রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কী ডলারের বিকল্প এনেই ছাড়বে
০৭ মার্চ ২০২২, ০০:০৬ সোমবার
WHY GOLD? – Gold rises 2% on fear of Russia-Ukraine war
সারা দুনিয়াই এখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ইস্যুতে, একভাবে না একভাবে সংশ্লিষ্ট হয়ে গেছে। এবং বলাবাহুল্য তা পক্ষে অথবা বিপক্ষে। আবার এই যে কথাটা বললাম সেটাও নতুন কথা নয়। কেবল ফারাক হয়ত এতটুকুই যে, অন্যরা আমার মত করে নয় তারা তাদের মত করে অন্যভাবে বুঝে বলেছে।
তা হলে নতুন যে কথাটা এখন বলতে যাচ্ছি সেটা হল, গ্লোবাল নেতৃত্বে বদল এতে আরো আসন্ন হতে গতিপ্রাপ্ত হয়ে যেতে পারে। এ কথা আমি ২০১৪ সাল থেকে নিশ্চিত করে বলে আসছি। আসন্ন সেই গ্লোবাল নেতৃত্বে বদলের দিকে একটা গ্রেট লিপ [great leap] বা বড় পদক্ষেপে এগিয়ে যাওয়ার নতুন ঘটনাটাই হল ‘রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ’ – তবে এটা ঘটনার একদিক। মানে বাইরের দিক থেকে দেখে এটাকে কেবল ‘রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ’ -ই মনে হচ্ছে। অর্থাৎ বড় পদক্ষেপে বদলের বাইরে দিকটাই মানুষ দেখছে ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ’ হিসেবে। আসলে গ্লোবাল নেতৃত্বের নেতাদেশ বদল মানে – আমেরিকা নেতৃত্ব হারানো আর চীনের উত্থান ঘটা, এটাই ধেয়ে আসছে। আর আমেরিকা নেতৃত্ব হারাচ্ছে – এ ঘটনাটাকে মুখে বলা তা মোটেই ব্যক্তির ইচ্ছা না। এমনকি সে চীনকে বেশি পছন্দ করে কি না তাতেও কিছু এসে যায় না। এটা এক ব্যক্তি-ইচ্ছা-নিরপেক্ষ বাস্তবতা – এমন এক অবজেকটিভিটি। তাই তা সিরিয়াসভাবে আমল করার বিষয়।
সাম্রাজ্যের ইতিবাচক ভূমিকাঃ
এম্পায়ার [empire] বা বাংলায় ‘সাম্রাজ্য’ শব্দটা অনুসরণ করা যাক। বহু পুরনো এই শব্দ, দুনিয়া যখন শাসন বলতে কেবল রাজার শাসন বা রাজতন্ত্র বুঝত, সে আমলের। তখনকারই আরেক প্রায় সমান্তরাল শব্দ হল এই সম্রাট বা সম্রাটের সাম্রাজ্য। পরবর্তিতে সম্রাটের শাসন পর্ব বা যুগ শেষ হবার পরে ইউরোপে, অন্যের দেশ দখলদার – এটাই যেসব দেশের প্রধান পেশা ও ব্যবসা, পরিচয়, এমন সবচেয়ে বড় পাঁচ রাষ্ট্র হল – ব্রিটেন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, পর্তুগাল ও স্পেন – যারা সবাই ‘সাম্রাজ্য’ (যেমন ব্রিটিশ সাম্রাজ্য) বলেই পরিচিত ছিল। এমনকি তারা ১৬০০ সালের পরে এরা ততদিনে রিপাবলিক জাতি-রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে উঠে গেলেও।
আমাদের জন্য এখনকার প্রাসঙ্গিক কথাটা হল, কোনকিছুকে রাজ্য আর সাম্রাজ্য বলে ডাকার ক্ষেত্রে একটা বড় ফারাক হল, ছোট হলে রাজ্য আর বড় হলে সাম্রাজ্য এমন একটা চিন্তা অবশ্যই কাজ করত; যদিও এদের মূল ফারাকটা আরো গভীরে। যেমন ধরেন, রাজা আর সম্রাট উভয়ে খাজনা তুলে খায় এটা কমন। কিন্তু দুটোর ফারাক বা বড় অমিলের দিকটা হল, রাজা খাজনা নেয়ার বিনিময়ে প্রজাকে কিছু দিতে সে বাধ্য নয় অথবা শাসন-সম্পর্ক চর্চায় সেটা ছিল না। যেমন দুনিয়ার যত রাজা ছিল তাদের এসব অর্থ আদায় হত যেসব নাম দিয়ে সেগুলো লক্ষ্য করা যাক। প্রথমত বলে রাখি এদের নানা নাম থাকলেও এখানে কমন নাম আকারে, সব কিছুকেই ‘খাজনা বলছি’। যেমন, আমাদের পাহাড়ি এলাকায় রাজতন্ত্র অকেজো হয়ে গেলেও এখানে খাজনা আদায় হত ‘পুণ্যাহ’ এই নামে; এখনও এই নামে অনুষ্ঠানটা চালু আছে দেখা যায়। অর্থাৎ এখনো পাহাড়ি প্রজাদের [বাংলাদেশ রাষ্ট্র হয়ে গেছে বলে এই বিচারে পাহাড়িরা নাগরিক হয়ে গেলেও পুরানা রাজার