পাকিস্তানে  আমেরিকান হস্তক্ষেপ!


পাকিস্তানে  আমেরিকান হস্তক্ষেপ!
গৌতম দাস

১ এপ্রিল ২০২২   সময় ০০ঃ০৬ শুক্রবার

https://wp.me/p1sCvy-3ZZ

 

 

দক্ষিণ-পুর্ব এশিয়ার দায়িত্বে থাকা এক আমেরিকা উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী পাকিস্তানের এক রাষ্ট্রদুতকে হুমকি দেয়া এক চিঠিতে লিখেছে যে ইমরানের বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাব পাশ না হলে পাকিস্তানকে নাকি চরম পরিণতি ভোগ করতে হবে [ …wherein Pakistan was warned of “grave consequences” if the no-trust motion failed.]। এই চিঠিকে কেন্দ্র করে এটা পাকিস্তানের রাজনীতি ও ক্ষমতায় আমেরিকা সরাসরি হস্তক্ষেপ করছে বলে অভিযোগে তোলপাড়। এবং এখন খুব সম্ভবত আগামি ৩ এপ্রিলে পাকিস্তানে সংসদে অনাস্থা ভোটে ইমরানকে পরাজিতই হতে দেখব আমরা।
আসলে এটা কেবল পাকিস্তান নয়। আমাদের ধারণা সবাই পাকিস্তানের জায়গায় নিজ নিজ দেশ-রাষ্ট্রকে বসিয়ে ব্যাপারটা ভাবতেছে। তাই এই পাকিস্তান ইস্যু গুরুত্বপুর্ণ।

এনিয়ে আমার এক ফেসবুক স্টাটাসে আলোচনায় এক পাঠক একটা প্রশ্ন রাখেন। নিচে সেই প্রশ্নটা তুলে ধরা হল। আর এরপরে এনিয়ে আমার জবাবও সাথে দেয়া হল।

 

প্রশ্নঃ  চীন কেনো হাত গুটিয়ে বসে থাকে বিভিন্ন দেশে এরকম অবস্থায়? চীনের তো বিশাল বিনিয়োগ ও কৌশলগত স্বার্থ আছে। চীন তাহলে কিভাবে বিশ্ব রাজনীতিতে আমেরিকার সঙ্গে পেরে উঠবে? এছাড়া কোন দেশের সরকার চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে এরকম বিপদে পরলে, চীনের পক্ষ থেকে যদি যথাযথ সাহায্য না পায় তাহলে কে যাবে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে।

 

আমার উদাহরণসহ একটু বড় জবাবঃ 
সব স্বার্থ-সংঘাতকেই সামরিক সংঘাত মনে করা খুবই বড় ভুল বিচার। অথবা একে সামরিক দিক থেকে দেখা-নেওয়া বা ঠেলে দেওয়া ঠিক না; বুদ্ধিমানের কাজও না। কারণ এর চেয়েও সহজ পথ আছে।
এছাড়া সবার আগে চীন-আমেরিকার স্বার্থ-সংঘাতটাকে বুঝতে হবে। মূলত এর ধরণটাকে বুঝতে হবে। এখন গ্লোবাল নেতৃত্বে থাকে আমেরিকা, এর নেতৃত্ব এখন চ্যালেঞ্জড হয়ে গেছে।  চীনা উত্থান আমেরিকাকে তাড়া করে ফিরছে।  তাই এর নানা ধরণের ছাপ ও প্রকাশ ঘটছে চারদিকে বিশেষত এশিয়াতেই যা বেশি এবং সবদেশেই কমবেশি।  ফলে আমাদের মত দেশে একেকজন ইমরান – প্রো চীন অথবা প্রো আমেরিকান এই টানাটানি চাপের মধ্যে পড়বেই। তাতে আপনি ইমরান অথবা হাসিনা  প্রো চীন অথবা প্রো আমেরিকান যেই হন!
এখন আপনি প্রশ্নকর্তা  আশা করছেন আমেরিকান ন্যায় অথবা অন্যায় চাপের মুখে চীন কেন পাকিস্তানের ইমরাঙ্কে  রক্ষা করতে এগিয়ে আসছে না – এই হল আপনার প্রশ্ন!
এনিয়ে আগে বাংলাদেশেরই একটা উদাহরণ দিব। পরে আবার কিছু তত্ব কথায় আসব।

