দেশপ্রেম নয়, মানুষ ন্যায়বিচার দেখতে চায়!
বিচারক-কমিশনাররা যখন ন্যায়দন্ড ফেলে সবাই দেশপ্রেমিক!
গৌতম দাস
২১ মার্চ ২০২২, ০০:০৬ সোমবার
–
Former Chief Election Commissioner OP Rawat along with Chief Election Commissioner Sunil Arora (L) and Election Commissioner Ashok Lavasa (R) | PTI–
গত ১০ মার্চ ছিল ভারতের পাঁচ রাজ্য নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের দিন। এক পাঞ্জাব ছাড়া নির্বাচন কমিশন বাকি চার রাজ্যে বিজেপিকে বিপুল বিজয়ী বলে ঘোষণা করেছিল সেদিন। অর্থাৎ বিজেপি এখন ওসব রাজ্যে সরকার গড়বে। উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, পাঞ্জাব, গোয়া ও মনিপুর এই পাঁচ রাজ্যে এবার নির্বাচন হল। যদিও এই পাঁচ রাজ্য রাজ্যের মর্যাদার দিক থেকে এরা সবাই-ই সমান। কিন্তু এরা সবাই সমান রাজ্যের মর্যাদার হলেও জনসংখ্যা বা রাজনৈতিক গুরুত্বের দিক থেকে তারা সমান নয়। এভাবে এগিয়ে থাকা রাজ্যগুলো কোনোভাবেই অন্য রাজ্যের সমান নয়। কেন সমান নয়?
এটা বুঝবার একটা দিক-পদ্ধতি হতে পারে কেন্দ্রীয় ক্ষমতার পার্লামেন্ট (বা যেটাকে ওরা লোকসভা বলে) তাতে কোন রাজ্যের কার কতটা আসন তা দিয়ে। কেন্দ্রে কম আসনের রাজ্য মানে সেটা ছোট রাজ্য; মানে কম জনসংখ্যার মানেই তা ভৌগলিকভাবেও ছোটরাজ্য। এই হিসাবে ভারতের কেন্দ্রীয় সংসদ বা পার্লামেন্ট নির্বাচন যেটাকে তারা লোকসভা বলে তাতে মোট ৫৪৩ আসন। আর তাতে উত্তরপ্রদেশ (৮০), উত্তরাখণ্ড (৫), পাঞ্জাব (১৩), গোয়া (২) ও মনিপুর (২) – এভাবে পাশের ব্রাকেটে তাদের লোকসভার আসন বা কনষ্টিটুয়েন্সি কয়টা তা দেখানো হয়েছে। যদিও পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য নির্বাচন হয়ে গেছে গত বছর ২০২১ সালে; তবু কৌতুহল মিটানো আর তুলনা করে বুঝবার জন্য এখানে জানানো হচ্ছে যে, পশ্চিমবঙ্গ লোকসভা আসন ৪২টা আর এর মোট জনসংখ্যা প্রায় ১০ কোটি। তুলনায় বাংলাদেশের জনসংখ্যা কম করে ধরলেও ১৬ কোটি।
তাহলে ফর্মুলাটা হল, ভারতের কোন রাজ্য কত বড় বা গুরুত্বের তা বুঝবার সোজা তরিকা হল ঐ রাজ্যের জন্য বরাদ্দ লোকসভায় আসন সংখ্যা জেনে নেয়া। এই গুরুত্বের বিচারে যেখানে ভারতে কেন্দ্রে সরকার গড়তে লাগে লোকসভায় ন্যূনতম ২৭২ আসন, সেখানে একা উত্তরপ্রদেশ যা একমাত্র বড় রাজ্য তা দিতে পারে একাই ৮০ আসন। ফলে উত্তরপ্রদেশ গুরুত্বে এখানেই সবার চেয়ে বড়। এ ছাড়া সারা ভারতের উপর যেটাকে বলে হিন্দি বলয়ের শাসন- আধিপত্য, এর কেন্দ্র বুঝাতে উত্তরপ্রদেশকে দেখানো হয় । আবার এটাই ‘আর্য’ বা ব্রাহ্মণ আধিপত্যের কেন্দ্র, এই হিসেবে উত্তরপ্রদেশ। আবার এর