গ্লোবাল অর্থনীতির মোচড় বুঝতে, জিম ও’নিল পাঠ



যে নায়ক এখন ভিলেন হতে চায়?
গ্লোবাল অর্থনীতির মোচড় বুঝতে, জিম ও
’নিল পাঠ

গৌতম দাস

২৩ মে ২০২২, ০০:০৫ সোমবার

https://wp.me/p1sCvy-46Y

 

      Brics ‘grew more than I thought’, says Jim O’Neill 2016

The Big Issues for 2022

জিম ও’নিল [Jim O’Neill] মূলত যুক্তরাজ্যের [UK] এক অর্থনীতিবিদ। আমেরিকার নিউ ইয়র্ক সিটির ওয়াল স্ট্রিট পাড়ায় সবচেয়ে প্রভাবশালী এক বিনিয়োগ কোম্পানি ‘গোল্ডম্যান স্যাশে’[Goldman Sachs] আর এরই প্রধান অর্থনীতিবিদ ছিলেন তিনি; আর এর পুরা সেই সময়কালটা হল ১৯৯৫-২০১৩ সাল। তাঁর প্রসঙ্গে বৃটিশ সরকারের উপস্থাপিত এক বাইওগ্রাফিতে দেখা যাচ্ছে সেখানে লেখা আছে – Jim O’Neill worked for Goldman Sachs from 1995 until April 2013, spending most of his time there as Chief Economist.। পরে ২০১৫-১৬ সালে তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের অর্থমন্ত্রী ছিলেন। তিনি ‘প্রজেক্ট সিন্ডিকেট’ [Project Syndicate] নামে বিভিন্ন নামি-লেখকের প্রবন্ধ সংগ্রহ ও মজুদের যে ওয়েবসাইটটা আছে সেখানে ২০০৮ সাল থেকেই তিনি নিয়মিত কলাম লিখে থাকেন বলে তারা জানাচ্ছে।

গোল্ডম্যানের সাথে থাকার সময়ের তার কিছু কাজ ছিল দুনিয়ায় সবচেয়ে প্রভাব পড়া ঘটনার একটা যা, তাকে বিখ্যাত করেছিল বলে মনে করা হয়। সেই ২০০১ সালের এক নিবন্ধে তিনি প্রথম আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের সমান্তরাল প্রতিষ্ঠান হিসাবে নয়া ব্রিকসের {BRICs} ধারণা (যা থেকে পরে ব্রিকস BRICS ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়) নিয়ে আসেন। কাজের অংশ হিসেবে তিনি তখন আসলে একটা নিবন্ধ বা পেপার লিখেছিলেন যার শিরোনাম ছিল ‘বিল্ডিং বেটার গ্লোবাল ইকোনমিকস ব্রিকস’ [Building Better Global Economic BRICs.”]। পরে সেই ধারণাটাই আরো সবিস্তার করেছিলেন ২০০৩ সালে সিরিজ আকারে লিখে। সেখানেই তিনি পরিসংখ্যানগত ফ্যাক্টস-ফিগার বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের ভিত্তিতে একটা পূর্বাভাস বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘২০৪০ সালের মধ্যে চীনা অর্থনীতি আমেরিকাকে ছাড়িয়ে যাবে’ [China’s economy could become as large as the US economy (in nominal dollar terms) by 2040]।

সেই ও’নিল গত বছর ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর তাঁর সেই প্রথম রচনার ২০ বছর পূর্তিতে এ নিয়ে প্রজেক্ট সিন্ডিকেটেই একটি কলাম লিখেছিলেন। “ব্রিকস কী আদৌ কখনও জাগবে? [Will the BRICS Ever Grow Up?] শিরোনামে।  যেখানে তার আরো কিছু আপডেট মূল্যায়ন যোগ করেছিলেন।

যদিও তাঁর ২০০১ সালের প্রথম মুখ্য মন্তব্যটা ছিল, তিনি “রাইজিং ইকোনমিজ” [Rising Economy] দেশ বলে একটা নয়া শব্দ চালু করেছিলেন। সেকালেই দাঁড়িয়ে দেখে, শতকোটির উপরের জনসংখ্যার দুই দেশ চীন ও ভারতকে এদের অর্থনীতির গ্রোথ রেট দেখে তিনি ‘রাইজিং ইকোনমি’র দেশ বলে আলাদা এই ক্যাটাগরি চালু করেছিলেন। সার কথায় বলেছিলেন, চীনা অর্থনীতি সবাইকে ছাড়িয়ে এক নম্বর অবস্থানে যাবে। আর ভারত সেকালের এশিয়ার জাপানকেও ছাড়িয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে চলে যাওয়া আমেরিকার পরে, মানে তৃতীয় স্থানে উঠে যাবে […… India could surpass Japan to become the third-largest economy soon thereafter; ]। শুধু তা-ই নয়, তৎকাল থেকেই এক বিবেচনায় সবচেয়ে উন্নত অর্থনীতির ব্লক বা গ্রুপের দেশ বলতে জি-৭ [G7 group] দেশগুলোকে বুঝানো হত; সেই জি-৭ ভুক্ত (কানাডা বাদে) দেশগুলোর মোট প্রবৃদ্ধির চেয়ে একত্রে এই নয়া রাইজিং ইকোনমিগুলোর দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি যোগ করলে এটাই বেশি হবে – এই ছিল তার প্রধান দৃষ্টি-আকর্ষণী মন্তব্য!! অর্থাৎ তিনি তুলনা করছিলেন সেকালের অর্থনৈতিক অবস্থার বিচারে শীর্ষ ইকোনমিক ব্লকের সদস্য এমন সাত দেশের সাথে রাইজিং ইকোনমিগুলোর প্রবৃদ্ধি যোগফল – এটা তুলনায় ভালো ও বেশি সম্ভাবনাময় বলে দাবি উঠিয়ে!!