ঘটনাটা বাংলাদেশের টিকা প্রাপ্তি নিয়েঃ
তখনও  দুনিয়াতে  চীনা উতপাদিত কোন টিকাই বাজারে আসে নাই।  এমনকি পশ্চিমা ফাইজার বা মর্ডানাও নয়। বরং চীনা টিকারই (Sinovac) তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা শুরু হবে যা সফল হলে পরে টিকার বাণিজ্যিক উতপাদন শুরু হবে। চীন বাংলাদেশকে এই থার্ড ফেজে ঐ প্রক্রিয়াতে যুক্ত হতে অফার দিয়েছিল। থার্ড ফেজ মানে আগের মূল দুই গুরুত্বপুর্ণ ফেজ-এর পরীক্ষানিরীক্ষা সফল হয়ে গেছে। তাই এবার বাজারে ছাড়ার আগে একটু দেখে নেয়া যে (বাংলাদেশেও) এই টিকা পুশ করলে ব্যবহারিক পর্যায়ে ছোটখাট হলেও খারাপ প্রতিক্রিয়া হয় কিনা বা হলে আগেই তা এড়ানো যায় কীনা ইত্যাদি এসব ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্যই এই থার্ড ফেজ। যার অর্থ চীন এই পরীক্ষামূলক টিকা বাংলাদেশ কেবল নির্বাচিত কিছু হেলথ-স্টাফদেরকে দেয়া হবে আর তাদেরকে গভীর পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। যেহেতু এটা তখনও পরীক্ষামূলক তাই। আর বাংলাদেশের আইসিডিডিআরবি হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল চীনা টিকার এক শেষ ফেজে টেকনিক্যাল সহায়তা করার।  বাংলাদেশকে দেয়া ঐ অফারে বলা হয়েছিল এই পরীক্ষা সফল হলে কয়েক লাখ ফাইনালি উতপাদিত টিকা  আমাদের দেয়া হবে বিনা খরচায় আর সাথে  লাইসেন্স ও সহায়তা দেয়া হবে যাতে নিজেরাই আমরা দেশে প্রডাকশনে যেতে পারি  একটা বড় খরচ ও সামর্থ ছাড়াই।
কিন্তু ভারত পুরা ব্যাপারটা ভন্ডুল করতে নগদ “কমিশনের” লোভ দেখিয়ে সরকারকে অন্যদিকে নিয়ে যায়। বাংলাদেশই ভারতে আগাম অর্থ দিয়ে ওদের ফ্যাক্টরির উতপাদন
ক্ষমতা বাড়িয়ে দিবে আর তাতে উতপাদিত টিকা আর কমিশন দুটাই ভোগ করবে। আর তা করতে মাঝখানে সরকার-প্রিয় বাংলাদেশের প্রাইভেট কোম্পানির মাধ্যমে ভারতের সাথে চুক্তি করা হয়।  আর এতে মন্ত্রণালয় অতি খুশিতে থাকায় চীনের সাথে টিকার (থার্ড ফেজ) ফর্মাল চুক্তির সম্মতি স্বাক্ষরের সময়সীমা মিস করে যায়। পরে দেরিতে হলেও সেসব পত্র দিতে যোগাযোগ করলে চীনের দিক থেকে জানানো হয় যে যে তাদের টিকা উতপাদন কোম্পানি (ওটা চীনা প্রাইভেট কোম্পানির টিকা পরীক্ষা ছিল) আমাদের সময়সীমা মিস করাতে ঐ অফার অন্য দেশকে দিয়ে দিয়েছে (সম্ভবত ইন্দোনেশিয়া)। ফলে এখন আর কী করা যায় এনিয়ে এক প্রাথমিক আলাপে বলা হয় ফান্ডই প্রধান সমস্যা।  এখন নতুন করে ফান্ড যোগাড় করতে সময় লাগবে। আপনারাও দেখেন আমরাও দেখি ফান্ড কোথা থেকে যোগাড় করা যায়। এককথায় ব্যাপারটা অনিশ্চিত হয়ে যায়।
এখন এনিয়ে বাংলাদেশ খবর ছড়িয়ে পড়লে এটা বিব্রতকর হবে কারণ তখনও আমাদের টিকা কোথা থেকে আসবে তা একেবারেই অনিশ্চিত ছিল। তাই অনুমান করা হয় এথেকে রক্ষা পেতে ভারতের সাথে মিলে একটা গল্প সাজানো হয়। ভারতের রয়টার্সের রুমা পাল আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করেন চীনারা অর্থ চেয়েছে এজন্যই বাংলাদেশ-চীন টিকা ডিল ভেঙ্গে গেছে?
আমাদের মন্ত্রী সায় দিয়ে বলে হা সেজন্যই। এরপর তারা আইসিডিডিআরবি-কেও জিজ্ঞাসা করে কেন টিকা-সম্পর্ক কাজ করছে না? কিন্তু এনিয়ে আইসিডিডিআরবি কোন মন্তব্য করতে রাজি হয় নাই। এরপর ঢাকার চীনা এমব্যাশি কেও একই প্রশ্ন করেছিল কিন্তু তাদেরও জবাব ‘নো কমান্টস’।
আমাদের অঞ্চলে  আমেরিকান ফান্ডেড ও নিয়ন্ত্রিত আরেক মিডিয়া আছে “বেনার নিউজ” নামে। তারাও এনিয়ে রিপোর্টের ফাইন্ডিংসও প্রায় একই রকম।

