ইরান সফরে পুতিন-এরদোগান, রাইসির সাথে বৈঠক


ইরান সফরে পুতিন-এরদোগান, রাইসির সাথে বৈঠক

গৌতম দাস

০১ আগষ্ট ২০২২, ০০:০৬ সোমবার

https://wp.me/p1sCvy-4bH

 

  Russia, Turkey and Iran have in recent years been holding talks as part of the so-called ‘Astana peace process’ to end more than 11 years of conflict in Syria [File: Reuters]

 

 

ঠাণ্ডা পানিতে গোসল, মানে “নো হিটার” গোসল; কখন? যখন তাপমাত্রা শূন্যের দিকে ধাবমান বা মাইনাসে চলে গেছে। যেকোন কারও জন্য এটা অবশ্যই একটা বড় রকমের শাস্তি। অথচ তা শুরু হয়ে গেছে!

সারা ইউরোপেই কমবেশি আগস্ট থেকেই তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রির নিচে নামতে শুরু করে আর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির দিকে চরমে ওঠে, মানে এটা শূন্য বা মাইনাসে নেমে যায়। আর এর সাথে পাল্লা দিয়ে যেন রাশিয়া এখন থেকেই ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ কমানো শুরু করেছে। বিশেষ করে জার্মানির অবস্থা ভালো না।

বিবিসি জার্মানির হ্যানোভার শহর নিয়ে এক রিপোর্ট করেছে “কোল্ড শাওয়ার [Cold showers ]” শিরোনাম দিয়ে; মানে গোসলখানায় ঠাণ্ডা পানিতে গোসল নিয়ে। রিপোর্টের সারকথা, এখন থেকেই  রাশিয়ান গ্যাস সরবরাহের অভাবে ইউরোপে জ্বালানি মিতব্যয়িতা শুরু হয়ে গেছে। হ্যানোভার সিটিতে সব পাবলিক গোসলখানায় পানির হিটার বন্ধ করা হয়েছে। রুম হিটার সীমিত করা হয়েছে। এমনকি হাতে করে বয়ে নিয়ে বেড়ানো এসি, হিটার বা রেডিয়েটর ধরণের সবকিছুই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মূল কারণ,  ইউরোপে রাশিয়া তার গ্যাস সরবরাহ ইতোমধ্যেই অর্ধেক করে দিয়েছে। সামনে আরো কী করে কেউ জানে না। এদিকে ২৭ রাষ্ট্রের জোট ইইউর সম্মিলিত সিদ্ধান্ত রাশিয়ান গ্যাসের অভাবে তারা সবাই গ্যাসের ব্যবহার এবার শীত সিজনে কমপক্ষে ১৫% কম করবে। এসব থেকেই বিবিসির এ রিপোর্ট ‘কোল্ড শাওয়ার’। প্রশ্ন হচ্ছে, ইউরোপ কি এবার ‘কোল্ড শাওয়ারের’ শাস্তি সহ্য করতে সক্ষম হবে?

না ব্যাপারটা এমন নয় যে, রাশিয়ার গ্যাস ছাড়া ইউরোপের কোনো বিকল্পই নেই; ঠিক তা নয়, কিন্তু অন্য যেকোনো বিকল্প জ্বালানি পাওয়ার জন্য কোনো চুক্তি করা দিয়ে শুরু করতে হবে। এরপর সবচেয়ে কষ্টকর অংশ হল, সেই জ্বালানি বয়ে আনতে প্রয়োজনীয় নয়া বিনিয়োগ করে নয়া অবকাঠামো গড়ে সেই জ্বালানি এনে এবার তা ব্যবহার-উপযোগী করে ঘর গরম বা পানি গরমের জায়গায় নিতে সব মিলিয়ে কমপক্ষে পাঁচ বছর সময় লাগাতে হবে। এটাই ইইউ এতদিন বহুভাবে বাইডেনকে বুঝাতে চেয়েছে, পারেনি। তাহলে আগামী ২০২৭ সালের আগে পর্যন্ত তারা চলবে কী করে? নাকি আগামী ডিসেম্বরের (২০২২) আগেই বাইডেনের হাত ছেড়ে ইইউ পুতিনের হার ধরে আপস করে ঘর গরম, পানি গরমের সুখ নিতে মরিয়া হয়ে উঠবে! সেটাই এখন দেখার অপেক্ষায়!
বিবিসির ওই রিপোর্টের শেষ বাক্যটা হল, ‘ইউরোপে রাশিয়ান গ্যাস সরবরাহ যুদ্ধের আগে ছিল মোট চাহিদার অর্ধের বেশি একা রাশিয়ান গ্যাস এখন যা এক-চতুর্থাংশের কম’।

“Russian gas supplies now account for about a quarter of the nation’s needs, compared with more than half before the war.”