স্বভাবতই জিম ও’নিল এর এই কাজ, এটা কোনো গণকের ভাগ্য গণনা ছিল না। ছিল বাস্তব পরিসংখ্যানগত ফ্যাক্ট ও ফিগারের উপরে দাঁড়িয়ে করা বিশ্লেষণ। তাই ওই প্রবন্ধ সেকালে ওয়াল স্ট্রিট জগতে অর্থাৎ গ্লোবাল বিনিয়োগ পুঁজির পুঁজিবাজারের জগতে ব্যাপক আলোড়ন ও তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল। এর মূল কারণ, গ্লোবাল অর্থনীতিতে কখনো এতে কম হারে প্রবৃদ্ধি হলে তা গ্লোবাল বিনিয়োগ ও পুঁজিবাজারের জগতে খুবই নেতি চোখে ও ব্যবসা খারাপ যাওয়ার ইঙ্গিত বলে বিবেচিত হয়। তাদের হিসাবটা সোজা;  সেটা হল যে যত ভাল বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ততই তা আরো বড় বিনিয়োগ পুঁজির জন্য বড় চাহিদার বাজারের ইঙ্গিত আর ততই তাদের ব্যবসা  ভাল ও বাড়বার সম্ভাবনা নিয়ে আসবে সেটা।
আর এখানেই একপর্যায়ে জাতিবাদি অর্থনীতির ধারণা ব্যর্থ ও ভেঙে পড়া শুরু হয়ে যায়। কিভাবে, কেন?

‘ওয়াল স্ট্রিট’ বলতে এখানে ঠিক কী বোঝানো হচ্ছে:
আক্ষরিক অর্থে ‘ওয়াল স্ট্রিট’ [Wall Street] বলতে  সেটা নিউ ইয়র্ক শহরের কোন একটা পাড়া-মহল্লাই মাত্র। আমাদের মতিঝিলের মত! কিন্তু এখানে এখন থেকে সেটা আর কেবল নিউ ইয়র্কের কোন একটা পাড়া-মহল্লাই নয়, বরং প্রতীকী অর্থে এটাই গ্লোবাল বিনিয়োগ কোম্পানি ও গ্লোবাল পুঁজিবাজারের সাধারণ স্বার্থ – এটাকেই বুঝানো হয়েছে। কারণ গ্লোবাল বিনিয়োগ কোম্পানি ধরণের কোম্পানির প্রধান অফিসগুলো বেশির ভাগই নিউ ইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিট পাড়াতেই অবস্থিত বা শুরু হয়েছিল। অনেকটা যেমন খুবই ক্ষুদ্র-অর্থে হলেও বাংলাদেশের পুঁজি ও শেয়ারবাজার বলতে ‘মতিঝিল’ পাড়া বুঝানো যায়। অবশ্য একালে “ওয়াল স্ট্রিট” ততপরতা আর কেবল ওয়াল স্ট্রিটেই সীমাবদ্ধ নয়, তা ছাড়িয়ে এর একটা দুবাইয়ে ও আরেকটা সিঙ্গাপুরে গড়ে উঠে ইতোমধ্যেই আসর জমিয়েছে; যদিও তা ওয়াল স্ট্রিটেরই ঠিক প্রতিদ্বন্দ্বি না বরং সহযোগী হিসেবে নয়া কিছু অঞ্চলে, গ্লোবাল বিনিয়োগ কোম্পানি ও গ্লোবাল পুঁজিবাজারের নয়া কিছু তুলনায় ছোট কেন্দ্রভুমি হিসেবে যাত্রা শুরু করে। তাই ‘ওয়াল স্ট্রিট’ বললে এখন থেকে বুঝতে হবে এর ব্যাপকার্থে  – গ্লোবাল বিনিয়োগ কোম্পানি ও গ্লোবাল পুঁজিবাজারের সাধারণ স্বার্থের কথাই বলছি।

নিউ ইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিটের জন্ম বা যাত্রা শুরু ধরা হয় ১৭৯৪ সাল। তখনকার গভর্নর পিটার স্টাইভেসেন্টের [Then-Governor Peter Stuyvesant] এক নির্দেশে ওয়াল স্ট্রিট গড়ে উঠেছিল মূলত নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জকে কেন্দ্র করে [NYSE]। যেটার ঠিকানা ১১ নম্বর ওয়াল স্টিটে।  আর এর প্রায় শত বছর পরে ১৮৮০ এর দশকে আমেরিকান অর্থনীতি তখনকার বড় অর্থনীতি ব্রিটেনকে প্রথম ছাড়িয়ে গিয়েছিল। যে ব্রিটিশ এম্পায়ার ছিল সবচেয়ে বড় কলোনি দখলদার যার সূর্য নাকি ‘কখনো অস্ত যায় না’ বলে গর্ব করা হত। আর এরও পরবর্তীতে আরেক বিরাট ঘটনাটা হল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-৪৫)। যে সময়ের প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট, যাকে বলা হয় আমেরিকাকে দুনিয়ার গ্লোবাল নেতা বানানোর নায়ক; সেই রুজভেল্ট ছিলেন আসলে প্রধানত ওয়াল স্ট্রিটেরই স্বার্থ মাথায় রেখে চলা প্রেসিডেন্ট। আর এভাবে চলে তিনিই প্রথম আমেরিকাকে গ্লোবাল নেতার স্তরে উত্তীর্ণ করেছিলেন। রাষ্ট্রের হাতে সঞ্চিত বিপুল উদ্বৃত্ত সম্পদ সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে, মূলত ওয়াল স্ট্রিটের কোর [core] স্বার্থে, তিনি আমেরিকাকে এই স্তরে উঠিয়েছিলেন। আর তাই দেখা যায় এই প্রেসিডেন্টের চার টার্মের সময়কালে তাঁর আশপাশের  প্রায় সব উপদেষ্টা-মন্ত্রী-পরামর্শদাতা বা দফতর পরিচালকরা যারা ছিলেন তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড হল যারা এর আগে ওয়াল স্ট্রিটের বিনিয়োগ কোম্পানিগুলো চালাতেন, মানে ওর (ঠিক মালিক না) পরিচালন-কর্তা বা এক্সিকিউটিভ হিসাবে কাজ করেছেন।