বিচারে তারা প্রজা-ই ] থেকে তাদের রাজা অর্থ আদায় করতে পারুক আর না পারুক, সেই ‘পুণ্যাহ’ কালেকশন ও অনুষ্ঠানের স্মৃতি অন্তত রাজারা জারি রাখতে চান। রাজ-প্রশাসন বলে তেমন কিছু না থাকলেও তাদের সাংস্কৃতিক পরিসরে রাজার অনুভূতি থাকুক, এই চাওয়াকে কার্যকর রাখা হয় এ ঘটনায়। এখন এই শব্দটা পরীক্ষা করা যাক; এটা এক ধর্মতাত্বিক ইঙ্গিতমূলক শব্দ যা দিয়ে যেন বলতে চায় ‘খাজনা দেয়া পুণ্যের কাজ’। আর সারকথায় বলা যে, বস্তুগত লাভালাভের দিক থেকে কথাটার সোজা অর্থ হল, খাজনা দিলেও প্রজারা বিনিময়ে কিছু পাবে না।
এসব ক্ষেত্রে এমনই আরেকটা শব্দে খাজনা তোলার রেওয়াজ ছিল – ইংরেজিতে ‘ট্রিবিউট’ [tribute] শব্দে, যার একটা বাংলা করা যায় ‘শ্রদ্ধা’ জানানো। মানে হল যেমন, ভিজিটিং আওয়ারেই রাজাকে ভিজিট করতে গেছেন কিন্তু সেটাকে বলতে হবে – শ্রদ্ধা জানাতে গেছেন। এখানেই শেষ না। আপনি যে শ্রদ্ধা জানাতে গেছেন তা শুধু ‘ভাব-ভঙ্গিতে বুঝালে হবে না। পারিষদেরা বুঝবে কী করে যে রাজাকে আপনি শ্রদ্ধা-সালাম জানাতে গেছেন? সে জন্য আপনাকে নগদ অর্থ (অথবা জমির ফসল) দিতে হবে। দিলে পরে সেটাতে আপনার সালাম জানানোর ইচ্ছা প্রকাশিত হয়েছে, ধরা হবে। না, আমাদের বাংলা ভাষা বা সমাজেও দেখেন। সেখানে এটা এখনো তা আরেকভাবে চালু আছে। যেমন, কোন মার্কেটের দোকান ভাড়া নিতে গেছেন। মার্কেট মালিক বলছে ভাড়া মাসে তিন হাজার কিন্তু সাথে ‘সালামি’ দিতে হবে পাঁচ লাখ। এই সালামিটাই ইংরেজিতে ট্রিবিউট। সারকথায় রাজা মানে যারা সালামি, ট্রিবিউট, পুণ্যাহ ইত্যাদি নানান নামে খাজনা খায়। আর গুরুত্বপুর্ণ হল, বিনিময়ে রাজা প্রজাকে কিছু দেয় না। অথবা দিতে হবে এমন কোন অর্থ-ইঙ্গিত ওসব শব্দে থাকে না।
রাজা-সম্রাটের ফারাকঃ
আর ঠিক এ জায়গাটা হল রাজা-সম্রাটের ফারাক। যেমন সম্রাটের ক্ষেত্রেও, সারকথায় সম্রাটও সালামি, ট্রিবিউট, পুণ্যাহ ইত্যাদি যা আছে সব নেয়। কিন্তু একই সাথে প্রজাদের জন্য অনেক সামাজিক দায়-কর্তব্য সে নেয়। কেমন সেটা? গঞ্জ-হাট-বাজার অনেক পুরনো জিনিস। সেকালে যে সম্রাট সে হয়ত এমন কমন জায়গার বাজারটা পাকা করার দায় নিবে, বর্ষাকালে খুব কষ্ট হয় তাই। এছাড়া বণিকদের হাটে আসা-যাওয়া চলাচলের নিরাপত্তা দিবে; সে জন্য পাইক-পেয়াদা নিয়োগ দিবে। এক কথায় কমন গুড [common good] মানে সবার কাজে লাগে, এমন কাজকর্মে সম্রাট মনোযোগ দিবে। সম্রাট জানে, এতে হাটবাজারে ব্যবসাটা ভালো জমলে খাজনা-আয় আপোষেই ভাল হবে। তার ভাবনা হল, এসব মিউনিসিপাল বা সিভিক [civic] সার্ভিস বাড়িয়ে দিয়ে যদি এবার খাজনা একটু বেশি চাই হাটের মানুষ তাও দেবে। এই হল সাম্রাজ্য ব্যবস্থা শুরুর গুরুত্বপূর্ণ দিক। এটাই ‘সাম্রাজ্য’ ধারণা ও শব্দটার বড় কিছু ইতিবাচক দিক; আর যদিও সাম্রাজ্যের বড় বড় অনেক খারাপ দিক দিয়েই মানুষ ধারণাটাকে চিনে থাকে।
উপরে সাধারণভাবে যেকোন সাম্রাজ্যের বেলায় কথাগুলো প্রযোজ্য এমন অনুমানে কথাগুলো বলা। তবে আমাদের সাবধান হতে হবে ১৯৪৫ সালের আগের (১৬০০-১৯৪৫) সাড়ে তিন শ’ বছরের ইউরোপ নিয়ে; এ সময়ের তাদের দেশের সাম্রাজ্য শব্দটার অর্থ আমাদের মত এশিয়ান দেশের অভিজ্ঞতায় পুরাটাই নেতিবাচক ছিল; কারণ সাম্রাজ্য তৎপরতা বলতে তখন এর একটাই অর্থ, যারা কলোনি দখল ও শাসন করে। সাম্রাজ্য মানেই অন্যের দেশকে কলোনি দখল – এই দিকটা অনেক ভারী ও প্রধান ছিল।