বিপরীতটা হল দ্রাবিড়ীয় বা ডেকান [Deccan বা দাক্ষিণার্ত] দক্ষিণী চার রাজ্য আর এ দিকে আংশিকভাবে বাংলা প্রদেশ। এ ছাড়া শেষে একটা ‘নোক্তা’ হিসেবে বলা যায়, ভারতের নেহেরু-গান্ধী ডায়নেস্টি বা বংশের শাসন সেটাও এই উত্তরপ্রদেশ কেন্দ্রিক; সুনির্দিষ্ট করে বললে এলাহাবাদ শহরে যেটা আসলে উত্তরপ্রদেশ রাজ্য হাইকোর্টের শহর। আর এখানেই নেহেরুর বাবা মতিলাল নেহেরু বৃটিশ আমলে এলাহাবাদে ওকালতি প্র্যাকটিস করবেন বলে পাশের কাশ্মির থেকে এক কাশ্মিরি ব্রাহ্মণ – তিনিও উত্তরপ্রদেশেই এককালে খুঁটি গেড়েছিলেন।
ভূগোলের পাঠ শেষ এখন রাজনীতির পাঠঃ
ভূগোলের পাঠ শেষ এখন রাজনীতি বা রাজনৈতিক ক্ষমতা মানে নির্বাচনের প্রসঙ্গে আসি। এবার এই পাঁচ রাজ্য নির্বাচন চলেছিল কয়েকপর্বে প্রায় এক মাস ধরে, ৭ মার্চ পর্যন্ত; যার গণনা, ফলাফল এক সাথে ১০ মার্চ প্রকাশিত হয়েছে। উপরে দেখানো উত্তরপ্রদেশের গুরুত্বের কারণে পাঁচ রাজ্যে নির্বাচন হলেও ভারতের রাজনীতির সবাই আসলে তাকিয়েছিল এক উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনের দিকে। যেকোন নির্বাচনে কিসের ভিত্তিতে ভোট বিভিন্ন প্রাথীর বাক্সে যাবে, ভাগ হবে, এমন নানা নির্বাচনী ইস্যু তাতে হাজির হতে দেখা যায়। সেই বিচারে ভারতের বিভিন্ন মিডিয়ায় গত এক মাস ধরে যেসব নির্বাচনী ইস্যুর কথা বলা ও আলোচনা করে হয়েছিল সেগুলো হল – এক. কৃষক আন্দোলন। মানে আগের টানা ১৫ মাস ধরে চলা এক কৃষক আন্দোলনে শেষে মোদি হার স্বীকার করে সংশ্লিষ্ট তিন আইন প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। দুই. ভারতে কোভিডের ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ সামলাতে মোদির ব্যর্থতা। অর্থাৎ মোদির সরকার – সৎকার, হাসপাতাল বেড, অক্সিজেন ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট সব সিস্টেমটাই ভেঙে পড়েছিল যেখানে। আর তাতে নাগরিক হিশাবে মানুষের মর্যাদা এই সামাজিক মুল্যবোধে ধুলায় লুটিয়ে পড়েছিল। তিন. অর্থনীতি; অর্থাৎ ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি ও কাজ সৃষ্টিতে অভাব মানে পুরানা অর্থনৈতিক ততপরতাই সীমিত বা বন্ধ হয়ে আসা – কোভিডের আগে যা ছিল তা একেবারেই ভেঙে পড়া, ইত্যাদি।
এসব ইস্যুগুলোতে এক বিজেপির দলীয় বা সমর্থক মিডিয়া ছাড়া বাকি সব মিডিয়ায় এসব ইস্যুতে বিজেপির পক্ষ থেকে জবাব-সাফাই নাই, তারা এসব ইস্যুতে নেতি-ছাপ পড়বে প্রাপ্ত-ভোটে তাই এই ভিত্তিতে বিজেপি ভোট হারাবে এই ছিল তাদের সবারই রিপোর্টিংয়ের লাইন। যেমন “উত্তর প্রদেশের ভোটে বিজেপিকে শায়েস্তায় ‘মিশন ইউপি’’ অথবা “উত্তর প্রদেশের ভোট যে কারণে মোদির জন্য জনপ্রিয়তার পরীক্ষা”- এমন ছিল সেসব রিপোর্টের শিরোনাম।