রাশিয়ার গা-ঝাড়া দিয়ে উঠাঃ
দুনিয়ায় অন্য দিকের সব ঘটনাবলিতে রাশিয়া যেন গা-ঝাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে। পুতিন বিদেশ সফরে বের হয়েছেন, তিনি ইরান সফরে গেছেন। রাশিয়ার ওপর ডলার-ইউরো-ইয়েন ইত্যাদিসহ আরো কয়েকটা মুদ্রার অবরোধে রাশিয়া যেন টুপ করে ভেঙে পড়বে! বাইডেনের নেতৃত্বে পশ্চিমা শক্তির [Western bloc] এই ছিল প্রবল বিশ্বাস ও আকাঙ্খা যাতে তারা দেখতে পাবে পুতিন সারেন্ডার করে মাফ চাচ্ছে! কিন্তু সরি, তা বাস্তবে ঘটেনি তা তো আমরা সবাই দেখতে পাচ্ছি। উল্টো দুনিয়াজুড়ে গ্লোবাল মুদ্রাস্ফীতিই শুধু নয়, এখন বিশ্বব্যাংকই দাবি করছে, গ্লোবাল বাণিজ্য-অর্থনীতিতে মহামন্দা আসন্ন, তা এলো বলে। সাথে নিয়ে আসছে খাদ্যাভাব দুর্যোগে এলেমেলো করে দেয়া মানুষের জীবনযাত্রায় প্রবল ধাক্কা! গ্লোবাল জিডিপি ২.১% এ নেমে যাবে এ বছর আর আগামী বছর ২০২৩ সালে যা আরো নেমে ১.৫% হয়ে যেতে পারে।

“In a news conference, World Bank President David Malpass said global growth could fall to 2.1% in 2022 and 1.5% in 2023, driving per capita growth close to zero, if downside risks materialized.” – REUTERS

বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাস এক সংবাদ সম্মেলন করে সাবধান করছেন যে, “অনেক দেশই এই ধাক্কা এড়াতে পারবে না”।  তিনি এই সঙ্কটের নামকরণ করেছে ‘মন্দা-মুদ্রাস্ফীতি’ বা ‘স্টাগ-ফ্লেশন’ [stagflation]।

এদিকে খোদ আমেরিকার প্রথম তিনমাস বা প্রথম কোয়ার্টারের জিডিপিতেই যেখানে টানাটানিতে তা ছিল মাত্র ১.৬%। সেটা দ্বিতীয় কোয়ার্টারে আরো কমে হয়েছে  ১% এরও নিচে, তা ০.৯%। গত পরশু মানে ২৮ জুলাই তা প্রকাশিত হয়েছে। যেটাকে আমেরিকা অর্থনৈতিক মহামন্দা আসা নিশ্চিত হবার লক্ষণ বলে আমেরিকান অর্থনীতি ও বাজার জুড়ে ছড়িয়ে পড়া ধারণা বলে তা হাজির হয়েছে।

Real gross domestic product (GDP) decreased at an annual rate of 0.9 percent in the second quarter of 2022, following a decrease of 1.6 percent in the first quarter. The smaller decrease in the second quarter primarily reflected an upturn in exports and a smaller decrease in federal government spending. – BEA.GOV

কিন্তু তবু বাইডেন নির্বিকার। তিনি ইউক্রেনকে আরো ভারী অস্ত্র ও অর্থ সরবরাহ আর সেই সাথে, ইইউর উপর রাশিয়ান জ্বালানি নেওয়ার চেষ্টা না করতে চাপ দিয়েছেন। আপস না করতে চাপ দেয়া চালিয়ে যাচ্ছেন। কোনোভাবেই এরা যেন পুতিনের সাথে রফা না করে ফেলে তার হুঁশিয়ারি দিয়ে যাচ্ছেন।

