যারে দেখতে পারি না অথচ, তাঁর আরো ঘনিষ্ঠ হই, কেন?
গৌতম দাস
০১ মে ২০২২, ০০:০৮ সোমবার
–
If China’s Economy Falls, Ours Will Too
Dependence on China shrinks the US economy in Q1
‘গ্লোবাল বাণিজ্য’ কথাটার মানে হল, এমন এক অবস্থা ও সিস্টেমের মধ্যে বসবাস যখন, মূলত আন্তঃরাষ্ট্রীয়ভাবে সব রাষ্ট্রের সাথে সবার এক ব্যাপক বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে তোলাই সেই গ্লোবাল সমাজের বৈশিষ্ঠ। দুনিয়াতে বাণিজ্য নতুন না অবশ্যই। তাই অনেকের মনে হতে পারে এই গ্লোবাল বাণিজ্য তো দুনিয়াতে সব সময়ের মতই এখনও আছে। কিন্তু সরি, তবু এ’কথাটা সত্যি না। বাণিজ্য বলতে আসলে দুটো মেজর ভাগ আছেঃ এক. কোন রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে বাণিজ্য, অপরটা বা দুই. রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বাণিজ্য। কেন এই ভাগের কথা বলছি? বাণিজ্য বলতে একটা আগাম-দরকারি [pre-requisite] শর্ত হল, বাণিজ্য ঘটতে হলে আগাম যার উপস্থিতি দরকার সেটা হল মুদ্রা [currency]। তাই বাণিজ্য ও মুদ্রা কার্যত সমনামীয় শব্দ। এখন মুদ্রা যে প্রচলন করত সেই অথরিটি হল সেকালের রাজা আর একালের ভাষায় রাষ্ট্র। আর কোনো দেশের মুদ্রার গ্রহণযোগ্যতা কেবল ঐ রাষ্ট্রের সীমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ। এটাকেই তাই প্রথম ধরনের বাণিজ্য বলছি।
এখন দ্বিতীয় ধরন মানে আন্তর্জাতিক বা আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য যেটাকে বলে, এটা পরিপূর্ণভাবে শুরু হয়েছে মাত্র এই তো সেদিন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ১৯৪৪ সালে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের গঠন ও ১৯৪৫ সালে এদের কার্যক্রম চালুর পর থেকে। মানে মাত্র ৭৭ বছর আগে থেকে। আর এখানে একই মানে কোন কোন রাষ্ট্রীয় মুদ্রা একই সাথে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে লেনদেনেরও মুদ্রা হিশাবে ব্যবহৃত হয় তবে সেক্ষেত্রে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের দ্বারা অনুমোদিত থাকতে হয়। তাহলে কি এর আগে (১৯৪৫ সালের আগে) গ্লোবাল বাণিজ্য বলতে কিছু ছিল না? ‘ছিল না’ বলার মতই। মানে ছিল তবে খুবই সীমিত পর্যায়ে আর সেটাও প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ১৯১৪ সালে শুরু হওয়া থেকেই এই সীমিত বাণিজ্য ব্যবস্থাটাও চিরদিনের মত অকার্যকর হয়ে যায়। এছাড়া ঐ সীমিত বাণিজ্য মানে যা হারিয়ে যাওয়া সেকালের অর্থনীতির মূল তৎপরতারও ছিল খুবই তুচ্ছ এক অংশ। মূল প্রধান ধারার অর্থনীতি তা ছিল না। এছাড়া তা ছিল এক পরিবারের প্রাইভেট ব্যাংকের উদ্যোগ। রথশিল্ড ব্যাংক (Rothschild) যাকে ফ্যামিলি ব্যাঙ্কিং ডায়নেস্টি বলা হয়, তা ইউরোপে ১৭৪৪ সাল থেকে ১৯১৪, এই সময়কালে ততপর ছিল। যদিও এনিয়ে কমিউনিস্ট প্রপাগান্ডামূলক ষড়যন্ত্রতত্বে লেখা প্রচুর ‘রহস্য’ ছড়ানো মুখরোচক আর্টিকেল অনলাইনে পাওয়া যায়। যেগুলো নিয়ে ঘাটাঘাটি খুব জরুরি কিছু না। তবু এক পারিবারিক ব্যাংকের মাধ্যমে হলেও এই সীমিত বাণিজ্যও বা কেন এমনভাবে তা চালু ছিল? অথবা অন্যভাবে বললে সেকালের ইউরোপে ব্যাপক কোন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রায় ছিল না কেন?