এছাড়া “গোরক্ষা ইস্যু” যেটা গরুকে দেবতা মান্য করার হিন্দুত্বের রাজনীতি হাজির করা; উদ্দেশ্য যে এতে ভোটাররা এই হিন্দুত্ত্বের ইস্যুতে ডুবে গিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিদের ফেলে বিজেপিকেই ভোটটা দিবে এই অনুমান। এই কথিত “গোরক্ষা ইস্যু” বুমেরাং হয়ে কত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। মানে কৃষকের গরু বুড়া হলে তা মাংসের বাজারে বেচার নিষেধাজ্ঞার কারণ গরুকে বসিয়ে খাওয়াতে না পেরে মালিক সে গরুর মালিকানা ত্যাগ করে ছেড়ে দিয়েছে। আর সেই ছাড়া গরু এবার গৃহস্থের জন্য ফসল নষ্টের সমস্যা, তাতে রাতজেগে পাহারা বসানোর সমস্যা হয়ে হাজির হয়েছে। [নদীতে গরু-মহিষের মৃতদেহ, উত্তর প্রদেশের রাজনীতিতে উত্তাপ]। এককথায়, ভারতের উত্তর প্রদেশের নির্বাচনে গরুর আক্রমণ কেন বড় ইস্যু হয়ে উঠেছে এটা তুলে ধরেছিল বিবিসিসহ বিভিন্ন মিডিয়া।
এমনকি আমেরিকান ক্ষমতাসীনদের থিংকট্যাংক “আটলান্টিক কাউন্সিল”, তারাও মোদির জন্য ‘ক্রিটিক্যাল টেস্ট’ বলে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করে রিপোর্ট করেছিল [Modi faces a critical test in India’s most populous state]। অথবা বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীর ভাগ্য নিয়ে ফ্রান্সের মিডিয়ায় উদ্বিগ্ন রিপোর্ট [Turbulent priest: India’s anti-Muslim firebrand and possible future PM]। অন্য দিকে বিশেষ করে ইংরাজি দ্য-প্রিন্ট এ নিয়ে নিয়মিত রিপোর্ট করে গেছে [The BJP and the SP are neck-to-neck in Uttar Pradesh ] অথবা [CM says UP will be largest economy if BJP wins. Data shows unlikely ...]। আর কলকাতার আনন্দবাজার ছিল আরো সরেস। সে অনিন্দ্য জানা নামে এক রিপোর্টারকে সারা মাস উত্তরপ্রদেশে রেখেই নিয়মিত – “উত্তরপ্রদেশের ভোট-বুক” সিরিজ রিপোর্ট ছাপিয়ে গেছে; ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে টানা ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৩ পর্বে তের শহরের সিরিজ রিপোর্ট। প্রতিটা খণ্ড ছিল উত্তরপ্রদেশে বিজেপির দুঃসহ শাসনের বিভিন্ন নজির। যেমন ‘হাতরাস’ এর কাহিনী যেটা আসলে এক দলিত কিশোরীকে রেপ করে, হত্যা করে উঁচুজাতের লোকেদের কাহিনী। এরপর পুলিশ-বিজেপি মিলে ওই কিশোরীর সৎকারের নামে মা-বাবার অনুমতি বা তাদের উপস্থিতি ছাড়াই সেই লাশ পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আর সেই কিশোরীর বাড়ি এখন আদালতের নির্দেশে আর্মি ক্যাম্প বানিয়ে পাহারা দিচ্ছে।