তাই, এসব চাপ যে, রাশিয়ার উপর কাজ করছে না তা দেখাতেই যেন রাশিয়া গা-ঝাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে। সেকারণে, পুতিন পাল্টা পশ্চিমের অবরোধে যারা কষ্টভোগী তাদেরকে সাথে মিলে নয়া জোট করে উঠে দাঁড়ানো চেষ্টা করছেন – এমনই কিছু লক্ষ্যে পুতিন ইরান সফরে গিয়েছিলেন গত ১৯ জুলাই। আসলে ইরানে এটা ছিল এক ত্রিদেশীয় সামিট। কারণ, তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী এরদোগানও একই সাথে একই দিনে ইরান সফরে আসাতে তিন সরকারপ্রধানের এক সামিট মিটিংও অনুষ্ঠিত হয়েছে সেখানে। কিন্তু কী ছিল এই সফরের উদ্দেশ্য বা মতিগতি বা আলোচ্যসূচিইবা কী কী ছিল- তা জানতে [তা বুঝতে বাংলাদেশে খুব সিরিয়াস ডেফিনেশন নয় বরং হালকাভাবে যাদের ‘ইসলামিস্ট আকাঙ্খা’ বলে বুঝা হয়, এমন] তরুণদের ভিতর আগ্রহ তৈরি হয়েছে। যেমন একজন লিখছে, “পুতিনের ইরান সফর এবং বাইডেন কেন সৌদিতে, এই দুটো বিষয় নিয়ে একটা লেখায় দেখতে চাই”।

এমনিতে কোন “আকাঙ্খাই” দোষের নয়, কেবল যদি খেয়াল রাখা থাকে যে, তা কতটা কল্পনার রঙের বা ইউটোপিয়াতে দেখা হয়েছে আর কতটা তা বাস্তবসম্মত। যেমন মুসলমান প্রধান দেশগুলোর সরকার একটা গ্লোবাল ইসলামিক স্বার্থের পক্ষে একত্রে  কাজ করবে – এই হল এমনই একটা আকাঙ্খা। এখন এই আকাঙ্খা তা কতটা বাস্তব আর কতটা কল্পনার রঙে দেখা হয়েছে তা কী দিয়ে মাপব? যেকোনো দেশের সরকারকে দেশের বৈষয়িক-অর্থনৈতিক স্বার্থ- এটাকেই সব বিবেচনার শীর্ষে রাখতেই হয়। এ দিকটাই ভারী থাকে; কারণ এগুলো মানুষের বেসিক চাহিদাসংশ্লিষ্ট। আর এর পরে এসে থাকে কোনো চিন্তা-আদর্শ অনুসরণ বা হেদায়েতের কথা।

প্রথমত, ইরানে ওই তিন সরকার প্রধানের সফর ছিল অনেক উদ্দেশ্য বা ইস্যুতে। তবে প্রত্যেকটা ইস্যুই আবার তিন পক্ষের সবার জন্য নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা ছিল দ্বিপক্ষীয়। যেমন তিনপক্ষীয় বড় বা একটাই প্রধান ইস্যু ছিল – সিরিয়া বা আসাদ সরকার প্রসঙ্গ বা বিবিসির ভাষায় “সিরিয়ায় সহিংসতা কমানোর” ইস্যু যেটাকে আরো একদম সুনির্দিষ্ট করে বললে, সিরিয়ান কুর্দি সশস্ত্র গ্রুপ ওয়াইপিজিকে [YPG] নিয়ে দুটো ভিন্ন মত এই তিন রাষ্ট্রের কথা বলা। এরদোগান চান এদের সামরিকভাবে হামলায় দমন-উতখাত করতে। কিন্তু রাশিয়া-ইরান চায় আলোচনায় সমাধান।

আসলে এরদোগানের জন্য যেকোনো কুর্দি ন্যাশনালিজমের বা কুর্দি-জাতিরাষ্ট্র চিন্তার দল তা সে ইরাকি কুর্দি কিংবা সিরিয়ান কুর্দি অথবা টার্কিশ কুর্দি যেই হোক, “এই রাজনীতি” তিনি ধ্বংস করে দিতে চান ফিজিক্যালি। কারণ সত্যি সত্যিই এই তিন দেশের কুর্দিদের নিয়ে একটা নতুন কুর্দি জাতিরাষ্ট্র করতে চাওয়া এর ব্যবহারিক মানে হল এই যে,  এটা ‘কুর্দি-জাতিরাষ্ট্রীয় রাজনীতি’। মানে এতে (ইরাক, সিরিয়া ও তুরস্ক) এই তিনটি দেশই ভেঙে যাওয়া যা যদি ঘটে তবে এই তিন দেশের কোনো শাসক সরকারই নিজ নিজ দেশের বাকি মানুষের কাছে মুখ দেখানোর লায়েক থাকবে না। যার সোজা মানে তারা আর ক্ষমতায় থাকতে পারবে না।