অর্থাৎ এসব প্রশ্নের জবাবে চীন চাইলে প্রতিবাদ করে আসল ঘটনা ফাঁস করে দিলে আমাদের সরকার বিব্রত হয়ে যেত। কিন্তু চীনা অবস্থান ছিল মিডিয়া এড়িয়ে যাওয়া। কেবল সবুর করা ধৈর্য ধরা আর এতে মেওয়া মিলবে তা বিশ্বাস করা। ঘটেছিলও তাই।

ভারতীয় টিকা আমরা নিতে শুরু করার কয়েক মাসের মধ্যে করোনা সেকেন্ডে ভ্যারিয়েন্ট বা ঢেউয়ে ভারত বিপর্যস্ত হয়ে যায়। দাবি উঠে বাংলাদেশকে টিকা বন্ধ করার যদিও আমরা আগাম বিনিয়োগ করে কারখানার সক্ষমতা বাড়িয়ে টিকা পাবার চুক্তি করেছিলাম। কিন্তু ভারত সরকার আর টিকা দিতে পারে নাই, বন্ধ করে দিয়েছিল। ততদিনে দুনিয়ায় টিকা পুর্ণ আবিস্কৃত আর প্রত্যেক দেশই কোথা থেকে নিজের প্রয়োজনীয় টিকা পাবে তা চুক্তিবদ্ধ হয়ে রয়েছিল। কেবল আমরা বাদে। ফলে সরকারের এতা বলার সুযোগ ছিল না যে টিকা আবিস্কৃত-ই হয় নাই।  তাই উপায়ন্ত না পেয়ে সরকার চীনের হাত-পায়ে ধরা শুরু করেছিল।
সংক্ষেপে বললে এতে ফলাফল হল, চীনের স্ট্রাটেজিক স্বার্থে অনেক ছাড় আমাদের দিতে হয়েছে যদিও বিনিময়ে আমরা এখন প্রয়োজনীয় টিকা যতটা পুশ করতে সক্ষম এর সবটা পাচ্ছি চীন থেকে আর তা সম্ভবত এখন ফ্রি। সাথে আমাদের একটা প্রাইভেট ওষুধ কোম্পানিকে টিকা উতপাদনের সক্ষমতা তৈরি করা হচ্ছে চীনা সহায়তায়।

তাহলে কী দাড়ালো?
কুটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মনোমালিন্য হলেই লাঠি-বন্ধুক বের করা চলে না। এর সবচেয়ে বড় কারণ, সব সম্পর্কই সামরিকভাবে কে কত বড় বা সক্ষম তা দিয়ে সাব্যস্ত হয় না, তা নয়ও তাই।
বিশেষ করে চীন-আমেরিকার দ্বন্দ্ব টা সামরিক নয়। আমেরিকার অর্থনৈতিক হাল চীনের তুলনায় অনেক পিছিয়ে, একেবারেই তুলনীয় নয়। কিন্তু সামরিক দিক দিয়ে আমেরিকা এখনও ছয়গুণ বেশি সক্ষম। আমেরিকার গ্লোবাল প্রভাব এখনও কম নয়। যদিও দ্রুতই তা কমছে।

কাজেই আমেরিকার উদ্বৃত্ব সম্পদ না থাকার সমস্যাটা, অন্যদেশকে অর্থ-বিনিয়োগ-অনুদান দিবার অযোগ্যতাটা  এসবগুলো আমেরিকার বাড়তি সামরিক সক্ষমতা দিয়ে পূরণীয় নয়। কাজেই মূল সামর্থটা উদ্বৃত্ব সম্পদ কার কেমন আছে!

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s