কোনো মিডিয়া রিপোর্টই বিজেপির জিতবার আশা জাগানোর ছিল নাঃ
অর্থাৎ সমর্থকের বাইরে কোনো মিডিয়া রিপোর্টই বিজেপির পক্ষে জিতবার আশা জাগানোর মত রিপোর্ট ছিল না। এর মধ্যে আরেক সংযোজন হল – দুই কথিত সাধুর (যারা বিজেপি-আরএসএস অ্যাফিলিয়েটেড) প্রকাশ্য সভা থেকে মুসলমান গণহত্যা শুরুর আহবান, হাতে অস্ত্র তুলে নেয়ার আহ্বানের বক্তৃতা দেয়া হয়। [ধর্মীয় বিভাজন ভারতকে তলেতলে ভেঙে দিচ্ছে] অথবা [As UP Polls Continue, BJP MLAs Dial Up Anti-Muslim Hate Speeches]।
অথচ পুলিশ, প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন অথবা সুপ্রিম কোর্ট নির্বিকার। সবার সময় ক্ষেপণ চলতেই থাকে। প্রায় এক মাস পরে কথিত সাধুর একজনকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু মামলা দেয়া হয় মেয়েদের প্রতি অশালীন উক্তির অথবা Haridwar ‘Dharam Sansad’ shows Modi is facing an internal threat from Sangh Parivar। এমন মামলা জামিনযোগ্য বলে ক’দিনের মধ্যেই তার জামিনও হয়ে যায়।
এছাড়া ক’দিনের মধ্যেই হিজাব নিয়ে প্রায় জোর করে ব্যাপক এক সামাজিক বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়। উদ্দেশ্য হলো, যত বেশি ধর্মীয় মেরুকরণ ততই বেশি বিজেপি ভোট বাড়বে, এই অনুমান। এখানে যে বয়ান তৈরির দিকে গুরুত্ব দেয়া হয়ে থাকে তা হলো, যেন মুসলমানদের অত্যাচারেই হিন্দু জনগোষ্ঠী অতিষ্ঠ। এমন একটা ভাব তৈরি করা হয়। আর এই ‘নিপীড়িত’ হিন্দুদেরই ত্রাতা হিসেবে এবার হাজির হয় মোদি ও দল বিজেপি। অতএব বয়ান শেষে হিন্দুরা একজোট হয়ে বিজেপিকে ভোট দাও!!
মোদির এই তৎপরতা এবার প্রমাণ করেছিল যে, মোদিও নির্বাচনের ভোট তার বিরুদ্ধে যাবে এটা তার ও দলেরও অনুমান ছিল। তাই এত মরিয়া হয়ে সুনির্দিষ্ট করে এথনিক-ধর্মীয় কোনো জনগোষ্ঠী-বিরোধী প্রপাগান্ডা, সরাসরি খুন করতে বলা, ঘৃণা করতে বলার উদ্বীপ্তকরণ; এসব অ্যান্টি-মুসলমান প্রচারণা, ইসলামবিদ্বেষের [Hijab Row Can Hurt Indian Diplomacy] কোনো কিছুই তিনি বাদ রাখেন নাই।
আরেক শেষ অস্ত্র প্রপাগান্ডায় বিজয় ঘোষণাঃ
এরপরেই ছিল বিজেপির আরেক শেষ অস্ত্র। সারা ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে এসব প্রপাগান্ডার পরে পয়লা মার্চ থেকে মোদি-অমিত একেবারে ড্রাইভিং সিট নিয়ে সরাসরি বসে যান। অমিতশাহ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় পয়লা মার্চ এক লম্বা সাক্ষাৎকার দেন। সেখানে তিনি ঘোষণা করে দেন, নির্বাচনে বিজেপি বিপুল ভোটে বিজয়ী হচ্ছে। এই ঘোষণায় একটা মিলের দিক হল, গত ২০১৯ সালের নির্বাচনের সময়ও তিনি একইভাবে শেষ সপ্তাহে বিজেপি কেন্দ্রের কত