এ ছাড়া তিন দেশের কুর্দিদের জন্য তাদের নিয়ে  -একটা নয়া জাতিরাষ্ট্রই একমাত্র বা সব সমাধান – এ কথাও তো সত্যি নয়। কারণ তাতে “প্রতিটা কুর্দির রাজনৈতিক অধিকারের প্রসঙ্গটা”  তা সে তারা এখনকার যে রাষ্ট্রেরই বাসিন্দা হোক না কেন এতে, জাতি ধারণার নিচে সব চাপা পড়ে আড়ালে চলে যাবে, যেমন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটাই হয়েছে। অর্থাৎ জাতি-ধর্ম পরিচয় নির্বিশেষে প্রত্যেকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আইডেনটিটি নির্বিশেষে তারা সকলেই নাগরিক এবং সমান অধিকারের নাগরিক  – এভাবে আর দেখা হয় নাই। চাপা পড়ে গিয়েছে। বাঙালি জাতিরাষ্ট্রে ধারণাটা প্রবল হওয়াতে এর নিচে সবার নাগরিক অধিকার এবং সমান অধিকারের “সাম্য” প্রসঙ্গটা চাপা পরে গিয়েছে। সবমিলিয়ে ফলাফল এই যে বাংলাদেশ বলে রাষ্ট্র কায়েম হয়েছে ঠিকই কিন্তু নাগরিক অধিকার প্রশ্নে বা নাগরিক বৈষম্যহীনতার প্রসঙ্গের দিক থেকে রাষ্ট্র হয়ে গেছে খামোখা
তাই এক নয়া জাতিরাষ্ট্র কায়েম করার রাজনীতি এটা কোন সমাধানই নয়। বরং ইরাক, সিরিয়া ও তুরস্ক এই প্রতিটা রাষ্ট্রকেই নাগরিক অধিকারভিত্তিক রাষ্ট্র করে গড়ে তোলা আর জাতি নির্বিশেষে সেখানকার সবাই সমান অধিকারের নাগরিক – এই ভিত্তিতে তা বাস্তবে প্রতিষ্ঠা করার ভেতরেই আছে সব সমাধান। তবে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বার্নিং অবস্থায় আছেন এরদোগান। কারণ আমেরিকার অবস্থান কুর্দিদের পক্ষে। এটা এরদোগানের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার প্রশ্নই আসে না। কুর্দিদের অধিকার বা তাদের ভিকটিম হয়ে থাকার প্রতি সহানুভুতিশীল হওয়া কারো জন্যই অবশ্যই কোন দোষের নয়।  কিন্তু এই সুযোগে তাদের তিনটি রাষ্ট্র ভেঙে এক নয়া কুর্দি জাতিরাষ্ট্র গড়তে সমর্থন দেয়া অপরাধ।

আসলে রাশিয়া-ইরানকে এরদোগান বলছেন তোমাদের সাহায্য আমার লাগবে না। তুরস্ক একাই ওয়াইপিজিকে দমন করতে পারবে। তবে দ্বিতীয়ত, রাশিয়া-ইরানের মতে সফট লাইনে এদের বুঝানো বা পিঠে হাত বুলিয়ে কাজ হবে বলে এরদোগান মনে করেন না। তাহলে এবারের ইরান-আলোচনায় ফলাফল কী হল? ফলাফল এই যে, তবুও তিনপক্ষই অন্তত একমত যে, কুর্দি ইস্যুতে আমেরিকাকে দূরে রাখতে হবে।
ওদিকে ওই আলোচনায় রাশিয়া-ইরানের স্বার্থ ছিল সিরিয়াকে এক স্থিতিশীল রাষ্ট্র আর এর সব ভূখণ্ডই আসাদের নিয়ন্ত্রণে আছে তা দেখাতে চাওয়া। এ ছাড়া সিরিয়ায় বিভিন্ন সশস্ত্র ও বিচ্ছিন্নতাবাদী বা ইসলামী গ্রুপগুলোর তৎপরতা লোপ পেয়ে যাক যাতে সব কিছুর ওপর আসাদের নিয়ন্ত্রণ ফিরে আসে। তাই এই সুযোগে তুরস্ক প্রস্তাব রেখেছে যে, তুরস্ক-সিরিয়ান বর্ডারে, মাঝখানে একটা ৩০ কিলোমিটারের সেফ জোন বা নিরাপত্তা জোন তৈরি করা হোক। এটা তিনি চাইছেন মূলত যাতে দুই দেশের কুর্দিরা অবাধে যাতায়াত আদান-প্রদানে করে চলে ঘোট না পাকাতে পারে!