তবে ১৯৪৫ সালের পরে আমরা প্রথম দেখলাম এক নতুন ধরনের আমেরিকা শুধু না, সেটা একটা কলোনিমুক্ত দুনিয়াও বটে। তবে না এটা আবার কোন সম্রাটের রাজতন্ত্র ছিল বরং ছিল নাগরিকের ক্ষমতায় নির্বাচিত এক আমেরিকান রিপাবলিক। ফলে সেই অর্থে এখানে কোনো আমেরিকান সম্রাট থাকে নাই। কিন্তু এই আমেরিকার হাতেই তবু ১৯৪৫ সালের পরে – সেই প্রথম দুনিয়াতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তার নেতৃত্বে এক গ্লোবাল পলিটিক্যাল ও ইকোনমিক ব্যবস্থা ও শৃঙ্খলা তৈরি করা হয়েছিল বলে বুঝা যেতে পারে; এবং এর খারাপ-ভালো সব দিকসহ-ই। কমিউনিস্টরা এই আমেরিকান কর্তৃত্বকে বিশেষ করে ১৯৫৩ সালের পরের আমেরিকাকে ‘আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ’ বলে থাকে এবং তা বলার পক্ষে এমন আমেরিকান ভূমিকাও আছে; যেমন সিআইএ পাঠিয়ে কোনো দেশে ক্ষমতা দখল ও সরকার বদল এবং তা বিশেষত প্রাকৃতিক সম্পদ দখলের উদ্দেশ্যে। কিন্তু একই সাথে এই আমেরিকার এম্পায়ার রোলও আছে। যেটাকে আগে সাম্রাজ্যের ব্যতিক্রমী ইতি ভূমিকা বলেছি, তেমন এক ধারাবাহিকতা যেন, যেটা আমেরিকা একালেও পালন করেছে। কিভাবে?
সেকালে সম্রাট যেমন রাজার চেয়ে এগিয়ে গিয়ে বসে বসে চাঁদা-খাজনা খাওয়া নয় – প্রজাদের সার্ভিস দেয়ার কাঠামোতে হাজির ছিল এবং এই বিনিময়ের মাধ্যমে একটা রাজ্য-প্রশাসন বা সাম্রাজ্য খাড়া করে ফেলা যার মুখ্য অবদান; ঠিক তেমনি ১৯৪৫ সালের পরে, আমেরিকা এক ইতি-এম্পায়ার ভূমিকাও নিয়েছিল। কারণ এক নয়া গ্লোবাল সিস্টেম সে গড়ে তুলতে চেয়েছিল।
যার পিছনের কারণ গ্লোবাল সিস্টেমের নেতা হতে গেলে পজিটিভ এম্পায়ারের দায়-ভূমিকা যা থাকে সেটাও পালন করতে হয় এবং তা করে বলেই তো সে গ্লোবাল নেতা। উদাহরণ, যেমন চলতি শতকের শুরু থেকেই, ব্যাপারটাকে ভাল / মন্দ যা বলেই দেখি, আমেরিকা রাষ্ট্র নিজে চলতে গিয়ে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি এই বেকায়দায় পড়ে সভরেন-লোন নিয়ে চলতে শুরু করেছিল আর তা, এখনও। সভরেন লোন [sovereign loan] মানে এখানে খোদ রাষ্ট্রকেই বন্ধক রেখে গ্লোবাল পুঁজিবাজার থেকে ঋণ নেয়া, আর এভাবেই ঋণ করে খরচ চালানো একটা দেশ আমেরিকা। আর সে-জন্য প্রায়ই আমেরিকাকে নিজ সংসদ থেকে নতুন লোন নেবার অনুমতি নিতে বা লিমিটটা বাড়িয়ে নিতে হয়। আর এনিয়ে প্রতিবারেই এক-দুই সপ্তাহের নাকানি-চুবানি খায় আমেরিকান প্রেসিডেন্টের। একবার ওবামা আমলে প্রেসিডেন্টের এমন নাকানি-চুবানি চলছিল কিন্তু এরই ভিতর ডব্লিউএফপি WFP (বিশ্ব খাদ্য সংস্থা – জাতিসঙ্ঘের খাদ্য সহায়তা-বিতরণ প্রতিষ্ঠান)-কে দেয়া তার রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য ওবামা এক শ’ মিলিয়ন ডলার ফান্ড রিলিজ করছেন। কারণ, ডব্লিউএফপি এই ফান্ড ব্যবহার করেই সোমালিয়ায় ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য খাদ্য পাঠানোর অপেক্ষায় ছিল। অথচ তখন আমেরিকার নিজ-বাজেটে অর্থ বরাদ্দ নেই বলে যারা বিভিন্ন সেক্টরে দিন-ভিত্তিতে স্যালারি পান এমন আমেরিকার সরকারি কর্মচারীদের ‘কাজ নাই’ বলে বাসায় রেখে দিতে হয়েছিল।
অর্থাৎ, নিজের অবস্থা যাই হোক, ডব্লিউএফপি-কে প্রতিশ্রুত অনুদানের ফান্ড আগে রিলিজ করতে হবে – এই হলো গ্লোবাল রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক এক ব্যবস্থায় গ্লোবাল নেতার ইতিবাচক দায়-ভূমিকা তাকে অগ্রাধিকারে পুরণ করতেই হয়েছে; যা পুরনো স্টাইলে বললে এটা ‘এম্পায়ারের ইতি-দায়’ বলা যায়। আমি অনেকবার লিখেছি, কোনো রাষ্ট্র গ্লোবাল নেতা হতে হলে এর একনম্বর শর্ত হল তার অর্থনীতিকে অবশ্যই উদ্বৃত্ত অর্থনীতি হতে হবে, মানে ভাল পরিমাণে সারপ্লাস বা উদ্বৃত্তের সম্পদ থাকতে হবে। এমন হতে হবে, যাতে দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতে নয়া অবকাঠামোগত খাতে স্বল্পসুদে ঋণ পাবার যে চাহিদা আছে তা নেতা দেশকে পূরণের যোগ্যতা সামর্থ্য থাকতেই হবে। যে যোগ্যতার জন্যই সে পজিটিভ এম্পায়ার, ফলে সে গ্লোবাল নেতা।
