিলাবে না – সেটাই এখন সবখানে একেবারেই স্পষ্ট। যেমন ইউক্রেন ইস্যুতে ইউরোপ বাইডেনের সাথে হাত ধরে হাটছে না, পা ফেলছে না…।
তাহলে সেরকম একটা জোটের সভায় গিয়েই হাসিনাকে তার চীনের সাথে সম্পর্কের গভীরে যাওয়াটা উচিত-অনুচিত যাই হোক, কেন তাকে তার সিদ্ধান্তের পক্ষে সাফাই গাইতে ঐ সভায় যেতে হবে?? আর জয়শঙ্করের কাছে কেন? সে কে??
কোয়াড জোট – তা অবকাঠামোর জন্য স্বল্পসুদের ঋণ দিবার সংগঠন নয় – এর সে মুরোদও নাই এটা তেমন জোটও নয়। সারা দুনিয়া এটা জানে। তাহলে কোয়াড এমন ঋণ দিতে পারলে তবেই আমরা কোয়াডে যাব অথবা চীন এমন ঋণ দিতে পারে কেবল এজন্যই আমরা চীনের কাছে গিয়েছি – এসব বয়ান তুলে ধরতে মিউনিখ যাওয়া কেন? আর অপমানিত হওয়া কেন? দুনিয়া সম্পর্কে আমরা কী এতই বেখবর??
প্রথমত ভুল অথবা সঠিক দিদ্ধান্ত আমরা যেটাই নেই না কেন কারও কাছে জবাবদিহিতার সম্পর্ক আমাদের হতেই পারে না। এর মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করার মত কোন কাজ কোন ঘটনাই থাকতে পারে না। অপমানিত হওয়া ছাড়া। আর সেটাই মোমেন করেছেন, যেকোন সম্ভবত কোন উপদেষ্টা, কারও বোকামি নির্দেশে।
কোয়াডের কথাই যদি এসময় মাথায় থাকে তাহলে এর বাস্তবতাটা হল এখন ইউরোপ-আমেরিকা একই চোখে ঘটনা দেখছে না। এমনকি কোয়াডের চার দেশই একই তালে নাই। অকাস সামরিক জোট গঠনই এর প্রমাণ। আবার পরিণতিতে অকাস (AUKUS) বা কোয়াড (QUAD) দুটাই স্থবির। বরং আমেরিকার বাংলাদেশে অবরোধ দেওয়ার গ্লোবাল পলিটিক্যাল সোজা মানেটা হল বাইডেনের কাছে অকাস বা কোয়াড কোনটাই আর ফোকাসে নাই। তার ফোকাস এখন বঙ্গোপসাগর- সেভেন ফ্লিট ইত্যাদি এসব। আর বঙ্গোপসাগর- সেভেন ফ্লিট মানেই ভারতের সাথে আমেরিকার জন্মের সর্ববৃহত স্বার্থ-সংঘাত হবে সেটা।
আবার খোদ ভারত-ই কী এখন কোন জোটে কারও সাথে আছে?? আজ বাইডেন তো কাল পুতিন – এই অবস্থায় চলে গেছে ভারত; পা কাঁপছে। ওদিকে পুতিনও ভারতের উপর ভরসা করে বসে নাই। তাহলে পুতিনের পাকিস্তানের ইমরানের সাথে ঘনিষ্ঠতার নয়া যুগ শুরু করত না। ইমরানের সাম্প্রতিক রাশিয়া সফর ইঙ্গিত করে যে পাকিস্তানের জন্মের পরে এই প্রথম সে মেরু বদল করছে। যার মানে পুতিনের কাছে ভারতের চেয়ে পাকিস্তান বেশি গুরুত্বপুর্ণ এখন। তাহলে এই পরিস্থিতিতে ভারতকেই পুতিনের কাছে যেতে হবে নিজ তাগিদেই, সব অপমান বা তুচ্ছ হবার কথা জেনেই।
তাহলে মোমেন কোন ভারতের কাছে যাচ্ছে, নিজ চীনের সাথে সম্পর্ক এর সাফাই দিতে যাচ্ছে কেন? হাসিনার সরকারের ভারতের কাছে ঠেকা টা কোথায়? কে ভারত? কোন ভারতের কাছে সে যাচ্ছে??
এক হতে পারে যদি সরকার পরে যায় তো কর্মিদের আশ্রয়স্থল হতে পারে এমন কাজে লাগা ছাড়া এই “একাকী” হয়ে পড়া ভারত হাসিনার কেউ না। কোন কাজে লাগবে না। এটা হতেই পারে ভারতের মাধ্যমে আমেরিকা চলতি সরকারকে এককালে ক্ষমতায় বসিয়েছিল। কি সেই কৃত্যজ্ঞতা তো ২০১৪ সাল থেকে মিটে গেছে।
কেউ কার কাছে সাফাই দিয়ে ক্ষমতায় থাকা যায়নি, যাবে না।
আর মোমেন সাহেব কোন মিটিংয়ে যাবার আগে ঐ হবু মিটিংয়ের ফরমাট আগে জেনে নিয়ে তবেই তার যাওয়া উচিত। আপনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী। আপনাকে মাটিতে রেখে ডায়াসেে বসবে ভারতের জয়শঙ্কর – এই ফরমাট কখনও গ্রহণযোগ্য নয়। যেকোন ধরণের বাংলাদেশের সরকারের জন্যই এটা ইজ্জতের প্রশ্ন।
প্রটোকল প্রটোকল বলে চেচিয়ে লাভ নাই, প্রটোকল আগে বুঝতে হবে। কোন প্রটোকল চিন্তায় মোমেন সাহেব মিউনেখ গেছিলেন?? এখানে হাসিনার লাভালাভের চিন্তায় তিনি কিছুই হাসিল করতে পারেন নাই, উলটা তিনি বাংলাদেশের মান-সম্মান ডুবিয়ে দিয়ে এসেচেন।

সবশেষ হাসিনা সরকারের কী হবে এটা এখন অবজেক্টিভ বাস্তবতায় নির্ধারিত হবে। সাবজেক্টিভ কর্তা হিসাবে হাসিনা তাতে হাত ঢুকায়ে কিছুই আগাবে না – এমন শত মিউনিখ মিটিং সরকারকে রক্ষা করতে পারবে না! লাভের লাভ হবে অপমানিত হয়ে ফিরে আসা…! আর সেটাও সরকারের বিরুদ্ধেই যাবে।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com[লেখাটার প্রথম ভার্সান আজ (২২ফেব্রু ২০২২) সকালের সরাসরি আমার ফেসবুকে দেয়া হয়েছিল।
পরে তা আরও আপডেট করে, আমার এই ওয়েব সাইটে দেয়া হয়েছে। আর সেই ভার্সান টাই ফিরে লোড করা হল  আজই আমার ফেসবুকে এখনই সকাল ১১ঃ৩৪ এ।
এই আপডেটে অনেক নতুন তথ্য সংযোজন করা হয়েছে।]

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s