কলোনিদখল ব্যবসা যখন ইউরোপের প্রধান অর্থনীতিঃ
এর মূল কারণ, সেকালে মানে ১৬০৭-১৯৪৫ সাল এই প্রায় সাড়ে ৩০০ বছর ধরে চালু দুনিয়াটা ছিল কলোনি দখলদারদের যুগ। অর্থাৎ আমাদের মত দেশকে কলোনিদখল করা – এই ব্যবসা যখন ইউরোপের প্রধান অর্থনীতিক ততপরতা ছিল। যদিও এটাকে এই প্রথম ইতিহাসের রাজতন্ত্র ছেড়ে “রিপাবলিক” [republic] বা জন-রাষ্ট্র গড়ার যুগ বলে প্রশংসিত। তবুও এর সবচেয়ে নেতিবাচক দিকটা হল ওমন নব-রাষ্ট্রগুলোর প্রধান অর্থনীতি বলতে তা ছিল জাহাজে বিনিয়োগ আর সেই জাহাজ বেয়ে কলোনিদখল করে বেড়ানো। সোজা ভাষায় অন্যের দেশ দখল ও তার সম্পদ লুটে নিজ দেশে আনা। মানে সে সময়কালে স্বাধীন রাষ্ট্র বলতে ছিল ইউরোপের চার-পাঁচটা কলোনি দখলদার দেশ (বৃটিশ, ফরাসি, ডাচ, পর্তুগীজ ও স্পানিজ) আর বেশির ভাগই এদের কারো না কারো কলোনি দখল হয়ে থাকা দেশ। আর এর ব্যতিক্রম হিসাবে ছিল রাশিয়ান জার বা অটোমান সাম্রাজ্য ধরনের কিছু সাম্রাজ্য অথবা আমেরিকা (১৭৭৬ সালের আগে পর্যন্ত ছিল কলোনি) পরে স্বাধীন দেশ। ফলে আন্তঃদেশীয় বাণিজ্য বলতে বড় কিছুই ছিল না; মূল অর্থনীতিও তা ছিল না। তবে একটা বিশেষ ধরনের লেনদেন ছিল যে, দখল হয়ে থাকা কলোনি (যেমন বৃটিশ-ইন্ডিয়া) থেকে একপক্ষীয় সম্পদ পাচার ধরণের ততপরতা; মানে বৃটিশ-ইন্ডিয়া থেকে তাদের মূল ভূখণ্ড ইংল্যান্ডে সম্পদ লুটে নিয়ে যাওয়া ধরনের। এভাবে “ওয়ান ওয়ে” সম্পদ পাচারের ততপরতা, একে ঠিক বাণিজ্য বলা মুশকিল এবং তা অর্থহীনও!! আবার যেমন বরফ আবিষ্কারের পরে বৃটিশ আমলেই, আমেরিকা থেকে জাহাজ ভরে কলকাতার এলিটদের জন্য বরফের জাহাজ আসত। এটা বৃটিশ-ইন্ডিয়ার মূল অর্থনীতির তৎপরতা ছিল না বলে একে কলোনি ইন্ডিয়ার মূল অর্থনীতির তৎপরতা মনে করা মুশকিল। তবে কলোনি সম্পর্কের কারণেই বা কোন স্বাধীন রাষ্ট্র না থাকার কারণেই মূলত সেকালে আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য বলতে কিছু গড়ে উঠেনি।
তাই ১৯৪৪ সাল থেকেই আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের জন্ম ও পরের বছর কার্যক্রম শুরু হয়েছিল নয়া কলোনিমুক্ত স্বাধীন রাষ্ট্রগুলো ও পুরানা রাষ্ট্র, সবার মধ্যে আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য চালু করার জন্য; একটা গ্লোবাল বাণিজ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য। একদিক থেকে এটা ছিল এক বিশাল তাতপর্যপুর্ণ ঘটনা যে দুনিয়াব্যাপী এক আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছে। এবং এমন এক দুনিয়াতে যেখানে আইনিভাবেই আর কোন দেশকে আর কলোনি করে রাখা যায় না। জাতিসংঘের আইনে ও দৃষ্টিতে তা বেআইনি ও অন্যায়। তবু নয়া এই গড়ে উঠা বাণিজ্য ব্যবস্থা এর পণ্য বিনিময়ের সিস্টেমটা বড়লোক দেশগুলোর দিকে কান্নি মারা ভাবে গড়ে তোলা হয়েছে। তাই এই বিনিময় ব্যবস্থায় বৈষম্য আছে। তবে এটা অস্বীকার-উপেক্ষা করা ভুল হবে যে ১৯৪৫ সালের আগের কোন বাণিজ্য ব্যবস্থাই না থাকার চেয়ে এবং ইউরোপের হাতে কলোনি দখল হয়ে না থাকার চেয়ে এমন স্বাধীন রাষ্ট্র অবশ্যই ভাল!
কিন্তু ১৯৪৫ সালের পরও কিছু রাষ্ট্র যারা জাতিসঙ্ঘের সদস্য হলেও তবু তারা আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের সদস্য হয়নি বা তাদের করা হয়নি। অন্য ভাষায় বললে, এরা মূলত তখনকার কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলো, এরাই আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের সদস্য হয়নি। তাই এই অপারগতার জন্য তারা গ্লোবাল বাণিজ্য ব্যবস্থায় যোগ দিবার যোগ্য হয়নি। তবে এনিয়ে আরেকটু বিস্তারে বলা দরকার।
বাণিজ্য ও কমিউনিজমঃ
কমিউনিজমে কী বাণিজ্য থাকে? মানে কমিউনিস্ট দেশের অর্থনীতিতে কী বাণিজ্য থাকে? মানে অনুমোদিত?? এই হল, আদি কনফিউশন! আভ্যন্তরীণ বাণিজ্যও না থাকলে আভ্যন্তরীণভাবে যেকোন উতপাদিত পণ্য বিতরণ মানে ভোক্তা পর্যন্ত তা পৌছে দিবার বিতরণ ব্যবস্থা (এটাই ট্রেড বা বাণিজ্য) বলে কী ওদেশে কিছুই নাই? আর থাকলেই বা তা কেমন?