গ্লোবাল ইকোনমিতে আরও ভাল একটি উদাহরণে যাওয়া যাক; গ্লোবাল ইকোনমি ও চলতি করোনা ভাইরাস প্রসঙ্গে। গ্লোবাল ইকোনমি কখনও ফেল করলে, খারাপ অবস্থায় পতিত হলে এটা কোনো খুশির খবর নয়। আমরা দুর্ভিক্ষ দেখেছি। “সারপ্লাস ভ্যালু চোরেরা” এবার ‘ধরা খাইবে’ যুক্তিতেও তাই এটা খুশি হওয়ার বিষয় নয়। দুর্ভিক্ষ বা জীবনের ন্যূনতম চাহিদা পূরণ না হওয়ায় তা-জনিত কোন মানুষের মৃত্যু কাম্য বিষয় নয়। তাই গ্লোবাল ইকোনমিকে পতিত বা ফেল করে যাওয়া থেকে বাঁচানোর ক্ষেত্রে গ্লোবাল নেতার এক বিরাট দায়-ভূমিকা আছে থাকে, মানুষ ও বিশ্ব তা আশাও করে।
গ্লোবাল নেতার কী করার আছে এখানে?
করোনার টিকার পূর্ণ ডোজ নিলে আর করোনা হবে না অথবা শতভাগ করোনামুক্তি মিলবে, টিকা উৎপাদকেরাও কখনো এমন কথা দাবি করে না। তাহলে টিকা নিয়ে এত কী হৈচৈ, কাজ? কোনো “লকডাউন’ বা সব অর্থনৈতিক তৎপরতা বন্ধ যেটা প্রায়ই করতে দেখা যায় এর বিরুদ্ধে আবার যদি মানুষ উঠে দাঁড়াতে চায়, আর এতে ন্যূনতম অর্থনৈতিক তৎপরতা যদি চালু করতে চায় তাহলে মানুষের হাতের নাগালে আছে আর যা কিছু পরিমাণ প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যা কিছুটা কাজ করে এমন একমাত্র উপায় হল টিকা – পাবলিককে টিকা দিয়ে নেয়া। যত দ্রুত দেশের বেশির ভাগ যোগ্য নাগরিককে তা দেয়া যায়। তাহলে এর অর্থ দাঁড়াল যে, গ্লোবাল অর্থনীতিকে যদি ফিরে দাঁড়াতে হয়- যতটা সম্ভব ফিরে উঠে দাঁড়ানোর ব্যাপারটা সে ক্ষেত্রে নির্ভর করে মানুষের কাছে টিকার প্রাপ্যতা, টিকা কিনবার ফান্ড যোগান দেয়া আর ম্যানেজমেন্ট – যাতে সুষ্ঠুভাবে টিকা দেয়ার কাজটা সুচারুভাবে করা যাবে বা গেছে কি না এর ওপর। অর্থাৎ টিকা ধনন্তরী না হলেও বন্ধ অর্থনীতি থেকে বের হবার হাতের নাগালে থাকে আপাতত এমন একমাত্র উপায় হল টিকা। আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতায় তাই দেখা যাচ্ছে। আর এখানে গ্লোবাল নেতার বিরাট ভূমিকাটা হল, এখানেই এই তিন কাজে বিনিয়োগ জুটিয়ে আনা। কারণ টিকা উৎপাদন বা ক্রয়ে সামর্থ্যহীন অথবা লাইসেন্স দিলেও যে উৎপাদন করতে পারবে না; এমনকি টিকা শুধু পৌঁছে দিলেও হবে না; তা ঠিকমতো পুশ করার ম্যানেজমেন্টেও সহায়তা লাগবে এমন গরিব দেশ কম নয়, বরং এরাই সংখ্যায় বেশি। এ ছাড়া বড়লোক দেশগুলো নিজে সবাই টিকা নেয়ার পরও আরো দ্বিগুণ টিকা মজুদ করে রেখেছিল তাতেও “নয়া” করোনার বিস্তার ঠেকেনি। এমনকি এভাবে রেখে তারাও “নয়া” করোনার হাত থেকে বাঁচবে না। কারণ আফ্রিকায় টিকা না দিলে সেখান থেকেই এই ভাইরাস আরো ভয়ঙ্করভাবে নতুন ভ্যারিয়েন্ট বা নতুন রূপ নিয়ে আবার সারা দুনিয়াতে ছেয়ে যাবে। আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা তাই বলছে, আমরা ওমিক্রনে এসে ঠেকেছি।