আসনে জিতে যাবে, তা ঘোষণা করেছিলেন। এবারও তাই দেখা গেছে। তিনি খুব করে রিপোর্টারকে বুঝিয়ে দেন যে, দিল্লির ক্ষমতায় মানে কেন্দ্রে সরকার গড়তে গেলে উত্তরপ্রদেশ হয়ে তবেই দিল্লিতে যেতে হয়। তাই তারা উত্তর প্রদেশে জিতে যাচ্ছেন। মানে ২০২৪ সালে কেন্দের নির্বাচনেও জিতে যাচ্ছেন [“If anyone wants to form a government with full majority at the Centre, it cannot be without Uttar Pradesh’s mandate,” ]।
কিন্তু প্রশ্ন যেখানে উত্তরপ্রদেশের এই নির্বাচনে বিজেপির জন্য এত নেগেটিভ ইস্যু আর অসংখ্য জনদুর্ভোগ থাকার পরেও কেন বিজেপি জিতবে- এ নিয়ে কোনো প্রসঙ্গ কোনো কথার জবাব অমিত শাহ দেন নাই। বারবার বলেছেন এবার (২০২২) তারা উত্তরপ্রদেশে জিতে যাচ্ছেন, তাই ২০২৪ সালেও কেন্দ্রে জিতবেন। এ ছাড়া কিসের ভিত্তিতে এ কথা বলছেন এ ব্যাপারে তিনি নিরুত্তর থেকেছেন।
পরে ১০ মার্চ ফলাফল ঘোষণার দিনও অমিত শাহের বর্ণনা মত ফলাফল আসতে থাকে। আর তাতে নিজেদের বিজয় ঘোষিত হয়েছে বলে মোদি প্রথমেই পার্টির অফিসে বিজয় সভার আয়োজন করেন। পরে আরো বিজয় মিছিল বের করেন গুজরাট সফরে। সেখান থেকেও তার একইকথা তারা ২০২৪ সালের নির্বাচনে কেন্দ্রে জিতে যাচ্ছেন।
এখানে তামাশা দিকটা হল, নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পরে কোনো মিডিয়ার মনে প্রশ্ন নাই যে, কেন তাদের গত এক মাস ধরে যা কিছু রিপোর্ট – বিজেপির দিক থেকে খারাপ বা নেতি ফলাফল বা জিতিতে বাধা পাবার রিপোর্ট এর কোনো প্রতিফলন ফলাফলের মধ্যে নাই, কেন? এর ব্যাখ্যা কী? এটা আসলেই খুবই মজার যে, অনেক সময় মিডিয়া নিজের আলোচনা-রিপোর্টের প্রতিফলন ভোটের ফলাফলে না-ও থাকতে পারে। কিন্তু কেন থাকল না এর ব্যাখ্যা কী? সেটা নিয়ে কথা বলা, তালাশ করা কী তাদের কাজ নয়? কিন্তু এখানেই সব ‘কবি’ নীরব দর্শক মাত্র!! আসলে, মোদির হাতে এমন কী আছে যে মোদি বা বিজেপির বিরুদ্ধে যত নেগেটিভ দিক তার অযোগ্যতা প্রকাশিত বা প্রমাণিত থাক না কেন, ভোটাররা ক্ষুব্ধ ও সাফারার হোকনা কেন – এসবের কোনোটারই প্রতিফলন ভোটের ফলাফলে থাকে না কেন? এর উপর এটা নিয়ে ঐ মিডিয়াগুলোই আর কথা বলে না কেন??
মিডিয়া এদিকে তাকানোকে যেন নিষিদ্ধ মনে করেঃ
ব্যাপারটা এমন যেন ভোটের প্রকাশিত কমিশনের ফলাফল মিডিয়া আলোচনার বিরুদ্ধে গেলেও তারা এনিয়ে আর আলোচনা করে না। যেন এদিকে তাকানোকে তারা নিষিদ্ধ মনে করে!! বরং সেদিক থেকে মনোযোগ সরাতে এখন তারা অনেকে রিপোর্ট করেছে যে, কংগ্রেস কেন এত খারাপ ফল করল? যেন কংগ্রেস ক্রমেই সব হারানো দলে পরিণত হচ্ছিল না! যেন সবাই আশা করছিল কংগ্রেস এবার বিরাট কিছু ফলাফল দেখাবে!