তবুও স্টালিনের সোভিয়েত ইউনিয়ন-এই মোড়ল কমিউনিস্ট দেশ, এর প্রতিনিধি আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের জন্মের সময় উপস্থিত ছিলেন। বিখ্যাত ব্রেটনউড শহরের এক হোটেলে টানা ২২ দিনের সেই সম্মেলনে কিছু সোভিয়েত প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের জন্ম নিয়ে আলোচনা ও দলিলপত্র খসড়া তৈরি শেষে, পরে দলিল স্বাক্ষরের সময় এবং তারও পরবর্তী সময়ে সদস্যপদের চাঁদা জমা দিয়ে সদস্য হওয়ার সময় সোভিয়েত প্রতিনিধি অনুপস্থিত ছিলেন। যদিও পরে স্টালিন বেঁচে ছিলেন ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত। কিন্তু তা সত্ত্বেও কেন সোভিয়েত ইউনিয়ন আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের সদস্য হয়নি তা কাউকে জানানো হয়নি। অথবা এই নিয়ে স্টালিন কোন কারণ তুলে ধরেছেন বা লেখাও লিখেছেন বলে জানা যায় না। আবার আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের কার্যক্রম শুরু হয়ে যাবার পরে যদিও কমিউনিস্ট দেশগুলো আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের সদস্য হবে না – এমন একজোট হয়ে কোন দিন এধরনের কোন সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাও সত্য নয়।
তবে এখান থেকেই একদিকে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক কেন্দ্রিক গ্লোবাল অর্থনীতি ও বাণিজ্য ব্যবস্থা চালু আর অন্যদিকে এসবের বাইরে থেকে গেছিল ২০-২৫ রাষ্ট্র যারা আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের সদস্যপদ নেয় নাই। যার অর্থ এই ২০-২৫ রাষ্ট্র এদের নিজেদের মধ্যেও কোন বাণিজ্য ব্যবস্থা বলতে কিছু ছিল না। প্রত্যেকেই বিচ্ছিন্ন অর্থনীতিক অস্তিত্ব হয়ে টিকে ছিল। যদিও এমন দেশগুলোকে “সোভিয়েত ব্লক” বা “কমিউনিস্ট ব্লকের” রাষ্ট্র বলার রেওয়াজ শুরু হয়েছিল। আর তা টিকে ছিল ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে না যাওয়া পর্যন্ত।
তবে কেবল পোল্যান্ডের কথা কিছু জানা যায়। আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের জন্মের পরে কার্যক্রম শুরু করলে পোল্যান্ড কমিউনিস্ট ব্লকের দেশ হওয়া সত্ত্বেও সে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের সদস্যপদের জন্য আবেদন করেছিল। আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকও রাজি ছিল, অভ্যন্তরীণ প্রস্তুতিও নেয়া হয়েছিল। তাদের যুক্তি ছিল একদিন না একদিন সবদেশকেই একই গ্লোবাল অর্থনীতির সম্পর্কের মধ্যে আনা আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের ম্যান্ডেট। কাজেই তাঁরা পোল্যান্ডকে সদস্যপদ দিবে। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের পক্ষে আমেরিকান প্রশাসনের সাড়া ও সমর্থন না পাওয়াতে ব্যাপারটা ওখানেই থেমে যায়। অর্থাৎ পরে সদস্যপদ না নেয়া বা পাওয়ার সিদ্ধান্তটা আর একা সোভিয়েত ব্লকের দেশগুলোর সমস্যা থাকেনি। আমেরিকার না চাওয়াও যুক্ত হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু অন্য দিক থেকে বললে, কমিউনিস্ট দেশের ব্যবহারিক চিন্তায়, বাইরের অন্যদেশের সাথে কোনো আন্তঃদেশীয় বাণিজ্য – এই আইডিয়াটা নিয়ে কমিউনিস্টদের মধ্যেই মূলত অস্বস্তি ও অস্পষ্টতা ছিল গভীর এবং যা এখনো কমিউনিস্ট চিন্তায় আছে- এ কথাও আরেক কড়া সত্য। এটা অনেকটা যেন ‘কমিউনিস্ট হারাম-হালাল’-এর সমস্যা। যেমন কমিউনিস্ট চোখে খোদ বাণিজ্য জিনিসটা কি হালাল? উৎপাদন একমাত্র সরকারি মালিকানায় হতে হবে এই ছিল সেকালের কমিউনিস্ট রাস্তা। ফলে এর সাথে আবার বাণিজ্যের দরকারটা কী? এমনই ছিল মনোভাবটা। যার সারকথা হল, এসব চিন্তার মুল জায়গাটা হল কমিউনিস্ট অর্থনীতিক চিন্তায় তাদের অর্থনীতিতে “পণ্য আমদানি” বলে কোন ধারনা নাই।
তবে এসব অস্পষ্ট কথা হয়ত সেকালের সোভিয়েত ইউনিয়নে নিজে অনেক বড় দেশ বলে চিন্তা করা যেত যে, দেশের প্রয়োজনীয় সব ভোগ্যপণ্যই সে নিজ দেশে উৎপাদন করে নিবে। তাই, পণ্য আমদানি হীনতার অর্থনীতি এটাই কমিউনিস্টদের বাস্তব অর্থনীতি বলে খারা করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু তুলনায় ধরা যাক বাংলাদেশের মত ছোট কোনো কমিউনিস্ট দেশ হলে তার বেলায় কী হবে?? সব প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য অথবা এমনকি কোন কাঁচামাল আমদানি তার জন্য অত্যাবশিকীয়। কারণ তার পক্ষে এসব কিছুই নিজ দেশে উতপাদন করা অথবা কম শ্রমমুল্যে তৈরি করাই অসম্ভব হবে। এছাড়াও আরেক বড় সমস্যা! তার ব্যাপক প্রয়োজনীয় হবে অর্থনীতিতে বিনিয়োগ পাওয়ার। এবং সেটা অবকাঠামো বিনিয়োগ এবং কারখানা নির্মাণে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (FDI) – এদুটাই ঐ কমিউনিস্ট দেশ কোনভাবেই যোগাড় করতে পারবে না। তত্সব হিশাবে দুনিয়ার প্রত্যেকটা দেশ বা অর্থনীতি নিজের প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ নিজেই জেনারেট ও সঞ্চয় করে থাকে। ফলে বিদেশ থেকে ঋণ আনা প্রয়োজনীয় হবার কথা না। কিন্তু শতভাগ বাস্তবতা হল, আমাদের মত সবদেশই নিজ প্রয়োজনীয় যে থাকবে এটাও স্বাভাবিক; তার পক্ষে আমদানি বাণিজ্য ছাড়া গতি কী? এ ছাড়া আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের সদস্য ছিল না বলে কমিউনিস্ট দেশগুলো বাণিজ্যে জড়িত হতে সুযোগ না পেয়ে ধুঁকে মরেছে। যদিও আধাখেঁচড়াভাবে কথিত বার্টার সিস্টেমের কথা বলে বছরে একবার হয়তো কোনো পণ্য ‘আমদানি’ করতে তাদের দেখা গিয়েছে। কেবল অবাস্তব জিদটাই থেকে গিয়েছে!!