তা হলে এখন বিচার করা যাক আমেরিকা বা চীন কে কতটা এ জায়গাটায় গ্লোবাল ভূমিকা দেখিয়েছে; বিনিয়োগ করেছে? আফ্রিকার সব বয়সের মিলিয়ে মোট জনসংখ্যা ১.২ বিলিয়নের মত। চীন একাই আফ্রিকাতে এক বিলিয়ন টিকা দেয়ার প্রতিশ্রুতি পূরণের চেষ্টায় রত হয়েছে। আর আমেরিকার একা নিজ প্রোগ্রামের কোনো প্রতিশ্রুতি ছিল না। বড়লোক দেশের জোট জি-৭ হিসেবে- ডব্লিউএইচও বা (হু WHO)-এর কাছে এদের সম্মিলিত প্রতিশ্রুতি ছিল এক বিলিয়ন ডোজের যা তারা এখনো টার্গেটের ধারে কাছে নাই বলে অভিযোগ। তবে WHO-কে দেয়া ওই মজুদ থেকেই (আমেরিকার অনুরোধে) হু আমাদের দেশে যত যা মডার্না ফাইজার টিকা সরবরাহকারী। আর ঢাকার একাংশসহ সারা দেশের জন্য এখনকার টিকার একমাত্র সরবরাহকারী চীন। আর আমার জানা মতে, চীনের এখনকার টিকাগুলো একেবারে বিনাপয়সায় আমাদের দেয়া। এ ছাড়াও অল্প কিছু টিকা জাপান থেকে এসেছে, আমেরিকা-ভারতের মুখরক্ষা করতে। কারণ টিকা-ইস্যুতে কোয়াডের ভিতরেই ক্যাচাল, মনোমালিন্য, অভিযোগের শেষ নাই। আর বড়কথাটা হল, বাইডেনের আমেরিকাই কোয়াডে টিকার জন্য অর্থ দেয় নাই, দিয়েছে জাপান। টিকার গ্লোবাল দায়-ভুমিকায় আমেরিকা নাই নয়ত পিছিয়ে। আবার সেকালেই ভারতের অভিযোগ তাকে কোন অনুদানের অর্থ দেয় নাই। আর টিকার কাঁচামাল পেতে আমেরিকা বাধা দিয়েছে।
অর্থাৎ টিকা প্রশ্নে এরই মধ্যে গ্লোবাল ভূমিকা দেখাতে এগিয়ে আসার ক্ষেত্রে, আমেরিকার চেয়ে চীন অনেক বেশি গ্লোবাল নেতার ভূমিকা নিয়ে নিয়েছে। করোনা গত ২০১৯ সালের শেষের দিক থেকে বিশ্ব ছেয়ে ফেলা শুরু করেছিল। আর ২০২০ সালে ছিল ওর প্রথম ভয়ঙ্কর প্রকোপ। অথচ আমেরিকার মতো দেশের প্রেসিডেন্ট এটা আদৌ কোনো সিরিয়াস ভাইরাস নাকি সাধারণ সর্দি-কাশি এসব নিয়ে মশকরায় দিন কাটিয়েছেন। মজার কথা হল, যড়যন্ত্র-তত্ত্ব বিশ্বাসী কিছু কমিউনিস্টরা বলে থাকেন, করোনার আবির্ভাব নাকি বিল গেটসের ‘জীবাণুযুদ্ধের ষড়যন্ত্র’। আর এনিয়ে খোদ ট্রাম্পের অবস্থানও এর কাছাকাছিই ছিল, যেটা আবার এখন পুরোই উদাম। সর্বশেষ কানাডায় ট্রাক ড্রাইভারদের দিয়ে ভ্যাকসিনবিরোধী আন্দোলনে এসে দেখা গেল ইউরোপের যড়যন্ত্র-তত্ত্ব বিশ্বাসী কমিউনিস্ট আর আমেরিকা-কানাডার কনজারভেটিভ বা হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট এরা দু’পক্ষই ভ্যাকসিনবিরোধিতার প্রশ্নে একাকার। দুনিয়াতে এমন ঐক্য সম্ভবত এই প্রথম; সত্যিই বিরল! সবশেষে কানাডার আদালত তাদের এই কথিত আন্দোলনকারীদের ইজ্জত-সম্মান বাঁছিয়েছেন, আদালত আন্দোলনকে অবৈধ ঘোষণা করে সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে।
আমেরিকার গ্লোবাল নেতাগিরির দিন যে ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে তা নিয়ে বাইডেনের পূর্বসূরি ট্রাম্প বা তার দল-গোষ্ঠীর অবস্থান। ট্রাম্প বলতে চাচ্ছিলেন যে, আমেরিকার জন্য তার আমলে গ্লোবাল দায়-দায়িত্ব নেয়া বিশাল ভারী হয়ে উঠেছে। অতএব ভানুর কৌতুকের মত, “তাহলে যুদ্ধেই যাবো না”; অর্থাৎ আমেরিকা আর ইকোনমিক গ্লোবালাইজেশন এবং আমেরিকান গ্লোবাল রোল এর কোনোটাতেই আর থাকবে না। তাই সম্ভবত টিকা নিয়ে ফাজলামির রাস্তা নিছিলেন তিনি। এ ছাড়া আরো যেমন – ট্রাম্প ন্যাটো ভেঙে দিতে চান; এছাড়া এটা রাখার দরকার কী – ইউরোপ কোন খরচের দায় নেয় না ধরণের যুক্তি তুলেছিলেন। আর ১৯৪৫ সাল থেকে জার্মানি-জাপানে মার্কিন সেনা ও ব্যারাক আছে; আর একালের আফগানিস্তান থেকেও সব সেনা ফিরিয়ে আনতে চান, অবস্থান নিয়েছিলেন। এসবই ছিল গ্লোবাল নেতৃত্ব ছাড়তে চান এর ইঙ্গিত-ততপরতা। আর সবশেষে ৬ জানুয়ারি ২০২১ ট্রাম্প প্রকাশ্যেই ‘হোয়াইট সুপ্রিমিস্টদের’ হাতে সংসদ ভবন আক্রমণকে সমর্থন করেন। বলা যায় করিয়েছিলেন ও এর বিল্ডিংয়ের মাথায় উঠে নৃত্য করান। তাহলে এই হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট কারা, কী তাদের পরিচয় ও চাওয়া, আর কেন ট্রাম্প তাদের সমর্থন করেন বা নেন?