এখন যে প্রশ্নটা তুলব, সেটা হল নিউ ইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিটের স্বার্থ কি সবসময় আমেরিকা রাষ্ট্রের স্বার্থ ছিল? হয়ে আছে বা থাকতে পেরেছে? এর জবাব খুঁজব এখন।

জিম ও’নিল যখন ‘রাইজিং ইকোনমি’ বলে নয়া টার্মে কথা বলা শুরু করেছিলেন তখনকার চীনা অর্থনৈতিক উত্থান মানে  সেটা ডাবল ডিজিট গ্রোথের (১০% বা এর উপরের জিডিপি) প্রথম দশকটা (১৯৯০-২০০০) পার হয়ে গেছে। ও’নিল মূলত চীনের এই উত্থান দেখেই ‘রাইজিং ইকোনমি’ টার্মটা আনছেন, কারণ ভারতের অর্থনীতিতে তখনও তেমন নড়াচড়া শুরু হয়নি। তবে ভারতেরও চীনের (এখন ১৪২ কোটি 2022) মতই বিপুল জনসংখ্যার দেশ শতকোটি (এখন ১৩৮ কোটি) ছাড়িয়েছে যা। যার সোজা মানে, একটা সঠিক নীতি-পলিসি বেছে নিতে পারলে এই জনশক্তিই হয়ে উঠতে পারে সম্পদ আর তাতে বিপুল উদ্বৃত্ত ও সঞ্চিত সম্পদের এক রাষ্ট্র হতে পারে ভারত। তাই চীনকে দেখেই ভারতও সেই থেকেই হতে পারে এমন সম্ভাবনাময় গোনায় ধরা দেশ বলে গণ্য হয়ে উঠেছিল।

পরিস্কার করে রাখি, এখানে সেসময় বলতে তা আমেরিকান প্রেসিডেন্ট (২০০১-০৮) জুনিয়র বুশের শেষ আমল আর প্রেসিডেন্ট (২০০৯-১৬) ওবামা আমলের শুরু এদুই কালের এক মিলিত সময়কাল ছিল সেটা।
সময়টা একই সাথে আরো অনেক কিছুর। যেমন আফগানিস্তানে বুশের ওয়ার অন টেররে পা আটকে গেছে তা টের পাবার সময় সেটা। মানে ২০০৫-০৬ সাল থেকেই এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, তখন আর দুনিয়াটা সোভিয়েত-আমেরিকা এভাবে দুই মেরু দুনিয়া নয়। আর সেখান থেকেই এই দৃষ্টিভ্রম যে কাজেই একা আমেরিকা তখন দুনিয়াতে যা খুশি করতে পারে বাধাহীনভাবে একথায় তখন জুনিয়র বুশ এন্ড গংয়েরা ভেবেছিল – আর এটাই, তখন পরিস্কার হয়ে যায় যে এই বুঝাবুঝি ছিল ভিত্তিহীন। কারণ আমেরিকা তখন আফগানিস্তানে নিজেই এমন এক যুদ্ধে জড়িয়ে গেছে যেখানে বিজয় দূরে থাক যুদ্ধ-ফেলে নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার আশু সম্ভাবনাটুকুও নাই। মানে নিরন্তর খরচের এক অন্তহীন যুদ্ধে আটকে গেছে আমেরিকা যা থেকে কোন প্রাপ্তি বা সুফলও নাই। আর এতে খরচ জোগাতে ব্যর্থ আমেরিকান অর্থনীতি শেষে এথেকেই এক নয়া গ্লোবাল মহামন্দা্র (২০০৭-০৮) ডেকে এনেছিল বা গড়িয়ে যায়। অথচ তুলনায় তখনো চীনের প্রবৃদ্ধি ডাবল ডিজিট না হলেও ৭-৮ শতাংশ চালিয়ে যাচ্ছিল। মহামন্দার প্রভাব পশ্চিমা দেশগুলোতে ছিল সর্বোচ্চ অথচ যেটা চীন-কেন্দ্রিক এশিয়া দেশে ততটা অনুভুত নয়!  ব্যাপারটাকে ব্যাখ্যা করা যায় সম্ভবত এভাবেঃ এতদিনের পশ্চিমের হাতে উপেক্ষিত হয়ে থাকা এশিয়ার অর্থনীতি এবার উলটা উপেক্ষিত হয়ে থাকাটাই তো তাদের সুবিধা – মানে এশিয়ান অর্থনীতি পশ্চিমের সাথে ততটা সমন্বিত বা ইন্ট্রিগেটেড ছিল না, করা হয় নাই  বলেই পশ্চিমের মহামন্দার আঁচ এশিয়ায় কম দেখা যাচ্ছিল।