যখন আলোচনার বিষয় ড্রোনঃ
তেহরানে ড্রোন আলোচনার ইস্যু হলেও এটা ছিল কেবল দ্বিপক্ষীয়- মানে রাশিয়া আর ইরানের মধ্যে আলোচনার ইস্যু। এটা এরদোগানের জন্য আলোচনার ইস্যু নয়। কারণ তিনি আবার রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে উল্টো ইউক্রেনকে ড্রোন সরবরাহকারী। মানে ইউক্রেনের হাতে যে টার্কিশ ড্রোন ব্যবহৃত হচ্ছে তা হচ্ছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ও উপরে। তবে ইউক্রেনের হাতে থাকা সব ড্রোনই টার্কিশ নয়। বড় অংশই বরং আমেরিকার সরবরাহ করা। আর ওদিকে রাশিয়ার সব ড্রোনই ইরান থেকে নেয়া নয়। রাশিয়ার নিজস্বও আছে। যা হোক, এই ইরানিয়ান ড্রোন রাশিয়াকে সরবরাহ নিয়েই রাশিয়া-ইউক্রেন দ্বিপক্ষীয় আলাপ হয়েছে এবার।

ইউক্রেনের শস্য রফতানি ইস্যুঃ
এটাও আরেক দ্বিপক্ষীয় ইস্যু। তবে এবার তা রাশিয়া আর তুরস্কের মধ্যে। যদিও সেটাও আবার সরাসরি রাশিয়া আর তুরস্কের স্বার্থে নয়। কেন?  মূলত বিভিন্ন সময়ে ইউক্রেন-রাশিয়া এদের মধ্যে আপোষ আলোচনায় মধ্যস্থতা করেছে তুরস্ক, এমনকি কখনো এরদোগান নিজে উপস্থিত থেকেই তা ঘটিয়েছেন। তাই শস্য ইস্যু যেটা হল আসলে – যুদ্ধের কারণে, ইউক্রেন শস্য রফতানির বড় দেশ হওয়া সত্বেও এ পর্যন্ত ইউক্রেনের সব শস্য রফতানি বন্ধ করে রেখেছিল  নিজ সাইলো গুদামে, যা প্রায় ২২ মিলিয়ন টন। গ্লোবাল বাজারে খাদ্যশস্যের (গম) দাম আকাশচুম্বী হওয়ার অন্তত একটা কারণ এটাকেই মনে করা হয়। তাই জাতিসঙ্ঘের সেক্রেটারি জেনারেল (António Guterres ) আর এরদোগান – এরা দু’জন নিজে উপস্থিত থেকে রাশিয়া আর ইউক্রেনের মধ্যে শস্য রফতানিতে রাশিয়ান সহযোগিতা করবে – এমন এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল  [Ukraine, Russia sign grain export deal]। যদিও তা স্বাক্ষরের পরেই ইউক্রেনের ওডেসা বন্দরে এক বোমা পড়ায় রফতানি আশঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। তাই এরদোগান ইরান সফরের সময়ে এই সুযোগে পুতিনের সাথে কথা বলে রফতানি যেন ঠিকমত বাধাহীন চালু হতে পারে এর আশ্বাস নিয়েছেন পুতিনের কাছ থেকে।

বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্যে সফরে ইসরাইলের সাথে তাঁর অসৎ ঘনিষ্ঠতাঃ
গত ১৯৭৯ সালে খোমেনির ইরান বিপ্লবের সংঘটিত হবার পর থেকে আমেরিকা ইরানকে শুধু স্বীকৃতি দেয়নি তাই নয়, ইরানের বিরুদ্ধে নানান স্যাবোটাজ করে গেছে নিয়মিত। অথচ ইরান বিপ্লবের অপরাধ কী? অপরাধ হল এই যে, ১৯৫৩ সালে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট আইসেনহাওয়ারের অপরাধের বিরুদ্ধে উঠে দাড়িয়েছিল, বিপ্লব করেছিল। আইসেনহাওয়ার সিআইএ পাঠিয়েছিলেন; পপুলার ইরানি সরকারকে ফেলে দেওয়া, ইরানের সব তেলের খনি দখল আর এক পুতুল সরকার হিসেবে শাহ পাহলভিকে ক্ষমতায় বসানো ইত্যাদি যা যা অপরাধ ঘটিয়েছিলেন, এঘটনাগুলোর ২৬ বছর (১৯৫৩-৭৯) পরে এর পরিসমাপ্তি টানা এবং ইরানিদের নিজেদের জন্য নিজেদের দেশ ও সরকার কায়েম করা। এতাই ইরানের অপরাধ!!! এরপর থেকে আমেরিকার সাথে বিল্পবী বা খোমেনির ইরানের সাথে আমেরিকার কখনো ন্যূনতম সম্পর্ক বা স্বীকৃতি বিনিময় ঘটেনি। আমেরিকান ভুল নীতি-পলিসির কারণে  অন্যকিছু ঘটবার সুযোগও ছিল না। কিন্তু ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট ওবামা বিড়ালের গলায় এক ঘণ্টা বেঁধেছিলেন ২০১৫ সালে!

যদিও এই ওবামাই আইএস-এর উত্থানে সহায়তাকারী, পরে আইএসকে দিয়ে গাদ্দাফিকে হত্যাকারী, এরাই বেনগাজীতে আমেরিকান রাষ্ট্রদূতসহ সব আমেরিকান স্টাফের হত্যাকারী; শেষে সিরিয়ার আসাদেরও একই পরিণতি ঘটাতে সিরিয়াতে  গিয়েও তা ব্যর্থ-অসম্পূর্ণ থেকে যায়। কিন্তু সেই আইএস এরপর ইরাকে ফিরে গিয়ে নিজ নামে হাজির হয়ে গেলে, তাতে পাল্টা ইরাকের ক্ষমতা তাদের হাতে প্রায় দখলের উপক্রম হয়ে গেলে এবার ওবামা ভীষণ বিপদে পড়ে ধরা খেয়ে যান। কারণ, কথিত ওয়ার অন টেররে যেসব যুদ্ধক্ষেত্র বুশের আমেরিকা জন্ম দিয়েছিল, ২০১৪ সালেই ওবামা সেসব স্থান থেকে আমেরিকান সৈন্য তুলে ফেলেছেন। ইরাকেরসহ মেজরিটি সংখ্যক [মোট দশ হাজার রেখে বাকি সব ফেরত] আমেরিকান সৈন্য দেশে ফিরিয়ে এনেছিলেন। কারণ একটাই, সমাপ্তিহীন অন্তহীন যুদ্ধের ব্যয় বইবার  সক্ষমতায় আমেরিকা-রাষ্ট্রের অপারগতা, অযোগ্যতা!!

অথচ পরের বছরই ইরাকে আইএস হাজির হয়ে গেলে তাদের তাড়াতে গেলে তো আবার প্রয়োজনীয় সৈন্য আমেরিকা থেকে ফেরত আনতে হয়, যা বিরাট খরচের দায়ভার!!কিন্তু আমেরিকার ব্যয়-নির্বাহের মুরোদ নাই। অতএব উপায় না দেখে ওবামা এই প্রথম ইরানের সাথে আপসের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। ইরাক থেকে ইরান নিজ সামরিক শক্তি ব্যবহার করে আইএস মুক্ত করে দিবে। আর এতে বিনিময়ে আমেরিকা ইরানের উপর নিজের আগে থেকে দেয়া সব স্যাংশন প্রত্যাহার করে নিবে। আর ওদিকে কেবল ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা থাকবে যদিও তা দিয়ে অস্ত্র তৈরি না করে আইনি মাত্রায় আটকে রাখবে আর তা জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে নিরীক্ষিত হবে – এই শর্তে এক চুক্তি হয়েছিল। ইরানের সাথে ২০১৫ সাল থেকে যা কার্যকর চুক্তি তার নাম ‘জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন’ [Joint Comprehensive Plan of Action, JCPOA] ; যাকে অনেকে ইরানের সাথে পি৫+১ চুক্তিও বলে থাকে। কারণ এটা ছিল জাতিসঙ্ঘসহ তার নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য ও সাথে জার্মানিকেও নিয়ে করা। তাই (পি৫+১) বলা।