সব ব্যর্থ হয়ে গেলেও কেবল বাণিজ্যকেই পাপ গণ্য করবেন কোন কমিউনিস্ট ধর্মেঃ
অথচ পুরা কমিউনিজমেই বাণিজ্য করা যাবে কি না, সহি বা তা সঙ্গত কি না এই অস্পষ্টতা কখনো কাটেনি। সারপ্লাস ভ্যলু বা শ্রমের চুরি যাওয়া উদ্বৃত মুল্য ফেরত এনে দিবে এমন নয়া এক অর্থনীতির তাঁরা প্রচলন করবেই। বাস্তবে এই চরমপণ এর প্রতিরুপ হল কথিত “সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি” যেটা কার্যত – “সরকারি মালিকানায় এক উতপাদন ব্যবস্থা” গড়লেই নাকি সেই কাম্য সমাধান পাওয়া যাবে – কিন্তু নানান কারণে এই কল্পিত অর্থনৈতিক সিস্টেমটাই কার্যত যেন টিকে থাকে তা কায়েম করাই যায় নাই। ফলে কল্পিত সেই “শ্রমের চুরি যাওয়া উদ্বৃত মুল্য ফেরত এনে দিতে পারব – এমন অর্থনীতিটাই অধরা থেকে গেছে, এই হল কড়া বাস্তবতা। এতে সব ব্যর্থ হয়ে গেলেও তবু “সেই কল্পনাটা মানে সমাজতন্ত্র – সেটাই ভাল ছিল” – এই জিদটাই কেবল এখনও টিকে আছে। কিন্তু জিদ – এটা না কল্পনায় না বাস্তবে – এর কোনই মুল্য নাই, অর্থহীন।
এটা তো গেল সেই সমাজতন্ত্র ভাবনা যার সারকথাটা এখন হতে পারে যে “সরকারি মালিকানায় এক উতপাদন ব্যবস্থা” গড়াটাই টিকানো যায় নাই বলে এই পদ্ধতিতেও শ্রমের চুরি যাওয়া উদ্বৃত মুল্য ফেরত আনার প্রতিশ্রুতিও ব্যার্থ হয়ে গেছে। তাই এখন আবার নতুন কোন অর্থব্যবস্থা – একটা সাসটেইনেবল কিছু কি করা যায় তা নিয়ে নয়া খোজ শুরু করতে হবে। কিন্তু এতে আমাদের আলোচ্য ইস্যু যে কমিউনিস্টদের জন্য বাণিজ্য হালাল কিনা – এই অনুমান-বিশ্বাসও জড়িয়ে আছে বলে – এই প্রশ্নও অমীমাংসিত থেকে গেছে ফলে বাণিজ্য ও কমিউনিজম – এদের পারস্পরিক সম্পর্কও কমিউনিজমে অমীমাংসিত। তবে এটা অস্বস্তিকর প্রশ্ন হলেও কার্যত সকলেই বাস্তবে তা মেনে নিয়েছে। তাই দেখা যাচ্ছে কমিউনিস্ট নিজেই ব্যবসা করছে, ব্যবসাদারদের বিল্ডিং ভাড়া দিয়ে সে পয়সায় দল চালাচ্ছে। যেখানে সারা বাংলাদেশের অর্থনীতিটাই গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের অংশ মানে বাংলাদেশের প্রতিটা মানুষ আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের অংশ এখন। তখন আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হন বা রাস্তায় ভিখারি কিংবা উন্নয়ন কনসালটেন্ট বা গবেষক কিংবা বসে বসে বই লিখছেন – ইত্যাদি যাই করেন কোন ফারাক নাই। আপনি গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের অর্থের ভাগীদার। এই ক্যাপিটালিজম আপনার মুখের ভাতের প্রতিটা গ্রাস এর যোগানদাতা। আমাদের রক্তের কণায় কণায় ক্যাপিটালিজম। তাহলে আপনি কমিউনিস্ট হন আর না হন কেবল বাণিজ্যকেই পাপ গণ্য করবেন কোন কমিউনিস্ট ধর্মে???