আর এসব কিছু দেখে শেষে ওয়াল স্ট্রিট আর আমেরিকা-কেন্দ্রিক বা পশ্চিমাকেন্দ্রিক থাকতে পারেনি বা চায়নি। বিদেশে যেখানেই আয় করুক, আমেরিকাতেই তাকে উদ্বৃত্ত সম্পদ ফেরত নিতে হবে, এই বাধ্যবাধকতা এই প্রথম সে ভুলতে শুরু করেছিল। এশিয়াতেই নয়া বিনিয়োগ বাজার, তাই নয়া চাহিদার দেশ অঞ্চলকেন্দ্রিক হয়ে যায় সে!! এটাই জিম ও’নিলের পর্যবেক্ষণের মর্মার্থ বলে দাবি করা যায়!  আমেরিকান নিজস্ব সার্ভে রিপোর্টগুলোতেও তা প্রতিফলিত হতে থাকে। সার কথায়, ওয়াল স্ট্রিট আর জাতিবাদি থাকেনি, পারে নাই। গ্লোবাল স্বার্থ হয়ে উঠেছিল। রুজভেল্টের আমেরিকায় এই প্রথম ওয়াল স্ট্রিটের সাধারণ স্বার্থ আর আমেরিকার রাষ্ট্রস্বার্থ হয়ে থাকতে পারে নাই। এক ব্যাপক বিচ্ছেদ ঘটে যায়। এটা মনে করা ভুল হবে না যে এই বিচ্ছেদের ঘটনাটাই জিম ও’নিল এর পর্যবেক্ষণে ধরা পরেছিল। আবার এখানেই জিম ও’নিল যখন ‘রাইজিং ইকোনমি’ এই তত্ব আনলেন এটাই আসলে তখন ওয়ালস্টিটের আচরণের সাফাই হিসেবে ব্যবহৃত হতে থেকেছিল। এক কথায়, এই প্রথম ওয়াল স্ট্রিট আমেরিকার রাষ্ট্রস্বার্থ ফেলে চীনা ‘রাইজিং ইকোনমি’র ভেতরে নিজের ‘কোর’ মানে, গ্লোবাল বিনিয়োগের বাজার এই মৌলিক স্বার্থ খুঁজে পেয়েছিল!

ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের সংস্কারঃ
সাথে আরও উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা ছিল ২০০৯ সালের। যেমন একটা হল,  বিশ্বব্যাংকের ঢেলে সাজানোর ঘটনা। না, সবটা বোধহয় ঠিক বললাম না। আসলে এটা হল ঘটনার কেবল বাইরের দিকটা দেখে বললে। বিশ্বব্যাংক জন্ম থেকেই এর “অভ্যন্তরীণ তথ্য উন্মুক্ত নয়” – এভাবেই গড়ে উঠেছিল। এর সম্ভাব্য দুটো কারণ আছে মনে করা হয়। এক. বিশ্বব্যাংক কাজের ধরণ অনুসারে কোন সাধারণ আম পাবলিককে সার্ভিস দেয়ার প্রতিষ্ঠান নয়। তবে পাবলিকের যে রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠান আছে মূলত এর সাথে তার কারবার ও ডিলিং [dealing]। আর সেটাকেই সুযোগ হিসেবে নিয়ে এর কান্ট্রি অফিসগুলো (যেমন বাংলাদেশের বিশ্বব্যাংক অফিস) পাবলিক থেকে দূরে পাবলিক ডিলিং না করেও চলতে পারত। সাধারণ তথ্য যেমন কোন দেশের মৌলিক তথ্যাবলী বা কান্ট্রি প্রোফাইল – এ’তথ্যও উন্মুক্ত ছিল না তখন। দুই. এরই সম্ভাব্য কারণ মনে করা হয়, কোল্ডওয়ার যুগ বলে তখন ছিল  কড়া কমিউনিস্ট ভীতি। এ’ভীতির কারণে নিজেকে ঢেকেঢুকে কেবল সংশ্লিষ্ট দেশের অর্থ মন্ত্রণালয়ের বহির্বিভাগ (ERD বা এক্সটারনাল রিসোর্স ডিভিশন) আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের (বাংলাদেশ ব্যাংক যেমন) সাথে যোগাযোগ রক্ষার মধ্য দিয়েই নিজ তৎপরতা চালিয়ে নিতে অসুবিধা হতো না। আগের এই ঢেকেঢুকে চলার সিদ্ধান্ত ভেঙে নিয়ে বিশ্বব্যাংক উন্মুক্ত হয়ে যায় ২০০৯ সাল থেকে। এমনকি এখন তো কান্ট্রি অফিসেরও ফেসবুক পেজ আছে যেখানে অনেক ইস্যুতে ওপেন আলোচনাও দেখতে পাওয়া যাবে। প্রশ্নোত্তর ও তথ্য সেখান থেকে পাওয়া যাবে। এ ছাড়া প্রতিটি ইস্যুতে বিভিন্ন দেশের কান্ট্রি অফিসগুলো বা হেড কোয়ার্টারের বহু কিছুই এখন নানা ওয়েবসাইট থেকে সরাসরি যে কেউ আম-পাবলিক নিজেই জানতে পারে। একালে ‘ডিসকাশন ব্লগও’ [discussion blog] আছে যার বুলেটিন পাওয়া বা ওয়েবে সদস্য হওয়া যায়। কিন্তু কেন এই উন্মুক্ততা? সেটাও জিম ও’নিল-এর পরোক্ষ প্রভাব। কিভাবে সেটা?