প্রধানমন্ত্রী বা নির্বাহী বিভাগের কোনো আইনভঙ্গের বিরুদ্ধে কোনো উচ্চবাচ্য নয়ঃ
নীতিটা ভারী সুন্দর(!)। দেখা যাচ্ছে ভারতের লিগ্যাল প্রফেশনের (বিচারক, উকিল-ব্যারিস্টার বা লিগাল একাদেমিক ইত্যাদি) কেউ অথবা মিডিয়া যেন প্রধানমন্ত্রী বা নির্বাহী বিভাগের কোনো আইনভঙ্গের বিরুদ্ধে কোনো উচ্চবাচ্য করা দেশের বিরুদ্ধে কাজ মনে করা শুরু করেছে। যেমন ধরা যাক বর্তমানে সাবেক এক নির্বাচন কমিশনার অশোক লাভাসা যিনি নিয়মিত মোদির নির্বাচনী আইন ভঙ্গের বিরুদ্ধে একাই সোচ্চার থাকতেন; আর অন্য কমিশনারেরা নির্বাহী ক্ষমতার সাথে সঙ্ঘাতে যাওয়া [EC Rejects by 2-1 Vote Lavasa’s Demand to Record Dissent Note in Orders] বা আইনি-নিরপেক্ষ জায়গায় দাঁড়িয়ে যেকোনো বেআইনি কাজের প্রশ্ন তোলাকে দেশ-বিরোধী কাজ মনে করেছেন। এমনকি কমিশনার অশোক লাভাসা ঐ নো-অফ-ডিসেন্ট বা আপত্তি-নোটে ঠিক কী বলেছিলেন সেকথা রাইট টু ইনফরমেশন আইনেও (যে আইনে যেকোন নাগরিক কোন “পাবলিক তথ্য” জানতে চাইলে সরকার সেই তথ্য দিতে বাধ্য) নির্বাচন কমিশন তা প্রকাশ করে নাই। মোদি এবং এসব বিচারক-কমিশনারদের স্বার্থ কত গভীরে যে এরা পরস্পরকে আঁতাতে সাহায্য করে বলে থাকে, তা এখানে প্রকাশিত। তাই তারা সবাই নির্বাহী ক্ষমতার পক্ষের লোক হয়ে থাকাই তাদের ভূমিকা মনে করছেন। কিন্তু কেন? ভারত এমন হয়ে গেল কেন?? কবে থেকে??
Ashok Lavasa, the only member of the 3-man Election Commission to rule that Prime Minister Narendra Modi had violated the Model Code of Conduct while campaigning for the 2019 general election, was selected as a potential candidate for surveillance just weeks after his dissent, according to leaked records of phone numbers that The Wire has seen.
সেই যে এককালে ১৯৭৫ সালে জুনে জরুরি আইনের শাসন দেখেছিল ভারত, সেই থেকে এনিয়ে এক স্মৃতি তারা কাঁধে নিয়ে ফিরছে। তারা আজও বিভ্রান্ত যে, সেসময়ে ঐ হাইকোর্ট মামলার বিচারক [Justice Jagmohanlal Sinha] সিটিং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে আইনত শাস্তির রায় দিয়ে কি তারা ঠিক করেছিল? তারা মনে করা শুরু করেছিলেন সারকথায় বললে, তা হল প্রধানমন্ত্রী বা নির্বাহী ক্ষমতা যদি ট্যারা হয় – আগ্রাসী আচরণের হয়, আইন মানতে, চলতে না চায়, বাড়তি সুবিধা চায়, বিরোধীদের বিরুদ্ধে আদালতকে ব্যবহার করতে চায়- তবে বিচার বিভাগ বা নির্বাচন কমিশনের কাজ-ভূমিকা যেন হল নির্বাহী বিভাগের পক্ষে দাঁড়ানো বা নির্বাহী বিভাগের জন্য পথ ছেড়ে দেয়া। এককথায় যত আগ্রাসী এক্সিকিউটিভ প্রধানমন্ত্রী, নিয়ম-আইন ভাঙতে চাওয়া নির্বাহীর মুখোমুখি তারা হবেন ততই তাদেরকে যেন আপসে প্রধানমন্ত্রীর জন্য জায়গা ছেড়ে দিতে হবে। এই হলো সেই নীতি! কেন?