সব প্রশ্নের জবাব একখানেঃ
সব প্রশ্নের জবাবের মাথা একখানে – চীনের কাছে আমেরিকার গ্লোবাল নেতৃত্ব, অভ্যন্তরীণ বাজার ও অর্থনীতি সবকিছু ক্রমশ হারানোতে আমেরিকান সাধারণ মানুষের মনে ক্ষোভ থেকে উঠা বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ার একটা হল হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট হয়ে যাওয়া বা এর সমর্থক হয়ে যাওয়া। এরা বলতে চায় আমেরিকা অর্থনীতির পিছিয়ে পড়া, ডুবে যাওয়া, কাজ-ব্যবসা হারানো, সচ্ছলতা কমে যাওয়া – এসব কিছুর কারণ একটাই। তা হচ্ছে, আমেরিকা হল সাদা ককেশীয় নীল-চোখের মানুষের দেশ। কিন্তু সেখানে আজ কালো আর বাদামি সারা দুনিয়ার মানুষে ভরে গেছে। আর এরা আমেরিকায় ছেয়ে বসে যাওয়াতেই এদের ভারে তাদেরই কাজ না পাওয়া বা সম্পদ ভাগাভাগিতে সঙ্কট এসেছে। অতএব তাদের বয়ানের সারকথাটা হল – আমরা সাদারাই শ্রেষ্ঠ ছিলাম; এখন সেই পুরানা জমানাটাই ফেরত আনতে হবে। কাজেই দুনিয়াতে আমাদের গ্লোবাল দায়-দায়িত্ব নেওয়ার কাজ কী? আমাদের তা নিতে হবে কেন? এসবের অর্থে এরা বুঝুক না বুঝুক, যা তারা দাবি করছে এর বাস্তবায়ন-যোগ্যতা দুনিয়ায় থাকুক না থাকুক এরা এক এন্টি-গ্লোবালাইজেশন অবস্থানে ঢুকে পড়েছে। আর এখানেই কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্রবাদীদের সাথে অজান্তেই তাদের অবস্থানগত মিল হয়ে গেছে। অথচ এরা খবর নেয় নাই যে, তাদের আমেরিকাই গত পঁচাত্তর বছর ধরে সারা দুনিয়াকে গ্লোবাল বাণিজ্যের গ্লোবালাইজেশনে টেনে নিয়ে গেছে। এখন খিচুড়ি একবার রান্না হয়ে গেলে কি আর চাল-ডাল আলাদা করা যায়? সেই অবস্থা! তেমনি এক বেচারা অবস্থায় এরা ও তাদের আমেরিকা! এছাড়া আবার গত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রধান সমর্থক এই সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদীরাই। মাঠের বিচারে এরাই মূল ফাইটার।
তা হলে গ্লোবাল কর্তৃত্ব হারাতে থাকা আমেরিকার অর্থনৈতিক এলোমেলো দুর্দশা দেখে থেকে এর একটা প্রতিক্রিয়া যদি হয় ট্রাম্প, তাহলে এরই আরেক প্রতিক্রিয়া (মুদ্রার অপরদিক) হল বাইডেন। বাইডেন বলতে চাইলেন তিনি অনেক বোঝেন – কাজেই তাদের প্রাণের আমেরিকা হারতে, হারাতে পারে না। কারণ তিনি জানেন আমেরিকার হাতে চীন-রাশিয়াসহ যে কেউ দেশের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার মত দুই মারাত্মক অস্ত্র আছে, যেটার কথা অন্যরা বুঝেইনি। এর একটা হল, বেয়ারা যারা এমন রাষ্ট্র ও ব্যক্তির উপর অর্থনৈতিক অবরোধ (sanction) আরোপ আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে ধরা। এ দুটো ব্যবহার করলেই আমেরিকাকে আর কারো কাছে গ্লোবাল নেতৃত্ব হারাতে হবে না। আর এ’কাজটারই এক ব্যবহারিক রূপ-পদ্ধতি বিষয়ক ঘটনা হল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। যেমন, রাশিয়া যখন ইউক্রেন আক্রমণের সিদ্ধান্ত জানিয়েছে কিন্তু একশনে যায়নি তখনই আমেরিকান প্রতিক্রিয়া হল, রাশিয়ার উপর স্যাংশন আরোপ। অর্থাৎ বাইডেন যে অনুমানের উপরে চলতে চাইছেন তা হল, আমেরিকা রাশিয়ার সাথে কোনো প্রত্যক্ষ যুদ্ধে যাবে না; আর সে অনুযায়ী তিনি (যুদ্ধের খরচ দিবার ফলে এর সব নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা আছে বলে) বলিয়েছেন, ন্যাটো কোনো “নো ফ্লাই জোন আরোপ করবে না”। মানে ন্যাটোও যুদ্ধে জড়াবে না। তবু কেবল অবরোধ আরোপ করেই নাকি বাইডেন সব দিকে জিতে আসবেন। কেন তা ঘটবে? কারণ, তিনি মহা-অস্ত্র “অবরোধ” তা ব্যবহার করে দিয়েছেন! আর এতে মনে হচ্ছে বাইডেন “অবরোধ” নামের সোনার ডিম দেয়া হাঁসের পেট কেটে সব ডিম বের করার পথে রওনা দিয়েছেন! তাই এনিয়ে নিচে এক প্রফেসরের বক্তব্য শুনে শেষ করব।
সব কিছুতেই একই অবরোধ-নির্ভরতার অর্থ কী?