আসলে রাইজিং ইকোনমির দেশগুলোর মোট প্রভাব তখন ক্রমশ জি-৭ উন্নত অর্থনীতিগুলোকেও ছাপিয়ে যাচ্ছে এ’কথার গুরুত্ব তখন কেউ অস্বীকার বা ছোট করে আর দেখতে পারছিল না। এ’ছাড়া ওয়াল স্ট্রিট আপন স্বার্থেই এসব ঘটনা ও তথ্যকে গুরুত্ব দিয়ে সামনে এনেছে। মূল কথা, এর আরো কিছু প্রভাব ছিল মারাত্মক।

যেমন, বিশ্বব্যাংকের প্রাকটিস বা নিয়ম হল, নিজ অর্থনীতির সাইজ-প্রভাব অনুসারে সদস্য দেশকে কম বা বেশি চাঁদা দিয়ে শুরুতে বিশ্বব্যাংকের সদস্যপদ নিতে হয়। আর পরে যাদের অর্থনীতির সাইজ ব্যাপক বড় কিছু হয়ে যায় ততই বাড়তি চাঁদা দিতে হয়। এখন এই চাঁদা মানে কী আবার? চাঁদা মানে, বিশ্বব্যাংক এর মালিকানা আসলে এক শেয়ার হোল্ডিং কোম্পানির মত আর সদস্য দেশগুলোর চাঁদা দেওয়াটাই আসলে সদস্য দেশের বিশ্বব্যাংকের শেয়ার কেনা হিসেবে দেখা হয়। কাজেই সদস্যদেশের অর্থনীতি যত বড় হয়ে যাবে ততই বড় শেয়ার কিনতে হবে। কিন্তু ব্যতিক্রম হল, একেবারে বড় মালিকানাগুলোর বেলায়। যেমন এখন সবচেয়ে বড় মালিকানা আমেরিকার; তা ১৬.৫৭% [অবশ্য গত ২০ বছরের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, এটা ১৬-১৮% এর মধ্যে নড়াচড়া করেছে]। পরে জাপান ৮.৩২%। আর এরপর ইউরোপের বড় অর্থনীতির চারটা দেশ ৪-৫ শতাংশের বেশি কেউ নয়। তুলনায় বাংলাদেশ ১ শতাংশের শতভাগের এক অংশের মত, এরকম। নিচের এই ডাটা পেয়েছি  সরাসরি বিশ্বব্যাংকের সাইট থেকে, তবে একটু পুরানা। যা কম্পাইল করা হয়েছে ২০১৯ পর্যন্ত আর প্রকাশিত ২০২০ সালে। [নিচের এই তথ্য যথেষ্ট আপডেটেড না, তবে এর চেয়ে আপডেট সংগ্রহ আমার নাগালে আসে নাই।]

Who are the World Bank’s shareholders and
how much capital do they own?
• 189 member countries have subscribed to US$280
billion of subscribed capital (paid in capital + callable
capital)
• The largest shareholders include the United States
(16.57% of total subscribed capital), Japan (8.32%),
China (4.59%), Germany (4.16%), and France and
the United Kingdom (with 3.90% each
source: WORLD BANK 2020

কিন্তু বিরোধ বাধে চীন নিজের শেয়ার বাড়াতে চাইলে। চীন তার নয়া অর্থনীতির সাইজে শেয়ার মালিকানা বাড়াতে চাইলে তাতে আমেরিকা মানে তার সিনেট সেই ফাইলে অনুমোদন দেয়নি। মানে অভ্যন্তরীণভাবে বিশ্বব্যাংক টেকনিক্যালি চীনের প্রস্তাবের পক্ষে সায় দিলেও তা পাস করতে আমেরিকান মতামত চেয়ে পাঠালে সেই ফাইল আর (মূলত আমেরিকান সিনেট থেকে) ফিরে যায়নি। ফলে চীনের শেয়ার (২০১৯ পর্যন্ত) ৪.৫৯% এর নিচেই থেকে যায়। তুলনায় ভারতের শেয়ার হল ২.৯১%, এটা ভারতের সরকারি তথ্য।  

আসলে বিশ্বব্যাংকে চীনের মালিকানা বাড়ানোর আবেদনে সাড়া না দেয়া  এটা ছিল চীনের প্রতি আমেরিকার এক অব্যক্ত মেসেজ। মানে কিছু না বলে যেটা ইঙ্গিতে বলা হয়ে যায় তা হল যে, আমি আমেরিকা বিশ্বব্যাংকের মালিকানায় চীনের শেয়ার বাড়াতে দিব না। একে নিজ নিয়ন্ত্রণেই রাখব। আমেরিকা জানত [জিম ও’নিলের ততপরতার কারণে অনুমানে] যে, চীন তাহলে নিজেই আলাদা করে বিশ্বব্যাংক খুলবে। আর সেক্ষেত্রে সম্ভাব্য সেটাই তুলনায় আমেরিকার স্বার্থের জন্য ভাল বলে আমেরিকার কাছে মনে হয়েছিল।