গ্লোবাল বাণিজ্যের পণ্য কেনাবেচায় অংশ নিতে গেলে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের সদস্য হয়ে থাকতেই হবে এটা একটা আবশ্যিক পূর্বশর্ত। তা মূলত এজন্য যে, প্রত্যেক দেশের নিজ মুদ্রার বিনিময় হার না জানলে বিদেশের কোনো পণ্য কেনাবেচায় অংশ নেয়া সম্ভব নয়। কারণ নিজ মুদ্রার বিনিময় হার না জানলে বিদেশী পণ্যের মূল্য নিজ মুদ্রায় কত, তা জানা সম্ভব নয়। বিশ্বব্যাংকের মুদ্রার নাম এসডিআর [SDR] যার মান প্রতিদিন এই প্রতিষ্ঠান, এক মার্কিন ডলার সমান কত এসডিআর তা প্রকাশ করে থাকে। সাধারণত তা, এক ডলার মানে ০.৭৪৩ এসডিআর – বিনিময় হার এর ‘আশপাশে’ হয়ে থাকে। আর এখান থেকেই প্রত্যেক সদস্য দেশ তার মুদ্রার মান বা তুল্য বিনিময় হার সম্পর্কে জেনে নিতে পারে। কিন্তু আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের সদস্য না হলে সেটাও জানা সম্ভব নয়। তাই এমন কমিউনিস্ট দেশের পক্ষে অন্যদেশের সাথে কোন বাণিজ্য করা অসম্ভব।
কবে কার্যত কমিউনিস্ট দেশগুলোর “বাণিজ্য করা পাপ” ধারণা থেকে আপাত মুক্তি মিলেঃ
সোভিয়েত ইউনিয়ন রাষ্ট্র ১৯৯১ সালের ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে ভেঙে যায়। ভেঙে রাশিয়াসহ মোট ১৫টা আলাদা আলাদা রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে গেছে। আর এরপর এসব রাষ্ট্র সবাই নতুন রাষ্ট্র হিশাবে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের সদস্যপদ লাভের জন্য আবেদন করেছিল। ১৯৯২ সালের মধ্যে তারা সবাই সদস্যপদ লাভ করে, গ্লোবাল বাণিজ্যে অংশ নেবার যোগ্য হয়ে যায়। কমিউনিজম মাথায় থাক কিন্তু পাপ-মুক্তি মিলে যায় সকল কমিউনিস্ট দেশে। তবে এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ব্যতিক্রম চীন। মাও-এর চীন সকল কমিউনিস্ট দেশের আগে অগ্রগামি যে ১৯৭৮ সালের পয়লা জানুয়ারি থেকে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের নেতৃত্বে গ্লোবাল বাণিজ্য ব্যবস্থায় প্রবেশ করেছিল। কখন ও কিভাবে সেই সময় সেকথা আপাতত এখানে না বলি; অন্য কখনও বলব বা বলাই আছে!!
ফলে বলতে গেলে, সোভিয়েত ভেঙ্গে গেলে পরে সেই প্রথম সারা দুনিয়ার সব রাষ্ট্রই একই আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের সদস্য হয়ে যায় মানে, গ্লোবাল বাণিজ্য ব্যবস্থার সদস্য হয়ে যায়। অর্থাৎ ১৯৪৫ সালের আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের চালু করার কার্যক্রমও যা পারে নাই তা সেই প্রথম সম্ভব হয়েছিল। এর ফলে, দুনিয়াতে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের অধীনস্থ গ্লোবাল অর্থনৈতিক এক মহাগোষ্ঠীর বাইরে ‘সোভিয়েত অর্থনৈতিক ব্লক’ বলে আর কোনো দেশ থাকার অবসান ঘটেছিল।
আগের এই ব্লক রাজনীতিতে দুই ব্লকে ভাগ হয়ে থাকা রাজনীতির আরেক প্রকাশ ছিল কোল্ড ওয়ার। মানে হল আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন (গত পঞ্চাশের দশক থেকে) এদুই পরাশক্তির রেষারেষি থেকে তারা যেন সবসময় কোনো যুদ্ধাবস্থায়, এমন টেনশন দেখা যেত; অথচ বাস্তবে তারা কোনো যুদ্ধে জড়িত নয় এমন থাকলেও এই টেনশন কাজ করত। পরে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ায় এই কোল্ড ওয়ারের অবসান ঘটেছে।
আমেরিকার নয়া অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী চীনঃ
কিন্তু একালে আমেরিকার নয়া প্রতিদ্বন্দ্বী চীন, যার অর্থনীতি ২০২৮-৩০ সালের মধ্যে আমেরিকাকে ছাড়িয়ে যাবে বলে নানান স্বাধীন পরিসংখ্যানগত অনুমান বলছে। যেহেতু এখানেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে তাও অভ্যাসবশত অনেক অধ্যাপকেও প্রায়ই মন্তব্য প্রকাশ করতে দেখা যায় যে, আবার কি কোল্ড ওয়ার তাহলে ফিরে আসবে? ফ্যাক্টস হল, কোল্ড ওয়ার দুনিয়াতে সত্যিকারার্থে আর ফিরে আসার কোনোই সম্ভাবনা নেই। এর একেবারেই মৌলিক কারণটা হল, এখন দুনিয়ার প্রায় সব দেশ একই গ্লোবাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অংশ (আমরা অনেকে ব্যক্তিগতভাবে তা পছন্দ করি বা না করি) হয়ে গেছে যে ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক। আর পুরনো কোল্ড ওয়ার যুগের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল- ‘সোভিয়েত ব্লক’ বলে কিছু রাষ্ট্র ছিল যারা গ্লোবাল বাণিজ্যে অংশ নেয়নি বা সম্পর্কিত ছিল না। সেটাও এখন আর নাই। আর কোল্ড ওয়ার রেষারেষি সেকালে (১৯৫০-৯১) এর বাস্তবতায় দেখতে পাবার একটা বড় কারণ ছিল এমন ‘সোভিয়েত ব্লক’ বলে আলাদা অর্থনৈতিক ব্লক হিসাবে কিছু দেশের অস্তিত্ব থাকার সুযোগ তখন ছিল, তাই। একালে এই বাস্তবতাটাই আর নাই, সব লোপ পেয়ে গেছে। এখন সব রাষ্ট্রই একই গ্লোবাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অংশ। তাই চাইলেও কোল্ড ওয়ার রেষারেষির আবহ আবার তৈরি করা সম্ভব নয়।
তাহলে একালে এই ব্যাপারটা আমরা এখন কী বা কেমন হবে-থাকবে, নতুন করে কী দেখতে পাবো?