হংকং থেকে পরিচালিত গ্লোবাল পুঁজিবাজার অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের এক পত্রিকা “এশিয়া টাইমস”(Asia Times)। তারা অবরোধকে প্রসঙ্গ করে প্রধান এক রিপোর্ট করেছে। আর সেখানে এক্সপার্ট হিসেবে কথা বলেছেন আইএমএফের এক সাবেক চিফ ইকোনমিস্ট কেনেথ রগঅফ (Kenneth Rogoff); যিনি বর্তমানে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরও। তার শেষ কথাটা দিয়েই শুরু করিঃ
এমনিতেই আমেরিকা যেকোনো স্যাংশন আরোপ বলে যা করছে এর পেছনে আইএমএফের কোনোই অনুমোদন নেই। তবু এমন এই অতিমাত্রায় স্যাংশন বা অবরোধের ব্যবহার যা আমেরিকা করছে এর পরিণতিতে কী হবে তা নিয়েই এই প্রফেসর বলছেনঃ “স্যাংশন অস্ত্রের ব্যবহারের ফলে ডলার-মুক্ত (ডি-ডলারাইজড) এক দুনিয়া হয়ে যাবার পথে হাটা এটা, সেই প্রক্রিয়ার দিকে যাওয়া এখন ব্যাপক গতি লাভ করবে। আর সেটাই ডলার আধিপত্যের কবর খোঁড়ার মতো সমতুল্য এক ঘটনা হবে” (the frequent use of the financial sanctions weapon will accelerate the process of de-dollarisation of the world, which is tantamount to digging a grave for dollar hegemony.)”।
কেন এমন হবে এর আরও কিছু মুল্যবান বেজ ফ্যাক্টস তিনি তুলে এনেছেন। তিনি বলতে চাইছেন, স্যাংশনের ব্যাপারটা আর কেবল রাশিয়ার বেলায় সীমাবদ্ধ নাই। স্যাংশন মানে এখন কেউ যেদেশ আমেরিকার কথা শুনে নাই বা নীতির বিরোধী, এমন সবার বেলায় ঘাড়ের উপর ঝুলানো এক তলোয়ার হয়ে ঝুলতে শুরু করেছে। কাজেই চীনও এখন এর আওতায়; তাতে সে আগামিতে তাইওয়ান আক্রমণ করতে যাক অথব না যাক কোন ফারাক নাই। আর এটাই চীনকে এখন বাইডেন আমেরিকান ডলারের বিকল্প – এখনই খুঁজে বের করতে বাধ্য করে দিয়েছে। কেন? এখনই কেন?
For the United States, the frequent use of the financial sanctions weapon will accelerate the process of de-dollarisation of the world, which is tantamount to digging a grave for dollar hegemony.”
প্রফেসর রগঅফ হিসাব দিচ্ছেনঃ এক) “আজ যে ডলার আধিপত্যের গ্লোবাল অর্থনীতির দুনিয়ায় আমরা আছি, আপনারা যদি এর একটু দুরের ভবিষ্যতের ছবিতে তাকান – বিশ্বাস করেন চীনও এমনই ভবিষ্যতের দিকে তাকাবেই। কারণ তার আছে তিন ট্রিলিয়ন (৩০০০ বিলিয়ন) ডলারের রিজার্ভ যা রাখা আছে আমেরিকার রিজার্ভ ব্যাংকে”। দুই) আমেরিকান ট্রেজারির দুই বিলিয়ন ডলারের সিকিউরিটি বন্ড কেনা আছে চীনের। এখন কোন কারণে আমেরিকা চীনের উপরও কোন অবরোধ দিলে রশিয়ার মত চীনেরও এসব অর্থ আটকে যাবে। তাই প্রফেসর বলছেন এজন্য রাশিয়ার উপর অবরোধ আরোপ দেখে চীনেরও ক্ষুব্ধ-বিরক্ত হওয়াই নয়; এর চেয়েও বড় প্রতিক্রিয়া হবার কথা সেটা বা সেগুলো কী?