আসলে ততদিনে, মানে সেই ২০০৩ সাল থেকে জিম ও’নিল যখন ‘রাইজিং ইকোনমির’ তত্ব দিচ্ছেন, সম্ভবত পরোক্ষে তিনি চীনের রাইজিং অবস্থা দেখে আগে থেকেই চীনকে উৎসাহ দিচ্ছিলেন যে, চীন যেন নিজ প্রভাবাধীন (আমেরিকান প্রভাবের বিপরীতে) নয়া আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের সমতুল্য প্রতিষ্ঠান দুটোই গড়ে নেয়।

পাঠককে মনে করিয়ে দেই, জিম ও’নিল-এর কথাগুলো কিন্তু আদতে ছিল ওয়াল স্ট্রিটের স্বার্থের দিকে তাকিয়ে বলা কথা। অর্থাৎ যে কথা এখন সহজ করে বলতে পারি যে, আমেরিকান ওয়াল স্ট্রিট স্বার্থ সে রাইজিং চীনা সরকারকে পরামর্শে দিয়ে বলে চলছিল যে, নিজ প্রভাবাধীন নয়া আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক সমতুল্য প্রতিষ্ঠান খাড়া করে নাও। অর্থাৎ সেই থেকে ওয়াল স্ট্রিটের স্বার্থ আর জাতিবাদ আমেরিকান সীমায় থাকেনি, থাকতে চায়নি বা থাকলে নিজ অস্তিত্বের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে যেত।

অতএব সেই থেকে ও’নিলের BRIC বা ব্রিক ধারণাটা সবল হচ্ছিল। আর ২০০৯ সালে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের সংস্কার এবং উন্মুক্ত করা আর সেই সাথে চীনকে প্রত্যাখ্যানের সেই বছরই ব্রিকস ব্যাংক [BRICS Bank] নামে চীনা প্রভাবাধীন নয়া প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়ে যায়। এখানে একটু তথ্যের কারেকশন আছে। জিম ও’নিলের প্রথম আইডিয়াটা ছিল চীন, ভারত আর সাথে রাশিয়া ও ব্রাজিলকে নিয়ে মানে তাদের দেশের নামের প্রথম অক্ষরত নিয়ে BRIC বা ব্রিক এভাবে। ২০০৯ সালে এই চার দেশ নিয়েই ব্রিক নামে যাত্রা শুরু করেছিল। কিন্তু পরের বছর দক্ষিণ আফ্রিকাকেও সাথে জুড়ে নিলে এবার নয়া নাম হয়ে যায় ব্রিকস [BRICS]।

এখন একটা প্রশ্ন, তাহলে ব্রিকস ব্যাংক যদি এর নাম হয়  তো সেক্ষেত্রে এটা একটাই প্রতিষ্ঠান। বিপরীতে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক তো প্রতিষ্ঠান হিসেবে আলাদা দুটো; যদিও তাদের সমন্বয় আছে। এমনকি কোনো দেশের বিশ্বব্যাংকের সদস্য হতে হলে সেই দেশকে আগে আইএমএফের সদস্য হতেই হয়। সেটা হয়ে থাকলে এবার বিশ্বব্যাংকের সদস্য হওয়ার সে যোগ্য হয়। তা হলে ব্রিকস ব্যাংক কার সমতুল্য, আইএমএফ না  বিশ্বব্যাংক এর? এর উত্তর হল, আসলে ব্রিকস ব্যাংকটাই আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের মিলিত ধারণা। আর এর ভেতরে ‘নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক’ [NDB] বলে বিশ্বব্যাংক সমতুল্য আরেকটা নয়া প্রতিষ্ঠান খোলা হয়েছে।