এটাই তারা সেসময় উলটা ভুল শিক্ষা নিয়েছিলেন; আদালতের দেয়া সাজা ও সিদ্ধান্ত মানতে না চাওয়া প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ক্ষেত্রে! যেন আদালত ইন্দিরাকে সাজা দিয়েছিল বলেই ভারতে জরুরি আইন এসেছিল। মানে পরোক্ষে জরুরী আইন আনার দায় বিচারকদের!!! অতএব, লিগ্যাল প্রফেশনের মানুষের কাজ ও ভূমিকাই হচ্ছে অ্যাগ্রেসিভ প্রধানমন্ত্রীর সাথে খাপ খাইয়ে চলা। এতে দেশ ভালো থাকে – তাই এটাই দেশপ্রেমিকতা!!!! বিচারকের হাতে ন্যায়দণ্ড নয়; কথিত দেশপ্রেমিকতা দেখিয়ে দোষী প্রধানমন্ত্রী হলেও তাকে মাফ বা তাঁর দোষ মাফ করা বা এড়িয়ে চলাই বিচারকের কাজ!!
লক্ষ্য করা যায়, সেই থেকে আইন প্রফেশন, বিচারকেরা হয়ে গেছেন – ন্যায়দণ্ডের বাহকের চেয়েও সবার আগে ‘দেশপ্রেমিক”। যেন দেশপ্রেমিকতা আগে দেখানো শেষ হলে এরপর বিচার-আচারে বসা যেতে পারে। এ জন্যই কি ভারতের নির্বাচন কমিশনার অশোক লাভাসাকে কমিশনের চাকরি ছেড়ে যেতে হলো? অথচ কোনো মিডিয়ায় এ নিয়ে কোনো আলোচনা নাই!
অথচ অশোক লাভাসা নিজে তো বটেই তার স্ত্রীও তাঁর প্রফেশনে সরকারের হাতে নিগৃহিত ও বাধাপ্রাপ্ত হয়েছেন। শেষে যেটা কার্যত ক্যাডার বদল করা, এভাবেই অশোক লাভাসা এখন নির্বাচন কমিশন আগাম ছেড়ে দিয়েছেন। আর তিনি এখন মোদি প্রশাসনের তরফে সরকারিভাবে এডিবি (এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক) ম্যানিলাতে নিয়োগ পেয়েছেন। তিনি নির্বাচন কমিশনে থাকলে ২০২২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার থাকতেন। মানে এই পাঁচ রাজ্যের নির্বাচন তার অধীনে হত।
তাহলে অবস্থা দাঁড়াল এই যে এখন থেকে আইন না মানতে না চাওয়া অ্যাগ্রেসিভ প্রধানমন্ত্রীকে জায়গা করে দিয়ে পাশ কাটিয়ে যেতে হবে। এভাবেই ভারতের আদালত আর কমিশন চলবে – ভোট কারচুপি, বাক্সের প্রোগ্রাম বদলে দিলেও এভাবেই সব চলবে। আগ্রাসি মোদিকে কিছু বলা যাবে না। আর এমন দুর্দমনীয় ক্ষমতায় প্রধানমন্ত্রী মোদি এরপরে মুসলমান গণহত্যার হুমকি দিয়ে হিন্দু ভোট নিজ বাক্সে নিতেই থাকবেন! আর এভাবেই আগামী ২০২৪ সাল তো বটেই, আগামী ভারতে সব নির্বাচন জিতে চলবেন! আর নিশ্চয় এতে দেশপ্রেমিক ভারত অনেক উন্নতি করে এগিয়ে যাবে!!!!
[আরেক ইস্যুতে নির্বাচন কমিশনকে প্রভাবিত করা নিয়ে আমার আগের আগের আরেক লেখা – “ভারত-রাষ্ট্রের ভেঙ্গে পড়া ও রবি কান্তের হতাশা” – সেটা পাবেন এখানে। ]
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
[এই লেখাটা দৈনিক “নয়াদিগন্ত” পত্রিকার ১৯ মার্চ ২০২২ ওয়েবে আর পরদিন প্রিন্টে “বিচারক বা কমিশনাররা যখন সবাই দেশপ্রেমিক!“– এই শিরোনামে ছাপা হয়েছিল। ঐ ছাপা হওয়া লেখাগুলোকে আমার লেখার ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ বলা যায়। আর আমার এই নিজস্ব সাইটের লেখাটাকে সেকেন্ড ভার্সান হিসাবে এবং থিতু ভাষ্য বলে পাঠক গণ্য করতে পারেন। আসলে পরবর্তিতে ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ লেখাটাকেই এখানে আরও অনেক নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে ও নতুন শিরোনামে এখানে আজ ছাপা হল। ]