যেকোন রাষ্ট্রের জন্য উদ্বৃত্ব অর্থ-সম্পদ ধরে রাখার সমস্যাঃ
বাইডেনের স্যংশন আরোপ এককথায় এতে স্যংশনকে অতিব্যবহার ফলে তা অপব্যবহারের স্তরে চলে গেছে। শুধু তাই না, যেকোন রাষ্ট্রের জন্য তার উদ্বৃত্ব অর্থ-সম্পদ ধরে রাখাকে উপায়হীন স্তরে নিয়ে ফেলেছে। বাইডেনের অবরোধ আরোপের সিদ্ধান্তের অর্থ এখন হয়ে দাড়িয়েছে যে, প্রায় সব ব্যাপারে আমেরিকার ইচ্ছা ও স্বার্থের সাথে একমত থাকা বা তাল মিলিয়ে চলতে না চাইলে সব রাষ্ট্রেরই উদ্বৃত্ব অর্থ-সম্পদ ডলারে তা সংরক্ষণ হারাম করে দিবেন তিনি। তাহলে এখন চীন তাইওয়ানের উপর আক্রমণ করুক বা না-করুক চীনের সমস্ত উদ্বৃত্ব অর্থ-সম্পদ সংরক্ষণ এখন হুমকির মুখে। এই ব্যাপারটার দিকেই প্রফেসর মনোযোগ আনছেন।
অনেকের মনে হতে পারে তাহলে তো বাইডেনের আমেরিকা এখন খুবই শক্তিশালী দেশ! তাই কী? এর জবাবটা হবে হ্যা এবং না। অর্থাৎ সাময়িক ভাবে হ্যা আর একটু আগামিতে দৃষ্টি ফেললে দেখা যাবে তারা আমেরিকার ডলারের আধিপত্য ভেঙ্গে নয়া বিকল্প বের করে ফেলার পথেই। ফলে আমেরিকা তখন আর শক্তিশালী থাকবে না, বরং কোণঠাসা হয়ে পড়বে।
তাই প্রফেসর সমস্যাটা আমাদের বুঝাতে গিয়ে আবার বলছেন, “সোনা অবশ্যই সম্পদ ধরে রাখার এক ভাল বিকল্প উপায়। কিন্তু এর সমস্যা হল, দুনিয়ার সবদেশের ব্যাঙ্ক রিজার্ভে যে পরিমণ সোনা রাখা আছে ডলারে এর মোট মুল্য হবে ২.৩ ট্রিলিয়ন। কিন্তু এক চীনের হাতে যে বৈদেশিক মুদ্রা মজুদ আছে এর পরিমাণ ৩.২ ট্রিলিয়ন।
Gold is an alternative but China’s $3.2 trillion of foreign exchange reserves is greater than the $2.3 trillion value of all the world’s central bank gold reserves.
মানে তিনি বলতে চাইছেন এতে সোনারই অভাব পড়বে। তত সোনা বিভিন্ন দেশের মোট রিজার্ভেও নাই। ফলে বাইডেন দুনিয়াতে রাষ্ট্রগুলো উদ্বৃত্ব অর্থ-সম্পদ রাখার যে ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠেছিল তাকেই ভালনারেবল বা নড়বড়ে করে দিয়েছেন। আর এটা বলাই বাহুল্য দুনিয়া যেহেতু উদ্বৃত্ব অর্থ-সম্পদ রাখার ব্যবস্থপনাকে নড়বড়ে করে রাখা সহ্য করবে না, মানে আমেরিকান খামখেয়ালিপনা বা সকলকে জিম্মি করে রাখা সহ্য করতে পারে না অতএব দুনিয়া একটা “ডলার বিকল্প” ব্যবস্থা গড়ে তুলবেই – এটাকেই প্রফেসর বলছে এক ডলার-মুক্ত বিশ্ব হবে সেটা!!! আর এটাকেই সম্ভবত আমরা বলি আম-ছালা দুটাই হারানো দশা!!!
আশা করি এখন পাঠক ধরতে পারবেন কেন সোনা? কেন সোনার দাম বাড়ছে? এখন অনেক মিডিয়ায় পাবেন আমেরিকান ডলার লেনদেন ব্যবস্থার SWIFT Code – এর বিকল্প হিশাবে কেবল শুরু করা চীনের CIPS (Cross-Border Interbank Payment System) এর কথা কেন উঠতে শুরু করেছে!
[একটা সতর্কতাঃ অনেকে দেখা যাচ্ছে ভুল বুঝছেন তাই একটা আগাম সতর্কতা যে এটা আমেরিকার বিপক্ষে আর রাশিয়ার (মানের চীনেরও) পক্ষ নিয়ে – এভাবে তৈরি কোন লেখা নয়। এই চোখে দেখা ভুল হবে। এখানে আমার কাজ হল এভেলাবেল ফ্যাক্টস বিশ্লেষণ করে দেখানো। এমন চাপা পড়া দিকগুলোকে সামনে এনে দেয়া। আর গ্লোবাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় এর প্রভাব পরিণতি কী হতে পারে তা বলা বা সে ধারণা নিয়ে কথা বলা। আশা করি পাঠক “পক্ষ-বিপক্ষের” মধ্যে আটকে থাকবেন না! ]
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
[এই লেখাটা দৈনিক “নয়াদিগন্ত” পত্রিকার ০৫ মার্চ ২০২২ ওয়েবে আর পরদিন প্রিন্টে “রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যার বাইরের রূপ“– এই শিরোনামে ছাপা হয়েছিল। ঐ ছাপা হওয়া লেখাগুলোকে আমার লেখার ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ বলা যায়। আর আমার এই নিজস্ব সাইটের লেখাটাকে সেকেন্ড ভার্সান হিসাবে এবং থিতু ভাষ্য বলে পাঠক গণ্য করতে পারেন। আসলে পরবর্তিতে ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ লেখাটাকেই এখানে আরও অনেক নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে ও নতুন শিরোনামে এখানে আজ ছাপা হল। ]