কিন্তু জিম ও’নিল এখন অন্য কিছু বলছেনঃ
গত ১৭ মে ২০২২ ও’নিল আরেক কলাম লিখেছেন সেই প্রজেক্ট সিন্ডিকেট ওয়েবেই। যার শিরোনাম হলো ‘ফের গ্লোবাল মহামন্দা কী আসন্ন?’ [Another Global Recession?]  আর আমাদের প্রথম আলোও এ’লেখার একটা অনুবাদ ছাপিয়েছে।   এখানে পাঠককে আবার একটু মনে করিয়ে দেই। এখানে “এখন” মানে সুনির্দিষ্ট করে যখন বাইডেন তার নয়া ও শেষ অস্ত্র [স্যাংশন ও মানবাধিকার] নিয়ে হাজির যেটাতে জিদ আছে কিন্তু সাফাই নাই। মনের গহীনের জিদটা হল যে, দুনিয়াতে সাদা চামড়ার (সাদা ককেশীয় এথনিসিটি) শাসন চলে আসছে, যা প্রায় ৫০০ বছর [মোটামুটিভাবে ১৬০৭ সালে আমেরিকাকে (আজকের ভার্জিনিয়া রাজ্য) বৃটিশ কলোনি করা দিয়ে শুরু থেকে আজও] ধরে টিকে আছে। এটা যেভাবেই হোক বাইডেন আরো টিকিয়ে রাখবেন। চীনা অবজেকটিভ উত্থানের বিরুদ্ধে  জিদ-জবরদস্তিতে যা করা যায় এমন সবকিছু করে হলেও টিকে থাকবেন! তাতে অবজেক্টিভ বাস্তবতা ভিন্ন কিছু বললেও তিনি জিদ ধরে আড়াআড়ি বসে থাকবেন। একবার বলবেন অবরোধ আর মানবাধিকার  নামে নতুন দুটো অস্ত্র এনেছেন। এতে আর অর্থ-অস্ত্র কোনটাই আর লাগবেই না। আমেরিকা এমনিতেই ইউক্রেনসহ সবকিছুতেই জিতে যাবে। আবার রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে প্রায় শেষ বা আপস হতে যাওয়া অবস্থায় পৌছে গেলে এবার নয়া ৪০ বিলিয়ন ডলার অর্থ-অস্ত্র ঢেলে সেই মরা যুদ্ধকে তিনি আবার চাঙ্গা করছেন। এমনকি এতে ডেমোক্রাট-রিপাবলিক দুদলই মিলে আপোষের অর্থের অনুমোদন দিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ ডেমোক্রাট-রিপাবলিক দুদলই যে আসলে “সাদা শ্রেষ্ঠত্ব” জাতিবাদ বা সাদা চামড়ার শাসনের ঘোর সমর্থক তা এখানে উদাম হয়ে প্রকাশিত। কিন্তু এতে স্বভাবতই আমেরিকান জন্য বড় যুদ্ধের খরচ বাইডেন ডেকে নিয়ে আসছেন, যা বইবার অর্থনৈতিক অবস্থা আমেরিকারই নাই, এই দুইদল তা জানা সত্বেও একাজ করছে অবলীলায়!! অর্থাৎ আবার আরেক ভয়াবহ হিটলারিজম মানে এক এথিনিসিটির শ্রেষ্ঠত্ব কায়েম কিন্তু তফাত এই যে এবার জর্মান শ্রেষ্ঠত্বের বদলে সাদা ককেশীল শ্রেষ্ঠত্ব – করে হলেও তারা দুনিয়ার নেতা থেকে যাবেই। গ্লোবাল অর্থনৈতিক নেতৃত্ব যেন গায়ের জোর জবরদস্তি বা সামরিক শক্তি দিয়ে অর্জন করার বিষয়???

তাই এ অবস্থায় ও’নিল নিজের এ লেখার সারাংশ শুরুতেই লিখছেন এভাবেঃ
এককথায় ও’নিলের এই লেখা পড়লে অনুমান হবে ও’নিল তিনিও সম্ভবত দুনিয়া থেকে সাদা শাসন উঠে যাওয়ার শকুনি শোকের ফাঁদে পড়েছেন!!!
যদিও তিনি এলেখার শুরুতেই নিজ লেখার সারাংশ করে বলছেন, “উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোতে আসল আয় ক্রমেই কমছে, ওদিকে চীনের দুর্বল বাইরের চেহারা আর সাথে ইউক্রেন যুদ্ধের সাথে লতিয়ে থাকে অনিশ্চয়তা এসব কিছুর মধ্যে করোনা মহামারীর ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার বদলে নিচে চলে যাওয়া দেখে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু তা সত্তে¡ও নীতিনির্ধারকদের এখনো অনেক কিছু করার সুযোগ আছে, যাতে ধাক্কাটা কাটিয়ে ওঠা যায়!

Between falling real incomes in advanced economies, China’s weakening outlook, and the uncertainties stemming from Russia’s war in Ukraine, there is more than enough reason to worry that the post-pandemic recovery is giving way to a downturn. But there is still much that policymakers could do to mitigate the blow.

এ বক্তব্যের তাৎপর্যপূর্ণ দিকটা হল, ও’নিল গ্লোবাল অর্থনীতি করোনা মহামারী ক্ষতি কাটিয়ে উঠার বদলে নিচের দিকে যাওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন কিন্তু তাতে বাইডেনের বর্তমান অনুসৃত নীতি-পলিসিই যে এটা তৈরি করছে সেদিকে জিম ও’নিলের ভ্রুক্ষেপ নাই। তিনি বাইডেনের নীতিতে খারাপ ভুমিকা বা আপত্তির কিছু দেখছেন না। একেবারে বাইডেনের নামই তিউনি উচ্চারণ করেন নাই। কেন? ভাসুরের নাম? পতিত বৃটিশ অর্থনীতিকে টেনে তুলতে বাইদেনকে দরকার? তাই এখন কিছু বিপক্ষে বলা যাবে না??   আসলে সবমিলিয়ে পুরো ব্যাপারটা রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণে হয়েছে এই পশ্চিমা বায়াসড অবস্থানটাই তিনি গ্রহণ করেছেন। সাধারণত পলিটিক্সের চেয়ে যার আগ্রহের বিষয় অর্থনীতি হয় তিনি যেকোনো উপায়ে অর্থনীতির অস্থিতিশীলতার বিরুদ্ধে খাড়া অবস্থান নেন। কিন্তু এখানে তিনি ব্যতিক্রম, তা করেননি।
আবার ধরা যাক পুতিন সবকিছুর জন্য দায়ী তবু সেক্ষেত্রে যুদ্ধের সম্ভাবনা বাড়ানোর দিকে আরো ঠেলে দেওয়া কী বাইডেনের নীতি-পলিসি হতে পারে? করোনা উত্তরকালে অর্থনীতির রিকভারি গুরুত্বপুর্ণ, খাদ্যের মূল্য নিচে নামানো গুরুত্বপুর্ণ নাকি পুতিনকে শায়েস্তা?