উপরে এতক্ষণ ধরে গ্লোবাল বাণিজ্য ব্যবস্থাটা নিয়ে পাঠকের ধৈর্য চুরি করে কথাগুলো বলে গিয়েছি – এখন সিদ্ধান্ত টানতে পারব বলে।
“এশিয়া টাইমস” [Asia Times] হংকং থেকে প্রকাশিত এক প্রভাবশালী পলিটিক্যাল ও ফাইন্যান্সিয়াল ওয়েব পত্রিকা। বলা যায় যেন এশিয়ার “ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল“। এর গত ২৮ এপ্রিল এক রিপোর্টের শিরোনাম হল, ‘চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে আমেরিকান অর্থনীতি প্রথম কোয়ার্টারে জিডিপি নেমে গেছে” [Dependence on China shrinks the US economy in Q1]।’ এর ভিতরের রিপোর্ট বলতে চাইছে, আমেরিকান অর্থনীতি চীনা পণ্য আমদানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ার কারণে আমেরিকার জিডিপি চীনের সাথেই ওঠানামা করা শুরু করেছে। এ কারণে রিপোর্টারের মন্তব্যঃ দুনিয়াতে আগের কোনো রেকর্ড নেই এমন এক ঘটনা এটা- দুনিয়ার প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী বা রাইভাল [rival] অর্থনীতি তারা এমনই আজব রাইভাল যে, তারা একে অপর দেশটা থেকে আমদানিতে পণ্য আনাতে নির্ভরশীল হয়ে গেছে, অথচ তারা স্ট্র্যাটেজিকভাবে রাইভ্যাল দুই দেশ যে, পারলে অপরকে মেরে ফেলে! সারকথায় এতে চীন-আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতি আমেরিকার বিরুদ্ধে, চীনের পক্ষে গেছে। চীনের সাথে আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতি এখন প্রায় ১৮ ট্রিলিয়ন ডলার আর এটাই আমেরিকার জিডিপি-কে নামিয়ে দিয়েছে। গত ৩০ বছরের মধ্যে ক্রমশ এই ঘটনাটা ঘটে গেছে। ট্রাম্প আমলের সাথে তুলনায় চীনাপণ্য আমদানি এখন ৬০% বেড়ে গেছে।
তাহলে, এখানে প্রাসঙ্গিক মূল কথাটা হল, একালে কোল্ড ওয়ার উত্তর যুগে, কেউ কারও প্রধান স্ট্র্যাটেজিক প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ বলে তার সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক নাই বা করা যাবে না – বাস্তবে এমনটা দেখা যাবে না। একালে বরং রাইভালের সাথেও বাণিজ্যিক সম্পর্ক হতে দেখা যাবে; তা অবশ্যই হবে। এমনকি তা সবচেয়ে গভীর নির্ভরশীলতার অর্থনৈতিক সম্পর্কে ডুবে থাকছে ও থাকবে। এখানেই একাল পুরোপুরি আলাদা! আর এখান থেকেই জাতিবাদি অর্থনীতির বুঝা একেবারে ফেল করে, অচল হয়ে যায়। জাতবাদি বুঝের উল্টাটাই বাস্তবে দেখা যায়। অতএব কোল্ড ওয়ারের যুগ আবার দুনিয়াতে ফিরে আসবে বলে কেউ যেন গল্প না ফাঁদে। আর সাথে জাতিবাদি অর্থনীতির বুঝ যেন আর কেউ প্রাকটিশ না করে নিজেকে যেন শাসন করে রাখে!!
আর এটাই কমবেশি একই অবস্থা ভারত-চীনের বাণিজ্যিক সম্পর্কের মধ্যেও। প্রথমত তারা উভয় দেশ এখন ঘোরতর এক বাণিজ্য সম্পর্কে লেপটে জড়িয়ে আছে। অথচ তারা প্রবল ও প্রধান স্ট্র্যাটেজিক রাইভ্যাল দুই দেশ। ভারত পারলে চীনকে ছিড়ে খায়!! ভারতের ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস লিখছে, ‘২০২১ সালের পরিসংখ্যান বলছে গত এক বছরে ভারতের চীনা পণ্য আমদানি বেড়েছে ৪৩%।’ এই খবরের শিরোনামটা হল, [Amid bilateral chill, India-China trade marks record surge in 2021] অথচ চীন-ভারতের রাজনৈতিক সম্পর্ক এখন শীতলতম, ঠাণ্ডা। গত ২০২০ সালের সীমান্ত সংঘর্ষের পর থেকে নরেন্দ্র মোদি গত কয়েক বছর ধরে চীনা আমদানি কমাবেন বলে প্রপাগান্ডা ক্যাম্পেইন শুরু করেছিলেন – স্বদেশ জাগরণ মঞ্চ [Swadeshi Jagran Manch] নামে আগে থেকে এক সংগঠন গড়া ছিল সেটা দিয়ে। কিন্তু ফলাফল উল্টা এবং নিজের এই দুরবস্থা দেখে মোদিও নিশ্চুপ!
এটাই কোল্ড ওয়ার-পরবর্তী যুগের ফেনোমেনো। কারো সাথে যুদ্ধের সম্পর্ক থাকলেও সে দেশের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক, আমদানি নির্ভরশীলতার সম্পর্ক আরো জোরদার হতে পারে, একালে। সোজা কথায় জাতিবাদী অর্থনীতি বলে কোনো ধারণা এখানে ব্যর্থ শুধু নয়; জাদুঘর আর্কাইভে ফেলে রেখে দিবার বিষয় হয়ে গেছে। বাস্তবে বরং প্রায় উল্টারূপে তা এখন হাজির হচ্ছে! তাই মোদি এ নিয়ে এখন একেবারেই চুপ!
কিন্তু ব্রহ্ম চেলানি ততই ভোকাল!