কিন্তু পরবর্তিতে  ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে সব উল্টে দিয়েছিলেন। ২০১৭ সালেও ‘ইরান যথাযথভাবে চুক্তি মেনে চলছে’ বলে ট্রাম্প প্রশাসন রিপোর্ট দেয়া সত্ত্বেও ২০১৮ সালের ৮ মে এই চুক্তি থেকে “আমেরিকা নিজেকে প্রত্যাহার করে নিচ্ছে” বলে ট্রাম্প ঘোষণা দেন এবং পুরানা অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ আবার ফিরিয়ে এনেছিলেন। মূলত ইসরাইলকে ফেভার বা খুশি করতেই তিনি এসব করেছিলেন।

যদিও সে সময়ে ডেমোক্র্যাটরা এমনকি ইইউও ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা ও সমালোচনা করেছিল। অথচ এখন ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট বাইডেন সেই ট্রাম্পের পথ ধরেছেন। তিনি উসিলা খুঁজছেন কিভাবে পুরানা (JCPOA) বা ‘ইরান ডিল’ চুক্তি ফিরে তাকে না করতে হয়। সম্প্রতি সিনেটে ডেমোক্র্যাট-রিপাবলিকান মিলে আরো শর্ত চাপিয়ে একটা বিল পাস করিয়েছে যাতে সহজেই নয়া কোনো “ইরান ডিল” স্বাক্ষরিত না হয়। এটা ছিল এক রিপাবলিকান প্রস্তাব অথচ বাইডেনের দল তাতে সমর্থন দিয়েছে। এ ছাড়া বিশেষত এবার জুলাইয়ে বাইডেনের ইসরাইল সফর ও ঘনিষ্ঠতা এই ইঙ্গিতই দিচ্ছে।

এসব মিলিয়ে পুতিনের ইরান সফর নিয়ে করা বিবিসির রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, “উপসাগরীয় দেশগুলোর সাথে ইসরাইলের মাখামাখি যেভাবে বাড়ছে এবং তারা ইরানের বিরুদ্ধে জোট বাঁধছে, সেটা ইরানকে উদ্বিগ্ন করছে। তাদের আশঙ্কা, এটি মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য তাদের বিপক্ষে নিয়ে যেতে পারে। কাজেই ইরান চেষ্টা করছে, রাশিয়ার সহায়তায় পাল্টা কিছু করা যায় কিনা”।

এখন একটি সাম-আপ যদি করি তাহলে দেখব, প্রতিটা রাষ্ট্রই বিভিন্ন ইস্যুতে এনগেজ হয়ে থাকলেও; একটা রাষ্ট্র অন্য আরেক রাষ্ট্রের থেকে ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থ নিয়ে বসে আছে। এগুলোকে একই জায়গায় আনা খুবই কঠিন, কখনো প্রায় অসম্ভব। এর ভেতর আবার দুটো মুসলমান প্রধান দেশ হলেও বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের স্বার্থ-অবস্থানে বিরাট ভিন্নতা দেখা যাবেই। এটাই স্বাভাবিক। যেমন এখানে ইরান ও তুরস্ক উপরে যে দুটো ইস্যুতে আলাপ করেছি, দেখা যাচ্ছে তারা একই অবস্থান নিতে পারছে না। আসলে কার্যত দেশ দুটো হলেই আর তাদের এক অবস্থান নেয়াটাও সহজ কাজ নয়। এই বাস্তব দিকটা মনে রেখে আমাদের চলতে হবে!

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

 

[এই লেখাটা  দৈনিক  “নয়াদিগন্ত” পত্রিকার  ৩০ জুলাই  ২০২২ ওয়েবে আর পরদিন প্রিন্টে   পুতিন, এরদোগানের ইরান সফর এই শিরোনামে  ছাপা হয়েছিল।   ঐ ছাপা হওয়া লেখাগুলোকে আমার লেখার ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ বলা যায়।  আর আমার এই নিজস্ব সাইটের লেখাটাকে সেকেন্ড ভার্সান হিসাবে এবং  থিতু ভাষ্য বলে পাঠক গণ্য করতে পারেন।  আসলে পরবর্তিতে ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ লেখাটাকেই এখানে আরও অনেক নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে ও নতুন শিরোনামে এখানে আজ ছাপা হল।]

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s