আবার ও’নিল রাজনীতির প্রসঙ্গেই যদি ঢুকলেন তা হলে বাইডেন কেন বিনা অর্থ-অস্ত্রের যুদ্ধের কথা বলে শেষে প্রায় আপস হয়ে যাওয়া ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধকে টেনে অর্থ-অস্ত্রের যুদ্ধের মধ্যে ঢুকালেন এটাও ও’নিলের চোখে আমল পায়নি। তা হলে তিনিও কী এখানে চীনা উত্থানে সাদা শাসন হারানোর আশঙ্কার দ্বারা প্রভাবিত? অথচ তিনিই না অবলীলায় ওয়াল স্ট্রিটের স্বার্থের পক্ষে দাঁড়িয়ে মানে, পরোক্ষে রাইজিং চীনের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন, ফোরকাস্ট করেছিলেন এবং তার ফোরকাস্ট ২০৪০ সালে চীন আমেরিকাকে ছাড়িয়ে যাবে, যা এখন ‘২০২৮ সাল’ বলছে ইন্ডিপেনডেন্ট পরিসংখ্যান স্টাডির লোকেরা। তিনি এখন তা হলে পিছাচ্ছেন কেন? পালাচ্ছেন কেন? এখানে তিনি নিজ পুরনো অবস্থানের বদল সাদা শ্রেষ্ঠত্বের ছোঁয়ায় প্রভাবিত হয়েছেন বলেই মনে হচ্ছে!!!

আবার চীনের বর্তমান লকডাউন প্রসঙ্গে দুই রকম কথা বলছেন। এক দিকে বলছেন, ‘সেই দিক থেকে সংক্রমণ ঠেকাতে সতর্ক থাকার ব্যাপারে চীনের সমালোচনা খুব কমই করা যেতে পারে” [China can hardly be criticized for being generally cautious. ]।’ আবার বলছেন, চীন “কোভিডের বিরুদ্ধে এত কড়া অবস্থান নিবার বদলে শিথিল করলে চীনা অর্থনীতি চাঙ্গা হবে; এটা চীনের জন্য ভাল, গ্লোবালিও ভাল”!  আসলেই জিম ও’নিল কী বলছেন এগুলা????

শেষে বলছেন তিনটা ফ্যাক্টরের কথা, আমেরিকান ফেডারল রিজার্ভসের সিদ্ধান্ত, চীনা নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত আর পুতিনের কথা। প্রথমত তিনি বাইডেনের নীতি-পলিসির উপর দুনিয়ার যেন কিছুই নির্ভর করে না, এই মিথ্যা অনুমানের উপর দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। অর্থাৎ দুনিয়া উলটে গেলেও এমন অবস্থানে থেকেই তিনি কথা বলবেন বলে আগেই ঠিক করেছেন।  কারণ এই তিন ফ্যাক্ট্রের মধ্যে বাইডেনের সিদ্ধান্ত-করণীয় কোনোই ফ্যাক্টর নয়, তিনি ধরে নিয়েছেন। তাই এই তিনের একটাতেও বাইডেন ফ্যাক্টর নয়।  অথচ বাইডেন ৪০ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ নিয়েছেন যেন তিনি ইউক্রেনকে অর্থ-অস্ত্র দিয়ে এই যুদ্ধ সেপ্টেম্বর-অক্টোবর পর্যন্ত চালাতে পারেন। আর মরা যুদ্ধকে জাগিয়ে আরো কমপক্ষে ছয়মাস জীবিত-যুদ্ধ করে দেয়া মানেই সরাসরি অন্তত জ্বালানি তেল, ভোজ্যতেল আর গম বা খাদ্যের দাম কমার বদলে আরো বেড়ে যাবার সব লক্ষণ নিশ্চিত করেছেন বাইডেন। অথচ ও’নিল এখানে এসে বাইডেনের নাম উচ্চারণই করছেন না।  সোজা কথায় ও’নিল দেখা যাচ্ছে তাঁর নিজ কথা আর কাজের মধ্যে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন। তিনি কেন সাদা শ্রেষ্ঠত্ব বা বাইডেনের নীতির সমর্থক হচ্ছেন এর কোন কারণও বলছেন না। এমনকি তিনি যে সমর্থক তা পাঠক যেন বুঝবে না বলে ধরে নিয়েছেন!

সবচেয়ে বিস্ময়কর হল, বাইডেনের হাতে এখন আরো ছয় মাস আরামে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার অর্থ আছে। মানে, যুদ্ধকে টেনে নিয়ে যাবার অর্থনৈতিক সক্ষমতা। অথচ ও’নিল এটাকে কোনো ফ্যাক্টর মনে করছেন না!! তার এ অবস্থানের মধ্যে ওয়াল স্ট্রিটের কোনো স্বার্থ কিভাবে লুকিয়ে আছে? তিনি নিশ্চুপ!!!

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

 

[এই লেখাটা  দৈনিক  “নয়াদিগন্ত” পত্রিকার  ২১ মে  ২০২২ ওয়েবে আর পরদিন প্রিন্টে   জিম ও’নিল : যে নায়ক এখন ভিলেন!– এই শিরোনামে  ছাপা হয়েছিল।   ঐ ছাপা হওয়া লেখাগুলোকে আমার লেখার ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ বলা যায়।  আর আমার এই নিজস্ব সাইটের লেখাটাকে সেকেন্ড ভার্সান হিসাবে এবং  থিতু ভাষ্য বলে পাঠক গণ্য করতে পারেন।  আসলে পরবর্তিতে ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ লেখাটাকেই এখানে আরও অনেক নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে ও নতুন শিরোনামে এখানে আজ ছাপা হল। ]

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s