ব্রহ্ম চেলানি [Brahma Chellaney] – ছোট হলেও দিল্লিতে তার একটা থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠান আছে; নাম সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ। প্রো-আমেরিকান থিংকট্যাংক বলা যায়। কিন্তু এই বাইডেনের আমলে তিনি বারে বারে বাইডেনের ওপর ক্ষেপে উঠছেন। আবার প্রচণ্ড চীনবিরোধী তিনি, আর তা কখনও একেবারে আনলাইক একাদেমিক স্বভাবে!!! সময়ে মোদির চেয়েও বেশি ন্যাশনালিস্ট হয়ে উঠতে দেখা যায় তাকে! চীনকে তিনি ‘আগ্রাসনবাদী চীন’ [aggressor]- সবসময় তিনি এভাবে লিখেন। মানে সময়ে তিনি আমেরিকাকেও ছাড়িয়ে চীনবিরোধি হয়ে যান। এমনকি খোদ তিনিই আমেরিকার-বিরোধি হয়ে উঠেছিলেন একসময়। তাকে প্রথম এমন ক্ষেপে উঠতে দেখা গিয়েছিল গত ২০২১ আগষ্টে বাইডেন যখন আফগানিস্তান ফেলে পালিয়ে আসেন; সব সেনা ফিরিয়ে আনেন। চেলানি পরাশক্তির এই শিয়াল ভূমিকা দেখে এটা মেনে নিতে পারেননি। তাই বাইডেনেরই কঠোর সমালোচনা করেছিলেন আর সেটা এমনই পর্যায়ে যে প্রায় ফিরে যেন তিনি আবার বুশের কোলে গিয়ে উঠতে চাইছেন দশা!
সেই ব্রহ্ম চেলানি, তিনি ইদানীং আবার ক্ষুব্ধ! প্রধানত কোয়াডকে [QUAD] নিয়ে। কোয়াড-এর চার দেশের প্রধানদের এবার সাক্ষাতে (অন লাইন বা ভার্চুয়াল নয়) সম্মেলন হচ্ছে আগামী ২৪ মে ২০২২। আর তাতে এখনই চেলানির হইচই শুনে মনে হচ্ছে যেন এবার ভারতের বদলে দক্ষিণ কোরিয়ার নাম নতুন অন্তর্ভুক্ত হবার কথা উঠেছে, তা হয়েই যাবে। সেটা হোক আর না হোক, চেলানির এবারের কলামের (প্রথম আলো যার অনুবাদ ছেপেছে – কোয়াড কি চীনকে ঠেকানোর লক্ষ্য থেকে সরে যাচ্ছে? – এই নামে) শিরোনাম। বুঝা যাচ্ছে এখানেও খুবই এগ্রেসিভ তিনি! যেমন- আনুষ্ঠানিকভাবে চীনকে ঠেকানো যেন কোয়াডের লক্ষ্য এটা ধরে নিয়ে তিনি লিখছেন। অথচ, এটা বোধহয় কোথাও পাওয়া যাবে না।
যা হোক, তিনি কোয়াডের চার দেশের উপরই প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত। কেন? তিনি দেখতে চান যে, এ’চার দেশের কারো সাথে চীন থেকে চীনা পণ্য-আমদানির বা বাণিজ্য সম্পর্ক বলতে কিছু নাই। অর্থাৎ মনে মনে তিনি যেন একটা কোল্ড ওয়ার আমলের সোভিয়েত-আমেরিকা সম্পর্ক দেখতে চাইছেন। এ কারণে তিনি মোদির উপরেও প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত!
কিন্তু তাকে কে বুঝাবে, একালের গ্লোবাল পরিস্থিতিতে তিনি যেমনই একে দেখতে চান না কেন সেটা আর দেখার সুযোগই নাই; সব বদলে গেছে। অর্থাৎ উপরে লেখার শুরুতে গ্লোবাল বাণিজ্য ও এর গতিপ্রকৃতিকে প্রসঙ্গ করে অর্ধেরই বেশি পাতা খরচ করেছি – এজন্য যে এই ধারণাটা সকল পাঠকেরই খুব কাজে লাগবে। অসংখ্য ব্রহ্ম চেলানি-রা ছড়িয়ে আছে এবং আরো গজাবে। কিন্তু তাঁরা কী বলতে চাইছেন এবং কেন এসব কথাগুলোর এখন আর বাস্তবতা নাই – সেটা সম্পর্কে পাঠকে সচেতন ও প্রস্তুত করতেই এই লেখা। ফলে কোল্ড ওয়ার যুগের মত চেহারা-বৈশিষ্ট্য একালে আর দেখা যাবে না বা তা আর ফিরবে না। জাতিবাদী অর্থনীতিই তো লোপ পেয়ে গেছে – সেই ১৯৮০ সালের শুরু থেকেই গ্লোবাল বাণিজ্যই দুনিয়ার মুখ্য অভিমুখ হতে চেয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে গেছে। অর্থাৎ কোল্ড ওয়ার এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন জীবিত থাকতেই এই পরিবর্তন যাত্রা শুরু করেছিল। তবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর থেকেই বাণিজ্য গ্লোবাল হয়ে উঠা আর এর প্রভাব টের পাওয়া প্রবলভাবে শুরু হয়েছে। তাই একালের বৈশিষ্ট্য হল, যেকোনো দেশের স্ট্র্যাটেজিক রাইভালের সাথেও তার বাণিজ্যিক সম্পর্ক একালে অবশ্যই থাকবে। সেটা চীন হলেও তাতেও ব্যত্যয় ঘটবে না; বরং যেন আরও ভালোভাবে থাকবে। কারণ যেসব চীনাপণ্য সবচেয়ে সস্তা তা আপনি না কিনে (আমদানি করে) তো আপনার রেহাই নেই। বরং চীনাপণ্য কিনতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবানই মনে করবেন।
যেমন এই উদাহরণটা ভালো করে লক্ষ করেন!!! তবে সাবধান এটা চীনের প্রশংসার ইস্যু নয় বা চীনের প্রশংসা করার জন্য লিখা মনে করলে ভুল হবে। বরং আজকের বাস্তবতাটা খেয়াল করতে ও বুঝতে হবে। ভারতে বেশির ভাগই জাপানি প্রাইভেট কার – এই গাড়ির জয়েন্ট ভেঞ্চারে গড়ে ওঠা কারখানা ভারতে আছে। কিন্তু সেই জাপানই মোদি সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছে যেন চীনা স্পেয়ার্সের (যন্ত্রাংশ) ওপর বাড়তি ট্যাক্স বসানো না হয়। মানে, প্রত্যাহার করা হয়। কেন? কারণ, গাড়ির অরিজিন জাপানি আর এসেম্বল ভারতে হলেও এর স্পেয়ার্সগুলো ভারতে বসে ওর যন্ত্রাংশগুলো চীনাপণ্য আমদানি করে এনে লাগানো। কারণ চীনা স্পেয়ার্স-এর দাম আকাশপাতাল কম। সে কারণেই জাপান সরকারের নিজেরই অনুরোধ এটা মোদির কাছে। [ভারতের বোকার “জাতিবাদি অর্থনীতি বুঝ” যে অচল ও অকেজো সেটা দেখাতে ২০২০ সালের আমারই এক পুরান লেখা এখানে দেখা যেতে পারে। ]
অর্থাৎ ব্রহ্ম চেলানির চিন্তাটা পুরনো যা ১৯৮০ সালের আগ পর্যন্ত কোনোমতে চলতে পারা “জাতিবাদী অর্থনীতির বুঝ” দিয়ে তৈরি। অথচ এই “মফস্বলি বুঝ” নিয়ে তিনি এখন দুনিয়াকে এবং কোয়াড-দেশের অর্থনীতিকেও ব্যাখ্যা করতে গেছেন। এর মানে, তিনি খোয়াবে আছেন যে, তিনি যেন ১৯৮০ সালের আগেই এখনো আছেন।
এমনকি তিনি চীনা আরসিইপি [RCEP] জোট মানে যেটা ‘ভ্যালু অ্যাডিশন শেয়ার্ড প্রোডাক্ট’ উৎপাদনের এক নয়া জোট যেটা আসলেই এক বিরাট আগামী সম্ভাবনার জোট – এর প্রবল বিরোধিতাও করেছেন। জাতিবাদি বুঝের ভারত এতে যোগ দিতে চায়না, আঙুর ফল টক মনে করে। কিন্তু বাংলাদেশ সাহস করে এত যোগ দিবার আবেদন করেছে সঠিক ভাবেই। বহু আগে থেকেই বলে আসছি যে, স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ বা ফরেন রিলেশনবিষয়ক গ্রাজুয়েট-বিশ্ববিদ্যালয় লেভেল থেকেই সিলেবাসে অর্থনীতিকেও অন্তত একটা সাবসিডিয়ারি বিষয় হিসাবে একালে রাখতেই হবে। কারণ যে কেউ অর্থনীতির কিছু না পড়লেও নিজেকে জাতিবাদী অর্থনীতির ওস্তাদ বলে হাজির করতে পারে। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি এখন জাতিবাদী অর্থনীতির বুঝ থেকে বহু দূরে চলে গেছে। কাজেই নতুন বাস্তবতা বুঝতে অন্তত কিছু অর্থনৈতিক নতুন ধারণা জানতেই লাগবে। অনেক স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ বা ফরেন রিলেশনবিষয়ক প্রফেসরের মধ্যেও এই (জাতিবাদী অর্থনীতির বুঝ দিয়ে সব ব্যাখ্যার) ঝোঁক দেখা দিতে পারে বা এখনও থেকে যেতে পারে।
তাই অন্তত জাতিবাদী অর্থনীতির বাস্তবতা যে আর নাই এটুকু রিয়ালাইজ করাই হবে তাদের প্রথম পাঠ! মোদির “স্বদেশ জাগরণ মঞ্চ’ তাই এখন চীনের বিরুদ্ধে নিশ্চুপ। আবার সাবধান, ব্যাপারটা চীন বলে নয়; যেকোনো দেশের সাথে হতে পারে। বিদেশী পণ্য আমদানি এখন সাধারণ ব্যাপার যখন আপনিও রফতানিকারক। এটা গ্লোবাল বাণিজ্যের যুগ!
তাই যাকে পছন্দ করেন না তার সাথেই সবচেয়ে বেশি বাণিজ্যিক সম্পর্ক; ফলে রাজনীতিক সম্পর্ক শীতল থাকলেও বাণিজ্যিক ঘনিষ্ঠতাই এখান খুবই স্বাভাবিক!
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
[এই লেখাটা দৈনিক “নয়াদিগন্ত” পত্রিকার ৯ এপ্রিল ২০২২ ওয়েবে আর পরদিন প্রিন্টে “যারে দেখতে পারি না তার আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে যাই, কেন? “– এই শিরোনামে ছাপা হয়েছিল। ঐ ছাপা হওয়া লেখাগুলোকে আমার লেখার ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ বলা যায়। আর আমার এই নিজস্ব সাইটের লেখাটাকে সেকেন্ড ভার্সান হিসাবে এবং থিতু ভাষ্য বলে পাঠক গণ্য করতে পারেন। আসলে পরবর্তিতে ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ লেখাটাকেই এখানে আরও অনেক নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে ও নতুন শিরোনামে এখানে আজ ছাপা হল। ]